#মেঘের_পালক
পর্ব-১০
অরিনকে দেখার পর থেকেই প্লাবনের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কী দারুণ লাগছে অরিনকে! এতটা দিন কত চেষ্টা করেছে মেয়েটাকে ভুলতে, কিন্তু ভুলতে পারেনি। কোনো না কোনোভাবে ঠিকই মনে পড়ে গেছে। পৃথিবীটা সত্যিই গোল। তাই জন্যই আবার দেখা হলো তাদের। আর আজ দেখার পর থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না প্লাবনের। অরিন খুব সুন্দর হয়েছে। নাকি এতদিন পর দেখায় সুন্দর লাগছে কে জানে!
প্লাবনের মা বলে রেখেছিল বিয়েতে এসে কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে বলতে। প্লাবন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে অরিনের কথা বলবে মাকে। এতদিন পর আসলে আগের কথা তেমন কিছু মনে নেই। সেসব যেন মিঠে স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে৷ সে মায়ের খোঁজে এদিক ওদিক হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু মাকে খুঁজে পেল না। দেখা হয়ে গেল অরিনের সাথে।
দু’জন সামনাসামনি পড়ে প্রথমটায় অস্বস্তিতে পড়ে গেল। প্লাবনই আগে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কেমন আছ অরু?”
“অরু মানে? আমার নাম অরিন। নামটাও মনে নাই?”
“আছে তো। আরও অনেক কিছু মনে আছে। ওটা তো আদর করে ডাকলাম।”
“আপনার সাথে আমার আদর করে ডাকার সম্পর্ক?”
“না, তবে হতেও পারে।”
“ইম্পসিবল!”
বলে চলে গেল অরিন৷ প্লাবনের মজাই লাগল৷ অরিনকে বিয়ে করতে পারলে সারাজীবন মিষ্টি ঝগড়া করে কাটবে৷ ব্যাপারটা খারাপ হবে না একেবারেই!
সে আবার মাকে খুঁজতে শুরু করল।
★
মানুষের মধ্যে একটা বয়সে আপনা থেকেই পরিণত চিন্তাভাবনা আসে। অরিনেরও এসেছে৷ এক বছরেই সে অনেকটা বড় হয়ে গেছে। তার একটা কারন বোধহয় অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়া। জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ায় আগেকার ফ্যান্টাসি এখন আর নেই। তবু মনটা এত অস্থির লাগছে ক’দিন ধরে প্লাবনকে দেখার পর থেকে! কী সমস্যা কে জানে! এমন তো কখনো কারো জন্য হয় না।
ভোরে সে বের হয়েছে ক্লাসে যাবে বলে। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। রিকশা না পেয়ে হেঁটেই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছুল সে। বাস আসছে সব ভর্তি হয়ে। তিল ঠাঁই নেই অবস্থা। কোনো একটায় উঠে পড়লে হয়, কিন্তু ধাক্কাধাক্কি অসহ্য লাগে অরিনের। সে দাঁড়িয়েই রইল।
আচমকা একটা পরিচিত কন্ঠের ডাক শুনে পাশ ফিরল। প্লাবন! সমস্যা কী এর? পরপর দুদিন দেখা পাওয়া গেল মহাশয়ের! ওকে ফলো করছে নাকি?
“তোমার আজকে ক্লাসে যাওয়া জরুরি অরু?”
অরিন মুখ শক্ত করে বলল, “আমার নাম অরিন।”
“আমি জিজ্ঞেস করেছি ক্লাসে যাওয়া জরুরি কি না!”
অরিনের গলা শুকিয়ে এলো। প্লাবনের কন্ঠে অধিকারবোধ জড়িয়ে আছে। এমন করে কথা বলছে কেন? অরিন শক্ত থাকতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে গলে যাচ্ছে। তবু চেষ্টা করল কঠিন হয়ে থাকার। বলল, “অবশ্যই। ক্লাসে না গেলে ফাইন কে দিয়ে দেবে? আপনি?”
“নাহয় একদিনের ফাইন দেব। চলো যাই কোথাও বসি।”
“আমার ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে।”
“মিথ্যে বলছ কেন? আজকে কোনো জরুরি ক্লাস নেই। অর্নবের কাছেই শুনলাম।”
কথাটা সত্যি। তাই ফিরতি আরেকটা মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হলো না অরিনের। সে বলল, “আমার কোথাও বসার সময় নেই। বাস পেলে ক্লাসে যাব, নয়তো বাসায়।”
“জাস্ট একটু। অল্প কথা শোনার মতো মানসিকতা তোমার নিশ্চয়ই আছে। আমি এত খারাপ লোক নই।”
“ঠিক আছে।”
“বসবে?”
“না। আপনি যে খারাপ লোক নন সেটা মেনে নিলাম।”
“তাহলে বসতে কী সমস্যা?”
“ইচ্ছে নেই।”
প্লাবন চুপ করে গেল। বাস পাওয়া গেল না একটাও। এদিকে বৃষ্টি নেমে গেল জোরেশোরে। দুজনার কাছেই ছাতা আছে, তবে এই তুমুল বৃষ্টিতে সেই ছাতা কাজে দেবে না। অরিন ছাউনির নিচে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। সে আর প্লাবন ছাড়া কাছাকাছি একটা মানুষও নেই।
প্লাবন জিজ্ঞেস করল, “তোমার বৃষ্টি দেখতে কেমন লাগে?”
অরিন যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল, “ভালো।”
“আমার কিন্তু ভীষণ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে মুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকি। এইযে প্রকৃতির প্রতি প্রেম, এটা কেন হয় বলতে পারো?”
