মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি পর্ব -০২

মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|২|

থালা-বাসনের ঝনঝন শব্দে তরুর ঘুম ছুটে গেলো। আধো-আধো ঘুমে তরুর মনে হলো, সে কোনো গৃহিণীর সাধের রান্নাঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। গৃহিণী কোনো কারণে চেতে গিয়ে স্বামীকে বাসনকোসন ছুঁড়ে মারছে। স্টিলের বাসনগুলো ঝনঝন করে তরুর আশেপাশে এসে পড়ছে। কিন্তু আসল ব্যাপার তা না। তরুর থাকবার জায়গায় কোনো বাসনকোসন থাকার কথা না। তরু থাকে ভার্সিটির হলে। তাদের হলে রান্নার ব্যবস্থা নেই। রান্না করতে হলে করতে হয় চুপিচুপি। রান্না সেরেই চট করে আলমারিতে লুকিয়ে ফেলতে হয়। নয়তো কেস খেয়ে যাওয়ার সম্ভবনা। কেস খেয়ে গেলে পানিশমেন্টের ব্যবস্থা আছে। তরু কখনো রান্নাবান্নার ঝামেলায় যায় না। খুব ছোটবেলায় সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে জীবনেও রান্নাবান্না করবে না। এই রান্নাবান্না জনিত সিদ্ধান্তটা তরু নিয়েছে বাবার জন্য। তরুর ধারণা, সাদিকুল সাহেবের মাথায় খুবই সূক্ষ্ম ধরনের সমস্যা আছে। এই সমস্যা শুরু হয়েছে তরুর মা মারা যাওয়ার পর থেকে। সাদিকুল সাহেব সারাজীবন সরকারি চাকরি করেছেন। খুবই ছোট ধরনের চাকরি। ছোট চাকরি করা মানুষগুলোর মাঝে খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা খাই খাই ব্যাপার-স্যাপার চলে আসে। সাদিকুল সাহেব সেদিক থেকে পরিষ্কার। তিনি অত্যন্ত সৎ মানুষ। কোনো কাজের বিনিময়ে কেউ তাকে একটা পান খাওয়াতে চাইলেও তিনি ভয়ানক চটে যান। দশবার তওবা কাটেন। অত্যন্ত সৎ মানুষদের একাংশ আবার হয় ভয়ংকর পুলিশ বিদ্বেষী। তাদের ধারণা, পুলিশরা কোনো কাজ ফাজ করে না। তাদের প্রধান কাজ হলো, পাবলিকের কাঁধে চড়ে টাকা খাওয়া। সাদিকুল সাহেব সেই ভয়ংকর পুলিশ বিদ্বেষীদের একজন। পুলিশ তার দু’চোখের বিষ। তরুর বড়ো আপা, চারু, যখন সজলকে বিয়ে করতে চাইলো। তখন বাড়িতে এক ভয়াবহ লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেলো। এই লঙ্কা কাণ্ডের প্রধান কারণ হলো, সজল সদ্য বিসিএস পাশ এএসপি। সাদিকুল সাহেব কিছুতেই কোনো পুলিশ অফিসারের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন না। অন্যদিকে চারুরও কঠিন ব্রত, সজলকে ছাড়া সে এই পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে বিবাহ করবে না। প্রয়োজনে দেহ বিসর্জন দেবে তবুও প্রেম বিসর্জন দেবে না। চারুকে অবশ্য দেহ বিসর্জন দিতে হয়নি। মানুষ হিসেবে সজল খুবই বোকা ধরনের মানুষ। বোকা মানুষরা সারা জীবন বোকা বোকা কাজ করে। সজল তেমনই এক বোকা ধরনের কাজ করে বসলো। সাদিকুল সাহেবের কাছে দেনদরবার না করে সে দ্বিতীয়বার বিসিএসের পরীক্ষায় বসলো। বিসিএস তো আর ছেলের হাতের মোয়া না যে চাইলেই পাওয়া যাবে? কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয়, বোকা সজল কেবলমাত্র চারুকে পাওয়ার জন্য দ্বিতীয়বারের বিসিএস পরীক্ষাও টপকে গেলো। পুলিশের চাকরি ছেড়ে সজল প্রশাসনে ঢুকলো। সাদিকুল সাহেব খুব বিরক্ত মুখে কন্যা সম্প্রদান করলেন। তরুকে ডেকে কঠিন কণ্ঠে বললেন,

