#মরুর_বুকে_বৃষ্টি
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৪৪
★রিসোর্টে ফিরে এসে সবাই যার যার রুমে চলে গেল। আদিত্য আর নূরও ওদের রুমে ঢুকলো। তবে নূর খেয়াল করলো আদিত্য ওর দিকে তাকাচ্ছেও না, কথাও বলছে না। আদিত্যের কঠিন হয়ে থাকা মুখমন্ডল দেখে নূর বুঝতে পারছে আদিত্য প্রচুর রেগে আছে। রেগে থাকারই কথা। ওরা কাজই এমন করেছে। কিন্তু এখন হিরোর রাগ ভাঙাবো কেমন করে?
আদিত্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ঘড়ি খুলছে। তখনই নূর গিয়ে পেছন থেকে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে অপরাধী কন্ঠে বললো।
–সরি সরি সরি, আর কখনো এমন হবে না। সত্যি বলছি। প্লিজ মাফ করে দাও, কথা বলো আমার সাথে প্লিজ?
নূরের সরির খুব একটা প্রভাব পড়লোনা আদিত্যের উপরে। আদিত্য নূরের হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই নূর আদিত্যের হাত ধরে আবারও বলে উঠলো।
–সরি তো, প্লিজ মাফ করে দাওনা?
আদিত্য এবার চোয়াল শক্ত করে নূরের দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে রাগী কন্ঠে বললো।
–হোয়াট সরি হ্যাঁ? হোয়াট সরি? সরি বললেই সব খতম হয়ে গেল? তুমি কি এখনো সেই বাচ্চা নূর আছ যে কিছুই বুঝতে পারনা? তুমি জানোনা, তুমি এক সেকেন্ডের জন্য চোখের আড়াল হলে আমার জান বেরিয়ে যায়? তুমি জানো তোমাকে না দেখে কি অবস্থা হয়েছিল আমার? এই তিনটা ঘন্টা দমবন্ধকর ছিল আমার জন্য।আজ ওই লোকগুলো যদি সত্যিকারের খারাপ লোক হতো,তাহলে কি হতে পারতো তোমাদের সাথে ধারণা আছে তোমার? সে কথা ভাবতেই আমার রুহ কেঁপে ওঠে।কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝবে? তুমি বুঝলে বারবার আমার সাথে এমন করতে না তুমি। তোমাকে আমি মানা করেছিলাম না বাইরে কোথাও যাবেনা? তাহলে কি এমন জরুরি কাজে তোমাদের যেতে হলো বলো?
নূর কাঁদো কাঁদো গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিত্য ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো।
–থাক তোমার এই সিলি এক্সকিউজ শোনার ধৈর্য নেই আমার মাঝে। তুমি থাক তোমার মতো।
কথাটা বলেই আদিত্য নূরকে ছেড়ে দিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে হনহন করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
আর নূর দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে কাঁদতে লাগলো। তারপর নিজের চোখ মুছে মনে মনে বললো,শুধু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদলে কাজ হবে না। আমাকে আমার হিরোকে মানাতে হবে। রাগিয়েছি যখন আমি, তখন আমিই রাগ ভাঙাবো। নূর মনে মনে কিছু প্ল্যান করে নিল।
দশ/পনেরো মিনিট পর আদিত্য ওয়াশরুম থেকে বের হলো। রুমে ঢুকতেই থমকে গেল আদিত্য। নূর একটা লাল রঙের পাতলা জর্জেট শাড়ী পরে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ীটা একটু সিনেমার নায়িকাদের মতো আবেদনীয় ভাবে পড়েছে। স্লিভলেস ব্লাউজের ওপর পাতলা শাড়ীর নিচে ফর্সা মেদহীন পেট আর নাভী দৃশ্যমান। নূরের এমন আবেদনময়ী আবতার দেখে আদিত্যের নেশা জাগলেও তার রাগের সামনে সেটাকে সে বাইরে আসতে দিল না। আদিত্য অন্য দিকে তাকিয়ে নূরের সামনে দিয়ে নূরকে পুরোপুরি ইগনোর করে চলে যেতে লাগলো। তবে নূরও এতো সহজে হার মানার পাত্রী নয়। আজতো যেকরেই হোক সে তার হিরোকে মানিয়েই ছাড়বে। তাই নূর আদিত্যের হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে আনলো। তারপর দুই হাতে আদিত্যের গলা জড়িয়ে ধরে মায়াবী হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ ♬ সোনা কিতনা সোনা হে
