#রংধনুর_রঙ_কালো
২২.
অরিন রান্নাঘরের এই মাথা থেকে ওই মাথা পাগলের মতো দৌড়াতে লাগলো। দিশেহারা হয়ে প্রায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে সে৷ তার আশেপাশে এখন কোনো আলো নেই, শব্দ নেই, অক্সিজেন নেই। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতিতে শুধু ভেতর থেকে টালমাটাল সর্বনাশা এক স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। যা তার সবকিছু ভয়ংকরভাবে এলোমেলো করে দিচ্ছে। অরিনের গায়ের সাথে লেগে রান্নাঘরের কিছু সরঞ্জাম ধুমধাম মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দ তুললো। সেই শব্দে দৌড়ে এলেন নুসাইবা। উৎকণ্ঠিত চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” কি হয়েছে মা?”
অরিন কোনো শব্দ করতে পারলো না। সে শব্দ করতে ভুলে গেছে। কারো ডাকে সাড়া দিতে হয় এটাও সে ভুলে গেছে। পৃথিবীতে যে তার অস্তিত্ব আছে এই বিষয়েও এখন সে উদাসীন। শুধু বিরবির করে এক মনে কি যেনো বলতে বলতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো অরিন। নুসাইবা মুখে দুই হাত চেপে বেশ জোরে এক চিৎকার দিলেন। শায়িখ সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ঘটনাস্থলে আসলেন। তিনি দেখলেন তাঁর পুত্রবধূ মেঝেতে শুয়ে ক্রমাগত কাঁপছে। তার শরীরের এই অদ্ভুত ঝাঁকুনি দেখে ভয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেললেন নুসাইবা। শায়িখ সাহেব দ্রুত গিয়ে অরিনকে কোলে তুললেন। নুসাইবা এক পাশ থেকে ধরলেন। দু’জন ধরাধরি করে অরিনকে বিছানায় নিয়ে এলেন। শায়িখ সাহেব তাড়াহুড়ো করে বললেন,” পানি, পানি দাও।”
নুসাইবা পানি আনলেন। জোর করে অরিনের মুখে পানি দিতে গেলে অরিন এতো জোরে শরীর ঝাঁকালো যে পানির গ্লাস পর্যন্ত উল্টে পড়ে গেল। নুসাইবা ভয়ে এইবার দূরে সরে দাঁড়ালেন। এক কোণায় গিয়ে ভীত দৃষ্টিতে অরিনের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে তাদের সামনেই জ্ঞান হারালো। অদ্ভুত বিষয় হলো, অচেতন অবস্থাতেও অরিনের চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছিল। শায়িখ সাহেব মোবাইল নিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলেন। ডাক্তার অনলাইনের মাধ্যনেই ভিডিওজলে অরিনের চেকাপ করলেন। তারপর জানালেন প্রচন্ড শকে অরিনের খিঁচুনি উঠে গেছিল। স্ট্রোক হতে নিয়েও হয়নি। তবে রোগীকে খুব সাবধানে রাখতে হবে। নয়তো যে কোনো সময় স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে৷ এমনও হতে পারে এক স্ট্রোকেই মৃত্যু! নুসাইবা আর শায়িখ সাহেব ভেবে পেলেন না অরিন কি এমন শকিং নিউজ শুনেছে৷ ডাক্তার কিছু মেডিসিনের নাম লিখে একটা প্রেসক্রিপশন পিডিএফ তৈরী করে দিলেন। সেই পেসক্রিপশন দেখিয়ে শায়িখ সাহেব নিকটস্থ ফার্মেসী থেকে ঔষধ সংগ্রহ করে আনলেন।অরিনকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। ডাক্তার তাকে ঘুমের ঔষধ দিতে বলেছেন। কারণ তার এখন মানসিক প্রশান্তি সবথেকে বেশি প্রয়োজন। মস্তিষ্কের দীর্ঘ আরাম প্রয়োজন। নুসাইবা শেষবার যখন অরিনের সাথে কথা বলেছিলেন তখনি খেয়াল করেছিলেন অরিন খুব চিন্তিত৷ কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলার পর থেকেই মেয়েটা অন্যরকম হয়ে গেছিল। তাই তিনি অরিনের মোবাইলে দেখার চেষ্টা করলেন যে অরিন আসলে তখন কার সাথে কথা বলেছিল। আর কি এমন খবর শুনেছে যে তার এই অবস্থা হয়ে গেল! এই কাজ নুসাইবা একা একা করলেন৷ শায়িখ সাহেবকে কিছু জানতে দিলেন না। তিনিও অরিনের মতো দূর্বল হৃদয়ের মানুষ। একটু আঘাতেই স্ট্রোক করে বসতে পারেন যেকোনো মুহুর্তে। নুসাইবা মনে মনে খুবই খারাপ চিন্তা করছেন। ইলহানের কোনো খোঁজ নেই৷ ছেলেটার কি কিছু হয়েছে? সেই দুঃসংবাদ শুনেই কি অরিনের এই অবস্থা? উফফ, নুসাইবা আর কিচ্ছু ভাবতে পারছেন না। তাঁর মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা তৈরী হলো। অরিনের মোবাইল ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে লক। নুসাইবা ঘুমন্ত অবস্থাতেই অরিনের ফিংগার প্রিন্ট নিয়ে মোবাইল খুললেন। তারপর ডায়াল লিস্টে শেষ যে নাম্বার থেকে কল এসেছিল সে নাম্বারেই কল দিলেন৷ অস্ট্রেলিয়ান একটা নাম্বার। ওই পাশ থেকে বিদেশী একজন পুরুষ তাঁর নিজস্ব ভাষায় বললেন,” হ্যালো,মেলবোর্ন ইস্ট পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি।”
অরিন সারারাত বেহুশের মতো ঘুমিয়ে কাটালো। তাকে খুব ইফেক্টিভ ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিল। তাই তার ঘুম ভাঙলো অনেক দেরিতে। সকাল এগারোটায়। চোখ খুলে অরিন প্রথমেই জায়গাটা চিনতে পারলো না। এই মুহুর্তে সে কোথায় আছে? আড়মোড়া ভেঙে আশেপাশে তাকালো। তারপর ভয়ে চমকে উঠলো। একটা চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলো। অরিনের পাশে ইলহান ঘুমিয়ে আছে৷ তার গাঁয়ে টকটকে লাল রঙের টি-শার্ট। ব্রাউনিশ চুলগুলো হালকা উড়ছে। ইলহানকে খুব ফ্রেশ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাত্র গোসল করে শুয়েছে। অরিন চোখ কচলে আরও ভালো করে তাকালো৷ তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ঘটনাটা। সে ইলহানের ঘরে কিভাবে আসলো? গতরাতের কোনো কিছুই তার তৎক্ষণাৎ মনে পড়লো না। যখন সে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিচ্ছিল আর আয়নায় নিজের চেহারা দেখছিল তখন হঠাৎ করেই সব মনে পড়ে গেল। এক দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আবার বিছানার কাছে আসলো সে। ইলহানকে ছুঁয়ে দেখলো। চোখেমুখে স্পর্শ করলো। আসলেই কি জ্বলজ্যান্ত মানুষটা এখানে শুয়ে আছে? তার কি নিশ্বাস আছে? অরিন ইলহানের নাকের কাছে হাত রাখলো নিঃশ্বাসের প্রবাহ বোঝার জন্য। অরিনের এমন অত্যাচারে ঘুমন্ত ইলহান চোখ-মুখ কুচকে জেগে উঠলো। এক চোখ খুলে অরিনকে দেখেই মুচকি হেসে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। অরিনের হাত ধরে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললো, ” গুড মর্ণিং!”
অরিন স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে খানিক পিছিয়ে গেল। ইলহানের হাসি তাকে আরও অবাক হতে বাধ্য করলো। অরিন একটু এগিয়ে এলো। বিস্মিত চেহারায় কণ্ঠ শীতল রেখে বললো,” তুমি এখানে কিভাবে এলে?”
ইলহান হেসে বললো,
” আমি কিভাবে আসলাম মানে? নিজের বাড়িতে আসবো না?”