“জানি না।”
“ধরো তুমি খুব বিশাল এক সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছ, যার গায়ে জন্মে আছে অগণিত গাছপালা, পথে বুনোফুল, পাহাড়ের বুক ফেটে বেরিয়ে আসা স্বচ্ছ ঝর্ণা! কিংবা ধরো সমূদ্র, প্রথমবার দেখলেই তার সাথে প্রেম হয়ে যায়। কেন হয়? শুধু সুন্দর বলেই? না, তারা আমাদের চোখের সাথে সাথে তাদের বিশালতা আর গভীরতা আমাদের ভেতরের শান্তি যোগায়। ঠিক তেমনটা আমরা কেন মানুষের ক্ষেত্রে ভাবি না বলো তো? আমি যখন তোমাকে প্রথমবার ভালোবাসি বলেছিলাম তখন তোমার চোখে আমি সেই অজস্র আনন্দের ধারা দেখতে পেয়েছিলাম। তোমার মুখ দেখে এতটা শান্তি লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। হ্যাঁ, প্রপোজটা মিথ্যে ছিল, কিন্তু তারপরের পুরোটা সত্যি ছিল অরু!”
অরিন তাকে অরু বলার জন্য এবার কিছুই বলল না। কথাগুলো তার মাথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্লাবনও তাকে সময় দিল একটু বুঝতে।
অরিন কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করল, “আর চিঠিটা?”
“ওহ! ওটার জন্য স্যরি। আমি নিজে চিঠিফিঠি কখনো লিখিনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি বলে মনে সেরকম রসকসও নেই যে রাগ ভাঙানোর জন্য সুন্দর করে চিঠি লিখব৷ তাই অন্যের সাহায্য নেয়া। আমি স্বীকার করছি কাজটা উচিত হয়নি।”
“তাই বলে অর্নবের লেখা চিঠি….”
“অর্নবের হবে কেন? আরেক বন্ধু আছে৷ আমার আর অর্নবের কমন ফ্রেন্ড। নাম উদাস। খুবই ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। তোমাকে দেখা করিয়ে দেব তার সাথে।”
“আচ্ছা।”
চিঠিটা অর্নবের লেখা না হওয়ায় অরিন একটু স্বস্তি পেল। তার এখন শীত শীত লাগছে। বৃষ্টি কমে আসছে। প্রচন্ড বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে গায়ে ঠান্ডা পানির টুকরো ছিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
প্লাবন বলল, “খুব রোমান্টিক ওয়েদার না?”
“হুম।”
“একটা কথা বলব অরু?”
“বলুন।”
“তার আগে বলো তুমি আমাকে আপনি বলছ কেন? তুমি করে বলবে।”
“কী কথা সেটা বললে ভালো হয়।”
“ওহ! কথাটা হলো, তুমি কি সত্যিই খুব গালাগালি করতে পারো? সেদিন যা সব লিখেছিলে! ওসব মুখেও বলো? আমার আবার গালাগালি সহ্য হয় না একেবারেই। তুমি যদি…”
অরিন রেগে গিয়ে বলল, “আপনি যেমন চাইবেন আমি তেমন হয়ে দেখাব? এত ঠেকা কেন আমার? গালি দিতে চাইলে একশো বার দেব৷ আপনি না করার কে?”
অরিনের গাল দুটো ফুলে উঠেছে। প্লাবন রাগ করতে গিয়েও করতে পারল না। তার হাসি পেয়ে গেল। অরিনকে বাচ্চা মেয়েদের মতো লাগছে। সে কাছে গিয়ে অরিনের গালদুটো টেনে দিল।
ঝটকা দিয়ে সরে গেল অরিন। চেঁচিয়ে বলল, “আপনি আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?”
প্লাবন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তাদের সম্পর্কটা আসলে গোলমেলে। বাজে রকমের ভুলভাল কাজকর্ম তারা শুরু থেকে করে সেটাকে আরও জটিল পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্লাবন ভেবেছিল আজ কোনো ভুল করবে না। কিন্তু হয়েই গেল।
অরিনের গালদুটো আরও ফুলেছে। সাথে লাল হয়ে আছে মুখ। রাগে নাকি লজ্জায় বোঝা যাচ্ছে না।
প্লাবন দুই হাত ওপরে তুলে বলল, “আচ্ছা স্যরি! তুমি বোঝার চেষ্টা করো অরু, আমি তো তোমাকে সব বললাম।”
“আমি কিছু বুঝতে চাই না। আপনার ওপর আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। বাংলাদেশে আরও অনেক মেয়ে আছে। আপনি শুধু আমাকেই চোখে দেখেন? আপনার পেছনেও তো কত মেয়ের লাইন! আমাকে জ্বালাবেন না প্লিজ।”
প্লাবন হতাশ হয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই একটা বাস এসে থামল। মোটামুটি ফাঁকা বাসটা। অরিন চোখের পলকে উঠে বসল সেটাতে। বাসটাও হাওয়া হয়ে গেল দেখতে দেখতে। প্লাবনের খুব খারাপ লাগতে লাগল।
এদিকে অরিন বাসে উঠে একটা খালি সিটে বসে কেঁদে ফেলল। সে জানে না বাড়াবাড়ি করে এসেছে কি না। কিন্তু মনে বড্ড বেশি অভিমান জমে গেছে। এতই যখন প্লাবনের প্রেম, তাহলে এই এক বছর সে ছিল কোথায়? এতদিন পর এসে এত অধিকার দেখায় কেমন করে?
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু