#মহুয়া
#শারমিন_আক্তার_সাথী
পর্ব:১৭
প্রিয়তি এবার হালকা গলায় বলল,
” সৃষ্টিকর্তা তোমাকে কী শাস্তি দিয়েছেন?”
” এই যে আমি দু দুটো সন্তান হারালাম। এর চেয়ে বড় শাস্তি কী হবে? যদিও প্রেমা যে সন্তানকে আমার বলে দাবি করেছে সে আদৌ আমার ছিলো কিনা তা আমি জানি না! তবে তবুও কষ্ট হয়েছিলো খুব। আর তোমার আমার সন্তান! যার আগমনের বার্তা শোনার কয়েকঘন্টা পরই তাকে হারালাম। প্রথম যখন তুমি বললে যে, তুমি আমার সন্তানের মা হবে, বিশ্বাস করো নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে মানুষ হচ্ছিলো। কিন্তু কয়েকঘন্টা পর ডাক্তার যখন বলল সব শেষ ঐ মুহূর্তে বার বার মনে হচ্ছিলো সৃষ্টিকর্তা আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। হয়তো আরো শাস্তি তিনি আমাকে দিবেন। কিন্তু যে সন্তান আসছে শুনে মাত্র কয়েকঘন্টায় মনে হাজারটা স্বপ্ন বুনে ফেলেছিলাম, মাত্র কয়েকঘন্টায় আমার সে স্বপ্নগুলো ছাই হয়ে উড়ে গেলো। আমি জানি আমার এ শাস্তিতে তোমার মনে শান্তি আসবে না, তুমি বরং আমাকে আরও বেশি শাস্তি দাও। যা তোমার মন চায়।”
প্রিয়তি কতক্ষণ চুপ করে রইলো। দূর রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোর দিকে কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে থেকে বলল,
” রিদু মজা কথা শুনবে?”
রিদু একটু অবাক হলেও বলল,
” হুঁ বলো।”
” তুমি বিয়ের আগে অবৈধ সম্পর্ক করলে, তোমার মতে তুমি অনেক শাস্তিও পেলে। প্রেমাও হয়তো ওর কৃতকর্মের শাস্তি একদিন ভোগ করবে। কিন্তু আমি কোন পাপের শাস্তি পেলাম? বিয়ের আগে তো আমার কারো সাথে বাজে সম্পর্ক ছিলো না। বাজে সম্পর্ক তো দূরের কথা কোনো ছেলের সাথে তেমন বন্ধুত্বও ছিলো না। কারো কোনো ক্ষতি করেছি বলে মনে পড়ছে না। যতদূর মনে পড়ে সর্বদা যাকে পেরেছি উপকার করেছি ক্ষতি কারো করিনি। তবে আমি কোন পাপের শাস্তি পেলাম? পরিবার হারালাম, বোন বিশ্বাসঘাতকতা করল, নিজের শারিরীক ক্ষতি হলো, স্বামী মিথ্যা বলল, ধোঁকা দিলো, সব শেষে সন্তান হারালাম। তোমাদের শাস্তির কাছে আমার শাস্তিটা কী হাস্যকর নয়?
তোমরা নাহয় অন্যায় করে শাস্তি পেলে? তবে কিসের দোষে আমি সবার চেয়ে বেশি শাস্তি পেলাম? আমাদের বিয়ের পর যত ঘটনা ঘটেছে, ঝামেলা হয়েছে বা যাই হয়েছে তাতে সবচেয়ে বেশি কথা আমি শুনেছি। সবচেয়ে বেশি কষ্ট কিন্তু আমি পেয়েছি। অথচ আমার অন্যায় কী ছিলো? প্রেম করলে তুমি আর প্রেমা, মজা নিলে দুজন মিলে। তোমাদের মজার ফল প্রথমে ভোগ করল প্রেমার আর তোমার অনাগত সন্তান। তারপর আমার সাথে বিয়ে হলো, তুমি স্ত্রী হিসাবে আমাকে সহ আমার পুরো অস্তিত্ব পেলে, সুখী হলে, প্রেমার হিংসা হলো, সে প্রতিশোধ নিলো তোমার উপর। পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম আমি, শারিরীক-মানসিক ক্ষতি হলো আমার, সন্তান হারালাম আমি, শাস্তি ভোগ করলাম আমি। তারপরও বলছো সৃষ্টিকর্তা তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন? বাহ মজার কথা বললে। প্রিয়তি তাচ্ছিল্য হেসে বলল, যাই হোক আজকাল এসব মজায় আমার হাসি পায় না। মন থেকে হাসিরা হারিয়ে গেছে। রিদু আরেকটা মজার ডায়লগ শোনো তুমি, প্রেমা আর আমার সম্পর্ক নিয়ে বলতে গেলে, মজা তুমিও পাইছো, প্রেমাও পেয়েছে কিন্তু মাঝখান থেকে শাস্তি প্রিয়তি নামের হতভাগী মেয়েটা পেলো।”
