যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব ৫+৬

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

৫.
এদিকে পরপর দুইবার স্যালাইন খেয়ে খুব জোর বাথরুম পেয়েছে সিদ্রার। ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে খালা খালা বলে, কোন সাড়াশব্দ নেই। ব্যাপার কি! বাথরুমও আর চেপে রাখা যাচ্ছেনা। এবার ডাকের সাথে নানারকম আল্টিমেটাম দেয়াও শুরু করল সিদ্রা।

“খালা, দরজা না খুললে কিন্তু ঘরে টয়লেট হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি খুলেন” এসব বলার পরেও যখন খালার দেখা পাওয়া গেলনা, তখন অসাধ্য সাধন করে ফেলল সিদ্রা। খাটটাকে টেনে জানালার কাছে আনল। তারপর বহু কসরৎ করে শরীরটা মোচড়ামুচড়ি করে জানালা দিয়ে বের করে আনল। মোটামুটি জান বের হয়ে গেল এতটুকু জানালা দিয়ে বের হতে গিয়ে। আর ওইপাশে তো কিছু ছিলনা, পায়ে একটু ব্যাথাও পেল। ভাগ্য ভাল যে ভাঙেনি কি মচকায়নি।

এর আগেও একবার এই চেষ্টা করেছিল ও, একদম প্রথমদিন সকালে। কিন্তু সেদিন কিছুতেই বের হতে পারেনি। আজকে প্রয়োজনের তাগিদেই হোক, আর না খেয়ে শুকিয়ে যাওয়ার কারণেই হোক, সফল হল সিদ্রা। পায়ে ব্যাথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতেই সোজা বাথরুমে দৌড় দিল। আহ! শান্তি!! বাথরুম করেও যে এত শান্তি পাওয়া যায়, আজকে জীবনের প্রথম উপলব্ধি করলাম, ভাবল সিদ্রা। গোপাল ভাঁড়ের গল্পটা কি আর এমনি এমনি হয়েছে!!!

এবার মাথায় এলো আসল চিন্তা। লোকটাও নেই আর মহিলাও নেই। এটাই তো সুযোগ পালানোর। বোরকাটা পরে আসি জলদি। যে ভাবা সেই কাজ, দৌড়ে বারান্দায় আসল সিদ্রা। তালা কি করে খুলব, এই চিন্তা করতেই দেখে দরজার সাইডেই একটা হুঁকে চাবি ঝোলান। আলহামদুলিল্লাহ্‌! বলে তালা খুলে ফেলল সিদ্রা। তাড়াতাড়ি করে বোরকাটা পরে ওই শাড়িছেড়া ওড়নাটা দিয়ে ভালভাবে নেকাব পরে ফেলল। বারান্দা থেকে নামার সময় একটু কৌতূহল হল, চলেই তো যাচ্ছি, পাশের ঘরটা কেমন ছিল একটু উঁকি মেরে যাই। এবং ভুলটা করল এখানেই।

আস্তে করে হেঁটে উঁকি মারতেই দেখে, খালা মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। দৌড়ে গেল সিদ্রা উনার কাছে। ডাক দিল, সাড়া নেই। গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা, হাত রাখা যাচ্ছেনা। জ্বরের প্রকোপেই অজ্ঞান হয়ে গেছে, বুঝল ও। দোটানায় পড়ে গেল সিদ্রা। কি করব আমি, পালাবো নাকি উনার জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করব! পালানোর এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলব? কিন্তু একজন অজ্ঞান মানুষকে ফেলে যাই কি করে, এতটা অমানবিক কিকরে হব?
একটু পরেই দেখা গেল সিদ্রা ওকে পরতে দেয়া শাড়িটার একপাশ ছিড়ে সেটা দিয়ে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। আর শরীর ভেজা গামছা দিয়ে মুছে জ্বর কমানোর চেষ্টা করছে। পালিয়ে ও যেতেই পারতো, কিন্তু বিবেক সায় দিলনা। ওরা অমানুষ বলে কি ওকেও অমানুষ হতে হবে নাকি!

একেতো ওর জন্য বৃষ্টিতে ভিজে খালার এই দশা। আবার এত তাপ গায়ে, তার মানে জ্বর অনেক আগেই এসেছে, সকালে হয়ত জ্বর গায়েই ওর জন্য রান্না করেছে। আর লোকটারো দুদিন ধরে পাত্তা নেই, কখন আসবে সেটাও তো বোঝা যাচ্ছেনা। ততক্ষণে মহিলার বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে যেতে পারে। এছাড়া এই ঘন জংগল থেকে যে ও নিজে আসলেই পালাতে পারবে, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই, কিছুই চিনেনা ও। বরং একটা মানুষের প্রাণ বাঁচানোই আগে দরকার, নাহলে পালিয়ে বাঁচলেও নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারতোনা সিদ্রা।

ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতেই নড়ে উঠল মহিলা। মুখ ফাঁক করল, যেন কিছু বলতে চাইছে। সিদ্রা কি করবে বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি করে চামচ দিয়ে পানি দিল ঠোঁটের ফাঁকে, খেয়ে নিল মহিলা। এভাবে বেশ খানিকটা পানি খাওয়ানোর পর মনে হল ওষুধ খাওয়াতে হবে। কিন্তু তার আগে তো কিছু খাওয়ানো দরকার।

রান্নাঘরে পাতিলে ভাত তরকারি সবই পেল সিদ্রা। জ্ঞান এসেছে ঠিকই, কিন্তু হুঁশ এখনো ফেরেনি মহিলার। গলার ভেতর থেকে গোঁ গোঁ একটা আওয়াজ আসছে, কথা বলতে পারলে হয়তো প্রলাপ বকত এতক্ষণ। অনেক চেষ্টা করেও কয়েক লোকমার বেশী খাওয়াতে পারলনা। এবার ওষুধ খোঁজার পালা।

এতক্ষণে ঘরটার দিকে ভাল করে নজর দেয়ার সুযোগ পেল সিদ্রা। ও যেটাতে ছিল, তার থেকে বেশ বড় ঘরটা। আর অনেক সুন্দর করে সাজানো গুছানো, যেন আধুনিক হোটেল রুম কিংবা কোন ভ্যাকেশন হোম। ঘরের মাঝখানে মশারি টানানোর স্ট্যান্ডসহ মাঝারি সাইজের সুন্দর একটা খাট, খাটের দুপাশে বেডসাইড টেবিল, একপাশে দারুণ একটা কাঠের আলমারি, ম্যাচিং ড্রেসিং টেবিল, জানালার পাশে একটা কফি টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি দুটো আরামদায়ক সোফা।

বাব্বাহ! এখানে এসে নিশ্চয় কেউ সময় কাটায়, ভাবল সিদ্রা। ওই মহিলার নিজের ঘর এটা হতেই পারেনা।

আলমারি, বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার কোথাও কোন ওষুধ পেলনা সিদ্রা। লাস্ট বাকি আছে শুধু ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার। “আল্লাহ্‌! এখানেই যেন পাই, তুমি দেখো” বলে ড্রয়ার খুলল সিদ্রা।

“আলহামদুলিল্লাহ্‌”, প্যারাসিটামল সহ ইমার্জেন্সিতে প্রয়োজন এমন সব ওষুধই আছে ড্রয়ারে। তাড়াতাড়ি করে একটা প্যারাসিটামল গুলে খাইয়ে দিল খালাকে।

বিকালের দিকে জ্বর কমে আসল। এর মধ্যে সিদ্রা খালি দুইবার নামাজ পড়ার জন্য উঠেছে, এছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও জলপট্টি দেয়া থামায়নি। যতবার চোখ খুলেছে মহিলা ততবার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছে ওর দিকে, হয়ত ভাবতে পারছেনা সিদ্রা এখানে কিভাবে এল অথবা সিদ্রা উনার সেবা করছে সেটা বিশ্বাস করতে পারছেনা কিংবা দুটোই।

মাথায় পানি ঢাললে হয়ত আরো তাড়াতাড়ি জ্বর নামতো, কিন্তু সমস্যা হল মহিলা এত ভারী যে, সিদ্রা চেষ্টা করেও উনাকে খাটের উপরে তুলতে পারেনি, সেজন্য মাথায় পানি ঢালা সম্ভব হয়নি।
আলমারি থেকে চাদর বের করে মেঝেতে বিছিয়ে উনাকে গড়িয়ে ওইটার ওপর এনেছে। তারপর গায়ে কাঁথা দিয়ে দিয়েছে।

যাই হোক, মাগরিবের আগে আগে পুরোপুরি জ্বর ছেড়ে গেল। মহিলা তখন ঘুমাচ্ছে। সিদ্রা ভাবছিল, এখন পালাবে কিনা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত হয়ে যাবে। অচেনা জংগলে যেখানে দিনে কিভাবে পালাবে সেটা বুঝতে পারছিলনা, সেখানে এখন তো আরো অসম্ভব। তার ওপর ওইদিন গাছে আটকে থাকার সময় রাত হয়ে যাওয়ার পর যে ভয় পেয়েছিল, সেটা ভেবেও বুক কেঁপে উঠলো ওর। তাই, আপাতত বাদ দিল পালানোর চিন্তা। আল্লাহ্‌ যদি আমার কপালে মুক্তি লিখে রাখেন, তাহলে সুযোগ আবার আসবে, ইন শা আল্লাহ্‌, ভাবল সিদ্রা।

রাতের বেলা ফিরে এল লোকটা।

এশার নামাজ শেষ করে সোফার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে নামাজের পরের তসবিগুলো গুনছিল সিদ্রা। বুদ্ধি করে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে এসেছে, যাতে লোকটা এসে দরজা খুলতে গেলে ও শব্দ শুনে বুঝতে পারে। আর এ ঘরের দরজাও ভেজিয়ে রেখেছে।

