#মেঘের আড়ালে বৃষ্টি
#সতেরো
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
সি বিচ এ বসে আছে রোদেলা আর প্রয়াস বীচের পাশের বেঞ্চে বসে আছে।
ফুলকারি অফ হোয়াইট ওড়নার সাথে, গাঢ় সবুজলাভ কামিজ পড়েছে সে। কানে এক জোড়া টপ কানের দুল। হাতে কালো রঙের ঘড়ি। অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে। জীবনের এত সুন্দর মেয়ে প্রয়াস দেখেনি বলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে।
রোদ বলল, কী ব্যাপার চুপ করে থাকার জন্য ডেকেছেন?”
“তোমার উত্তর জানার জন্য ডেকেছি।”
“কী উত্তর?”
“আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি কী সেটা গ্রহণ করবে?”
“রোদ লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলল, ” গ্রহণ করা হইল।”
প্রয়াস নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার বলল, “কী বললে শুনতে পাইনি।”
“যা শুনেছেন তাই বলেছি।”
প্রয়াস মুহূর্তেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে ইয়েস বলে একটা চিৎকার দেয়। তার এমন পাগলামো দেখে রোদ অবাক হয় আবার খুব খুশী ও হয়।
“এই যে আপনাকে সবাই দেখছে। এভাবে বাচ্চাদের মত কেন করিছেন?”
“ওহ সরি! আনন্দ ধরে রাখতে পারিনি।”
দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। বাতাসে রোদের চুল এলোমেলো হচ্ছে আর হাত দিয়ে সেই চুলকে বাধ্য করতে চাইছে রোদ। প্রয়াসের খুব ইচ্ছে করছে রোদের হাত ধরে হাঁটতে। কিন্তু ওইদিনের পর আর কোনো প্রকার ভুল সে করতে চায় না।
হঠাৎ রোদ বলল, “আপনি চাইলে আমার হাত ধরে হাটতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।”
প্রয়াস একটু অবাক হলো। এই মেয়ে জ্যোতিষী নাকি কেমনে মনের কথা বুঝে গেলো।
প্রয়াস আলতোভাবে রোদের হাত ধরলো। কেমন তুলোর মত নরম। সে ভাবল নিশ্চিত এই হাত কোনোদিন কাজ করেনি।
“কি ভাবছেন? আমি অকর্মা কখনো কাজ করি না?”
এই মেয়ে আবার বুঝে ফেলল আমি কী ভাবছি অদ্ভুত!
আমি ইতস্ততভাবে বললাম, “না তেমন কিছু না।”
“আচ্ছা আপনার পরিবার সম্পর্কে বলেন আমি তো কিছুই জানি না।”
“পরিবার সম্পর্কে জানা কী খুব জরুরী?”
“জি, আসলে আপনি যদি আমাকে ছেড়ে যান।আপনার বাড়ি গিয়ে ধর্মঘট করবো তো তাই। সব জেনে রাখা দরকার। ” রোদের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
প্রয়াস ভ্রু কুচকে তাকায় বলে, “আমি তোমাকে যতটা পিচ্চি ভাবি তুমি ততটা না। সকাল ঠিকই বলে, ইন্টার পড়ুয়া মেয়েরা বাচ্চার মা হতে পারে। তারা আবার পিচ্চি হয় কেমনে।” মুখ টিপে হাসে সে।
রোদ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে, সে যে মজা করছে প্রয়াস সেটা বুঝতে পারছে।
আমার পরিবারে সদস্য ৪জন ছিল, কিন্তু এখন ৫জন। আমরা দুই ভাইবোন, আমি প্রয়াস আহম্মেদ। বোন পুস্প আহম্মেদ। বাবা আশরাফ আহম্মেদ। আমার মা আর আমার বউ রোদেলা আহম্মেদ।
লাস্টের কথাটা শুনে রোদের বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল। কেমন যেন শিহরে উঠল। ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পুরো শরীর। রোদেলা আহম্মেদ। হ্যাঁ আজ থেকে প্রতিদিন সে আল্লাহর নিকট চাইবে সে যেন রোদেলা আহম্মেদ হতে পারে।
প্রয়াসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোদ। দুজন একসাথে ফিরে যায় বাসায়।
রোদকে বাসার সামনে নামিয়ে দেয় প্রয়াস। সাথে গাড়ি নিয়ে এসেছিল তাই নয়তো দুজনকে আলাদা করে যেতে হত। যেহেতু প্রয়াস গাড়ি চালাচ্ছে, রোদ তার পাশের সিটে বসেছে। স্কেলেটরে আগে রোদের হাত টেনে রেখে তার উপর নিজের হাত দিয়ে প্রয়াস গাড়ি স্টার্ট দেয়।
মিউজিক চালু করে দেয় প্রয়াস।
ভালবাসি ভালবাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি,
ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি …
গানের প্রতিটি লাইনের অর্থ যে কতটা গভীর আজ দুজনে উপলব্ধি করতে পারছে। এর আগেও অনেকবার এই গান শুনেছে। কখনো মনে দাগ কাটেনি। আর এর অর্থ ও বুঝেনি আজ বুজেছে।
কতটা দরদভরা এই গানের কথাগুলো।
ভালবাসা বুঝি এমনি। যখন আসে চারদিকে আলো নিয়ে আসে। রঙ নিয়ে আসে। সেই রঙে চারপাশ রঙিন করে তুলে। অন্ধকারকেও তখন ভালো লাগে আলো এতো আলো কেন চারপাশে।
★★★
জীবনে কোথাও উত্থান হয় তো। অন্য কোথাও পতন। কেউ ভালোবাসা গড়ে আবার কেউ সেই একই ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনায় ছটফট করে।
জীবনের এই পুনরাবৃত্তি যেন প্রকৃতির সৃষ্টি কেউ চাইলে সেটা থামাতে পারবে না। জীবন কোনো আলো নয়। আবার কোনো অন্ধকারও না। আমরা যে যেভাবে দেখি জীবন ঠিক তেমনই।
এভাবেই আজকের দিনে যেভাবে রোদেলা আর প্রয়াসের প্রনয়ের শুরু হয়েছে। এই দুটি মানুষ একদিকে ভালবাসা পাওয়ার প্রবল ইচ্ছায় স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। আবার অন্যদিকে রহিম তার ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনায় ছটফট করছে।
আজ চারদিন ধরে রহিম আর সনির মাঝে কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই। কেউ কাউকে কল দিচ্ছে না।ইচ্ছে করেই দিচ্ছে না। অথচ দুজনেই চাইছে বিপরীত জন কল দিক। কিন্তু নিজ থেকে কেউ কাউকে কল দিবে না। ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে দুজনই।
রহিম তার রুমের বেলকোনিতে বসে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের মনের ভেতর গুমোট কষ্টটাকে এই ধোঁয়ায় জ্বালিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু পারছে না।ভালোবাসা এমন কেন?
সনি কোনোদিন আমাকে ভালোবাসবে না। জেনে ও আমি কেন এটা মেনে নিতে পারি না। এতগুলো বছর আমাদের বন্ধুত্ব। এতগুলো বছর ধরে তাকে ভালোবাসি। আমি চাইলে এসব অনুভূতি উপেক্ষা করতে পারি না। যখন কোনো মানুষকে ভালবেসে ফেলে। কেউ আর যাইহোক তাকে বন্ধুত্ব নাম দেয়া যায় না। তাকে শুধু বন্ধুর চোখে দেখা অসম্ভব হয়ে যায়। যেহেতু নিশি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না। তাই আমাকে এই কষ্টটা মেনে নিতেই হবে। আজ থেকে আমি এই সম্পর্ক থেকে সনিকে মুক্তি দিয়ে দেব। মন থেকে আমি সনির নামের শব্দটাকে শেষ করতে না পারলেও উপর থেকে মুছে ফেলব। এভাবে হয় না। আমার জন্য অন্য কেউ কষ্ট পাবে এটা আমি মেনে নিতে পারব না। তাই কাল থেকে তার সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ করব না।
__________________________________
আজ কলেজ খোলা সবাই সবার মতন করে কলেজে আসে। প্রয়াস সেই সকাল আটটায় এসে বসে আছে। অথচ কলেজ খোলে ৯টার পর। সব জেনেও কেন যে সে এমন করে নিজেই বুঝে না।
রোদ কলেজে আসে সকাল ৯টায়। সনি সুচিসহ তিন বান্ধবী মিলে আসে।
প্রয়াস কলেজ খোলার পর গেটের পাশে যে বসার জায়গাটা আছে সেখানেই বসে আছে। রোদ খেয়াল করেনি প্রয়াসকে। কলেজে ঢুকে রহিমের সাথে প্রথমে দেখা। রহিম খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে।
“কিরে রোদ কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই?”
“এইতো ভালো।”
“সুচি কী অবস্থা?”
“এইত দোস্ত ভালো।”
সনিকে কিছুই বলল না রহিম। একবার সনির দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখল না। এই ব্যাপারটা সনি খেয়াল করল এবং খুব ইনসাল্ট ফিল করল। যে রহিম কি না তাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। আজ সে নিশি সামনে থাকার সত্ত্বেও একবার কথা বলা তো দূর একবার ফিরে ও তাকালো না। এই ব্যাপারটা খুব লাগল তার। কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ হজম করে নিল।
রোদ বলল, “কী ব্যাপার মামা রহিম। আজ হঠাৎ সনিকে রেখে রোদ আর সুচির দিকে নজর ব্যাপারটা কী।আপনাদের মান অভিমান এখনো শেষ হলো না নাকি?”
“কী যে বলিস রোদ তোরা সবাই আমার জন্য সমান। সবাই আমার বন্ধু। সবাই বন্ধু হলে কেউ একজন স্পেশাল হবে এটা কেন ভাবিস?”