‘ খবরদার! এমন ছাগল ধরনের ছেলের প্রেমে পড়বে না।’

তরু প্রেমে পড়েনি। কিন্তু মনে মনে অসংখ্যবার চেয়েছে, এমন এক ছাগল ধরনের পুরুষ অতি অবশ্যই তার প্রেমে পড়ুক। তরুর মনে হয়, সে নিজেও একটা ছাগল। এজন্যই কোনো ছাগল তার প্রেমে পড়েনি। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অপজিট এট্রাকশন দরকার। ছাগলে ছাগলে প্রেম হবে কী করে?

পুলিশ নিয়ে যেখানে এতো এতো ইতিহাস সেখানে সাদিকুল সাহেব কী করে তরুকে ফট করে এক ডিউটিওয়ালার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন, তা খুবই আশ্চর্যের বিষয়। তরুর হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে গেলো। থালাবাসনের ঝনঝন শব্দটা যে মূলত মোবাইল টেলিফোনের শব্দ বুঝতে পেরে হাত বাড়িয়ে কল উঠালো। হেমা টেলিফোন করেছে। হেমা অত্যন্ত পড়াকু ছাত্রী। দিনে সে আঠারো ঘন্টা পড়াশোনা করে। পড়াশোনার পাশাপাশি তার একটা কঠিন প্রেম আছে। তরুর যেখানে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যেতে যেতেই দিন ফুরিয়ে যায়; হেমা সেখানে কী করে এতোকিছু মেইনটেইন করে তা তরুর কাছে খুবই আশ্চর্যের বিষয়। হেমা লাইন পেয়েই খুব গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

‘ ক্যাম্পাসে আসছিস কখন?’

‘ আসছি না।’

হেমা অবাক হয়ে বললো,

‘ কালও তো আসিসনি। কেন আসছিস না?’

তরু উদাস কণ্ঠে বললো,

‘ মন ভালো নেই তাই আসছি না। মন খারাপ একটা সংক্রামক রোগ। কারো হাসি দেখলে যেমন হাসি পায়। কারো মন খারাপ দেখলেও মন খারাপ হয়ে যায়। আমি চাই না মন খারাপ ব্যাপারটা সংক্রামিত হোক, তাই যাবো না।’

হেমা যেন এবার কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। হেমার কাছে মন খারাপ বিষয়টাই ভীষণ অদ্ভুত। তার ধারণা এই পৃথিবীতে মন খারাপ বলে কোনো বস্তু নেই। খেয়েদেয়ে সুস্থ থাকাটাই সব। মানসিক ব্যথা আবার কী? এগুলো সব উচ্ছন্নে যাওয়ার পূর্ব লক্ষ্মণ। সে প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘ খাওয়া-দাওয়া করিসনি? মন খারাপ কেন?’

তরু গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

‘ বরের আদর খেতে পারিনি বলে মন খারাপ।’

হেমা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। আর্ত চিৎকার করে বললো,

‘ ও মাই গড! তোর কী মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তরু? কী রকম ঝরঝর করে অশ্লীল কথা বলে ফেলছিস। ছিঃ!’

তরু হাই তুলতে তুলতে বললো,

‘ অশ্লীল কথার কী হলো? আমার ক্ষীণ সন্দেহ আমার কাল বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে হিসেবে কাল রাতে আমার বাসর হওয়ার কথা। অথচ আমি এখন হলের বিছানায় বসে হাই তুলছি। ব্যাপারটা দুঃখজনক না?’

‘ কাল তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে?’

‘ আমার তো তাই মনে হচ্ছে।’

‘ বিয়ে হলে হয়েছে। না হলে নাই। এখানে আবার মনে হওয়া-হওইর কী আছে? ডিরেক্ট বল, ইয়েস অর নো?’

তরু বললো,

‘ ইয়েস।’

হেমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘ কাল বিকেলে তোর সাথে আমার কথা হয়েছে, তুই ময়মনসিংহে ছিলি। এখন সকাল নয়টা বাজে এখনও তুই হলের বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস। তো বিয়েটা হলো কী করে? টেলিপ্যাথি করে?’