♬ ♬ সোনে জেইসা তেরা মান
♬ ♬ সুন জারা সুন কেয়া কেহতি হে
♬ ♬ দিওয়ানি দিল কি ধারকান
♬ ♬ তু মেরা তু মেরা তু মেরা তু মেরা
♬ ♬ তু মেরা হিরো নাম্বার ওয়ান
(আদিত্য ভাবলেশহীন ভাবে নূরের হাত নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগলো। নূর আবারও আদিত্যর হাত ধরে আটকালো। আদিত্যের আগে পিছে ঘুরে ঘুরে নানান ভঙ্গিতে আদিত্যকে ছুঁয়ে গাইতে লাগলো)
♬ ♬ হিরো তু মেরা হিরো হে
♬ ♬ ভিলেন জেইসা কাম না কার
♬ ♬ স্বপ্ন কি ইস রাণী কো
♬ ♬ এইসে তো বাদনাম না কার
♬ ♬ দিওয়ানি ইয়ার কেহতা হে পেয়ার
♬ ♬ আচ্ছা নেহি দিওয়ানা পান
♬ ♬ তু মেরা তু মেরা তু মেরা তু মেরা
♬ ♬ তু মেরা হিরো নাম্বার ওয়ান
(আদিত্য ভেতরে ভেতরে ঠিকই নূরের কাজকর্ম ইনজয় করছে। তবে উপরে উপরে রাগ দেখিয়ে আবারো চলে যেতে লাগলো। নূর এবার আদিত্যকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। তারপর নিজে ওর কোলে বসে হাতের দুই আঙুল দিয়ে আদিত্যের বুকের ওপর হাটার মতো করে কিছুটা আবেদনময়ী ভঙ্গিতে গেয়ে উঠলো।)
♬ ♬ আন্দার কিতনি গারমি হে
♬ ♬ বাহার কিতনি সারদি হে
♬ ♬ তুনে বেদারদি মেরি হালাত কেইসি কারদি হে
♬ ♬ উফফ আন্দার কিতনি গারমি
♬ ♬ বাহার কিতনি সারদি হে
♬ ♬ তুনে বেদরদি মেরি হালাত কেইসি কারদি হে
♬ ♬ দিলমে বাসালে আপনা বানা লে
♬ ♬ ইউ না বারা মেরি উলঝান
♬ ♬ তু মেরা তু মেরা তু মেরা তু মেরা
♬ ♬ তু মেরা হিরো নাম্বার ওয়ান
(আদিত্য আর মিথ্যে রাগ দেখাতে পারলোনা। এবার নিজেও মুচকি হেসে নূরকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে গেয়ে উঠলো।)
♬ ♬ সোনা কিতনা সোনা হে
♬ ♬ সোনে জেইসা তেরা মান
♬ ♬ সুন জারা সুন কেয়া কেহতি হে
♬ ♬ দিওয়ানি দিল কি ধারকান
♬ ♬ মে তেরা মে তেরা মে তেরা মে তেরা
♬ ♬ মে তেরা হিরো নাম্বার ওয়ান
গান গাইতে গাইতে আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে বিছানার দিকে এগুলো। নূর মুচকি হেসে আদিত্যের বুকে মুখ গুঁজল।
_____
আদিত্যেরা সবাই পরেরদিনই আবার ঢাকায় ব্যাক করলো।
ঢাকায় আসার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। সবাই আবার যার যার লাইফে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেছে। নূর আর আদিত্যের লাইফ দেখতে গেলে ঠিকই চলছে। তবে ইদানীং নূর একটা জিনিস খেয়াল করছে। আদিত্য আজকাল কেমন যেন বদলে গেছে। আজকাল অনেক দেরি করে বাসায় ফেরে। সকালেও অনেক সকাল সকাল অফিসে চলে যায়। নূরকে আজকাল বেশি সময়ই দেয়না আদিত্য। তবুও নূর এটা নিয়ে বেশি মন খারাপ করে না। কারণ ও বোঝে আদিত্যের অনেক বড়ো বিজনেস।কাজের চাপ হয়তো বেশি হয়ে গেছে তাই হয়তো সময় দিতে পারে না। তবে আদিত্য সময় দিতে না পারলেও নূরের কেয়ারে কোন কমতি রাখে না। অফিসে থাকলেও সবসময় নূর খেয়েছে কিনা সে খোঁজ খবর রাখে। আর সার্ভেন্ট দের বলে রেখেছে নূর খাওয়া দাওয়ার গাফিলতি করলে তাকে যেন ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়।
