যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (১১)
~মিহি
১১.
চার দেয়ালের ঘরটাতে নিজেকে বন্দি মনে হচ্ছে সন্ধির। জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা সে ইতোঃমধ্যে খেয়েছে। নয়ন নামক পুরুষটাকে তার বিয়ে করতে হবে এটা সে কখনো কল্পনাও করেনি। রামিলা পারভীনের মুখেও অন্যরকম হাসি। গোলাপ দিয়ে ছেলের বাসর সাজিয়েছেন তিনি। পুরোনো ধাঁচের দোতলা বাড়ি এটা। বাড়িতে কেবল রামিলা পারভীন ও একটা কাজের মেয়ে থাকে। নয়ন বিদেশে চাকরী করে, বছরের অধিকাংশ সময় তার বিদেশেই কাটে। নতুন এ জীবনকে কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছে না সন্ধি। পড়াশোনা করে অনেক বড় কিছু করার স্বপ্ন ছিল তার। মাহিদের যোগ্য হয়ে উঠে তাকে চাওয়ার ইচ্ছেটাও আর পূরণ হলো না। মানুষের জীবনে নাকি অতৃপ্ত ইচ্ছে থাকতে হয়, থাকতে হয় অপ্রাপ্তি কিন্তু যে অপ্রাপ্তি জীবনকেই অর্থহীন করে তোলে সে অপ্রাপ্তির আবশ্যকতা কতটুকু?
নয়ন ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো। বধূবেশে সন্ধি বিছানায় বসে। বাচ্চা মেয়ের উপর লাল বেনারসিটা দারুণ মানিয়েছে। সাজসজ্জাহীন মুখে ক্লান্তির পরশ মুখটাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নয়নের মনঃর মধ্যে সব ঘেঁটে যাচ্ছে। কথা বলতেও যেন ভুলে গেছে সে। সন্ধিকে পাওয়ার মুহূর্ত যেন তাকে আরো দুর্বল করে তুলেছে। ধীরে ধীরে সন্ধির পাশে এসে বসে নয়ন।
– ‘সন্ধি..’
– ‘এমনটা করতে পারলেন নয়ন ভাই? আমার জীবনটা এভাবে শেষ করতে পারলেন?’
– ‘সন্ধি, তোমার পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না। বাড়ির পাশেই স্কুল, কালকেই আমি তোমাকে ভর্তি করে আসবো আর যে যে বিষয়ের প্রাইভেট লাগবে বলো আমায়।’
– ‘বিয়ে করার আগে একবারও জানতে চেয়েছিলেন এ বিয়েতে আমার মত আছে কিনা?’
– ‘খালা বললো…’
– ‘তিনি বললেন আর আপনি মেনে নিলেন? আমার মুখ থেকে শোনার প্রয়োজন বোধ হলো না?’
– ‘তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করতে?’
– ‘বিয়ের আগে যখন জানতে চাননি, তখন বিয়ের পর শুনে আর কী করবেন। আমাকে হাসিল করাই তো ছিল আপনার উদ্দেশ্য। করে নিয়েছেন হাসিল, এখন যা ইচ্ছে করুন।’
– ‘এত খারাপ ভেবো না আমাকে। বিয়ের আগে আমি তোমার অনুমতি নেইনি কারণ খালা বলেছিলেন তুমি লজ্জা পাচ্ছিলে। তোমার অনুমতি ছাড়া আমি তোমায় স্পর্শ করবো না।’
কথাটা বলেই বালিশ আর চাদর নিয়ে মেঝেতে বিছানা করলো নয়ন। সন্ধি সেদিকে ফিরেও তাকালো না। যে সর্বনাশ লোকটা করেছে তার সামনে এসব আদিখ্যেতার কোনো মূল্য নেই।
ভারী শাড়িতে ঘুম আসছে না সন্ধির। বারবার এপাশ-ওপাশ করছে। নয়ন খেয়াল করলো বিষয়টা। সন্ধিকে কিছু বলতে গেলে হয়তো রেগে যাবে তবুও ঝুঁকি নিল নয়ন।
– ‘সন্ধি, ব্যাগে তোমার বেশ কিছু কাপড় আছে। চেঞ্জ করে নেও।’
– ‘করবো না চেঞ্জ। আপনার কী সমস্যা?’
