মিসেস চৌধুরী পর্ব ১৬+১৭

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_16
#Writer_NOVA

পরের দিন………

আকশি ও আদিয়াত একটা দরকারী কাজে অফিসে এসেছে। কিন্তু অফিসের একজন কর্মচারী থেকে জানলো আজও ফিহা অফিসে আসবে না।আদিয়াত চলে যেতে নিলে আকশি ওকে টেনে ভেতরের দিকে নিয়ে গেল।

আদিয়াতঃ টেনে এখানে নিয়ে এলি কেন?
আকশিঃ আমরা এখানে কেন এসেছি তুই ভূলে গেছিস। কাজ না করে চলে যাবো।
আদিয়াতঃ কিন্তু ফিহাতো নেই।
আকশিঃ ফিহা না থাকায় তো সুবিধা হয়েছে। এখন আমরা অনায়াসে কেবিনে গিয়ে আমাদের কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে যাবো।
আদিয়াতঃ ফিহা থাকলে কেবিনে ঢুকতে সুবিধা হতো।এখন কেবিনে ঢুকলে চোর সন্দেহ করে গণধোলাই ফ্রী তে পেয়ে যাবি।আগেরবার দারোয়ানের ধাওয়ার কথা এত তাড়াতাড়ি ভূলে গেলি।
আকশিঃ চুপ কর।আমাকে একটু ভাবতে দে।

নিজের চুলগুলো হালকা ঝাড়া দিতে দিতে ভাবতে লাগলো আকশি। এবার ভাবছেন তো কি এমন দরকারী কাজ পরলো ওদের। দরকারী কাজটা হলো রিয়ানা সেদিন ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত ফিডারটা যা দোলনার নিচে ফেলেছিল সেটা আদিয়াত দেখে ফেলেছিল।তবে ফিডার দেখে নি।রিয়ানা যে কিছু একটা পা দিয়ে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়েছে সেটা দেখেছে।কিন্তু কি?সেই রহস্যের সমাধান করতে আজ এখানে এসেছে। তখন মিটিংয়ের চিন্তায় আদিয়াত ব্যাপারটা ভূলেই গিয়েছিলো।রাতে আকশিকে কথাটা বলতেই আকশি ব্যাপারটা নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে যায়।তাই সকাল সকাল অফিসে চলে এসেছে।

আকশিঃ পেয়ে গেছি!!!
আদিয়াতঃ কি পেয়েছিস?
আকশিঃ আমরা এখন আবদুল চাচাকে গিয়ে বলবো গত পরশু আমারা ফিহার কেবিনে ভুলে আমাদের ফাইল রেখে চলে গেছি।তাই এখন আমাদের ফাইলটা নিতে হবে।
আদিয়াতঃ আইডিয়াটা মন্দ নয়। চলে কোন রকম আর কি।তবে বেশি ভালো নয়।
আকশিঃ ঘুষি মেরে তোর মুখের আদল বদলে দিবো।ফাইজলামি না করে জলদী চল।রিয়ানা নিশ্চয়ই অনির ক্ষতি করতে এসেছে। মেয়েটা একটুও ভালো নয়।রিয়ানাকে আমি হারে হারে চিনি। নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করতে এক ফোঁটাও বুক কাঁপবে না।হোক সে বড় মানুষ কিংবা বাচ্চা।
আদিয়াতঃ এখানে দাঁড়িয়ে মহান ব্যাক্তিদের বড় বড় ভাষণ না দিয়ে ভেতরে চল।

দুই বন্ধু একসাথে আবদুল আজিজ সাহেবের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

