#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৮
সূর্যের তীর্যক রশ্মি মুখের উপর লম্বভাবে পড়তেই তন্দ্রার রেশ কমে এলো। ক্ষণে ক্ষণে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। হাত দিয়ে আড়াল করার প্রয়াস করলাম বিরক্তিকর রোদের অংশকে। ব্যর্থ হচ্ছি বরাবরই। নিভু নিভু এক চোখ মেলে তাকাতেই নজর সর্বপ্রথম আঁটকে গেল জানালার দিকে। মৃদু হাওয়ার সাথে রোদ লাগছে। আজ একটু বেশিই বেলা হয়েছে বৈকি। এত দেরীতে কখনো বিছানা ছাড়া হয়না। পায়ের উপরও পড়ছে মৃদু। পুড়ে যাচ্ছে জায়গাটা। ইশ্! কেউ যদি পর্দাটা টেনে দিত। উপায়ান্তর না পেয়ে উঠে বসার প্রয়াস করলাম। থ্যালামাস হচ্ছে।ধীরে ধীরে দৃষ্টি পাশে নিবদ্ধ করতেই ভরকে গেলাম। চিত হয়ে শুলেও আমার একপা ধ্রুবে পায়ের উপর। নেত্রযুগল বড়ো বড়ো হল। পলক থেমে গেল। আমার ঘুম তো এমন নয়। একদম পরিপাটি ঘুম। তাহলে?
অতিদ্রুত পা সরিয়ে পরিপাটি হয়ে বসলাম। যেন বিড়াল চু’রি করে মাছ খেতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সরতে হবে, তিনি আবার আমাকে দেখে ফেলেন নি তো! জানালার পর্দা টেনে দিলাম। এলোমেলো হয়ে আসা কম্বলটা টেনে জড়িয়ে দিলাম গায়ে। হাই তুলে উঠে দাঁড়ালাম। অগ্ৰসর হলাম অন্যরুমে। সেখান থেকে জামা কাপড় ভর্তি ব্যাগ থেকে লাল রঙের একটা থ্রী পিস বের করলাম। সেই রুমের ওয়াশরুমে ঢুকলাম শাওয়ার নেওয়ার উদ্দেশ্যে। শাড়ি পড়ে হাঁপিয়ে উঠেছি।
“চড়ুই, কোথায় তুমি?”
ভেতর থেকেই অস্পষ্ট ধ্রুবের গলা ভেসে আসছে। আমি সাড়া দিলাম না। একদম শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব বিছানায় একপা তুলে দরজার পানে মুখ করে চেয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে বললাম, “ডাকছেন কেন? গলার আওয়াজ শুনেছেন? ভাঙা বাশও ফেল। আপনার গলা শুনে পালিয়ে যাবে সবাই।”
“সবাই যাক, তুমি তো যাওনি। এতেই হবে।”
“আমি এখানকার কিছু চিনি বলে মনে হয় আপনার? যাবো কীভাবে?”
চিবুকে স্লাইড করতে করতে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কালকে রাতে কিছুই তো করলাম না। এত সকাল সকাল শাওয়ার নিলে যে। সামান্য কিস্ করেছি বলে সকাল সকাল শাওয়ার নিলে, অন্যকিছু করলে সারাদিনে বের হতেই না। আবার একদম লাল পড়েছ। ভাবা যায়।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখশ্রী ফিরিয়ে নিলাম। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে লাগলাম। সাদামাটা কণ্ঠে বললাম, “এখন দুপুর হয়ে এসেছে। আযান দিল বলে, আমার তো কাজ নেই ওয়াশরুমে সারাদিন বসে থাকব।”
প্রত্যুত্তর দিলেন না। হাত থেকে ভেজা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলেন। আমি নিষ্পলক চেয়ে রইলাম। চুল শুকিয়ে এসেছে ততক্ষণে।
……..
নামাজ আদায় করে বিছানায় শুয়ে আছি। ধ্রুবও নামাজ আদায় করেছে একসাথে। অতঃপর বেরিয়েছে খাবার আনতে। আমি ফোনের স্ক্রিনে গেমস খেলছি। তৎক্ষণাৎ ফোন বাজল। অপরিচিত নাম্বার দেখে ইতস্তত বোধ করলাম। ‘রং নাম্বার’ কি-না এতেই বিব্রত। বাজতে বাজতে কেটে গেল লাইন। পুনরায় বেজে উঠল। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে রিসিভ করলাম। পরক্ষণেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সালাম বিনিময় করে ‘কে’ জানতে চাইলে তিনি অস্পষ্ট জবাব দিলেন।
“আমি কে, তা না জানলেও চলবে। শুধু জেনে রাখো, তোমার ছোট বোনের চেঞ্জিং ভিডিওটা আমার কাছে স্বযত্নে রাখা আছে।”
অবিলম্বে হার্টবিট বেড়ে গেল। ঘামতে শুরু করলাম ক্রমশ। হতবাক হয়ে বললাম, “মানে? কীসের চেঞ্জিং ভিডিও?”
