#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#বত্রিশ
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
সবাই বসে আছে একসাথে শুধু রোদ এখনো আসেনি। রোদ আসলে আড্ডা শুরু হবে। আজ রোদের চাচ্চু, বড় আব্বু সবাই আছে। সব কাজিনরা এসেছে। শুধু রাহা আসেনি।
আজকে অনেক রকম খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। রোদের সব পছন্দের খাবার আরও কিছু বাড়তি পদ রান্না হয়েছে। আড্ডা গান, গল্প,সব শেষে খাওয়া হবে।
স্নিগ্ধ রাত আকাশের থালার মত গোল পূর্ণ চাঁদ। রোদদের বাড়ির ছাদের উপর সব আয়োজন করা হয়েছে। ছাদের চারপাশে নানা রঙের লাইট লাগানো হয়েছে। সব মিলিয়ে সুন্দর পরিবেশ। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। এই বাতাস গায়ে লাগার সাথে সাথে শরীর শীতল হয়ে যায়।
রিফাত ইরাকে বলে, “রোদ কোথায় আসছে না কেনো?”
“আসছে একটু অপেক্ষা করো।”
মেঘলা বলে, “ওই যে আপু আসছে!”
রোদ আসে, কালো, এস রঙের মিশ্রণে একটা সুতি শাড়ি পরে। কানে এন্টিকের এক জোড়া ঝুমকা। দুহাতে কয়েকটি কাচের চুড়ি।
একদম বাঙালী লুক। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রোদের দিকে। আগের থেকে একটু মোটা হয়েছে। এতে যেন আরও বেশী সুন্দর লাগছে রোদকে। শাড়ি পরায় অপূর্ব লাগছে রোদকে।
মিনু বেগম মেয়ের কাছে এসে বলে, “আয় মা সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। সনি ও সুচি এসেছে, রহিম আর রাহাত একটু পর আসবে। তাদের অফিস শেষ হবে ৮টার পর।
তবে তারা বলেছে ঘন্টা খানিক আগে আসবে আজকে।”
সবাই এক সাথে গোল হয়ে বসে। ফ্লোরে শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। রোদের প্রবাস জীবনের কথা জানতে চায় সবাই। রোদ বলে। এমন অনেক কথা হয় অনেক্ষণ ধরে।
রিফাত গলা পরিস্কার করে হাতকে মাইকের মত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে, “উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলছি এখন আমরা গান শুনবো। রোদের গলায়।”
উপস্থিত সবাই হাত তালি দিয়ে উঠে। রোদ চমকে যায়। ধুর ভাইয়াটা কি যে করে না! একবার জিজ্ঞেস করে নিলে কি হতো? এসব ভাবছে রোদ। ইরা রোদের হাতে গিটার এনে দেয়। রোদ অনেক্ষণ ধরে গিটারের গায়ে হাত বুলায় কত বছর পর গিটারটা হাতে নিলো। কত আবেগ মিশে আছে এটার সাথে।কত স্মৃতি!!
সবার অনুরোধে রোদ গান ধরে,,
“জানি না
দূরে দূরে মেঘ যাচ্ছে পুড়ে
মন মেললো স্মৃতি দু’ডানায় (দু’ডানায়…)
দূরে দূরে মেঘ যাচ্ছে পুড়ে, জানি না।”
রোদ থামে গিটার বাজতে থাকে গান গাওয়ার সময় একদম অন্য দুনিয়ায় চলে যায় সে। এতো দরদ দিয়ে গান গায় যে বুঝার উপায় নেই যে সে কোন প্রফেশনাল সিঙ্গার না!
সবাই অবাক হয়ে শুনছেন রোদের গান। চারদিকে নীরবতা নেমে এসেছে।
রোদ আবার গায়”
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়
মেনে নেয় তার পরাজয়
জীবন পড়ে ধূলোতে, হারিয়ে সঞ্চয়।।
এটুকু গাওয়ার পর রোদ ভুলে যায় গানটার লিরিক, তখন তিনজন পুরুষের আগমন ঘটে। তার মধ্যে থেকে একজন গেয়ে ওঠে”
তবু সে দূরে তা মানি না (মানি না)
যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে
তবু সে দূরে তা মানি না
জানি না, কেন তা জানি না।
রোদ থমকায়! এই সুর তার চেনা। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখতে পায় রহিম, রাহাত,দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের সাথে আছে প্রয়াস। রোদের বুকের ভেতর ধুকপুকানি শব্দটা যেন কয়েকগুনে বেড়ে যায়।
চোখে পানি আসতে গেলে অনেক কষ্টে তা আটকায়।
প্রয়াসের নজর অন্যদিকে। রোদের দিকে না। কিন্তু রোদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রয়াসের দিকে। মনে হচ্ছে সে নিজে না। কেউ জোর পূর্বক তার চোখগুলোকে প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলেছে।
রিফাত রোদকে বলল, “এই রোদ গাইছিস না কেনো?”
