#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৬
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
দুরুদুরু কাঁপান্বিত হৃদয়ের হৃদস্পন্দন খুব ভালো করেই টের পাচ্ছে অর্ষা। তার বিচলিত মুখখানায় রক্তিম আভা। রাফি এর পূর্বে অর্ষার এমন অস্বস্তিপূর্ণ মুখ দেখেনি। তার ভয় লাগছে। মামা বকেছে নাকি আবার ম্যামকে? তাহলে তো ম্যামও এখন তাকে বকবে। আর জীবনেও সে লুকিয়ে লুকিয়ে টুম্পার ছবি দেখতে যাবে না। ঢের হয়েছে। মিথ্যে বলার শাস্তি বোধ হয় এবার তাকে পেতেই হবে। তার ছোট্ট মন কতশত কিছুই না ভেবে চলেছে।
সে ভয়ে ভয়ে অর্ষার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অর্ষার হাতে আলতো স্পর্শ করে বলে,
‘মামা কি আপনাকে বকেছে ম্যাম?’
সম্বিৎ ফিরে পায় অর্ষা। একটু নড়েচড়ে বসে বলে,
‘না, বকবে কেন?’
পরক্ষণেই কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
‘তুমি আমায় মিথ্যে কেন বলেছ?’
রাফি হকচকিয়ে গিয়ে বলে,
‘ক…কোন মিথ্যে কথা?’
‘তোমার মামা তো আমায় ডাকেনি বলল।’
‘মিথ্যে বলেছে মামা। ডেকেছিল। বোধ হয় ভুলে গেছে।’
‘সে মিথ্যা বলেছে নাকি তুমি?’
‘আমি মিথ্যা কথা বলি না ম্যাম।’
অর্ষা রাফির ভয়ার্ত মুখটির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে যা বোঝার বুঝে নেয়। কোনো রকম বকাঝকা না করে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
‘আচ্ছা পড়ো এখন।’
স্বস্তি ফিরে পায় রাফি। ও-কে পড়িয়ে আর কোনোদিক না তাকিয়েই তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় অর্ষা। এতটা অস্বস্তি যে তার কেন লাগছে কে জানে। সে একটু এগিয়ে গিয়ে রিকশা নিয়ে নেয়।
______________
চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে রুহুল আর ওর বন্ধুরা। হাতে সিগারেট। এই পর্যন্ত কতগুলো সিগারেট যে শেষ করেছে তার কোনো হিসাব নেই। এক সময় রুহুল সিগারেটের গন্ধও সহ্য করতে পারত না। আর আজ তার নিত্যসঙ্গীই হচ্ছে এই সিগারেট। জীবনের একটা অতীত তাকে অনেক তাড়া করিয়ে বেরিয়েছে এক সময়। কতবার ইচ্ছে হয়েছে নিরুদ্দেশ হতে। কিন্তু অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই সাহস তার কোনোদিনও হয়নি। বরঞ্চ তার ভয় হতো সর্বদা। তার অনুপস্থিতিতে তার বোনের যদি কোনো ক্ষতি হয় কখনো? এটা তো সে জীবন থাকতেও মেনে নিতে পারবে না। আর যখন সে নিরুদ্দেশের পথে যেতে পারল না তখন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেটকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিল। খুব ছোটোবেলা থেকেই সিগারেট তার প্রিয়তমা এবং ভালোবাসার স্থান দখল করে রেখেছে।
সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটুকু মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে শামসু জিজ্ঞেস করল,
‘বিদেশ যাওয়ার ট্যাকা দিছে তোর বাপে?’
রুহুল সিগারেটে দম না নিয়ে টান দিয়ে বলল,
‘না।’
‘দিবো না?’
‘মনে হয় না। বাড়ি সে বেঁচব না।’
‘তোর ভাগেরটা তুই নিলেই তো পারস।’
‘চাইছিলাম। দিবো না।’
‘জোয়ান মর্দ পোলা তুই। জোর খাটাইতে পারস না?’
‘পারি। কিন্তু মায়া লাগে। তার ওপর আবার অর্ষা!’
