#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_২
#পর্ব_৫
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। কাদা-পানির রাস্তা মাড়িয়ে অসংখ্য গাড়ি ছুটে চলেছে তাদের নিজস্ব গন্তব্যে। কিছু পথযাত্রী মাথায় ছাতা ধরে ব্যস্ত রাস্তার ধার ঘেঁষে যাচ্ছে। ছাতা শুধু তাদের মাথাটুকু বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচাতে পারছিল। এছাড়া সম্পূর্ণ শরীর বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে একাকার। তবুও তাদের ঘরে আটকে রাখা যায়নি। সকলের মাঝেই তাড়া। কর্মজীবন হোক কিংবা শিক্ষাজীবন কোনোটাই তো আর ঘরে বসে থাকলে চলবে না।
গাড়ির কাচ অল্প একটু নামিয়ে মিনিট দশেক ধরে এসবই দেখছিল আহনাফ। তার পাশে বসে অর্ষা তখনও বেঘোরে ঘুমুচ্ছিল। কয়েকবার ডাকতে গিয়েও ইতস্ততভাবে নিজেকে আবার ধাতস্থ করে নিয়েছে। এভাবে আর কতক্ষণই বা বাস স্টপেজে বসে থাকা যাবে? বাড়ির ঠিকানাও তার জানা নেই। জানলে না হয় বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যেত। কোনো রকম দিকদিশা খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল সে ডাকবে অর্ষাকে। কেশে গলা পরিষ্কার করে প্রথমে মৃদুস্বরে ডাকল,
‘শুনছেন?’
অর্ষার কোনো সাড়াশব্দ নেই। বার দুয়েক এভাবেই মৃদুস্বরে ডেকে বুঝতে পারল, তার কণ্ঠস্বরের থেকে বৃষ্টির শব্দও বেশি। এবার সে বেশ জোরেই ডাকল,
‘মিস অর্ষা। শুনছেন?’
হকচকিয়ে ওঠে অর্ষা। ঘুম সম্পূর্ণ হয়নি বলে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কয়েক সেকেণ্ড লাগে তার নিজেকে ধাতস্থ করতে। প্রথমে ঘুম ভেঙে নিজেকে গাড়িতে দেখে এবং আহনাফকে পাশে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিল। আপাতত নিজেকে সামলে নিয়েছে সবটা মনে পড়ায়। তড়িঘড়ি করে সে বলে,
‘চলে এসেছি?’
‘অনেকক্ষণ আগেই।’
‘তো আপনি আমায় ডাকবেন না?’
আহনাফ চুপ করে রইল। বৃষ্টির মধ্যেই অর্ষা বের হওয়ার জন্য গাড়ির দরজা খুলছিল। পিছু ফিরে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘থ্যাঙ্কিউ।’
‘আপনি বৃষ্টির মধ্যে যাবেন কী করে?’
‘আমার কাছে ছাতা আছে।’
‘কোথায়?’
অর্ষা ছাতাটি দেখাতে গিয়ে দেখল ফাইল আর ব্যাগ ছাড়া তৃতীয় কোনো বস্তু তার কাছে নেই। ওদিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আহনাফ। অর্ষা আমতা আমতা করে বলল,
‘মনে হয় হারিয়ে ফেলেছি!’
অর্ষার বোকা বোকা চাহনী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল আহনাফ। সোজা হয়ে বসে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বলল,
‘বাড়ির ঠিকানাটা বলুন।’
‘অ্যা?’
‘বাড়ির ঠিকানা চেয়েছি। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
অর্ষা আর দ্বিমত করল না। বাড়ির ঠিকানা বলে দিল। বাড়িতে পৌঁছাতেও বেশি সময় লাগেনি। অর্ষা ফের গাড়ি থেকে নামার পূর্বে আহনাফকে ধন্যবাদ জানাল এবং এবারও আহনাফ ধন্যবাদের প্রত্যুত্তর করেনি।
এক দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর চলে এসেছে অর্ষা। রুহুল তখন বারান্দায় বসে ফোনে গেইম খেলছিল। অর্ষাকে এমন অবস্থায় দেখে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। রুহলকে এড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় হাত টেনে ধরে অর্ষার। অস্থিরতার সঙ্গে বলতে শুরু করে,
‘তোর গায়ে র’ক্ত কেন? কী হয়েছে তোর?’
