যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (৩)
~মিহি
৩.
মাহিদের বাহুতে সজোরে ধাক্কা দিল সন্ধি, ঠিক ক্রোধের কারণেই নাকি কী কারণে যেন দানবীয় শক্তি ভর করেছে। মাহিদ কদম দুই পেছালো, স্তব্ধ নয়নে সন্ধির হিংস্র অভিব্যক্তিটা দেখল কেবল। মাহিদকে ধাক্কা মারার মিনিট খানেক পর সন্ধির মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল যেন এতক্ষণ কী হয়েছে সে বুঝেই উঠেনি। ক্লাসের মেয়েরা একবার মাহিদের দিকে তাকাচ্ছে, একবার সন্ধির দিকে। সন্ধি অবুঝের মতো তাকিয়ে আছে। মাহিদ ধীর পায়ে সন্ধির সামনে এলো।
– ‘ঠিক আছো তুমি?’
– ‘সবাই এভাবে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে?’
– ‘কিছুনা। তুমি কাঁদছিলে তাই।’
– ‘আমি? কখন?’
– ‘এসব রাখো। ক্লাসে মনোযোগ দাও।’
– ‘স্যরি স্যার।’
মাহিদ মাথা নেড়ে সন্ধির দিকে তাকালো। গালের একপাশে আবছা হাতের ছাপ। লালচে হয়ে আছে গালের সে অংশে। ব্যাপারটা কিঞ্চিত বুঝলো মাহিদ। ক্লাসের বাকি সময়টা মাহিদ একটা ক্ষুদ্র গল্প ন্যারেট করে শোনালো, ‘দুই বন্ধু এক মরুভূমির মধ্য দিয়ে হাঁটছিল। কোন এক কারণে প্রথম বন্ধু দ্বিতীয়জনকে থাপ্পড় মারে, বন্ধুটি তা বালির উপর লিখে রাখে। পথিমধ্যে যখন বন্ধুটি চোরাবালিতে আটকে পড়েছিল তখন দ্বিতীয় বন্ধুটি তার প্রাণ বাঁচায়। এবার প্রথম বন্ধু সেটি লিখে রাখে পাথরে। বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করে এর কারণ। তখন প্রথম বন্ধু এর কারণ হিসেবে বলেছিল থাপ্পড় মারার ঘটনা সে বালিতে লিখেছে যেন মরুভূমির বালিগুলো লেখাটা চাপা দেয়। দ্বিতীয়ত সে জীবন বাঁচানোর কথা পাথরে লিখেছে যাতে তা আমৃত্যু রয়ে যায়। কিছু বুঝলে তোমরা এ গল্প থেকে?’ সবাই একজন অপরজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মাহিদ আবারো জিজ্ঞাসা করলো, ‘যে যে গল্পের মানেটা বুঝেছো হাত তোলো।’ পুরো ক্লাসে কানাকানি-ফিসফিস শুরু হলো। এরই মাঝে বেশ চঞ্চল প্রকৃতির অস্থিরচিত্ত এক মেয়ে আধখানা হাত তুলে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলো। মাহিদ লক্ষ করলো। ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বললো।
– ‘স্যার, আমি বুঝেছি গল্পটা।’
– ‘কী বুঝেছো বলো।’
– ‘এটাই যে প্রথমে বন্ধুকে থাপ্পড় দিতে হয় তারপর বাঁচাতে হয়।’
মেয়েটার ব্যঙ্গ করার সুরে বলা কথাগুলো শুনে ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল। মাহিদ নিজেও হালকা হাসলো। প্রসারিত সে ঠোঁটের ভাঁজে কতগুলো চোখজোড়া যে খেই হারালো তা তার ভাবনাতেও এলো না।
ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়লো। শীটগুলো ক্লাস ক্যাপ্টেনকে দিয়ে সবাইকে দিতে বললো। ক্লাস রুম থেকে বের হওয়ার আগে কী ভেবে যেন সন্ধির কাছে এলো, ‘তুমি ছুটির পর আমার সাথে দেখা করে তারপর যাবে।’ সন্ধি মাথা নাড়লেও সে যে আসবেনা এ বিষয়ে নিশ্চিত মাহিদ। এটা বোঝার জন্য যদিও বিশেষ কোনো ক্ষমতা নেই তার তবুও তার প্রতি সন্ধির বিরক্তিটা সে আঁচ করতে পারে।
_________________________________________________
– ‘স্যার, আসবো?’
