মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ১২

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ বারো

-“অনেকদিন কলেজে না যাওয়ার কারণে তোমার সাথে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু সবসময়ই তোমাকে মনে পড়েছে আমার। পড়ে ভাবলাম নাহ এভাবে আর থাকা যাবে না। তুমি আমাকে না দেখলেও, ভালো না বাসলেও চলবে। কিন্তু আমি তোমাকে না দেখে আর থাকতে পারবো না। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমি এতে। এইকয়দিনেই তা আমি খুব করে টের পেয়েছি। কলেজের সামনে যখন গেলাম তখন অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম ভাবতে ভাবতে তোমার দেখা পাবো তো এতদিন পরে? ভাবতে ভাবতে কখন যে কলেজের ভিতর গিয়ে আনমনে হাঁটতে শুরু করেছি জানিই না। হঠাৎ কারো ডাকে আমার হুঁশ আসে। তাকিয়ে দেখি তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। তুমি হুট করেই কাছে এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললে-” তোমার সাথে কথা আছে চলো” সেদিনই তুমি আমার সাথে প্রথম কথা বলেছিলে। আমার বুকের ভেতর মনে হচ্ছিল কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছিল। কথা বলতে পারছিলাম না। তুমি আমাকে টেনে নিয়ে কলেজের কোনার দিকে একটা বড় গাছের পিছনে নিয়ে এসে থামলে। কিছু বলছিলে না শুধু গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলে। আর আমি? আমি তোমাকে দেখতে ব্যাস্ত ছিলাম। কয়েকদিনেই কতটা পরিবর্তন হয়েছে তোমার। সিল্কি চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে কপালে ছড়িয়ে আছে, গায়ের শার্ট টাও কেমন কুঁচকানো জায়গায় জায়গায়, মুখটাও শুকনো শুকনো লাগছিল, চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে, আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম তোমায়। এ কি অবস্থা। পরে অবশ্য জেনেছিলাম এর কারন আমিই ছিলাম। তুমি চোখ খুলে আমায় কিছু বলছিলে সামনে এসে কিন্তু আমি মনে হয় এক ঘোরের ভেতর ছিলাম সেজন্যই হয়তো তোমার কথাগুলো আমার কানে পৌঁছায় নি। তোমার বলা শেষে যখন তুমি আমায় ঝাঁকিয়ে বললে “তুমি কি চাও” তখনও আমি শুধু অবুঝের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কিছুই তখন আমার বোধগম্য ছিল না। তুমি আমার হাত ধরেই কলেজ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলে। হাঁটতে হাটতেই বুঝতে পারি তখন তুমি কি বলেছিলে। বলেছিলে তুমিও আমাকে ভালবাসো, আমাকে না দেখে থাকতে পারবে না, আমি যেন রাজি হই এজন্য তুমি হুমকিও দিয়েছিলে। হা হা হা। আমার তোমায় নিয়ে এতোদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমাকে বুঝেছ তুমি, ভালোবেসেছ, আমি যাতে বুঝতে না পারি সেজন্য তুমি আমার আড়ালে কত কিই যে করেছ। আমার চাওয়া এখন আমি তোমায় নিয়ে ভালো থাকতে চাই। আমার সব স্বপ্ন তোমায় ঘিরে।”

ডায়েরির এতোটুকু পড়ে তুলতুল বিছানায় থ হয়ে বসে আছে। এর কিছুটা বুঝলেও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। ও ভেবেছিল ডায়েরিটা যে ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা তার চেহারা, আচার-আচরণ বা ব্যবহারের কিছুটা বর্ননা দেয়া থাকবে। কিন্তু এতো পযন্ত পড়েও কিছু পেল না। তুলতুল খুব ভালো স্কেচ করতে পারে। বর্ণনা গুলো ভালোভাবে দেওয়া থাকলে ও হয়তো আঁকতে পারতো কিছুটা সেই ব্যক্তির চিত্র। কিন্তু না সে পায়নি কিছুই। আরো কিছুটা পেজ বাকি আছে পড়ার কিন্তু তুলতুলের আর পড়তে মন চাইলো না। তার ধারণা এত পযন্ত পড়েও যখন কিছু পায়নি বাকিটুকু পড়েও কিছু পাবে না। তুলতুল ডায়রিটা আগের জায়গায় রেখে এলো।

সেদিনের ঐ ঘটনার পর একমাস কেটে গিয়েছে। তুলতুল আর একবারও রাফসানের সামনে পড়ে নি। কলেজে গেলেও ছুটি হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। দোকানেও যায় না। সেই ঘটনার পর তুলতুলের স্বাভাবিক হতে তিনদিন লেগেছিল। ঐ তিনদিন সে না ঘরের থেকে বের হতো আর না কারো সাথে কথা বলতো। তুলতুলের মা বা কখনো তিয়াস এসে খাবার খায়িয়ে দিয়ে যেত। তিনদিন পরে দিয়া এসে অনেক বোঝানোর পরে সে স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ঘটনা রেশ তার মন থেকে এখনো যায়নি। সে আর রাফসানের মুখোমুখি হতে চায় না।

.

