#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
৩০.
বনের ভেতর ঢুকার পর মুগ্ধ দৃষ্টিতে ডানে বাঁয়ে তাকাতে লাগল সিদ্রা। সুবহানআল্লাহ! কি বড় বড় গাছ, পানির মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই গাছগুলোর মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ছে নিচের পানিতে, আলোছায়ার খেলা চলছে যেন। পরিবেশটাকে আরো একটু বেশি উপভোগ্য করতেই যেন হালকা গলায় গান ধরল রাইয়্যান, ওর সুরেলা কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।
“জিসে জিন্দেগী ধুঁড় রাহি হ্যায়, কেয়া ইয়ে য়ো মাক্বাম মেরা হ্যায়
ইয়াহা চ্যায়ান সে বাস রুক যাউঁ, কিউঁ দিল ইয়ে মুঝে কেহতা হ্যায়
যাজবাত নায়ে সে মিলে হ্যায়, যানে কেয়া আসার ইয়ে হুয়া হ্যায়
এক আস মিলি ফির মুঝকো, জো কুবুল কিসি নে কিয়া হ্যায়
হাঁ………
কিসি শায়ের কি গাজাল, যো দে রুহ কো সুকুঁ কে পাল
কোয়ি মুঝকো য়্যুঁ মিলা হ্যায়, য্যায়সে বানজারে কো ঘার
হুম…….
য্যায়সে কোই কিনারা, দেতা হো সাহারা, মুঝে য়ো মিলা কিসি মোড় পার
কোয়ি রাত কা তারা, কারতা হো উজালা, ওয়্যাসে হি রশন কারে য়ো শেহের
দারদ মেরা য়ো ভুলা হি গায়া, কুছ এ্যাসা আসার হুয়া
জীনা মুঝে ফিরসে য়ো সিখা রাহা
হুম……
য্যায়সে বারিশ কার দে তার, ইয়া মারহাম দারদ পার
কোই মুঝকো য়্যুঁ মিলা হ্যায়, য্যায়সে বানজারে কো ঘার
মুসকাতা ইয়ে চেহরা, দেতা হে যো পেহরা, যানে ছুপাতা কেয়া দিল কা সামান্দার
অউরো কো তো হার দাম সায়া দেতা হ্যায়, য়ো ধুপ মে হ্যায় খাড়া খুদ মাগার
চোট লাগি হ্যায় উসে ফির কিয়্যুঁ মেহসুস মুঝে হো রাহা
দিল তু বাতা দে কেয়া হ্যায় ইরাদা তেরা
মে পারিন্দা বেসাবার, থা উড়া জো দারবাদার
কোয়ি মুঝকো য়্যুঁ মিলা হ্যায়, য্যায়সে বানজারে কো ঘার…..”
প্রথমে আস্তে আস্তে শুরু করলেও পরে গলা ছেড়ে দিয়েছিল রাইয়্যান। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল সিদ্রা। এত সুন্দর গলা উনার, মা শা আল্লাহ্! একদম অন্তরে গিয়ে ধাক্কা মারছে যেন। লোকটা যে বেশ বড়সড় মাপের বিজনেসম্যান সেতো বোঝাই যায়, সেই উনি কিনা নৌকা বাইছে, গান গাইছে, আরো না জানি কত কি পারে! একটা মানুষের মধ্যে এত প্রতিভা থাকে!! গান শুনতে শুনতে এসবই ভাবছিল সিদ্রা। তাই গান শেষ হয়ে গেলেও তন্ময়তা ভাঙলোনা ওর। নিশ্চুপ বসে রইলো, যেন নড়লেই রেশটা কেটে যাবে।
রাইয়্যান সারাটাক্ষণ সিদ্রার দিকে তাকিয়ে ছিল। অন্তরে তো ধাক্কা মারবেই, কারণ গানের প্রতিটা শব্দ যে ওরই মনের কথা ব্যক্ত করছে! সিদ্রা ওর দিকে তাকায়নি বলে লক্ষ্য করেনি ব্যাপারটা। কিন্তু রাইয়্যান ওর চোখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছিলো যে ওর ভাল লাগছে। হঠাৎ নৌকাটা জোরে দুলে উঠতেই সিদ্রা এমনভাবে নড়ে উঠলো যেন কেউ ওর ঘুম ভাঙাল।
একটা গাছের সাথে নৌকা লাগিয়েছে রাইয়্যান। সেই গাছে উঠতে বলল ও সিদ্রাকে। প্রথমে না না করলেও পরে মজা পেয়ে গেল সিদ্রা। বাচ্চা মেয়ের মত খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো, “কি মজা, আমি গাছে উঠেছি”। গাছটা বেশ বড়, মোটা মোটা শাখা প্রশাখা ছড়ানো। উঠার পরে ও নিজেই ওগুলো ধরে ধরে এগুতে লাগলো উপরের দিকে।
রাইয়্যান ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। খেতে খেতে দেখল, সিদ্রা তৃষ্ণার্ত নয়নে ওর পানি খাওয়া দেখছে। নিজের খাওয়া শেষে বোতলটা সিদ্রার দিকে এগিয়ে দিলো ও।
খানিক পরে আবার চলতে শুরু করলো ওরা। মাঝেমাঝেই অন্যান্য নৌকা পাশ কাটাচ্ছে ওদের। কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ আবার গান গাইছে। একটা কাপলকে দেখা গেল গাছের ওপর উঠে নানা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে সেলফি তুলছে, দেখে হাসি পেলো সিদ্রার। কিন্তু ওদের চোখেমুখে যে সুখ আর পরিতৃপ্তির হাসি লেগে আছে, তা দেখে বুকের ভেতরটা চিনিচিন করে উঠলো ওর। কত স্বপ্ন ছিল বিয়ে নিয়ে, বিয়ের পর ঘুরতে যাওয়া নিয়ে, সেসব হয়তো আর পূরণ হবে না। আজ এই লোকের যায়গায় যদি ওর সত্যিকারের হাজবেন্ড থাকতো, ভ্রমণটা কত আনন্দেরই না হতো! দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা।
কিছুদূর যাওয়ার পর যেন হঠাৎ করে বন থেকে একটা ফাঁকা যায়গায় বেরিয়ে এলো নৌকা। সেই ফাঁকা যায়গার মাঝে একটা ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারের আশেপাশে অনেকগুলো নৌকা আর প্রচুর মানুষ ওয়াচ টাওয়ারে উঠেছে। এত মানুষ দেখে সিদ্রার আগেই বিরক্তি লেগে গেল, “আমি কিন্তু ওইটার উপরে উঠবোনা”
“কেন? বনের সবথেকে সুন্দর ভিউ তো ওপর থেকেই পাওয়া যায়” অবাক হল রাইয়্যান।
“কিন্তু এত মানুষ…..”
