যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব শেষ

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

৩৪. (অন্তিম পর্ব)

এবার যেন মাথায় বাজ পড়লো সিদ্রার। নাম! তাইতো, উনার নাম কি? এতোগুলো দিন যার কাছে থেকে আসলাম, তার নামটা পর্যন্ত জানিনা আমি! মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো ওর।

“কি হল, হঠাৎ চুপ মেরে গেলি কেন?” মেয়ের মুখটা হঠাৎ শুকিয়ে গেলো কেন বুঝতে পারছেননা নিজাম সাহেব।

“আমি উনার নাম জানিনা আব্বু” ধীরকণ্ঠে বলল সিদ্রা।

“নাম না জানলে ঠিকানা বল। কোথায় রেখেছিল তোকে?”

“সিলেটের একটা চা বাগানে”

“কি নাম সেই চা বাগানের?”

“সেটাও জানিনা আব্বু”

“তাহলে অন্তত এমন কিছু বল যাতে ওকে খুঁজে বের করা যায়! না, এভাবে হবেনা” উঠে দাঁড়ালো নিজাম সাহেব, হাত ধরল সিদ্রার, “ তুই আমার সাথে থানায় চল। ওই লোকের বর্ণনা দিবি, আর বাকি যা দরকার পুলিশ প্রশ্ন করে ঠিক জেনে নিবে” দরজার দিকে এগোলেন তিনি।

“দাঁড়াও আব্বু, এসব করার দরকার নেই”

“আলবৎ দরকার আছে”

“তুমি রাগের মাথায় এসব বলছো। শান্ত হয়ে ভেবে দেখো আগে, উনার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করো। উনি উনার ভাইকে চিরদিনের মতো হারিয়েছেন আব্বু! তোমার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল, ফিরে পেয়ে গেছো, উনি কিন্তু উনার ভাইকে কোনদিন ফিরে পাবেননা। বাবা মা মারা যাওয়ার পর ভাইকে সন্তানের মত মানুষ করেছেন উনি। উনার ভাইয়ের যায়গায় নিজের মেয়েকে একবার কল্পনা করে দেখো তো”

সারা শরীর কেঁপে উঠলো নিজাম সাহেবের, আবার সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন। বলে চলল সিদ্রা, “এই পৃথিবীতে উনার ভাই ছাড়া আর কেউ ছিলনা, সেই ভাইকে হারিয়ে উনি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন, প্রতিশোধের নেশায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস করো, উনি আমার প্রতি কোন অসম্মান করেননি। আর সত্যি জানার পর তো একটুও দেরী না করে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, আমাকে সসম্মানে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। উনি যদি না বলতেন, আমি জীবনেও জানতে পারতামনা যে উনি সবটা জানেন। উনি চাইলে আজীবন আমাকে আটকে রাখতে পারতেন আব্বু। কিন্তু উনি সেটা করেননি। নিজের ভুল উনি বুঝতে পেরেছেন। এই তিনমাস তো সবকিছু আমি সহ্য করেছি আব্বু। সেই আমি যদি উনাকে ক্ষমা করে দিতে পারি, তুমি কেন পারবানা বলো?”

“আমি জানিনা। এতো কথা আমি জানতেও চাইনা আর বুঝতেও চাইনা। আমি শুধু জানি, যে আমার মেয়ের সম্মান নষ্ট করেছে, তাকে শাস্তি পেতে হবে”

“সম্মান কি জীবনের থেকে বড় আব্বু? উনার ভাইয়ের জীবন চলে গেছে আব্বু, তোমার মেয়ের জন্য, আর তুমি সম্মানের কথা বলছো!”

এভাবেই দুজনের মধ্যে কথা চলতে থাকলো, এক পর্যায়ে হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন নিজাম সাহেব। অবশ্য না ছেড়ে আর উপায় কি, সিদ্রা যে কিছুই বলতে পারছেনা। পুলিশ হয়ত খুঁজে বের করতে পারবে, কিন্তু সিদ্রার যুক্তির কাছে হার মানলেন তিনি।