ফোন থেকে চোখ তুললো মাহিদ। সন্ধির ভাবলেশহীন মুখ দেখে অনেকটাই বিস্মিত হলো। সন্ধি আসবে তা ভাবনাতেও আসেনি মাহিদের। সন্ধিকে সে আসতে বলেছিল ছুটির পর, সন্ধি এখনি এসেছে। স্টাফ রুম জনশূন্য এখন। এমতাবস্থায় সন্ধির সাথে কথা বলা ঠিক হবে কিনা ভেবে দোটানায় পড়লো। এর মধ্যে সন্ধি আবারো নমনীয় স্বরে বললো, ‘স্যার আসবো?’ মাহিদ আসতে বললো। সন্ধি মাহিদের চেয়ারের সামনাসামনি দাঁড়ালো।
– ‘স্যরি স্যার। আমি ইচ্ছে করে আপনাকে ধাক্কা দেইনি। আমি বুঝতেই পারিনি আমি কখন আর কেন আপনাকে ধাক্কা দিলাম।’
– ‘এসব আবার কে বললো তোমায়?’
– ‘সবাই বললো। আমি সত্যিই ইচ্ছে …’
– ‘বসো। আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে করোনি।’
– ‘তার মানে মাফ করে দিয়েছেন। আমি যাই তাহলে?’
– ‘কিছু প্রশ্ন করবো।’
– ‘আমি ইংরেজি পারিনা স্যার। কাল পড়ে এসে উত্তর দিই?’
– ‘তূমি যে এত কথা বলো তা আগে জানতাম না তো, নিতান্তই সরল সোজা ভেবেছিলাম। বসো আগে।’
– ‘বলেন স্যার।’
– ‘তুমি কী কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত? সচরাচর যারা অনেক বেশি টেনশন করে,তাদের এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে।’
– ‘আপনি আমাকে পাগল বলছেন?’
– ‘না রে মেয়ে। পাগল বলিনি, আচ্ছা থাক কিছু বলার দরকার নেই। তুমি শুধু অযথা চিন্তা বাদ দিয়ে মনোযোগ দিয়ে ক্লাসগুলো করো। যতদূর শুনেছি নেক্সট উইকে তোমাদের সারপ্রাইজ টেস্ট হতে পারে।’
– ‘ইন্না লিল্লাহ…’
– ‘বাসায় গিয়ে ভালোমতো পড়াশোনা করবে। এখন ক্লাসে যাও। আর কোনো সমস্যা থাকলে আমায় জানিয়ো।’
সন্ধি মাথা নাড়লো। মোহগ্রস্তের মতো সন্ধি স্টাফ রুম থেকে বের হলো। বের হওয়ার আগে আরেকবার মাহিদের দিকে তাকালো। যতটা বিরক্তিকর ভেবেছিল সে, ততটা বিরক্তিকর নেই এই মানুষটা। সন্ধির মনে এখন আসলেই অনেক চিন্তা বাসা বেঁধেছে। তূর্ণা ভুল পথে যাচ্ছে, রাফি ছেলেটা ঠিক নয় তার জন্য। বাবা-মায়ের মধ্যে কাল আবারো একটা ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সন্ধি। মা-বাবার ঝগড়া দেখার পর থেকে সন্ধির একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে প্রেমের বিয়ে কখনো টেকে না। প্রেম বিয়ের আগ অবধিই থাকে, বিয়ে হলেই তা ফানুস হয়ে উড়ে যায়। সেজন্যই তো তার শহরে প্রেমের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। তার শহরে যে প্রেমে পড়া বারণ।
