#মরুর_বুকে_বৃষ্টি💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩৭
★বিহান আয়াতকে নিয়ে ধানমন্ডির এক বাসার সামনে এসে গাড়ি থামাল। তখন ফ্ল্যাটে আরও কিছুসময় থেকে বিহান আয়াতকে নিয়ে এখানে এসেছে। আয়াত বাসাটা দেখে বললো।
–এটা কার বাসা? এই বাসাও আপনি কিনেছেন নাকি?
বিহান মুচকি হেসে বললো।
–তোমার হবু জামায়ের এতো টেহা নাইক্যা। এইডা আমার বাছা না।
–তাহলে?
–ছবকিছু কি এইহানেই হুনবা? আগে চলো গেলেই দেখতে পাইবা।
আয়াত মুচকি হেসে গাড়ী থেকে নামলো। বিহান গাড়ি লক করে আয়াতকে নিয়ে বাসার দরজায় এসে বেল বাজালো। একটু পরে একজন বয়স্ক লোক এসে দরজা খুলে দিল। লোকটি বিহানকে দেখে খুশী হয়ে বললেন।
–আরে বিহান বাবা তুমি এসেছ? এসো এসো ভেতরে এসো। আবিদা তোমাকে দেখে খুশী হয়ে যাবে।
লোকটি বিহান আর আয়াতেকে সানন্দে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালেন।
আয়াত কিছুই বুঝতে পারছে না। কে এই লোক? বিহানকে দেখে এতো খুশীই বা হচ্ছে কেন?
লোকটি এবার উৎসাহিত কন্ঠে তার স্ত্রীকে ডাকতে লাগলো।
–আবিদা, আবিদা দেখ কে এসেছে? তাড়াতাড়ি এসো।
একটু পরে ওনার স্ত্রী ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলেন। মহিলাটি বিহানকে দেখে আরও খুশী হলেন।যেন ওনার হারিয়ে যাওয়া সন্তান খুজে পেয়েছেন। মহিলাটি খুশি হয়ে বিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে নানান কথা বলতে লাগলেন।আয়াত শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে এদের কান্ড দেখছে।
একটু পরে বিহান একটু গম্ভীর কন্ঠে ওই বয়স্ক দম্পতির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আপনারা আমাকে আগে বলেছিলেন আমাকে আপনারা অফিসিয়াল ভাবে এডপ্ট করে আপনাদের ছেলে বানাতে চান। আমি তখন রাজি হইনি। কারণ আমার এসব ভালো লাগতো না, আর না কোন প্রয়োজন মনে করতাম। তবে এখন আমি রাজি আছি। আপনারা যদি চান তাহলে আমি আপনাদের ছেলে হতে প্রস্তুত।
বিহানের কথায় ওনারা যেন অমূল্য রতন পাওয়ার মতো খুশী হলেন। খুশীতে দুজনের চোখে পানি চলে এলো। তারা হাসিমুখে বললেন।
–সত্যি বলছো বাবা বিহান? সত্যি তুমি আমাদের ছেলে হতে রাজি? আমরা যে কি খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তোমরা বসো আমি মিষ্টি নিয়ে আসছি।এতো বড় খুশির দিনে মিষ্টিমুখ তো করতেই হবে।
কথাটা বলে ওনারা দুজনেই মিষ্টি আনতে চলে গেলেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা আজ জীবনের কোন অতি কাঙ্ক্ষিত খুশিটা পেয়েছেন।