একটু তন্দ্রা এসে গেছিল সিদ্রার, সে সময়ই শুনল ওর ঘরের দরজা খোলার শব্দ। তন্দ্রা ছুটে গেলেও ঘুমের ভান করে পড়ে রইল সিদ্রা। মুখটা এমনভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে যাতে চোখ বন্ধ দেখে বুঝা যায় যে ও ঘুমাচ্ছে।

“খালা, খালা, মেয়েটা কোথায়?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকল লোকটা। ঢুকেই থমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল, যেন পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। জল পট্টি দেয়ার বাটি আর কাপড় খালার পাশেই পড়ে আছে, যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। হালকা করে খুলে চোখের কোণ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সিদ্রা। তেলের বাতির আলো-আঁধারি ওর অভিনয় আরো সহজ করে দিল। লোকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে, যেন ঘুম ভাঙাতে চাইছেনা। ওর দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে চোখ বুজে ফেলল সিদ্রা।

লোকটা একদম সিদ্রার মুখের কাছে এসে বোঝার চেষ্টা করল, ও আসলেই ঘুমাচ্ছে কিনা। তারপর খালার শিওরে বসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরখ করল। তারপর আস্তে করে ডাকল খালাকে।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল খালা। হাত নাড়িয়ে কথা বলতে লাগল ইশারায়, সব বুঝতে পারলনা সিদ্রা, তবে মাঝেমাঝে ওর দিকে ইশারা করল। লোকটা যেন পুরো হতভম্ব হয়ে গেছে।

“আপনি জানেননা ও কিভাবে বেরিয়েছে?”
“চোখ খুলে দেখলেন ও আপনার মাথায় জল পট্টি দিচ্ছে?”
“আপনাকে খাইয়েও দিয়েছে?”

প্রতিটা প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল মহিলা। লোকটা সিদ্রার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। “আনবিলিভেবল! এই মেয়ের মধ্যে দয়ামায়া বলে কিছু আছে!! কিন্তু তালা লাগানো ঘর থেকে ও বের হল কিভাবে এটাই তো বুঝতে পারছিনা, যাদু জানে নাকি!” চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লোকটা।

“যাকগে, সেবা যখন করেছে তখন ঘুমাক, ডাকবনা এখন। তুমি একটু দেখোতো, কিছু খাবার আছে নাকি? প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে”

এইরে, আমিও তো কিছু খাইনি রাতে, মনে পড়ল সিদ্রার, এখন তো না খেয়েই থাকতে হবে। খালা উঠে গেল, একটু পরেই থালায় করে সকালের ভাত তরকারি নিয়ে এসে দিল।

“ভাত? আমি না তোমাকে বলেছি ওকে ভাল খাবারদাবার না দিতে!”

খালা উত্তরে মনে হয় সিদ্রার ডায়রিয়া হওয়ার খবর দিল।

“তাহলে ভালই করেছো, সামান্য ডায়রিয়াতে টুস করে মরে গেলে আমার জ্বালা মিটতোনা। প্রতিশোধ নেয়া হতনা আমার। আমি ওকে তিলেতিলে মারব। আমাকে দেয়া কষ্টগুলো শতশত গুণ করে আমি ওকে ফিরিয়ে দিব“

আরো কিছু বলুক, কোন কষ্ট কিসের কষ্ট, সব খুলে বলুক লোকটা, মনেপ্রাণে চাইছে সিদ্রা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আর কিছু বললনা লোকটা।

খাওয়া শেষে বলল, “খালা, আমি পাহারায় থাকছি, তুমি আজ রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমাও।“ এই বলে আলমারি থেকে কয়েকটা জিনিস নিয়ে বের হয়ে গেল লোকটা।

খালা থালাবাটি এসব পরিষ্কার করে বাতিটা নিভিয়ে দিল। সিদ্রার গায়ের ওপর কিছু একটা চাপিয়ে দিল। নেড়ে দেখল কাঁথা, মুচকি হাসি ফুটে উঠল সিদ্রার ঠোঁটে। খালার মন ওর প্রতি নরম হয়েছে, বুঝল সিদ্রা। আলহামদুলিল্লাহ্‌, পালাতে না পারলেও অনেক বড় উপকার হয়েছে আমার। শব্দে বুঝল, বিছানায় শুয়ে পড়ল খালা। পেটে ক্ষুধা নিয়েও বন্দী জীবনে প্রথমবারের মত মনে প্রশান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সিদ্রা।