সিদ্রা বোঝাল, যা হবার তাতো হয়েছেই। এখন পুলিশ ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলে মুনিরার বিষয়টাও ফাঁস হয়ে যাবে। মুনিরাকে সেফ রাখার জন্য ওইখানে কি কি করেছে, সব বলল সিদ্রা। এখন এসব করে যদি মুনিরাকে এক্সপোজ করে দেয়া হয়, তাহলে ওর এতো কষ্টের তো মূল্যই থাকেনা। একজনের জীবন নষ্ট হয়েছে, আরেকজনের জীবন সাধ করে নষ্ট করবার দরকার কি! ও চায়না এই ঘটনার সাথে যে মুনিরা জড়িত, সেটা শুধুমাত্র ওরা চারজন ছাড়া আর কেউ জানুক।

কিন্তু তাই বলে মুনিরাকে ছেড়ে দিলেননা নিজাম সাহেব। হুকুমজারি করলেন, যেমন এ তিনমাস মুনিরার প্রাপ্য কষ্টগুলো সিদ্রা ভোগ করেছে, তেমনি এখন থেকে এর জন্য সিদ্রা যে অসুবিধার সম্মুখীন হবে, সেগুলো মুনিরাকে হ্যান্ডেল করতে হবে। সিদ্রার নাম নিয়ে মজা যখন করেছে, তখন তার সাজাও ভোগ করতে হবে ওকে। সিদ্রা সেজে সামনে যেতে হবে সব পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনের। কারো কোন কটুকথা যেন সিদ্রাকে শুনতে না হয়। বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছে মুনিরা। তখন থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে আর বারংবার সিদ্রার কাছে ক্ষমা চাইছে ও।

সিদ্রার বলা কথাগুলো কতটা সত্য সেদিনই বুঝে গেলেন নিজাম সাহেব। আসরের নামাজে মসজিদে যেয়ে সবাইকে সিদ্রার ফিরে আসার সংবাদ জানাতেই সবাই জানতে চায় কি হয়েছিল। সত্যি কথাই বললেন তিনি, শুধু আসল দোষীর পরিচয় বাদে। সবাই জানলো, অন্য মেয়ের বদলে সিদ্রাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো এক লোক, যখন বুঝেছে ভুলজনকে তুলে এনেছে, তখন ছেড়ে দিয়েছে। এরপর সেটাতে মসলা মাখিয়ে মুখরোচক বানানো তো সকলের অবশ্য কর্তব্য। পাড়াময় সংবাদটা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগলোনা।

তারপরেই একের পর এক পাড়ার মহিলারা দেখতে আসা শুরু করলো সিদ্রাকে। ওদের সামনে বাবার কথামতো মুনিরা সিদ্রা সেজে দেখা করতে আসলো। এমনিতেই তো জমজ বলে কেউ পার্থক্য করতে পারেনা, তার ওপর কান্না করে ফুলে থাকা চেহারা দেখে কেউ বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করলোনা। সবাই প্রথমে আদর করে, যেন কত খুশি হয়েছে ও ফিরে এসেছে দেখে। এরপর নানান প্রশ্ন করে কাহিনীটা মোটামুটি শুনে নেয়, আর তার পরেই বেরিয়ে পড়ে সবার মনের নোংরা চিন্তাগুলো। সেগুলো শুনে কখনো নিরবে অশ্রু ঝরল দুইবোনের চোখ দিয়ে, আবার কখনো সহ্য করতে না পেরে মুনিরা রাগারাগি করে মানুষকে বের করে দিলো ঘর থেকে। আর জাহানারা বেগম অসুস্থ বলে এই মহিলাদের মুখের ওপর জবাব দেয়ার মতও কেউ ছিলনা, শেষমেশ নিজাম সাহেব বাধ্য হয়ে সবাইকে প্রায় তাড়িয়ে দিলেন।

“আমরা তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলিনা, তোরা যাকিছু একটা শুনিয়ে দিবি, আর আমরাও শুনে নিবো। চুলগুলো এমনি এমনি পাকেনি বুঝলি! কালে কালে কত দেখলাম। তোর বোন নিজের সাথে তোদের গোটা পরিবারের মুখে চুনকালি মাখিয়েছে, এখন তোরা দুধে ধোয়া তুলসী পাতা বানিয়ে দিলেই তো আর সেটা উঠে যাবেনা না?” বেরিয়ে যাবার আগে পাশের বিল্ডিং এর এক আন্টি বললেন কথাগুলো সিদ্রার দিকে তাকিয়ে, ওকে মুনিরা মনে করে।