‘এত বইন বইন করস যে, বইন থাকব কয়দিন? বিয়া দিলেই দেখবি পরের বাইত্তে যাইয়া তোরে ভুইলা গেছে।’
শামসুর সাথে তাল মিলিয়ে দিপু বলে,
‘ভুইলা যাইব কী রে? এহনই তো ওর বইন ওরে দেখতে পারে না।’
রুহুল কিছু বলল না। সে চুপ করে সিগারেট টানছে। এই দোকানের সামনে দিয়েই তখন অর্ষার রিকশাটি ক্রস করে যায়। একবার দুই ভাই-বোনের মধ্যে চোখাচোখিও হয়ে যায়। রাগে, ঘৃণায় দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অর্ষা। কারণ সে শতবারেরও ঊর্ধ্বে রুহুলকে বারণ করেছিল এসব ছেলেদের সঙ্গে না মিশতে। রুহুল অবশ্য অর্ষাকে দেখামাত্রই সিগারেট ফেলে দিয়েছিল, তবে অর্ষা এর পূর্বেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে।
জামিল তখন বলে,’ঐডা রুহুলের বইন গেল না?’
দিপু তাচ্ছল্যি করে হেসে বলে,
‘হ। কইছিলাম না বইনে দেখতে পারে না? দেখলি কেমনে মুখ ঘুরাইয়া চইলা গেল।’
রুহুলের মেজাজ এবার চটে যায়। সে রুক্ষকণ্ঠে বলে,
‘আমার বইন আমার লগে যা খুশি করুক। তগো কী? তগো এত মাথা ব্যথা ক্যান? ওরে নিয়া খবরদার কইলাম কোনো কথা কইবি না।’
শামসু পাশে বসে রুহুলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
‘আহা রাগ করস ক্যান? আমরা কি খারাপ কিছু কইছি? তোর বইন তো আমগোরও বইন। ওয় যে তোর লগে ঠিকমতো কথা হয় না এইডা তো আমগোরও খারাপ লাগে।’
দিপুও তাল মিলিয়ে বলে,’আচ্ছা দোস্ত বাদ দে। রাগ করিস না। চল যাই আজ এক জায়গায়।’
রুহুলের মেজাজ এখনও ভালো হয়নি। জামিল রুহুলকে জোর করে ধরে উঠিয়ে বলল,
‘হ, চল। মজা হইব, মাস্তি হইব। তোর রাগও দেখবি পানির মতো গইলা গেছে।’
রুহুল এবার জানতে চায়,’কোথায়?’
শামসু শিস বাজিয়ে কানে কানে বলে,
‘পাড়ায়।’
রুহুল দ্বিমত দেখিয়ে বলে,’না। তোরা যা। আমি ঐ জায়গায় যামু না।’
‘আরে ব্যাটা যাবি না মানে? এই সপ্তাহে দুইটা নতুন মাইয়া আনছে। একদম পরীর মতো দেখতে। কী যে সুন্দরী মা’ল! ব্যাটা মিস করিস না। তুই তো জীবনে যাস নাই। আজ চল যাই।’ রুহুলের কাঁধে হাত রেখে বলল শামসু।
রুহুল তবুও গড়িমসি করে না যাওয়ার জন্য। পরবর্তীতে বন্ধুদের জোরাজুরিতে একটা সিএনজি নিয়ে চারজনে রওনা দেয় নিষিদ্ধ পল্লীতে।
.
.
অর্ষা বাড়িতে পৌঁছে দেখে সকাল বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে। সে পার্স টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করে,
‘শুয়ে আছিস কেন? পড়া নাই?’
সকাল ক্লান্তস্বরে বলে,’মাত্রই শুলাম। স্টুডেন্টস পড়ালাম এতক্ষণ। একটু রেস্ট নিয়ে পড়তে বসব।’
‘মুন কোথায়?’
‘আপু তো আমি আসার পর বের হয়েছে। এখনও আসেনি।’
অর্ষা আর কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে যায়। সেলিনা বেগম দু’মেয়েকে চা দিয়ে গেছেন। অর্ষা ওয়াশরুম থেকে ফিরে চা দেখে খুশি হয়। সে চায়ের কাপটি নিয়ে বিছানায় বসে। ফেসবুকে গিয়ে দেখে আহিল, আশিক, দিদার, রেশমি, লামিয়া, জুঁই এবং তাকে নিয়ে আলাদা একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খোলা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ধুমধাড়াক্কা গ্রুপ।’
এমন উদ্ভট নাম দেখে অর্ষা বেশ অবাকই হয়। সে ম্যাসেজ লিখে,
‘এটা আবার কেমন নাম?’