আকশিঃ আসতে পারি মি.আবদুল আজিজ।
আবদুলঃ আরে মি.পাটোয়ারী। আসুন আসুন।হঠাৎ কি মনে করে?আরে দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।
আদিয়াতঃ গত পরশু যখন আমরা সবাই মিলে কোম্পানির ওনারের কেবিনে গিয়েছিলাম তখন আমরা ভূলে আমাদের জরুরি একটা ফাইল রেখে গেছি।সেটা এখন আমাদের অনেক প্রয়োজন।
আবদুলঃ ওহ এই ব্যাপার।আপনারা বসুন।কোথায় আছে বলুন আমাকে?আমি সিকিউরিটি পাঠিয়ে নিয়ে আসতে বলছি।
আকশিঃ নাআআআআআ।(চিৎকার করে)
আবদুলঃ কি হয়েছে মি.পাটোয়ারী?
আদিয়াতঃ এই গাধা এতো জোরে চিৎকার দিলি কেন?প্রেমে পরে কি বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। (ফিসফিস করে)
আদিয়াতঃ সরি মি আবদুল। আসলে আমরা ফাইলটা কোথায় রেখেছি সেটা ভূলে গেছি।সিকিউরিটি খুঁজে পাবে না।তাই আমার ভাই এতো জোরে চিৎকার দিলো।
আবদুলঃ ঠিক আছে তাহলে আপনারা যান।
আদিয়াতঃ আপনি চাইলে আমাদের সাথে আসতে পারেন।যদি আপনার আমার কথা বিশ্বাস না হয়।
আবদুলঃ না না ঠিক আছে। আমি আপনাদের বিশ্বাস করে যেতে দিয়েছি এবার আপনারা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলেই হবে।
আকশিঃ কোম্পানির ওনার আসে নি কেন?
আবদুলঃ ছোট বউমার শরীরটা ভালো নয়।
আকশিঃ কি হয়েছে ফিহার?(ব্যস্ত হয়ে)
আবদুলঃ 🤨🤨
আদিয়াতঃ 🤦‍♂️🤦‍♂️
আবদুলঃ কি বললেন আপনি?
আদিয়াতঃ কোথায় কিছু বলেনি তো?ভাই জিজ্ঞেস করলো আপনাদের ওনারের কি হয়েছে?
আবদুলঃ বউমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথার কারণে আজ অফিসে আসবে না।
আদিয়াতঃ আমরা তাহলে আসছি।অনেক কাজ বাকি আছে আমাদের।

আদিয়াত কথাটা আকশির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।আরেকটু হলে ধরা পরে যেতো।এই আকশি মাঝে মাঝে কোথায় কি বলতে হয় সেটা ভূলে যায়।সবসময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।আর সবকিছু আদিয়াতের সামলাতে হয়।রুমের বাইরে এসে আদিয়াত চোখ দুটো ছোট ছোট করে আকশির দিকে রেগে তাকালো।

আদিয়াতঃ তোর কমোন সেন্সগুলো কি প্রেমে পরার পর উড়াল দিয়ে তোকে ছেড়ে চলে গেছে। তুই কি বলে ফেলেছিস তোর ধারণা আছে। ভাগ্যিস চাচা ভালো করে শুনতে পায়নি।নয়তো আজ কপালে শনি ছিলো।
আকশিঃ ফিহা অসুস্থ, এই খবরটা শুনে আমি চুপ থাকবো।আমার যে কি টেনশন হচ্ছে।
আদিয়াতঃ চুপ থাকবি কেন?একটা ঢোল আন।পুরো অফিস ঢোল পিটিয়ে খবরটা সবাইকে জানিয়ে দিয়ে আয়।তোর নির্বুদ্ধি কর্মকান্ড দেখলে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। তোর পাল্লায় পরে এবার যে মিথ্যে কথা বলেছি সারাজীবন মনে হয় না এতো মিথ্যে কথা আমার বলা হয়নি।
আকশিঃ আহারে!! তুই তো সাধু মানুষ। একটা মিথ্যা কথাও বলিস না।
আদিয়াতঃ তোর জন্য বলতে হয় এখন।মুখ ফসকে উল্টো পাল্টা কথা বলিস।আর সেগুলো আমাকে হ্যান্ডেল করতে হয়।
আকশিঃ হয়েছে, আমাকে সাহায্য করে তো হাতেম তাঈ হয়ে গেছিস।এবার দুজন এখানে লড়তে থাকলে আমাদের কাজ আজকে আর হচ্ছে না।জলদী চল।

দুজন রুমে এসে দরজা আটকে দিলো।হন্যি হয়ে এদিক সেদিক ফিডারটা খুঁজতে লাগলো। যদিও ওরা জানে না সেটা ফিডার ছিলো।

