#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
৮||
কিছুটা ভয়ে ভয়েই বাড়ীতে পা রাখল মেঘা। মেজ জা রান্নাঘরেই ছিলেন। মেঘাকে দেখে প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও মুহূর্তেই সামলে নিয়ে বললেন,
– “কী অবস্থা এখন বাবুর?”
-” জি, আলহামদুলিল্লাহ।”
মেজ জা হাতের বাটিটা একপাশে রেখে আরশকে কোলে নেবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,” আরে আমার শরীরটা গত এক সপ্তাহ ধরে যে কী খারাপ যাচ্ছে। তোমার মেজ ভাইকে প্রতিদিনই বলি, আজ বাবুটাকে দেখতে যাব। আজ দেখতে যাব..! কিন্তু যাই যাচ্ছি করে আর যাওয়া হলোনা। ও নিজেও সময় বের করতে পারছেনা। তাই আর যাওয়া হয়নি। আজকেই মাত্র নিয়্যত করেছি যাবো বলে আর আজই তুমি চলে এলে।”
মেঘা কোন কথা না বলে ভদ্রতার হাসি হাসল। আরশকে কোলে নিয়ে মেজ জা ওর থুতনী নেড়ে দিয়ে বললেন, ” হাসপাতালে থেকে মানুষ শুকায় আর তোমার ছেলে দেখি মোটা হয়ে আসছে। ওজন তো ভালোই বাড়সে মনে হয়।”
মেঘা সবেমাত্র গেটের লকে চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতে যাচ্ছিল তার আগে ওর নিজেরই কলজেটা মোচড় দিয়ে উঠল মেজ জার কথা শুনে। রাগও হলো খুব। বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে মুখের ওপর মন্তব্য করে কেউ ? মাত্রই তার বাচ্চাটা অত বড় ফাড়া কাটিয়ে উঠল আর আজই কী না..! মেঘা তাৎক্ষণিকভাবে কী বলবে ভেবে পেল না। তবে মনে মনে বদনজরের দু’আ পড়ে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে নিল। শান্ত ভঙ্গিতে গেট খুলে মেজ জার হাত থেকে বাচ্চাটা নিতে এলে উনি মৃদু ঝামটা মেরে বললেন, ” আরে তুমি আগে তোমার হাতের কাজ সারো। বাচ্চা আমার কোলে আছে থাক না। তুমি তোমার ব্যাগট্যাগ গুছাও তারপর নাও । অস্থির হবার কী আছে।”
মেঘা কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। ঘরে ঢুকে ব্যাগ থেকে এটা সেটা বের করে গোছাতে শুরু করে দিল। মেজ জা হঠাৎ কাছে এসে গলা খাদে নামিয়ে বলল, ” বড়জন তো রেগে টং হয়ে আছে।”
মেঘা ব্যপারটা আগেই শুনেছে আম্মার কাছে। তাই চট করে কোন মন্তব্য করল না। মেজজা আবারও বললেন, ” অবশ্য রাগ করবে নাই বা কেন। পুরো ঠিকঠাক বিয়েটা ভেঙ্গে দিল বর্ষণ। এটা কোন কাজ করলো সে ? আর তুমিও যেমন। কোন আক্কেলে ওকে নিয়ে ক্লিনিকে গেলে?”