অর্ষা কিয়ৎক্ষণ রুহুলের অস্থির চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরনো স্নেহ, ভালোবাসা খোঁজার প্রচেষ্টা। রুহুল আগের তুলনায় আরও অস্থির হয়ে বলে,
‘কিরে? কথা বলছিস না কেন? তোর কী হয়েছে?’
রুহুলের অস্থিরতায় বলা কথাগুলো সেলিনা বেগম, ওমর রহমান আর মুনও শুনতে পায়। ওরাও বারান্দায় এসে অর্ষাকে এমন অবস্থায় দেখে চমকে ওঠে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে জানার জন্য যে, কী হয়েছে।
অর্ষা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’আমার কিছু হয়নি। এক ফ্রেন্ডের এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছিল। ও-কে হাসপাতালে নেওয়ার সময় র’ক্ত লেগেছে।’
রুহুল ওর কথা বিশ্বাস করল না ঠিক। সেলিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মা তুমি ও-কে ঘরে নিয়ে দেখো তো কোথাও কে’টে’ছে নাকি।’
রুহুল অবশ্য ইতিমধ্যে অর্ষার হাত ভালো করে চেক করেছে। অর্ষা সবাইকে শান্ত হতে বলল,
‘সত্যিই আমার কিছু হয়নি। কিছু হলে কি আমি এমন স্বাভাবিক থাকতে পারতাম?’
ওমর রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,’আচ্ছা পরে সব শুনছি। এখন যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’
মুনকে নিয়ে ঘরে এলো অর্ষা। হিজাব আর ওড়নার পিন খোলার সময় মুন পেটের, পিঠের কাছ দিয়ে কামিজ সরাচ্ছিল। অর্ষা এক লাফে সরে গিয়ে বলে,
‘এই অ’স’ভ্য মেয়ে কী করছিস?’
মুন আবার এগিয়ে গিয়ে বলল,’আহ্! চেক করতে দে। সত্যি নাকি মিথ্যা বলেছিস দেখতে হবে তো।’
‘মিথ্যা বলার কোনো প্রশ্নই আসে না।’ বলে মুনকে সরিয়ে দিল।
মুন ভ্রুঁ কু্ঁচকে তাকিয়ে আছে। বিছানার ওপর বসে বলল,
‘এরকম লাফালাফি করিস কেন? আমিই তো। তোর যা আছে, আমারও তাই আছে। তাহলে এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে?’
‘তুই আগের মতোই বেশরম আছিস।’
‘আর তুই আগের মতোই লজ্জাবতী আছিস। তোর হাজবেন্ড যে কীভাবে তোর লজ্জা ভাঙাবে আমি ভেবে পাই না।’
‘তোকে এত বেহুদা ভাবনা কে ভাবতে বলেছে বল তো?’
‘কেউ না। বান্ধবী হিসেবে আমার তো একটা দায়িত্ব আছে।’
‘আমার লজ্জা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার দায়িত্ব তোর নেওয়া লাগবে না। তুই বিয়ে করতে যাসনি?’
‘এটা তুই কেমন কথা বললি অর্ষা?’
অর্ষা ওয়ারড্রব থেকে জামা-কাপড় বের করতে করতে বলল,
‘কেমন কথা মানে? তুই না বিয়ে করতে এসেছিস?’
‘হ্যাঁ। তাই বলে তোকে ছাড়াই বিয়ে করে ফেলব? এটা তুই কী করে ভাবলি!’
