#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৩১
#মৌরিন_আহমেদ
পরদিন বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো বর্ষণের। চোখ খুলেই ঘরের ভেতর রোদের উত্তাপটা টের পেল! জানালা গুলো বন্ধ, পর্দা দিয়ে ঢাকা অথচ তারপরও সূর্যের সোনালী কিরণ ঘরটাকে হলুদ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে! ভাবটা এমন যে জানালাটা খুললেই যেন রোদ এসে উপচে পরবে ঘরের ভেতর!
বর্ষণ হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে। উঠে গিয়ে জানালা খোলার জন্য এগোয়। একে একে জানালাগুলো খুলে ফেলে। তারপর পর্দা সরাতে গিয়েই হঠাৎ একটা কাগজকে চোখে পড়ে। বাতাসের তোড়ে উড়ে গিয়ে সেটা ওর পায়ের কাছে এসে পড়ে। কাগজটা দেখেই ভাঁজ পড়ে কপালে। মাথা হেলিয়ে হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় সেটা। ভ্রূ জোড়া কুঁচকে রেখেই ভাঁজ খুলতে থাকে। ছাপার অক্ষরে লেখা ক্ষুদ্র চিরকুট। মানে প্রেরকের হাতের লেখা না দেখানোর প্রয়াস! যাই হোক, চিঠি দিয়েছে এই বেশি!
” তোমাকে ধ্রুব বলে সম্বোধন করবো না বর্ষণ? কোনটা বেশি পারফেক্ট? বুঝতে পারছি না। সে যাই হোক, আসল কথায় আসি। আগেরবার আমার ভুলের কারণে সব ধরিয়ে দিতে পেরেছ বলে নিজেকে খুব বড় ভাবছো না কি, অফিসার? বেশি উড়ো না ঝরে পড়ে যাবে! আমার ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে যে ভুলটা তুমি করেছ তার জন্য তোমাকে পস্তাতেই হবে। পরপর দু’ বার আমার ছুরির কবল থেকে তুমি বেঁচে গেছ, বিষ দিয়েও মারতে পারি নি, এবার কিন্তু মিস হবে না! শেষ হুল এবার আমিই ফুটাবো!”
চিঠিটা পড়েই ঠোঁটের কোণে অদ্ভুদ এক তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো ধ্রুবের। কে ও? ধ্রুব না বর্ষণ? দু’টোই। বর্ষণ রাইয়ান ধ্রুব। র ্যাবের বিশেষ ক্রাইম ইনভেস্টিগেটর। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। তারই হাত ধরে বিজনেস ম্যান ইফতেখার চৌধুরীর অর্ধেক বিজনেস ডোবায় ডুবেছে! ধরা পড়েছে সাদা মুখোশের আড়ালে কালো, কুৎসিত চেহারা! কালো বাজারির ব্যবসা ধরা পড়েছে র ্যাবের হাতে!
চিঠিটা কার পক্ষ থেকে এসেছে সেটা বেশ ভালোই জানে সে। ইফতেখার চৌধুরীই এর প্রেরক। কারণ তার ছেলে ইফতিকেই ইয়াবা সমেত ধরা খাইয়েছে ধ্রুব। আর গত দু’ বার ওর ওপর করা হামলাও যে ওনারই সাজানো তাও বেশ বুঝতে পারছে! সে যাই হোক। ওসব রাস্তার কু’ত্তা অনেক ঘেউ ঘেউ করে, তাতে কারো কাজ থেমে থাকে না। কাজটা করতেই হয়। না হয় ওসব বেওয়ারিশ কু’ত্তা’র কামড়ে সাধারণ জনতাই ভোগে বেশি!
__________________________
আজ রাতেই কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে বাসে চড়বেন লেবু মামারা। সে উদ্দেশ্যেই নিজের লাগেজ গুছিয়ে নিচ্ছেন লতা। কাপড়-চোপড় সব তুলে লাগেজের চেইন লাগালেন। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে যাবেন এমন সময়েই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো।
ওয়াসরুমে যাওয়া ছেড়ে তড়িঘড়ি করে ফোনের কাছে এলেন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল তার শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের গলা,
– হ্যালো, লতা! কোথায় তুমি?
– বা.. বাংলাদেশে।
– বাংলাদেশে যে আছো সেটা আমিও জানি। কিন্তু কোথায়? কানিজের কাছে শুনলাম খাগড়াছড়ি এসেছ…
– জ্বি, আমি খাগড়াছড়িতেই আছি। একটু ঘোরাঘুরির জন্য এসেছিলাম। চারপাশ দেখতাম…
– ও দেশে আবার দেখার মতো কী আছে? যতসব ময়লা-আবর্জনার দেশ!..
