মাতাল_হাওয়া পর্ব ১৪

#মাতাল_হাওয়া
#১৪ম_পর্ব
#তাসনিম
পরদিন সঙ্গীতে সবাই একে একে নেচে গেয়ে পারফর্ম করলো। এখন সবাই নিরবকে ধরলো গান গাওয়ার জন্য। নিরবের গানের গলা অনেক ভালো। নিরব প্রথমে রাজি না হলেও পরে সবার জোরাজোরিতে রাজি হল।

“আমি পারিনি তোমাকে
আপন করে রাখতে
আমি পারিনি তোমাকে
আবার আমার করে রাখতে
তুমি বুঝোনি আমি ভুলিনি
তুমি স্বপ্নতে কেনো আসো নি
আমার অভিমান
তোমাকে নিয়ে
সব গেয়েছি।”

নিরবের গান শেষ হলে তুলির মনে হলো নিরব তুলিকে নিয়েই এইগান গেয়েছে। তুলির উপর অভিমান করেই এইগান গেয়েছে। নিরব পুরো গান গাওয়ার সময় তুলির দিকেই একনজরে তাকিয়ে ছিল। তুলির চোখে পানি চিকচিক করছে। এত আবেগ এত আদর দিয়ে গানটা গেয়েছে নিরব তুলির অজান্তেই ওর মনের মধ্যে সূক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু উনি আমাকে নিয়ে কেনই বা গান গাবে উনার তো এখন নিলীমা আছে। এবার আর বাধ মানলো না ঠুস করে জল গরিয়ে পরল তুলির চোখ থেকে। তুলি অন্যসাইডে চলে গেল। তুলি যখন কান্নায় ব্যাস্ত তখন পিছনে কারো আভাস পেল। পিছন ফিরতে নিলেই ধাক্কা খেল কারো সাথে তুলির আর বুঝতে বাকি নেই এটা নিরব ছাড়া আর কেউ না। এই মাতাল করা ঘ্রাণ যে নিরব ছাড়া আর কারো না সেটা তুলি খুব ভালভাবে জানে। নিরবের মাতাল করা ঘ্রাণ তুলির কাছে অসাধারণ লাগে। তুলিকে কান্না করতে দেখে নিরবের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। আলতো হাতে তুলির চোখের পানি মুছে দিল। তুলির চোখে চুমু খেল। তুলি আবেশে নিরবের শার্ট খামছে ধরলো। নিরব তুলিকে বুকে জরিয়ে নিলো। তুলি মনে মনে ভাবলো আজীবন যদি এভাবেই উনার বুকে থাকতে পারতাম!!!

একে একে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। আজ রায়নার বিয়ে। রায়নাকে আজকে কোনো পুতুলের থেকে কম লাগছেনা। অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। তুলি ঠেস মেরে বললো,

—– বাহ!! তোকে যা লাগছে না আজকে। রাকিব ভাই দেখে না জানি আবার ফিট হয়ে যায়। আজকে শিউর থাক রাকিব ভাই তোকে ভালোবাসার সাগরে ডুবিয়ে মারবে।

তুলির কথা শুনে রায়না প্রচুর লজ্জা পেল আর বললো,

—- বলে নে এখন যা বলার একদিন আমারও টাইম আসবে। হুম দেখে নিস। তখন আমিও তোকে সেই পচান পচাবো।

হাসিঠাট্টার মধ্যেই সবাই বর এসেছে বর এসেছে বলে চেচিয়ে উঠলো। তুলি রায়নাকে নিয়ে স্টেজে নামলো। নিরব তুলিকে দেখে ওর পা দুটো যেন জমে গেল এতো সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। লাল কালারের সারারা পরেছে কিন্তু আজকে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দেয়নি হাল্কা কালারের লিপস্টিক দিয়েছে। চুলগুলো কার্ল করেছে হালকা তাতেই যেন ওর রুপ উপচে পরছে। নিরব চোখ ফেরাতে পারছে না। নিরবকেও কোনো অংশে কম লাগছে না। ব্ল্যাক কালারের পাঞ্জাবিতে অনেক বেশি হেন্ডসাম লাগছে। চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাতাল করা ঘ্রাণের পারফিউম দিয়েছে একটা। তুলির তো নিরবকে দেখে হার্টঅ্যাটাক ই হয়ে যাচ্ছে যেন এমন অবস্থা। ইশ! এই ছেলেটাকে দেখলে পাগল পাগল লাগে কেন এতো?? সবমেয়ে গুলো চিবিয়ে খাচ্ছে উনাকে মন তো চাচ্ছে মেয়েগুলার মাথার চুল সব টেনে ছিড়ে ফেলি আর উনাকেও খালের পানিতে চুবাতে পারলে একটু শান্তি লাগতো। “বেটা খাটাশ একটা!! সবাইকে দেখাতে হবে যে দেখো আমি কত সুন্দর!!” তুলি মুখ ভেংচি মেরে মনে মনে বলে উঠলো।

হুট করে তুলি নিলীমাকে দেখলো। সাথে সাথেই তুলির মন ভিষণ খারাপ হয়ে গেল। তুলি পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে নিলীমা ডেকে উঠে তুলিকে,

—– তুলি!! কেমন আছো? আর আমাকে দেখে এভাবে পালিয়ে যাচ্ছিলে কেনো??

—- কই না তো আপু। আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

— ভালো আছি।

পাশ থেকে একজন বলে উঠলো,

— আরে এইটা কি নিরবের সেই তুলি??