‘ন্যাকামি করিস না। তোর দ্বারা সবই সম্ভব। দুই বছর যখন যোগাযোগ না রেখে থাকতে পেরেছিস, তখন বিয়েও আমাকে ছাড়াই করতে পারবি।’
‘একটা ভুলের জন্য এভাবে খোঁটা দিবি? আমি তো ভেবে রেখেছি বিয়েতে তোকে আমার উকিল মা বানাব। তুই যখন বলেছিলি শ্বশুরবাড়িতে যাস, তখন তো মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম তোর স্বামীকে বানাব উকিল বাপ।’
কথা শেষে মুন হিহি করে হাসতে থাকে। এদিকে অর্ষার চোখ চড়কগাছ। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘বিয়ে করে তুই আমার বাড়ি থেকে বিদায় হ জলদি।’
‘আহা! রাগ করিস কেন? আচ্ছা শোন না, আমার ধারণা যদি সত্যি হতো তাহলে ঐ লম্বু গম্ভীর ছেলেটাই উকিল বাপ হতো তাই না?’
‘কার কথা বলছিস?’
‘আরে ঐযে তোর ছাত্রর মামা। যাকে তোর হাজবেন্ড ভেবেছিলাম।’
অর্ষা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,’আজেবাজে কথা বলবি না একদম।’
‘সত্যি কথাই তো বললাম। তোদের বিয়ে হলে বেশ মানাত। সবসময় তোকে কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরত। তুই যেই পিচ্চিবাচ্চা!’
অর্ষার হাতের তোয়ালে ছুঁড়ে মারল মুনের দিকে। মুন বিছানায় শুয়ে হাসতে হাসতে বলে,
‘একটু হরলিক্স খেলেই তো পারিস। লম্বা হওয়া প্রয়োজন।’
‘আমি শর্ট?’
‘তো কী? পাঁচ ফুটও তো মনে হয় না।’
‘এক থা’প্প’ড়ে দাঁত ফেলে দেবো। আমি একদম ঠিকঠাক পাঁচ ফুট।’
‘ওহ! তাও তো শর্ট-ই। সে তোর থেকে কত্ত লম্বা!’
‘সে লম্বা হোক নয়তো তাল গাছ হোক, তাতে আমার কী রে? তুই তার সঙ্গে আমায় কেন গুলাচ্ছিস?’
‘রাগ করিস কেন? এমনি এমনিই বললাম।’
অর্ষা আর কথা না বাড়িয়ে মুনের থেকে তোয়ালে নিয়ে গোসল করতে চলে যায়। মুন মুখটিপে হাসে।
_________
বিকেল ৪:২৩ মিনিট
আহনাফ কিচেন থেকে কফি বানিয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল কলিংবেলের শব্দ শুনে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। রেণু নেই আশেপাশে। তাই সে নিজেই যায় দরজা খুলতে।
আহনাফকে দেখে মৃদু হাসল অর্ষা। যাওয়ার জায়গা দিয়ে সরে দাঁড়াল আহনাফ।
‘রাফি ওর রুমেই আছে?’ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করল অর্ষা।
‘হ্যাঁ। আজ না আসলেও পারতেন।’
অর্ষা ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘কেন?’
‘আপনার ফ্রেন্ড হাসপাতালে। আপনার ওখানে যাওয়া উচিত ছিল।’
‘রাফিকে পড়িয়ে ওখানেই যাব।’
‘না আসলেও অসুবিধা ছিল না। আপনি চাইলে এখনই চলে যেতে পারেন।’
‘এসেছি যখন পড়িয়েই যাই।’
‘রাফি ঘুমাচ্ছে।’
অর্ষা অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
‘তাহলে কি চলে যাব?’
আহনাফ হাসতে গিয়েও হাসল না। বলল,’সেটাই ভালো হবে।’
‘ঠিক আছে।’ বলে অর্ষা চলে আসে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু সামনে গিয়ে একটা রিকশা নেয়।
অর্ষা চলে যাওয়ার পরই মুচকি হাসে আহনাফ।
.
