মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_৩৪

0
197

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৩৪
#মৌরিন_আহমেদ

ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন বারোটা। চৌধুরী বাড়ি তখন নিস্তব্ধ। সন্ধ্যার দিকে বেশ খানিকক্ষণ মদ্যপান করে নিজের শোবার ঘরে এখন ঘুমোচ্ছেন ইফতেখার চৌধুরী। বাড়ির চাকর-বাকরেরাও যে যার মতো ঘুম! পরিবেশ যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন তখন হঠাৎ সদর দরজায় কার যেন করাঘাত! বেশ ক’বার শব্দ হলো, কলবেল বাজলো, ভেতর থেকে সাড়া দিল না কেউ!

শেষমেষ বাধ্য হয়েই দরজা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন আগন্তুক দল। রাইফেলের বাট দিয়ে কয়েকটা বারি দিতেই হা হয়ে খুলে গেল দরজা। ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটলো কালো পোশাকধারীদের। র্্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের এক দল সৈন্য। বুট জুতার খটখট শব্দ তুলে ড্রয়িং রুমে এসে দাড়ালেন তারা। ক্যাপ্টেন জোর গলায় ডাকলেন,

– ইফতেখার চৌধুরী, আপনি কি বাসায় আসেন? আমরা একটা বিশেষ কাজে এসেছি, আপনি একটু নিচে নামবেন কী?.. মি. ইফতেখার চৌধুরী?

ডাকাডাকির তুমুল কলোরবে উঠে আসে চাকর-বাকরের দল। র্্যাবের লোক দেখে একদল ভীত হয়ে দাড়িয়ে থাকে এককোণে। মুখে রা নেই। অন্যদল আবার ছুটে যায় মনিবের ঘরে তড়িঘড়ি করে ডাকতে থাকে বেঘোরে ঘুমোনো চৌধুরী সাহেবকে। ডাকাত পড়ার মতো ‘হা রে রে রে রে!’ গোলযোগ শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠলেন উনি। লাফ দিয়ে উঠে চোখ কচলে ঘটনা শুনলেন। র্্যাব এসেছে? এই মাঝরাতে? কেন? কিছুটা চিন্তা, কিছুটা দর্প নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন।

– কী ব্যাপার?

– আপনার নামে ওয়ারেন্ট এসেছে.. ইউ আর ইনভলভড ইন ড্রাগ ডিলিং.. অলরেডি আপনার বাড়ি তালাশ হয়ে গেছে। আমরা বিয়ার আর ওয়াইনের বেশ কিছু ক্যান পেয়েছি। ইভেন এলএসিও আছে… মাদক দ্রব্য আইন অনুযায়ী আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি..

– এসব কি বলছেন আপনি?.. আমার বাড়িতে…

চিল্লাচিল্লি করার চেষ্টা চালান চৌধুরী। ভয় দেখান কিন্তু লাভ হয় না। বেশ রুঢ় আচরণ করেই হাতে হ্যান্ড কাপ লাগিয়ে দেয়া হয় ওনার। মাঝরাতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় হেড কোয়ার্টারে।
______________________

সকালের বাসে ঢাকা যাওয়ার জন্য রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে প্রদোষ। কাল বিকেলে ফিরে যাবার মতো কোনো বাসই ধরতে পারে নি। অগত্যা থেকে যেতে হয়েছে।

সকালে ও যখন বেরোল তখন সাথে সাথে বর্ষণকেও বেরোতে দেখা গেল। ওর হাতে লাগেজ দেখে অবাক হয়ে শুধোলো,

– তুই আবার যাচ্ছিস কই? কাল না বললি যাবি না?.. আজ আবার…

– না জেনে এতো ফট ফট করিস কেন, বল্ তো? আমি কখন বললাম ঢাকা ফিরছি?..

বিরক্ত কণ্ঠে জবাব দেয় বর্ষণ। ও তাতে আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

– তাহলে যে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ বেরোচ্ছিস?.. যাচ্ছিস কোথায়?

– অন্য রিসোর্ট বুক করে ফেলেছি, সেখানে যাবো।

– কেন? এখানে কি হলো?