‘ উঁহু। টেলিফোন করে।’

‘ ওয়াও! তো, তোর বাপ বুঝি আরেক টেলিফোন দিয়ে কন্যা সম্প্রদান করলেন? বড়ো মামা আরেক টেলিফোন দিয়ে উকিল বাপ হলেন। চারু আপা আর দুলাভাই আরেক টেলিফোন দিয়ে হাততালি দিলেন, তাই তো? অত্যন্ত সুখের সংবাদ। শুনে খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।’

‘ তুই ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না।’

‘ সিরিয়াসলি নেওয়ার মতো কথা তুই বলছিসও না। এমন ভেলকিবাজি তুই আগেও বহুতবার করেছিস। আমি আর বোকা নেই। এসব না করে একটু পড়াশোনা কর। আর… ‘

তরু টেলিফোন রেখে দিলো। হেমার জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে বিষণ্ণ এক মন খারাপ। তরুর বারবার মনে হচ্ছে, সে ফেঁসে গিয়েছে। সেই ডিউটিওয়ালা, যার নাম তরু একবার শুনেছিলো কি শুনেনি, সে একদমই ছাগল টাইপ হবে না। সে হবে শেয়াল টাইপ। তার মাথায় থাকবে গিজগিজে বুদ্ধি। যে বুদ্ধি দিয়ে সে কেবল বাস্তবিক চিন্তা করবে। বাস্তব জীবন নিয়ে ভাববে। তার বুদ্ধির খাতায় থাকবে লাভ লসের বিশাল বিশাল অঙ্ক। তরুর রূপকথার মতো মন সে বুঝতে পারবে না। জীবনসঙ্গী মানে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু৷ তরুর একটা জীবন কেটে যাবে তীব্র বন্ধুহীনতার যন্ত্রণায়। এমন হলে তরু খুব কষ্ট পাবে। ছোটকাল থেকে জমানো অনেকগুলো স্বপ্ন একসাথে ভেঙে যাবে। তরুর চোখ ভিজে আসছে। বুকের ভেতর কষ্টগুলো কালবৈশাখী ঝড়ের মতো হুল্লোড় করছে। এমন ভয়ংকর কষ্টের ঝড় তার একুশ বছরের জীবনে কক্ষনো আসেনি। মায়ের মৃত্যুর সময়ও না!

তরুর মন খারাপের ভিন্ন ভিন্ন ধাপ আছে। ভিন্ন ভিন্ন মন খারাপের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ঔষধ আছে। এই যেমন তীব্র মন খারাপের জন্য তীব্র ঘুম। মাঝারি মন খারাপের জন্য মাঝারি ঘুম। তরু আজ তীব্র ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তীব্র ঘুমের প্রস্তুতি অনুযায়ী একটা লেক্সোপিল খেয়ে নিয়েছে। লেক্সোপিল একটা ঘুমের ঔষধ। যাদের হৃদয়ঘটিত সমস্যা আছে তাদের জন্য উপকারী। এই ঔষধগুলো তরু অনেকদিন আগে আপার ঘর থেকে সরিয়ে ফেলেছে। কেন সরিয়েছিলো জানে না, তবে আজ দারুণভাবে কাজে লেগে গিয়েছে। তরুর লেক্সোপিলওয়ালা ঘুমের মাঝেই অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো। কানের কাছে টেলিফোনটা বুম বুম করে বাজছে। ঘুমের ঘোরে তরুর মনে হচ্ছে তরু একটা অজগরের পিঠে চড়ে বসে আছে। অজগরটা থেকে থেকে গা ঝাড়া দিচ্ছে। অজগরের সাথে সাথে তরুর সারা শরীরও কাঁপছে। অজগরের গা ঝাড়া থামাতে তরু হাত বাড়লো। ফোন রিসিভ করে বিরক্ত কণ্ঠে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে ভীষণ মায়া মায়া কণ্ঠে জবাব এলো,

‘ কেমন আছো মা?’