সিদ্রার কান মাথা সব ঝাঁঝাঁ করতে লাগলো, এতোদিনের পরিচিত মানুষগুলো কিভাবে পারছে এসব বলতে! সত্য ঘটনা বিশ্বাস না করে নিজেদের মত সবটা বানিয়ে নিচ্ছে কেন এরা? সবাই বেরিয়ে যাবার পর দরজার সামনে বসে পড়ে কাঁদতে শুরু করলো ও। মুনিরাও কাঁদছিল, এবার সিদ্রার সামনে বসে পাদুটো ধরে ফেললো ওর।

“আমাকে তুই ক্ষমা করে দে সিদ্রা, আমাকে ক্ষমা করে দে” সিদ্রা মহিলাদের কথায় এতোটাই শকড হয়ে ছিল যে, মুনিরার হাতদুটো সরিয়ে দেয়ার কথা মাথায় আসলোনা ওর। বলে চলল মুনিরা, “আমার কয়দিনের মজা করার পরিণাম যে এতো ভয়ঙ্কর হবে আমি বুঝতে পারিনি রে। আমার জন্য হয়েছে এতোকিছু! আমার জন্য ফারহান এই দুনিয়া থেকে চলে গেছে। আমার জন্য তোর জীবনটা নরক হয়ে গেলো, আমি এতো খারাপ কেন, বলতে পারিস!” কাঁদতে কাঁদতেই কথা বলছিল মুনিরা, “বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছে করে তোকে এর মধ্যে ঢুকাইনি। আমি আসলেই শুধু একটুখানি মজা করতে চেয়েছিলাম। তাও কোনভাবে ব্যাপারটা ফাঁস হলে তুই এসব করেছিস এটা কেউ বিশ্বাস করবেনা, এটা ভেবেই আমি তোর নামটা দিয়েছিলাম। এছাড়া আর কিছুই না, বিশ্বাস কর আমাকে। আর ফারহান! আমি…..আমি ওকে সত্যি সত্যি ধোঁকা দিইনি। মজা করতে করতে আমিও ভালবেসে ফেলেছিলাম ওকে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা কোনদিন পরিণতি পাবেনা, তোরা কেউ ওকে কখনোই মানবিনা, বুঝেই আমি সরে গেছিলাম। কিন্তু এসবের পরিণাম যে এতোটা ভয়াবহ হবে আমি আগে কেন বুঝলামনা!”

কিছুই বললনা সিদ্রা, শুধু মুনিরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো। বুঝে গেছে কান্না তো সবে শুরু, এ কান্না কবে শেষ হবে, সেটা আল্লাহ্‌ ছাড়া কেউ জানেনা। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন নিজাম সাহেবও, মেয়েদের কষ্ট দেখে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। কিন্তু কিভাবে এই কষ্ট দূর করবেন, কিভাবে মানুষের মুখ বন্ধ করবেন, জানা নেই তার। সিদ্রা যেদিন হারিয়ে গিয়েছিল, সেদিনের থেকেও অসহায় লাগছে নিজেকে। কারণ সেদিন সমাজ পাশে ছিল, আর আজ সমাজই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে।

“আমার জন্য তুই এতোকিছু সহ্য করেছিস, আমাকে বাঁচানোর জন্য পালানোর আশা পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলি, নিজের সারাটাজীবন স্যাক্রিফাইস করতে রাজি ছিলি, আর আমি কিনা তোকে অত বাজে একটা সন্দেহ করলাম! ছি!! সব দোষ আব্বুর ঠিক করা ওই গোয়েন্দাটার। উনিই আমার মাথায় এসব আজেবাজে কথা ঢুকিয়েছেন” একটু শান্ত হওয়ার পর বলল মুনিরা।

“আমার ঠিক করা গোয়েন্দা!?” ঘরে ঢুকে বললেন নিজাম সাহেব।

“হুম, ওই যে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, সিদ্রাকে খুঁজে বের করার জন্য তুমি ঠিক করেছিলে, উনি। ফোন করেছিলো তো আমাকে। আমি সেদিনই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আম্মুর এই এক্সিডেন্ট এর চক্করে মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিল”

“কিসের প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর! আমি তো কাউকে ঠিক করিনি” হতভম্ব হয়ে গেছেন নাজিম সাহেব।