ওনারা যেতেই আয়াত আর ওর কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে উঠলো।
–বিহান জি উনারা কারা? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
বিহান বলে উঠলো।
–আসলে বছর তিনেক আগে আমি আজাদ আঙ্কেল, আই মিন এই আঙ্কেল টাকে একটা রোড এক্সিডেন্ট এর হাত থেকে বাচিয়ে ছিলাম। ওনাকে বাচিয়ে ওনার বাসায় নিয়ে এসেছিলাম।সেদিন থেকেই উনাদের সাথে পরিচয়।আমাকে দেখে উনারা অনেক খুশী হতেন।আমাকে বারবার তাদের সাথে দেখা করতে বলতেন। আমিও উনাদের খুশীর জন্য মাঝে মধ্যে এসে দেখা করে যেতাম। উনাদের কোন সন্তান নেই। তাই আমাকে অনেক স্নেহ করেন। একদিন হঠাৎ উনারা বললেন আমাকে নাকি তারা তাদের ছেলে বানাতে চায়। তাই তারা আমাকে অফিসিয়ালি এডপ্ট করতে চান। আমি তখন মানা করে দিয়েছিলাম। কারণ এসব আমার তখন ভালো লাগতো না। একটা আজাইরা ক্যাচাল মনে হতো। তাই আমি রাজি হইনি। তবে এখন আমার মনে হচ্ছে এটা জরুরি। তাই তাদের কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
আয়াত ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো।
–আপনি এসব আমার জন্য করছেন তাইনা? কিন্তু আমি সত্যি বলছি, আপনি যেমন আছেন তাতেও আমার কোন সমস্যা নেই।
বিহান আয়াতের চোখের পানি মুছে দিয়ে মায়াবী কন্ঠে বললো।
–তোমার নেই তবে আমার আছে। আমি তোমাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। আর সেখানে অতীতের কোন অন্ধকার ছায়া তোমার ওপর পড়তে দিতে চাইনা আমি। হ্যাঁ আমি আমার অস্তিত্বকে বদলাতে পারব না। তবে যতটা সম্ভব সুধরাতে তো পারি। তুমি ভালো করেই জানো আমাদের সামনের পথটা অনেক কঠিন হবে। সেখানে এই পদক্ষেপ টা হয়তো কিছুটা হলেও আমাদের সাহায্য করবে। এই বুড়ো মা বাবা দুজন যদি আমাকে তাদের ছেলে হিসেবে পেয়ে খুশী হন তাহলে সমস্যা কোথায়? আর আমারও তখন একটা অফিসিয়াল পরিচয় হবে। তাছাড়া তোমারও তো একটা শশুর বাড়ি দরকার তাইনা?
আয়াত অশ্রু চোখেই হাসিমুখে মাথা ঝাকালো। তারপর বলে উঠলো।
–যে কারনেই হোক না কেন, আপনার এই পদক্ষেপে আমি খুশী। কারণ আপনি এতদিন পরে মা বাবা পেতে চলেছেন। আর ওই বয়স্ক মানুষ দুজন সন্তানের খুশী পাবেন। এটাই বড়ো কথা। বাকি জিনিস ওতো ম্যাটার করে না। সামনে যত ঝরই আসুক আপনি সাথে থাকলে আমার কোন ভয় নেই। আপনি শুধু আমাকে কথা দিন কখনো আমার হাত ছাড়বেন না। সবসময় আমার হাত ধরে থাকবেন।
বিহান একটু দুষ্টু হেসে আয়াতের দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বললো।
–শুধু হাতই ধরবো? নাকি আরও কিছু ধরবো?
