মাতাল_হাওয়া পর্ব ১৫

#মাতাল_হাওয়া
#১৫ম_পর্ব
#তাসনিম
রহমান সাহেব সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। তুলি হসপিটালের থাকাকালীন রহমান সাহেবের অনেক যত্ন করেছে। সময় মতো ঔষুধ খাওয়ানো, সঠিক টাইম মতো খাবার খাওয়ানো সবই করেছে তুলি এই কয়দিন। নিরবের সাথে দেখা হলে দুইজনই আড় চোখে দুইজনের দিকে তাকিয়ে চলে যেত। বাসায় ফেরার পর তুলি ভাবলো এখন তার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। তাই সালেহা বেগমকে বললো,

—- খালামনি! খালু আল্লাহ রহমতে সুস্থভাবে বাসায় ফিরে এসেছে এখন আমার যাওয়া দরকার। কিন্তু যে কোনো দরকারে আমাকে বলবে খালামনি ঠিকাছে?? আমি একদৌড়ে চলে আসবো।

সালেহা বেগম মন খারাপ করে বললো,

—- না গেলে হয় না মা!! তোর খালু একটু সুস্থ হয়ে নেক আমি উনার সাথে কথা বলবো। তুই যাস না মা আমি ভিষণ একা হয়ে যাই রে। তোকে ছাড়া আমার খুব একা লাগে মা। সারাজীবন কোলেপিঠে করে তোকে মানুষ করেছি তার কি কোনো দাম নেই???

এই বলে সালেহা বেগম কান্নায় ভেংগে পরলো।

— ছিহ খালামনি!! কি বলসো এসব?? নিজের বাবা মা কে তো কখনো দেখিনি। তোমাদের ছোট থেকে বাবা মা ভেবে এসেছি। তোমারা ছাড়া আমার কে আছে বল। আর আমি তো একে বারে চলে যাচ্ছিনা।মাঝে মাঝেই আসবো তোমাদের খোজখবর নিতে।

সালেহা বেগম কান্না থামিয়ে বললো,

—- তোর খালু তোকে অনেক স্নেহ করে হয়তো বলতে পারে না। মানুষটা এমনই জানিস খুব রিজার্ভ। কাউকে মনের কথা বুঝতে দিবে না। নিরবটা ও ঠিক তোর খালুর মতোই হয়েছে।

তুলি ছলছল চোখে বলে উঠলো,

—- আমি জানি খালামনি খালুও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমিও উনাকে বাবার মতোই মানি। অনেক শ্রদ্ধা করি।

সালেহা বেগম তুলির দিকে কথা ছুড়ে দিল,

—- আর নিরব?? ওকে ভালোবাসিস না??

তুলির নিরবতাই অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলো সালেহা বেগমকে। উনি তুলির চুপটি দেখে আর কোনো কথা বারালো না। হালকা গলায় বললো,

—- তোর খালুর কাছে চল। উনাকে বলে তারপর চলে যাস। কিছু বলবো না।

তুলি সালেহা বেগমের কথা ফেলতে পারলোনা। উনার সাথে চুপচাপ খালুর রুমে গেল। রহমান সাহেব বিশ্রাম করছিল তুলি আর সালেহা বেগমকে একসাথে দেখে উঠে বসলো। তুলি দূরে দাঁড়িয়ে হালকা গলায় বলে উঠলো,

— খালু আমি তাহলে আসি। নিজের খেয়াল রাখবেন। আর সময় মতো ঔষুধ গুলো খাবেন।

রহমান সাহেব তুলির কথা শুনে ব্রু কুচকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

—- তো কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি???

—- খালু আমরা কিছু বান্ধবী মিলে একসাথে থাকি। ওখানেই যাচ্ছি।

তুলির কাপাকাপা স্বর শুনে রহমান সাহেব ধমকে উঠে বললো,

— এক থাপ্পড়ে সবকয়টা দাত ফেলে দিব। ফাযিল মেয়ে বেশি বড় হয়ে গেছো তাই না?? ঔইবার কিছু বলিনি বলে ভেবোনা এইবারো কিছু বলবো না। কোথাও যাওয়া হচ্ছেনা তোমার।

তুলি ধমক শুনে কেদে দিল। রহমান সাহেবের তুলির কান্না দেখে বুকে কেমন যানি করে উঠলো। বেশি বকে দিল নাকি মেয়েটাকে। আহ্লাদ স্বরে বলে উঠলো,

—- সেকি মা কাদসিস কেনো?? বেশি বকে দিয়েছি?? থাক কান্না করিস না মা আর বকবো না। বুড়ো হয়ে গেছি তো মা তাই একটু খিটখিটে মেজাজ হয়ে গেছে।এই যে কানে ধরছি দেখ!!