মেঘা মেজ জার দিকে একবার তাকিয়ে ফের কাজে মন দিল। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর। মেজজা ফিসফিস প্রায় কণ্ঠে বললেন, ” রাতে নাকি ওখানেই থেকেছে ? ”
মেঘার হাত থেমে গেল এবার। মুখ শক্ত করে তাকাল মেজ জা’র দিকে। তিনি মেঘার চাউনি উপেক্ষা করে বললেন , ” অমন সেয়ানা ছেলে বাড়ীর বাইরে থাকলে তো সন্দেহ হবেই। সুরমা ভাবি ক্ষেপে বোম হয়ে আছে। এতোই রেগেছে যে, নিজের মায়ের পেটের ভাইকেই শেষ পর্যন্ত এ বাড়ীতেই আসতে মানা করে দিলেন। ”
মেঘা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
-” আমি এখন গোসল করব ভাবি। জমে থাকা কাপড়গুলো ধোব। বেলা পড়ে আসছে।”
মেজ জা বুঝল এটা পরোক্ষভাবে তাকে চলে যেতে বলা। সে কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। মেঘা তার ডোর লক করে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। একটু একটু করে ভয় বাড়ছে। এরা তাহলে এখানে বিরাট কাহিনী খাড়া করেছে। একজন কাহিনীকার আর বাকিরা দর্শক। মেঘা তাদের তামাশার পাত্রী। নইলে এরা ভালো করেই জানে বর্ষণের হাসপাতালে রাতে থাকার কোন প্রশ্নই আসেনা। তারপরেও ইচ্ছে করেই এই অভিযোগটা তৈরী করা। এটা তো ইচ্ছে করেই মেঘাকে বেকায়দার ফেলা। নয়ত আর কী ? আরেকটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর। কিছুক্ষণ বিমর্ষ বসে থাকার পর সব চিন্তাকে একপাশে সরিয়ে অবশেষে উঠতে হলো ওকে। আরশকে আম্মার ঘরে দিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে জমা কাপড়ের পাহাড় নিয়ে ধুতে বসে গেল মেঘা। তবে ধোয়া শেষ করে আজ আর সাথে সাথেই ছাদে গেলনা। ইচ্ছে আছে একবারে গোসল সেরেই যাবে। তাছাড়া গত কয়েকদিন হাসপাতালে থাকায় চুলেও ঠিকমত শ্যাম্পু করা হয়নি। প্রচুর ফেনা তুলে চুলে শ্যাম্পু করল। তারপর শাওয়ারের নবটা মোচড়াতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল মেঘার। পানি নেই। একফোঁটাও পানি পড়ছে না শাওয়ার থেকে। অথচ একটু আগেও ঝরঝর করে পানি ঝরেছে। ব্যপারটা আশ্চর্যই লাগল। কিন্তু এই মুহূর্তে কাকে ডেকে বলবে পানির কথা। ওর এখন পানিটাই তো আগে দরকার । সবাই নিশ্চয়ই এখন যার যার ঘরে ডোর লক করে বসে আছে। মেঘার নিজের অবস্থাও শোচনীয়। পুরো একমাথা শ্যাম্পু। এটা নিয়ে বেরোবে কীভাবে। এটা না থাকলে সে নিজেই বেরিয়ে পাম্পের সুইচ অন করত। এখান থেকে চিৎকার করে আম্মাকে ডেকেও তো লাভ হবেনা। তিনি নিজেই এখন ক্লান্ত হয়ে আরশকে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন। তার ঘরের দরজাও বন্ধ।
প্রায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করে অবশেষে মেঘাকেই বেরোতে হল। পুরোনো একটা মেক্সি গায়ে চড়িয়ে ভারী তোয়ালেতে মাথা পেঁচাল মেঘা। তার উপরে বড় ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে সন্তর্পনে বাইরে এসে মটরের সুইচ অন করতে যাবার মুহূর্তেই সুরমা চিৎকার দিয়ে উঠল, ” এই সুইচে হাত দিবানা। খবরদার বললাম, খবরদার”।
বিস্মিত মেঘা প্রথমটায় থতমত খেয়ে বলল, ” কলে পানি নেই ভাবি। আমি গোসল করব, চুল ধোব। আমার মাথায় এখনো শ্যাম্পু। এজন্যেই…!”
