যেদিন তুমি এসেছিলে ২ পর্ব -১৮+১৯

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_১৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
মুন বাসায় আসার পর ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কী রান্না করবে, কী খাওয়াবে সেসব ভাবতে ভাবতেই সে দিশেহারা। আহনাফ শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে। আদিব শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মুন নিজে দিশেহারা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটার পর একটা ফরমায়েশ আদিবকেও দিয়ে যাচ্ছে। কখনও বলছে, এটা করো তো কখনও বলছে ওটা করো। সর্বশেষ বাধ্য হয়ে অর্ষা মুখ খুলল। মুনকে শান্ত করতে বলল,

“তুই একটু থাম মুন। এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? তোর বাসায় তো আর এই প্রথম এলাম না।”

মুন চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় যেন অর্ষা মাত্রই বড়ো মাপের কোনও অন্যায় করে ফেলেছে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল,

“তোর কথা ভাবছে কে? তুই প্রথমবার না এলেও দুলাভাই তো আমার বাসায় প্রথমই এলো। তার জন্য ব্যস্ত হব না? তুই হচ্ছিস দুধভাত অতিথি।”

অর্ষার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

“বারবার কেন তাকে দুলাভাই ডাকছিস?”

“কেন তাতে তোর কী? সে তখন বলল না আমার জন্য তার নাম দুলাভাই। সূতরাং আমি তাকে দুলাভাই-ই ডাকব। তোর মন চাইলে তুইও ডাকতে পারিস।”

এরপর সে আদিবকে ফের তাড়া দিয়ে বলল,

“তুমি অমন সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? পেয়াজ-মরিচগুলো জলদি কেটে নাও। তাড়াতাড়ি রান্না বসাতে হবে তো।”

আহনাফ তখন বলল,

“আপু আজ আমাদের জন্য রান্না-বান্না কিছু করতে হবে না। অন্য একদিন এসে পেট ভরে খেয়ে যাব। আজ শুধু এক কাপ চা খাওয়ালেই হবে।”

মুন ভারী কণ্ঠে বলে উঠল,

“তা আবার হয় নাকি? এক কাজ করি। বিরিয়ানি রান্না করি। বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।”

অর্ষা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“তোর যা ইচ্ছে তুই কর। আমি যাচ্ছি। একটুপরই বাচ্চারা পড়তে আসবে।”

“তুই যেতে পারবি না তো। আমি রুম তালা দিয়ে চাবি লুকিয়ে রেখেছি।”

“এরকম বাচ্চামো করার মানে কী?”

“মানে কিছুই না। খাওয়া-দাওয়া না করে তুই যেতে পারবি না।”

“মুন একটু বোঝার চেষ্টা কর।”

“পারব না।” বলে অর্ষার সমস্যাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মুন রান্নাঘরে চলে যায়। সঙ্গে আদিবও। সে হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে মুনকে সাহায্য করছে।

অর্ষার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে আহনাফের ওপর। সে ক্ষেপে গিয়ে বলে,

“আপনার জন্যই আমাকে এখন মুসিবতে পড়তে হলো।”

“আশ্চর্য! এখানে আমার কী দোষ? বান্ধবী তো আর আমার নয়। তোমার বান্ধবী। সে যাওয়ার পথ সব বন্ধ করে রেখেছে। রাগ দেখালে আমি দেখাতে পারি। তুমি কেন দেখাচ্ছ?”

অর্ষা যেন রাগ প্রকাশ করারও ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। সে অন্যপাশে বসে ফোন ঘাঁটতে লাগল। মুন যা শুরু করেছে আজ রাতে না খেয়ে কিছুতেই যেতে দেবে না। ওদিকে বাচ্চাগুলো যদি এসে বসে থাকে? সকাল তো মনে হয় এতক্ষণে রাফিকে পড়াতে চলে গেছে। এখনও বাজারও করা হলো না। বাড়িতে মনে হয় রান্নাও হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে অর্ষার মেজাজ এখন বেজায় খারাপ। সে ওমর রহমানের নাম্বারে কল করে। রিং হচ্ছে ওপাশে। ওমর রহমান ফোন রিসিভ করলেন। কাশতে কাশতে বললেন,

“হ্যালো।”

এপাশ থেকে অর্ষা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল,

“তোমার কাশি আবার বেড়েছে বাবা?”

“ও কিছু না। শুকনা কাশি। মাঝে মাঝে হয়।”

“ওষুধ কি খাচ্ছ ঠিকমতো?”

“হ্যাঁ, মা। তোর ছুটি হয়নি এখনও?”

“হয়েছে। আমি এখন মুনের বাসায় আছি। বাজারে দেখা হয়েছিল। ধরে-বেঁধে নিয়ে এসেছে। রাতে না খেয়ে এখন কিছুতেই যেতে দেবে না।”

ওমর রহমান হেসে বললেন,

“ও তো এমনই। পাগলী একটা। তুই তাহলে কখন আসবি মা?”

“আসতে তো একটু দেরি হবেই। ঘরে তো বাজারও নেই। রান্নাও হয়নি। আমি আহিলকে ফোন করে বলে দেই কিছু খাবার কিনে দিতে।”

ওমর রহমান আহিলকে চেনেন। অর্ষাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তিনি বললেন,

“না, না। ছেলেটাকে এখন কষ্ট করে এতদূর আসতে হবে না। সকাল ভাত, আলু ভর্তা আর ডিম ভেজে রেখে গেছে। ওতেই হয়ে যাবে।”

“ঠিক বলছ?”