– এমন হাঁটুর নিচে বুদ্ধি নিয়ে চাকরি করিস ক্যামনে? শা*লা আহাম্মক!.. অপারেশনের পর এই রিসোর্টে থেকে যাওয়ার মানে বুঝিস? সাক্ষাৎ মৃত্যু!.. এরই মধ্যে দু’ দু’ বার অ্যাটাক হয়েছিল, খেয়ালে আছে? না খাওয়ার ধান্ধায় সেটাও গুলিয়ে খেয়েছিস?

ধমক খেয়ে চুপসে যায় প্রদোষ। এরপরে একই রিসোর্টে থাকা আসলেই বিপজ্জনক! এবং সবথেকে ভালো হয় সোজা ঢাকায় ফিরে যাওয়া। ওখানে ওরা নিরাপদ, ওদের ঠিকানা কেউই জানে না। তাই ভয়েই ভয়েই বললো,

– তাহলে কোন রিসোর্টে উঠবি?

– উহুম সম্ভব না! তোকে বলা যাবে না।…

বলেই দুষ্টু হাসে বর্ষণ। ওর হাসির কারণটা ঠিক ধরতে পারলো না প্রদোষ। তবে ওকে আর ঘাটালও না। ছেলেটা এমনই রহস্যময়। রহস্যের জালে ঘেরা তার জীবনের প্রতিটাঅধ্যায়। সৌজন্যতায় মুচকি হেসে বললো,

– ঠিক আছে বলিস না।.. ডুব মেরে থাকার ইচ্ছে থাক। কিন্তু দরকারের সময় তোকে খুজবো কোথায়?

– ক্যান ফোন দিবি।…

– ফোন? কিন্তু সেদিন যে পাহাড় থেকে ওটা পড়ে গেল, নিউ সিম তুলেছিস?…

এবারের কথায় কী যেন ভাবতে শুরু করলো বর্ষণ। এমনিতেই ওর ওই ফোন নামক বস্তুটাকে অসহ্য লাগে, তারমধ্যে নতুন ফোন, নতুন সিম তোলা- যত্তসব আজারি ঝামেলা! বিরক্ত হয়ে বললো,

– মনেই তো ছিল না, তুলবো কখন?.. যাক, সে গেছে গেছে! ওসব ফোন আমার লাগে না। প্রজেক্ট শেষ, ফোনের দরকারও শেষ।…

– কিন্তু তোর সাথে যোগাযোগ?

অসহায় গলায় প্রশ্ন করলো প্রদোষ। হঠাৎ করেই ধমকে উঠলো বর্ষণ,

– ওই আমি কী তোর প্রেমিকা লাগি যে ঘনঘন আমার খোঁজ নেয়া লাগবে?.. আর তুই না ইনভেস্টিগেটর? প্রয়োজনে খুঁজে নিতে পারবি না?

আবারও ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় প্রদোষ। এবার বেশ বুঝতে পারছে, ধ্রুব কেন ওকে রিসোর্টের নামটা বলছে না! শা*লা বজ্জাতের বজ্জাত, ইচ্ছে করেই কোথাও একটায় গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকবে! তারপর ওকে খুঁজতে গিয়ে নিজে হয়রান হয়ে পড়বে প্রদোষ! উফফ্! ব্যাটার শরীরের প্রতি গিটে গিটে কুবুদ্ধি যেন গিজগিজ করছে! সবসময় তালে থাকে ওকে প্যাঁচে ফেলার। রাগ দেখিয়ে বললো,

– থাক তুই!.. এই আমি চললাম!..

– ok, bye!

একটুও পিছু ডাকলো না বর্ষণ। উল্টো সানন্দে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো! তাতে মনঃক্ষুন্ন হয় ওর। চোখ গরম করে ওর দিকে একপলক তাকায়। প্রতি উত্তরে বর্ষণ কে অমায়িক হাসি হাসতে দেখা যায়। রাগে গা যেন জ্বলে উঠলো ওর। খিটমিট করতে করতে দ্রুত পায়ে হেঁটে রিসোর্ট এরিয়া থেকে বেরিয়ে আসে।
_______________________________

জিডি করে থানা থেকে বেরিয়ে এলো অনন্যা-কানিজ। লেবু মামা আর লতা ফুপিন যে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেলেন তারই জন্য এ জেনারেল ডায়েরি। এতে বিশেষ কোনো লাভ হবে কী না তা অবশ্য জানা নেই ওদের। কারণ ঘটনার পুরো বিবরণ না শুনেই ওসি সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন,

– “আপনাদের যা বলার তা এই ডায়েরীতে লিখে যান। বাকিটা আমরা দেখে নেব!”