“শাড়িতে জুস ফেলেছিলাম না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোমার বোনের শাড়িতে পড়ে। তারপর রাহাত নামক একটা ছেলে শাড়ি এনে দিল। বাবুই চেঞ্জ করতে গেল।
ক্যামেরা ফিট করা ছিল, উঠে গেছে ভিডিও। কী করব এটা দিয়ে বুঝতে পারলাম না। আমার তো তোমার চেঞ্জিং ভিডিও দরকার ছিল। পরে ভাবলাম, এটা দিয়ে না-হয় আমার সার্থ হাসিল করে নেই। ফোন কাছেই রেখো, যখন তখন কল করতে পারি।”
লাইন কেটে গেল। মুহুর্ত অতিক্রম হল।
সেদিন বাবুইকে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ের জন্মদিন গিয়েছিলাম। তখনকার দুর্ঘটনা ছিল সাজানো পরিকল্পনা। বিস্মৃত হলাম কর্ণকুহর থেকে ফোন সরাতে। মাটির দিকেই চেয়ে রইলাম। বাকশক্তি লোপ পেল। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম। দ্রুত দেয়াল ধরে সামলে নিলাম। ‘কে তিনি? কী শ’ত্রুতা আমার সাথে? বাবুইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়নি তো!’
ভরে এলো নেত্রযুগল। বাবুইকে কল করতে গিয়েও থেমে গেলাম। মেয়েটা বড় কিছু করে ফেললে। নিরব তৌফিককে জানাতে হবে ব্যাপারটা। দ্রুত ধ্রুবের ফোন খুঁজতে লাগলাম। ধ্রুব ফোন রেখে গেছে। নাম্বার তুলে কল করলাম নিরবকে। সবাই হয়ত একত্রে ছিল। কল করতেই রিসিভ হল। কৌতূহলী স্বরে বলল,
“কে?”
“আমি চড়ুই বলছি।”
“চড়ুই তুই! কোথায় আছিস এখন? কালকে রাত থেকে তোর কোনো খবর নেই।”
নিরবকে থামিয়ে বললাম, “থাম, আগে আমার কথাটা তো শোন। আমি একটা সমস্যা পড়েছি। অনেক বড় সমস্যা। প্লীজ হেল্প কর আমায়। প্লীজ।”
“কী সমস্যা, তাড়াতাড়ি বল। তুই ঠিক আছিস তো।”
“হম, আমি ঠিক আছে। কিন্তু বাবুই..
ফুঁপিয়ে উঠলাম পরক্ষণেই। ওপাশ থেকে ক্রমাগত থামতে বলছে, পারছি না। কিছু বলতে পারলাম না। বলার মত ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই শরীরে। ফোন নম্বরটা দিয়ে খোঁজ নিতে বললাম।
ইতোমধ্যে ধ্রুব এসে হাজির হল। অতিদ্রুত কললিস্ট থেকে নম্বরটা রিমুভ করে রেখে দিলাম। সৌজন্য হাসি দিলাম। ধ্রুব একটু আধটু অনুমান করলেন। সন্দিহান গলায় বললেন, “কোনো সমস্যা হয়েছে চড়ুই? কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে?”