দুপুর গড়িয়েছে অনেকক্ষন আগে। রোদের তাপ কম। গাছের কারনে রাস্তার একপাশে ছায়া আর আরেকপাশে রোদ রয়েছে। আলো ছায়া একসাথেই দেখা যাচ্ছে। তুলতুল যে পাশ দিয়ে গাছের ছায়া রয়েছে সেখান দিয়ে হাঁটছে আস্তে আস্তে। প্রাইভেট শেষ করে সে বাড়ি ফিরছে। আশেপাশে কেউ নেই। নিরিবিলি পথ। মাঝে মাঝে পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। রাস্তার কিনারে কিছু নাম না জানা লতা-পাতা রয়েছে। লজ্জাবতী গাছে গোলাপি আর বেগুনির মিশ্রণ রঙের ফুল ফুটেছে। তুলতুল গিয়ে লজ্জাবতী গাছের পাতা একটু ছুয়ে দেয়। দেখে পাতাগুলো কেমন চুপসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নতুন বউ লজ্জায় নুয়ে পড়ছে। তুলতুল হাসি দিয়ে গাছের অন্য পাতাগুলোকেও ছুয়ে বলে
-” কিরে লজ্জা পাচ্ছিস কেন? এটা মেয়েদের কাজ। তুই কেন এই কাজটা করছিস? উহুম একদম ঠিক না। এবার থেকে আর লজ্জা পাবি না বুঝলি ড্যাবড্যাব করে থাকবি। যেমন আমি থাকি কিছু হলে” বলে তুলতুল খিলখিল করে হেসে ওঠে।

তুলতুল উঠে দাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য, তখনই পিছনে তাকিয়ে দেখে কারো ওপর নজর পড়ে তাই তুলতুল দ্রুত হাঁটতে লাগে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। পিছনের ব্যক্তিটি দৌড়ে তুলতুলের পাশে এসে দাঁড়ায়। তুলতুল ভড়কে যায়। আশেপাশে কেউ নেই। সে এখন কি করবে? লোকটি তুলতুলের গা ঘেঁষে বলে

-” কি তুলতুল একা একা এখানে কি কর?” বলেই বিশ্রী ভাবে হাসলো।

তুলতুলের গা ঘিনঘিন করে উঠলো। তাদের এলাকার এক বখাটে ছেলে। মন্টুদের দলের একজন। রনি নাম। রাফসান যখন সবাইকে মারছিল তখন এটা কোথায় ছিল? ভাগ্য ভালো ছিল হয়তো এর তারজন্য হয়তো দলের সাথে ছিল না। দলের সঙ্গে থাকলে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতো না। তুলতুল কিছু না বলে সরে গিয়ে জোরে দৌড় দিতে গেল। কিন্তু রনি ধরে ফেলে। তুলতুলের কামিজের নিজের অংশ টেনে ধরেছে।

-” কি মাইয়া কই যাও? আরে কথা তো শুনো। সবসময় এমন পালাই পালাই করলে চলে?”

-“দেখুন আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ভালোভাবে বলছি আমাকে ছাড়ুন। নাহলে ভালো হবে না।”

-“আরে কি কও? ভালো না খারাপ ওইটা পরে দেখব। আগে তোমাকে দেইখা নেই। তারপর তোমার ওইযে একটা বান্ধবী আছে না দিয়া ওইটারে দেখবো। দেখতে তো সুন্দরই দেখা যায়। ”
বলে তুলতুলের কামিজ ছেড়ে কাধ জরিয়ে ধরলো। তুলতুলের যেমন গা ঘিনঘিন করছে তেমনি রাগও হচ্ছে। এতোক্ষণ সহ্য করেছে আর না। তারপর আবার দিয়াকে নিয়েও বাজে কথা বলে। মাঝে মাঝে তুলতুলের রাগ হলে উল্টো পাল্টা করে বসে। ও কাধের ওপর রাখা রনির হাতটা ধরে মোচড় দিয়ে পেছনে নিয়ে গেল। এতে রনি বাঁকা হয়ে চিল্লায়।