“হ্যাঁ, মা।”

“আচ্ছা আজ একটু কষ্ট করে নাও। আমি রাতে আসার সময় বাজার করে নিয়ে আসব। আর শোনো বাবা, যারা আজ প্রাইভেট পড়তে আসবে ওদেরকে বাড়িতে চলে যেতে বোলো। আর বলবে যে, আজকের পড়া শুক্রবার পড়িয়ে দেবো।”

“আচ্ছা।”

“রাখছি এখন।”

“ঠিক আছে মা। সাবধানে আসিস।”

অর্ষা ফোন রেখে দেখে আহনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কথা বলার সময়ই মুন চা আর বিস্কুট দিয়ে গেছে দুজনকে। আহনাফ চায়ে চুমুক দিচ্ছিল আর অর্ষাকে দেখছিল। ফোন রাখার পর আহনাফ বলল,

“তুমি বাসায় প্রাইভেট পড়াও?”

“আপনাকে বলব কেন?”

“জিজ্ঞেস করেছি তাই।”

“আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

“আমি তাহলে বারবার জিজ্ঞেস করেই যাব।”

“ভালো ফ্যাসাদে পড়লাম তো! আচ্ছা আপনি হঠাৎ এমন ইউটার্ন মারলেন কেন? আগে তো খুব গম্ভীর আর অল্পভাষী ছিলেন। আলাদা একটা এটিটিউড নিয়ে ছিলেন। হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন হয়ে গেলেন কেন?”

যত্নসহকারে কাপটি ট্রে-তে রেখে আহনাফ বলল,

“আমি আগের মতোই আছি। তবে সেটা বাকিদের জন্য। আর ইউটার্ন মেরেছি তোমার জন্য। অর্থাৎ আমার পরিবর্তন তুমি ব্যতীত অন্য কারও জন্য নয়। জানো তো, নিজের মানুষের সামনে গম্ভীর হয়ে এটিটিউড নিয়ে থাকলে মনের ভাবটা ঠিক প্রকাশ করা যায় না। আর তুমি তো এমনিতেই আমাকে বুঝতে চাও না। এরমধ্যে আমি যদি আবার অল্পভাষী হয়ে থাকি তাহলে তুমি তো আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। এনিওয়ে, এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। প্রাইভেট পড়াও বাসায়?”

“হু।” গম্ভীর হয়ে বলল অর্ষা।

“তাহলে রাফিকে পড়াচ্ছ না কেন?”

“সময় নেই তাই।”

“বিষয়টা সময়ের না। সকাল নিশ্চয়ই আগে বাসায় পড়াত? এখন ওর জায়গায় তুমি বাসায় পড়াও আর সকাল রাফিকে পড়ায়। এর কারণ কী? আমার মুখোমুখি হতে ভয় পাও?”

“ভয় পাব কেন? আপনি বাঘ নাকি ভাল্লুক? আমি আপনাকে এড়িয়ে যেতে চাইছি আপনি সেটা বুঝতে পারছেন না?”

“বুঝতে চাইছি না।”

“তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। অবুঝকে বোঝানোর ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু যে বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকে, তাকে বোঝানোর সাধ্যি আমার নেই।”

“তোরা দুজনে আবার ঝগড়া করছিস।” শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মুন। অন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে অর্ষার পাশে বসল। আহনাফ বলল,

“আমি না, ও ঝগড়া করছে। আমি ঝগড়া করতে জানি না।”

মুন হেসে বলল,

“আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়, আপনি অনেক শান্তশিষ্ট দুলাভাই।”

“কিছু ঝগড়ুটে মেয়ে মানুষ এটারই ফায়দা লুটে নেয় বোন। আমার মতো সাধাসিদা ছেলে পেয়ে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করে।”

“আপনি অর্ষার কথা বলছেন তাই না? ধুর! ওর কথা বাদ দিন। জেদ অনেক বেশি। কিন্তু মানিয়ে নিতে পারলে জীবন সুন্দর করে কেটে যাবে।”

কিছুক্ষণ বাদে আদিবও সেখানে চলে আসে। চারজন উপস্থিত থাকলেও গল্প করছে তিনজন। অর্ষা এখানে নিরব ভূমিকা পালন করছে। তার হাতে হুমায়ুন আহমেদের ‘শুভ্র গেছে বনে’ বইটি। সে বইয়ের পাতায় শুধু শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। কী পড়ছে না পড়ছে তা ওদের গল্প আর হাসির শব্দে ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তবুও অর্ষা বইটি চোখের সামনে ধরে রেখেছে। সময় কাটানোর জন্য এরচেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। ওদিকে যে আহনাফের ব্যস্ত, ব্যাকুল দৃষ্টি একটুপর পরই তার দিকে এসে আটকে যাচ্ছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ নেই।

গল্পে গল্পে মুনের বিরিয়ানি রান্নাও হয়ে গেছে। আদিব সালাদ বানিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। বিরিয়ানির ঘ্রাণ শুনেই আহনাফ কিছুক্ষণ মুনের রান্নার প্রসংশা করে। খাবার মুখে তোলার পর প্রসংশা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। মুনের রান্নার হাত ভালো এটা অস্বীকার করার জো নেই। আহনাফ খেতে খেতে বলল,

“শালিকার হাতের রান্না খেয়ে ফেললাম। কবে যে বউয়ের হাতের রান্না খাব কে জানে!”