আয়াত বিহানের বুকে হালকা চাপড় মেরে বললো।
–ছিহ্ অসভ্য।
বিহান হেঁসে দিল। একটু পরে মিঃ আজাদ আর তার স্ত্রী নানারকমের মিষ্টি নিয়ে এলো। বিহান এবার আয়াতকে দেখিয়ে বললো।
–আঙ্কেল আন্টি,ও হচ্ছে আয়াত। আমার ফিয়ন্সে।
আয়াত উনাদের উদ্দেশ্যে সালাম দিল।
আয়াতকে দেখে তারা দুজন অনেক খুশী হলেন। ছেলের সাথে আজ পুত্রবধূও পেয়ে গেলেন তারা।
____
এরই মাঝে আরও এক সপ্তাহ কেটে গেছে। সবার জীবন মোটামুটি ভালোই চলছে। নূর এই কয়দিনে ভার্সিটিতে একটা জিনিস খেয়াল করেছে। এখন আর শিশির কে দেখতে পায় না ও। যদিও এই ব্যাপারে ও খুশীই হয়েছে। কারণ ছেলেটাকে ওর তেমন একটা ভালো লাগতো না। কেমন গায়ে পড়া স্বভাবের ছিল। তবে আজ হঠাৎ ওর এক বান্ধবী বলল,শিশিরকে কারা যেন মেরে হাত পা ভেঙে দিয়েছে। ও নাকি হসপিটালে ভর্তি। কথাটা শুনে ওর কেমন যেন খটকা লাগলো। কে মারতে পারে উনাকে? নূরের কেন যেন মনে হলো আদিত্য মারেনি তো? সেদিন যে পরিমাণ রেগে ছিল। আবার ভাবলো, না না এমনটা কিভাবে হবে? উনি কি কোন গুন্ডা মাস্তান নাকি? হবে হয়তো কেউ। তাই নূর আর তেমন ভাবলো না।
নূর ওর বান্ধবীদের সাথে ভার্সিটির মঠের একপাশে গাছতলায় বসে কথা বলছিল। তখনই হঠাৎ ওখানে একটা আঠারো/ উনিশ বছরের ছেলে এসে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–নূর আপু আপনি প্লিজ আমার সাথে একটু হসপিটালে যাবেন? শিশির ভাইকে দেখতে? উনি আপনাকে যেতে বলেছেন।
নূর থতমত খেয়ে বললো।
–আরে আমি কেন যাবো উনার সাথে দেখা করতে? আর আপনাকে তো চিনিই না। অপরিচিত লোকের সাথে আমি কেন যাবো?
ছেলেটি মিনতির সুরে বললো।
–প্লিজ আপু মানা করবেন না। শিশির ভাই খুবই অসুস্থ।সে শুধু আপনার সাথে পাঁচ মিনিট দেখা করতে চাইছে। প্লিজ চলুন না? আপনাকে রিকুয়েষ্ট করছি। আপনি যদি একা যেতে সাহস না পান তাহলে আপনার ফ্রেন্ডস দেরও সাথে নিয়ে চলুন।
নূর পরে গেল এক মুশকিলে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। নূরের এক বান্ধবী বলে উঠলো।
–এতো করে যখন বলছে তখন চলনা? একটা অসুস্থ মানুষের কথা এভাবে মানা করা ঠিক হবে না।
অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নূর যেতে রাজি হয়ে গেল। তবে ও একা যাবে না। ওর ফ্রেন্ডস দেরও সাথে নিয়ে গেল।
হসপিটালে এসে শিশিরের কেবিনের সামনে আসতেই সেই ছেলেটি আবার বলে উঠলো।
–আসলে কেবিনে একসাথে এতো মানুষ যেতে মানা করেছে ডক্টর। তাই শুধু নূর আপু ভেতরে গিয়ে দেখা করুক। আমরা বাইরেই ওয়েট করি।
সবাই রাজি হয়ে গেল। অতঃপর শুধু নূর একাই কেবিনের ভেতর ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে দেখলো শিশির বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাথায় আর হাত পায়ে অসংখ্য ব্যান্ডেজ। নূর একটু বেডের কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে শিশির কে ডাকলো।
–শিশির ভাইয়া,
নূরের ডাকে শিশির চোখ খুলে তাকালো। নূরকে দেখে হাসার চেষ্টা করে বললো।
–আরে নূর তুমি এসেছ? বসোনা?
নূর সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বেডের পাশে থাকা টুলে বসলো। তারপর শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কেমন আছেন ভাইয়া? আর এসব কিভাবে হলো?
শিশির একটা তিরস্কারের হাসি দিয়ে বললো।
–নিজেই আমার এই অবস্থা করিয়ে আবার জিজ্ঞেস করছো কিভাবে হলো?
শিশিরের কথায় নূর অবাক হয়ে বললো।
–কি বলছেন এসব? আমি কিভাবে আপনার এই অবস্থা করলাম?
–হ্যাঁ তুমিই তো করিয়েছ। আচ্ছা বলোতো আমি কি কখনো তোমার সাথে খারাপ আচরণ বা কোন অযাচিত কাজ করেছি? তাহলে নিজের বয়ফ্রেন্ড কে দিয়ে আমাকে এভাবে মারার মানে কি? আমাকে যদি তোমার এতই অসহ্য লাগে তাহলে আমাকে সেটা বলে দিতে? তাহলেই তো আর আমি তোমার সামনে আসতাম না। তাই বলে আমার সাথে এমন করবে তুমি?
