#যখন_আমি_থাকবোনা
#পর্ব_৪
#লেখক_দিগন্ত
মুক্তি রাতে একা একা গোপনে কোথাও বেরিয়ে যায়। কেউ একজন তার পিছু নেয়৷ কিছুদূর যাওয়ার পর মুক্তি পিছনে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
-“আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম মিসেস আলেয়া চৌধুরী।”
আলেয়া চৌধুরী বাঁকা হেসে বলে,
-“আমি আগে থেকে জানতাম তুমিই সেই। তুমি তাহলে ফিরে এসেছ।”
-“হ্যাঁ আমি এসেছি। আমাকে তো ফিরে আসতেই হতো প্রতিশোধ নিতে।”
-“আমিও তোমার মতো প্রতিশোধই নিতে চাই। তবে…”
মুক্তি বলে,
-“হ্যাঁ আমি জানি। আপনি সবার উপর প্রতিশোধ নিলেও নিজের স্বামীর উপর প্রতিশোধ নিতে পারবেন না। এখানেই আপনার সাথে আমার পার্থক্য।”
আলেয়া বেগম ভ্রু কুচকে বলেন,
-“আমি অন্য সবার উপর প্রতিশোধ নিতে তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু নিজের স্বামীর উপরে আচ লাগতে দেবো না। এইজন্য আমি বলি, আমি তোমার বন্ধু আবার শত্রুও।”
-“আপনিই এতদিন ধরে আমার উপর নজর রাখছিলেন তাইনা?”
-“হ্যাঁ আমিই নজর রাখছিলাম। দেশে আসার পর তোমার সব ক্রিয়াকালাপ আমি দেখেছি।”
মুক্তি আর কিছু বলে না। আলেয়া বেগম মুক্তিকে চুপ থাকতে দেখে বলে,
-“তুমি আসলেই অনেক চালাক। আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝতে পারবে না। কিন্তু বুঝে গেলা।”
_______________
মুক্তি তার সৎমা মিসেস জামিলার সামনে বসে আসে। অনেকক্ষণ থেকে তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কিন্তু জামিলা কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। শুধু একটাই কথা বলে যাচ্ছে,
-“আমি কিছু জানি না। তুমি আমাকে বেকার এখানে তুলে এনেছ। আমাকে যেতে দাও।”
মুক্তি অনেকক্ষণ ধরে এসব সহ্য করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল। এবার জামিলাকে সরাসরি বলে,
-“আমি জানি আমার বাবা সরি তথাকথিত বাবাকে আপনিই খু*ন করেছেন। আমার সেই নিয়ে কোন সমস্যা নেই৷ আপনি না মা*রলে আমিই তাকে শে*ষ করে দিতাম।”
জামিলা অবাক হয়ে মুক্তির দিকে তাকায়। মুক্তি জামিলাকে অভয় দিয়ে বলে,
-“আমি আপনার শত্রু নই। আপনি সবসময়ই আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে ছিলেন। আমি জানি আমাকে ঘৃণা করার আপনার একমাত্র কারণ হলো আমি মিরাজ হোসেনের মেয়ে। আর এইটাই আপনার সবথেকে বড় ভুল। আমি মিরাজ হোসেনের মেয়ে নই। বরং সে আমাকে মিথ্যা পরিচয়ে বড় করেছে। আমার মায়ের খু*নি সে।”
জামিলা কিছুই বুঝতে পারে না। কি বলছে এই মেয়েটা? জামিলা এবার নিজের ঘটনাগুলো মুক্তিকে বলতে থাকে,
-“আমি শহরের এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে ছিলাম। মিরাজ হোসেন নামক শ*য়তান কি*টটা আমার অনেক ক্ষতি করেছে। কলেজ থেকে তুলে এনে আমায়….পরে ধরা পড়ে যাওয়ায় নিজের মানসম্মান রক্ষায় আমাকে বিয়ে করেছিল। আমি বিয়েটা কখনো করতে চাইনি। পরিবারের চাপে বিয়েটা করেছিলাম। যখন জানতে পারি মিরাজ হোসেনের একটা মেয়ে আছে তখন তোমার উপর আমার অনেক রাগ হয়। নিজের প্রতি হওয়া অন্যায় তোমার উপর দিয়ে মিটাতে চাই। তাই তোমার বাবা তোমাকে বিদেশে তোমার ফুফুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি অনেক আগেই চেয়েছিলাম মিরাজকে শে*ষ করে দিতে কিন্তু পারিনি। তখন আমি অসহায় ছিলাম। কিন্তু একজনের সহায়তায় আমি কিছুদিন আগে নিজের জমা রাগ তুলে নেই।”
-“কার সাহায্যে…”
জামিলা বলে দেয় যে, কে তাকে সাহায্য করেছিল। নামটা শুনে মুক্তি বেশ অবাকই হয়। ভাবে,
-“এই লোকটা কেন সাহায্য করল। হিসাব তো কোনভাবেই মিলছে না। আমি বুঝতে পারছি না কিছুই।”
মুক্তি আর সেখানে না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে আসে। আলেয়া চৌধুরী বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। মুক্তিকে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করে,
-“কিছু জানতে পারলে তুমি?”