তরু ভালো নেই। তরুর মাথাব্যথা। তার থেকেও ভয়ংকর হলো, তার প্রচণ্ড হৃদয়ব্যথা। এই ব্যথা কমছে না। লেক্সোপিল খেয়েও কমছে না। তরুর ধারণা, তার এই মর্ম ব্যথা জীবনেও কমবে না। এই ব্যথার কথা কাউকে বলা যাবে না। কেবল সয়ে যেতে হবে। সে মিথ্যে করে বললো,

‘ ভালো আছি।’

এই একটা মিথ্যে কথাই তরু চট করে বলে ফেলতে পারে। পরিশ্রম করতে হয় না। তরু খেয়াল করেছে, সবচেয়ে বড়ো বড়ো মিথ্যাগুলোই অবলীলায় বলে ফেলা যায়। ছোট ছোট মিথ্যাতেই যত কষ্ট। তরু শুধালো,

‘ আপনি কে?’

ভদ্রমহিলা বললেন,

‘ আমি মাহবুবের মা। তোমারও মা অবশ্য।’

মাহবুব! কোন মাহবুব? তরু কোনো মাহবুবকে চিনতে পারলো না। ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘ আমি কোনো মাহবুবকে চিনি না। রং নাম্বার।’

ভদ্রমহিলা ব্যস্ত হয়ে বললেন,

‘ মাহবুবুল হাসান নীরব। চিনতে পারছো না? সেকি কথা!’

তরুর ঘুম কেটে গেলো। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ আমি যেখানে কোলকাতাই চিনি না সেখানে ইংরেজিতে ক্যালকাটা বললেই কী চিনে ফেলবো চাচি? মাহবুবকেই চিনি না, মাহবুবুল হাসান নীরব তো আরও কঠিন ব্যাপার। মন খারাপ করবেন না চাচি, আপনি বোধহয় ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছেন।’

‘ তুমি তরু না?’

তরু অবাক হয়ে বললো,

‘ কী আশ্চর্য! আপনি কী করে জানলেন?’

ভদ্রমহিলা বিরক্ত হলেন না। স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন,

‘ তোমাকেই তো টেলিফোন করেছি বোকা মেয়ে! একদিনেই বরের নাম ভুলে গেলে চলবে মা?’

তরু হঠাৎ কিছু বুঝতে উঠতে পারলো না। খানিকক্ষণ চুপ করে চিন্তা করতেই ‘বর’ শব্দটা মস্তিষ্কে বলের মতো ডিগবাজি খেলো কয়েকবার। বর! তরুর বর! তরুর বর কোথা থেকে….. ও মাই গড! শিট! শিট! শিট! তরু লাফিয়ে উঠে বসলো। ব্যস্ত হয়ে বললো,

‘ মা! সরি, মা। একদম ভুলে গিয়েছিলাম আমি। মানে..
আসলে ঠিক ক্যাচ করতে পারিনি।’

ভদ্রমহিলা স্মিত হেসে বললেন,

‘ বুঝতে পারছি। এমন একটা পরিস্থিতিতে বিয়েটা হলো!’

তরু হঠাৎ করেই কোনো কথা খুঁজে পেলো না। কিছুক্ষণ ভেবে অপ্রস্তুত কণ্ঠে শুধালো,

‘ জি মা। বলছি, আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?’

ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন,

‘ আমি মা হলে মাহবুবের বাবা বুঝি তোমার আঙ্কেল হবে?’

তরু কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো। ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই বললেন,

‘ তোমার শ্বশুর আব্বা আগের থেকে ভালো আছেন। প্রাণসংশয়ের ব্যাপার নেই। কিন্তু কথাবার্তা বলতে পারছেন না। ডানহাত আর ডানপাটাও অবশ। মাহবুব দেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে চাইছে। তুমি আসবে আজ হাসপাতালে? নতুন বউ তুমি আর তোমাকে হাসপাতালে ডাকছি। কী একটা অবস্থা বলো তো?’