রোদের হুস ফেরে।
রোদ নিচের দিকে তাকিয়ে গেয়ে ওঠে।
রাত বেড়ে যায় ধীর পায়
বাতাসেরা যেন অসহায়
শুকনো পাতার নূপুরে (নূপুরে)
যার উষ্ণ আঁচে, ভালোবাসা বাঁচে
সে হৃদয় ভাঙ্গে তা মানি না (তা মানি না)
যার উষ্ণ আঁচে, ভালোবাসা বাঁচে
সে হৃদয় ভাঙ্গে তা মানি না (মানি না)
এবার রোদ প্রয়াস একসাথে গেয়ে ওঠে
জানি না, কেন তা জানি না
রোদ জানতো আজকে এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে। তাই আগে থেকে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু প্রয়াস জানতো না রোদ দেশে এসেছে। কেউ তাকে বলেনি।
কেন বলেনি কে জানে?
রোদের বুকের ভেতর সাইক্লোন, ঘূর্নি ঝড় বেয়ে চলছে। কিন্তু তারপর ও মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করছে রোদ।
রহিম, রাহাত এগিয়ে আসে রোদের দিকে। প্রয়াস আগের জায়গায় দাড়িয়ে আছে। প্রয়াসের পেছন পেছন রিমি আসে। রিমিকে দেখে রোদের যন্ত্রনা আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়। ভাবে ও বউকে সাথে নিয়ে এসেছো! ভালো! একজন স্ত্রী তার স্বামীর সাথে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। কিন্তু এই অতি সাধারণ বিষয়টাও রোদের বুকে কাঁটার মত বিধছে। রোদ সেদিকে না তাকিয়ে রহিমের দিকে তাকায়।
রহিম বলে, “দোস্ত কত দিন পর! কেমনে ছিলি তুই আমাদের ছেড়ে?”
রহিম হাত বাড়িয়ে দেয় রোদের দিকে রোদও বাড়িয়ে দেয় হাত।
রাহাত আর রহিম একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে। সনি, সুচি এসে দাড়িয়েছে বন্ধুদের কাছে।
“তোদের খুব মিস করেছিরে দোস্ত।” রোদ বলে
“হইছে মামা এখন দেশে আসছো, তাই এসব বলতেছো। আমাদের মিস করলে তো একেবারে চলে আসতা। তুমি নাকি মাত্র…” কথাটা শেষ করতে দিলো না
রোদ বললো, “চুপ হারামি বাসায় কেউ জানে না। আমি ছুটিতে আসছি।”
রিমি এগিয়ে আসে রোদের দিকে তার কোলে তার মেয়ে।
রোদ হেসে বলে, “কেমন আছেন আপু?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো রোদেলা?”
“জ্বি ভালো আপু।” প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে বলে “অনেক ভালো আছি আপু।”
প্রয়াস এতোক্ষন রোদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। রোদের তাকানোতে একটু বিচলিত হলো সে।
রোদ বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। তারপর অনেক মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখে।তারপর বলে মাশাল্লাহ অনেক কিউট বাচ্চাটা! অনেকগুলো আদর করে মেয়েটাকে। প্রয়াস আবার তাকিয়ে আছে রোদের দিকে।
কত বছর পর রোদকে দেখছে সে।আগের মতই আছে রোদ।তবে আগের থেকে আরও সুন্দরী হয়ে গেছে।শাড়িতে পুরো নতুন বউয়ের মত লাগছে রোদকে একদম পুতুল পুতুল ভাব।
বাচ্চাটার সাথে কথা বলার সময় মনে হচ্ছে সেও এক বাচ্চা।
আল মাহমুদ প্রয়াসকে দেখে বলে, “প্রয়াস বাবা দূরে দাড়িয়ে আছো কেনো?দেখছো না রোদ এসেছে। কথা বলো রোদের সাথে?”
রিমির কাছে বাচ্চাকে দিয়ে রিমির পাশে দাঁড়ায় শক্ত ভাবে। প্রয়াস একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোদের বুকের কাপন।
প্রয়াস বলে, “কেমন আছো রোদ?”
রোদ কাঁপা গলায় বলল, “ভালো। আপনি?”
“এইতো ভালো।”
দূর থেকে কয়েক জোড়া তাকিয়ে আছে রোদ প্রয়াসের দিকে। তাদের মনে এই দোয়া। প্রয়াস যেন বিয়ে না করে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো দুজনের কেউ আর কোন কথা খুঁজে পায় না বলার জন্য।
অথচ মনের ভেতর চারটি বছর ধরে কত কথা জমানো রয়েছে। যেন কেউ দেখতে না পায়। ছুঁতে না পারে!
ঠিক যেমন ব্যাংকের লকারে গুপ্তধন রাখা হয়।
দু’জন হাটা দেয় গোল হয়ে বসা দলটির দিকে।
অথচ রোদের সারা শরীর ঘামাচ্ছে। এই হিম শীতল বাতাসেও ঘামাচ্ছে। অদ্ভুত একটা কিছু অনুভব করছে। অথচ সে এতোদিন ভেবেছে চোখের আড়াল হলেই বুঝি মনের আড়াল। কিন্তু আজ বুঝলো। এসব বাক্য কথা স্বার্থপর মানুষের জন্য বানানো। যারা মুহুর্তেই পালটে যায়। ঠিক যেমন প্রয়াস পালটে গেছে।
কই সেতো আগের মত করে সব অনুভব করছে! তার কাছে কোন অনুভূতিই তো পাল্টেনি। সে তো হতে পারেনি স্বার্থপর!
সব ভালোবাসা এমন হয়না।
শুধুমাত্র ভালবাসার আগে সত্যি কথাটা যুক্ত হলেই কেবল এমন অনুভুতি হয়।
“সত্যিকারের ভালবাসা”
চলবে…