“না মামা তুমিই তো আমাদের এইটা ফিল করাইসো যে সনি আমাদের থেকে তোমার কাছে স্পেশাল।”
“এটা তোদের ভুল ভাবনারে সুচি। আজ থেকে এসব চিন্তা ও করিস না।”
সনি শুধু অবাক হচ্ছে রহিমের কথা শুনে। এই ছেলে এই কয়দিনে এতটা পাল্টে গেলো কী করে! আজব!
তার এসব শুনতে ভালো লাগছে না। তাই রোদকে বলে,
“তোরা আয়,আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো। ”
এখানে উপস্থিত সবাই জানে সে এখান থেকে কেন চলে গেছে।
প্রয়াস অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। রোদের সাথে কথা বলতে কিন্তু পারছে না। রোদ দেখেনি এতোক্ষণ যে প্রয়াস দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাম্পাসে অনেক জুনিয়র থাকায় সে এগিয়ে গিয়ে নিজ থেকে কথা বলতে পারছে না। এতক্ষণ সময় অপেক্ষা করতে কার ভালো লাগে। একটু খারাপ লাগছে প্রয়াসের।
রোদ রহিম পাশাপাশি হাঁটছে। রহিমের চোখ পড়ে প্রয়াসের দিকে, প্রয়াস এদিকে তাকিয়ে আছে।
রহিম রোদকে বলে,
“রোদ প্রয়াস ভাই মনে হয় তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তুই গিয়ে কথা বলে আয়।”
রোদ প্রয়াসের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটায় এক অদ্ভুত শব্দ শুরু হলো। এই মানুষটা এমনভাবে কেন তাকিয়ে আছে। সবাই কী ভাববে। তার একটা ইমেজ আছে আই কলেজে, সেটা কী ভুলে গেছে সে।
রহিম সুচিকে নিয়ে যায় দরকারী কথা আছে বলে।
রোদ প্রয়াসকে কাটিয়ে গেটের পাশের দিকে ঝালমুড়ি মামার কাছে যায় ঝালমুড়ি নিতে।
প্রয়াস ও উঠে আসে বলে,
“মামা আমাকেও দিন তো ঝালমুড়ি?”
ঝালমুড়ি মামা মনে হয় এই মাত্র আকাশ থেকে পড়া কোনো এলিয়েন দেখলেন এমন ভাব করে প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে আছে।
“মামা আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন উনার দিকে?”
” আরে আম্মা আপনি জানেন না। প্রয়াস মামা এত বছর ধরে এখানে পড়তাছে কোনোদিন তারে দেখলাম না ঝালমুড়ি খাইতে। আজকে সে কইতেছে, হে নাকি ঝালমুড়ি খাইবে। কন আম্মা এইটা কী কম অবাক হইবার কথা আম্মা?”
রোদ এবার বুঝতে পারে ব্যাপারটা কি।
রোদ বলে,
“মামা মানুষের রুচির পরিবর্তন হতেই পারে কী বলেন?”
“হ আম্মা হইতে পারে।”
প্রয়াস লজ্জা পেয়ে যায়। আসলে মামা এইভাবে রোদকে সবটা বলে দিবে সেটা বুঝেনি সে।
প্রয়াস দুজনের টাকা দিতে চাইলে, রোদ নিজের টাকাটা দিয়ে দেয়।
আস্তে করে বলে, “আমি অন্য কারো থেকে টাকা নেই না।”
প্রয়াস আর কিছু না বলে মামাকে টাকা দিয়ে রোদের সাথে হাঁটা ধরে।
রোদ খুব সাবধানে বলে,
“আমার পেছনে কেন আসতেছেন। সবাই কী ভাববে।এতদিন আপনি কোনো মেয়ের সাথে ক্যাম্পাসে কথা বলেন নি। এখন বললে সবাই অন্য কিছু ভাববে।”
প্রয়াস ও একইভাবে বলে,
“আমি দরকারে জুনিয়রদের সাথে কথা বলতেই পারি। এতদিন প্রয়োজন হয়নি বলিনি। এখন প্রয়োজন আছে তাই বলছি। আর কে কী ভাবল এসব বিষয়ে আমি কখনোই কিছু ভাবি না। এখন তুমি বলো ছুটির শেষে আমার সাথে দেখা করছো তো?”
“জি না,দেরি হলে বাসায় চিন্তা করবে।”
“আরে ত্রিশ মিনিট থাকবে,বলবে বন্ধুদের সাথে ছিলে আর তুমি যে বন্ধুদের সাথে অনেক্ষণ সময় থাকো সেটা আমি দেখেছি। তবে তুমি না চাইলে আমি জোর করব না।”
“আচ্ছা ছুটির পর নিউমার্কেটের দিকে আসবেন। আমি ওখানে থাকব।”
“ধন্যবাদ পিচ্চি।” কথাটা বলেই প্রয়াস উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে যায়। রোদ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ভাবে এ লোক আমার সাথে প্রেম করছে, আবার আমাকেই পিচ্চি বলছে!
চলবে