ব্যস! হয়ে গেল। বাড়তি একটা কথাও বলার সুযোগ দিলেন না। ডায়েরি লিখে নিয়েও গম্ভীর ধ্বনিতেই হাত দেখিয়ে বললেন,

– “এবার আপনারা আসতে পারেন!”

স্থানীয় পুলিশের এই ব্যবহার দেখেই ওরা বুঝে গেছে ওদের দৌড় কদ্দুর! ভাবখানা এমন যে ওরা মহাব্যস্ত! কাজের কাজ করেই সময় পাচ্ছেন না সেখানে দুজন লোক হারিয়ে গেছেন না নিখোঁজ হয়ে গেছেন সেটা বের করবে কী ভাবে? এদের দিয়ে কিচ্ছুটি হবে না। এরা শুধু খায়-দায় আর নাকে সরিষার তেল ঢেলে ঘুমায়! অকর্মার দল সব!

– এবার তাহলে কি করবো আমরা?

হাঁটতে হাঁটতেই প্রশ্ন করে কানিজ। অনন্যা মাথা নিচু করে ওর পাশাপাশিই হাঁটছে। সেভাবে থেকেই মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়,

– জানি না। মামু যে কেন এমন করছে!.. কেন যে এভাবে হারিয়ে গেল!.. হারালো তো হারালো ফুপিনকে নিয়েই হারালো!.. একলা হারালে কী ক্ষতি হতো?

– তার মানে কী অনু? লেবু মামা একা হারালে তুই তাকে খুঁজতে যেতি না?

অবাক হয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে কানিজ। তাতে ও কিছুটা থতমত খেয়ে বললো,

– তা হবে কেন? উনি আমার একমাত্র মায়ের একমাত্র ছোট ভাই। আমার একমাত্র ছোট মামা। আমি তাকে খুঁজবো না কেন?.. কিন্ত কথা হচ্ছে, উনি যদি একলা হারাতেন তখন তো কারও কোনো দায় ছিল না। খোঁজার তাড়াও ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা উনি এদেশী লোক হারিয়ে গেলে যেখানেই যাক, অকূল পাথারে পড়বে না! লোকের ভাষা বুঝবে, জায়গার নাম শুনবে.. আর আমায় খবর দিয়ে দিবে।.. কিন্তু ফূপিন এসেই তো জটলাটা পাকালো। তোর হিটলার বাপতো আবার মার্শাল ল জারি করেছে.. সাতদিনের মধ্যে ইউএসএ ফেরার। এই সাতদিনে ওদের কোথায় খুঁজবো বল্ তো?

এবারে কথার মর্মার্থ বেশ বোঝা গেল। করুণ স্বরে বললো,

– কিন্তু ফুপনকে না পেলে বাবা যে আমাকে চিবিয়ে খাবে! তার নাকী বিয়েও ঠিক করে ফেলেছে, এখন তার আগেই যদি উনি এখানে এসে হারিয়ে যান তো?.. ওনাকে দেশে ফেরার কিছুতেই পারমিশন দেন নি বাবা। নেহাতই জেদাজেদি করে এসেছে! আর আমি আছি জন্য ছেড়েছে… এখন যদি…

বাকি কথা শেষ না করেই একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। প্রতি উত্তরে কথা বলে না অনন্যাও। কিছুটা সময় নিরবেই পেরিয়ে যায়। হঠাৎ কথা বলে ওঠে কানিজ। হামেশার মতো এবারও বুদ্ধী বের করে খাশা! লাফিয়ে উঠে বললো,

– আচ্ছা, আমরা আঙ্কেলকে বলে কেন দেখছি না? শত হোক, ওনার শালা হারিয়েছে উনি খুঁজবেন না? আর উনি না হয় নাই করুক। কিন্তু আমরা যেন ওনাকে খুঁজে পাই সে ব্যবস্থাও তো করে দিতে পারবেন? বড় কোম্পানিতে জব করেন, ওনার চেনা-জানা কতো লোক আছে না? ভালো একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর এর সন্ধান তো উনি দিতেই পারেন!