আজ শুক্রবার।
সকাল আটটার দিকে নূরের ঘুম ভাঙলো। নূর আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলে তাকালো। তবে চোখ খুলে রোজকার মতো আদিত্যকে চোখের সামনে দেখতে না মুখটা মলিন হয়ে গেল নূরের। নূর উঠে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। নাহ আদিত্য কোথাও নেই।তাহলে আদিত্য অফিসে চলে গেছে? কিন্তু আজতো শুক্রবার ছুটির দিন? তাহলে কোথায় গেল? নূর মলিন মুখে পাশে তাকাতেই ছোট টেবিলের ওপর পেপার ওয়েটের নিচে একটা ছোট্ট চিরকুট দেখতে পেল। নূর চিরকুট টা হাতে নিয়ে দেখলো আদিত্যর লেখা চিরকুট। আদিত্য লিখেছে,
” সরি এঞ্জেল একটা জরুরি কাজের জন্য সকাল সকাল আসতে হয়েছে। তাই তোমাকে ডাকিনি। প্লিজ রাগ করোনা। আর ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিও। আমি দুপুরের দিকেই মিটিং শেষ করে চলে আসবো। ”
নূর মুচকি হেসে চিরকুট টা ঠোঁটের ওপর চেপে ধরে চুমু খেল। মনে মনে খুব খারাপ লাগছে ওর। ইশশ একটু সকাল সকাল উঠলে হিরোকে দেখতে পেতাম। এতো ঘুম কেন আমার চোখে?
নূর প্রতিদিনই সকাল সকাল ওঠার জন্য এলার্ম দিয়ে রাখে। তবে সে এলার্ম কখনও বাজে না। আর এর কারণ যে আদিত্য তাও জানে ও। আদিত্য রোজই ওর অগোচরে এলার্ম বন্ধ করে দেয়। যাতে নূরের ঘুম না ভাঙে। তাই নূরও সকাল সকাল উঠতে পারে না। আদিত্য আমার কতো কেয়ার করে আর আমি কিছুই করতে পারি না ওর জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে নূর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
দুপুরের দিকে নূর অধীর আগ্রহে বসে আছে ড্রয়িং রুমে। আদিত্য বলেছিল দুপুরের দিকে আসবে তাই নূর বসে ওর অপেক্ষা করছে। আদিত্য আসলে তারপর একসাথে খাবে সেই আশায় বসে আছে নূর। দুপুর দুটো বেজে গেল তবুও আদিত্য এখনো আসছে না। নূর আদিত্যের খবর জানতে ওর নাম্বারে ফোন দিল তবে ফোন রিসিভ হলো না। নূরের একটু চিন্তা হচ্ছে। আদিত্য হাজার ব্যাস্ততার মাঝেও সবসময় ওর ফোন রিসিভ করে। তাহলে আজ রিসিভ করলো না কেন? সব ঠিক আছে তো? এসব ভাবনায় নূরের কেমন অস্থির লাগতে লাগলো।
দেখতে দেখতে তিনটা বেজে গেল তবুও আদিত্যর আসার নাম নেই। নূর আবারও ফোন দিল। কিন্তু এবারও ফোন রিসিভ হলো না। নূরের আরও চিন্তা হতে লাগলো। নূর ভাবলো একবার বিহানকে ফোন করে দেখা যাক ওরা কোথায় আছে। তখনই হঠাৎ নূরের ফোনে আদিত্যর ম্যাসেজ এলো। নূর দ্রুত ম্যাসেজ ওপেন করে দেখলো সেখানে লেখা আছে,
“সরি অ্যাগেইন এঞ্জেল। আসলে আমার কাজের চাপ বেশি তাই আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। তুমি প্লিজ খেয়ে নিও। একদম না খেয়ে থাকবে না কিন্তু। আমি কিন্তু সার্ভেন্ট দের কাছে খবর নেব। আর যদি শুনেছি তুমি খাওনি তাহলে কিন্তু তোমার না খাওয়ার শাস্তি ওরা পাবে। তাই ওদের চাকরি বাঁচাতে হলেও তুমি টাইম মতে খেয়ে নিবে। ওকে বাই”
ম্যাসেজ টা পরে নূর একটু স্বস্তি পেলেও,কিছুটা মন খারাপও হলো ওর। কতো আশা করে বসে ছিল আদিত্য আসলে একসাথে খাবে কিন্তু সেতো আসবেই না। নূরের খাওয়ার ইচ্ছাটাই মরে গেল। তবুও আদিত্যর ধমকি অনুযায়ী বেচারা সার্ভেন্ট দের চাকুরী বাঁচাতে নূর অনিচ্ছুক ভাবে অল্প করে কিছু খেয়ে নিল।