-” ঐসব কোন কথা শুনতে চাই না। সুইচে হাত দিবানা বাস, কথা শেষ।”
মেঘা হতবিহ্বলের মত তাকিয়ে থেকে অবশেষে বলল, ” তাহলে আমি এখন কী করব ? এভাবেই বসে থাকব? ”
-” এইভাবে বসে থাকবা না শুয়ে থাকবা সেটা তুমি জানো। সুইচ দিলে ঘটনা খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”
” আশ্চর্য এটা কেমন কথা বলেন আপনি ? হাউজে কী পানি নেই? ”
-” তোমার বাপের চাকর নাই কেউ এখানে যে হাউজের খবর রাখবে। বেতন দিয়ে কেয়ারটেকার রাখো। সে তোমারে দুই বেলা এসে পানির খবর দেবে।”
মেঘা পাথরের মুর্তির মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল মিনিট খানেক। সুরমা তখনও নির্বিকারে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। তার কোন বিকারই নেই। অগত্যা মেঘাকে শ্বাশুড়ীর ঘরে আসতে হল। বেচারী বুড়ো মানুষ। ইতোমধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু মেঘার উপায় নেই। তার গায়ে হাত রেখে ডাকতেই তিনি চোখ মেললেন। মেঘা বিড়বিড় করে পানি না থাকার কথাটা বলল। সুরমা ভাবির চিৎকার চেঁচামেচির কথাও বলল সংক্ষেপে।
কোহিনুর বেগম কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বললেন, ” ঘরের পানি দিয়া কাম সারো। কী আর করবা। সে তো পায়ে পা দিয়া ঝগড়া করার তালে আছে। ”
-” আম্মা , ঘরের জমা পানিতে কী চুলের শ্যাম্পু যাবে ? তাছাড়া ঘরে পর্যাপ্ত খাবার পানিও তো নেই। আবার ফোটাব ঠান্ডা করব। কত ঝামেলা। ” মেঘা অসহায়ের মত বলল।
কোহিনুর বেগম কিছুক্ষণ ভেবে অবশেষে আস্তে করে উঠলেন। এলোমেলো কাপড় সামলে ধীরে ধীরে বাইরে এসে বড় ছেলের ঘরে উঁকি দিলেন। সুরমা সবে ভাত খেতে বসেছে। শ্বাশুড়ীকে দরজায় দেখেও সে ভ্রুক্ষেপ করল না। কোহিনুর নিজেই বললেন,
-” অ সুরমা। পানিটা ছাইড়া দেও না মা। বউটা ভিজা কাপড়ে বইসা রইছে।”
-” বইসা থাক গে। আমার বাপের কী ? আসছে কেন এই বাড়ীতে। এই বাড়ীতে আসলে এই বাড়ীর নিয়ম মানতে হইব। বিকাল তিনটার পর মটর ছাড়া নিষেধ। জানে না ? এটা পিক আওয়ার। এসময় মটর ছাড়লে কত টাকা বিল উঠে আপনার শিক্ষিত বউমা খবর রাখে?”
-” আচ্ছা, আইজকা ছাইড়া দেও। কালকা থেকা পানি ধইরা রাখব। বারে বারে মটর ছাড়ব না। আজকা তো সে হাসপাতাল থেইকা আইছে।”
-” শোনেন, আম্মা। ছেলের বউয়ের হয়ে তরফদারী করতে আসবেন না। আমরাও বউ। আর আপনার ছোট পুতের বউও বউ। সে তো বাইরে থেকে আসছে। দেখা করসে কারো সাথে? না সালাম না কালাম। যেন বিরাট জমিদার বাড়ীর মেয়ে। এমনটাই তার দাপট। আর ভাবখানা তো এমন, যেন পুরা বাড়ী তার চাকর। মহারাণীর জন্য আমরা পানি ভরে রাখব আর ম্যাডাম এসে গোসল করবেন। সারাদিনে গুনে গুনে তিনবারের বেশী মটর ছাড়া নিষেধ। আজকে এরমধ্যে দু’বার ছাড়া হয়ে গেছে। রাতের আগে আর ছাড়া যাবেনা। তাছাড়া মাত্র এক ঘন্টা আগেই আমি এক হাউজ পানি তুলেছি। আপনার বউমা সব পানি শেষ করসে। সে কী এক হাউজ পানি দিয়ে কাপড় ধুইসে ? ”