আদিব মুচকি হেসে বলল,

“আগে বিয়েটা তো করুন ভাইয়া।”

“আমি তো রাজিই আছে। সে রাজি থাকলে আমি এখনই কাজী ডেকে আনব।”

অর্ষা কোনও প্রত্যুত্তর করছে না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। মুন কয়েকবার খুঁচিয়েও অর্ষার মুখ থেকে কোনও শব্দ বের করতে পারল না। খাওয়া-দাওয়ার পর মুন বাটি ভর্তি বিরিয়ানি অর্ষার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“এগুলো বাসায় নিয়ে যা। আঙ্কেল-আন্টি তো আর আসবে না আমার বাসায়। তারা তো মহা ব্যস্ত। খেয়ে আমাকে বলতে বলবি কেমন হয়েছে।”

মুনের অভিমানে অর্ষা মৃদু হাসল। দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে আহনাফ আর সে বেরিয়ে আসে। আহনাফ গাড়ি ঠিক করবে অর্ষা তখন বলল,

“আপনি বাড়ি চলে যান।”

“আর তুমি?”

“আমি বাজারে যাব। লেট হবে।”

“চলো।”

“চলো মানে?”

“মানে আমিও তোমার সঙ্গে বাজারে যাব।”

“কেন?”

আহনাফ ফোনের স্ক্রিন অন করে অর্ষার সামনে ধরে বলল,

“অলমোস্ট রাত ন’টা বাজে। ঢাকা-শহরে এটা খুব একটা রাত না হলেও আমার চিন্তায় তোমার জন্য অনেক রাত। এত রাতে তোমাকে একা রেখে আমি চলে যাব?”

“আমার প্রতি আপনাকে এত কেয়ার দেখাতে হবে না।”

“তুমি না চাইলেও আমি দেখাব। এখানের কোনও বাজারে যাবে নাকি ঐ বড়ো বাজারেই যাবে?”

অর্ষা বুঝতে পারল আহনাফ নাছোড়বান্দা, সে সত্যিই অর্ষাকে একা রেখে যাবে না। অযথা কথা বাড়িয়ে তর্ক করেও লাভ নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট। ছোটো করে বলল,

“বড়ো বাজারেই যাব।”

আহনাফ একটা রিকশা ডাকে। দুজনে রিকশায় বসলেও মাঝখানে বেশখানি জায়গা রেখেছে অর্ষা। আহনাফ বুঝতে পেরেও কিছু বলল না। বাজারে গিয়ে বাজার করার পর বাড়ি ফেরার পালা। আহনাফ বাজারের টাকা দিতে চাইলে অর্ষা চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছিল। এরপর আর বাড়তি সাহস দেখাতে যায়নি আহনাফ।

“এখান থেকে বাড়ি কাছেই। আমি একটা রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারব। আপনি বাড়িতে চলে যান।” বলল অর্ষা।

“বাজারের টাকা দিতে দিলে তোমার কথা রাখার চেষ্টা করতাম।” মিথ্যা বাহানা দেখাল আহনাফ।

অর্ষা বাজারের ব্যাগ নিচে রেখে বলল,

“এখন তাহলে আপনি কী করতে চাচ্ছেন?”

“তোমার সাথে বাসা অব্দি যেতে চাইছি। বারণ করে লাভ নেই। চলো।”

আহনাফ আবার রিকশা ঠিক করল। অর্ষা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে আহনাফ বলল,

“উঠো।”

বাধ্য হয়ে অর্ষাকে আহনাফের সঙ্গেই বাড়ি পর্যন্ত যেতে হলো। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিল আহনাফ। অর্ষা বাড়ির ভেতর যাচ্ছিল আহনাফ তখন পিছু ডেকে বলল,

“একটাবার শুনবে?”

অর্ষা দাঁড়াল। পিছু না ফিরেই বলল,

“কী দরকার?”

“তাকাও তো একবার।”

“তাকালাম। যা বলার জলদি বলেন।”

“তুমি এখনও আমার ওপর রাগ করে আছো?”

“না তো! আগেই বলেছি সেই অধিকার আমার নেই।”

“আমি মানছি তো আমার ভুল হয়েছে। সেদিন ওভাবে কথাগুলো আমার বলা উচিত হয়নি। কিন্তু তুমিই একবার ভেবে দেখো তখন আর আমি কী-ই বা করতাম? যা-ই বলেছি সেদিন দুজনের দিকটা ভেবেই বলেছি।”

“বেশ তো! আজ তাহলে এত আকুতি-মিনতি করতে বলেছে কে? আপনি যেমনটা চেয়েছিলেন সব তো তেমনটাই চলছে।”

“চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তো আর চাই না।”

“সেটা আপনার ব্যাপার। আপনি তখন চেয়েছিলেন, এখন চান না এতে আমার কী করার আছে? তখন যেমনটা চেয়েছিলেন আমি তেমনটাই মেনে নিয়েছিলাম। আর তেমনভাবেই চলব।”

“সবসময় জেদকে প্রশ্রয় দিও না অর্ষা। কেউ ভুল স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।”

“ভুল করলে ক্ষমা না হয় করা যায়। কিন্তু আঘাত করলে? আঘাত করার পর যদি ক্ষমা করাও হয় তাহলে কি সেই আঘাত মুছে যায়? ভুলে যাওয়া যায়?”