প্রিয়তি আর কোনো কথা না বলে ব্যালকনি থেকে উঠে রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বসে থাকার মতো শক্তিটা এখন নেই ওর। শরীটা কাঁপছে খুব। পেটেও খুদায় চো চো করছে কিন্তু খাবার খাবার রুচি নেই। বিশেষ করে হসপিটালের কেবিনে বেডে শুয়ে রিদুর বাবার বলা কথা গুলো শোনার পর এ ঘরের খাবার গুলো যেনো বিষ মনে হচ্ছে। রিদুর বাবা বা বাকি সবাই ভেবেছে প্রিয়তির হয়তো হুঁশ নেই। কিন্তু চোখ বন্ধ করে প্রিয়তি সবই শুনেছে। প্রিয়তি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল। চোখের কোন বেঁয়ে কিছু নোনা তরল আবার বালিশের গহিনে হারালো।
রিদু এতক্ষণ ব্যালকনিতেই ঠায় বসে ছিলো। প্রিয়তির বলা প্রতিটা কথা বারংবার ভাবছে। সত্যি তো অন্যায় সবাই করলো মাঝখান থেকে সবচেয়ে বেশি শাস্তি কেবল প্রিয়তিই পেলো। রিদু প্রিয়তিকে শুয়ে থাকতে দেখে ওর পাশে এসে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” ঘুমিয়ো না। কিছু খেয়ে তারপর ঘুমাবে।”
প্রিয়তি ধীর গলায় বলল,
” খিদে নেই।”
” তা বললে তো হবে না। তোমার শরীর প্রচন্ড দুর্বল। না খেলে তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি বসো আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
রিদু রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো হৃদিতা প্রিয়তির জন্য ট্রেতে খাবার নিচ্ছে। রিদুকে দেখে বলল,
” ভাই এগুলো নিয়ে যেতে আমাকে সাহায্য কর তো। ভাবিকে কিছু খাওয়াতে হবে। দেখ অসুস্থ মুখে ঝাল ঝাল খাবার ভালো লাগবে। ঝাল দিয়ে চিংড়ি মাছ ভূনা করেছি, ভাবির তো পছন্দ। সাথে ভাত আর দু তিন রকমের সবজি। আর এই মগটায় দুধ। ভাবি চাইলে দুধ দিয়ে ভাত খেতেও পারবে।”
” হুঁ খুব ভালো করেছিস। চল এখন”
খাবার গুলো বিছানায় রেখে হৃদিতা প্রিয়তিকে ডাকল।
” ভাবি ওঠো। খেয়ে নিবে।”
” আমার খিদে নেই হৃদি।”
” বললেই হলো। সারা দিন কিছু খাওনি। চলো খাবে।”
” নারে।”
” ভাইয়া খাইয়ে দিবে?”
” নাহ।”
হৃতিদা রিদুর দিকে তাকিয়ে বলল,
” ভাই জানিস। পৃথিবীতে মেয়েরা বড় অসহায়। তোরা ছেলেরা তাদের কষ্ট দিতে বিন্দু মাত্র ছাড় দিস না। রিদু মাথা নিচু করে ফেলল। হৃদিতা বলল, হসপিটালে বাবার বলা কথাগুলো মা আমাকে বলেছে। সত্যি মাঝে মাঝে নিজের আপন মানুষদের এমন জঘণ্য রূপের কথা শুনলে রাগ হয় প্রচন্ড। আর তোর কথা কী বলবো? তোর কোনো বিষয় তো আমার অজানা নয়। যা হোক তুই রুম থেকে একটু বাইরে যা। ভাবীর সাথে কিছু কথা আছে আমার।”
রিদু বাইরে যেতেই হৃতিদা প্রিয়তিকে ধরে বসিয়ে বলল,
” চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় ভাবি।”
” প্রিয়তি নিশ্চুপ।
” শোনো ভাবি তোমার বোনের আর ভাইয়ার বিষয়টা আমি সেই প্রথম থেকেই জানি। ভাইয়া আমার কাছ থেকে কিছু লুকায় না। তোমার হয়তো অবাক লাগতে পারে তবে গত কয়েকদিনের ঘটনা শুনে আমি আজ বিকালে ভাইয়াকে চড় মেরেছি। আমি ছোট বোন হিসাবে বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলিনি বরং একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের হয়ে প্রতিবাদ করেছি। মাও সব শুনেছে। তিনি ভাইয়ার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। বলেছেন যতদিন না তুমি ভাইয়াকে ক্ষমা করবে ততদিন মা ভাইয়ার সাথে কোনো কথা বলবে না।”
প্রিয়তি বেশ অবাক হয়ে বলল,
” মা জানেন এসব?”