***
একটা পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্রা। চারিদিকে অন্ধকার। সামনেই পূবাকাশে ভোরের আভাস দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে উঠছে চারপাশ। এত সুন্দর দৃশ্য কোনদিন দেখেনি সিদ্রা। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়, সারবেধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝ দিয়ে রূপালী ফিতার মত একটা নদী বইছে। ও যেটাতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাই যেন সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোরের সূর্যোদয়ের দম আটকানো সৌন্দর্য উপভোগ করছে সিদ্রা। সারা পৃথিবী যেন সূর্যের আলোয় আস্তে আস্তে প্লাবিত হচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করল, ও একদম পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আর নিচে অতল খাদ মুখ ব্যাদান করে আছে। আচমকা কে যেন ধাক্কা মারল। পড়তে শুরু করল ও, চিৎকার করে উঠলো সজোরে, কিন্তু নিজেই নিজের চিৎকার শুনতে পাচ্ছেনা। স্লো মোশানে নিচে পড়ছে তো পড়ছেই, তল পাচ্ছেনা কোন, এ অবস্থাতেই কেউ একজন ওর হাত ধরল। এসময় ঘুমটা ভেঙে গেল।

আতঙ্কিত হয়ে সোফায় সোজা হয়ে বসল সিদ্রা। পুরো শরীর ঘামে চপচপ করছে। অস্বাভাবিক ভাবে ঘুমানোর জন্য ঘাড় সোজা করতে পারছেনা। কোনমতে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হল সিদ্রা। বুঝলো, তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গেছে বলেই ঘুম ভেঙেছে। বাথরুমে যাবার জন্য দরজা খুলতেই দেখল, দরজার বাইরেই লোকটা ওর ওই খাটে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। এমনভাবে যে, খাট না সরিয়ে ওইপাশে যাবার উপায় নেই।

কি করবে বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। লোকটার ঘুম ভেঙে গেলে হয়তো নামাজ পড়াই বাদ হয়ে যাবে। দরজাটা লাগিয়ে আগের মত খাওয়ার পানি দিয়েই অজু করে ফেলি। নিঃশব্দে অজু নামাজ সেরে নিল সিদ্রা। আজকে আর বোকামি করলনা, মোনাজাতও আস্তে আস্তেই করল। তারপর সোফায় বসে জানালার ঠাণ্ডা বাতাসে চোখ বুজল। কি অদ্ভুত জায়গা, ভাবছিল সিদ্রা, যেন দুনিয়ার বাইরে কোথাও। পাখিদের কিচিরমিচির ছাড়া কোন শব্দও শুনতে পাইনা। আজানও শোনা যায়না, লোকালয় মনে হয় অনেক দূরে। জানালা দিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করতেই স্বপ্নের কথা স্মরণ হল সিদ্রার।

ভোরের আলো, তবে কি শিগগিরই মুক্তি পাব আমি! কিন্তু তারপরে তো আবার কে যেন ফেলে দিল খাদের ভেতরে। তাহলে কি আরো বড় বিপদে পড়ব? আবার কেউ একটা হাতও ধরল। কিন্তু পড়তে পড়তে হাত ধরলেই বা কি, বাঁচাতে তো পারবেনা। আদৌ কি কোন তাবীর আছে এ স্বপনের, নাকি পুরোটাই আমার কল্পনা, ভাবল সিদ্রা।

দরজা খুলে লোকটা ঘরে ঢুকতেই স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এল সিদ্রা, তাকাল উনার দিকে। মাত্র ঘুম থেকে ওঠা চেহারা, পুরো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে, একটু হাস্যকর আর বোকাবোকা লাগছে লোকটাকে। সিদ্রাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যেন একটু বিব্রত হল লোকটা। কিছু না বলেই বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দিল বাইরে থেকে। এসবে এখন অভ্যস্ত সিদ্রা, আর কিছুই মনে হয়না। আর কালকের পর কেন যেন মনের বিশ্বাস বেড়েছে, পালাতে পারবে ও।

– Farhina Jannat

৬.

চুলায় ভাতের পাতিল বসিয়ে তরকারি কাটছে সিদ্রা। লোকটা হুকুম দিয়েছে, আজকে রান্নাবান্না সব কাজ সিদ্রা করবে। খালা অবশ্য আপত্তি করছিল, বুঝতে পেরেছে সিদ্রা, কিন্তু লোকটা মানেনি। সকালের নাস্তায় সবাই চা মুড়ি খেয়েছে, অবশ্যই চা টা সিদ্রাকেই বানাতে হয়েছে।

রান্না না করলেও মাঝে মাঝে আম্মুকে হেল্প করতো সিদ্রা। তরকারি কাটতে জানি, রান্নাও হয়ত করতে পারব। কিন্তু আমি এসব করছি কেন, আলু কাটতে কাটতে ভাবল ও। একজন অসুস্থ মানুষের জন্য রান্না করছি, নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিল সিদ্রা।

আজকে চুলা জ্বালাতে আগের দিনের মত কষ্ট হয়নি। লোকটা সেই আগের দিনের মত চেয়ারে আয়েশ করে বসে পা দুটো টেবিলে তুলে দিয়েছে। তবে পার্থক্য হল, আজকে সারাক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে না থেকে মোবাইল টিপছে আর মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে। মোবাইলটা কোনভাবে হাত করে বাসায় ফোন দিতে হবে, ভাবছে সিদ্রা। কিন্তু আমি কোথায় সেটাই তো জানিনা, কি বলব আমি। অবশ্য আমি কোথা থেকে ফোন করেছি, সেটা হয়ত পুলিশ বের করতে পারবে। কিন্তু মোবাইলটা হাতে পেলে তো!