“কী করলে তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে বলো? আমি তা-ই করব তোমার জন্য।”

“কিছু করতে হবে না আপনাকে। দয়া করে আমাকে শুধু আমার মতো ছেড়ে দিন। আমি এভাবেই ভালো আছি। আমার কাউকে দরকার নেই। কারও ভালোবাসারও দরকার নেই আমার।”

“কিন্তু আমার দরকার আছে। আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি স্যরি। মন থেকেই ক্ষমা চাচ্ছি।”

“কিন্তু আমি মোটেও আপনাকে ইট’স ওকে বলব না। আপনি এখন আসতে পারেন।”

অর্ষা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আহনাফ কিছুটা রাগীস্বরে বলে,

“আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। তুমি কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ?”

আহনাফ রাগীস্বরে কথা বলায় অর্ষাও চটে যায়। সে ফের দু’কদম এগিয়ে এসে বলে,

“কাকে ধমক দিয়ে কথা বলছেন আপনি? আর কে বলেছে আপনাকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে? বললাম তো আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন। কেন শুধু শুধু নিজের সময় নষ্ট করছেন আর আমাকে বিরক্ত করছেন?”

“তুমি সত্যিই আমার মেজাজ খারাপ করে ফেলছ অর্ষা।”

“কী করবেন এখন? মারবেন? মারুন না! অপমান করেছেন, কষ্ট দিয়েছেন, আঘাত করেছেন। এখন তো শুধু মারটাই বাকি আছে। এটা আর বাকি রেখে কী হবে? কী হলো তাকিয়ে আছেন কেন? মারুন।”

আহনাফ শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। জোরে শ্বাস নিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে। এরপর ম্রিয়মাণ কণ্ঠে,

“স্যরি ফর দ্যাট।’ বলেই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে অর্ষার গালে আলতো করে চুমু খায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যায় অর্ষা। আহনাফ পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলে,

“এখন থেকে অপমান, আঘাত, কষ্ট কোনও-টাই দেবো না। যা দেবো শুধু ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া আর কিচ্ছু তুমি আহনাফের থেকে পাবে না।”

এরপর সে মুচকি হেসে সোজা হাঁটতে শুরু করে। আস্তে আস্তে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_১৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অর্ষা স্তম্ভিত হয়ে নিজের রুমে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে করেই বারবার অবাক হচ্ছে সে। বিশ্বাসই হচ্ছে না আহনাফ এমন কিছু করেছে। সকাল প্যাটিসকে খাবার খাওয়াচ্ছিল। অনেকক্ষণ যাবৎ অর্ষাকে এমন ঝিম মেরে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে আপু?”

অর্ষা বড়ো করে শ্বাস নিয়ে বলল,

“কিছু না।”

“আহিল ভাইয়া এসেছিল আজ।”

“কখন?”

“বিকেলে। তোকে নোট দেওয়ার জন্য এসেছিল। তোর বইয়ের ভেতর রেখেছি।”

“আচ্ছা।”

“আপু একটা কথা বলি?”

“কী?”

“তুই একদিন রাফির সাথে দেখা করিস। ও তোকে অনেক মিস করে।”

অর্ষা কাঁথা টেনে শুয়ে বলল,

“দেখি।”
.
.
আহনাফ মায়ের রুমে বসে আছে। আমেনা বেগম ঘুমিয়েছেন আরও আগেই। আহনাফ পাশে বসে তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। অর্ষাকে আমেনা বেগমের কাছাকাছি আনা খুব দরকার। কিন্তু অর্ষা তো তাকেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। আজ সে যেই কাজ করেছে তা অবিশ্বাস্য। চলে আসার সময় হাত-পা কাঁপছিল। রাগ সামলে এমন কিছু করে ফেলবে নিজেও বুঝতে পারেনি। অবশ্য তাছাড়া আর কী করত? মেয়েটা এত বেশি জেদ করে যে নিজেকে সামলানো যায় না।

নিজের রুমে গিয়ে সে হাসিবকে কল করে। ফোন রিসিভ করেই হাসিব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে,

“দোস্ত তুই না কল করলে আমিই তোকে কল করতাম এখন।”

“চাপাবাজি আর করিস না তুই।”

“সত্যি বলছি। আমি নেক্সট মান্থে দেশে আসব।”

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ, দোস্ত।”

“ভাই এটা গ্রেট নিউজ ছিল।”

“এজন্যই তো বললাম, কল দিতাম তোকে। কিন্তু তার আগে তুই-ই কল দিলি। কোনও খবর-টবর আছে নাকি? অর্ষার রাগ ভেঙেছে?”

আহনাফ হতাশ হয়ে বলল,

“না রে! সহ্যই করতে পারে না আমাকে। কতভাবে মানানোর ট্রাই করতেছি। ফলাফল শূন্য।”

“বোঝো এবার! আগ বাড়িয়ে সেদিন ঐভাবে বলতে গেছিলা কেন?”

“আরে ভাই আমি কি জানতাম এরকম ইফেক্ট পড়বে!”