শ্বাশুড়ীর ঘর থেকে সব কথাই স্পষ্ট শুনতে পেল মেঘা। কপালে ভাঁজ পড়ল ওর। সত্যি যদি এক ঘন্টা আগে পানি তোলা হয়ে থাকে তাহলে এত তাড়াতাড়ি তো শেষ হবার কথা না। কী মনে হতে সে সোজা ছাদে ছুটল। ক্ষীণ একটা সন্দেহ ছিল মনে। বাস্তবে তা সত্যি হতে দেখে বেশ ধাক্কাই খেল। ওর পানির লাইনের চাবিটা বন্ধ করে রেখেছে কেউ । বিস্মিত চোখে ছাদে চারপাশে তাকাতেই দেখল নেহাল আর ওর সমবয়সী একটা ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। দুজনের হাতেই ঘুড়ি। আর ছাদের অপর কোণে মেজ জা তার রোদে শুকানো কাপড়গুলো ভাঁজ করে হাতে নিচ্ছেন।কাউকে কিছু না বলে পানির লাইনের চাবিটা ঘুরিয়ে দিল যেটা কেউ মুচড়ে বন্ধ করে রেখেছিল। নিচে নেমে কল ছাড়তেই দেখল আবারও ঝরঝর পানি ঝরতে শুরু করেছে। তারমানে হাউজে পানি ঠিকই আছে কিন্তু কেউ একজন ইচ্ছে করেই ওর ঘরের পাইপ লাইনের চাবিটা বন্ধ করে রেখেছিল। কার হতে পারে কাজটা। নেহালের ? নাকি মেজ ভাবির ? শাওয়ারের পানিতে চুল ধুতে গিয়ে কথাটা ভাবল মেঘা।”
গোসল শেষে কাপড়গুলো ছাদে মেলতে গিয়ে দেখল ওর কাপড় শুকাতে দেবার দড়িগুলোও যেন কে কেটে রেখেছে। ছাদের এ মাথা ও মাথা দুটো নাইলনের দড়ি বেঁধে রেখেছিল মেঘা। দুটোর একটাও নেই। বড়জা, মেজ জার আর সেজ জায়ের তারগুলো খালি পড়ে আছে। ওদের তারে দেবে কী না ভাবছে । এক মন বলছে দেই, আরেক মন বলছে যদি ফেলে দেয় ! তাহলে এত কষ্টে ধোয়া কাপড়গুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে। আরেকবার ধোয়া প্রায় অসম্ভব। তারপরেও দুরু দুরু বুকে মেজ জার তারে কাপড়গুলো মেলে দিল মেঘা। ঠিক করল আধা শুকনো হলেই নামিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর ঘরেই মেলে দেবে। তাছাড়া এ বেলা তো সবাই ঘুমিয়েই থাকে।
কাপড় মেলে দিয়ে নিচে নেমে ভাত খেতে বসল মেঘা। খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে গিয়েই টের পেল শরীরটা কী ভীষণ ক্লান্ত হয়ে আছে। বালিশে মাথা ছোঁয়াতেই ঘুমে তলিয়ে গেল বেচারী।
===
ঘুম ভাঙ্গল কোহিনুর বেগমের ডাকে। তিনি জানালেন, আরশের খিদে পেয়েছে। ওকে কিছু খেতে দিতে হবে। দ্রুত উঠে হাত মুখ ধুয়ে আগে রান্নাঘরে চলে এল মেঘা। কারণ আরশের খাবার তৈরী করা নেই। কাজের চাপে ভুলেই গেছে। এখন চালের সুজি জ্বাল দিতে হবে। এমনি দিনে এক হাঁড়ি জ্বাল দিয়ে ফ্রিজে রাখে। আর ফ্লাস্ক ভরে গরম পানি রাখে। যতবার ওকে ফিডার খাওয়ায় ততবার সুজি বের করে নেয়। গরম দুধের সাথে ঠান্ডা সুজি মিশিয়ে নিলেই আরশের খাবার উপোযোগী সুজি তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে আসার পর অতগুলো কাপড় ধুয়ে ঘর মুছে এসব করার মত সময় ছিলো না। তার উপর পানি চলে গিয়ে আরো দেরী হয়ে গিয়েছিল। এখন আপাতত আরশের খাবার মত সুজি হলেই চলবে। কিন্তু চুলা তো একটাও খালি নেই। দুটোতেই কিছু চাপানো। কোনটা কার হাঁড়ি আর কোনটাতে কী বোঝাও যাচ্ছে না। চারপাশে তাকিয়ে দেখল মেঘা। আশেপাশে কেউই নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করে যে নামাবে সেই উপায়ও নেই। ঐ দিকে আরশের কান্নাও তুঙ্গে। ভাল করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে দেখল একটাতে ভাত অন্যটাতে একটা ঢাকনা দেয়া ননস্টিক ফ্রাইপ্যানে কিছু