লোকটা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ও কিভাবে বের হয়েছে ঘর থেকে। ও কোন উত্তর দেয়নি। বলে দিলেই যে জানালাটা আর থাকবেনা সেটা ও ভালই বুঝতে পারছে। লোকটা আর জোরাজোরি করেনি তখন, কিন্তু পরে আবার জানতে চাইবে বলে মনে হয়েছে সিদ্রার।
“মহারাণী, চুলা তো নিভে গেল” লোকটার কথায় বাস্তবে ফিরে আসল সিদ্রা।

নিভে যাওয়া চুলা আবার ধরাতে হল সিদ্রাকে। এইসব নানান চিন্তাভাবনা করতে করতে আর বারবার নিভে যাওয়া চুলা জ্বালাতে জ্বালাতে ভাত রান্না করতেই লেগে গেল প্রায় এক ঘণ্টা। তারপর চুলায় তরকারি তুলে দিয়ে আন্দাজ করে মশলাপাতি দিয়ে দিল। যা হয় হবে, আল্লাহ ভরসা।

অনভ্যস্ত হাতে অবশেষে যখন রান্না শেষ করে ও উঠে দাঁড়ালো, কালিঝুলি মেখে, ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বেলাও গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। গোসল করতে হবে, এটাই প্রথম মাথায় আসল। লোকটার দিকে তাকাতেই দেখে, লোকটা কেমন একটা চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর লোকটা যা বলল, তাতে আরো একবার মন খারাপ হয়ে গেল সিদ্রার।

***
একটা বালতি হাতে জঙ্গলের মাঝে দিয়ে একটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটছে সিদ্রা। পেছনে ওই লোকটা। বাথরুমের বালতি আর রান্নাঘরের ড্রাম, দুই জায়গার পানিই শেষ হয়ে গেছে। এখন থেকে পানি তোকেই আনতে হবে বলে লোকটা ওকে বালতি হাতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ও বুঝতে পারছেনা। তবে ওইদিন যেদিকে গেছিলো, সেদিকে না। রাস্তাটা এতই অস্পষ্ট যে বুঝা যাচ্ছে, তেমন মানুষ চলাচল নেই এ রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝে লোকটা ডান বাম শুধরে দিচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছে, আসলে আর নিতে পারছেনা ও। লোকটার কথা ওকে আরো দুর্বল করে দিয়েছে।

“এটাই তোর উপযুক্ত লুক” লোকটা সন্তুষ্টির সাথে বলেছিল ওর কালিঝুলি মাখা চেহারার দিকে তাকিয়ে।

প্রথমে ও বুঝতে পারেনি। তখন লোকটা ওকে ধরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সারামুখে কালি আর ঘামে ওকে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। বারবার চুলার কালিমাখা হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছাতে গিয়ে এই দশা হয়েছে। আর এই কালিমালিপ্ত মুখটাই ওর উপযুক্ত চেহারা! ও এত খারাপ এই লোকটার কাছে!!

“ডানে” আবার চিন্তার জগত থেকে ফিরে এল সিদ্রা। জংলা রাস্তা দিয়ে হাঁটার অভ্যেস নেই, তার ওপর ঝোপঝাড়ের কাঁটায় বারবার বোরকা আটকে যাচ্ছে বলে দেরী হচ্ছে আর লোকটা বিরক্ত হচ্ছে।

“ঢং করে আবার বোরকা পরে আসা হয়েছে” বিড়বিড় করে বলল লোকটা।

যখন সিদ্রার মনে হতে লাগল যে, এ পথ আর শেষ হবেনা, সেই মুহূর্তেই এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল যে বিস্ময়ে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল। এত সুন্দর! কিছুক্ষণের জন্য ও সবকিছু ভুলে গিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকল।

“সুবহানআল্লাহ!” মুখ দিয়ে স্বভাবতই বেরিয়ে এল আল্লাহর প্রশংসা।

সামনে একটা পাহাড়ের দেয়াল। একটা ছোট ঝর্ণা ঝিরঝির করে নামছে সেই দেয়াল বেয়ে। কান পাতলেই তার মধুর আওয়াজ কানে আসছে। ঝর্ণার পানি পড়ে একটা বড় দিঘীর সাইজের জলাশয় তৈরি হয়েছে। জলাশয়ের চারিদিক ঝোপঝাড়ে ভরা, আর তাতে অজস্র রঙবেরঙ এর বুনোফুল ফুটে আছে। জলাশয়ের পানি একদম টলটলে, দেখলেই মনে হয় একটা ডুব দিয়ে আসি।আশেপাশে পাখির কলরব আর বুনোফুলের গন্ধে পুরো মেতে আছে জায়গাটা। লোকটা যেন ওর মনের কথা পড়ে ফেললো। এক ধাক্কায় যখন ওর হুঁশ ফিরে এল, ততক্ষণে ও পানিতে।

পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগল সিদ্রা, সাঁতার জানেনা ও। লোকটা কি আমাকে পানিতে ডুবিয়ে মারবে নাকি! বোরকা পানিতে ভিজে ভারী হয়ে গেছে আর শরীর তো আগে থেকেই দুর্বল হয়ে আছে। হাত পাও সেভাবে ছুড়তে পারছেনা। অনেক্ষন হাবুডুবু খেয়ে যখন হাল ছেড়ে দিয়ে নিচে নামতে লাগল, মারা যাচ্ছে মনে করে ইস্তেগফার পড়া শুরু করল। আব্বু-আম্মু আর বোনের চেহারা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। কান্না পেল সিদ্রার কিন্তু পানিতে কি আর কাঁদা যায়। পুরো জীবন যেন ফ্ল্যাশব্যাক এর মত চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে হল, আব্বু আম্মু আর বোনকে আরেকবার দেখতে পাওয়া ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই ওর। ওদের থেকে অনেক দূরে এক অজানা স্থানে ও ডুবে মরছে। ওরা হয়ত কোনদিন জানতেও পারবেনা। আল্লাহ্‌ তুমি ওদের ভাল রেখো, শেষ প্রার্থনা করল সিদ্রা।

যখন মনে হল দম ফুরিয়ে আসছে, ঠিক তখনি ওর পা মাটিতে ঠেকল, আর ও অটোমেটিক্যালি ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠলো। বুকভরে শ্বাস নিল সিদ্রা। আহ! বেঁচে থাকা যে কত আনন্দের, হাড়ে হাড়ে টের পেল। কিন্তু আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলনা।

পা সোজা করতেই পুরো বোকা বনে গেল। পানির মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পানি মাত্র ওর গলা পর্যন্ত। এতক্ষণ শুধু আতঙ্কেই এসব করছিল! ছি ছি!! শয়তান লোকটার সামনে পুরো গাধা হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখে লোকটা প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন মজা দেখছে। এ আর নতুন কি, আমার সব কাজেই তো উনি মজা পান, আর এটা তো পুরা গাধার মত কাজ হয়েছে, ভাবল সিদ্রা।

মুখ দিয়ে কেমন চু চু শব্দ করল লোকটা। “ইশ! প্ল্যানটা সফল হলনা, না!! ভেবেছিলি, সিনেমার হিরোদের মত তোকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিব। তারপর তোকে তুলে আনব। বুকে চাপ দিয়ে পানি বের করব। তারপর জ্ঞান না ফিরলে মুখে মুখ লাগিয়ে তোর জ্ঞান ফিরাব, তাইনা?” পায়চারি করতে করতে হাত নেড়ে নেড়ে অভিনয় করে বলছিল লোকটা কথাগুলো।

ছি ছি! লজ্জায় পানিতেই ডুবে মরতে ইচ্ছে হচ্ছে সিদ্রার। নিজের বোকামির জন্য কত নোংরা কথা শুনতে হচ্ছে। নিজের সাফাই গাওয়ারও মুখ রইলো না। মুখ নিচু করে মিনমিন করে বলল,
“আমি সাঁতার জানিনা, তাই হঠাৎ করে ভয় পেয়ে গেছিলাম। তার জন্য এত বাজে কথা শোনানোর কি আছে!”

তখনি মনে পড়ল, লোকটাই তো ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। ঝট করে তাকালো ও।
“আপনি আমাকে ধাক্কা মারলেন কেন?”

“আমার ইচ্ছা। যেভাবে হা করে তাকিয়েছিলি, আমি ভাবলাম একটু ভাল করে কাছ থেকে দেখ” কেমন একটা বিচ্ছিরি হাসি দিল লোকটা। দেখে আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সিদ্রার।

যাক, পানিতে যখন নেমেই গেছে, তখন মুখ হাত এখানেই ধুয়ে নিই। যেই ভাবা সেই কাজ। পানিকে আয়না বানিয়ে কচলে কচলে মুখ ধুয়ে নিল। এবার উঠতে গিয়ে টনক নড়ল। সব তো ভিজে গেছে। এখন এই ভেজা কাপড়ে এই লোকের সামনে কিভাবে উঠব!