“নো টেনশন। ভীড় বেশিক্ষণ থাকবেনা, কেউ তো আর এখানে থাকতে আসেনি, আমরা বরং অপেক্ষা করি” এই বলে রাইয়্যান আস্তে আস্তে ওয়াচ টাওয়ারের চারিধার দিয়ে কয়েকবার চক্কর লাগাল। আসলেই, দশ মিনিটের মধ্যেই দুইটা বাদে বাকি সবগুলো নৌকা চলে গেল। সিদ্রা বলল, “এখন যাওয়া যেতে পারে”
উপরে উঠে মনে মনে স্বীকার করল ও, না আসলে বিশাল মিস করতো। পুরো বনটাই উপর থেকে দেখা যাচ্ছে, অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে। নিচে একরকম সুন্দর লাগছিলো আর এখন আরেক রকম, অনেকটা পাহাড় চূড়ায় উঠে নিচে তাকানোর মত ব্যাপার, বিশ্বাস হচ্ছেনা একটু আগে ওই সুন্দর জায়গার ভেতর দিয়েই এসেছে, পুরো অন্যরকম একটা অনুভূতি।
ওয়াচ টাওয়ার দেখা শেষে আবার বনের মধ্যে ঢুকল ওরা। সিদ্রার খুব মায়া লাগছিল রাইয়্যানের জন্য, লোকটা এতক্ষণ ধরে নৌকা বাইছে, হাত টাত তো ব্যাথা হয়ে যাওয়ার কথা। হঠাৎ রাইয়্যান ব্যাগ খুলে একটা চিপস এর প্যাকেট ছুড়ে দিলো সিদ্রার দিকে।
“চলবে তো?” ভ্রু নাচাল রাইয়্যান।
“হুঁ, আপনি খাবেননা?” চিপস এর প্যাকেট খুলতে খুলতে জানতে চাইলো সিদ্রা।
“না, আমার এতো পছন্দ না, তোমাদের বয়সের ছেলেমেয়েরা বেশি পছন্দ করে এসব। ফারহান তো চিপস বলতে ক্রেজি ছিল। ঘুরতে গেলে ওর পুরো ব্যাগ ভর্তি শুধু চিপসই থাকতো”
আবার! আবার উনি ফারহানের নাম এতো ক্যাজুয়ালি নিচ্ছেন!! আমার তো আবার একটু একটু ভয় করছে, সত্যি উনি আমাকে এখানে ডুবিয়ে মারতে আনেননি তো!?
কিন্তু একটু পরেই রাইয়্যান আবার গুনগুনিয়ে উঠলে সিদ্রার সব দুশ্চিন্তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সব চিন্তা বাদ দিয়ে চিপস খেতে খেতে গান আর প্রকৃতির দিকে মনোনিবেশ করলো ও। এবার রাইয়্যান গাইলো,
“তুম মেরে হো, ইস পাল মেরে হো
কাল শায়েদ ইয়ে আলাম না রাহে
কুছ এ্যয়সা হো তুম তুম না রাহো
কুছ এ্যয়সা হো হাম হাম না রাহে
ইয়ে রাস্তে আলাগ হো যায়ে
চালতে চালতে হাম খো যায়ে……
মে ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা
ইস চাহাত মে মার যাউঙ্গা…….” হঠাৎ থেমে গিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল রাইয়্যান, আবার গাইলো,
“মে ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা
ইস চাহাত মে হি জিলুঙ্গা…..”
বেদনাময় একটা হাসি ফুটে উঠলো রাইয়্যানের ঠোঁটের কোণে, লক্ষ্য করল সিদ্রা। উনি মনে হয় গানটা ভুল গেয়েছিলেন, কিন্তু এতে কষ্ট পাওয়ার কি হল? এরপর বাকি গানটা গেয়ে গেল রাইয়্যান আর সিদ্রা আগের মতই তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলো।
“এ্যায়সে জারুরী হো মুঝকো তুম, য্যায়সে হাওয়ায়ে সাঁসোকো
এ্যায়সে তালাশুঁ মে তুমকো, য্যায়সে কি প্যায়র জামিনোকো…..