আদিয়াতঃ আকশি তোর কি হয়েছে রে?আমার মনে হচ্ছে তোর মাথা গেছে। আমি আজি পাবনার হেমায়েতপুরে তোর জন্য একটা সিট বুকিং করতে হবে।(রেগে)
আকশিঃ তুই আজকে আমার পেছনে পরেছিস কেন?আমি তোর কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি।
আদিয়াতঃ না তোকে মাথায় তুলে নাচবো।আমি তোকে বলেছি রিয়ানাকে আমি দেখেছি দোলনার নিচে কিছু ফেলতে।আমরা দুজন মিলে দোলনার নিচে খুঁজবো। সেটা না করে তুই টেবিলের ড্রয়ারে কি খুঁজছিস😤?
আকশিঃ আমি শুধু এই জন্য আসিনি।আমার একটা দরকারী কাগজ লাগবে।সেটা খুঁজতেও এসেছি। টাকা পয়াসা হাতে নেই। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে কাগজটা লাগবে।না জেনে কমপ্লিমেন্ট করাটা তোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আদিয়াতঃ হয়েছে, হয়েছে। তোরা পাতানো জামাই, বউ কখন কি করিস সেটা আমার মাথায় ঢুকে না।যেমন তুই তেমনি তোর ঐ বউ ফিহা।তবে ফিহা তোর থেকে বেশি কমোন সেন্স নিয়ে চলে।তুই তো শালা, দিনকে দিন বুদ্ধ আর হাঁদারাম হচ্ছিস।
আকশিঃ একবার অফিস থেকে বের হতে দে।তারপর দেখ তোর কি অবস্থা করি।তোর মুখের আশেপাশে লাল, লাল দাগ দেখতে পাবি।
আদিয়াতঃ 😡😡
আকশিঃ চুপচাপ কাজ কর।নয়তো আমার চেয়ে বেশি খারাপ কেউ হবে না।সারাক্ষণ শুধু বকবক করিস।

আকশি ও আদিয়াত দুজন কাজে লেগে পরলো।আগেই বলেছি ফিহার কেবিনের দিকে সাধারণত মানুষ বেশি একটা আসে না। আদিয়াত উবু হয়ে দোলনার নিচে খুঁজতে লাগলো। একসময় কোণার দিকে একটা ফিডার দেখতে পেলো।ফিডারটা হাত দিয়ে এনে জোরে চেঁচিয়ে আকশিকে ডাকলো।

আদিয়াতঃ আকশি ই-ই ই-ই!!! (চিৎকার করে)
আকশিঃ এতো জোরে চিৎকার করছিস কেন হারামজাদা? গণপিটনু খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।
আদিয়াতঃ হারামী রুম সাউন্ড প্রুফ করা। এখন যদি আমরা কেবিনের ভেতরে বক্সে জোরে গান ছেরে উরা ধূরা ডান্সও করি তাও কেউ জানবে না।
আকশিঃ আর জ্ঞান বিতরণ করতে হবে না মহাশয়।কেন ডাকিয়াছেন তাহা বলিয়া আমাকে উদ্ধার করুন।
আদিয়াতঃ এদিকে আয়।
আকশিঃ কেন?
আদিয়াতঃ আসতে বলছি আসবি।এত প্রশ্ন করিস কেন?দেখে যা জলদী করে।

আকশি একরাশ বিরক্তি নিয়ে আদিয়াতের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদিয়াত হাতে থাকা ফিডারটা দেখিয়ে বললো।

আদিয়াতঃ আমি সঠিক দেখেছিলাম।এই যে দেখ। এই ফিডারটাই রিয়ানা দোলনার নিচে ফেলে দিয়েছিলো।
আকশিঃ রিয়ানা কি তাহলে অনিয়ার সর্বনাশ করতেই এসেছিলো।যদি এমনটা হয় তাহলে রিয়ানাকে আমি খুন করে ফেলবো।ওর এত বড় সাহস আমার ভাতিজীর ক্ষতি করতে এসেছে।অনেক বড় ভূল করেছে রিয়ানা।এর শাস্তি ওকে অবশ্যই পেতে হবে।
আদিয়াতঃ দুধের কালারটা কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমি সিউর রিয়ানা এটার সাথে কিছু মিশিয়েছে।এই মেয়ে মোটেও ভালো নয়।অনেক স্বার্থপর।
আকশিঃ এক কাজ কর আদি।তুই এই ফিডারটা দুধ সহ ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়।এখন তারাই বলতে পারবে ফিডারের দুধের মধ্যে কি মেশানো আছে।
আদিয়াতঃ আচ্ছা। তুই কি তোর কাগজটা খুঁজে পেয়েছিস?আমাদের এখন বেরুতে হবে।
আকশিঃ হুম আমি পেয়ে গেছি।চল তাড়াতাড়ি। ফিডারটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেল।কেউ যাতে না দেখে।আমি বাসায় ফিরে যাবো আর তুই ফরেনসিক ল্যাবে চলে যাবি।