এভাবে দেখতে দেখতে আরও দু সপ্তাহ কেটে গেছে। আদিত্য এখন আগের থেকে আরও বেশি বদলে গেছে। আদিত্য এখন প্রায়ই নূর ঘুম থেকে ওঠার আগেই চলে যায়,আবার রাতে ফিরতে ফিরতে নূর ঘুমিয়ে পড়ার পরে ফিরে। আজ একটা সপ্তাহ হলো আদিত্যকে সরাসরি দেখতে পায়না নূর।শুধু আদিত্যের খুলে রাখা কাপড়চোপড় দেখে বুঝতে পারে আদিত্য এসেছিল। নূর অনেক চেষ্টা করে। রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকে আদিত্যর বাসায় ফেরার আশায়। তবুও একটা সময় অবাধ্য চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসে নূরের। আবার সকালে ওঠার জন্য এলার্ম দিয়ে রাখলে সেটাও আদিত্য বন্ধ করে রাখে। যারকারনে সকালেও আদিত্যকে দেখা হয়না ওর।
এখন আর নূরের জন্য কোন চিরকুটও রেখে যায়না আদিত্য। সারাদিনে একবার ফোনও করেনা।আর নূর ফোন করলেও ফোন ধরে না।শুধু একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয়, “আমি ব্যস্ত আছি, খেয়ে নিও”। ব্যাস এতটুকুই। নূরের এখন প্রচুর খারাপ লাগে। যতই মনকে বোঝানোর চেষ্টা করুক যে আদিত্য হয়তো সত্যিই ব্যাস্ত তাই এমন করছে। তবুও অবুঝ মনটা আজকাল এসব বুঝতে চায়না। তার খুব খারাপ লাগে। না চাইতেও নানান খারাপ চিন্তা ভাবনা তার মন মস্তিষ্কে এসে ভর করে।
নূরের ভয় হয়। ওর হিরোটা কি সত্যিই বদলে গেছে? তার কি আর আমার প্রতি আর কোন অনুভূতি নেই? সে আমার ওপর তিক্ত হয়ে গেছে? তাই কি সে এমন আমার থেকে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে? এসব ভেবে ভেবে নূরের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। আবার সে নিজেই নিজেকে বুঝ দেয়।না না এমন কিছুই না। তুইও না কিসব ফালতু চিন্তা নিয়ে থাকিস। এমনটা কখনোই হবে না। আমার হিরো আমাকে অনেক ভালোবাসে। সে নিশ্চয় ব্যাস্ততার কারণেই এমন করছে। আর কিছুই না। তুই একদম উল্টো পাল্টা ভাববি না।
এসব নানান কথা বলে মনকে বুঝানোর চেষ্টা করলেও সেটা কতটুকু কার্যকরী হয় সেটা জানা নেই নূরের।
রাত দশটা,
যথারীতি আদিত্য এখনও বাসায় ফেরেনি। তবে আজ নূর পণ করে নিয়েছে সে আজ আদিত্য না আসা পর্যন্ত কিছুতেই ঘুমাবে না। নূর আজ শাড়ী পরে সুন্দর করে সেজেগুজে রেডি হয়ে বসে আছে আদিত্যর জন্য। আজ সে নিজের হাতে ডিনার বানিয়েছে আদিত্যের জন্য। যদিও আদিত্য ওকে কিচেনের ধারে কাছেও যেতে মানা করেছে। তবুও আজ নূর আদিত্যের কথা না মেনেই এ কাজ করেছে। নূর টেবিলে সব খাবার সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। আদিত্য আসলে তারপর একসাথে খাবে। নূর বসে টিভি দেখছে আর বারবার চা খাচ্ছে যাতে ওর ঘুম না ধরে।
বসে থাকতে থাকতে এগারোটা বেজে গেল। আদিত্য এখনো আসছে না। নূর দুবার ফোন দিয়েছে কিন্তু বরাবরের মতো ফোন রিসিভ করেনি আদিত্য। নূরের এতক্ষণের উৎসাহ ধীরে ধীরে চুপসে এলো।তবে মনোবল হারালো না নূর। বসেই রইলো আদিত্যের জন্য। সার্ভেন্ট রা অনেক বার নূরকে এসে অনুরোধ করে গেছে নূরকে খাবার খেতে। বলেছে সে খাবার না খেলে আদিত্য তাদের চাকুরী থেকে বাদ দিয়ে দিবে। তবে নূর আজ কোন কথাতেই নরবে না।সে আজ মনে মনে পণ করে নিয়েছে আদিত্য আসলে তবেই খাবে সে।নাহলে খাবেই না। নূর সার্ভেন্ট দের বলে দিয়েছে তারা যেন গিয়ে ঘুমিয়ে পরে। আর আবিরও কয়দিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেছে একটা কাজে।তাই আপাতত সেও বাসায় নেই।