নূর যেন ভ্যাবাচেকা হয়ে গেল। কি বলছেন উনি? আমার আবার বয়ফ্রেন্ড কোথাথেকে আসলো? আর সেই বয়ফ্রেন্ড কিনা আবার উনাকে মেরেও গেল? নূর বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–কি বলছেন ভাইয়া এসব? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। যেখানে আমার কোন বয়ফ্রেন্ডই নেই সেখানে তাকে দিয়ে আপনাকে মারানোর প্রশ্ন কোথাথেকে আসলো? আপনার নিশ্চয় কোথাও ভুল হচ্ছে।
–কেন? মিঃ আদিত্য তোমার বয়ফ্রেন্ড না? তুমি তাকে বলোনি আমাকে মারতে?
নূর এবার স্তব্ধ হয়ে গেল। আদিত্য? আদিত্য মেরেছে উনাকে? কিন্তু কেন? আর আমাকে তো কিছু বলেনি? নূর একটা ঢোক গিলে বললো।
–আ আদিত্য আপনাকে মেরেছে?
–হ্যাঁ, কেন তুমি জানোনা?
নূর মাথা নাড়াল। মানে সে জানে না।
শিশির এবার একটু গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–হুম বুঝতে পেরেছি। তারমানে সে তোমাকেও অন্ধকারে রেখেছে। তোমাকেও তার জালে ফাঁসিয়েছে।
নূর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–মা মানে?
–দেখ নূর তুমি যাই ভাবোনা কেন, আমি তোমাকে সত্যিকারের বন্ধু ভেবেছি। আর সবসময় তোমার ভালোই চেয়েছি। তাই তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।
–কি কথা?
–তার আগে তুমি বলোতো, তুমি আদিত্যর সম্পর্কে কতটুকু জানো।
–উনি আমাদের বাসায় কিছুদিন হলো পেইং গেস্ট হয়ে এসেছে। শুনেছি বিদেশ থেকে এসেছে কোন বিজনেসের কাজে। ব্যাস এতটুকুই।
–হুমম, যা সন্দেহ করেছিলাম তাই।
নূরের বুকের ভেতর কেমন যেন দুরুদুরু করছে। কেমন যেন ভয় লাগছে ওর। নূর কম্পিত কণ্ঠে বললো।
–কি কি বলতে চাইছেন আপনি?
–নূর ওই লোকটা তোমাকে ফাঁসিয়েছে। উনি কোন বিদেশ থেকে আসেননি। বরং এখানে ঢাকায়ই থাকেন। আর ঢাকাতেই তার বিশাল বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ি অফিস সবই আছে। তাহলে সে তার নিজের এতবড়ো বাড়ি রেখে তোমাদের ওই ছোট্টো বাসায় কেন পেইং গেস্ট থাকতে এলো? যার আশেপাশে শতশত গার্ডস আর কাজের লোক ঘুরে বেড়ায়, সে তোমাদের সুবিধাবঞ্চিত বাসায় কেন থাকছে?
নূর যেন বাকরূদ্ধ হয়ে গেল। কি শুনছে ও এসব? এসব কি সত্যি? লোকটা ওদের এভাবে মিথ্যাে বলেছে? নূরের কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। শিশির তো মিথ্যেও বলতে পারে। হতে পারে ও এসব বানিয়ে বলছে। নূরের ভাবনার মাঝেই শিশির আবার বলে উঠলো।
–জানি আমার কথা হয়তো তুমি বিশ্বাস করবে না। হয়তো মনে হবে আমি মিথ্যে বলছি। তবে আমার কাছে আমার কথার প্রমাণ আছে। শিশির বেডের পাশে থাকা ওর ফোনটা বের করে ফোনের সোশ্যাল সাইট ঘেটে কিছু ছবি বের করে নূরকে দেখিয়ে বললো।
–এই দেখ, এখানে আদিত্যর অফিস, বাড়ি, গাড়ির ছবি দেওয়া আছে। এগুলো তো আর আমি হাতে বানায় নি তাইনা?