-“অনেক কিছুই জানতে পারলাম। আচ্ছা সেসব বাদ দিন। আগে আমাকে বলুন আপনি আপনার কথা রাখবেন তো? আপনি বলেছিলেন নিজের স্বামী বাদে বাকি সবার উপর প্রতিশোধ নিতে আমাকে সাহায্য করতে হবে। সেটা করবেন তো?”
-“হ্যাঁ করব।”
-“আমার টা*র্গেট ছিল ৪ জন। তাদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যেই নিজের স্ত্রীর হাতেই খু*ন হয়েছে। আপনার স্বামী বাদে বাকি যে দুইজন আছে তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে তাহলে আমার পাশে থাকুন।”
______________
মুক্তি আজ বাড়ির সবার জন্য একা হাতে সবকিছু রান্না করেছে। বাকের চৌধুরীর দলের কিছু নেতাও আজ যোগ দিয়েছে ডিনারে। মুক্তি নিজের হাতে সবাইকে খাবার দিচ্ছে। খাবার টেবিলে বাকের চৌধুরী হঠাৎ করে এমন একটা ঘোষণা দেন যে সবাই অবাক হয়ে যায়। তিনি বলেন,
-“এইবছর আমি আর ইলেকশনের টিকিট নেব না। আমার হয়ে এবার আমার ছেলে ইলেকশনে দাঁড়াবে। আমার ছোট ছেলে বিপ্লব চৌধুরী এবার আমার আসন থেকে ল*ড়বে।”
বিপ্লব খাচ্ছিল। হঠাৎ এরকম কথা শুনে বিষম খেয়ে যায়। তার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। খাবারে পানি ঢেলে দিয়ে বলে,
-“আমি কোনদিনও রাজনীতিতে নাম লেখাব না। তোমরা যা করার করো। আমি কতবার বলব এই কথা?”