আশিক একটিভ-ই ছিল। সে রিপ্লাই করে,’তোমরা চলে যাওয়ার পর দিদারের সাথে আমার ফা’ই’ট হয়েছে। দুজনই দুজনকে ধুমধাড়াক্কা মে’রে’ছি। গ্রুপ খুলতে গিয়ে কোনো নাম মনে আসেনি তাই এটাই নাম দিয়ে দিয়েছি। তবে এটা এখনও কনফার্ম নয়। পরবর্তীতে পাল্টানো হবে।’
বাকিরা সবাই ওর ম্যাসেজে হাহা রিয়াক্ট দেয়। আহিলের বর্তমান কন্ডিশন জানতে চাইলে আশিক এবং দিদার জানায় আগের চেয়ে ভালো। আগামীকাল ওদের ক্লাস ছিল। যেহেতু আহিল যেতে পারবে না, তাই ওরাও কেউ যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি আহিল মোটামুটি সুস্থ হয়ে ভার্সিটিতে না যাওয়া অব্দি কেউ যাবে না। আহিল অনেক বোঝালেও ওদের কাউকে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যায়নি। তাই তাদের দেখা হতো আশিকের বাসায়। প্রতিদিন অবশ্য যাওয়া হতো না। বেশিরভাগ সময় ভিডিয়ো কলেই কথা হতো। তিনদিন কাটে এভাবেই।আগামীকাল বৃহস্পতিবার। তাই বাকিরা বলে একদম শনিবার থেকেই আবার ক্লাসে যাবে।
.
মুন আর আদিব গত পরশু বিয়ে করেছে। তাই ওদের নতুন ফ্ল্যাট দেখানোর জন্য অর্ষা আর সকালকে নিয়ে এসেছে।
চা-নাস্তা এনে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল মুন। ওর পরনে গাঢ় খয়েরী রঙের সুতী শাড়ি। ব্লাউজও খয়েরী রঙের। চুলগুলো হাতখোপা করা। দেখতে একদম নতুন বউদের মতোই লাগছে। নাকে নাক ফুল পরার দরুণ মুনের সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেছে।
মুন সকালকে বলল,’নাও চা মিষ্টি খাও।’
সকাল একটা মিষ্টি তুলে খাওয়া শুরু করে। অর্ষা চায়ের কাপ তুলে নিল। মুন হাসিমুখে অর্ষাকে জিজ্ঞেস করে,
‘আমাদের নতুন সংসার কেমন লাগছে?’
অর্ষাও মুচকি হেসে বলল,’ভালো।’
মুনের হাসি হাসি মুখটা অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। দুঃখী দুঃখী গলায় বলে,
‘আমার অনেক দায়িত্ব পড়ে আছে বুঝলি।’
‘কী দায়িত্ব?’ জানতে চাইল অর্ষা।
‘বাবা-মাকে না জানিয়ে বিয়ে করলাম। মাকে অবশ্য সকালে ফোন করেছিলাম। রাগ করেনি তবে কেঁদেছে খুব। আব্বু তো প্রচুর রেগে আছে। এরমধ্যে তুইও এখনও আমার ওপর রেগে আছিস জানি। শুধুমাত্র আদিবের অনুরোধেই যে তুই এই বাসায় এসেছিস আজ সেটাও আমি জানি। অন্যদিকে আদিবের বাবা-মা’ও আমাদের বিয়েটা মেনে নেয়নি। ভীষণ রেগে আছে। এখন তোদের প্রত্যেকের রাগ ভাঙাতে গিয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিতে হবে।’
শেষের কথাটি শুনে অর্ষার মুখ দিয়ে চা বেরিয়ে যায়। সকাল তড়িঘড়ি করে অর্ষার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। কোনো রকম নিজেকে সামলে নিল অর্ষা। মুন তখনও দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে আছে।
জামা থেকে চা ঝাড়তে ঝাড়তে অর্ষা বলে,’আল্লাহর দোহাই লাগে, তোর রাগ ভাঙানোর এমন উদ্ভট চিন্তার জন্য আমাদের দায়ী করিস না।’
মুন হেসে ফেলে। পিরিচ থেকে একটা বিস্কুট নিয়ে খেতে খেতে বলে,
‘আচ্ছা বাদ দে এখন এই টপিক। তুই আমার বিয়েতে লম্বু ভাইয়াটাকে আনলি না কেন?’
অর্ষা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে যে মুন আহনাফের কথা বলছিল। অথচ মুন তো জানেই না, কতগুলো দিন ধরে অর্ষা আহনাফের থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার বিষয়টা এমনও নয় যে আহনাফ তার সাথে কথা বলার জন্য ম’রে যাচ্ছিল। বরং সে তার মতোই নির্বাক থাকত। কখনও কখনও দেখা হয়ে যেত এই পর্যন্তই। অর্ষা তখন মাথা নত করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।
সে মুনের ওপর রাগ দেখিয়ে বলল,’আশ্চর্য! সে কেন আসবে তোর বিয়েতে?’