তরু তাড়াহুড়ো করে বললো,

‘ না, না। কী বলছেন? আমি নিজেই যেতে চাচ্ছিলাম হাসপাতালে। আপনাদের কারো ফোন নাম্বার নেই। বাবার থেকেও চাইতে পারছিলাম না। যোগাযোগ… ‘

কথাটা বলে নিজেই অবাক হয়ে গেলো তরু। সে সাধারণতো মিথ্যে কথা বলতে পারে না। তবে আজ কী হলো? সে কী আনমনে হাসপাতালে যেতে চাইছিলো? কক্ষনো না। একটু আগেও এই বিয়েটা নিয়ে তার এক সমুদ্দুর দু’টানা ছিলো। তবে? এটা কী বিয়েশাদির সাইডইফেক্ট? তাহলে তো খুব বিপদের কথা! মানুষ বিয়ে করে ভদ্র হয়, লক্ষ্মী হয়। সে তো আরও বেত্তমিজ হচ্ছে! শ্বাশুড়ি মা অবশ্য তরুর কথায় খুশি হলেন৷ আনন্দে বিগলিত হয়ে বললেন,

‘ সত্যি আসবে? তোমার একা আসার দরকার নেই। নতুন বউ, একা চলাচল করা ঠিক না। মাহবুব গিয়েছে তার বাবার কিছু রিপোর্ট আনতে। আমি সরবকে পাঠাচ্ছি। তুমি রেডি হও। সরব গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে।’

‘নতুন বউ’ শব্দটা তরুর মাথায় টেপরেকর্ডারের মতো ঘুরতে লাগলো। তরু নতুন বউ? টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট আয়নার দিকে চাইলো তরু। চেয়ে রইলো অনেকটাক্ষণ। কই! কোথাও তো কোনো রঙ নেই। আনন্দ নেই। কারো অকারণ বাহানা নেই। একেবারে ‘নেই, নেই’ ঝুড়ি নিয়েও বুঝি নতুন বউ হয়? তরু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে শুধালো,

‘ সরব। সরব কে?’

‘ আমার ছোট ছেলে। ওর নাম মাহমুদুল হাসান সরব। আমরা সরব ডাকি।’

তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলতে ইচ্ছে হলো,

‘আমি কোনো হাসপাতাল ফাসপাতালে যাবো না। খবরদার! আমাকে আর কখনো ফোন করবেন না। এই বিয়ে বিয়ে খেলা আমার ভালো লাগছে না।’

তরু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলো, এই কথাগুলোর পরিবর্তে সে খুব মিষ্টি করে বিদায় জানালো। তরু কী তবে পাল্টে গেলো? এক রাতেই পাল্টে যাওয়া যায়? তাহলে মাহবুব লোকটা পাল্টাচ্ছে না কেন? মাহবুব! নামটা এখনও কত অপরিচিত। কত দূরের। এই লোকটা নাকি তার বর! তরুর হঠাৎ করেই বিতৃষ্ণায় বুক ভরে গেলো। হাসফাস লাগছে। আত্মাভিমানী মন মিইয়ে থাকা আগুনে ঘি ছিটাচ্ছে। মন পুড়ছে। কেন পুড়ছে? তরু জানে না। হয়তো জানে, কিন্তু সে বলবে না। সব কথা নারীরা মুখে বলে না। তরু জানে, তার মনের এই কথাগুলো সেই ডিউটিওয়ালা কখনোই বুঝবে না। কখনোই না!

”কেন আশা বেঁধে রাখি।
কেন দীপ জ্বেলে রাখি।।

জানি আসবে না ফিরে আর তুমি।
তবু পথ পানে চেয়ে থাকি…..”

সুরেলা কণ্ঠে গুনগুন করে হল থেকে বেরিয়ে এলো তরু। দাঁতের ফাঁকে পিষে চলেছে চুইংগাম। তরু ভেবে রেখেছে হাসপাতালে পৌঁছে মাহবুব নামক লোকটাকে বড়োসড়ো একটা চমক দেখাবে। মাথায় এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে তার পা ছুঁয়ে সালাম করবে। লাজুক লাজুক কণ্ঠে বলবে,

‘ ওগো স্বামী, তুমি ভালো আছো?’

তরুর হঠাৎ এমন আচরণে লোকটা কী হতভম্ব হয়ে যাবে না? তরুর ব্যাগে একটা কমলা রঙা লিপস্টিকও আছে। কমলা রঙের লিপস্টিকে তরুকে জঘন্য লাগে। তরু ভেবেছে ঘোমটা দেওয়ার আগে সে অবশ্যই এবং অবশ্যই এই লিপস্টিকটা পরবে। তরু আবারও গুনগুনিয়ে গান ধরলো। হল থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগুতেই হ্যাংলা-পাতলা, খুব লম্বা দেখতে এক ছেলেকে চোখে পড়লো। ছেলেটার ড্রেসিং সেন্স চমৎকার। কানে কালো রঙের একটা হেডফোন। মনে হয়, গান শুনছে। তরু এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

‘ কেমন আছো সরব?’