তুলি কান্না করতে করতে লাফিয়ে যেয়ে রহমান সাহেবের বুকে লুটিয়ে পরলো। রহমান সাহেব তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে আদরমাখা কন্ঠে বললো,

এই বুড়ো বাপটা কে কি মাফ করা যায় না মা?? না বুঝে শুধু ছোটরাই ভুল করে না অনেক সময় বড়োরাও ভুল করে ফেলে। আমিও ভুল বুঝেছিলাম মা। মাফ করে দেয় আমাকে।

তুলি রহমান সাহেবের দুইহাতের তালুতে চুমু খেলো। কান্না মাখা কন্ঠে বললো,

—- বাবা হয়ে মেয়ের কাছে মাফ চাইতে হয় না মেয়ের মাথায় হাত রেখে দোয়া দিতে হয়। আপনি আমার বাবা আমি আপনাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। আর কখনো আমার কাছে মাফ চাইবেন না। শুধু দোয়া দিবেন। আপনি সেদিন অসুস্থ হয়ে যখন ছটফট করছিলেন আমার মনে হচ্ছিলো আমার পুরো দুনিয়া অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। অনেক ভালোবাসি আপনাকে আর খালামনিকে। মা বাবাকে হারিয়েছি আপানাদের হারানোর ক্ষমতা নেই আমার।

রহমান সাহেব তুলির চোখ মুছে দিয়ে বললো,

— সালেহা!! আমার মেয়েকে আমার কাছে রাখার পারমানেন্ট ব্যবস্থা করো। যাতে মেয়ে চাইলেও যেতে না পারে। আমার নিরবের জন্য তুলির চেয়ে ভালো মেয়ে কেউ হতেই পারবে না। আমার নিরব আর তুলির বিয়ের ব্যবস্থা করো।

সালেহা বেগম প্রাণখোলা হাসি হেসে মাথা নাড়লো। আজকে উনার মন খুশীতে ভরে গেছে। নিরব দরজার বাহিরে থেকে সবকিছু দেখলো। খুশীর বন্যা বয়ে যাচ্ছে ওর মনে। বাবা এতো সহজে মেনে নিবে কখনো কল্পনাও করেনি নিরব। এবার আর তুলিকে আপন করে নিতে কোনো বাধা নেই। তুলি শুধু নিরবেরই থাকবে আজীবন। তুলি হুট করে নিরবের ছায়া আয়নায় দেখতে পেলো। মনে মনে ভাবলো,
“ওহ তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে সব শুনছে। না এতো সহজে রাজি হবে না ও। এই খাটাসটা কম কষ্ট দেয়নি ওকে এইবার আমিও মজা দেখাবো উনাকে। বেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাবে তুলি কি জিনিস!!” তুলির মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সাথে সাথে বলে উঠলো,

— খালু আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি যতটুকু জানি নিরব ভাইয়ের অলরেডি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।ইভেন আমাকে উনার হবু বৌয়ের সাথে পরিচয় ও করিয়ে দিয়েছিল। তাহলে উনার সাথে আমার বিয়ে তো ইম্পসিবল। আমি অন্য একটা মেয়ের হবু বরকে তো ছিনিয়ে নিতে পারি না। তবে হ্যা আপনাদের মেয়ে হয়ে আমি এইবাড়িতে আজীবন থাকতে রাজি।

তুলি এসব বলে চুপচাপ নিরবের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রহমান সাহেব আর সালেহা বেগম তো আকাশ থেকে পরলো। এসব কি বলে গেল মেয়েটা?? নিরবের বিয়ে!! যে ছেলে তুলির জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গেছিলো সেই ছেলের বিয়ে ঠিক। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে গেল দুজনের। সালেহা বেগম নিরবের মাথায় চাটি মেরে বললো,

—- কিরে কি বলে গেল মেয়েটা?? হুম?? কি গুল খেলেছিস আবার ওর সাথে?? দেখ মেয়েটাকে আর কষ্ট দিস না এইবার হাত ছাড়া হলে আর পাবিনা।

নিরব ঠোঁট কামড়ে হাসলো। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,

— ও কিছু না মা!! আমি সামলে নিবো। তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা করো।

এইবলে লজ্জায় সেখান থেকে প্রস্থান নিল নিরব। কিন্তু ওর মাথায় ঢুকছে না তুলি এইকথা কেন বললো। ও যতটুকু জানে রায়নার বিয়েতে নিলীমা তুলিকে সব বলে দিয়েছে। নিলীমা নিজে আমাকে বলেছে যে ও তুলিকে সব বলে দিয়েছে। তাহলে আজ কেন এইকথা উঠালো তুলি?? ওহ তার মানে মেডামের অভিমান এখনো কমেনি। যাহ ভায়া নিরব!! এখন তো সুন্দরী রূপসীর অভিমান ভাঙ্গাতে হবে। তারপরই না বিয়েতে রাজি হবে না হয় আজীবন চিরকুমার থাকতে হবে।

রহমান সাহেব কিছু না বুঝে সালেহা বেগমকে জিজ্ঞেস করল,

— সালেহা!! কি হলো বলো তো ওদের মধ্যে??