“মানে? তাহলে কে ছিল লোকটা?” মুনিরাও হতভম্ব হয়ে গেছে।

জবাব দিলো সিদ্রা, “আমি জানি লোকটা কে ছিল” দুইজনেই অবাক হয়ে তাকাল ওর দিকে।
“ফারহানের ভাই, উনিই তোকে ফোন দিয়েছিলেন আমার ব্যাপারে খবর নেয়ার জন্য। তোর সাথে কথা বলেই উনি শিওর হন যে আমি নির্দোষ”

***
রাতেরবেলা বিছানায় শুয়ে সারাদিন ধরে ঘটে যাওয়া সকলকিছু ছাপিয়ে মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছিল সিদ্রার। আমি এতোই গাধা! উনার নাম জানারও প্রয়োজন বোধ করিনি আমি! লোকটা তাহলে আমার কাছে শুধু “উনি” হয়েই থেকে যাবে!! আর শুধু কি উনার, আমি তো বুবুর নাম, খালার নাম, কারোর নামই জানিনা। তার মানে আমি চাইলেও কোনদিন খুঁজে পাবোনা ওদের। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালই হল, কোন পিছুটান রইলোনা। আল্লাহ্‌ যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন।

সেদিন ভোররাতে ঘুম ভেঙে আশ্চর্য হয়ে দেখল সিদ্রা, মুনিরা ওর আগেই উঠে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে গেছে, যেটা এর আগে কোনদিন ঘটেনি। আল্লাহ্‌র লীলা বোঝা ভার! কখন কিভাবে তিনি তাঁর বান্দাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিবেন, তিনিই ভালো জানেন। সকল কিছু দূরে সরিয়ে অত্যন্ত আনন্দিত মন নিয়ে বিছানা ছাড়ল ও।

***
সাতদিন! মাত্র সাতদিন লাগলো রিয়েলাইজ করতে যে জীবনটা আর আগের মত নেই আর হবেওনা কোনদিন, আমূল বদলে গেছে সবকিছু। সিদ্রা আর রাইয়্যান, দুজনেই অনুভব করলো জীবনের এই নতুন সত্যি। কারটা বলবো আগে? ঠিক আছে, রাইয়্যানের কথাই নাহয় আগে বলি।

সিদ্রাকে রেখে আসার পর তিনদিন ধরে ঢাকার রাস্তাঘাট আর পার্কে পার্কে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াল রাইয়্যান। বুবুকে বলে এসেছিলো ওরা হানিমুনে থাইল্যান্ড যাবে। সেজন্য ঢাকার বাসাতেও যায়নি আর হোটেলে উঠবে তার উপায় নেই, প্রথমদিনেই মানিব্যাগ, মোবাইল সব ছিনতাই হয়ে গেছে। ড্রাইভার ডেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল সিদ্রাকে নামিয়ে দেয়ার পরপরই। সেক্রেটারি কে কোথাও থেকে একটা ফোন দিলেই সব সলভ হয়ে যেতো, কিন্তু ওই যান্ত্রিক জীবনে ফিরতে ভালো লাগছিলো না ওর। ফারহানকে কবর দিয়ে আসার পর যেমন শূন্য লাগছিলো, চারিদিকে এখন যেন সেই একই শূন্যতা অনুভব করছে ও। তৃতীয় দিন রাতে পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমাচ্ছিল ও। হঠাৎ স্বপ্নে দেখা দিলো সিদ্রা, মুখটা বেদনায় পাংশু, ব্যাথাতুর এক দৃষ্টি অশ্রুসজল দুচোখে ।

“কি হয়েছে তোমার?” উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাইয়্যান।

“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন কিন্তু সেই কথা রাখছেন না, তাই খুব কষ্ট পাচ্ছি”

সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে যায় রাইয়্যানের, উঠে বসে ও। মনে পড়ে ওর, সিদ্রাকে বলেছিল জীবনটা নতুন করে গড়ার চেষ্টা করবে, আর সেখানে এসব কি করছে!