‘কেন আসবে মানে? আসা উচিত ছিল। উকিল বাপ তো আর বানাতাম না সত্যি সত্যি। অন্তত সাক্ষী হিসেবে তো থাকতে পারত। কেননা তোর অবিবাহিত হাজবেন্ড বলে কথা!’ কথা শেষ করে মুখটিপে হাসল মুন।
অর্ষা দাঁত-মুখ খিঁচে বলল,’তোর কথাবার্তা শুনলে মেজাজ চটে যায়। না সে আমার কেউ হয়; আর না তোর কেউ হয়। সূতরাং তোর বিয়েতে সে আসবে এটা কল্পনারও বাইরে।’
সকাল অসহায়ের মতো করে বলে,’তোমরা কী বলছ? কার কথা বলছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
মুন চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলে,’সে কি! এখনও নিজের অবিবাহিত দুলাভাইয়ের কথাই জানো না?’
অর্ষা চোখ পাকিয়ে তীব্র স্বরে বলল,’মুন!’
মুন ধমক শুনে মোটেও দমে গেল না। সে রসিয়ে রসিয়ে সেদিনের ঘটনাটি সকালকে বলল। মুনের সঙ্গে সঙ্গে এবার সকালও হাসিতে যোগ দেয়।
অর্ষা ওদের থামিয়ে বলে,’থামবি তোরা? বেশি বেশি হচ্ছে এবার।’
‘কী বলিস? আমার তো মনে হয় কম কম বললাম।’ বলল মুন।
‘শোন তোর এত নাচানাচি করা লাগবে না। রাফির পরীক্ষা শেষ। এই মাস গেলে আমি আর ও-কে পড়াতে যাব না।’
‘কেন? আমার কথায় রাগ করে? আহারে! বেচারা অবিবাহিত দুলাভাইর তাহলে কী হবে?’
অর্ষা রাগে কুশন ছুঁড়ে মারে মুনের দিকে। মুন আর সকাল ওর রাগ দেখে হেসে ফেলে। রাতে আদিব বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরলে চারজন একসাথে ডিনার করে। একটুখানি রেস্ট নিয়ে অর্ষা সকালকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে।
ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেবে তখন সেলিনা বেগম এসে বলে গেল ওমর রহমান ডাকছে। গায়ে ওড়না জড়িয়ে অর্ষা বাবা-মায়ের রুমে যায়। রুহুলের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে সিটকিনি দেওয়া। আজকাল প্রায় রাতেই রুহুল বাড়িতে ফিরে না।
‘আমাকে ডেকেছ বাবা?’ রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
ওমর রহমান আধশোয়া হয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন। অর্ষাকে দেখে বইটা বন্ধ করে বসে বললেন,
‘হ্যাঁ, মা। বোস।’
অর্ষা বাবার শিয়রে বসল। সেলিনা বেগম চেয়ারে বসে হাত পাখা সেলাই করছেন।
ওমর রহমান বললেন,’মুনের বাড়ি কেমন দেখলি?’
‘ভালো। ওর হাজবেন্ডও বেশ ভালো।’
‘একা একা মেয়েটা বিয়ে করল! ওর বাবা আমায় ফোন করেছিল। বলল আমি যেন দেখে,শুনে রাখি ‘
অর্ষা অবাক হয়ে বলল,’তাই? কিন্তু আঙ্কেল তো মুনের সাথে কথা বলে না। ফোনও রিসিভ করে না।’
ওমর রহমান মৃদু হেসে বললেন,’বাবা-মা এমনই হয় রে মা। ওপরে ওপরে যতই রাগ দেখাক না কেন ভেতরটা ঠিকই সন্তানের জন্য পুড়ে। কিন্তু বুঝতে দেয় না।’
অর্ষা বাবার কথায় সম্মতিপূর্বক হাসল। তিনি বললেন,
‘আমরা যেতে পারিনি বলে মুন কিছু বলেছে?’
‘রাগ করেছে খুব। সামনের শুক্রবার যেতেই হবে বলেছে। নয়তো এসে তুলে নিয়ে যাবে।’
তিনি হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’তোর ভার্সিটির বন্ধুর কী খবর? কেমন আছে এখন?’
‘ভালো আছে বাবা। শনিবার থেকে আমরা আবার ক্লাসে যাব।’
তিনি এবার একটু ইতস্তত করে বললেন,’চাকরি নিলে পড়বি কীভাবে রে মা?’
‘তখন তো ক্লাস করা সম্ভব হবে না। ওদের থেকে নোটস নিয়ে পড়ব। তুমি অত ভেবো না তো।’
‘তোর শফিকের কথা মনে আছে?’