দুইজন খুব সাবধানে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।ফিহার কেবিনে কোন সি সি টিভি ফুটেজ নেই। যার কারণে ওরা বেঁচে গেলো।নয়তো ঘটনার মোড় উল্টো দিকে ঘুরে যেতো।ফিহা নিজের কেবিনে সি সি টিভি ফুটেজ পছন্দ করে না।

অন্য দিকে……

ফিহার মাথাটা আজ অসহ্যকর ব্যাথা করছে। যার কারণে অফিসে যায় নি।হঠাৎ করে কেন মাথা ব্যাথা শুরু হলো তা বুঝতে পারছে না।এদিকে অনিয়াও অনেক জ্বালাতন করছে।কোন সার্ভেন্টের কোলে যাচ্ছে না,টেবলেটর সাথে থাকছেও না, খেলছে না।দোলনায় রাখলেও চিৎকার করে কাঁদছে। ফিহা কোলে তুলে নিলে শান্ত হয়ে যায়।কিন্তু ফিহা অসহ্যকর মাথা ব্যাথা সত্ত্বেও অনিকে কোলে নিয়ে রাখছে।সাফানকে কল করে আজ চলে আসতে বলেছে ফিহা।সাফান থাকলে হয়তো একটু রেস্ট নিতে পারবে।সাফান বাচ্চা অনেক পছন্দ করে। সাফান ছাড়াতো আপন বলতে ওর কেউ নেই।

ফিহাঃ মাথা ব্যাথা তো কমার নাম নিচ্ছে না। ঔষধ খেয়েও কাজ হলো না।আচ্ছা একটু মাথায় কি তেল দিবো।যদি মাথাটা শান্তি লাগে।

অনিয়াকে কোলে নিয়ে বেড থেকে নামলো।মাথার চুল এলোমেলো।কপালের সামনের বেবি চুলগুলো এসে চোখ ঢেকে ফেলেছে। মুখ,চোখে একরাশ বিষন্নতা।তেলের বোতল হাতে নিয়ে বেশ কিছুটা তেল নিয়ে মাথায় দিলো।২য় বার দেয়ার সময় অনি মোচর দিয়ে হাত ঝাড়া মেরে তেলের বোতলটা ফেলে দিলো।বোতল থেকে অনেকখানি তেল মেঝেতে পরে গেল।ফিহা বোতল তুললেও পরে থাকা তেল খেয়াল করলো না।সাধারণত টাইলসের মেঝেতে তরল জাতীয় কিছু পরলে দেখা যায় না।তেলের বোতলটা পাশে রেখে সাফানকে কল করলো।

ফিহাঃ হ্যালো সাফান, কোথায় তুই? এত দেরী লাগে তোর আসতে?
সাফানঃ আমি তোদের সদর দরজা দিয়ে মাত্র ঢুকেছি।আর দুই মিনিট অপেক্ষা কর আমি চলে এসেছি।
ফিহাঃ আচ্ছা, জলদী আয়।আহহহহহহহহহহ

একটা আর্তচিৎকারে সারা চৌধুরী বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেলো।সাথে অনির কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

সাফানঃ হ্যালো ফিহু, ফিহু। কি হলো তোর?কথা বলছিস কেন?ফিহু, ফিহু কি হয়েছে? (ভয় পেয়ে)