– ‘আমার উপর রাগ দেখিয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়া বন্ধ করো সন্ধি। এতটা বোকা অন্তত তুমি নও।’
নয়নের কথায় গুরুত্ব দিল না সন্ধি। চুপচাপ পাশ ফিরে রইল। নয়ন আর ব্যর্থ চেষ্টা করলো না। সন্ধিকে বিয়ে করে সে ভুল করে ফেলল না তো? সন্ধির মনে অন্য কেউ নেই তো? কী করে সে সন্ধির মন জয় করবে তবে?
_______________
তূর্ণার ঠিক সামনে বসে আছে রাফি। রাফির কপালে ব্যান্ডেজ। তূর্ণা সমানে ফোঁপাচ্ছে। রাফিকে ভুল বুঝে সে অনেক বড় ভুল করেছে। যে টেক্সটটা পেয়ে সে সন্ধির জীবন নষ্ট করলো, সে টেক্সট রাফি করেইনি। রাফিকে দুদিন বন্দি রাখা হয়েছিল। বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিল সে। আচমকা তানজীম আর নিহাল মিলে তাকে বেঁধে ফেলে। রাফির ফোন থেকে টেক্সটটা তানজীম করেছিল আর তূর্ণার ভিডিও করাটাও ওদেরই ষড়যন্ত্র ছিল। তূর্ণার খাবারে চেতননাশক ওষুধ মিশিয়েছিল নিহাল। রাফি যখন তূর্ণাকে নিয়ে বাগানবাড়িতে পৌঁছায় তখন তানজীম আর নিহালও গিয়েছিল পিছু পিছু। জানালার এক কোণ থেকে ভিডিও শ্যুট করে তারা। পরবর্তীতে তূর্ণাকে ব্ল্যাকমেইল করে। এসবের উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা। তূর্ণার কাছে রাফিকে খারাপ বানানো আবার সন্ধিকে ভোগ করার সুযোগ পাওয়া। তূর্ণার ফোঁপানো বেশ বিরক্ত লাগছে রাফির।
– ‘তূর্ণা, তুমি থামবে? এত অবিশ্বাস আমার প্রতি? যেখানে তুমি আমাকে বিশ্বাসই করো না, সেখানে অযথা ভালোবাসার ভং ধরার তো কোনো মানে হয় না।’
– ‘রাফি, আমি ভিডিওটা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো আর কী করবো না। তাছাড়া আগের দিন থেকে তোমার নম্বর বন্ধ। আমি কিভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতাম?’