হাসনা…. ইয়া রোনা হো মুঝে, পাগাল সা ধুঁড়ুঁ মে তুমহে
কাল মুঝসে মুহাব্বাত হো না হো, কাল মুঝকো ইজাজাত হো না হো
টুটে দিল কে টুকরে লেকার তেরে দার পার হি রেহ জাউঙ্গা……”
এ পর্যায়ে লোকটার গলা সামান্য কেঁপে গেল মনে হল সিদ্রার, সাথে সাথে তাকাল ও রাইয়্যানের দিকে। আরে, লোকটার চোখের কোণে পানি মনে হচ্ছেনা, চোখদুটোও লাল হয়ে গেছে। উনি হঠাৎ এত ইমোশনাল হয়ে গেলেন কেন?
রাইয়্যান তখনো গেয়ে যাচ্ছে,
“মে ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা, ইস চাহাত মে হি জিলুঙ্গা…….”
এরপর আর পুরোপুরি দৃশ্যের দিকে মনযোগ দিতে পারলোনা সিদ্রা, একটু পর পর রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে ওর অভিব্যক্তি খেয়াল করতে লাগলো। ফাইনালি,
“লেকিন যাব ইয়াদ কারোগে তুম, মে বানকে হাওয়া আজাউঙ্গা……” বলার সময় রাইয়্যানের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখল সিদ্রা, খুশি হল ও। আনমনা হয়ে পানিতে হাত দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাইয়্যান গান থামিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“সাবধান! জোঁক আছে কিন্তু!!”
“জোঁক!” সিদ্রা ভয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, আর সাথে সাথে নৌকা ভয়ানকভাবে দুলে উঠলো। তড়িৎ গতিতে রাইয়্যান দুহাত দুপাশে দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে কোনমতে উলটে যাওয়া থেকে বাঁচালো। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে গেল সিদ্রা, রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্যরি, আমি সাপ-জোঁক এসব অনেক ভয় পাই, তাই খুব চমকে গিয়েছিলাম”
“এতে স্যরি বলার কি আছে। প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু ভয় পায়”
“নৌকা উলটে গেলে তো বিপদ হয়ে যেতো!” ভীত কন্ঠে বলল সিদ্রা।
“কি আর হতো, আমি কি সাঁতার জানিনা! দুজনে ঠিক একটা গাছে উঠে পড়তাম, কত নৌকা যাচ্ছে দেখছোনা, কোন একটা আমাদের উঠিয়ে নিতো, সিম্পল!” হাসল রাইয়্যান।
লোকটা আগে আমার কাজকর্মে এত বিরক্ত হতো, কিন্তু ইদানীং প্রায় কিছুই বলছেনা। আজকে আরেকটু হলে কতবড় ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলতাম, অথচ না বকে উল্টে আমাকেই সান্ত্বনা দিচ্ছে!
এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে অনেকক্ষণ। রাইয়্যান তো এতক্ষণ নৌকা বেয়েছে, তার আগে আবার এতটা পথ ড্রাইভ করে এসেছে, ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করে উঠলো ওর। সিদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইঁদুর কি শুধু আমার পেটেই ডাকছে নাকি আর কারো পেটেও ডাকছে?”
সিদ্রা তখনো ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি, কোন উত্তর দিলো না।
“যদি ডেকে থাকে, তাহলে মাঝে আসো, সাবধানে” বলে নৌকা আবার একটা গাছের নিচে ভেড়াল রাইয়্যান। তারপর ব্যাগ খুলে একটা টিফিন ক্যারিয়ার বের করে খাবার সাজাতে লাগল ও।
সিদ্রাও ততক্ষণে মাঝে চলে এসেছে, টিফিন ক্যারিয়ারের ঢাকনা খুলতেই খিচুড়ির সুস্বাদু গন্ধে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ঠিকঠাক হয়ে বসার পর রাইয়্যান ওর হাতে টিফিন ক্যারিয়ারের একটা বাটি আর একটা চামচ ধরিয়ে দিল। বাটির দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার পালা সিদ্রার।
“ওয়াও! খিঁচুড়ি, গরুর গোস্ত ভুনা, ডিম ভাজি!! এতকিছু কিভাবে?”
“খালাকে কালকে রাতে বলে দিয়েছিলাম”
“ইশ! খালা রাতেরবেলা একা একা কত কষ্ট করেছে, আমাকে বলেননি কেন?” মন খারাপ হল সিদ্রার।
“বললে তো আর সারপ্রাইজ হতোনা! আর খালা একটু খেটেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা না করলে এই যে গাছের ছায়ায় নৌকার ওপর বসে এত সুন্দর একটা লাঞ্চ করার এক্সপেরিয়েন্স হত কি?”
“হুম, তা অবশ্য ঠিক” খাওয়া শুরু করলো সিদ্রা। এই লোক ওকে সারপ্রাইজ দিচ্ছে, এও সম্ভব!
খিদে ভালই পেয়েছিল, গপগপ করে খেয়ে যাচ্ছিল সিদ্রা। আর রাইয়্যান, খাওয়ার থেকে বেশি মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলো সিদ্রার দিকে। খাওয়া শেষে রাইয়্যান বলল,
“আমরা এখানে একটু রেস্ট নিয়ে তারপর আবার যাত্রা শুরু করবো, কেমন?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সিদ্রা, একটু পরে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা আমরা এখান থেকে ফিরবো কখন?”
“এইতো, এবার আমরা ফিরতি পথে রওনা দিবো, কেন?”