“মেয়েদের আত্মসম্মান অনেক বেশি দোস্ত। এরা সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজি আছে, কিন্তু আত্মসম্মানের বেলায় এক চুলও ছাড় দেবে না।”

“অর্ষার আত্মসম্মান মনে হয় একটু বেশিই! কথার এমন সাইজ যে একদম বুকে গিয়ে লাগে।”

হাসিব শব্দ করে হেসে ওঠে। আহনাফ বলে,

“হাসিস না। খুবই করুণ সময় পার করছি। অর্ষাকে মানাতে পারছি না, নিজের কাছে আনতেও পারছি না। চারদিকে খালি শূন্য দেখতেছি।”

“ভালোবাসার কথা তো বলে দিছিস তাই না?”

“তা তো প্রতি মুহূর্তেই বলি। সুযোগ পেলেই বলি। পাত্তা দেয় না। এমনভাবে তাকায়, মনে হয় কাঁচা-ই গিলে খেয়ে ফেলবে।”

“হাল ছাড়িস না।”

“তা ছাড়ছি না। কিন্তু কী করা যায়? কোনও উপায় বল; যাতে করে ওর মন গলে।”

“এখন আমি কী বলি বল তো? তোর কথায় মনে হচ্ছে অর্ষার জেদ আকাশচুম্বী। আর এমন মেয়েদের রাগ ভাঙানো, মন গলানো সহজ কোনও কথা না।”

“হতাশ করিস না। আইডিয়া দে কোনও।”

“কোনও গিফ্ট দিয়ে দেখতে পারিস।”

“ধুর! মুখের ওপর ছুঁড়ে মারবে। ওকে দিয়ে কোনও ভরসা নেই। পরে মান-সম্মানের আর কিছু বাকি থাকবে না।”

“তাহলে আর কী করা যায়? আচ্ছা শোন, আর তো মাত্র কিছুদিন। আমি দেশে আসি। তারপর পরামর্শ করে কোনও ভালো আইডিয়া বের করব। ততদিন পর্যন্ত তুই তোর কাজ চালিয়ে যা। কতদিন আর ইগনোর করবে? মেয়ে মানুষ যতই রাগী, জেদি হোক না কেন; ওদের মনটাও আবার অনেক নরম। বাইরের শক্ত আবরণটা একবার ভাঙতে পারলেই হলো। আর তোকেও এখন এটাই করতে হবে।”

“বুঝলাম। আচ্ছা শোন, আমি তো একটা কাজ করে ফেলেছি।”

“কী করেছিস?”

আহনাফ ইতস্তত করে বলল,

“চুমু খেয়ে ফেলেছি।”

“কীহ! ডিরেক্ট চুমু? এত সাহস তোর? আহনাফ একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছে? এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? কীভাবে পারলি রে তুই? তুই তো দেখি ছুপা রুস্তম!”

“আহ্! লজ্জা দিস না।”

“লিপ কিস করেছিস?”

“হপ! গালে দিয়েছি। কীভাবে কীভাবে যেন চুমু দিয়ে ফেললাম।”

হাসিব হেসে বলে,

“ও তোকে মারে নাই?”

“তার আগেই তো চলে এসেছি। আর কিছুক্ষণ সামনে থাকলে নির্ঘাত মারতো।”

“ভাইরে ভাই! আর হাসাস না তুই আমাকে।”

“তোকে বলি আমি দুঃখের কথা, আর তুই হাসিস। তাহলে আর বলে লাভ কী?”

“কী করব বল? আমরা তো বন্ধুরা সবাই তোকে আনরোমান্টিক বলেই জানতাম। তুই যে ভেতরে ভেতরে এত রোমান্টিক তা কি আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছি কখনও?”

‘আশ্চর্য! তোরা কেন টের পাবি? আমার ভেতরে কোনও সমস্যা নেই।”

হাসিব আহনাফের কথার মিনিং বুঝতে পেরে দাঁত খিঁচিয়ে বলল,

“শালা!”
________

অর্ষা অফিসে গিয়ে ভাবছিল আজ সে ফাইল নিয়ে আহনাফের কাছে যাবে না। কিন্তু সে না গেলে কে যাবে? এই কাজ তো আর অন্য কারও নয়। স্মৃতিকে পাঠানো যায়; কিন্তু এর জন্য যদি আবার তাকে কথা শুনতে হয়? দোনামোনায় সে কলম কামড়াচ্ছিল। জিসান এসে বলে,

“এটা খুবই খারাপ স্বভাব!”

অর্ষা হকচকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। জিসান বলে,

“দাঁড়াতে হবে না। বসো, বসো।”

“না, স্যার। ঠিক আছে।”

“কলম খাচ্ছ কেন? সকালে খেয়ে আসোনি?”

অর্ষার মুখ হা হয়ে যায়। বড়োসড়ো ধাক্কা খায় সে। জিসান মশকরা করছে তার সাথে! যেই লোক ধমক না দিয়ে কথা বলে না সেই লোক এখন হেসে কথা বলে, সেধে এসে কথা বলে, বাড়ি পৌঁছে দিতে চায়। আবার মশকরাও করে। কেন এত পরিবর্তন? তাহলে স্মৃতির কথাই ঠিক? এই লোক ধাক্কা খেয়ে নিচে না পড়ে একদম প্রেমে পড়ে গেল? এমন হলে তো খুব মুসিবত!