ছবিগুলো দেখে নূরের হাত পা অবস হয়ে এলো। তারমানে উনি সত্যিই আমাদের মিথ্যে কথা বলেছেন?
শিশির আবার বলে উঠলো।
–শুধু এসবই না। আরও আছে। উনি একজন মাফিয়া গ্রুপের লিডার। উনার একটা গ্যাং আছে।মানুষকে নির্দয়ভাবে মারা, তাদের খুন করা তার নিত্যদিনের কাজ। এই আমাকেই দেখ। বিনা অপরাধে কিভাবে মেরেছে আমাকে।
নূরের কেমন মাথা ঘুরছে।সবকিছু এলোমেলো লাগছে ওর কাছে। এসব কথা কানে শুনতে পেলেও মন মানতে চাচ্ছে না কিছুতেই। মনে হচ্ছে যেন ভয়ংকর কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছে ও। এখুনি ঘুম ভাঙলেই সব মিথ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু ঘুম ভাঙছে না কেন? কেও ওকে ঘুম থেকে জাগাচ্ছে না কেন?
শিশির এবার বললো।
–আর হ্যাঁ নূর আরও একটা কথা আছে। উনি কিন্তু ম্যারিড। উনার স্ত্রী আছেন। দেখ আমি তোমার ভালো চাই বলে তোমাকে সবটা জানালাম। এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছে।
নূরের মাথায় যেন এবার আকাশ ভেঙে পড়লো। চোখের সামনে পৃথিবীটা গোল গোল ঘুরতে লাগলো। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। না না এটা হতে পারে না। সব মিথ্যে, সব মিথ্যে। নূর আর সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
আর নূর যেতেই শিশির একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিল। ওর কাজ হয়ে গেছে। এটাই তো ও চাচ্ছিল। আদিত্য ওকে মারার পরে শিশিরের মাথায় প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে ছিল। তবে ও জানতো যে ও আদিত্যের ক্ষমতার সামনে টিকতে পারবে না। তাই লোক লাগিয়ে আদিত্য আর নূরের সব খবর নিয়েছে। ও জানে নূরই আদিত্যের বউ। আর নূরই ওর সবচেয়ে বড়ো দূর্বলতা। তাইতো ও জায়গা বুঝে কোপ মেরেছে। এখন আর নূর আদিত্যের মুখও দেখতে চাইবে না।
নূর বাইরে এসে দৌড়ে চলে গেল। নূরের বান্ধবীরা ঘাবড়ে গিয়ে ওর পেছনে ছুটলো। নূর পাগলের দৌড়াচ্ছে। নিজেকে উন্মাদ লাগছে ওর। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না ও। শিশিরের কথাগুলো কিছুতেই ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না ওর। যদিও ওর নিজেরও আদিত্যকে সন্দেহ হতো। কেমন রহস্যময় লাগতো তাকে। আদিত্যের কথায় মাঝে মধ্যে মন হয় সে নূরকে আগে থেকেই চেনে। মনে হয় কিছু একটা লুকাচ্ছে সে। তবে সত্যিটা যে এতো ভয়ংকর হবে তা কখনোই ভাবেনি নূর। বারবার শুধু একটা কথাই কানে বাজছে, আদিত্য ম্যারিড। সে বিবাহিত।
–নাআআআআ
নূর দুই কান চেপে ধরে নিচে বসে পড়লো। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে ওর।
নূরের বান্ধবীরা দৌড়ে এসে নূরের কাছে বসে ওকে ধরে চিন্তিত সুরে বললো।
–এই নূর কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?
নূর ওর বান্ধবীকে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওর বান্ধবীরা আরও ঘাবড়ে গেল। বারবার শুধু জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? নূর কিছুক্ষণ পর একটু শান্ত হয়ে ওদের সবটা খুলে বললো। নূরের কথা শুনে বাকি সবাইও অবাক হয়ে গেল। নূরের এক বান্ধবী বলে উঠলো।
–আচ্ছা একটা কথা বলতো, এসব শুনে তুই এতো কাঁদছিস কেন? তারমানে কি তুই আদিত্যকে ভাইয়াকে ভালোবেসে ফেলেছিস?