“না। কী লুকাব? [প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম] খাবার এনেছেন? খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
“দেরী হয়েছে যেতে। হোটেল বন্ধ।”
মেজাজ চটে গেল মুহুর্ত। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম, “কাল থেকে আজ পর্যন্ত না খেয়ে আছি। আপনার কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। আশ্চর্য আমি। কিড’ন্যাপ করার সময় মনে ছিলনা আপনার। আমি এক্ষুনি বাড়িতে যাবো।”
_______
“ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।”
কথাটা আজ আমার জন্য প্রযোজ্য।
মিনিট বিশেক হল খাবারের প্যাকেট সমেত বসে আছি। অনেক খাবার। অনেক আগেই অনলাইনে অর্ডার করেছে ধ্রুব। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে দিয়ে গেছে। তখন বাবুইয়ের চিন্তায় ধ্রুবকে কথা শুনিয়ে দিয়েছি। একজনের ক্ষোভ অপরজনের উপর ঝেড়েছি। সামান্য একটা কথায় এতটা কষ্ট পাবেন, বুঝতে পারলে কখনো বলতাম না। এখন অনুশোচনায় ভুগছি। খাবার প্লেটে সাজিয়ে ধ্রুব ডাকতে রুমে গেলাম। ধ্রুব শুয়ে আছে। একহাত মুখের উপর রেখে চোখজোড়া আড়াল করা। সন্তর্পণে পা ফেলে ডাকলাম তাকে, “শুনছেন, তিনটা বাজতে চলল। খাবেন না?”
ধ্রুব অতিশয় শান্ত বালকের মত বললেন, “পরে খেয়ে নিব, তুমি খাও।”
“আমি সত্যিই দুঃখিত। আমার এতটা রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি।”
“এটা স্বাভাবিক। ক্ষুধা লাগলে চারিপাশের কিছু খেয়াল থাকেনা। খেয়ে নাও। অবশিষ্ট থাকলে আমি খাবো।”
অবশিষ্ট থাকলে, মানে কী? আমি রাক্ষসের মত খাই। ললাটে সরু ভাঁজ ফেলে বললাম, “তারমানে কী বলতে চাইছেন আপনি? আমি রাক্ষসের মত খাই?”
ধ্রুব এবার উঠে বসলেন। ফিচেল হেসে বললেন, “আমি কখন তোমায় রাক্ষস বলেছি?”
“সরাসরি বলেননি, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছেন। রাক্ষস ছাড়া কে খাবে এতগুলো।
আমি মহান মানুষ, আপনাকে ছাড়া খাবো না।”
ধ্রুব একঝলক হাসলেন। খাবার নিয়ে আসতে বলেন। আমি তৃপ্তিকর হাসি দিয়ে খাবার নিয়ে এলাম। দুজনে একসাথে খেলাম।
নিরিবিলি পরিবেশ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছি। গ্ৰামের মাঝে হওয়াতে তেমন গাড়ি চলার সুবিধা নেই আবার অসুবিধাও নেই। ছোটো ছোটো দুইএকটা গাড়ি চলছে। ধ্রুব আর আমি পাশাপাশি হাঁটছি। শুকনো পাতার উপর হাঁটার ফলে খচখচ শব্দ হচ্ছে। ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। তাই সাথে নিয়ে এসেছে। হাতে চকবার আইসক্রিম। গলে গলে মাটিতে পড়ছে কিছুটা। আমার মন মস্তিষ্ক সবকিছু বাড়িতে। কী করব এটাই ভাবনা। ধ্রুবের আইসক্রিম শেষ। কাঠি চিবিয়ে চিবিয়ে কয়েক খণ্ড করেছে। এরমধ্যে হঠাৎ উদয় হল চলন্ত গাড়ি। দ্রুত চলছে। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হাত থেকে খসে পড়ল আইসক্রিম। সেকেন্ডের মাঝে অতিরিক্ত সামনে চলে এসেছে। আমি দ্রুত ধ্রুবের হাত ধরলাম। ধ্রুব হাত ছাড়িয়ে ধাক্কা দিল সর্বশক্তি দিয়ে। ভারসাম্যহীন হয়ে ছিটকে পড়লাম দূরে। আর্তনাদ শুনতে পেলাম ধ্রুবের। পরক্ষণেই বিকট শব্দ। আমি দ্রুত পেছনে ফিরলাম। ধ্রুব নিচে পড়ে আছে। গাড়িটা গাছের সাথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ধ্রুবের নিকট ছুটে গেলাম। মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। হাত পা ছিলে গেছে অনেকটা। হাঁটু মুড়ে বসে ধ্রুবের মাথাটা নিজের কাঁধে নিলাম। রক্তে ভিজে যাচ্ছে আমার জামা। ওড়নাটা হালকা করে বেঁধে দিলাম মাথায়। এই অসহায় পরিস্থিতিতে আমি একা, কী করব? কোথায় যাবো? কার কাছে সাহায্য চাইব? কিছু বুঝতে পারছি না।
‘বিপদ যখন আসে, সবদিক থেকে আসে।’