ফিহা কথা বলবে কি করে? অসাবধান বশত তেলের মধ্যে পা স্লিপ কেটে ফিহা পড়ে গিয়েছে। অনিয়া মায়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে কান্না করছে।প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে ফিহা অজ্ঞান হয়ে যায়।তবে অনির কিছু হয়নি।কারণ অনিয়াকে ফিহা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছিলো।এখনও অনিয়া ফিহার বুকের ওপর শুয়ে আছে।জ্ঞান হারানোর আগেও ফিহা শক্ত করে অনিয়াকে নিজের সাথে ধরে রেখেছে। যাতে অনির কিছু না হয়।ঝাপসা চোখে ফিহা দেখতে পেলো সাফান পাগলের মতো দৌড়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
#মিসেস_চৌধুরী
#Part_17
#Writer_NOVA

হাসপাতালে ভর্তি ফিহা।ওর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আনিস চৌধুরী, সাফান,আবদুল আজিজ সাহেব।সাফানের কোলে অনিয়া। অনি চিৎকার করে কেঁদে পুরো হাসপাতাল তুলে ফেলেছে।কেউ শান্ত করতে পারছে না।টেবলেট দরজার একপাশে ঘাপটি মেরে চুপ করে বসে আছে। তার মনটাও খারাপ। সাফান অনিকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না।কান্না করতে করতে অনি গলাস্বর ডাবিয়ে ফেলেছে।যেটাকে আমরা আঞ্চলিক ভাষায় গলা ভেঙ্গে যাওয়া বলি।

অনি সকাল থেকে এক চুমুক দুধও মুখে দেয় নি।
সবাই এখন অপেক্ষা করছে ফিহার ঘুম ভাঙ্গার।ফিহা কোমড়ে বেশ চোট পেয়েছে। আল্লাহ রহমত করছে বলে মাথায় আঘাত পাইনি।ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে।শরীর অনেক দূর্বল ফিহার।স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। হাতে স্যালাইনে চলছে।মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে।সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে বেচারী ফিহা নিজের খেয়াল রাখতে পারে না।

আকশির কানে আদিয়াত ফিহার অসুস্থতার খবর দিতেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেছে।এতটা তাড়াহুড়ো করে এসেছে যে আদিয়াতকে ফেলেই চলে এসেছে। টেনশনে পাগল হওয়ার জোগাড় সে।নিজের ছদ্মবেশ না নিয়েই চলে এসেছে।রিসিপশন থেকে কেবিন নং জেনে ছুটে চলে এলো। দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আনিস চৌধুরীর সামনে থেমে বললো।

আকশিঃ বাবা, ফিহা কেমন আছে?ওর কিছু হয়নি তো।ওর অবস্থা কি রকম?ফিহা ঠিক আছে তো।

আকশিকে দেখে আনিস চৌধুরী ও আবদুল আজিজ সাহেব চোখ ডলতে লাগলো।তারা দুজন ভূত দেখার মতো করে চমকে উঠেছে।তাদের মনে হচ্ছে তারা ভূল দেখছে।নিজের গায়ে চিমটিও কাটলে।যখন ব্যাথা পেলো তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করলো তারা।

আকশিঃ কথা বলছো না কেন তোমরা?ফিহা ভালো আছে তো?আমার ফিহার কিছু হতে পারে না।
আনিসঃ আকশি বাবা আমার। (খুশি হয়ে)

আনিস চৌধুরী প্রায় দৌড়ে আকশিকে জরিয়ে ধরলো। কত মাস পর নিজের ছেলেকে দেখছে।চোখের পানি পরছে অনবরত। আকশিও তার বাবাকে জরিয়ে ধরে কান্না করছে।সাফানের মাথার ওপর দিয়ে সব গেছে। বাপ-বেটাকে এভাবে দেখে আবদুল সাহেবের চোখের পানি ভরে গেছে। বর্তমানে আনিস সাহেব এতো খুশিতে কি বলবে তার ভাষা হারিয়ে ফেলছে।

আকশিঃ বাবা, আমি তোমাদের অনেক মিস করেছি।কেমন আছো তুমি?