প্রিয়তিকে কথার জালে ফেলে হৃদিতা ঠিকই ওকে ভাত মেখে খাওয়াচ্ছে। প্রিয়তি সেদিকে খেয়াল নেই। হৃদিতা প্রিয়তির মুখে আরেক লোকমা ভাত দিয়ে বলল,
” আগে জানতেন না। আজ ভাইয়া আমাকে বিগত কয়েবদিনের কথা বলার পর আমি মাকে বলেছি। মায়ের আর আমার সাপোর্ট সর্বদা তুমি পাবে। তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার মন খুব নরম। এক কথায় তুমি বলদ টাইপ মেয়ে। ভাইয়া একটু নরম হয়ে সরি বললে যেনো গলে যেও না। তুমি এত দ্রুত তাকে ক্ষমা করবে না। কাঁদিয়ে নাকানি চুবানি খাইয়ে তবে তাকে ক্ষমা করবে।
জানি ক্ষমা না করে তো পারবে না। সংসার ভাঙা তো সহজ নয়। বিয়ে করেছো সব কিছু মানিয়ে বা নিজে গুছিয়ে নিয়ে হলেও সংসার করতে হবে। একটা সম্পর্ক ভাঙার মত পাপ খুব কমই আছে। আর আমার পুরো কথা শোনার পর না হয় বাকিটা তুমি ভেবে দেখো। তাছাড়া দেখতে গেলে দোষ তোমার বোনের বেশি। হ্যাঁ ভাইয়ের মস্ত পাপ এটাই বিয়ের আগে লুলামি মারাইছে। তবে সে কিন্তু তোমার বোনকে বিয়ে করতে এক পায়ে রাজি ছিলো। তোমার বোনই ভাইয়াকে চিট করেছে।
তুমি হয়তো জানো না প্রেমার চিট করার পর ভাইয়া এতটা ভেঙে পড়েছিলো যে, মাঝে মাঝে মরার কথা বলতো। একদিন তো ঘুমের ট্যাবলেট কিনে এনেছিলো রাতে খাবে বলে। আল্লাহ মেহেরবান যে আমি সেটা দেখে ফেলেছিলাম। পরে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ভাইয়াকে ঠিক করেছি। তাকে স্বাভাবিক করতে কম কষ্ট হয়নি আমাদের।
তোমার বোন আমার ভাইটার জীবন তো নষ্ট করার চেষ্টা করেছে, তখন ব্যর্থ হয়ে, এখন আবার তোমার জীবনে অশান্তি করছে। অামার কী মন চায় জানো তোমার বোনের জায়গামত বোম্বাই মরিচ দিয়ে সব বিষ কমিয়ে দি। কিন্তু সেটা করতে না পেরে আফসুস হচ্ছে। তুমি কি আরেকটু ভাত নিবে?”
প্রিয়তি খেয়াল করল, ও অনেক ভাত খেয়ে ফেলছে। হৃদিতার দিতে তাকিয়ে বলল,
” এত ভাত কখন খেলাম?”
” বয়সে তোমাদের চেয়ে ছোটো কিন্তু বুদ্ধিতে নই। কাকে কিভাবে সামলাতে হয় জানি। তুমি আজ থেকে আমার কথামত চলবে নয়ত নিজের মস্তিষ্কের কথা শুনবে। খবরদার মনের কথা শুনবে না। দেখবে তোমার বোন আর আমার ভাই দুটোকে কিভাবে শায়েস্তা করি। তোমাদের বিয়ের আগে ভাইয়াকে বার বার করে বলেছি, তার পূর্ব সম্পর্কের কথা যেনো না লুকায়। পরে জানতে পারলে সমস্যা বাড়বে কিন্তু ছাগলটা আমার কথা শোনেনি। এখন ওর ছাগলামির জন্য যদি ওকে আমি ঘাস, লতা, পাতা আর কাঁঠাল পাতা না খাইয়েছি তবে আমার নাম হৃদিতা নয়। এখন আমি যা বলি তুমি মন দিয়ে শোনো।”
চলবে________
“