-” তোর সাহস তো কম না তুই আমার গায়ে হাত দিস? হাত ভেঙে একদম গলায় ঝুলিয়ে দেব।” বলে তুলতুল পেছন থেকে হাত মুচড়ে ধরে রাখা অবস্থায়ই পা দিয়ে মেন জায়গায় জোরে লাথি মেরে ছেড়ে দেয়। রনি জায়গায় হাত দিয়ে বসে পড়ে আর্তনাদ করে। তুলতুল কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে মাথায় বারি দেয়। ব্যাগে বই থাকায় ভারি হয়ে গিয়েছে সেটা দিয়ে আঘাত করায় রনি মাটির সাথে লেপ্টে বসে পড়ে। তুলতুল বলতে শুরু করে

-” কিরে কথা বলবি না? বল। শালার গু খাওয়া কু*। আমার সাথে বিটলামি। এতোদিন চুপ করে ছিলাম দেখে আজও চুপ করে থাকবো,এটাই ভেবেছিলি তাই না? শিক্ষা হয়নি? নাকি আরো লাগবে। এরপর আমার থেকে দশমাইল দূরত্ব বজায় রাখবি। নাহলে আজ শুধু জায়গায় লাথি খেয়েছিস এরপরে আর.. থাক বললাম না। এরপরে এমন লুচ্চামি করলে তখন বুঝিয়ে দেব।”

বলে তুলতুল চলে যেতে লাগলো। পিছনে রনি চিল্লিয়ে বলছে-” তোকে আমি দেখে নেব”

তুলতুল পিছনে তাকিয়ে দেখে রনি উঠে দাঁড়িয়েছে। এতোকিছুর পরেও শিক্ষা হয়নি। পাশে পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল হাতে রনির। তারমানে ওটা দিয়ে তুলতুলকে মারতে আসছে। তুলতুল এটা দেখে দৌড় দেয়। কারন তুলতুল যখন রনিকে আঘাত করে তখন সে প্রস্তুত ছিল না এজন্য তুলতুল ওর সাথে পেরেছে। প্রতিপক্ষ যখন অসতর্ক থাকে তখন তাকে আঘাত করা সহজ হয়। কিন্তু রনি এখন সতর্কভাবেই তুলতুলের দিকে এগিয়ে আসছে। তুলতুল এর সাথে পেরে উঠবে না এখন।

তুলতুল সামনে দৌড় দিয়ে দেখে একটা হোয়াইট কার রাখা। গাড়ির ভেতর থেকে আবিরকে বের হতে দেখলো। ও কি আবিরের কাছে সাহায্য চাইবে? ছেলেটাকে দেখে কিছুটা ভালো মনে হয়। সেদিন তো আবিরের কথার জন্য রাফসানের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু যদি রাফসান থাকে গাড়ির ভেতর তাহলে কি করবে তুলতুল? নাহ রাফসান থাকবে কেন সে তো দলবল, বডিগার্ড ছাড়া গাড়ি নিয়ে বের হয় না। আর রাফসানের গাড়ির কালার ব্লাক তা তুলতুল এ কয়দিনে দেখে বুঝেছে। তারমানে শুধু আবির হয়তো কোনো কাজে এসেছে। তাই হবে। তুলতুল পেছনে তাকায় দেখে রনি কাছাকাছি চলে এসেছে। তুলতুল আর কিছু না ভেবেই গাড়ির দিকে দৌড় দিল। গাড়ির সামনের সিটের দরজা খোলা। বাহ ভালোই হয়েছে তুলতুলের জন্য টানাটানি করতে হবে না। কিন্তু আবির কোথায়? ওহ ওইতো আসছে।কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো আবির ওর কথা শুনবে না। এই ভেবে তুলতুল দ্রুত গাড়ির সিটে উঠে বসতে গেলে দরজায় পা বেঁধে গাড়ির ভেতর কারো গায়ের ওপর পড়ে যায়। তুলতুল মাথা তুলে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। তুলতুলের মনে হচ্ছে সে ভয়ে ফ্রিজ হয়ে গিয়েছে। ও হুমড়ি খেয়ে রাফসানের কোলের উপরে পড়েছে। আজকে তুলতুল শেষ। ভয়ে রাফসানের থেকে সরে আাসার কথা ভুলে গেছে।

তুলতুল দেখে রাফসান ড্রাইভিং সিটে বসে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। যখন হুঁশ আসে তখন ঠেলে তুলতুলকে সরিয়ে দেয়। তুলতুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার গাড়ে একটা দশাসই থাপ্পড় পড়ে। তুলতুল গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে রাফসানের দিকে তাকায়। কিন্তু রাফসানের এতে কিছু যায় আসে না। সে চিল্লিয়ে বলে-

-” হোয়াট দা হেল আর ইউ ডুয়িং হেয়ার? ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here