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাটা বারোটার ঘন্টা বাজালো, তবুও আদিত্যের আসার নাম নেই। নূরের অবাধ্য চোখ জোড়ায় এবার রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে। নূর অনেক চেষ্টা করেও তাকিয়ে থাকতে পারছে না। নূর না পেরে উঠে গিয়ে চোখে পানির ঝাপসা দিয়ে এলো। তবে বিশ মিনিট যেতে না যেতেই নূরের চোখ আবারও ভারি হয়ে এলো।নূর কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছে না। তাহলে কি আজও সে তার হিরেকে দেখতে পাবে না। ভাবতেই নূরের ঘুম জড়ানো লাল চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। আর পারলোনা নূর।নিজের সাথে যুদ্ধ করে শেষমেশ ঘুমের কাছে হার মেনে সোফার ওপরই কাত হয়ে ঢলে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই নূরের চোখের পানি টুকু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।
রাত একটার পরে আদিত্য বাসায় ফিরলো। সারাদিনের কাজের ধকল আর ক্লান্তিতে নাজেহাল অবস্থা। ভেতরে ঢুকে ড্রয়িং রুমে নূরকে এভাবে সোফার ওপর শুয়ে থাকতে দেখে আদিত্য একটু চমকে গেল।আদিত্য টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো টেবিলে খাবার সাজানো।আদিত্য যা বোঝার বুঝে গেল। আদিত্য দ্রুত পায়ে নূরের কাছে গিয়ে নূরের মুখের সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলো। নূরের চোখের পানির দাগ এখনো আছে। আদিত্যের বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। আদিত্য নূরের গালে হাত বুলিয়ে মনে মনে ভাবলো, আমি কি আমার এঞ্জেল টাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? সারপ্রাইজ দিতে চাওয়ার চক্করে আমার এঞ্জেল টাকে আঘাত করে ফেললাম নাতো? আদিত্য নূরের কপালে চুমু খেয়ে মনে মনে বললো, আজই শেষ সোনা। আর এমন হবে না। আমি আমার এঞ্জেল টাকে আর কাঁদতে দিবো না।
তারপর আদিত্য নূরকে কোলে তুলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। বেশি রাত হওয়ায় আদিত্য আর নূরকে খাওয়ার জন্য উঠালো না।নাহলে আবার মাথা ব্যাথা করবে ওর।
___
সকাল সাড়ে আটটার দিকে নূরের ঘুম ভাঙলো। নূর চোখ খুলে তাকিয়ে আজও আদিত্যকে পেলনা। নূর মলিন মুখে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। আর নিজের ওপর চরম রাগও লাগছে ওর। মরার যতো ঘুম আমার চোখেই কেন আসে? কেমন বউ আমি? নিজের স্বামীর আগে ঘুম থেকে উঠে তাকে একটু দেখতেও পারি না। আবার সে আসার আগেই ঘুমিয়ে পরি। কেমন হতচ্ছাড়া বউ আমি? আমার স্বামী সারাদিন এতো কষ্ট করে বাসায় ফেরে। আর আমি কিনা তার একটু সেবাও করতে পারি না। বউ নামের কলঙ্ক আমি। আমার কোন যোগ্যতাই নেই আসলে। এসব নানান কথা বলে নিজেকে বকতে লাগলো নূর। চোখ দুটো দিয়ে নীরবে পানি ঝরতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু সামলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর মন মরা হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। তবে নিচে কোন সার্ভেন্ট কে দেখতে পেল না নূর। নূর ভ্রু কুঁচকে ভাবলো আজকে সব সার্ভেন্ট গুলো গেল কোথায়? কাওকেই দেখছি না। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে কিছু টুংটাং আওয়াজ শুনতে পেল নূর। নূর ভাবলো হয়তো কোনো সার্ভেন্ট হবে। তাই ধীর গতিতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল নূর।