‘তোমার বন্ধুর কথা বলছ? আগে যে আসত আমাদের বাসায়?’
‘হ্যাঁ। আজ বিকালে চায়ের দোকানে দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় তোর কথা জিজ্ঞেস করল। বিয়ে দিয়েছি কিনা। বললাম যে, এখন চাকরি করবি। বিয়ে করবি না। তখন বলল ওর ছেলে চাকরি করে। ওদের কোম্পানীতে নাকি লোক নিচ্ছে। তুই যদি চাকরি নিস তাহলে কাল যেতে বলেছে।’
‘সমস্যা নেই। যাব। যত তাড়াতাড়ি চাকরিটা হয় ততই ভালো। কিন্তু যোগাযোগ করব কীভাবে?’
তিনি তার ফোন থেকে একটা নাম্বার বের করে দিয়ে বললেন,’এইযে এটা ওর ছেলের নাম্বার।’
অর্ষা নাম্বারটি নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ফোন করে অফিসের ঠিকানা জেনে নিয়ে কাগজপত্রগুলি গুছিয়ে রাখে। সকাল বিছানা করে শুয়ে পড়েছিল। অর্ষাও লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।
প্রতিদিনের মতো ফজরের সময়েই ঘুম থেকে ওঠে দু’বোন। নিয়মতমাফিক সকল কাজ শেষ করে তৈরি হয়ে নেয়। শফিক আঙ্কেলের ছেলে শামীমের দেওয়া ঠিকানায় চলে যায় অর্ষা। পথে সে অনেকবার দোয়া দরুদ পড়ে যেন চাকরিটা তার হয়ে যায়।
অফিসের সামনে গিয়ে সে শামীমের নাম্বারে কল করে। শামীম অফিস থেকে বেরিয়ে এসে অর্ষাকে ভেতরে নিয়ে যায়। ওর কাগজপত্রে রেজাল্ট দেখে বেশ প্রসংশাও করে। ইন্টার্ভিউ রুম অব্দি এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এখানেই অপেক্ষা করুন। ইন্টার্ভিউ এর জন্য ডাকবে। নার্ভাস হওয়ার কোনো কারণ নেই। রিল্যাক্স থাকবেন। যা প্রশ্ন করে উত্তর দেবেন।’
অর্ষা স্মিত হাসল। যতই কেউ বারণ করুক না কেন, নার্ভাস না হয়ে উপায় নেই। স্কুলে থাকতে যতবার সে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছে ততবার নার্ভাসের জন্য তার হাত-পা কেঁপেছে। আজ যে কী হয় কে জানে!
শামীম চলে যাওয়ার পূর্বে বলল,’আমি অফিসেই আছি। ইন্টার্ভিউ শেষ হলে আমায় ফোন দিয়েন। অল দ্য বেস্ট।’
অর্ষা এবারও স্মিত হেসে বলল,’থ্যাঙ্কিউ।’
শামীম চলে যাওয়ার পর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল অর্ষা। এখনও সে দোয়া দরুদ পড়েই চলেছে। একটুপর ইন্টার্ভিউ নেওয়া শুরু হয়। তার সিরিয়াল নং ৭। একজন একজন করে ইন্টার্ভিউ রুমে যাচ্ছে আর তার বুক ধড়ফড় করা বাড়ছে। এখন যে ইন্টার্ভিউ দিতে গেল তার সিরিয়াল নং ৬। এরপরই তার সিরিয়াল। হৃদস্পন্দন কমার বদলে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
ওর সিরিয়াল এখন। সে বাইরে থেকে নিজেকে শান্ত ও স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করল। দরজায় নক করে বলল,
‘আসব?’
ভেতর থেকে একজন মহিলা বলল,
‘আসুন।’
অর্ষা ভেতরে ঢুকল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিয়ে হঠাৎ করেই থমকে গেল শেষের জনকে দেখে। আহনাফ! সে এখানে কেন? তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে সেই মহিলাই তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘বসুন।’
অর্ষা রোবটের মতো বসে পড়ল। তার দৃষ্টি তখনও কর্ণারে বসা স্যুট-টাই পরা আহনাফের দিকে। দৃষ্টি সরানো মুশকিল। আজ আর তার ইন্টার্ভিউ দেওয়া হচ্ছে! সে বারবার স্বগতোক্তি করে বলছে,
‘বড়ো রোবটটা এই অফিসে কী করছে!’
মাঝখানে বসা স্যার অর্ষার থেকে ফাইলগুলো নিতে নিতে বলল,
‘আপনার নাম?’
আহনাফের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অর্ষা কোনোরকম ভাবে বলল,
‘অর্ষা!’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]