অর্ষা বোকার মতো হেসে বলল,

“না, মানে…অভ্যাস।”

“ঐযে বললাম খারাপ অভ্যাস। কিছু নিয়ে টেনশন করছ মনে হয়।”

“না, স্যার।”

জিসানের সাথে কথা বলার সময় দেখে আহনাফ এসেছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেল।

জিসান বলে,

“কোনও সমস্যা হলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।”

“কোনও সমস্যা নেই স্যার।”

“শিওর?”

“একদম।”

“আচ্ছা। তোমার ফোন নাম্বারটা দাও তো। সব স্টাফদের নাম্বার আছে, শুধু তোমারটা নেই।”

মুখের ওপর বারণ করার উপায় নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অর্ষাকে ফোন নাম্বার দিতে হলো। জিসান চলে যাওয়ার পর অর্ষা আহনাফের কাছে যায়। চোখ-মুখ শক্ত করে রেখেছে সে। যতটা পারা যায় বাইরে থেকে নিজেকে সে কঠিন রাখার চেষ্টা করছে। আহনাফও আজ কোনও ‘রা’ করেনি। গম্ভীর হয়ে ফাইলে সিগনেচার করে দিয়েছে। অবাক হলেও অর্ষা আহনাফকে ঘাঁটাল না। ফাইল নিয়ে আমার নিজের জায়গায় চলে এসেছে।

জিদ্দে ফুলতেছে আহনাফ। মাথার রগ মনে হয় দপদপ করে কাঁপছে। সে প্রায়ই লক্ষ্য করে জিসান অর্ষার সঙ্গে সেধে সেধে কথা বলে। জিসানের স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত। তাই খুব সহজেই তার পরিবর্তন আহনাফের চোখে ধরা পড়েছে। জিসান যে অর্ষার প্রতি দুর্বল এটাও তার পুরুষ মন ধরে ফেলেছে। একজন ছেলে হয়ে খুব সহজেই সে অন্য ছেলের আচরণ,চোখের ভাষা বুঝতে পারে। আহনাফ নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কেউ কাউকে পছন্দ করতেই পারে,দুর্বল হতে পারে, ভালোও বাসতে পারে; এতে সমস্যার কিছু নেই। অর্ষা তো আর জিসানকে ভালোবাসে না। সে এক মনে এসব ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেও তার আরেক মনে ঈর্ষান্বিত হচ্ছিল। স্বাভাবিক ছোট্ট একটা বিষয়কেও তার অনেক বড়ো ইস্যু মনে হচ্ছিল। অর্ষাকে হারানোর ভয়ও মনে তীব্র হচ্ছে। সে রাগে,ক্ষোভে এবং বিরক্তিতে স্বগতোক্তি করে ওঠে,

“নিজেই এখনও মনে জায়গা পেলাম না; ওদিকে আবার প্রতিদ্বন্দ্বী চলে এসেছে। ড্যাম ইট!”

“স্যার, আসব?”

বিরক্তিকর চাহনীতে আহনাফ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আসুন।”

নিজেকে স্বাভাবিক করল সে। মিজান এসেছে।

“আপনি ব্যস্ত?”

“একটু! কিছু বলবেন?” জানতে চাইল আহনাফ।

“তাহলে আমি পরে আসি।”

“সমস্যা নেই। বসুন। বলেন কী বলবেন।”

মিজান চেয়ার টেনে বসল। নড়েচড়ে বলল,

“একটা লোক যদি নিয়ে দিতেন স্যার।”

“এখন তো লোক নিয়োগ বন্ধ।”

“কোনওভাবে কি নেওয়া যাওয়া না স্যার? একটা পদ তো খালি আছে শুনেছিলাম।”

“আছে। কিন্তু ঐ পদে এখন আমাদের কোনও লোক লাগবে না। তাই নিচ্ছি না।”

“চাকরিটা খুব দরকার ছেলেটার। অর্ষা অনেকবার করে রিকোয়েস্ট করেছে।”

এবার আহনাফ নড়েচড়ে বসে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

“অর্ষা! ছেলেটা কি হয় উনার?”

“বন্ধু হয়।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কালকে আসতে বলুন।”

মিজান খুশি হলো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“থ্যাঙ্কিউ স্যার।”

লাঞ্চ টাইমে আশিক ফোন করেছিল। আজ অফিস ছুটির পর দেখা করতে বলল। অর্ষার হাতে সময় বেশি নেই। এক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা করে আবার বাসায় ফিরে যেতে হবে। তাই বিকেলে অফিস ছুটি হওয়ার সাথে সাথেই সে বের হয়ে পড়েছে। আদিলকে আগামীকাল অফিসে আসতে বলার কথা দেখা হলেই বলবে বলে ভেবে রেখেছে। মিজান যেভাবে বলল তাতে মনে হচ্ছে জবটা হয়ে যাবে। হয়ে গেলেই ভালো। অর্ষা তো মনে মনে এটাই চায়।

আজ সবাই মিলে বসেছে রেস্টুরেন্টে। অর্ষা যাওয়ার পূর্বেই দিদার খাবার অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। তাই গিয়ে বসা মাত্র মিনিট দশেক পর ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে যায়। রেশমি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে,

“ট্রিট কেন দিচ্ছিস দিদার? কোনও সুখবর আছে নাকি?”