তবে রান্নাঘরের দরজায় এসেই চমকে গেল নূর।রান্নাঘরে অন্য কেউ না বরং আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে চুলায় কি যেন করছে। নূরের যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ও কি সত্যিই আদিত্যকে দেখছে? তারমানে আদিত্য আজ অফিসে যায়নি? আজ এতদিন পরে আদিত্যকে দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়লো নূর। নূর দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে আদিত্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
আদিত্য বুঝতে পারছে নূরের এই কান্নার কারণ। আদিত্য মুচকি হেসে নূরের হাত ছাড়িয়ে ওকে সামনে আনলো। নূর সামনে এসে আবারও আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আদিত্য কিছু না বলে নূরকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর নূর একটু শান্ত হয়ে আসলো। তবে এখনো ওভাবেই আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে আছে। আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–কতক্ষণ এভাবে থাকবে? ছাড়বে না?
নূর আদিত্যের বুকের মাঝেই মাথা নাড়াল। মানে সে ছাড়বেনা। আদিত্য বলে উঠলো।
–আরে বাবা আমার পাস্তা পুড়ে যাচ্ছে তো।
নূর আবারও আদিত্যর বুকের মাঝে থেকেই বাচ্চাদের মতো করে বললো।
–যাক পুড়ে।
আদিত্য হালকা হাসলো। তারপর দুই হাতে নূরের মুখটা উপরে তুলে, নূরের চোখের পানি মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বললো।
–আমার এঞ্জেল টাকে অনেক কষ্ট দেই শুধু তাইনা? আসলে আমি একটা পঁচা হাসব্যান্ড তাইনা?
নূর দ্রুত মাথা দুই দিকে নেড়ে দুই হাতে আদিত্যের মুখটা ধরে বলে উঠলো।
–না না একদম না। তুমি পঁচা না বরং আমি একটা পঁচা বউ।আমি বউয়ের কোন দায়িত্বই পালন করতে পারি না। তোমার বউ হওয়ার কোন যোগ্যতাই নেই আ,,,,
নূরের বাকি কথা শেষ করার আগেই আদিত্য তার অভিনব কায়দায় নূরের মুখ বন্ধ করে দিল। একটু পরে নূরের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বললো।
–আর কখনো যেন এসব ফালতু কথা না শুনি আমি। সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যর বউ হওয়ার সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতা হলো তোমার এই নিস্পাপ মন। যা অন্য কারো কাছে নেই। আর থাকলেও সেটা আমার জানার দরকার নেই। কারণ আমার বউ আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমনকি আমার নিজের থেকেও বেশি দামী সে বুজেছ? এখন কান্না বন্ধ করো। অনেক কান্নাকাটি হয়েছে আর না। আমি এতক্ষণ সহ্য করেছি আর সহ্য করতে পারবোনা। তাই লক্ষী মেয়ের মতো কান্না বন্ধ করে সুন্দর করে হাসি দাও।
আদিত্যের কথায় নূর হালকা হাসলো। তারপর বলে উঠলো।
–তুমি সকাল সকাল রান্না ঘরে কি করছো? আর সার্ভেন্ট রা কোথায়?
আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–আমি আজ সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। আজ শুধু বাসায় তুমি আর আমি থাকবো আর কেউ না। আর হ্যাঁ সকাল সকাল রান্নাঘরে এসেছি আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাতে।
নূর বলে উঠলো।
–তোমার বানাতে হবে না। তুমি গিয়ে রেস্ট নাও। আমি নাস্তা বানাচ্ছি।
–উহুম একদম না। তোমার কিছু করতে হবে না। আজকে আমি আমার এঞ্জেলের জন্য নিজের হাতে সব করবো।
আদিত্য নূরের কোমড় ধরে উঁচু করে রান্নাঘরের সিংকের ওপর বসিয়ে দিয়ে বললো।
–কোন কথা না বলে চুপচাপ এখানে বসো।আজকে তুমি তোমার হাসব্যান্ড এর কুকিং ট্যালেন্ট দেখবে।
নূর মুচকি হাসলো। আদিত্য একটা কাটা চামচে ওর মাত্র রান্না করা পাস্তা থেকে দুই টুকরো পাস্তা চামচে গেঁথে নূরের মুখের সামনে ধরে বললো।
–খেয়ে দেখেতো কেমন হয়েছে?
নূর মুচকি হেসে পাস্তা টা মুখে নিল। পাস্তা খেয়ে হাতের আঙুল 👌এমন করে বুঝালো অনেক ভালো হয়েছে। আদিত্য তৃপ্তির হাসি দিয়ে আবারও খাওয়াতে লাগলো।খাওয়াতে গিয়ে হঠাৎ পাস্তার একটু ঝোল নূরের থুঁতনি আর গলার নিচে পড়লো। নূর পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে মুছতে গেলে আদিত্য বাঁধা দিয়ে নেশা ভরা চোখে তাকিয়ে বললো।
–মুছতে হবে না। এতক্ষণ তুমি খেলে এখন আমার পালা।
কথাটা বলে আদিত্য নূরের থুতনি আর গলার নিচের অংশে লেগে থাকা ঝোল টুকু জিহ্বা দিয়ে লেহন করে নিল। নূর শিহরণে আদিত্যের চুল খামচে ধরলো। আদিত্য নূরের গলায় চুমু খেতে খেতে কানের কাছে এসে লো ভয়েসে বললো।
–মনে হচ্ছে এটুকুতে ক্ষুধা মিটবে না। ক্ষিদে আরও বেড়ে যাচ্ছে।
কথাটা বলে আদিত্য নূরকে কোলে তুলে নিল। তারপর নূরকে কোলে নিয়ে বেডরুমের দিকে এগুলো। আর নূর সবসময়ের মতো আদিত্যের বুকে মুখ গুঁজল।
আজ সারাদিন নূরের অনেক ভালো কাটলো।আজ কতদিন পর আদিত্য ওকে সময় দিচ্ছে। সারাদিন আদিত্য বাসায়ই আছে। নূরকে নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া, ওকে নিয়ে গল্প করা,ওকে নিজের হাতে রেডি করা। সবই করেছে আদিত্য। বিকেল চারটার দিকে আদিত্য নূরকে নিয়ে বের হয়েছে। নূর জিজ্ঞেস করলে বলেছে ওর জন্য নাকি সারপ্রাইজ আছে। তাই নূরও আর কিছু বলেনি। এতদিন পর আদিত্যকে পাচ্ছে এটাই তো অনেক।
আদিত্য নূরকে নিয়ে একটা নতুন নির্মিত ভবনের সামনে এলো। নূর দেখলো ভবনের সামনে আরো অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। ভবনের গেটের সামনে ফিতা টানানো। আর ফুল দিয়ে সাজানো। যেমনটা কোন জিনিসের উদ্ভোদনের সময় থাকে।
আদিত্য নূরকে নিয়ে ওখানে এসে দাঁড়াতেই সবাই তাকে সালাম দিতে লাগলো। নূর বুঝতে পারলো এরা আদিত্যর স্টাফ।
কিছুক্ষণ পর আদিত্য নূরের হাতে কেঁচি ধরিয়ে দিয়ে বললো।
–নাও ফিতাটা কাটো।
নূর একটু অবাক হয়ে বললো।
–আমি?