ফুটছে। মেঘা ভাতের হাঁড়িটা ধরল না। কিছুটা ভয়ে ভয়েই ফ্রাইপ্যানটাই নামাল। হয়ত সব্জি হবে। তাই ওটাই সরিয়ে দ্রুত হাতে জ্বাল দিয়ে নিল সুজিটা। কাজ শেষে ফের ওটা বসাতে যাবার আগেই শুনলো বড়জা’র চিৎকার। রান্নাঘরে ঢুকেই তুলকালাম বাঁধিয়ে দিলেন তিনি। মেঘা প্রথমে বুঝতে পারলো না তার অপরাধটা কী । পরে তার হৈ চৈ শুনে বোঝা গেল ওটা তে পুডিং বসিয়েছিলেন তিনি। তার মতে পুডিং নাকি আর ঠিক হবেনা ওটা নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরই তিনি এক নিঃশ্বাসে মেঘাকে যা নয় তাই বলতে লাগলেন। মেঘা নাকি মিশন নিয়ে এসেছে যে তাকে পাগল করে ছাড়বে। সেজন্যই ইচ্ছে করে এমন সব কাজ করছে যেন তার রাগ হয় আর তিনি চেঁচান। সবাই তো তার চেঁচানোটাই দেখে কিন্তু মেঘার নিঃশব্দ শয়তানিটা দেখেনা। মেঘা তার পরিবারের দিকে কুনজর দিয়ে তাদেরকেও ধ্বংসের পথে নামিয়ে দিয়েছে। ইত্যাদি কাহিনী বলে বলে পুরোটা সন্ধ্যা পার করলেন সুরমা।
মেঘার হাত পা কাঁপতে লাগল উত্তেজনায়। এমনিতেই শারিরীক আর মানসিক উত্তেজনায় সকাল থেকে বেহাল দশা। তার উপর অতগুলো কাপড় ধোবার পর শরীরে যেন শক্তিই পাচ্ছিল না। এর মধ্যে বাড়ী ফেরার পর থেকে একের পর এক তামাশা। বোঝাই যাচ্ছে বড় ভাবি হাত ধুয়ে লেগেছেন ওর পেছনে। সরাসরি কিছু বলতে পারছেন না কারণ তাতে নিজের ভাইকে টানা হয়ে যাবে। সেকারণেই অন্যভাবে মেঘাকে অপদস্থ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন তিনি। মেঘার মনে হলো মাত্র একদিনেই সে অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটাবে কে জানে। রাতে সেজ জা এসেও ঐ একই কথা বললেন। বর্ষণকে রাতে হাসপাতালে থাকতে দেয়া তার মোটেও উচিত হয়নি। তারচেয়ে বিয়ে করে নিলেও হালাল হতো। এটা তো জেনা হয়ে গেল। মেঘা স্রেফ পাথরের মত মুখ করে বসে তার কথাগুলো শুনে গেছে। প্রতিবাদ করার রুচি হয়নি ওর। জেদ করেই কোন উত্তর করল না মেঘা।
পরদিন আরশকে কোহিনূরের কাছে দিয়ে যথারীতি অফিসে গেল মেঘা। জিএম স্যারের সাথে দেখা করে রেজিগনেশন লেটার জমা দিল আর জানতে চাইল ওর বেতনটা কবে পাশ হবে। জিএম স্যার জানালেন, এ ব্যপারে এখনই কিছু বলা যাচ্ছেনা। তাছাড়া মেঘাকে অফিস থেকে যে শো-কজ করা হয়েছে সেটার আন্সার না পাওয়া পর্যন্ত রেজিকনেশন হয়ত হ্যাং হয়েই থাকবে। কাজেই মেঘাকে আগে বদরুল আলমের করা নালিশের উত্তর দিতে হবে। তার আগে কোন প্রোগ্রেস আশা করা উচিত হবেনা।
জিএম স্যারের সাথে কথা বলে অফিস থেকে প্রায় টলতে টলতে বেরিয়ে এল মেঘা। গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতেই ফোন বাজল। রিসিভ করে কানে ঠেকাতে চোখে পড়ল সেই বদটাকে। যার কারণে আজ সে অফিস ছাড়া। অজান্তেই হাতটা শরীরের একপাশে ঝুলে পড়ল মেঘার।