সেই মুহূর্তেই ঢাকার ফ্ল্যাটে ফিরে যায় ও। এতোদিনের অনুপস্থিতিতে ব্যবসায় যা যা সমস্যা হয়েছে সেগুলো মেটাতে কখন যে দুইদিন পার হয়ে যায় বুঝতেই পারেনা। পঞ্চম দিনে সিলেট ফিরে ও। কাজের ব্যস্ততায় শুধু যা ভুলে ছিল, বাংলোতে ঢুকতেই সেই শূন্যতা আবার ঘিরে ধরে ওকে। যেদিকে তাকাচ্ছে, সেদিকেই যেন শুধু সিদ্রাকে দেখতে পাচ্ছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিলো ফারহান চলে যাওয়ার পর। সিদ্রার ঘরে গিয়ে পাথরের মূর্তির মত বসে থাকে ও। সিদ্রার ব্যবহৃত সব জিনিস থরে থরে সেভাবেই রাখা আছে, গায়ের কাপড় আর বোরকাটা ছাড়া কিছুই নিয়ে যায়নি মেয়েটা। দেখে মনেই হচ্ছেনা, এসবের মালিক আর কোনদিন এঘরে পা রাখবেনা।

দুইদিন ওইভাবেই খেয়ে না খেয়ে সিদ্রার ঘরে পড়ে থাকার পর রাইয়্যানের চোখ পড়ে রিয়াদুস সালেহীন এর প্রথম খন্ডটার ওপর, বালিশের ওপর রাখা ছিল বইটা। কি এমন আছে এই বইতে, যে এই বইটা এতো বেশি পড়তো সিদ্রা। হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতেই বই তো না, যেন আলোর পথের প্রবেশদ্বার খুলল ও। একটার পর একটা হাদীস পড়ে আর আল্লাহর প্রতি, রাসূল (স) এর প্রতি, সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ভালবাসা বাড়তে থাকে, অন্তর কেঁপে কেঁপে উঠে ওর। একসময় কানে ভেসে আসে ফজরের আজানের ধ্বনি,“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”

সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় রাইয়্যান। আজ থেকেই শুরু হবে সিদ্রাকে দেয়া কথামতো নতুন জীবন গঠনের প্রক্রিয়া, যার উদ্দেশ্য হবে আখেরাতের পাথেয় অর্জন, নিজের জন্য আর অবশ্যই ফারহানের জন্য। অজু করে পাঞ্জাবী পরে রওনা দেয় ও মসজিদের দিকে।

নামাজ শেষে মুসল্লিরা সবাই চলে গেলে এগিয়ে যায় ও ইমাম সাহেবের দিকে। সালাম বিনিময়ের পর আকুতিভরা কন্ঠে বলল, “ইমাম সাহেব, আমাকে একজন সত্যিকারের মুসলিম হতে সাহায্য করবেন?”

জীবনে প্রথমবারে মত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে এতোটা পরিতৃপ্তি পেলো রাইয়্যান, যা এর আগে কোনদিন অনুভব করেনি ও। রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবল রাইয়্যান, এতোটা শান্তি লাগছে, মনে হচ্ছে আজ এ মুহূর্তে মরে গেলেও কোন আফসোস থাকবেনা। মানুষ ভুল করে হীরে মনে করে কাঁচ তুলে আনে, আর আমি কাঁচ তুলতে গিয়ে এনেছিলাম হীরে। উঁহু, হীরে না, পরশ পাথর, যার ছোঁয়ায় বদলে গেছে আমার সবকিছু। সিরাতুল মুস্তাকিম এর সন্ধান পেয়েছি আমি, এই পথ ধরেই বাকি জীবনটা চলবো, ইন শা আল্লাহ!

ঠিক একই সময়ে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বিছানায় শুয়ে সিদ্রাও করলো এক নতুন জীবন শুরু করার প্রতিজ্ঞা, বলে উঠলো, ইন শা আল্লাহ্‌!

***
এবার সিদ্রার কথা বলা যাক। প্রথমত সবাইকে সত্য ঘটনা জানালেও লুকানো অংশটুকুর জন্য ঘটনাটার মধ্যে একটা ফাঁক থেকে গেছে। আর সেই ফাঁকটা ধরেই একদল মানুষ ধরে নিয়েছে গল্পটা বানানো। আসলে সিদ্রা কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো, এখন ফিরে এসেছে, সেটা ঢাকতেই এই বানোয়াট কাহিনী বানিয়েছে নিজাম সাহেব। আর আরেকদল বিশ্বাস তো করেছে, কিন্তু তার সাথে সতীত্ব হারানোর কলঙ্ক লেপন করে দিয়েছে সিদ্রার গায়ে।