নিলীমা মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। রায়হান আবার বলে উঠলো,

—– বাহ!! নিরবের কাছে তোমার যেমন বর্ণনা শুনেছি তুমি তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দরী। সরি তুমি করে বললাম। তুমি আমার থেকে অনেক ছোট হবে তাই তুমি করে বললাম।

তুলি ঠিক চিনতে পারলো না লোকটাকে। নিলীমা হেসে জবাব দিল,

—– তুলি মিট মাই হাসবেন্ড রায়হান। আর রায়হান তুমি তো তুলিকে চিনেই গেছো তাই আর কি পরিচয় দিব।

তুলি যেন আকাশ থেকে পরলো নিলীমার কথা শুনে। হাসবেন্ড মানে তাহলে ওইদিন যে নিরব বললো নিলীমা উনার হবু বৌ। নিলীমা তুলির অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,

—- ওহ আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তোমার আর নিরবের মধ্যে সব ঠিক হয়নি। আর পাগলটা ও কিছু বলেনি তোমাকে। আমি কত করে বললাম সব ঠিক করে নে শুধু শুধু নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস মেয়েটাকে ও দিচ্ছিস। আমি নিরবের ভার্সিটি ফ্রেন্ড। আমি, রায়হান, নিরব এক ভার্সিটিতে পড়তাম। ওইখান থেকেই রায়হানের সাথে আমার প্রেম, ভালোবাসা অতপর বিয়ে। নিরব ওইদিন তোমার সাথে নাটক করেছে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আসলে তুলি ভালোবাসা খুব নাজুক একটা ফিলিংস। তুমি নিরবকে না বলে বাসা থেকে চলে গিয়েছিলে নিরব অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছিল। আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে অনেক বিঃশ্বাসও কর‍তে হয় না হয় ভালোবাসায় ফাটল ধরে। বিঃশ্বাসটা আসল ভালোবাসায়। তোমার নিরবকে বিঃশ্বাস করা উচিৎ ছিল। যে মানুষটা তোমার হাত ধরে আজীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছে, তোমাকে আজীবন ভালোবাসতে চেয়েছে তাকে তুমি বিঃশ্বাস কর‍তে পারোনি। তাকে কিছু না জানিয়ে তুমি চলে গিয়েছিলে যার জন্য নিরব অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে। যাইহোক নিজেদের মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে নাও। নিরব খুব ভালো ছেলে তুলি। ওর জীবনে তুমি ছাড়া আর কেউ কখনো ছিল না।

তুলি সব শুনে কান্নায় ভেংগে পরে। ও আসলেও নিজের অজান্তে নিরবকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মনের ভিতর অজানা এক ভালো লাগা কাজ করছে ওর নিরব শুধু ওরই আছে এই কথা ভেবে। কিন্তু লোকটাকে কি সাধে খাটাস বলি আসলেও একটা খাটাস আমি না হয় ভুল করে ফেলেছি তাই বলে এতো বড় শাস্তি দিবে। আমার যে কত কষ্ট হচ্ছিলো তার কোনো হিসাব আছে উনার কাছে। নিরব দূর থেকে দারিয়ে তুলিকে দেখলো ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে। নিরব ইশারা দিয়ে জিজ্ঞেস করল “কি??” তুলি ইশারা দিয়ে বুঝালো “কিছু না!!” নিরব আবার কথায় ব্যস্ত হয়ে পরলো।

তুলির খুব হাসফাস লাগছে তাই ভাবলো উপরে যেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিবে। উপরে গিয়ে দেখলো রহমান সাহেব বিছানায় শুয়ে আছে আর ছটফট করছে। তুলি দৌড়ে রহমান সাহেবের কাছে গিয়ে বললো,

—- খালু কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? খুব বেশি খারাপ লাগছে? ডাকবো সবাইকে?

রহমান সাহেব তুলির হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। তুলি এবার রেগে বললো,

—— খালু আপনার যা রাগ করার পরে করবেন। এখন যদি আর একবার রাগ দেখিয়েছেন তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি সবাইকে ডাকছি।

রহমান সাহেব যেন বোকা বনে গেল তুলির ধমকে। কিন্তু আস্তে করে বলে উঠলো,

—- না কাউকে ডেকো না। খামাখা বিয়ের মজাটা নষ্ট হবে। তুমি আমাকে একটু হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবে। আমার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করছে।

তুলি তারাতাড়ি করে রহমান সাহেবকে নিজের উপর ভর দিয়ে দাড়া করিয়ে হসপিটালে নিয়ে গেল। খবর শুনে নিরব, সালেহা বেগম আরও বাকি সবাই হসপিটালে চলে এলো। ডাক্তার বের হয়ে বললো,

—– পেশেন্ট এখন ডেঞ্জার মুক্ত। মাইনর একটা হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। যদি এইমেয়েটা (তুলিকে দেখিয়ে) টাইম মতো না আনতো তাহলে বড় কিছু হয়ে যেতে পারতো। বাকিটা মহান আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।

সবাই হাফ ছেড়ে বাচলো। সালেহা বেগম তুলির কপালে চুমু দিয়ে বললো,

—- আমার লক্ষী মা টা!! তোকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিব বুঝতে পারছি না।

—- ছিহ খালামনি!! কি বলছো এসব। আমি তোমাদের মেয়ে না। নিজের বাবার এমন অবস্থায় সাহায্য করবো না তো কি করব শুনি??

নিরব তুলির দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো। তুলি নিরবকে আঃশ্বাস দিয়ে বললো সব ঠিক হয়ে যাবে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here