বদরুল আলম হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে পথ আটকে বলল, ” কী খবর মেঘা রাণী ? কোথায় ডুব দিয়েছিলেন ? শুনেছেন তো অফিস যে আপনার বেতন আর বাকি পাওনা সব আটকে দিয়েছে ? তা আপনি বাবা বড় গোঁয়ার মানুষ। কত করে বললাম চলুন ঢাকার বাইরে আমার নির্মানাধীন বাড়ীটা দেখে আসি তা আপনি রাজী হলেন না। আরে ওখানে না গেলে এই বদরুলকে আন্দাজ করতে পারবেন না। অফিসের এই ছা-পোষা চাকরীর পয়সা আমার সিগারেটেই শেষ হয়ে যায় বুঝলেন? ওখানে গেলে বুঝবেন আমার রুচি কী জিনিস। নিজেকে দিয়েই আন্দাজ করুন না। এই যে আপনি নিজেও তো জানেন না যে আপনি কতটা হট। আপনি হলেন গিয়ে ছাইচাপা লকলকা আগুন। মাঝেমধ্যে দমকা বাতাসে যেটুকু ফুলকী ছোটে তাতেই আপনার উত্তাপের আঁচ টের পাওয়া যায়।”
মেঘা কড়া চোখে তাকিয়ে আছে দেখে হেসে প্রসঙ্গ বদলাল বদরুল।
-” বলছিলাম কী , ইটালীয়ান মার্বেল পাথর বসিয়েছি পুরো ফ্লোর জুড়ে। আর বাথরুমটা ? আহ্, দেখলে বলবেন। আপনাদের জিএম এর রুমের চেয়ে বড় বুঝলেন। বেলজিয়ামের যে বাথ টাবটা বসিয়েছি সেটা না দেখলে মিস করবেন। দুজন মানুষ অনায়াসে গোসল করা যায়। যাবেন নাকি একদিন। অফিস নিয়ে ভাববেন না, ওটা আমার উপর ছেড়ে দেন। চেয়ারম্যান স্যার আবার আমার ওয়াইফের ছোটবোনের মামা শ্বশুর হয় কি না। সো ডোন্ট উওরি, জাস্ট বি হ্যাপী। কী বলেন, যাবেন ? ” বদরুল আলম তাকিয়ে আছে মেঘার দিকে।
মেঘা ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত সরে এল সেখান থেকে। একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে অনেক দুর চলে আসার পর মনে পড়ল ওর হাতে মোবাইল ধরা। দ্রুত কানের কাছে নিতেই টের পেল লাইনটা অনেক আগেই কেটে গেছে। হতাশা এবার নতুন করে গ্রাস করল মেঘাকে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ আসার পর মনে পড়ল ওর আসলে রিক্সা নেয়া দরকার।
রিক্সার খোঁজে চারপাশে তাকাল। আর তখনই মনে পড়ল, এখনি বাড়ী না গিয়ে ওর কোথাও কাজের সন্ধানে যাওয়া উচিত ওর। তাছাড়া ব্যাগে চেইনটা আছে। সেটা সেল করতে হলেও তো মার্কেটে যাওয়া দরকার। ভাবনাটা কাজে দিল। সোজা মার্কেটে চলে এলো মেঘা। পারিচিত এক দোকানে চেইনটা প্রথমে ওজন মাপল তারপর বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী দাম ধরলো ওরা। ভ্যাটেও কিছু টাকা কাটা গেল। টাকাগুলো ব্যাগে নিয়ে বেরোবার মুখেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল রুহিয়া ম্যাডামের সাথে। মেঘা তাকে দেখেই চিনতে পারলেও তার একটু সময় লাগল। মেঘা সালাম দিয়ে পরিচয় দিলে তিনিও চিনতে পারলেন। খুব খুশি হলেন ওকে দেখে। জানতে চাইলেন মেঘা এখন কী করছে। হাজবেন্ড কী করে। মেঘা ম্লান মুখে পরশের কথাটা জানাল। তবে অফিসের কথাটা বলতে গিয়েও এড়িয়ে গেল সে। আরশের প্রসঙ্গ টেনে জানাল, ” বাচ্চা ছোট বলে এখন সেভাবে কিছুই করতে পারছে না কিন্তু সুইটেবল কাজ পেলে ভেবে দেখবে। কথাটা শুনে রুহিয়া খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর নিজেই অফার করলেন ওকে। মেঘা চাইলে আবার তার স্কুলে জয়েন করতে পারে। মেঘার মনে হল সে হাওয়ায় ভাসছে। আনন্দ চেপে জানতে চাইল, কবে জয়েন করতে হবে ! কারণ সে এখন পুরোপুরি ফ্রি । রুহিয়া ম্যাডাম জানালেন, মেঘা চাইলে কালই জয়েন করতে পারে। বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে। তাছাড়া তার ইংরেজী টিচারটাও অসুস্থ। ওনার সাবস্টিটিউটে যে মেয়েটা জয়েন করেছিল সেই মেয়েটারও হুট করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মেঘা কাল জয়েন করতে পারলে খুবই ভাল হয়। মেঘা মনে মনে রবের উদ্দেশ্যে শোকর জানাল। একই সাথে মনে হল, সে আসলে বেঁচে গেল। মুক্তি মিলল অনেক অপমান আর লাঞ্ছনা থেকে।
বাড়ী ফেরার পথেই মেঘা সিদ্ধান্ত নিল বাড়ী পৌঁছে সবার আগে সে ভাইয়াকে কল ব্যাক করবে। ঐ হারামজাদার কারণে ভাইয়ার তখনকার কলটা মিস করেছে সে। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হল। ভাইয়ার সাথে কথা বলে ওদের নিজেদের বাসায় ওঠার কথাটা বলতে পারবে এখন। কারণ ভাইয়ার এমনিতেও এখন ঢাকায় থাকা হয় কম। ক’দিন বাদে হয়ত সে খুলনাতেই সেটেল হয়ে যাবে। তখন হয়ত দেখা যাবে ভাইয়া তাদের বাসাটা ভাড়াতেই দিয়ে দেবে। সেক্ষেত্রে বাসাটা ভাড়া না দিয়ে মেঘা নিজের জন্যেই তো নিয়ে নিতে পারে। কারণ ও যদি স্কুলের চাকরীটা পেয়ে যায় তাহলে টাকার অভাবটাতো আর থাকছে না । যদিও অফিসের মত বেতন পাবেনা তবু কাজ চালানোর মত হবে। তাছাড়া সে তো আর পুরো বাসাটা নেবে না। কেবল বড়রুমটা নিজের জন্য নিয়ে বাকিটা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সাবলেটে ভাড়া দিয়ে দিতে পারে। এমনিতে সে নিজেও ভাইয়ার রুমটা বিনে পয়সায় নেবেনা। যতটুকু পারবে ভাইয়ার হাতে তুলে দেবে।
তবু এ বাড়ীতে আর থাকবে না। কেননা যত দিন যাচ্ছে পরশের বাড়ীতে থাকাটা ওর জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে । এতদিন তবু যেমন তেমন ছিল, এখন তো বর্ষণের ঐ কথাটার পর তার জন্য সুরমা ভাবি একটা মুর্তিমান ত্রাস হয়ে দেখা দিয়েছে। তারচে স্কুলের চাকরীটা পেলে সে আবার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবে। বিয়ের আগে তো এই স্কুলটাতেই চাকরী করত মেঘা। তখন দুচারটা ছাত্রীও পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল। এখনও নাহয় তাই করবে। স্কুলের বেতন আর ছাত্রী পড়িয়ে যা পাবে তাতে ওদের মা ছেলের অনায়াসে চলে যাবে। পরশের বাড়ীর সম্পত্তির জন্য তখন আর হা-পিত্যেশ করে থাকতে হবেনা। ভাবনাটা মেঘার মনে এক অন্যরকম স্বস্তির জন্ম দিল।
পুরো রাস্তা জুড়ে একথা ভাবতে ভাবতে বাড়ী পৌঁছুল মেঘা। ঘরে ঢুকে ভাইয়া ভাবি আর আদরের ভাইঝিকে দেখে রীতিমত বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। ভাইয়াকে এ সময় মোটেই আশা করেনি সে। আনন্দোত্তেজনার পাশাপাশি পেছনের কিছু তিক্ত স্মৃতি কাঁদিয়ে দিল মেঘাকে। প্রায় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ভাইয়াকে। ভাইয়া নিজেও কম আবেগাপ্লুত নয়। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ” এত ঝামেলার মধ্যে আছিস আর আমি কিছুই জানিনা ! ”
মেঘা কোন উত্তর দিলো না একথার। ভাইয়া মৃদু শব্দে বললেন , ” আমি সব কথাই শুনেছি। তোর শ্বাশুড়ী আমাকে সবই বলেছেন।”
– ” হ্যাঁ, আরশকে নিয়ে গত একসপ্তাহ ক্লিনিকে ছিলাম আমি গতকালই ফিরেছি।” মেঘা সংক্ষেপে বলল।