দিদার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

“হ্যাঁ, আছে তো। আমার ন’মাস চলছে। খুব শীঘ্রই তোরা খালামনি আর মামা হবি।”

দিদারের কথা শুনে রেশমি বাদে বাকিরা হেসে ফেলে। দিদার দাঁত খিঁচিয়ে বলে,

“কথাবার্তা শুনলেই মেজাজ হাই ভোল্টেজ হয়ে যায়। সুখবর ছাড়া কি খাওয়ানো যায় না?”

“যাবে না কেন? অবশ্যই যায়। আর এটা কেবলমাত্র তোর মতো ফ্রেন্ড থাকলেই সম্ভব। হাজার বছর বেঁচে থাক তুই।” বলল লামিয়া।

আশিক বলল,

“তোর খবর বল অর্ষা। দিনকাল কেমন যাচ্ছে?”

“এইতো যাচ্ছে অফিস টু বাড়ি, বাড়ি টু অফিস।”

“কতদিন ধরে ক্লাস করছিস না! একদিন আয় না সময় করে।” বলল জুঁই।

প্রত্যুত্তরে অর্ষা বলল,

“যাব। এখন ছুটি দেবে না তাই যেতে পারছি না।”

কথোপকথনের মাঝে অর্ষার ফোন বেজে ওঠে। মুন ফোন করেছে। রিসিভ করে হ্যালো বলার পূর্বেই অর্ষা ওপাশ থেকে মুনের কান্নার শব্দ শুনতে পায়। মুন ভীষণ হাসি-খুশি একটা মেয়ে। যেমন চঞ্চল, তেমন দুষ্টু। কান্নার আশপাশ দিয়ে ও নেই। তাহলে এখন হঠাৎ কাঁদছে কেন? অর্ষা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“মুন, কাঁদছিস কেন তুই?”

ওপাশ থেকে মুন ক্রন্দনরতস্বরে বলে,

“ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে আমার পা ভে’ঙে গেছে।”

“হাসপাতালে গেছিস? কোথায় আছিস এখন?”

“বাসায়।”

“আমি আসছি।”

ফোন রেখে অর্ষা উঠে পড়ে। বাকিরা জিজ্ঞেস করে,

“কী হলো? মুন কে?”

“মুন আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে নাকি পা ভে’ঙে ফেলেছে। এখন যেতে হবে আমায়।”

“বলিস কী! চল আমিও যাব।” বলল আদিল।

জুঁই কারেকশন করে দিয়ে বলল,

“আমিও নয়; আমরাও যাব।”

অর্ষা ওদেরকে নিয়েই মুনের বাসায় যায়। ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল তার। এই অবস্থায় ওর দেখাশোনা কে করবে? আদিব তো সারাদিন অফিসেই থাকে। মুনের বাড়ি যাওয়ার পর গোমড়ামুখে দরজা খুলে দিল আদিব। অর্ষা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সরাসরি বেডরুমে চলে গেল। এবং বলাই বাহুল্য বড়োসড়ো চমকও পায় সে। মুন দু’পা ছড়িয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। তার পাশেই চেয়ারে বসে আছে আদিল। পরনে অফিসের ফর্মাল পোশাক। তার মানে সরাসরি অফিস থেকে সে এখানেই এসেছে। কিন্তু কেন?

আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিয়ে অর্ষা মুনকে জিজ্ঞেস করল,

“হাসপাতালে যাসনি? কোন পা ভে’ঙে’ছে?”

“বাম পা।”

অর্ষা খাটের একপাশে বসল। মুনের পায়ে হাত দিতে যাবে মুন চেঁচিয়ে উঠে বলে,

“আরে করছিস কী! ওরা কারা রে?”

অর্ষার খেয়াল হলো সে একা নয়; সাথে বন্ধুরাও আছে। বলল,

“ফ্রেন্ডস।”

মুন হাসিমুখে বলল,

“আরে তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো, বসো।”

অর্ষা আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,

“এখনও হাসপাতালে কেন নেননি ভাইয়া?”

আদিবের উত্তরের পূর্বেই মুন খাট থেকে নেমে জুঁই, রেশমি ওদের হাত ধরে খাটের এক সাইডে বসিয়ে দিল। এই ঘটনা দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ। পা ভে’ঙে গেলে সে আবার হাঁটে কীভাবে?

আদিব বিরসমুখে বলে,

“এবার বুঝলেন তো কেন হাসপাতালে নিইনি?”

“মানে কী এসবের? সব মিথ্যা?”

“ওর বুদ্ধিশুদ্ধি কখনও হবে না বোন। হাতে-পায়েই শুধু বড়ো হয়েছে। আক্কেল নাই, জ্ঞান নাই। ফোন দিয়ে এমনভাবে বলেছে আমি তো ভয়ে নাই। ছুটি নিতে গিয়ে দেখি স্যার মিটিং-এ। অপেক্ষা করার সময় কোথায়? না বলেই চলে এসেছি। কাল অফিসে গিয়ে এখন কথা শুনতে হবে। শুধু আমায় হেনস্তা করলেও তো হতো। আহনাফ ভাইকেও ফোন করে বলেছে। আর এখন আপনাকেও।”

মুন কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“আরে মিথ্যা বলতে যাব কেন? আমি তো সত্যিই ওয়াশরুমে পড়ে গেছিলাম। মানে হোচট খেয়েছি আরকি! পা ভাঙেনি ঠিকাছে; কিন্তু ব্যথা তো পেয়েছি। তার মানে কী দাঁড়ায়? আমি কোনও মিথ্যা বলিনি।”