অরিন আগের ভঙ্গিতেই বললো,” গতরাতে আমার কাছে খবর এসেছিল তোমার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
ইলহান চোখ ছোট করে বললো,
” তাই নাকি?”
” হুম। এক্সিডেন্টে তুমি মারা গেছিলে।”
ইলহান অবাক হয়ে বললো,
” ও মাই গড! নিজের মৃত্যুর খবর নিজেই জানি না? আচ্ছা অরিন, তাহলে কি আমি এখন আত্মা হয়ে গেছি? এই, একবার চেক করে দেখো তো আমাকে। আমার শরীরের টেম্পারেচার চেক করো। শুনেছি আত্মাদের হাত-পা নাকি ভয়াবহ রকমের ঠান্ডা হয়। আমার হাত-পা কি ঠান্ডা? তোমাকে ধরে যে উঠলাম তখন খেয়াল করেছিলে? আমাকে ছুঁয়ে তোমার কি মনে হয়েছে? বরফ?”
অরিন অতিমাত্রার বিভ্রান্তি নিয়ে ভ্রু কুচকে চেয়ে বললো,” না।”
” তাহলে কি? নরমাল?”
” হুম।”
” তাহলে মনে হয় তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছো। মাঝে মাঝে এমন হয়। আসলে আমরা যাদের খুব ভালোবাসি, যাদের হারানোর ভয় পাই তাদের নিয়েই এমন ধরণের দুঃস্বপ্ন দেখি। তুমি এদিকে এসো। তোমাকে বুঝিয়ে বলি দুঃস্বপ্নটা কেনো দেখলে।”
” এই ফাজিল ছেলে, মেয়েটার সাথে ফাজলামি করছিস কেনো? একটা চড় দিবো।”
নুসাইবা ইলহানকে শাসিয়ে অরিনের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে রুমে ঢুকলেন। ইলহান মায়ের দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে দিল। অরিন এখনও ভীষণ বিভ্রান্ত। কারো কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না৷ নুসাইবা অরিনের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” এখন কি অবস্থা মা?”
ইলহান বললো,” অবস্থা ভালো৷ দেখছো না, উঠেই প্রশ্ন শুরু করেছে দিয়েছে? তার মানে সব নরমাল।”
” তুই চুপ কর। যা তোর বাবার কাছে যা। আমি অরিনের সাথে একটু একান্তে কথা বলবো।”
” ওকে।”
ইলহান চলে যাওয়ার পর নুসাইবা হাত ধরে অরিনকে বিছানায় বসালেন। অরিনের চেহারায় প্রশ্নের ভীর। নুসাইবা বললেন,” ঘটনা কি হয়েছে আমি তোমাকে বলি। গতকাল রাতে আমরা হসপিটালে গিয়েছিলাম৷ ইলহান সন্ত্রাসীদের হাতে কোমড়ে ছুঁড়ি খেয়েছিল। তারপর ওর বন্ধু ওকে হসপিটালে নিয়ে গেছে। এক ব্যাগ রক্ত লেগেছে। আর মৃত্যুর খবরটা ভুল ছিল। আসলে কি হয়েছে, ইলহান হসপিটালের যেই নং ওয়ার্ডে ছিল তার ঠিক পাশের ওয়ার্ডেই ওর মতো আরেকটা ছেলে ছিল৷ ওই ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছিল আর ইলহান ছুঁড়ি খেয়েছিল।এখন দু’টোই তো পুলিশ কেইস। তাই পুলিশের কাছেই দু’জনের বাসায় ইনফরমেশন পাঠানোর দায়িত্ব। এই বিষয়টাতেই গড়মিল হয়েছে। ইলহান তো তোমার মোবাইল নাম্বারই পুলিশদের দিয়েছিল। আর যে ছেলেটা সত্যিই মারা গেছে তার মোবাইল খুঁজে বাড়ির নাম্বার বের করা হয়েছিল। এখন তোমাকে যে খবর দেওয়ার কথা সেই খবর ওই ছেলের পরিবারের কাছে চলে গেছে। আর তোমার কাছে এসেছে ওই ছেলেটার এক্সিডেন্টের খবর। মানে নাম শুদ্ধো পুরো ব্যাপারটাই পুলিশরা গুলিয়ে ফেলেছিল। বুঝেছো?”