#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৯
রক্তে ভিজে রঙিন দেহ। পা থেকে দ্বিধাহীন রক্ত ঝরছে। গাল গড়িয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা। মোছার বিন্দুমাত্র স্পৃহা নেই। এই অশ্রু ব্যথার নয়, বুকে চেপে রাখা নিরব যান্ত্রনার। ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে উঠছে দেহখানা। আমি নির্বাক, বাকহীন, নিশ্চল, স্তব্ধ। ভেতরটা হাহাকারে ভরপুর। ধ্রুবকে ফার্মেসির ভেতরে নেওয়া হয়েছে। আলাদা ঘরে তার প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। তখনকার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। ক্ষণে ক্ষণে আঁতকে উঠছি সেই ভয়ংকর অনুভূতির কারণে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম তখন। অচেনা পরিবেশ। কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। মনে সাহস সঞ্চয় করে অতি কষ্টে রাহাত স্যারকে কল করেছিলাম। রাহাত স্যারকে সবটা খুলে বলতে তিনিই লোকেশন চ্যাক করে গাড়ি পাঠিয়ে ছিলেন। আশেপাশে তেমন কোনো হসপিটাল না থাকায় ফার্মেসিতে পাঠিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি চলে আসবেন।
রাহাত স্যার এলেন। তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখলেন। সাথে এলো বাবুই। ডাক্তার জানালেন, ধ্রুব সুস্থ আছে এখন। তেমন গুরুতর আঘাত পায়নি। মাথায় আঘাতের ফলে জ্ঞান হারিয়েছে। এখন ঘুমিয়ে আছেন। ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। রাহাত স্যারের সহায়তায় ফ্লাটে ফিরলাম। রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। ধ্রুবের সন্নিকটে বসে চেয়ে রইলাম তার মুখপানে। চোখজোড়া থামছেনা। এই মানুষটার একটু কষ্টে ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এটাই হয়ত স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা। নতুবা এমন অনুভূতির সম্মুখীন কেন হতে হবে?
পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরল ধ্রুবের। নির্ঘুম রাত্রি পার করার ফলে ভোর রাতে চোখের পাতা মিলেছে। তন্দ্রা ব্যঘাত ঘটল কথোপকথনে। আমি দ্রুত চোখ মেললাম। ধ্রুব আধশোয়া। দ্রুত কণ্ঠে বললাম,
“কী করছেন? একা একা উঠে বসেছেন কেন? আমাকে ডাকতেন।”
ধ্রুব মুচকি হাসলেন। পাশেই রাহাত স্যারকে ইশারা করলেন। রাহাত স্যার পাশেই বসা। সকাল সকাল বাবুই চা, পরোটা সবজি করেছে। সেগুলো খাচ্ছে। বোনটা বড় হয়ে গেছে। আমার ভাবনার ফোড়ন টেনে বলেন ধ্রুব, “তাহলে টিকেট বুকিং কর। শাওয়ার নিয়ে তৈরি হচ্ছি।”
রাহাত স্যার চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, “গাড়ি নিয়ে এসেছি। চারজনে আস্তে আস্তে ঠিক পৌঁছে যাবো।”
“তুই চিনতে পারবি গ্ৰামে রাস্তা। কখনো তো যাসনি।”
“তো! ম্যাপ অনুযায়ী ঠিক পৌঁছে যাবো।”
তাদের কথোপকথন বোধগম্য না হলেও এইটুকু বোধগম্য হয়েছে, কোথাও যাচ্ছি। তড়িগড়ি করে বললাম, “কোথায় যাবেন, এই অবস্থায়। আপনি অসুস্থ। কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলুন।”
“হ্যাঁ। তোমাকেই তো বলব। দেখতেই তো পাচ্ছি, এক রাতে চোখ মুখের কী অবস্থা করেছ। চুলগুলো এলোমেলো। রক্তমাখা জামাটাও পাল্টাও নি।”
“তাতে কী? আপনার জ্ঞান ফিরেছে, আমি সব সামলে নিবো।”
“জানি কী সামলাবে, আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। তারচেয়ে আমরা এখন গ্ৰামে যাবো। মা ওখানেই আছে। ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। তুমি তো জানোই। এখন সেখানেই যাবো। সবার মাঝে আদর যত্নে থাকলে সুস্থ হয়ে যাবো।”
অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কিন্তু..
“কীসের কিন্তু?”