এতক্ষণ ওর কথা খুব মনোযোগ দিয়েই শুনছিল অনন্যা। কথা শেষ হতেই বিরক্তিতে ‘ হাহ্ ‘ উচ্চারণ করে বললো,

– আমার বাবাকে আমি চিনি না? উনি হচ্ছেন একটা রোবট মানব।.. টাকা কামাই করার মেশিন।.. জগতের মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা কোন কিছুতেই যার ছিটে ফোঁটা আগ্রহ নেই! না হলে, গত পাঁচ দিন ধরে তার শালক নিখোঁজ, তার বৌ কেঁদে-কেটে সাগর বানাচ্ছে আর তার কী না বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই? এ কেমন মানুষ? তুই বল্?..

– তাও তো তোর বাবা! খোঁজ নেয় না তবুও রোজ দেখা হয়। হুকুম করেন না, খাঁচায় বন্দীও করতে চান না। তুই তোর মতো স্বাধীন। কিন্তু আমাকে দেখ.. বাবা-মা দেশে থাকেন না সারাবছর বিদেশে, তবুও হুকুম ঠিকই ফলাচ্ছে।…

একটা ব্যথিত দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিড়ে! অনুও হতাশ হয়। অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো,

– কখনও আপন গণ্ডি থেকে বেরোই নি বলেই হয় তো স্বাধীন! বেরোলে হয় তো.. স্বাধীনতার এ ক্ষুদ্র সাধটুকুও উপভোগ করতে পারতাম না!

এরপর আর কোনো কথা বলে না কেউই। চুপচাপ বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। মাথায় এখন বিশাল দায়িত্বের ভার ওদের! জ্বলজ্যান্ত দু’ দু’টো মানুষ হারিয়ে গেল আর ওরা কিছুই করতে পারলো না?

– আচ্ছা, তারচেয়ে আমরা নিজেরাই কেন ওখানে যাচ্ছি না, বল্ তো?..

কানিজের প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অনন্যা। ও বুঝিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললো,

– মানে, মামুরা খাগড়াছড়ি গিয়ে নিখোঁজ হলেন, পুলিশকে ইনফর্ম করলাম, লাভ হবে বলে তো মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমরাই গিয়ে যদি সরজমিনে দেখে আসি?.. যে রিসোর্ট টায় উঠেছিল তাতে খোঁজ নেই.. তাহলে?

– তাতে লাভ হবে বলে তোর মনে হয়?

– কেন হবে না? অ্যাটলিস্ট কিছু না হোক, ওরা যে রিসোর্ট টায় গিয়ে উঠেছিল সেখানে গিয়ে খোঁজ তো নিতে পারবো? ওখানে কিছু হয়েছে কী না…

বুদ্ধিটা বেশ মনোপুত হলো অনন্যার। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে খানিকটা উচ্ছাস নিয়ে বললো,

– তারমানে ওখানে গেলে আমরা কিছু না কিছু অবশ্যই জানতে পারবো?

– তাই তো মনে হচ্ছে…

– বেশ! তবে তাই সই!.. চল্, বেরিয়ে পড়ি…

– সে ঠিক আছে… কিন্তু..

– কিন্তু আবার কী?

– আরেকবার আঙ্কেলের সাথে কথা বললে হতো না?. মানছি আন্টি বলেছে, লাভ হয় নি। কিন্তু তুই তো একবার বলে দেখতেই পারিস.. একজন ভালো ইনভেস্টিগেটরের সাথে কন্ট্যাক্ট করলে বেশি লাভ হতো না?

– উফফ্!.. আচ্ছা যা, চেষ্টা করবো। তবে লাভ হবে না, শিওর থাক!

শ্রাগ জানায় অনন্যা। দুজনেই বাড়ি ফিরে আসে।

#চলবে—— কী?

[ প্রথমেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আসলে আমি খুবই ব্যস্ত ছিলাম, তাই গল্প দিতে পারি নি।💔 বর্তমানে প্রচুর প্রেশারের মধ্যে আছি, তাই নিয়মিত গল্প দিতে নাও পারি। সেজন্য অগ্রীম দুঃখিত।💔😔 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here