আদিব দীর্ঘশ্বাস নেয়। তার তাকানোর ভঙ্গিটা এমন যে দৃষ্টি বলছে,’একে বোঝানোর চেয়ে কলাগাছকে বোঝানোও ঢের ভালো।”

মুন অর্ষার দিকে তাকিয়ে বিগলতি হয়ে বাচ্চাদের মতোন করে বলল,

“রাগ করেছিস? রাগ করিস না। একা একা বাসায় ভালো লাগে না কী করব? মাথায় আবার চেপেছে দুষ্টুমি বুদ্ধি। তাই একটু প্রাঙ্ক করেছি। ভালোই হয়েছে। এই সুযোগে ওদের সাথে তো পরিচিত হতে পারব।”

“তোর এসব ফাইজলামি আমার একদম ভালো লাগে না মুন। দয়া করে আর এমন করিস না। যাই হোক, আমি আর বসব না। বাসায় যাব।”

“কীসের বাসায় যাবি? আমি সকালকে ফোন করে বলে দিয়েছি আজকে ও রাফিকে পড়াতে যাবে না। বাসায় যারা তোর কাছে পড়ে ওদেরকে পড়িয়ে দেবে। সূতরাং তোর তো আর তাড়া নেই। তুই ওদের সাথে রিল্যাক্স হয়ে বোস। আমি চা নিয়ে আসছি।”

মুন আর আদিব চলে যেতেই অর্ষা ক্ষেপে বলে,

“মুনের সাথে এই বুদ্ধিতে আপনিও জড়িত তাই না?”

আহনাফ হা হয়ে যায়। সে এতক্ষণ অর্ষার বাকি ফ্রেন্ডদের মতোই নিরব ভূমিকা পালন করছিল। হঠাৎ অর্ষার এমন নিরব আ’ক্র’ম’ণে কিছুটা হকচকিয়ে গেছে বৈকি! সে ওর বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে বলল,

“সবসময় সবকিছুতে আমাকে কেন দায়ী করো? আমি নিজেও কিছু জানতাম না। মুন তো বললই।”

“ও তো বলবেই। আপনি শিখিয়ে দিয়েছেন না!”

“ভুল বুঝতে বুঝতে তোমার এমন অবস্থা হয়েছে যে চারদিকে সত্যকেও মিথ্যা মনে হয় তোমার।”

শুনশান রুমে হঠাৎ করেই লামিয়া আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

“এই মাল-টা এখানে কেন রে?”

আহনাফের আর বিস্মিত হওয়ার সীমা নেই। সব বিস্ময়ের সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছে আগেই। সে ফাঁকা বিষম খায়। চোখগুলো বড়ো বড়ো করে বলে,

“মাল! হোয়াট ডু ইউ মিন বাই মাল?”

অর্ষাসহ বাকি বন্ধুরাও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। লামিয়ার কথার কোনও ব্রেক নেই সবাই জানে। তাই বলে সম্মুখেই এমন একটা কথা বলবে? গাধী, বে’য়া’দব একটা!

আদিল পরিস্থিতি সামলাতে হেসে বলে,

“মালা! মানে ও আসলে বলতে চেয়েছে মালা।”

“কীসের মালা? মালা কোত্থেকে এলো?”

আদিল কী বলবে বুঝতে পারছে না। লামিয়া বেফাঁসে কথা বলে নিজেও ঝিম মেরে গেছে। আশিক দাঁত বের করে হেসে বলে,

“গান!”

মুন আর আদিব চা নিয়ে এসেছে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করে,

“কীসের গান ভাই?”

আহনাফ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। ওর সঙ্গে অর্ষাও দাঁড়িয়ে পড়ে। এখন তার ইচ্ছে করছে লামিয়াকে পচা পানিতে চুবাতে। আহনাফ প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলে,

“কী শুরু করলে তোমরা? মাল, মালা গান! হচ্ছেটা কী?”

আশিক গান ধরে,

“সে যে কেন এলো না
কিছু ভালো লাগে না,
এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাব।

যদি ফু্লগুলো হায়
অভিমানে ঝরে যায়,
তবে মালা গেঁথে আমি কারে
পরাব?”

গান শেষ করে আশিক জোরপূর্বক জোরে জোরে হেসে বলে,

“ওমর সানির বিশাল বড়ো ফ্যান লামিয়া বুঝছেন ভাই? তাই বলছিল গানের কলি খেলবে। প্রথম শব্দ দিলো মালা। মালা বলতে গিয়ে বলে ফেলল মাল। সব তো ঠিকঠাক ছিল, শুধু আকার (া-কার) টা বলতে ভুলে গেছে আরকি!”

অর্ষা বাদে বাকিরা তাল মিলিয়ে বলল,

“ঠিক, ঠিক।”

লামিয়া অগ্নিদৃষ্টিতে আশিকের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে,

“শালা, আমি ওমর সানির বড়ো ফ্যান? আলাদা পাই শুধু তোকে!”

আহনাফের মাথা ঝিমঝিম করছে। এদের গ্যাঞ্জাম সাংঘাতিক লেভেলের। শুধু তাই নয়, এরা প্রতিটা বন্ধু একেজন সাংঘাতিক মানুষ। কেমন করে কথা ঘুরিয়ে ফেলল ভাবা যায়!

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here