“যোহরের নামাজটা পড়তে হবে……”
“ও আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, ওয়েট” বলে আবার বৈঠাটা হাতে তুলে নিলো রাইয়্যান। সামনে আরেকটু এগিয়ে পাশাপাশি দুটো গাছের মাঝে নৌকা ঢুকিয়ে দিলো ও। তারপর সিদ্রাকে বুঝিয়ে দিলো,
“গাছদুটোর মাঝ বরাবর বসে পড়ো, ওইদিক পশ্চিম, উল্টোদিক দেখাল রাইয়্যান”
তারপর সিদ্রা কিছু বলার আগেই নিজে থেকেই উঠে সিদ্রাকে পেছন করে বসে পড়লো আর ব্যাগ থেকে একটা ছোট টাওয়েল বের করে এগিয়ে দিলো ওর দিকে। খুশি হল সিদ্রা, আর নামাজ পড়তে বসে সেই খুশি বেড়ে গেলো বহুগুণে।
রাইয়্যানের দেখিয়ে দেয়া দিকে মুখ করে বসে ইশারায় নামাজ পড়ে ফেললো সিদ্রা। নামাজ শেষে মুখ ঘুরিয়ে রাইয়্যানের দিকে তাকাল ও। এখনো একইভাবে বসে আছে লোকটা, মোবাইলে কিছু একটা করছে। লোকটার প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠছে ওর। নামাজ পড়তে গিয়েই বুঝেছে, লোকটা কেন এমন জায়গায় নৌকাটা রেখেছে। অন্য নৌকাগুলো যেদিক দিয়েই যাক, দুইপাশে গাছ আর পেছনে লোকটা বসে থাকার কারণে ও আড়ালে থাকবে। সামনের দিকটাও এমন, নৌকা যাওয়ার উপায় নেই, নেকাব খুলে নামাজ পড়লো ও, কোন সমস্যাই হলনা। যদিও পাব্লিক প্লেসে উপায় না থাকলে নেকাব পরেই নামাজ পড়া যায়, তবু উনি যে এতোটা ভেবেছেন সেটাই তো অবাক করার মতো!
রাইয়্যানের আজকের ব্যবহার সিদ্রার মনের দুয়ার যেন খুলে দিলো, চিন্তার ধারা অন্যদিকে বইতে লাগলো ওর মনে। নকল স্ত্রী বা বন্ধু যাই মনে করুন, তাতেই যদি উনি এতো কেয়ার করেন, সম্মান করেন, সুবিধা অসুবিধার এতো সুন্দর করে খেয়াল রাখেন, তাহলে নিজের স্ত্রীর জন্য উনি কি আরো বেশি করবেননা? আমি তো এমন কাউকেই চেয়েছিলাম, যে আমার ঈমান আমলের হেফাজত করবে। বাকি রইলো উনার ভেতরে মুসলমানের কোন চিহ্ন না থাকা। খালা যদি সবকিছু জানার পরেও আমাকে ভালবেসে, আমার থেকে নামাজ শিখতে পারে, বাইরে যাওয়ার সময় বড় ওড়না পরা শুরু করতে পারে, তাহলে আমি কি উনাকে বদলাতে পারবোনা? আবার কখনো বিয়ের প্রস্তাব দিলে কি আমার রাজি হয়ে যাওয়া উচিত?
ছিঃ ছিঃ এসব কি ভাবছি আমি! মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার!! নাক-কান-গাল সব লাল হয়ে গেলো লজ্জায়। আর তাছাড়া একদিনের ব্যবহারেই এতকিছু ভেবে নেয়া উচিত নয়। কিন্তু শুধু আজকে তো না, এর আগেও কম কিছু করেননি উনি, শুধু পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। এসময় রাইয়্যান নড়ে উঠলে ধ্যান ভাঙল সিদ্রার। দেখল, ব্যাগ খুলে ফ্লাস্ক আর পেপার কাপ বের করছে রাইয়্যান। একটা কাপে চা ঢেলে চুমুক দিল ও, কিন্তু পেছনে তাকালোনা। সিদ্রা গলা দিয়ে আওয়াজ করতেই রাইয়্যান ঘুরে বসলো। আরেকটা কাপে চা ঢেলে সিদ্রার দিকে এগিয়ে দিলো।
বিনাবাক্যব্যয়ে কাপটা নিয়ে চুমুক দিলো সিদ্রাও। হঠাৎ কথা বলে উঠলো রাইয়্যান,
“আচ্ছা, এসময়ে তুমি কি করতে?”
“ঠিক বুঝলামনা”
“এমন সময়ে তুমি বাসায় কি করতে? মানে এখানে আসার আগে”
“সেটা জেনে আপনি কি করবেন?” আচমকা মনটা খারাপ হয়ে গেলো সিদ্রার।
“বলেছিনা, আজকের জন্য আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো, তাই একটু নরমাল গল্প করতে ইচ্ছে করছে”
“এসময় সাধারণত মাদ্রাসা থেকে ফিরে এসে গোসল -নামাজ -খাওয়ার পর্ব চলতো”
“তারপর কি করতে?”
“তারপর একটু রেস্ট নিতাম”
“তারপর?”
“আরে, আমি কি মাই ডেইলি লাইফ প্যারাগ্রাফ লিখছি নাকি? যদিও লেখলে সব পাস্ট টেন্স হয়ে যাবে, প্রেজেন্ট হবেনা” বিষণ্ণ কন্ঠে বলল সিদ্রা।
“ধরে নাও তাই, প্লিজ বলোনা” ততক্ষণে আরেক কাপ চা ঢেলেছে রাইয়্যান।
“এরপর আসরের নামাজের পর একটু হাদীস পড়তাম, তারপর ছাদে গিয়ে গাছে পানি দিতাম। মাগরীবের নামাজের পর নাস্তা করে পড়তে বসতাম। পড়াশুনার মাঝে উঠে নামাজ খাওয়া সেরে নিতাম। আব্বু বাসায় আসার পর একটুখানি গল্পগুজবও করতাম। তারপর সবশেষে কুরআন শরীফ পড়ে, জিকির আজকার করে ঘুম। ব্যাস, প্যারাগ্রাফ শেষ” কিন্তু চিন্তায় পড়ে গেল সিদ্রা, মুনিরা কি না কি লেখে রেখেছে, লোকটা কিছু আঁচ করতে পারবেনাতো! আরে ধুর, উনি তো ভাবেন যে আমি মিথ্যে বলছি, এখনো সেটাই নাহয় ভাববেন!!