অর্ষা যখন হাসপাতালে পৌঁছায় আহিল তখন ঘুমিয়ে ছিল। বাকিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একেক জায়গায় বসে আছে। দিদার একা একাই লুডু খেলছে ফোনে। আশিক ফোনে চ্যাটিং করছে। লামিয়া, রেশমি আর জুঁই গল্প করছিল। অর্ষাকে দেখতে পেয়ে সকলের মনোযোগ ওর দিকেই আসে।
খেলা বন্ধ করে দিদার বলে,’তোমাকে দু’বার ফোন দিয়েছিলাম।’
অর্ষা কাচুমুচু হয়ে বলল,’বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু শুতেই ঘুম চলে এসেছিল। তাই খেয়াল করিনি। ফোনে ব্যালেন্সও ছিল না যে পরে ব্যাক করব।’
দিদার হেসে বলল,’ইট’স ওকে। বসো।’
অর্ষা গিয়ে রেশমির পাশে বসল। লামিয়া একটা বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল,’খাও।’
‘কী আছে?’
‘খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা।’
অর্ষা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,’এগুলে কে এনেছে?’
রেশমি বলল,’লামিয়া। ওর বাসা হাসপাতাল থেকে কাছেই। ওর মাকে ফোন করে বলে দিয়েছিল খিচুড়ি রান্না করতে। রান্না শেষে নিয়ে এসেছে।’
অর্ষা প্রসংশিতভাবে হেসে বলল,’দারুণ তো।’
লামিয়া অর্ষাকে তাড়া দিয়ে বলল,’তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। নয়তো একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
‘তোমরা খাবে না?’
‘তোমার আসতে দেরি হচ্ছিল বিধায় আমরা খেয়ে ফেলেছি। স্যরি।’ বলল জুঁই।
অর্ষা হেসে বলল,’ধুর! এজন্য স্যরি বলতে হবে নাকি? খেয়েছ ভালো করেছ। এখন আবার সবাই আমার সাথে খাবে।’
লামিয়া হাত দুটো উচুঁ করে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গি করে বলল,’ওরে বাবা! মাফ চাই। আমি পারব না। পেটে একটুও জায়গা নেই।’
‘আমিও তো বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আমারও পেট ভরা। আমার সাথে না খেলে আমিও খাব না।’
অগত্যা সকলকে খাওয়ার জন্য রাজি হতে হয়। আশিক শর্তজুড়ে দিয়ে বলল,
‘আমি খাব তবে শর্ত আছে। আমায় খাইয়ে দিতে হবে। একচুয়ালি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমি ব্যস্ত আছি। খেতে গেলে মুসিবত হয়ে যাবে।’
জুঁই ফোঁড়ন কেটে বলল,’কী এমন রাজকার্য করছ শুনি?’
‘তুমি বুঝবে না লিটল গার্ল।’
দিদার হেসে বলে,’গার্লফ্রেন্ডের মান-অভিনান ভাঙায়।’
আশিক চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলে,’তুমি আমার ম্যাসেজ পড়েছ?’
‘পড়তে চাইনি। আমার কোলের ওপর শুয়ে ছিলে একটু আগে। তখনই দেখলাম মেয়ে আইডি থেকে উরাধুরা অ্যাংরি ইমুজি পাঠাচ্ছে কেউ।’
‘হেহে! ঠিকই ধরেছ। আমার গার্লফ্রেন্ড।’
জুঁই বিস্ময়ে বলল,’তোমার মতো ফানি টাইপ ছেলের সাথে রিলেশন করে কোন মেয়ে?’
আশিক অর্ষা আর দিদারের দিকে তাকিয়ে বলে,’এটা প্রশংসা ছিল নাকি অপমান?’
‘তোমার মান আছে আশিক?’ মুখটিপে হেসে বলল রেশমি।
‘ওহ মাই গড! এত বড়ো অপমান। তোমরা জানো আমার কয়টা গার্লফ্রেন্ড?’
লামিয়া প্রশ্ন করল,’কয়টা?’
‘শোনে তাহলে, দুই আইডিতে দুইটা গার্লফ্রেন্ড। হোয়াটসএপে একটা, ইন্স্ট্রাগ্রামে একটা, ইমোতে একটা, ভাইবারে একটা। আপাতত এই ছয়টা।’
সবার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। দিদার অবাক বিস্ময়ে বলে,
‘এতগুলোকে হ্যান্ডেল করিস কেমনে ভাই?’