“কিরে, আমি কি তোকে সাঁতার কাটতে এনেছি! উঠে আয় তাড়াতাড়ি, সারাদিন পড়ে নেই আমার”

“আমি উঠতে পারবনা”

“উঠতে পারবিনা কেন? এই যে এপাশের নিচু ঢাল দিয়ে উঠে আয়” ডানদিকে নির্দেশ করে বলল লোকটা।

মাথা নাড়লো ও। “আমি উঠতে পারবোনা আপনার সামনে, আপনি গিয়ে খালাকে পাঠান”

“আমাকে কি গাধা পেয়েছিস? আমি যাই খালাকে ডাকতে, আর তুই পালানোর চেষ্টা কর”

আরে তাইতো, এটাতো ভাবেনি। লোকটা নিজেই ওকে বুদ্ধি দিয়ে দিল। থ্যাংকইউ, মনে মনে খুশি হয়ে গেল সিদ্রা। কিন্তু পরের কথা শুনেই দমে গেল।

“অবশ্য পালাতে তো আর পারবিনা, কোনদিক দিয়েই পালানো সম্ভব না। শুধু শুধু আমাদের হয়রানি করবি। এখন ফালতু প্যাঁচাল না পেড়ে উঠে আয়।“

জোরে জোরে মাথা নাড়ল ও। “আমি মরে গেলেও ভেজা কাপড়ে আপনার সামনে উঠতে পারবনা।“

“ওরে ঢং! একটু আগে আমাকে সিডিউস করার জন্য পানিতে ডুবার নাটক করছিলি, আর এখন সতী সাজছিস!! তুই পারিস বটে!!! এমনি এমনি কি আর ছেলেদের ঘোল খাওয়াস!!!”

রেগে গেল সিদ্রা, “আমি কোন ঢং করছিনা। আমি ভয়ে আতঙ্কে ওরকম করেছি, ইচ্ছা করে না। আপনি বিশ্বাস না করলে না করেন। কিন্তু আমি ভেজা কাপড়ে আপনার সামনে উঠতে পারবনা মানে পারবনা”

“ঠিক আছে। আমিও দেখি তুই কতক্ষণ থাকতে পারিস পানিতে” লোকটা একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। মোবাইল টিপছে আর একটু পর পর সিদ্রার দিকে তাকাচ্ছে।

মেয়েটা পুরো চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে গলা পর্যন্ত পানিতে। মেয়েটাকে যত দেখছে, আস্তে আস্তে অবাক হচ্ছে লোকটা। সদ্যস্নাত চেহারাটা বড্ড নিষ্পাপ লাগছে। কিন্তু সে খুব ভাল করেই জানে, এই নিস্পাপ চেহারাটা একটা মুখোশ। ও একটা শয়তান মেয়ে। ওকে দেখলে কে বলবে, ওর ভেতরটা এত কুৎসিত! ওই নিষ্পাপ চেহারায় মায়ায় সে ফাঁসবে না। কিন্তু তার জানার সাথে মিলছেনা কেন মেয়েটার কোন কাজ। মানুষ কি এতখানি অভিনয় করতে পারে! এমন মেয়েরা হয়ত পারে।

যেমন, কালকে ও খালার জন্য যেভাবে সেবা করেছে, সেটা পুরাই অকল্পনীয়। ওর মত একটা মেয়ে, যার কাছে মানুষের আবেগ-অনুভূতি খেলার জিনিস, সে ওই কাজটা কেন করল। প্রতিদিনের নামাজ-কালাম আর বেশী বেশী পর্দা করা যে ঢং, সেটা তো আমি আগেই বুঝেছি। কিন্তু কালকে ও যখন বের হতে পারল, তখন পালিয়েই তো যেতে পারতো। সেটা না করে খালার সেবা কেন করতে গেল, এখনো বুঝতে পারছিনা। এটাও কি আমার কাছে নিজেকে ভাল প্রমাণ করার চেষ্টা? হুম, সেটাই হবে, সিদ্ধান্তে পৌঁছল লোকটা।

পলপল করে বয়ে যাচ্ছে সময়, সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, খেয়াল করল সিদ্রা। লোকটা বুঝতে চাইছেনা কেন, অবশ্য লোকটার যে ধারণা ওর সম্পর্কে তাতে ওকে বিশ্বাস না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু লোকটার এসব ধারণার উৎস আর আমার এই দুর্ভোগের কারণ কি আমি কোনদিন জানতে পারব, ভাবছিল সিদ্রা। লোকটা না নিজে কিছু খুলে বলছে, না আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করলে সিদ্রা সাহস করে বলে উঠলো,
“আপনি এমন করছেন কেন? নামাজ কাযা হয়ে যাচ্ছে তো! আপনি না হয় নিজে নামাজ পড়েননা, তাই বলে কি অন্যকেও পড়তে দিবেননা?”