বাকের চৌধুরী সবার সামনে অপমানিত বোধ করেন। তাই উঠে এসে সবার সামনে বিপ্লবকে ঠা*স করে থা*প্পড় মা*রেন। বিপ্লব জীবনেও তার বাবার হাতে মা*র খায়নি। তাই আজ বেশ অনেকটাই অবাক হয়েছে সে। এতগুলো মানুষের সামনে এত বড় ছেলেকে থা*প্পড় মা-রার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সে অপমানিত হয়।
বিপ্লব সঙ্গে সঙ্গে নিজের রুমে চলে যায়। বারেক চৌধুরী তার পার্টির লোকদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। মুক্তিও বিপ্লবের পেছন পেছন যায়।
বিপ্লব রুমে এসেই জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করতে থাকে। রাগে, অপমানে তার পুরো শরীর জ্ব*লে যাচ্ছে। মুক্তি তার কাছে এসে বলে,
-“আপনি রাগ করবেন না। আমার মনে হয় আপনার নিজের বাবার কথা মেনে নেওয়া উচিৎ।”
বিপ্লবের মেজাজ এমনিতেই গরম ছিল। তার উপর মুক্তির মুখে এমন কথা শুনে সব রাগ স্বাভাবিকভাবেই মুক্তির উপরে প*তিত হয়। বিপ্লব মুক্তি দিকে ফুলঝুরি ছু*ড়ে মে*রে বলে,
-“আমি কি করবো না করবো সেটা আপনি বলে দেবেন? কে দিয়েছে আপনাকে সেই অধিকার? আপনি তো একটা নির্লজ্জ মেয়ে। আপনাকে আমি পছন্দ করি না জেনেও আমার পেছনে ঘোরেন। একমাসের মধ্যে নাকি আমায় নিজেকে ভালোবাসতে বাধ্য করবেন। নিজেকে কি মনে করেন আপনি? চলে যান আমার সামনে থেকে।”
মুক্তির খুব খারাপ লাগে কথাগুলো শুনে। ভালোবাসার মানুষ যখন এরকম কটু কথা বলে তখন কারই বা ভালো লাগে। মুক্তি চেয়েছিল বিপ্লব রাজনীতিতে আসুক। কারণ সে জানে বিপ্লব অনেক ভালো একজন মানুষ। সে রাজনীতিতে এলে সাধারণ মানুষের ভালোর জন্যই কাজ করবে। কিন্তু বিপ্লব তো কিছু বুঝতেই চাইছে না। তাই মুক্তি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসে।
বাইরে এসে নিঃশব্দে নিজের চোখের দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করে। বলে,
-“বিপ্লব এমন করবে আমি জানতাম। তবুও কেন জানি ওর এরকম ব্যবহার আমার সহ্য হচ্ছে না। ভালোবাসি তোমাকে আমি বিপ্লব। আমার ভালোবাসা তুমি বুঝতে পারছ না। কিন্তু একদিন ঠিকই বুঝবে। দেখো বেশি দেরি না হয়ে যায়।”
_______________
নতুন দিনের আভাস দিয়ে সূর্যের আগমন। মুক্তি ভোরে উঠে নামাজ আদায় করে বাড়ির বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আলেয়া বেগমের সাথে কাজের ফাকে কিছু পরিকল্পনাও করে নেয়। আজ রাতে একটি বড় কাজ করতে হবে তাদের।
মুক্তি কাজ করে এসে বিপ্লবের রুমে ঢুকে দেখে তার সব জামাকাপড় অগোছালো করে রেখেছে। মুক্তি সেইসব জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে একটি শার্টের পকেটে বিপ্লবের লকেটটা পায়। কৌতুহলবশত লকেটটা খুলে দেখে।
লকেটটা খুলতেই একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি দেখতে পায়। ছবিটা ভালো করে দেখে মুক্তি বুঝতে পারে এটা কার ছবি। বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,
-“আমার ছবি আজও লকেটে রেখে দিয়েছ। কিন্তু আমায় চিনতেই পারলে না এখনো।”
হঠাৎ করে বিপ্লব রুমে আসে। রুমে এসে মুক্তির হাতে লকেটটা দেখে তার প্রচুর রাগ হয়। এমনিতেই গতকাল রাতের জন্য রেগে ছিল৷ তার উপর আজকে মুক্তির হাতে লকেট তার রাগ বাড়িয়ে দেয়। সে নিজের জ্ঞান হারিয়ে সোজা এসে মুক্তিকে থা*প্পড় মা*রে। মুক্তি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়।
বিপ্লব লকেটটা ছিনিয়ে নিয়ে বলে,
-“আমার অনুমতি ছাড়া আমার জিনিসে হাত দিয়েছেন কোন সাহসে? ফারদার আর এমন ভুল করবেন না। নাহলে টানতে টানতে আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।”
কথাটা বলে বিপ্লব চলে যাচ্ছিল তখনই মুক্তি একটি গানের কিছু কলি বলে,
“বুঝবি তুই খুঁজবি তুই
#যখন_আমি_থাকবোনা
হাত বাড়িয়ে ডাকবি তুই
আর তো ফিরে আসবো না।”
(চলবে)