আশিক বুকের ওপর হাত রেখে তৃপ্তির সুরে বলল,
‘আহা! এতক্ষণে মনে হলো আসলেই কোনো বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছে। সবাই তুমি তুমি বললে কি মানায়? বন্ধুদের মুখে তুই ডাকটাই বেস্ট। ভাই, তুমি আমায় তুই ডাকা শুরু করেছ যখন তখন ভুলেও আর তুমি ডেকো না।’
এরপর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল,’ডিয়ার গার্লস, তোমরাও এখন থেকে তুই বলে ডাকবে। মেয়েদের মুখে তুমি ডাক শুনলে আমার আবার গার্লফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ফিল আসে। বান্ধবীদের গার্লফ্রেন্ড ভেবে আবার গ’ণ’ধো’লা’ই খেতে চাই না।’
জুঁই ভেংচি কেটে বলে,’আমাদের গার্লফ্রেন্ড ভাবতে গেলে গ’ণ’ধো’লা’ই মাস্ট বি খেতে হবে।’
‘এই জুঁইটা বেশি কুইকুই করে। শাস্তিস্বরূপ ও আমাকে খাইয়ে দেবে।’
‘হু ঠ্যাকা তো আমার। যা ভাগ!’
আশিক অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’কিছু বলবা? দেখো কেমন ব্যবহার করে।’
‘হুম বলব তো। যদি নিজেও আমাদের তুই বলে ডাকো।’
আশিক জিভে কামড় বসিয়ে বলল,’আমি তুমি বলছিলাম! ওকে এখন থেকে তুই।’
ঠিক এখান থেকেই বন্ধুত্বের এক নতুন সূচনা ঘটার মাধ্যমে সকলের সম্ভোধন তুমি থেকে তুইতে চলে আসে। খাওয়ার ফাঁকে অর্ষা জানতে চায়,
‘আহিলের বাসায় খবর দিয়েছ?’
লামিয়া কথাটার কারেকশন করে দিয়ে বলল,’দিয়েছিস হবে।’
অর্ষা হেসে বলে,’হ্যাঁ। খবর দিয়েছিস?’
আশিক বলল,’আহিলের কাছে ফোন নাম্বার চেয়েছিলাম বাড়ির কারও। বলল যে, আঙ্কেল-আন্টি নাকি ওর বড়ো বোনের বাসায় গেছে। ওর বোন প্রেগন্যান্ট এজন্য। এখন ওর এই অবস্থা শুনলে টেনশন করবে।’
অর্ষা একটুখানি চুপ করে থেকে বলল,’তাও তো ঠিক কথা।’
রেশমি বলল,’সমস্যা নেই। আঙ্কেল-আন্টির অবর্তমানে না হয় আমরা বন্ধুরা মিলেই আহিলকে সুস্থ করে তুলব কী বলিস সবাই?’
সবাই মৃদুস্বরে বলে,’অবশ্যই।’
‘ডাক্তার কবে রিলিজ করবে বলেছে কিছু?’ জানতে চাইল অর্ষা।
আশিক বলল,’আগামীকাল সন্ধ্যায়। এখন যেহেতু ওর বাসায় কেউ নেই তাই আমি ঠিক করেছি, আহিলকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। তাহলে আমিও ওর দেখাশোনা করতে পারব।’
দিদার মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,’আমি আরও ভাবলাম আমি নিয়ে যাব।’
আশিক ওর পিঠ চাপড়ে বলে,’মন খারাপ করিস কেন? তুইও আমার বাসায় চলে আয়। প্রতিদিন তিনজনে মিলে ব্যাপক আড্ডা হবে।’
‘মাঝখান থেকে আমরা ঢেউ টিন।’ মেকি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল লামিয়া।
ওর এই অভিনয়ে সবাই জোরে হাসতে গিয়েও সাবধান হয়ে যায় আহিলের দিকে তাকিয়ে। তারপর আবার নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কথা বলতে থাকে। কথার মাঝে আবার হুটহাট করে নিঃশব্দে, হাতে মুখ ঢেকে হেসে ওঠে। মৃদু হাসির শব্দ আহিলের কানেও আসে। তার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। তবুও সে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এড়িয়ে চলা বন্ধুদের ফিসফাস করে বলা কথার ধ্বনি, চাপা হাসির ধ্বনি সবকিছু লুকিয়ে শুনতেই তার ভালো লাগছে। যদিও মনের এক কোণে ওদের সাথে আড্ডায় যোগ দেওয়ার বহিঃপ্রকাশও লক্ষ্য করেছে সে।
_________
রাফির কান্নাকাটি শুনে আহনাফ দৌঁড়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। রেণু কিছুতেই রাফির কান্না থামাতে পারছে না। আহনাফ এসে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে? ও কাঁদছে কেন?’