–হ্যাঁ তুমি নয়তো কে? এটা আমার নতুন ব্রাঞ্চ। তোমার হাতেই এটার উদ্ভোদন করতে চাই। নাও কাটো।
নূর একটু ইতস্তত করলেও আদিত্যের কথায় কেঁচি নিয়ে ফিতাটা কেটে দিল। ফিতা কাটতেই সবাই হাতে তালি বাজালো। আদিত্য এবার একটা পর্দার সামনে গিয়ে পর্দার রশিটা নূরের হাতে দিয়ে বললো।
–এখন এটা টান দাও।
আদিত্যের কথামতো নূর রশিটা টান দিতেই সামনের পর্দাটা দুই দিকে সরে গেল। পর্দা সরে যেতেই নূর আরও অবাক হয়ে গেল। কারণ এই ব্রাঞ্চ টা নূরের নামে করা। এটা দেখে নূর বিস্ময় ভরা চোখে আদিত্যের দিকে তাকালো।
আদিত্য তখন মুচকি হেসে বললো।
–হ্যাঁ এটা তোমার নামে। এই ব্রাঞ্চের কাজের জন্যই এতদিন এতো ব্যাস্ত ছিলাম। আর তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে কিছু বলিনি।
নূর যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কেমন রিয়াকশন দেবে ভেবে পাচ্ছে না ও। গলা জড়িয়ে আসছে ওর। নূর কোনরকমে নিজেকে সামলে আস্তে করে বললো।
–এক্সিকিউজ মি প্লিজ।
কথাটা বলে নূর দ্রুত ওখান থেকে সরে গিয়ে একটা কেবিনে ঢুকে পড়লো। কেবিনে ঢুকে মুখে হাত চেপে ধরে কেঁদে উঠলো নূর। আদিত্যও দ্রুত নূরের পিছে ছুটলো। কেবিনে ঢুকে নূরকে এভাবে কাঁদতে দেখে আদিত্যর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। আদিত্য নূরকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অপরাধী কন্ঠে বললো।
–সরি সরি সোনা,অনেক গুলো সরি।আমি জানি এইকয়দিনে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।আমি সত্যিই বলছি আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি। তোমার থেকে দূরে থাকা আমার জন্যও সুখকর ছিল না। আমারও অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কোন উপায় ছিল না। অফিসের কাজ শেষ করে আবার এখানে আসতে হতো।এখানকার কাজের চাপ বেশি তাই বাসায় যেতে যেতে দেরি হয়ে যেত। ব্যস্ততার কারণে তোমাকে ফোন করারও সময় পেতাম না। আর তুমি ফোন করলে আমি ইচ্ছে করেই ধরতাম না। কারন তোমার মলিন কন্ঠ শুনে আমি সহ্য করতে পারতাম না। তখন আমি দূর্বল হয়ে পরতাম।তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না।
নূর এবার আদিত্যের দিকে ঘুরে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।
–চাইনা আমার কোন সারপ্রাইজ। আর কখনো আমার সাথে এমন করবে না। জানো এইকয়দিনে কি অবস্থা হয়েছে আমার? মাথায় কতো খারাপ খারাপ খেয়াল এসেছে? খবরদার আর কখনো এমন সারপ্রাইজ দিবে না আমাকে। আমার কিচ্ছু চাইনা। আমার শুধু তোমাকে চাই।সবসময় তোমাকে আমার পাশে চাই। আর কিছু না।
–ওকে ওকে আই প্রমিজ আর কখনো এমন হবে না। এবার কান্না বন্ধ করো প্লিজ।
নূর কিছুক্ষণ পরে একটু শান্ত হয়ে গেল। আদিত্য নূরের কপালে চুমু খেয়ে ওর হাত ধরে আবারও বেরিয়ে এলো।
চলবে……
(কাল আমাদের এরিয়ায় কারেন্ট ছিল না। তাই কাল গল্প দিতে পারিনি।)