আনিসঃ আমি ভেবেছি তুই মারা গিয়েছিস।আমি পুরো নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম তোদের হারিয়ে। কিন্তু ছোট বউমা বলেছিলো তুই একদিন ঠিক ফিরে আসবি।ওর কথাই ঠিক হলো।আমাদের সবার চিন্তা করতে করতে নিজের শরীরের কি হাল করেছে দেখ।আজ ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।তোকে তো ছোট বউমার ব্যাপারে বলাই হয়নি।আসলে তোরা না থাকায়—

আকশিঃ আমি সব জানি বাবা।আমি তোমাদের সব খোঁজ -খবর রেখেছি।আর আমি ফিহাকে এবার সত্যি তোমার ছোট বউমা বানাতে চাই। আমি ফিহাকে ভালবাসি।

আকশির কথা শুনে সাফান,আনিস চৌধুরী, আবদুল সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। কেবিনের সামনে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ফিহাকে এক নজর দেখলো আকশি।তারপর সাফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনিকে সাফানের কোল থেকে নিলো।অনি আকশির কোলে গিয়ে চুপ হয়ে গেল।

সাফানঃ যাক বাবা,সারাদিন এতকিছু করেও বজ্জাত মেয়ের কান্না থামাতে পারলাম না।আর ছেলেটা কোলে নিতেই সব ঠান্ডা। চাচার কথায় যতটুকু বুঝলাম,ছেলেটা আকশি চৌধুরী। মানে ফিহার পাতানো স্বামী। (মনে মনে)

আকশিঃ এই ছেলেটা কে বাবা?(সাফানকে দেখিয়ে)
আনিসঃ ওর নাম সাফান।বউমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

আকশি সাফানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো

আকশিঃ আমি আকশি চৌধুরী।
সাফানঃ আমি সাফান হাসান।

দুজন একসাথে হাত মিলালো।টেবলেটের মনটা এতই খারাপ ছিলো যে ওর আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে ওর খেয়াল ছিলো না।হঠাৎ নাকে একটা পরিচিত ঘ্রাণ পেতেই এদিক সেদিক তাকিয়ে আকশিকে দেখতে পেলো।খুশি মনে এক ছুটে টেবলেট আকশির কাছে চলে এলো।আকশি এক হাঁটু মুড়ে টেবলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। টেবলেট খুশি হয়ে লেজ নাড়িয়ে দুই বার ঘেউ ঘেউ করে আনন্দ ধ্বনি করলো।

আকশিঃ কেমন আছিস তুই? তুই থাকতে ফিহা ব্যাথা পেলো কি করে?আমি না থাকায় ফাঁকিবাজি শিখে গেছিস। এটা তো ভালো কথা নয়।

আবদুলঃ আমার যে কি খুশি লাগছে তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না আকশি বাবা।চৌধুরী বাড়ির এক পুত্র এখনো বেঁচে আছে, এটা যে আমাদের জন্য কতবড় খুশির সংবাদ। আমি আজই পুরো কোম্পানিকে খবরটা জানাবো।

আকশিঃ এখন নয় চাচা। আর কিছু দিন যাক।
আনিসঃ আকশি তুই নিখোঁজ হওয়ার পর অনিল ও লিয়া এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি ও অনি দিদিভাই ভাগ্য জোরে বেঁচে যাই।তারপর ফিহাকে সবকিছু দেখার জন্য নিয়ে আসি।

আকশিঃ আমি জানি বাবা।আমি তখন অনেক অসুস্থ ছিলাম।যার কারণে আমি ভাইয়া,ভাবীকে শেষ দেখাও দেখতে পারি নি।(ছলছল চোখে)

আনিসঃ তোর কি হয়েছিলো?এয়ারপোর্ট থেকে নিখোঁজ কি করে হলি তুই?

আকশিঃ আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল।

আনিসঃ আমার মনে হচ্ছে আমাদের বড় কোন শত্রু আছে।যে তোর কিডন্যাপ ও আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করিয়েছে।

আকাশিঃ আমি ১মে এমনটাই ভেবেছিলাম বাবা।যার কারণে আমি এতদিন লুকিয়ে ছিলাম।তবে এই একমাস পুরো দমে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম,তোমাদের গাড়ি কেউ এক্সিডেন্ট করায়নি।

আনিসঃ তাহলে!!!! (অবাক হয়ে)

আকশিঃ গাড়ির আগের থেকে সমস্যা ছিলো।হঠাৎ করে ব্রেকফেল হয়ে যাওয়ায় এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।
আনিসঃ তোকে কিডন্যাপ কে করলো?