নূর এবার চুপ হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। এই প্রশ্নের উত্তর তো ও নিজেই জানে না। সত্যিই তো,ওর এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? আমি কি তাহলে সত্যিই উনাকে ভালোবেসে ফেললাম?
একটু পরে নূরের বান্ধবীরা ওকে ধরে একটা চেয়ারে বসালো।নূরের আরেক বান্ধবী বলে উঠলো।
–আচ্ছা তুই কাঁদিস না। আমরা বিষয় টা ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখি। আগেই কোন মন্তব্যে আসা ঠিক হবে না। ইন্টারনেট এর যুগে কোনকিছুই বের করা অসম্ভব না।
কথাটা বলে ওর বান্ধবী ফোন বের করে আদিত্যের সব সোশ্যাল সাইট চেক করতে লাগলো।
নূর শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে শিশিরের সব কথা যেন মিথ্যে হয়ে যায়। সব যেন ভুল প্রমানিত হয়। তবে নূরকে নিরাশ করে দিয়ে ওর বান্ধবী মলিন মুখে বলে উঠলো।
–ইয়ার নূর, শিশির যা বলেছে একদম সত্যি বলেছে। সোশ্যাল সাইটে উনার সব ডিটেইলস দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ মাফিয়া হওয়ার ব্যাপার টা নিয়ে নেটে তেমন কিছু পেলাম না। তবে উনার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ম্যারিড দেওয়া আছে। তবে উনার বউয়ের কোন ছবি কোথাও নেই।
নূর এবারে সত্যি সত্যিই ভেঙে পড়লো। ওর জীবনে হঠাৎ এমন মোড় আসবে ভাবতেই পারেনি ও। সবকিছু দেখার পরও কেন যেন ওর এসব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না।
নূরের এক বান্ধবী বলে উঠলো।
–এমনও তো হতে পারে উনি মিথ্যে স্টাটাস দিয়ে রেখেছে। অনেকে এমন করে থাকে। যাতে কোন মেয়ে তাকে বিরক্ত না করে।
নূর যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল। মনে মনে বললো, এমনটাই যেন হয়।
নূরুল আরেক বান্ধবী বলে উঠলো।
–আমর এক কাজ করি। নেটে তো আদিত্যের অফিস আর বাসার এড্রেস দেওয়া আছে। আমরা সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি। তাহলে আসল ব্যাপার টা বেরিয়ে পরবে।
ওর কথায় সবাই সায় দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। চল এখুনি যাই।
অতঃপর সবাই আদিত্যের অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো।
আদিত্যের অফিসে এসে অফিসের সিকিউরিটির কাছে আদিত্যর সম্পর্কে জানতে চাইলো ওরা। নূরকে অফিসের কেও দেখেনি। তাই ওরা নূরকে চিনতে পারলোনা। সিকিউরিটি প্রথমে কিছু বলতে চাইলো না। ওরা অনেক অনুনয় বিনয় করে আর কিছু টাকা খাইয়ে সিকিউরিটির মুখ খোলালো। আর সিকিউরিটি যা বললো তাতে ওদের শেষ আশাও মাটিতে মিশে গেল।সিকিউরিটি ওদের বললো, আদিত্যর বাড়ি গাড়ি আরও কি কি আছে। আর এটাও বললো যে, আদিত্য বিবাহিত। আর সে নাকি তার বউকে অনেক ভালোবাসে।
নূর আর শুনতে পারলোনা। মুহূর্তেই যেন সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল ওর। ওর ভালোবাসা টা এভাবে শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। কেন হলো ওর সাথে এমন? কি দোষ করেছিল ও? কেন এতোবড় ধোকা পেল ও?