রেণু চোখ-মুখ অন্ধকার করে বলে,’ম্যাডাম আসে নাই তাই।’
‘ম্যাডাম মানে? ওর টিচারের কথা বলছ?’
‘হুম। কালকে ওর পরীক্ষা। ম্যাডাম না আসলে পড়ব কার কাছে, তাই কানতাছে।’
আহনাফ প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলে,’আচ্ছা তুমি যাও। আমি দেখছি।’
রেণু চলে যাওয়ার পর আহনাফ রাফিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘বই বের কর।’
রাফি কান্না থামিয়ে গোল গোল চোখে আহনাফের দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কেন?’
‘কেন মানে? একটু আগেই তো পড়ার জন্য কান্নাকাটি করছিলি।’
‘তোমার কাছে তো পড়ব না। ম্যামকে আসতে বলো।’
‘ম্যাম আজ আর আসতে পারবে না। আমি পড়াচ্ছি তোকে।’
‘না, আমি ম্যামের কাছেই পড়ব। তোমার কাছে পড়ব না।’
‘কেন? আমি কি পড়াতে পারি না?’
‘তোমাকে আমার ভয় লাগে।’
‘ভয় লাগে! আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক?’
‘তুমি বড়ো রোবট।’
‘মানে!’
‘ম্যাম বলেছে তুমি বড়ো রোবট আর আমি ছোটো রোবট।’
আহনাফ হকচকিয়ে কিছুক্ষণ রাফির দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘এসব কথা কেন বলেছে?’
‘ম্যাম বলেছে, তুমি গম্ভীর স্বভাবের। হাসতে পারো না। আমিও নাকি তোমার মতোই হয়েছি।’
আহনাফ কী বলবে বুঝতে পারছে না। তবে মনে মনে সে অর্ষার ওপর একটু ক্ষেপেই আছে। রাফিকে ধমক দিয়েও তার কাছে পড়তে বসানো যায়নি। ওদিকে অর্ষাকে না আনলে আজ রাতে রাফির কান্না থামবে বলে মনে হয় না। এছাড়া আহনাফ নিজেও মনে মনে চাইছে অর্ষা আসুক। তাকে রোবট বলার মানে কী স্পষ্টভাবে জানতে চায় সে। সমস্যা বাধল অন্য জায়গায়। অর্ষার ফোন নাম্বার তার কাছে নেই। রেণুর কাছে সকালের নাম্বার ছিল। আহনাফ তাই আগে সকালকে ফোন করে অর্ষার নাম্বার নিয়ে কল করে। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে অর্ষা বলল,
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম’
আহনাফ প্রথমে চুপ করে রইল। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অর্ষার কণ্ঠস্বরের সাথে অনেকগুলো মানুষের হাসির শব্দও ভেসে আসছে। সকালকে ফোন করে শুনেছিল অর্ষা বাসায় নেই। তাই সে ধরে নিয়েছিল অর্ষা তাহলে হাসপাতালে। কিন্তু এখন হাসাহাসি শুনে মনে হচ্ছে সে অন্য কোথাও আছে।
আহনাফ সালামের উত্তর দিয়ে বলল,’ওয়া আলাইকুমুস-সালাম। আমি আহনাফ বলছিলাম।’
অর্ষা বেশ অবাক হয়। বন্ধুদের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। কান থেকে ফোন নামিয়ে নাম্বারটিতে একবার চোখ বুলায়। অবিশ্বাস্যকণ্ঠে বলল,
‘আপনি! বলুন।’
‘আপনি কি এখন ব্যস্ত?’