কিছুটা তাচ্ছিল্যের গলায় বলে উঠতেই প্রতিবাদ করে উঠলেন লতা। তবে উগ্র ভঙ্গিতে নয় যথেষ্ট স্বাভাবিক এবং শান্ত গলায়,
– ভুল বললে, ভাইয়া। এটা ময়লা-আবর্জনার দেশ নয়! অনেক সুন্দর একটা…
– চুপ কর! ও দেশ আমাকে চেনাতে এসো না!
তার কথা শেষ করার আগেই প্রচণ্ড রেগে ধমক বসান উনি। তার ধমকে কী বলবে ঠিক বুঝতে পারেন না লতা। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললেন,
– আমি তোমাকে বাংলাদেশ চেনাতে আসি নি, ভাইয়া। শুধু সত্যিটা বলতে চেয়েছি….
– তুমি কি এখন নিজেকে খুব সত্যবাদী নারী ভাবতে শুরু করেছ? যে বড় ভাইয়ের মুখের উপর দিয়ে কথা বলার সাহস দেখাও?
– আমি কোনো স্পর্ধা বা দুঃসাহস দেখাচ্ছি না।.. আমি.. আমি শুধু..
– just shut up, lota! মুখে মুখে তর্ক করবে না! তুমি জানো আমি এটা সহ্য করতে পারি না।…
প্রতি উত্তরে আর কিছু বলার সুযোগ পান না লতা। চুপ করে থাকেন। কেন না কিছু বললেই হয়ে যাবে বেয়াদবি, তর্কের শামিল। যেটা তিনি করতে চাইছেন না। কিছুক্ষণ পর আবারও শোনা যায় তার বড় ভাইয়ের গলা। তিনি নিজের শঠতা বজায় রেখেই বললেন,
– জেদ করে বাংলাদেশে গেছ, ঘুরেছ, ভালো কথা। কিছু বলি নি। তোমার কথা মেনেছি। ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েছি।.. এখন সময় হয়েছে তোমার জায়গায় ফেরার, তোমার দেশে ফেরার।.. আমি চাই তুমি খুব দ্রুতই usa ফিরে যাবে। ওটা তোমার দেশ, ওখানেই তোমাকে মানায়…
– আমেরিকা আমার দেশ নয়, ভাইয়া। আমার দেশ বাংলাদশ।…
– লতা! বড্ডো বেশি কথা বলছো তুমি। আমি কিন্তু সহ্য করতে পারছি না!
বারংবার ধমক খেয়ে চুপসে যান লতা। প্রতিবাদ গুলো গলার কাছে এ দলা পাকিয়ে যায়। অথচ মুখে আর কিছু বলার সুযোগ পান না। তীব্র ক্ষোভটা বুকের ভেতর চাপিয়েই নতি স্বীকার করেন। বিনম্র গলার বললেন,
– i’m sorry. মাফ করে দাও!
– it’s ok. তবে নেক্সট টাইম এরকম ভুল করবে না!
আরেকবার শাসিয়ে ওঠেন ভ্রাতা। কিছুক্ষণ পর ধাতস্ত হয়ে ধীর গলায় বললেন,
– আমি কিন্তু তোমার সাথে রাগারাগি করার জন্য ফোন করি নি, লতা। তুমি অহেতুক কথা পেঁচিয়ে রাগটা তুললে।.. যাই হোক। আমি লনার সাথে কথা বলেছি। লনা আর ওর হাসবেন্ড রেজাউল মিলে একটা ভালো ছেলে দেখেছে। ছেলে টেক্সাসেরই (ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস) প্রফেসর। রেজাউলের কলিগ। দেখতে-শুনতে ভালো। ছবিও পাঠিয়েছে আমাকে…ভালোই। আমার আর তোমার ভাবীর পছন্দ হয়েছে। আমরা চাইছি….
– তোমরা কথাবার্তা আগাতে চাও? কিন্তু আমি তো বলেছি আমি এখন বিয়ে করবো না। আমি ট্রাভেলিং করবো। দেশে- দেশে…
– তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছো, লতা। বোকার স্বর্গ কী সেটা জানো তো? ইংরেজিতে যাকে বলে fool’s paradise!.. দেশে-বিদেশে ঘুরে ব্যয় করার মতো সময় তোমার নেই। লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি করো নি। ক্যারিয়ার নিয়ে তোমার চিন্তা নেই।.. এমন ছেলেমানুষী আমি অনেক সহ্য করেছি, আর না। আমি তোমাকে শেষবারের মতো বলছি, আর একটাও বাড়তি ঝামেলা বা অজুহাত দেখাবে না। কাল সকালেই বাড়ি ফিরে যাবে। কানিজকে নিয়ে কাল পরশুর মধ্যেই usa এর প্লেনে উঠবে। কানিজ না গেলে থাক। কিন্তু তুমি আসবেই! that’s final!