জাহানার বেগম মেয়েকে ফিরে পেয়ে সুস্থ হয়েছেন, কিন্তু মানুষের কথা আর খোঁচার বিষে আবার বিছনাগত হওয়ার জোগাড়। শুনিয়ে যাচ্ছে সবাই, এমন কলঙ্কিত মেয়ে তাদের ঘরে থাকলে নাকি গলা টিপে মেরে ফেলতো, আর নাহলে সপরিবারে বিষ খেয়ে মরে যেতো। অথচ এদের অনেকের ছেলেমেয়েই প্রেম করে বিয়ে করেছে, কয়েকজন তো পালিয়েও বিয়ে করেছে, তারপরও তারা কোন মুখে অন্যকে খোঁটা দেয়, আল্লাহই ভাল জানেন।

সবথেকে বড় ধাক্কাটা পেল সিদ্রা ওর বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছ থেকে। জীবনটা স্বাভাবিক করতে মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু করেছিলো সিদ্রা। সেখানেও ওকে নিয়ে গুজুরগুজুর ফুসুরফাসুর চলে, বুঝতে পারে সিদ্রা, কিন্তু সামনাসামনি কেউ কিছু বলেনা দেখে পাত্তা দেয়নি ও। কিন্তু সেদিন মাদ্রাসা থেকে ফেরার পথে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড নাইমা বলল, “শোন, কিছু মনে করিসনা, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলেই বলছি, তিনমাস তো হয়ে গেছে, একবার প্রেগনেন্সি টেস্ট করিয়ে নিস। বেশি দেরী হয়ে গেলে কিন্তু কিছু করার থাকবেনা” কথাটা শুনে সিদ্রা যেন পাথর হয়ে গেলো, স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ওখানেই। যেখানে সিদ্রা ওকে ওখানে যা যা ঘটেছে সবটা খুলে বলেছে, অবশ্যই মুনিরার কথা লুকিয়ে। এমনকি যেসব কথা আব্বু আম্মুকেও বলেনি, সেসবও বলেছে ও নাইমাকে, সেখানে ও এরকম একটা নিকৃষ্ট চিন্তা কিভাবে করতে পারলো ভেবে পেলোনা সিদ্রা।

“এর থেকে তুই আমাকে একটা থাপ্পড় মারতে পারতি রে! আদর্শ বন্ধুর মতো পরামর্শ দিয়েছিস, অনেক ধন্যবাদ তোকে” চোখের পানিটা আর ওর সামনে না ফেলে হনহন করে হেঁটে চলে আসে সিদ্রা। বাসায় এসে শেষবারের মত প্রাণভরে কেঁদে নেয়। সারারাত ধরে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়, এভাবে চলবেনা। চাইলেও আর পুরনো জীবনটা ফিরে পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু তাই বলে বুবুর মতো নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিবেনা ও। আর কেউ না থাকুক, ওর পরিবার তো ওর পাশে আছে, সেটাই যথেষ্ট। যারা ওকে বিশ্বাস করেনি, ওর কথার দাম দেয়নি, তাদেরকে নিজের জীবন থেকে জাস্ট ছেঁটে ফেলবে ও। নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করবে, এমন যোগ্যতা অর্জন করবে যেন এই মানুষগুলোই একদিন ওর কথা বেদবাক্যের মতো মেনে নিতে বাধ্য হয়। কালকের সূর্যোদয় এর সাথে এক নতুন জীবনের জন্য পথচলা শুরু করবো, ইন শা আল্লাহ্‌!

পরদিন সকালে যখন নিজাম সাহেব মসজিদ থেকে ফিরে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন, তখন তার পাশে এসে বসলো সিদ্রা। মনযোগ দিয়ে শুনতে থাকলো আব্বুর তেলাওয়াত। সূরাটা শেষ করে কুরআন শরীফ বন্ধ করে স্নেহের দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি।

“কিছু বলবি মা?”

“হ্যাঁ আব্বু, আমি একটা কথা ভেবেছি, মনে হয়না তোমরা অমত করবে”

“তুই কোন অন্যায় কথা ভাবতেই পারিসনা। কি ভেবেছিস বল মা”

“আমি সামনেবার মেডিক্যাল এডমিশনের জন্য তৈরি হতে চাই, ডাক্তার হতে চাই আমি”

খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো নিজাম সাহেবের। দুই মেয়েকে মাদ্রাসায় সাইন্স নিয়ে পড়িয়েছিলেন এই আশাতেই। কিন্তু সিদ্রা পড়তে চায়নি পর্দা রক্ষার খাতিরে, আর মুনিরা মেডিকেলের পড়াশোনার প্রেশার নিতে পারবেনা বলে। সেজন্য বেশ মন খারাপ হয়েছিল তার। আর আজ সিদ্রা নিজে থেকেই তার সেই আশা পূরণ করতে চাচ্ছে, খুশি তো হবেনই।

“সেতো খুব ভাল কথা মা। কিন্তু হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত? আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের প্রতি জুলুম করছিসনা তো?”