নূরের বান্ধবীরা আদিত্যের বাসায় যেতে চাইলো।তবে নূর মানা করে দিল। বারবার একই কথা শোনার সাহস আর তার নেই।
ওর বান্ধবীরা ওর অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে আর জোর করলোনা। ওকে নিয়ে রিকশায় উঠলো বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
আদিত্য একটা রেস্টুরেন্টে মিটংয়ে এসেছে। দোতালায় একটা ওপেন রুফ রেস্টুরেন্টে বসে মিটিং করছে। তখনই ওখানে আয়াত ওর ফ্রেন্ডস দের সাথে এলো এনজিওর একটা মিটিংয়ে । আদিত্যকে দেখে আয়াত হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বললো।
–আরে ভাইয়া? তুমিও এখানে?
আদিত্য আয়াতকে দেখে সেও হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে আয়াতকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো।
–কিরে আয়ু কেমন আছিস? এখানে কোন দরকারে এসেছিস?
–হ্যাঁ ভাইয়া এনজিওর একটা মিটিংয়ে।
–অনেক ভালো একটা কাজ করছিস তুই। অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ।
–থ্যাংক ইউ ভাইয়া।
নূরের রিকশা একটা সিগনালে এসে থেমে আছে। ওর সাথে ওর বান্ধবী বসে আছে। ওর বান্ধবীটা এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা দেখে ভ্রু কুঁচকে নূরের উদ্দেশ্যে বললো।
–এই নূর ওটা আদিত্য ভাইয়া না?
বান্ধবীর কথামতো নূর ওর ইশারা অনুযায়ী সেদিকে তাকালো। দেখতে পেল আদিত্য একটা মেয়েকে একহাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নূরের হৃৎপিন্ড যেন কেঁপে উঠল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো । নূরের বান্ধবী বলে উঠলো।
–লোকটা তো দেখছি সত্যিই খারাপ।কেমন মেয়েবাজি করে বেড়াচ্ছে। ঘরে বউ রেখে বাইরে রঙ্গলিলা করে বেড়াচ্ছে। কত্তো বড় ইতর ছি ছি।
নূর আর সহ্য করতে পারছে না। ইচ্ছে করছে কোন একদিকে পালিয়ে যেতে। বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ওর। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এমন একটা লোককে কিভাবে ভালোবাসলো ও?
_____
নূর ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকলো। নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে ওর। হঠাৎ আদিত্য হুট করে এসে কোনকিছু না বলে নূরের হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। নূরের হাত ধরে ওর রুমে নিয়ে এসে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে রাগী কন্ঠে বললো।
–তুমি ওই শিশিরের সাথে দেখা করতে কেন গিয়েছিলে? তোমাকে আমি মানা করেছিলাম না ওর সাথে কোন কথা নেই তোমার? তারপরও কেন গিয়েছিলে বলো?
নূরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে এলো এবার। আজকের সব কষ্ট রাগ এবার বিস্ফোরণে পরিনত হলো। রাগে শরীর কেঁপে উঠল ওর। রগে উঠে দুই হাতে আদিত্যকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। আচমকা নূরের ধাক্কায় আদিত্য দুকদম পিছিয়ে গেল। নূরের এমন কাজে অবাক চোখে তাকালো আদিত্য। নূর এবার ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠলো।
–কেন? কি করবেন আপনি? আমাকেও মারবেন নাকি,যেভাবে শিশিরকে মেরেছেন বলুন?
আদিত্য নূরের কথায় একটু চমকে গেল। নূর এই কথা জানলো কি করে? নিশ্চয় ওই বদমাইশ শিশির টা বলেছে। আদিত্য বলে উঠলো।
–নূর আমার কথা শোন। তুমি যা ভাবছ তেমন টা না,,
কথাটা বলে আদিত্য নূরের কাছে আসতে নিলে নূর হাত উঁচু করে রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–খবরদার, একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। আর আমি ঠিকই ভাবছি।বরং এতদিন যা ভাবছিলাম সেটাই ভুল ছিল। আপনি কি ভেবেছিলেন, আপনার আসল চেহারা আমি কখনো ধরতে পারবো না? আপনি আমাদের বোকা বানিয়ে যাবেন আর আমরা আপনার জালে ফেঁসে যাবো?