ক্লাসে বসে শত চেষ্টা করেও মনোযোগ আসলো না সন্ধির। চোখ বারবার চলে যাচ্ছে বাইরে বিস্তৃত মাঠের দিকে। খোলা প্রান্তরে পক্ষীর ন্যায় উড়তে পারলে ভালো হত, দূর আকাশে ভেসে বেড়ানো যেত। বিরাট বটবৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে কাক কিংবা কোকিলের স্বরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমতো। এই পড়াশোনা নামক বিদঘুটে বস্তুটার তিক্ত স্বাদ নিতে হতো না। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো তার। কল্পনার জগতে বিচরণ শুরু হলো। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এগোতে লাগল স্বপ্নে দেখা দোলনাটার দিকে। আর এক পা, তাহলেই দোলনা ছোঁবে সে। এমন সময় আবারো পেছন থেকে টান পড়লো। সন্ধি কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসলো। না চাইতেও কল্পনার জগতেও তার বিচরণকে সীমাবদ্ধ করছ কেউ। স্বপ্নে খাঁদে পড়ে যাওয়া, এখন এগোতে না পারা- কল্পনার জগতেও সে বন্দি আত্মা হয়ে উঠছে ইদানিং।
– ‘এই সন্ধি! এখনো রেগে আছিস আমার উপর? রাগিস না সোনা। আমি ইচ্ছে করি চিঠিটা রাখিনি ওখানে।’
– ‘হঠাৎ আমাকে দরকার পড়লো কেন তোর?’
– ‘ছুটির পর তোকে ছাড়া যাই নাকি আমি?’
– ‘আমি একবার তো বলে দিয়েছি, আবার কেন এসেছিস? একা ছেড়ে দে আমাকে।’
সন্ধির নিষেধ সত্ত্বেও তূর্ণা তার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো। সন্ধির মন কিছুটা গলেছে। তূর্ণার সাথে করা ব্যবহারের জন্য তার মাফ চাওয়া উচিত। সন্ধি বুঝে উঠতে পারছে না কথাটা কিভাবে শুরু করবে। এর মধ্যে তূর্ণা সন্ধিকে থামালো।
– ‘কীরে এখানে দাঁড়ালি কেন? পুকুরঘাট এলাকা যত তাড়াতাড়ি পেরোনো যায় তত ভালো। দেখছিস না কী নির্জন!’
– ‘একটু দাঁড়া না বোন। ও আসবে।’
– ‘তূর্ণা! এই জন্য তুই আমার সাথে আসতে চাচ্ছিলি? ছিঃ! আর ও কেমন ছেলে, এই নির্জন জায়গা কেন ডাকলো তোকে? তুই এখনো বুঝছিস না ওর মতলব কী?’
– ‘উফ! তুই না একটু বেশি বেশিই বলিস। মতলব আবার কী? স্কুলের বাইরে দেখা করলে কেউ দেখে ফেলতো, সেজন্যই এখানে ডেকেছে।’
– ‘যে কাজ লোকসমাজকে দেখানো যায় না, তা করার দরকারটাই বা কী?’
– ‘জ্ঞান দেওয়া বন্ধ করে দাঁড়া তো।’
সন্ধির ইচ্ছে করছে চলে যেতে কিন্তু তূর্ণাকে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। রাফি এসে ডাকলো তূর্ণাকে। তূর্ণা একটু এগিয়ে গেল। সন্ধি দূরে দাঁড়িয়ে রইল। রাফি যত্নবান প্রেমিকের মতো তূর্ণার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিল। অহেতুক শরীরের দিকে তাকালো না, চোখজোড়া অবনমিত। সন্ধির তবুও মনের সংকোচ মিটলো না। রাফির গোটা বংশ রাজনীতি করে, সে নিজেও ঠাঁট বজায় রেখে চলে। এমন শর্ট টেম্পারড ছেলে! তার উপর তূর্ণাও জেদী। ছোটখাটো সমস্যা হলেই এদের সম্পর্ক ভেঙে যাবে, দিনশেষে দুজনেই কষ্ট পাবে।
চলবে…