‘কেন?’
‘যদি ফ্রি থাকেন তাহলে এই বাসায় একবার আসতে হবে।’
অর্ষা অবাক হয়ে বলে,’এই সময়ে? এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’
আহনাফ রাফির ব্যাপারটা খুলে বলল এবার। অগত্যা অর্ষাকে রাজি হতে হয়। আহনাফ ক্ষো’ভ নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে কথা বলছিল। আসতে রাজি হওয়ার পর বলল,
‘আমি ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি কোথায় আছেন বলুন।’
‘আমি একা যেতে পারব।’
‘আছেন কোথায়?’
‘হাসপাতালে।’
‘ঠিক আছে। ড্রাইভার হাসপাতালে পৌঁছে আপনাকে কল করবে।’
এরপর আর কিছু না শুনেই আহনাফ কল কেটে দেয়। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে অর্ষা। অস্ফুটস্বরে বলে,
‘অদ্ভুত!’
.
রাশেদ হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়ে অর্ষার নাম্বারে কল করে। অর্ষা ফোন রিসিভ করে বলে,
‘আসছি।’
হাসপাতালে রাতে আহিলের সাথে আশিক আর দিদার থাকবে। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে অর্ষা, লামিয়া, জুঁই আর রেশমি চলে আসে। বাইরে রাশেদকে দেখে লামিয়া বলে ওঠে,
‘আরে, আরে এটা ঐ ব্যাটা না? ভার্সিটিতে যে দেখেছিলাম?’
রেশমি মুখটিপে হেসে বলে,’হ্যাঁ।’
রাশেদ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফোন চাপছিল। তার ভ্রুঁ এখনও কুঁচকানো।
‘হাই টাকলা।’
রাশেদ ধড়ফড়িয়ে সামনে তাকায়। লামিয়াকে দেখে তার কুঁচকানো ভ্রুঁ আরও কুঁচকে যায়। দাঁত-মুখ খিঁচে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনিই অর্ষা?’
লামিয়া অবাক হয়ে বলে,’না তো! কী ব্যাপার? আমার বান্ধবীর পেছনে লেগেছেন?’
অর্ষা বুঝতে পারে রাশেদকে আহনাফ পাঠিয়েছে। সে তর্ক বেশিদূর চলতে না দিয়ে বাঁধা দিয়ে বলল,
‘আমি অর্ষা।’
এরপর চোখের ইশারায় লামিয়াকে বোঝাল ফাইজলামি না করতে এখন। লামিয়া মেনে নিল। অর্ষাকে বলল,
‘আচ্ছা সাবধানে যা। পৌঁছে ম্যাসেজ করিস।’
ওদের থেকে বিদায় নিয়ে অর্ষা গাড়িতে উঠে বসে। বিরসমুখে গাড়ি ড্রাইভ করছে রাশেদ। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেও বাড়ির কাছাকাছি এসে বলে,
‘আপনার বান্ধবী চরম লেভেলের বে’য়া’দব। আদব-কায়দা কিচ্ছু জানে না।’
অর্ষা প্রতিবাদ করে বলল,’একটু ফাজিল। তবে বে’য়া’দব নয়।’
মেইন গেইটের ভেতর গাড়ি প্রবেশ করেছে তখন। রাশেদ আর কিছু বলল না। অর্ষা নেমে বাড়ির ভেতর চলে যায়। রেণু দরজা খুলে অর্ষাকে দেখে হাসল। এবং কিছুটা অপরাধীর স্বরে বলল,
‘ছেলেটার জন্য আপনাকে কষ্ট করে এই অসময়ে আবার আসতে হইল।’
অর্ষাও হাসিমুখে বলল,’সমস্যা নেই।’
সে চলে গেল সরাসরি রাফির রুমে। বই সামনে নিয়ে বসে ছিল। আজ অর্ষাকে দেখে প্রথম হাসল রাফি। এতে অবশ্য অর্ষা কিছুটা অবাকই হয়েছে। সে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
‘কেমন আছো রাফি?’