“সবাই চিন্তা করবে আপনাকে নিয়ে। বিয়ে বাড়ি।” ইতস্তত বোধ করে।
ধ্রুব ইশারা করতেই বাবুই রাহাত স্যার চলে গেলেন। স্মিত হেসে বললেন,
“আমার জন্য তোমার আর কোনো ক্ষতি হোক, আমি তা চাইনা। না করো না।”
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। কিছুটা অভিমান জড়ো হল। কেন হল? জানা নেই! শান্ত কণ্ঠে বললেন, “সারারাত রক্তমাখা জামা পড়ে আমার পাশে বসেছিল। এই অবস্থায় তোমাকে ভালো লাগছে না? জামাটা পাল্টে নাও। একটা পলিথিনে রেখে দিও। যাওয়ার সময় ফেলে দিবো।”
“প্লীজ না, এটা আপনার রক্ত। আমার কাছে অনেক দামী। ফেলব না। রেখে দিবো।”
“ঠিক আছে, তবে আলাদা ব্যাগে নিও। অন্য কাপড়ে দাগ লাগলে বিষয়টা..
থেমে গেলেন তিনি। তবে তার ইঙ্গিত শেষ হল না। ধ্রুবের কোলে মাথা রাখলাম। শুনলাম না তার বারণ। আশ্চর্য নিজের চিন্তা ভাবনায়। ‘ব্লাড ফোবিয়া’ ভয়ংকর রোগটাকে তুচ্ছ করে রক্তমাখা জামা পড়ে ঘুরেছি। আজ সাথে রাখতে চাইছি। তৃপ্তিদায়ক লাগছে বড্ড। ক্লান্তির অবকাশ।
আমাদের জামা কাপড় ব্যাগ ভর্তি করে ফেলেছে। আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে গিয়ে ধ্রুবের কয়েকটা টেস্ট করিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে হবে।
.
চারিপাশে সারিবদ্ধ গাছ। নীল মেঘশূন্য অন্তরিক্ষ হাতছানি দিচ্ছে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, বহুদূরে। পাখিরা কিচিরমিচির ডাকছে। মাটির রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে। কাঁচ নামানো। দক্ষিণা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে অবাধ্য চুলগুলো। ভেজা দরুন মুক্ত, বাঁধাহীন চুলগুলো। আমি মাথা হেলিয়ে দিলাম নামানো কাঁচের ভেতর দিয়ে। সিটি বাজালেন রাহাত স্যার। আমি দ্রুত মাথা ভেতরে নিয়ে এলাম। ধ্রুব ধমকে উঠলেন।
“চুলগুলো সামলাতে যেহুতু পারবেনা, বেঁধে তো রাখতে পারিস।”
রাহাত স্যার পেছনে না দৃষ্টি ফিরিয়ে মধুর সুরে বললেন, “বাঁধবে কেন? প্রেমিকার চুলের মিষ্টি সুবাসে মাতাল হবে প্রেমিক। এটাই সে চুলের অদ্ভুত ক্ষমতা।”
“আমার প্রেমিকা না-কি তোর? দুদিন আগ অবধি বিয়ে করতে পাগল হয়ে গেছিলিস, এখন শান্ত। ব্যাপারটা কী তোর?”
“পরে বলব, আগে সুস্থ হ।”
ভেজা চুল। হাওয়াতে জলকণা ধ্রুবের মুখের উপর আঁচড়ে পড়ছে। বাঁধলে বিশ্রী দুর্গন্ধ আসে। এই দুর্গন্ধে মাথা ধরে থাকে প্রায়ই। অন্য কোনো সময় হলে ঠিকই বাঁধতাম। আজ বাঁধলাম না। ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নিলাম মুখশ্রী। হাত ধরলেন তিনি। কোমল কণ্ঠে বললেন, “ওড়না ভিজে যাবে তো। বাঁধছ কেন?”