“আচ্ছা, যদি কোনভাবে সময়কে পেছাতে পারো, ফিরে যেতে পারো তোমার আগের জীবনে, এমন কিছু কি করতে চাও তুমি, যা আগে করোনি বলে এখন আফসোস হচ্ছে?”
হাসল সিদ্রা, বিদ্রুপের হাসি।
“আপনার কাছে হুটহাট করে এটা সেটা ভেবে নেয়া খুব সহজ, তাইনা? আমার কাছে কিন্তু না। আমার কাছে বর্তমান আর বাস্তবটা অনেক বেশি প্রকট। আপনি আমার জায়গায় নেই তো, আপনি ফিল করতে পারবেননা”
“স্যরি, আমি সেভাবে বলিনি। মানুষ অনেকসময় বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়লে অনেক কিছু রিয়েলাইজ করে, তোমারও তেমন কিছু মনে হয়েছে কিনা, জাস্ট সেটাই জানতে ইচ্ছে হল, এর বেশি কিছু না”
তিরতির করে কাঁপতে থাকা নদীর পানির দিকে কিছুক্ষণ নিস্পলক তাকিয়ে রইল সিদ্রা, তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো,
“আমি মুনিরাকে সময় দিতে চাই”
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
৩১.
তিরতির করে কাঁপতে থাকা নদীর পানির দিকে কিছুক্ষণ নিস্পলক তাকিয়ে রইল সিদ্রা, তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো,
“আমি মুনিরাকে সময় দিতে চাই”
“কি?” রাইয়্যান অন্তত মুনিরাকে নিয়ে কিছু এক্সপেক্ট করেনি, আফটার অল মুনিরাই তো দায়ী সিদ্রার এ অবস্থার জন্য, আর সেটা জেনেও……
“না, কিছুনা। এবার আপনার পালা” রাইয়্যানের চিন্তা বাধাগ্রস্ত করলো সিদ্রা।
“আমার পালা!” একটু অবাক হল রাইয়্যান, আমার সম্পর্কে ও জানতে চায়! “ঠিক আছে, বলো কি জানতে চাও”
“উম্ম, আপনি অবসর সময়ে কি করেন?” কথা ঘুরানোর জন্য বলেছিল কথাটা কিন্তু এখন কি জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছেনা সিদ্রা।
“অবসর সময়!” হাসল রাইয়্যান, “আমার কোন অবসর নাই, আমি অসম্ভব কাজপাগল মানুষ। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ফারহানের সাথে টাইম স্পেন্ড করতাম সময় বের করে। সেটাকে যদি অবসর ধরে নেয়া যায়, তাহলে মুভি দেখা, ঘুরতে যাওয়া, ভিডিও গেম খেলা, বলতে গেলে যা ফারহান চাইতো! বাট এজ হি ইজ নো মোর, দেয়ার ইজ নো নিড অফ অবসর!”
ইশ! সবকথা ঘুরেফিরে জিলাপির প্যাচের মত ফারহান আর মুনিরাতে গিয়েই কেন থামে!! ভাবল সিদ্রা, প্রসঙ্গ পালটাল ও।
“আপনার গলা তো মাশা আল্লাহ্ অনেক সুন্দর! কিন্তু আপনি বাংলা গান জানেননা?”
“কেন? গানদুটো তোমার পছন্দ হয়নি?”
“না, শুনতে তো ভালই লাগছিলো, কিন্তু কথাগুলো বুঝতে পারলে আরো ভালো লাগতো, এই আর কি”
“তুমি হিন্দী বোঝোনা?” হতভম্ব দেখাচ্ছে রাইয়্যানকে।
“নাহ!” বলেই জিভে কামড় দিল সিদ্রা। মুনিরা নিশ্চয় হিন্দী সিনেমা দেখার গল্পগুজব করেছে ফারহানের সাথে, লোকটার কাছে আবার মিথ্যুক হয়ে গেলাম। এতো মিথ্যে টলেরেট করতে না পেরে কখন যে বার্স্ট হবে, আল্লাহ্ মালুম।
আর এদিকে রাইয়্যান বেচারার হৃদয়খানা বেদনায় টুকরো টুকরো হওয়ার জোগাড়। ঢকঢক করে কাপের বাকি চাটুকু শেষ করে কাপটা হাত দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেললো ও। মনের কথা পরোক্ষভাবে জানানোর এতো সুন্দর প্ল্যান যে এভাবে মাঠে মারা যাবে, কল্পনাও করেনি। কোনমতে ধাক্কাটা হজম করে নিয়ে জবাব দিলো, “বাংলা গান একদমই জানিনা তা না, তবে সংখ্যায় কম। আর এ গানগুলো পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে অনেক ভাল ম্যাচ করছিলো, সেজন্যই গাইতে ইচ্ছে হল আর কি!”