– কিন্তু ভাইয়া…
– no more words! see you!
বলেই লতাকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। ফোনটা কট করে কেটে দিলেন। লতা হতভম্ব চাহনিতে চেয়ে রইলেন স্ক্রিনের দিকে। তবে তার সময়ও ফুরিয়ে এলো? সময় এলো আবার খাঁচায় বন্দি হওয়ার? তবে কেন এই সাময়িক মুক্তি মিলেছিল? কেন এই সাময়িক আনন্দ তার জীবনে এসে এলোমেলো করে দিলো? মুক্তির আনন্দ যে এতো প্রখর তা তো আগে জানতেন না তিনি! জানলে নিশ্চয় এ অনাকাঙ্খিত জেদ দেখিয়ে তিনি বাংলাদেশে পা রাখতেন না। আর ক্ষণিকের স্মৃতি নিয়ে তাকে এভাবে ফিরেও যেতে হতো না!
– একি বিদেশিনী লতা, আপনি এখনো রেডি হন নি?
ক্ষণকালের জন্য যে কল্পনা রাজ্যে উনি প্রবেশ করেছিলেন তা থেকে তাকে বের করে আনলেন লেবু মামা। অন্যান্য দিন হলে ওনাকে “বিদেশিনী” বলে সম্বোধন করলে নিশ্চয় একপ্রস্থ ঝগড়া করতেন কিন্তু আজ মামাকে কিচ্ছুটি বললেন না। কেমন নিষ্প্রভ চাহনিতে মামার দিকে তাকালেন। তার পরনে ফুল তোলা হাওয়াই শার্ট আর মেটে রঙের গ্যাবাডিন প্যান্ট। মাথায় স্টাইলিশ হ্যাট, তার উপরে বিশেষ কায়দায় সানগ্লাস রাখা। এই রাতের বেলায় লোকটা সানগ্লাস কেন লাগিয়েছে?
স্বাভাবিক সময় হলে নিশ্চয় এ প্রশ্নটাও করা হতো কিন্তু আজ বিষয়টা চোখে লাগলেও কিছু বললেন না। কেমন উপেক্ষা করে গেলেন। তার এমন চাহনি দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না লেবু মামা। বললেন,
– কী হলো? কথা বলছেন না যে?
আবারও একবার ওনার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন লতা। এখনও দৃষ্টি তার নিষ্প্রভ। খুব ধীর এবং শান্ত ভঙ্গিতে মুখ নাড়ালেন। যেন কিছু একটা বলছেন। কিন্তু কিছু শোনা গেল না। মামা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন তার ভাব বোঝার জন্য। খানিকবাদে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
– আ.. আমি যাচ্ছি না, লুটফর সাহেব!
– সে কী! কেন?
হঠাৎ বোকার মতো করে তাকালেন। যেন বুঝতে পারছেন না লতা রসিকতা করছে কী না। লতা আগের মতো কণ্ঠেই বললেন,
– ভাইয়া কল করেছিল, আজই ফিরে যেতে বলেছে। আপনি কাউন্টারে খোঁজ নিন, লুটফর সাহেব। আমি আজই ফিরে যাবো!
কথাটা বলেই কেমন চোখে তাকালেন। মামা সামান্যটুকুও নড়লেন না। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন বিদেশিনী লতার দিকে। মনের ভেতর দুশ্চিন্তারা দলা পাকিয়ে উঠলো। বাড়ি যেতে বলেছে? কেন? ওদিককার সব খবর ভালো তো? না কী কারও কিছু…
আঁতকে উঠে বললেন,
– হঠাৎ ফিরে যেতে চান, কী হয়েছে?.. কোনো দুঃসংবাদ?
– দুঃ সংবাদও না আবার সুসংবাদও না।.. আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে..
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিয়েই চুপ করে গেলেন উনি। মামা চকিত দৃষ্টিতে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যেই তার পৃথিবী থমকে গেছে! লতাকে নিয়ে তার সমস্ত স্বপ্নই যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়েছে! মস্কিস্ক হ্যাং খেয়ে বোবার দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু হয় তো বলতে চাইলেন কিন্তু বলতে পারলেন না!
#চলবে——-
[ ধ্রুব না বর্ষণ? এবার কনফিউশন ক্লিয়ার.. ]