সালেহা বেগম মুচকি হেসে জবাব দিলো,

— তুমি না আসলেই বুড়ো হয়ে গেছ। হয়েছে হয়তো দুজনের ভিতর কোনো খুনসুটি। ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করোনা।

রহমান সাহেব সালেহা বেগমের একহাত ধরে বললো,

—- শরীর থেকে বুড়ো হলেও মন থেকে এখনো কিন্তু আমি তাগড়া জোয়ান। তোমার হাসিতে আমি এখনও নির্বাক হয়ে যাই মনে হয় এখনো সেই ঝুটি করা যুবতীর হাসি দেখছি। জানো সালেহা!! তোমাকে দেখলে আমার হাজার বছর বাচতে ইচ্ছা হয়।

সালেহা বেগম স্বামীর কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো, “ইশ! এই মানুষটার যদি কিছু হতো ওইদিন আমি বাচতাম কেমন করে। আল্লাহ!! উনার মৃত্তুর সাথে আমাকেও মৃত্তু দিও। উনাকে ছাড়া বাচা আমার জন্য অসম্ভব।

তুলি আলমারিতে ওর কাপড় গুছিয়ে রাখছিল। হুট করে কারো হেচকা টানে চিল্লাতে নিয়েও চুপ হয়ে গেল কারণ সেই মানুষটি তার মুখ হাত দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। নিরব তুলির এতো কাছে দুজন দুজনের গরম নিঃশ্বাসের উত্তপ্ত ছোয়া পাচ্ছে। তুলি নিরবকে দেখে ঠেলে সরাতে চাইলো কিন্তু এতো বড় একজন মানুষের সাথে কি আর ও পেরে উঠবে। কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি করে তুলি হাপিয়ে উঠে মুখ ফুলিয়ে নিজের ভড় ছেরে দিল। নিরব তা দেখে ব্রু নাচিয়ে বললো,

—- শেষ সব শক্তি??? এইশক্তি নিয়ে তুই আমার সাথে ফাইট করতে চাস? বাব্বাহ!! বৌ তো আমার অনেক সাহসী।

—- খবরদার আমাকে বৌ বলবেন না? কেনো হবু বৌয়ের শখ মিটে গেছে যে এখন আমার কাছে এসেছেন। যান না নিজের হবু বৌয়ের কাছে।

নিরব তুলির কথা শুনে গা কাপিয়ে হেসে উঠলো। তুলি নিরবের হাসি দেখে জমে গেল। সব রাগ ধুয়ে পানি হয়ে গেল। “ইশ!! এই ছেলেটা কেনো এতো সুন্দর করে হাসে। ধেত ভালো লাগে না ছাই!! উনার হাসি দেখলেই আমি গলে যাই। তাহলে সারাজীবন ঝগড়া করবো কিভাবে?? আমার তো খুব ইচ্ছা ছিল নিজের স্বামীর সাথে মিষ্টি মিষ্টি ঝগড়া করবো। কিন্তু উনার হাসি দেখলেই তো নিজেকে পাগল পাগল লাগে, সুখ সুখ অনুভূত হয়। তুলিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিরব ঠুস করে তুলির নাকে চুমু খেল। তুলি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল। নিরব তুলির লজ্জা পাওয়া দেখে বললো,

—- ইশ!! এইটুকু চুমুতেই এতো লজ্জা?? বাসর রাতে যখন সবজায়গায় চুমু বসাবো তখন কি হবে তোর?? আবার নাকি ফিট হয়ে যাস এই চিন্তায় আছি আমি।

তুলি লজ্জায় কিছু বলতে পারছেনা। মনে মনে হাজার বকা দিচ্ছে নিরবকে। সারাক্ষণ শুধু লজ্জা দিবে তুলিকে লুচু ছেলে একটা। তুলি চোখ বন্ধ করে বললো,

—- আপনাকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। করবো না বিয়ে আমি আপনাকে। যান নিজের উড বির কাছে যান।

— তুলি সবজেনেও কেনো না জানার ভান করছিস বল?? নিলীমা তোকে সব বলে দিয়েছে জানি। সরি!! মানলাম তোর সাথে এমন করা ঠিক হয়নি কিন্তু তুই যা করেছিস তা কি ঠিক হয়েছে একবার নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখ!!

তুলি ছলছল চোখে নিরবের দিকে তাকালো আসলেই তো ও না জেনে বুঝেই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে নিরবকে। নিরব তুলির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

— প্লিজ কান্না করিস না। তোর চোখে পানি দেখলে আমার বুকে রক্তক্ষরণ হয়। আমরা দুজনি কষ্ট পেয়েছি তাই হিসাব শোধবোধ। আর তারপরো যদি বিয়েতে রাজি না হোস তাহলে আর কি করার বিয়ের আগেই দুইটা বাচ্চা ফুটিয়ে নিব। এটলিস্ট বাচ্চার টানেও তো বিয়েটা করবি আমাকে।

চোখ টিপ মেরে নিরব বলে উঠলো। তুলি লজ্জা পেয়ে নিরবের বুকে একঘা মারলো। নিরব হেসে তুলিকে বুকে জরিয়ে নিল। তুলি পরম আবেশে নিরবের বুকে চুপটি করে মুখ গুজে রাখল। এই বুকটা তার আজীবনের জন্য হতে যাচ্ছে ভেবেই বুকের মাঝে সূক্ষ্মভাবে সুখ অনুভূত হচ্ছে তুলির।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here