ও আচ্ছা, এমন একটা চেহারা করে মাথা ঝুঁকাল সিদ্রা, কিন্তু আর মুখ খুললোনা।
রাইয়্যান বাইরে বের করে রাখা জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে ফেললো, তারপর বলল, “এবার কিন্তু তোমার পালা”
“আমরা যেতে যেতে কথা বলি, নাহলে মনে হয় বনের মধ্যেই রাত নেমে যাবে” আবার বেফাঁস কিছু বলে ফেলার ভয়ে কাটানোর চেষ্টা করলো সিদ্রা।
“আরে না, এতক্ষণ তো ঘুরে বেড়িয়েছি, সেজন্য সময় লেগেছে, সোজা যেতে আধঘন্টার বেশি লাগবেনা, আর বেশি ধীরে গেলে ম্যাক্সিমাম একঘণ্টা” একথা বলে রাইয়্যান উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসলো, কিন্তু হাতে বৈঠা তুলে নিলোনা। “এবারের প্রশ্ন হল, মুনিরাকে সময় দিব বলতে কি বোঝাতে চেয়েছো তুমি? প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আই এম জাস্ট কিউরিয়াস”
ধুর! সেই কথা নিয়ে এখনো পড়ে আছে!! কি আর করা, সত্যিটাই বলি, কিছু বুঝতে পারবেনা আশা করি, ভাবল সিদ্রা।
“আসলে আমরা দুইবোন একটু আলাদা তো, যে যার পছন্দমতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি সবসময়। দুজনে মিলে ছোটবেলায় একসাথে পড়াশোনা খেলাধুলা করলেও বড় হওয়ার পর আমরা কেমন ছাড়াছাড়া হয়ে গেছি। পাশাপাশি থেকেও একটা অদৃশ্য দুরত্ব তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে। তাই সময়কে পিছিয়ে নিতে পারলে আমি সেই দুরত্বটা সবার আগে ঘোঁচাতে চাই, ওকে বুঝতে চাই আমি। ওর পছন্দের কিছু করে হলেও দুজন মিলে একসাথে সময় কাটাতে চাই, এনজয় করতে চাই। আমি তো বেশি কথা বলিনা, তাই আমাদের মধ্যে গল্পগুজব কম হয়, সেটাও আমি বদলাতে চাই। অন্য মানুষদের সাথে না হোক, নিজের বোনের সাথে প্রাণখুলে গল্প করতে চাই আর সেই সাথে ওর এমন বোন হতে চাই যাতে ওও আমার সাথে প্রাণখুলে সবকিছু শেয়ার করতে পারে। আমি চাইনা…….”
“আর ইউ ইনসেন!?” চিৎকার করে উঠলো রাইয়্যান। ব্যাস, এটারই অপেক্ষা করছিলাম! আমার কপালে এই জলাবনের পানিতে ডুবে মরাই লেখা আছে!! রাইয়্যানের অগ্নিমূর্তি দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলো সিদ্রা।
“এনাফ ইজ এনাফ! যে বোনের জন্য আজ তুমি এতো বড় বিপদে পড়ে আছো, তোমার সারাটা জীবন নষ্ট হওয়ার পথে, তার জন্য কিনা নিজেকে বদলাতে চাইছো? তোমার কি মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট বলে কিছু নেই?” রাগের চোটে সত্য বেরিয়ে গেলো রাইয়্যানের মুখ থেকে।
“কি বললেন আপনি?” বিস্ফোরিত চোখে বলল সিদ্রা, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।
সব ফাঁস হয়ে গেছে বুঝতে পেরে শান্ত হয়ে গেল রাইয়্যান, “আমি……. সত্যিটা জেনে গেছি। আসল দোষী যে তুমি নও, মুনিরা, সেটা আমি জানতে পেরেছি” ধীরকন্ঠে বলল কথাগুলো।
“কবে? কখন? কিভাবে?” নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে এবার মুনিরার চিন্তায় শঙ্কিত হয়ে উঠলো সিদ্রা।
“এবার যখন ঢাকায় গেলাম, তখন। আর কিভাবে জেনেছি অত ডিটেইলসে না যাই”
সাথে সাথে সিদ্রা বুঝে গেলো এবার ফেরার পর থেকে রাইয়্যানের অদ্ভুত ব্যবহারের রহস্য। তার মানে উনি আমি নির্দোষ জেনে আমার সাথে এতো ভাল ব্যবহার করছেন, এমনি এমনি না! আর আমি কি না কি ভাবছিলাম!! কিন্ত…. ভাবনা হোঁচট খেলো রাইয়্যানের কথায় আর নৌকার দুলুনিতে।
“তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে, সিদ্রা?” হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে রাইয়্যান, দুহাত সামনে জড়ো করা, “আমি জানি আমি যা করেছি, তার কোন ক্ষমা হয়না। তোমার মত একটা মেয়েকে বিনাদোষে দিনের পর দিন আমি কষ্ট দিয়েছি। তুমি কতবার বলেছো, বোঝানোর চেষ্টা করেছো যে এসবের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। অথচ আমি সেগুলোকে মিথ্যে ভেবে অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছি” দম নিলো রাইয়্যান।
“আমি…… আমি তোমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি! ছি!! মেরে মেরে তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলেছি!! হাউ কুড আই!!!” দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল রাইয়্যান।
সিদ্রা হা করে তাকিয়ে আছে, যেন বুঝতে পারছেনা এসব কি ঘটছে। এই লোক এভাবে ওর কাছে ক্ষমা চাইছে! এও সম্ভব!!