ভাইয়া যোগ করল, ” শুধু এটাই না। বর্ষণ ছেলেটার কথাও শুনলাম। তোর জা তো আমাদের দেখেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এদের ব্যপারটা কী বলতো ? আচ্ছা, এটা পরে শুনব। আগে অফিসে কী হয়েছে বলতো ? ”
-” অ….অফিস ? ”
কানের পেছন দিয়ে ঘাম বাইতে শুরু করল মেঘার। ওর অবস্থা এখন হয়েছে অকূল পাথারে পড়া মানুষের মত। কোনটা রেখে কোনটা বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার উপর ভাইয়ার পরের বাক্যটা ওকে অসাঢ় করে দিল প্রায়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-” আমি কিন্তু সবই শুনেছি। ঘন্টা খানেক আগে ফোনটা তোকে আমিই দিয়েছিলাম । যখন কেউ তোকে ঢাকার বাইরে নিজের বাড়ী বানানোর ফিরিস্তি দিচ্ছিল।”
মেঘা এবার বাস্তবিকই দারুণ লজ্জা পেল। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল সে। ইস্, ছি ছি। ভাইয়া ঐ হারামজাদার কথাগুলো শুনে ফেলেছে ! মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মেঘা। এমন সময় রেহানা ভাবি এসে ওর হাত ধরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ” আমাকে ক্ষমা করে দিস মেঘা। আসলে নিজের দিক দেখতে গিয়ে অন্য দিকের গুরুত্ব না দিয়ে অন্যায়ই করেছি। এখানে তোর মাথার উপর একের পর এক মসিবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে আর আমি কী না ! ”
-” এসব কথা থাক ভাবি। তোমরা আমার পাশে আছ এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। ”
-” তুই বরং ঐ অফিসের চাকরীটা ছেড়ে দে।” হাসিব বললেন।
-” ছেড়ে দিয়েছি ভাইয়া। রিজাইন লেটার দিতেই গিয়েছিলাম। তোমার মনে আছে ভাইয়া, বিয়ের আগে আমি যে একটা কিন্ডারগার্টেনে কাজ করতাম? ”
-” হ্যাঁ, ইকরা না কী যেন। কী হয়েছে ওটা ?”
-” আজ ইকরার হেডমিসট্রেস আপার সাথে দেখা হয়েছে নিউমার্কেটে। উনি নিজেই আমাকে অফার করেছেন ওখানে জয়েন করতে।”
-” ভালোই হয়েছে । আর বর্ষণ ছেলেটার টাকা ফেরত দিয়েছিস? ”
-” ন্…না, দেইনি। ওর টাকা আনতেই তো মার্কেটে গেলাম। ” মেঘা আবারও লজ্জা পেল। ভাইয়া বর্ষণের সব কথা শুনেছে ?
-” আমাকে না জিজ্ঞেস করে তোর চেইনটা বিক্রি করতে যাওয়া উচিত হয়নি । আচ্ছা যাই হোক, বর্ষণের সাথে তোর দেখা করার দরকার নেই। ওর সাথে দেখা করে ওকে আমিই দিয়ে দেব টাকাটা। ওর ফোন নম্বরটা আমাকে দে।”
মেঘা দীর্ঘশ্বাস চেপে ফোন নম্বর আর টাকা বের করে ভাইয়ের হাতে দিতে গিয়েই শুনল ভাইয়া বলছে, ” আমার খুলনায় পোস্টিং পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। আজই ঢাকার হেড অফিস থেকে লেটার ইস্যু হল। সামনের সপ্তাহের মধ্যেই আমাকে ওখানে পেপার সাবমিট করে কনফার্মেশন জানাতে হবে। আমি তিন চারদিনের মধ্যেই খুলনা ব্যাক করব। তুই এক কাজ করতে পারিস। চাইলে বাসায় এসে থাকতে পারিস। যদি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিস। তাহলে অন্তত এখানকার চেয়ে ভাল থাকবি।”
মেঘার মুখে কথা আটকে গেল। যে সব কথা সে নিজে ভাইয়াকে বলবে বলে ভেবে রেখেছিল সেসব কথা আজ ভাইয়া নিজেই বলে দিচ্ছে। চোখে আবারও পানি চলে এল মেঘার। তবে এবারের কান্নাটা আনন্দের, স্বস্তির।
চলবে…