আকশিঃ আমাকে ভূলে কিডন্যাপ করা হয়েছিলো।অন্য একটা ছেলের বদলে আমি কিডন্যাপ হয়েছি।ঐ ছেলে ও আমার দুজনের পরনে কালো শার্ট,প্যান্ট ছিলো।কিডন্যাপাররা ঐ ছেলে ভেবে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাম ধোলাই দিয়েছে। আদিয়াত যদি আমাকে সঠিক সময়ে খুঁজে না পেতো তাহলে আজ আমি বোধ হয় তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না।

(বিঃদ্রঃ আশা করি আমি আপনাদেরকে অনিল, লিয়ার মৃত্যু ও আকশির কিডন্যাপের বিষয়টা বুঝাতে পেরেছি।এই দুটো ঘটনাই যাস্ট এক্সিডেন্ট। এর পেছনে কোন মেইন মাস্টার মাইন্ড বা ভিলেন নেই।)

আকশির কথা শুনে আনিস চৌধুরী মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার ধারণা ছিলো তাদের বিজনেসের কোন শত্রু এমন করছে।যদিও তার জানামতে তাদের কোন শত্রু নেই।আনিস চৌধূরী চোখের পানি মুছে বললেন।

আনিসঃ আমি যদি ছোট বউমাকে খুঁজে না পেতাম তাহলে তুই আজকে আমাকে ও অনি দিদিভাইকে জ্যন্ত পেতি না।এখন তুই এসে পড়েছিস।মেয়েটাকে এবার এসবের ভেজাল থেকে বের করে দিবো।আর সারাজীবনের জন্য ফিহাকে তোর বউ করে আমাদের সাথে রেখে দিবো।তাহলে অনি দিদিভাই তার মা-কে হারাবে না।আমিও আমার মেয়েকে হারাবো না।

আকশিঃ আর আমি আমার বউকে হারাবো না।

আকশির কথা শুনে সবাই একসাথে হেসে উঠলো। সাফান ভীষণ খুশি হলো।যাক ফিহার তাহলে একটা সুন্দর পরিবার হবে।তখনি আদিয়াত দৌড়ে ওদের সামনে এসে হাঁপাতে লাগলো।আকশিকে টেনে আড়ালে নিয়ে বললো।

আদিয়াতঃ হারামী,তোকে আমি খবর দিলাম।আর তুই কি না আমাকে ফেলে চলে এলি।এই তোর বন্ধুত্বের পরিচয়।আমি তোর জন্য এতকিছু করলাম আর তুই কিনা আমাকে নিয়ে আসার প্রয়োজন মনে করলি না।তোর সাথে কোন কথা নেই। যা ভাগ, শালা।যেদিন থেকে তুই ফিহার প্রেমে পরেছিস সেদিন থেকে আমার কথা ভূলে বসে আছিস।তোর ভাব দেখে মনে হয় পৃথিবীতে তুই একাই প্রেম পরেছিস।ফিহা যদি তোকে মানা করে দেয় তাহলে আমার থেকে বেশি কেউ খুশি হবে না।
আকশিঃ সরি দোস্ত। আমার তখন মাথা কাজ করছিলো না। তাই তোকে না নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি।
আদিয়াতঃ বুঝি বুঝি সবই বুঝি।ছোটবেলায় খাইছি সুজি, একটু হলেও কিছুটা বুঝি।তুই যে ফিহার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস সেটা কি আঙ্কেল জানে?

আস্তে করে আকশির কানের কাছে গিয়ে শেষের কথাটা বললো আদিয়াত।

আকশিঃ আমি বাবাকে বলে দিয়েছি যে আমি ফিহাকে ভালবাসি আর বাবাও বলেছে ফিহা সুস্থ হলে আমাদের বিয়ে দিবে।
আদিয়াতঃ তুই তো দেখছি আমার সাথে থেকে থেকে অনেক বুদ্ধিমান হয়ে গিয়েছিস।যাক,আমি তাহলে গাধা পিটিয়ে মানুষ করতে পেরেছি😜।
আকশিঃ আমি ভালো কিছু করলে তোর ক্রেডিট আর খারাপ করলে আমার।এত চালাকি আমার সাথে চলবে না।বরং তুই আমার সাথে থেকে এতো চালাক হয়ে গেছিস।
আদিয়াতঃ খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। তোর মতো হাঁদারাম আমাকে ধূর্ত বানাবে।
আকশিঃ তুই কি হসপিটালের মধ্যেও ঝগড়ার মুডে আছিস।তোকে আল্লাহ ভূলে কি ছেলে বানিয়ে ফেলেছে নাকিরে?ঝগড়া করা তো মেয়েদের অভ্যাস।
আদিয়াতঃ চুপ কর।কখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছিস।এটা একটা হসপিটাল ভূলে গেছিস।
আকশিঃ 😲😲
আদিয়াতঃ 😎🥴

একটা নার্স এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। সাফান দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের খুনসুটি গুলো দেখছিলো।এতিমখানায় থাকতে সাফান আর ফিহাও এমন করতো।

নার্সঃ মিসেস.ফিহার বাড়ির লোক কি আপনারা?
আকশিঃ জ্বি আমরা।কিছু লাগবে।
নার্সঃ এই ঔষধগুলো পেসেন্টের জন্য লাগবে। দয়া করে নিয়ে আসুন।
আকশিঃ প্রেসক্রিপশনটা দিন।
নার্সঃ এই নিন।

নার্স চলে যেতেই আকশি সাফানের কোলে অনিয়াকে দিলো।আদিয়াতকে ডেকে সাফানের সাথে পরিচয় করে দিলো।
আকশিঃ আদি, ওর নাম সাফান।ফিহার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর সাফান ওর নাম আদিয়াত।আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
আদিয়াতঃ আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড নই।মিথ্যা কথা বলছে বকশি।না সরি আকশি।আমি উনাকে চিনিই না।আজকে ১ম দেখলাম।তা সাফান কেমন আছো?
সাফানঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?
আদিয়াতঃ আমিও ভালো আছি।
আকশিঃ সাফান তুমি একটু অনিকে দেখে রাখো।আমি জলদী করে ঔষধ নিয়ে আসছি।
আদিয়াতঃ আমিও যাবো।
আকশিঃ কে ভাই আপনি?আপনাকে তো আমি চিনি না। জীবনের ১ম দেখলাম আপনাকে।
আদিয়াতঃ হারামী, আমার কথা আমাকেই ফিরত দিচ্ছিস।সবার দিন কিন্তু একসমান যায় না।
আকশিঃ যা ভাগ।

আকশি ঔষধ আনতে ফার্মেসীতে রওনা দিলো।আনিস চৌধুরী ও আবদুল আজিজ সাহেব একসাথে বসে কথা বলছে।সাফান অনি ও টেবলেটকে নিয়ে বাগানের দিকে চলে গেল। আদিয়াত আকশির পেছনে দৌড়ে যাচ্ছে।
আদিয়াতঃ আকশি দাঁড়া। আমাকে নিয়ে যা।

♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪

এক মুঠো রোদ্দুর হাতে, এক আকাশ নীল
আজ তোমার জন্য ব্যস্ত শহরে,
চলছে ভালোবাসার মিছিল
শুধু তোমার জন্য,
প্রেমের জোয়ারে ভাসলো দুকূল।(×২)

এক মুঠো রোদ্দুর হাতে, এক আকাশ নীল
আজ তোমার জন্য ব্যস্ত শহরে,
চলছে ভালোবাসার মিছিল।

রাতের আকাশ জাগে,তারার চাদরে।
বৃষ্টি ভেজা বাতাস বহে,রাতের আদরে।
পাহাড়ে পাহাড়ে ফুটলো বনফুল।
শুধু তোমার জন্য,
প্রেমের জোয়ারে ভাসলো দুকূল।(×২)

♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪

ফার্মেসীতে থাকা কিশোর বয়সের ছেলেটা একাকিত্ব দূর করতে মোবাইলে গান শুনছে। আদিয়াত ঔষধের প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলে, ছেলেটা ঔষধ খুঁজে খুঁজে বের করে দিতে লাগলো। কিন্তু আকশির সেই দিকে কোন ধ্যান নেই। সে একমনে গানটা উপভোগ করছে। শিল্পী বালামের “এক মুঠো রোদ্দুর” গানটি এখন যেনো তার পরিস্থিতির সাথে হুবহু মিলে গেছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here