“ওইসব দিনগুলোর কথা ভাবলে নিজেকে আমার অমানুষ বলে মনে হয়। এমনকি তোমাকে নিজের মিথ্যে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে, তোমার বোনের প্রতি ভালবাসাকে কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেছি! সেই বোন, যে কিনা আসল দোষী। আর তুমি! সেই বোনের জীবন বাঁচাতে মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছো” একটুখানি থামল রাইয়্যান, মুখটা বেদনায় পাংশু হয়ে গেছে ওর।
“আমি যেদিন ভুল করে পাপোশের উপর চাবি ফেলে গিয়েছিলাম, সেদিন তুমি সব জানতে পেরেছো, তাইনা?” সিদ্রার দিকে তাকাল রাইয়্যান।
হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল সিদ্রা।
“তাহলে কেন? তোমার বোন তোমাকে ফাঁসিয়েছে জেনেও তুমি ওকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু কেন মেনে নিলে? আমাকে সত্যিটা বলে দিলেনা কেন?”
“কারণ ও আমাকে ফাঁসায়নি” শক্ত কন্ঠে বলল সিদ্রা, “হ্যাঁ ও মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু তার মানে এই না যে ও ইচ্ছে করে আমার ক্ষতি চেয়েছে। আমি আমার বোনকে খুব ভাল করে চিনি। ওর সাথে আমার মনের মিল না থাকতে পারে, তাই বলে কি আমি ওর শত্রু নাকি! তাহলে শুধু শুধু আমাকে বিপদে ফেলতে চাইবে কেন? এর পেছনে কি কারণ আছে আমি জানিনা। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ও যদি ঘুণাক্ষরেও জানতো যে আমার নাম ব্যবহার করলে আমি এতোবড় বিপদে পড়বো, তাহলে ও কখনওই এমন করতোনা”
এবার রাইয়্যান হা করে শুনছে, মুখের কথা যেন হারিয়ে গেছে ওর।
“আর ফারহানের সাথে ও যা করেছে, আমি জানিনা ঠিক কতটা গভীরে গিয়েছিল ওদের সম্পর্ক। কিন্তু আমি যেটুকু বুঝেছি, ও ফারহানের পাগলামি আঁচ করতে পেরেই সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ও যদি জানতো ফারহান এমন কিছু করবে, ও সেটা আটকানোর চেষ্টা করতো। আমার বোন এতটা পাষাণ নয়, বিশ্বাস করুন আপনি। এমনকি এখনো যদি ও জানতে পারে যে ওর জন্য একটা মানুষ মারা গেছে, তার ইহজীবন পরজীবন সব নষ্ট হয়ে গেছে, ও জাস্ট পাগল হয়ে যাবে, নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবেনা ও”
“ওর এসব কান্ডের পেছনে আমারও কিছুটা দোষ আছে বৈকি। আমি ওর বোন হয়েও এতোটা ক্লোজ হতে পারিনি যে এই কথাগুলো ও আমাকে শেয়ার করবে। হয়ত আমি ওকে সময় দিইনি, নিজের পছন্দমত কাজে ব্যস্ত থেকেছি বলেই ও ফেসবুকে নিজের সময় কাটানোর ব্যবস্থা খুঁজে নিয়েছে, জড়িয়ে পড়েছে হারাম সম্পর্কে। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন, কেন আমি সময়কে ফেরাতে পারলে মুনিরাকে সময় দিতে চেয়েছি?” এতোগুলো কথা বলে থামল সিদ্রা।
“স্যালুট তোমাদের দুইজনের বিশ্বাসকে। তোমরা একজন আরেকজনকে এতো ভালবাসো, এতোটা বিশ্বাস করো, আমি তো ভাবতেই পারছিনা” অবশেষে মুখ খুলল রাইয়্যান।
“দুইজন মানে?” অবাক হল সিদ্রা।
“হ্যাঁ, মুনিরাও তোমাকে ঠিক এতোটাই বিশ্বাস করে। আমি ওকে পরীক্ষা করার জন্য ফোন দিয়ে বলেছিলাম যে তুমি একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছো! ও আমাকে জুতা দিয়ে পিটাতে চেয়েছে, জানো তুমি?”