“এত জ্ঞান দিসনা তো, খুব নামাজের প্রতি মোহাব্বত দেখাচ্ছে, নটংকী কোথাকার, তোর মত মেয়ের মুখে এসব ধর্মের জ্ঞান শুনলে আরো রাগ উঠে আমার। তোকে কি আমি উঠতে না করেছি, নিজেই তো উঠছিসনা।“

“ধুর! সবসময় এক কথা” মনে মনে বলল সিদ্রা।

আস্তে আস্তে আলো কমে আসছে, দেখল সিদ্রা। তাকিয়ে দেখল লোকটাও অধৈর্য হয়ে উঠছে, উসখুস করছে। ফোনের কি চার্জ শেষ নাকি? এই অবস্থাতেও হাসি পেল ওর কথাটা চিন্তা করে।

“তুই কি সত্যিই উঠবিনা?” অবশেষে নিরবতা ভাঙল লোকটা।

“না” দৃঢ় স্বরে বলল সিদ্রা। ওর স্বরে কি যেন একটা ছিল, লোকটা উঠে দাঁড়ালো। “ঠিক আছে, আমি তোর কথা মানব, কিন্তু একটা শর্ত আছে”

“কি শর্ত?”

“আমাকে সত্যি সত্যি বলতে হবে তুই কাল ঘর থেকে কিভাবে বের হয়েছিস। যদি মিথ্যে বলিস, আমি তোকে সারারাত এই পানিতেই চুবিয়ে রাখবো।“

হা হয়ে গেল সিদ্রা, বলে কি লোকটা!

“আর আমি যে চাইলেই সেটা করতে পারি, তাতে আশা করি তোর কোন সন্দেহ নাই। সো, জলদি জলদি সত্যি কথাটা বলে দে”

ঢোক গিলল সিদ্রা, কি করবে বুঝতে পারছেনা।

“জলদি!” তাড়া দিল লোকটা।

ঠিক আছে, সত্যি বলে দেয়াই ঠিক মনে করল সিদ্রা। “আমি জানালা দিয়ে বের হয়েছি”

এবার লোকটার হা হওয়ার পালা। “তুই ওইটুকু একটা জানালা গলে বের হয়ে এলি! মাই গড!! তুই যে এত চিকনাচাকনা, তোকে দেখে তো বোঝা যায়না” কিছু বললনা সিদ্রা।

“আচ্ছা, তোর কথা আপাতত আমি বিশ্বাস করলাম, যাচ্ছি আমি খালাকে ডাকতে, তুই উঠে আয়” অনেকক্ষণ তো হল, যেই পোষাকে ও আমার সামনে উঠে আসছেনা, সেই পোষাকে ও পালাতে যাবেনা। আর সন্ধ্যে হয়ে আসছে, রাতের বেলা অচেনা জংগলে পালানোর সাহস হওয়ার কথা না। আরও বেশিক্ষণ থাকলে শেষে জ্বর বাঁধাবে, এসব ভেবে হাঁটা দিল লোকটা।

লোকটা গাছের আড়াল হতেই ভয় লাগতে লাগল সিদ্রার। বনে জঙ্গলে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। আলো ফুরিয়ে আসছে। উনি যাওয়ার পর খালা আসতে আসতে তো রাত হয়ে যাবে, আর ততক্ষণ এখানে একা থাকলে আমি ভয়েই মরে যাবে। এত ঝোপঝাড়, সাপ-খোপ থাকা বিচিত্র নয়। তাড়াতাড়ি করে পাড়ে উঠলো সিদ্রা।

গায়ে সেঁটে থাকা বোরকাটা আলগা করার ব্যার্থ চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। না পেরে নিচের দিকটা একটু চিপে, ঝেড়ে নিল। ওড়নাটাও খুলে দ্রুত হাতে চিপে নিল, তারপর ঝেড়ে আবার গায়ে পেঁচাল এমনভাবে, যাতে যথাসম্ভব কম শরীর বোঝা যায়। এরপর বালতি নিয়ে নিচে নেমে পানি ভরলো। কিন্তু ভরা বালতি নিয়ে তো আর পাড়ে আর উঠতে পারেনা। খালি পানি পড়ে যায়। লোকটা থাকলে হয়ত বালতিটা ধরতো, ভাবল সিদ্রা। কি করবে এখন! এই পানি দিয়েই রাত পার করতে হবে ওর। অনেকবার চেষ্টার পর আধ বালতি পানি নিয়ে পাড়ে উঠতে সক্ষম হল। এবার দ্রুত চলতে শুরু করল রাস্তা দিয়ে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে আর রাস্তা দেখতে পাবোনা, এই ভেবে হাঁটার গতি আরো দ্রুত করল। কিন্তু শীত করছে কেন এত? ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সিদ্রা। শরীরটাও দুর্বল লাগছে, কিন্তু হাঁটা থামালনা। মাথাও ঘুরতে লাগল একটু পর। বুঝতেও পারলনা ও, রাস্তা ছেড়ে ঢুকে যাচ্ছে বনের মধ্যে।

(চলবে)

বিম 😁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here