অভিমানী সুরে বললাম, “আপনিই তো বাঁধতে বললেন।”
স্মিত হেসে বললেন, “আমি কী বলেছিলাম, মনে মনে একটু আওড়াও। আমি রাহাতকে বাঁধতে বলেছি, [থেমে] চোখ।”
“চুলগুলো সামলাতে যেহুতু পারবেনা, বেঁধে তো রাখতে পারিস।” আমি নতজানু হয়ে লজ্জামিশ্রিত হাসি দিলাম। তিনি এক কথায় দু’জনকে বেঁধে ফেলেছেন। অথচ অভিমানে জর্জরিত হয়েছি।
__
আমরা পৌঁছেছি ঘণ্টা দুই পূর্বে। পৌঁছেই ধ্রুব ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়েছে। রমিলা আন্টি কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল অবস্থা করেছেন। নিজের হাতে ছেলেকে খাবার খাইয়ে দিয়েছেন। অতঃপর ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন। মায়ের ভালোবাসা হয়ত এমনিই হয়। যেটা হয়েও থাকল না আমার। সবকিছু লুকিয়ে আড়ালে হাসি দিয়ে তবেই শান্তি আমি।
রমিলা আন্টি ফিরে এলেন ধ্রুবের ঘর থেকে। বাবুইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “ও কে শ্রেয়া? চিনলাম না।”
“ও বাবুই। মামাত বোন।”
“ভালো। তোমার একা থাকতে কষ্ট হবেনা। তা খাওয়া-দাওয়া করেছ তোমরা।”
বাবুই ফট করে বলল, “হ্যাঁ। আমরা রাস্তায় খেয়েছি। চিন্তা করবেননা।”
“ঠিক আছে, কিছু লাগলে আমাকে বলবে। এবার এসো, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। অবশ্য সবাই তোমার পরিচিত, গ্ৰামটাই তো তোমার।”
বাড়ি ভর্তি মানুষজন। গিজগিজ করছে চারিপাশ। বিয়ের বাড়ি বলে কথা, মানুষজন তো থাকবেই। তাছাড়া যৌথ পরিবার। সবসময়ই গিজগিজ ভাবটা থাকবেই। গ্ৰাম বাংলায় এটা সাধারণ একটি ব্যাপার। রমিলা আন্টি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে গেলেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। তখন ধ্রুবকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়েছিল বিধেয় কথা হয়নি কারো সাথে। রান্নাঘরের দিকে অগ্ৰসর হলেন। আমি পিছুপিছু অগ্ৰসর হলাম।
রাতের রান্নার তোড়জোড় চলছে। বড়ো বড়ো ডেক্সিতে রাঁধছে। আমি সালাম দিয়ে আন্টির পাশে দাঁড়ালাম। সবাই বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ধ্রুবের চাচি, “এটা শোয়াত ভাইয়ের মেয়ে শ্রেয়া না।”
রমিলা আন্টি সায় দিয়ে বললেন, “হম। কিন্তু আপাতত আমার ছেলের বউ।”
বসতে বললেন না। নিজেদের কাজে মশগুল তারা। আমতা-আমতা করে বললেন, “ওকে না আনলে হতো না?”
“কীভাবে হবে? ও এই বাড়ির বউ। নতুন বউ আসবে ও থাকবে না।”
সৌজন্য হাসি মিলিয়ে গেল। রমিলা আন্টি আমাকে দাদিমার ঘরে পাঠালেন চায়ের কাপ সমেত। আমি এগোলেও এগোলাম না। তাদের কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দু আমি। শোনার তীব্র স্পৃহা। সকলের অগোচরে আঁড়ি পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ধ্রুবের চাচি পুনরায় বললেন, “ভাবী তুমি তো জানো, এটা শুভ অনুষ্ঠান। এখানে শ্রেয়ার মত একটা অশুভ মেয়েকে নিয়ে এলে। যদি আমার ছেলের বিয়েতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।”
“মানে?” রমিলা।
ধ্রুবের ছোট চাচী বললেন, “গ্ৰামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে মাঝপথে আমাদের ধ্রুবের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কিছু বছর আগে শ্রেয়ার জন্য ধ্রুব বিদেশে চলে গেছিল। ওর বাবা মা চলে গেল। তোমার স্বামীকে নিয়ে গেল। এখন মামার বাড়িতে থাকে।
বুঝতেই পারছ, আমি কী বলছি।”
রমিলা প্রত্যুত্তর দিলেন না। আঁচলের থেকে গিট খুলে পান মুখে পুড়ে চিবুতে লাগলেন। আশেপাশে পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি অবগত নয়, এমন ভাব ভঙ্গিমা। তবে আমি সহ্য করতে পারলাম না। সোজাসুজি না হলেও সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করেছেন। ভবিষ্যতে বিয়েতে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে, তাতেও আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। উতলা মন নিয়ে অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকে। হাসি মুখের আড়ালে লুকিয়ে ফেললাম ঝাঁপসা কষ্টকে। হুট করে সত্যিটা ধীরে ধীরে সমুখে আসছে যেন।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]