নূরের এসব কথায় আদিত্য প্রচুর অবাক হয়ে গেল। ওর এঞ্জেল টা এভাবে কথা বলছে কেন? কি হয়েছে ওর? আদিত্য অবাক সুরে বললো।
–নূর কি বলছো তুমি এসব? কিসের আসল চেহারা?
নূর একই ভাবে বলতে লাগলো।
–একদম সাধু সাজার চেষ্টা করবেন না। আমি আপনার সব মিথ্যে জেনে গেছি আজ। আপনি কোন বিদেশ টিদেশ থেকে আসেননি। বরং ঢাকায়ই থাকেন আপনি। তাহলে আমাদের মিথ্যে কেন বললেন? নিজের এতবড় বাড়ি রেখে আমাদের এই ছোট্ট বাড়িতে কেন থাকেন আপনি বলুন?
আদিত্য আরও চমকে গেল। নূর এসব কিছু কিভাবে জানলো? এখন কিভাবে বুঝাবো ওকে? ওকে সত্যিটাও বলতে পারবনা ।
আদিত্যকে চুপ থাকতে দেখে নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো।
–কি হলো আর কথা বের হচ্ছে না? চুরি ধরা পরে গেছে এখন আর কোন কথা বের হচ্ছে না তাইনা? বলুন কেন করেছেন এসব? আমাদের তো তেমন কোন ধন সম্পত্তিও নেই। তাহলে কিসের জন্য? আমার জন্য? আমাকে হাসিল করার জন্য এসব করেছেন তাইনা?
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে নূরের দিকে তাকালো। নূরের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না ও।
নূর এবার অশ্রু চোখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো। –আ আপনার লজ্জা করে না? নিজের ঘরে বউ থাকতে অন্য মেয়েদের পিছে ঘুরে বেরান? অন্য মেয়েকে নিজের প্রেমের ফাঁদে ফাসান? আমাকেও আপনার জালে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন তাইনা? আর কতো জনকে এভাবে ফাঁসিয়েছেন হ্যাঁ?
এতক্ষণ কিছু না বললেও এবার নূরের কথা শুনে আদিত্য নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলোনা। উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–নূররররর,,, স্টপ ইট নূর। অনেক বলেছ তুমি। এমন কিছু বলনা যার জন্য তোমাকে পরে পস্তাতে হয়।
–পস্তাতে তো আমাকে হচ্ছেই। আপনাকে বিশ্বাস করে আমাকে পস্তাতে হচ্ছে। আপনি চলে যান এখান থেকে। আপনাকে এই বাড়িতে আর দেখতে চাইনা আমি।
আদিত্য আহত চোখে তাকালো নূরের দিকে। ওর এঞ্জেল টা ওকে চলে যেতে বলছে? আমাকে আর দেখতে চায়না সে? আদিত্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত সুরে বলে উঠলো।
–ঠিক আছে। তুমি চাইলে তো হাসতে হাসতে জানও দিয়ে দিবো। তুমি যদি এতো খুশী হও তাহলে তাই হোক। আজকের পর আর এই অধমকে দেখতে পাবে না তুমি।
আদিত্যের কথায় নূরের বুকটা কেঁপে উঠল। এতকিছুর পরেও আদিত্যের যাওয়ার কথা শুনে ওর কষ্ট হচ্ছে। তবুও নূর কিছু বললো না। অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। আদিত্য ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো।
–ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখ। মেডিসিন ঠিকমতো নিও।
কথাগুলো বলে আদিত্য ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। একসময় বাসার বাইরে চলে গেল।
আদিত্য যেতেই নূর ধপ করে নিচে বসে পড়ে মুখে হাত চেপে কেঁদে উঠলো। অবুঝ মন এখনো চাচ্ছে আদিত্য না যাক। ফিরে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে নিক। ওর ভালোবাসার পরিনতি টা এমন কেন হলো?
আজ দুটি মন দুইদিকে কষ্ট পাচ্ছে। অথচ দোষ কারোরই নেই।
চলবে……
(আজও রিচেক করার সময় পাইনি। তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)