– ‘এত ঠুনকো বিশ্বাস নিয়ে ভালোবাসা যায় না তূর্ণা। তোমায় খুব কাছে পেয়েও আমি কোন ক্ষতি করিনি তোমার। কেন জানো? কারণ আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসটা ভাঙতে চাইনি আমি।’
– ‘রাফি, আমায় মাফ করে দাও প্লিজ।’
– ‘তুমি সন্ধির সাথে যা করেছো, তাতে আমি তোমায় মাফ করবো না। নেহা ম্যাম সন্ধির বাড়িতে জানানোর পর ওর মা ওকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে তাও সবার অগোচরে। তুমি ভাবতে পারছো এটা কত বড় একটা ব্যাপার? তুমি আগে সন্ধির মাকে গিয়ে সব সত্যি বলবে।’
– ‘আচ্ছা আমি বলবো। তবুও তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ।’
– ‘যা বলেছি সেটা আগে করো।’
রাফির এমন রুদ্রমূর্তি আগে দেখেনি তূর্ণা তবে সে যে বিরাট বড় একটা ভুল করেছে তাও সত্যি। সন্ধির মাকে সত্যিটা জানিয়ে যদি কোনোভাবে সন্ধির পড়াশোনা বন্ধ হওয়া থেকে বাঁচানো যায় তাও হয়তো রাফি তাকে মাফ করবে।
তূর্ণা সন্ধির বাড়িতে এসে অনুধাবন করলো আরেক ভয়ানক সত্য। সন্ধির বাড়িতে তালা দেওয়া। তার মানে সন্ধির মাও বাড়িতে নেই। তিনি যে কখন আসবেন তাও জানেনা তূর্ণা। মন খারাপ করে বারান্দায় বসে রইল সারা দুপুর। বিকেলের দিকে এক দম্পতি এসে সন্ধির বাড়ির তালা খুলল। বিস্মিত তূর্ণা তার মাকে ডাকল। তূর্ণার মাও সন্ধিদের বাড়িতে অপরিচিত দম্পতিকে দেখে অবাক। তাদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে নিজের বাড়ির ফটক পেরিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। দম্পতিদের মধ্যে উভয়কেই ত্রিশ-একত্রিশ বছর বয়সী মনে হচ্ছে, সাথে কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর কথা শুরু করলেন তূর্ণার মা।
– ‘আপনারা কি সায়েরা আপার পরিচিত কেউ? না মানে কখনো দেখিনি তো এদিকে।’
– ‘আমরা তো আজকেই এখানে এসেছি। আমার আর আমার স্বামীর ইচ্ছে ছিল গ্রামের দিকে একটা বাড়ি কেনার। সায়েরা আপার থেকে আমরা তার বাড়িটা কিনেছি।’
– ‘কি..কিনেছেন মানে? এটা তো ওনার স্বামীর বাড়ি। ভাইজান ওনাকে বাড়ি বেচতে দিল?’
– ‘উনি তো বলেছিলেন উনি বিধবা, সেজন্য বাড়ি বিক্রি করে ফেলতে চান।’
রীতিমতো দুজনের কথাবার্তা চলছেই। এদিকে এ ঘটনার সবটুকু তূর্ণার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সায়েরা খালা বাড়ি কেন বেচতে যাবে? তাছাড়া সবেই তো সন্ধির বিয়ে হলো, এখন ঘরবাড়ি বেচে তিনি কোথায় গিয়ে উঠলেন? সবকিছুর মধ্যে অদ্ভুত একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে তূর্ণা।
_____________
মাহিদের চিন্তারোগ ধরেছে। সন্ধি এখনো ফোন ধরেনি, ফোন বন্ধ তার। এত রাগ কেন মেয়েটার আল্লাহ ভালো জানেন। দেড় মাসের কাজ এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ করার জন্য রীতিমতো নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে মাহিদ। যে করেই হোক, গ্রামে ফিরতে হবে। সন্ধি কী অবস্থায় আছে তা জানতে হবে। তাছাড়া মা ভাবছেন চাচাজানের ঠিক করা পাত্রী অর্থাৎ নেহার প্রেমেই পড়েছে মাহিদ আদতে যা সত্যি নয়। সবদিক থেকে বিষয়গুলো কেন যেন পেঁচিয়ে যাচ্ছে। ক্রোমাটিন তন্তুর মতো সুতোর কুণ্ডলী পাকাচ্ছে পরিস্থিতি। মাহিদ এখনো নিজের পরিবারকে বলে উঠতে পারেনি সে নিজের এক ছাত্রীর প্রেমে পড়েছে। বললে বাড়িতে মানবে না এমনটা নয় তবে চাচাজান কখনোই মানবেন না। তার বদ্ধমূল ধারণা শিক্ষক কখনো তার ছাত্রীর সাথে প্রণয় কিংবা বিবাহ বন্ধনে জড়াতে পারেনা। এটা অনৈতিক এবং অত্যন্ত অসামাজিক কাজ। চাচাজানকে কিভাবে রাজী করাবে তা মাহিদের জন্য এক যুদ্ধের সম।
চলবে…
(