“কি!?” এই সিরিয়াস সময়েও ফিক করে হাসি বেরিয়ে গেলো সিদ্রার মুখ দিয়ে।
“হুম, এমনকি আমি প্রমাণ দেখাতে চেয়েছি, তাও শুনেনি। তুমি হাসছো! কি পরিমাণ কথা যে শুনিয়েছে আমাকে, চিন্তা করতে পারবানা। আমি জীবনেও কোনদিন কারো থেকে এতো কথা শুনিনি। বাপরে বাপ! তুমি ভাবছো, তোমরা দূরে সরে গেছো, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তোমাদের ভালবাসা কতটা মজবুত। মুনিরাও তোমাকে অনেক ভালবাসে সিদ্রা, এতোটা বেশি যে তুমি কল্পনা করতে পারছোনা”
আসলেই আমি কল্পনা করতে পারছিনা! মনে মনে বলল সিদ্রা।
“সো, তুমি যা যা করতে চেয়েছো, আশা করছি ফিরে যাওয়ার পর সেসব খুব সহজেই করতে পারবে। তুমি যখন চাও ফিরে যেতে পারো নিজের পরিবারের কাছে। আমি ফিরে আসার পরদিনই তোমাকে কথাগুলো বলতে পারতাম। কিন্তু আমি তোমাকে কিছু ভাল সময় উপহার দিতে চেয়েছিলাম। যদিও বুঝতে পারছি আনন্দের থেকে সেগুলো তোমাকে অপ্রস্তুত বেশি করছে। তাই, এ নাটকের আজ এখানেই সমাপ্তি। এখন, এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমি সম্পূর্ণ আলাদা দুজন মানুষ, কোন সম্পর্ক নেই আমাদের মধ্যে, তুমি চাইলে আমি লিখে দিতে পারি” একটু থামল রাইয়্যান।
“আর আমি তোমার কাছে আমার কৃতকর্মের জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। যদিও সত্যি সত্যি ক্ষমা পাবার আশা করছিনা, জানি সেটা সম্ভব না। তবে ভবিষ্যতে যদি কোনদিন পারো, ক্ষমা করে দিও আমাকে। আর তুমি যদি ক্ষমা না করে আমাকে শাস্তি দিতে চাও, কোন আপত্তি নাই আমার, যেকোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো।” দুহাত জোড় করে মাথা নিচু করে রইলো রাইয়্যান।
বাকশূন্য হয়ে গেলো সিদ্রা। যেখানে আমি ভাবছি উনি সত্যি জানার পর মুনিরার সাথে কি না কি করবেন, সেখানে উনি উলটে উনাকেই শাস্তি দেয়ার কথা বলছেন! আমাকে বিনাদোষে কষ্ট দেয়ার অপরাধবোধ এতটা পীড়া দিচ্ছে উনাকে!! আমি ঠিকই ভেবেছিলাম, উনার যে রূপ আমি আগে দেখেছিলাম, সেটা উনার আসল রূপ নয়, এটাই আসল। ওইটা জাস্ট ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা আর রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
“আমি আপনাকে বহু আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। সত্যিটা জানার পর আমি আপনাকে দোষ দিতে পারিনি, কারণ আসল দোষী তো আমারই বোন। আজ যদি পরিস্থিতি উল্টো হত, আল্লাহ না করুন, আপনার ভাইয়ের জায়গায় আমার বোনের এ পরিণতি হত, আমি কি আপনার ভাইকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারতাম? পারতামনা”
“তাই আমিও আমার বোনের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইবোনা। আপনি যদি মুনিরাকে কোর্টে তুলতে চান, কিংবা অন্য কিছু করেন, আমি বোন হিসেবে ওর পাশে দাঁড়াবো, ওকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, কিন্তু আপনাকে কিছু করতে আমি নিষেধ করবোনা” নিচের দিকে দৃষ্টি সিদ্রার।
“আমাকে তোমার এতটা অমানুষ বলে মনে হয়! আমি খারাপ হতে পারি, কিন্তু সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব এখনো বিলিয়ে দিইনি। বিনা অপরাধে তোমাকে তিনমাস ধরে শাস্তি দেয়ার পর আবার আমি তোমার বোনের বিরুদ্ধে একশন নিয়ে তোমাকে আবারও কষ্ট দিবো, এতোটা অমানুষ আমাকে ভেবোনা প্লিজ। তুমি যদি আমাকে এতকিছুর পরও নির্দ্বিধায় ক্ষমা করতে পারো, তাহলে আমি কেন পারবোনা?”
“আর ওই যে বললে, সবটা জানতে পারলে অনুশোচনায় দগ্ধ হবে মুনিরা, আর তার সাথে যুক্ত হবে নিজের দোষে বোনের শাস্তি পাওয়ার অপরাধবোধ। খুব কম শাস্তি হবেনা ওর জন্য। আর তাছাড়া, দোষ যে শুধু মুনিরার ছিল তাতো নয়। ফারহানও সমান দোষে দোষী ছিল, এক হাতে তো আর তালি বাজেনা। ও সবসময়ই একটু বেশি ইমোশনাল, আর আমাদেরও দোষ ছিল। সবসময় আদর আহ্লাদ দিয়েছিলাম, পৃথিবীতে সবকিছুই যে পাওয়া যায়না, দুঃখ কষ্ট বলে যে কিছু আছে, এসব বুঝতে দিইনি। সেজন্যই প্রথমবারের মত এতোবড় আঘাত পেয়ে আর সহ্য করতে পারেনি” চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো রাইয়্যানের, ত্রস্ত হাতে মুছে ফেললো ও।
“কিন্তু এসব তো আর তখন মনে হয়নি। রাগের চোটে নিজের ভাইয়ের কোন দোষই চোখে পড়েনি আমার” থামল রাইয়্যান।
“স্বাভাবিক! এতবড় আঘাত পেয়ে আপনিও তো সঠিক চিন্তা করার মতো অবস্থায় ছিলেননা। আর বললাম তো, আপনার জায়গায় যে কেউ থাকলে সেও একই কথাই ভাবতো। শুধু হয়ত আবেগ বা রাগের বহিঃপ্রকাশটা আলদা হত!!”
“থাক, এসব কথা বাদ দাও। লেটার বেটার দ্যান নেভার। পাপের ঘড়া আরো ভারী হওয়ার আগেই যে আমি সবটা জেনে গেছি, সেজন্য আল্লাহ্র দরবারে শুকরিয়া। এখন বল, কবে ফিরতে চাও তুমি? চাইলে নৌকা থেকে নেমে নেক্সট ফ্লাইটেই রওনা দিতে পারো, আমি এরেঞ্জ করে দিব” বুকে পাথর চেপে কথাগুলো উচ্চারণ করলো রাইয়্যান, যেন নিজের মৃত্যুদন্ডের অধ্যাদেশ জারি করছে।
“না, আমি খালা আর বুবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারপর ফিরতে চাই”
খুশিতে মুখটা ঝলমল করে উঠলো রাইয়্যানের, অন্তত আরো একটা দিন তো ও থাকছে!
(চলবে)