“না আব্বু, ভেবে দেখলাম, যে সমাজ আমাকে দুচ্ছাই করছে, তাদের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করতে আর তোমাদের মুখ ফেরাতে এর কোন বিকল্প নেই। যদিও ভবিষ্যতে কি হবে আমরা কেউ জানিনা, তবু মনে হচ্ছে যে দুর্নাম রটেছে তাতে আমার কপালে বিয়ে শাদী লেখা নেই। তাই আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের দুইজনকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই” আগে হলে নিজের বিয়ের কথা আব্বুর সামনে কখনওই মুখে আনতে পারতোনা সিদ্রা। কিন্তু পরিস্থিতি ওকে এতোটা ম্যাচিউর হতে শিখিয়ে দিয়েছে।

বুকটা কেঁপে উঠলো নিজাম সাহেবের। কি সর্বনাশা ভবিষ্যতের কথা বলছে আমার মেয়ে। নাহ! আল্লাহ্‌ সুবিচারক। আমার নির্দোষ মেয়ের জীবনটা এতো কঠিন আর অনিশ্চিত করতে পারেননা তিনি। মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন নিজাম সাহেব, দুশ্চিন্তাটা প্রকাশ করলেননা সিদ্রার সামনে। “বিয়ে শাদী আল্লাহ্‌র হাতে রে মা, তিনি যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। এখন বরং আমার মেয়েটাকে কিভাবে ডাক্তার বানানো যায় সেই চিন্তা করি। কিন্তু ফাজিল কি একেবারে বাদ দিয়ে দিবি?”

“না আব্বু, সময়মত পরীক্ষা দিয়ে নিবো, ইন শা আল্লাহ্‌। কিন্তু শুধু শুধু মন খারাপ করার জন্য প্রতিদিন ক্লাস করতে যেতে চাইনা”

“বেশ, তোর যা ইচ্ছা তাই কর। এবার চটপট কি কি বই কিনতে হবে লিস্ট করে দে দেখি, অফিস থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসবো”

“আচ্ছা, এক্ষুনি যাচ্ছি” বলেই সিদ্রা দৌড়ে চলে গেলো নিজের ঘরের দিকে।

নিজাম সাহেব ফরিয়াদ জানালেন আল্লাহ্‌র দরবারে, “হে আল্লাহ্‌, আমার এক মেয়ের ভুলে আরেক মেয়ের জীবনটা তুমি পরীক্ষায় ফেলেছো, এবার তুমি ওকে সফল হওয়ার তাওফিক দান করো। নিজের বোনের জীবন নষ্ট না করে সমস্ত কলঙ্ক নিজের কাঁধে নিয়েছে মেয়েটা। ওকে তুমি ধৈর্য দিও, শক্তি দিও, সাহস দিও। ও যে ভয়টা পাচ্ছে সেটা যেন সত্যি নাহয়। ওর জন্য তুমি সঠিক সময়ে যোগ্য জীবনসঙ্গী পাঠিয়ে দিও, এর বেশি আর কিছুই চাইনা আমি”

***
এভাবেই শুরু হল সিদ্রা আর রাইয়্যানের নতুন এক জীবনের পথচলা। ক্ষণিকের জন্য মিলে যাওয়া দুই পথিকের পথ আবার চলতে শুরু করেছে নতুন গন্তব্যের দিকে। আশা করা যায় ভালো কিছুই ঘটবে ওদের জীবনে। কারণ আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, “আর ধৈর্য্যধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের কর্মফল বিনষ্ট করেন না”(সূরা হুদঃ১১৫)

এই ছিল সিদ্রা আর রাইয়্যানের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প, যে গল্পের কোন নাম ছিল না!

সমাপ্ত

2 COMMENTS

  1. Eta shottii mana jacche na. Jantam ending ta emoni hobe. Tarporo ekhon khub koshto hocche. Jodi etar season aro ashto khub khushi hotam!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here