অরিন দুই হাতে মাথা জাপটে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতোবড় ভুল? নুসাইবা বললেন,” তাও যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। অঘটন কিছু ঘটতে নিয়েও ঘটেনি। তুমি একবার সেই পরিবারের মানুষের কথা চিন্তা করে দেখো তো, যাদের বলা হয়েছিল তাদের বাড়ির ছেলে সুস্থ আছে। হসপিটাল থেকে নিয়ে যেতে। কিন্তু হসপিটালে যাওয়ার পর তারা সুস্থ ছেলেকে আর নিয়ে যেতে পারলো না। নিয়ে গেল মৃতদেহ। আমি কি ঠিক করেছি জানো মা? আজ যোহরের ওয়াক্তে নফল নামায আদায় করবো৷ অনেক বড় একটা বিপদ কেটেছে আমাদের।”
অরিন হালকাভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। নুসাইবা আরও বললেন,” এই ঘটনায় তোমার উপর সবচেয়ে বেশি ঝড় গেছে। তোমার তো একদম খিঁচুনি চলে এসেছিল। অনেকবার সেন্সলেসও হয়ে গেছিলে। তোমাকে নিয়ে যে কত চিন্তায় ছিলাম! এখন ভালো আছো তো মা?”
” জ্বী মা, ভালো আছি।”
অরিন আপাতত কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু সব ঠিক হয়ে গেছে এই ভেবে মনে অদ্ভুত একটা শান্তি আসলো। নুসাইবা অরিনকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং টেবিলে এলেন। শায়িখ সাহেব নয়টার আগেই ব্রেকফাস্ট করে ফেলেছেন। নুসাইবা ইলহান-অরিনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এখন তিনি ছেলে আর ছেলের বউয়ের সাথে খাবেন। ইলহানও খেতে বসেছে। এমন সময় কলিংবেল বাজলো। নুসাইবা টেবিল ছেঁড়ে উঠতে নিলে অরিন বাঁধা দিয়ে বললো,” আমি খুলছি মা। আপনি বসুন।”
অরিন দরজা খুলতেই ছোট-খাটো একটা সাইক্লোন বয়ে গেল পুরো রুমজুড়ে। সোফিয়া তড়িৎ গতিতে এসে ইলহানের গলা জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু দিতে দিতে বললো,” বেইবি, ক্লিফোর্ডের কাছে এসব আমি কি শুনলাম? ও নাকি তোমাকে রাস্তা থেকে তুলে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে? তোমাকে নাকি সন্ত্রাসীরা ছুঁড়ি মেরেছিল? এই ঘটনা কি সত্যি?এত্তোবড় সাহস তাদের? পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছো না? এবার ক্রিমিনালদের খুঁজে পাওয়া গেলেই হলো। ইশশ, এক ব্যাগ রক্ত লেগেছে তোমার তাই না? আমার খুব আফসোস হচ্ছে৷ তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেনো?”
সোফিয়ার ঝটপট ইংরেজি হয়তো তেমন ভালো করে বুঝতে পারেননি নুসাইবা। কিন্তু তিনি এমনভাবে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন যেনো এখনি মাথা ঘুরে চেয়ারসহ উল্টে পেছনদিকে পড়ে যাবেন। মনে হচ্ছে তাঁর প্রেশারও বেড়ে গেছে। অরিনের কাছে এসব এখন একদম স্বাভাবিক। সে নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল। আচ্ছা, কালরাতে ওই ফোনটা যদি অরিনের কাছে না এসে সোফিয়ার কাছে আসতো তাহলে সে কি করতো? ইলহানের লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদার জন্য হসপিটালে ছুটে যেতো? নাকি অরিনের মতো কিছু করার আগে নিজেই শেষ হয়ে যেতো?
চলবে
– Sidratul Muntaz