তরু সরবকে চেনে না। হাওয়ার উপর ভর করে জিজ্ঞেস করেছে। মিলে গেলে ছেলেটি চমকে যেতে পারে। কিন্তু ছেলেটি চমকালো না। বিমর্ষ কণ্ঠে বললো,

‘ ভালো নেই। ভাইয়া এসেই আমাকে দুটো চড় মেরেছে। চড় খুবই নগণ্য ব্যাপার। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ভাইয়া আমার ফোন নিয়ে নিয়েছে। ফোন ছাড়া হেডফোন কানে দিয়ে ঘুরছি। এখন কী ফোন নিয়ে নেওয়ার সময় বলো? তোমাকে এর বদলা নিতে হবে ভাবী। বাই হুক অর বাই ক্রুক।’

সরবের কথায় নিজেই চমকে গেলো তরু। এই ছেলে তো তার থেকেও দুই ডিগ্রি উপরে। প্রথম সাক্ষাতেই ভাবী! ভাবী পর্যন্তও থেমে নেই একেবারে বিচার ফিচারও দেওয়া শেষ! তরু অবাক হয়ে বললো,

‘ তুমি কী করে জানলে, আমি তোমার ভাবী?’

সরব বললো,

‘ তুমি কী করে জানলে আমি সরব?’

‘ অনুমান করেছি।’

‘ আমিও অনুমান করেছি।’

সরবের বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললো তরু। সরবও হাসলো। ঠিক তখনই তরু খেয়াল করলো, সরব বাচ্চা ছেলে। হাতে-পায়ে তরুর মাথা ছাড়িয়ে আরও তিন চার ইঞ্চি বেড়ে গেলেও চেহারায় বালক বালক ভাব। তরু শুধালো,

‘ তুমি কী খুব ছোটো?’

সরব হেসে বললো,

‘ খুব ছোটো না। মোটামুটি ছোটো। আমার সবকিছুই মোটামুটি ধরনের। ছাত্র হিসেবে অবশ্য মোটামুটি থেকে একটু নিচে নেমে গিয়েছি। প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় অঙ্কে ষোল পেয়েছি। ডাহা ফেইল।’

তরু হাসলো। কত অবলীলায় নিজের লজ্জার কথাটা বলে ফেললো সরব। তরু অবাক হয়ে বললো,

‘ আমি তো তাহলে তোমার থেকেও দুই গ্রেড নিচের স্টুডেন্ট। আমার দুই সাবজেক্টে ফেইল এসেছে। ডাহা ফেইল।’

সরব হো হো করে হেসে উঠলো। সরবের হাসি সুন্দর। তরু সরবের হাসিমুখের দিকে চেয়ে আচমকা জিজ্ঞেস করে ফেললো,

‘ তোমার ভাইয়া কী তোমার মতো দেখতে?’

সরব ঠোঁট উল্টালো,

‘ না তো! আমাদের সবার চেহারা আলাদা আলাদা। কারো সাথে কারো মিল নেই। তুমি ভাইয়াকে দেখোনি? কী আশ্চর্য!’

তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আশ্চর্যই বটে! সরব নিঃসংকোচে তরুর হাত ধরলো। বললো,

‘ চলো, হাসপাতালে গেলে দেখতে পাবে।’

তরু কিছুটা অবাক হলো। বিস্ময় ছাড়িয়েও অদ্ভুত এক মানসিক টানাপোড়েনে অস্থির হয়ে উঠলো মন। হাসপাতালে গেলে দেখতে পাবে! মুখোমুখি হবে! তারপর? তারপর কী হবে? লোকটা তাকে কী বলবে? সে কী উত্তর দিবে? তরুর পা যেন হঠাৎ করেই আড়ষ্ট হয়ে এলো। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বললো,

‘ আমি যাবো না। যেতে ইচ্ছে করছে না।’

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here