‘ভালো আছি ম্যাম।’
‘আজ মনে হচ্ছে তুমি ভীষণ খুশি।’
‘আবদার পূরণ হলে আমার খুশি খুশি লাগে। এইযে আবদার করেছিলাম, আপনার কাছেই পড়ব আর কারও কাছে নয়। তাই তো মামা আপনাকে এনে দিলো।’
অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’আচ্ছা। বই বের করো এখন।’
‘করছি। মামা বলেছে আপনাকে দেখা করতে।’
‘কোথায়?’
‘এখন তার রুমে আছে।’
‘আচ্ছা যাওয়ার সময় দেখা করে যাব।’
‘মামা বলেছে এসেই দেখা করতে।’
হয়তো জরুরী কোনো কথা আছে ভেবেই অর্ষা উঠে দাঁড়ায়। সে রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে বইয়ের নিচে লুকিয়ে রাখা একটা ছোটো বাচ্চা মেয়ের ছবিটা তুলে বিছানার নিচে রেখে দিলো রাফি। পরক্ষণে বড়ো করে দম নেয়। ভাগ্যিস মিথ্যে কথাটা বলতে গিয়ে তোতলায়নি!
আহনাফ নিজের রুমে পায়চারি করছিল। গাড়ির শব্দ শুনে দু’তলার বারান্দায় গিয়ে সে দেখছে অর্ষা বের হচ্ছে গাড়ি থেকে। রাফির বলা কথাটিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সাথে সাথে। সে রোবট কী করে হয়? তাকে রোবটের সঙ্গে তুলনা কেন করবে এই মেয়ে? একটুখানি চুপ করে থেকে ভাবল, তার আচার-আচরণ কি কোনোভাবে রোবটের সঙ্গে মিলে যায়?
সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। একবার স্ট্রেইড সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তো একবার একটু বাঁকা। মুখের ভাবসাব খুব কঠিন। হঠাৎ করে তার দৃষ্টি যায় আয়নায় ভেদ করে দরজার দিকে। বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ষাকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বলে,
‘আপনি?’
ঢোক গিলে অর্ষাও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’আপনি নাকি ডেকেছেন?’
‘আমি? কখন?’ আহনাফ অবাক।
‘রাফি বলল।’
‘আমি তো আপনাকে ডাকিনি। যাই হোক, এসেছেন যখন তখন দুটো কথা বলি।’
অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
‘আমাকে রোবট বলার মানে কী?’
অর্ষা বুঝতে পারে রাফি সব বলে দিয়েছে। নয়তো এ কথা তো আহনাফের জানার কথা নয়। সে ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
‘মানে? এসব কী বলছেন?’
‘আপনি রাফির কাছে বলেননি আমি রোবট?’
‘কই না তো!’ অকপটে মিথ্যাটা বলে ফেলল অর্ষা।
আহনাফ নিশ্চুপ। সম্ভবত কিছু ভাবছে। অর্ষা মুখ টিপে হেসে বলে,
‘তাই বুঝি আয়নার সামনে পরখ করে দেখছিলেন আপনি আদৌ রোবট কিনা?’
আহনাফ কিছু বলতেই যাবে তখনই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়। অর্ষা কিছুটা ভয় পেয়ে গেলে আহনাফ বলে,
‘নড়াচড়া করবেন না।’
সে বেড হাতড়ে ফোন খুঁজতে থাকে। অর্ষার ফোন রাফির রুমে। তাই সে অসহায়ের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ বাদেই ফোনের ফ্লাশ অন করে আহনাফ। অন্ধকার রুমটি এখন মৃদু আলোতে আলোকিত। মিটিমিটি আলোতে আহনাফকে দেখে কেন জানি অর্ষার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। হতবিহ্বলের ন্যায় তাকিয়ে থাকে সে। অর্ষাকে এভাবে তাকাতে দেখে আহনাফ নিজেও কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। চোখাচোখি হওয়ায়তে অর্ষা দ্রুত বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]