রিকশা পর্ব -০৬

#রিকশা
।।৬।।
বার বার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে দেখছিল পারভেজ। এই মেয়েটা এত দেরি করছে কেন!
গত কয়েক মাস ধরেই নিয়ম করে প্রতিদিন শুভ্রার ফোনে কল আর মেসেজ করে গিয়েছে সে। এত দিন পর শুভ্রার জবাব পেয়ে আর এক মুহূর্তও দেরি করতে পারেনি।
ছুটে এসেছে সাথে সাথেই, যত দ্রুত সম্ভব! আর এই মেয়েটা কিনা ভেতরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোনের ভয়ে কাঁপছে!
অধৈর্য লাগছে পারভেজের। মনটা চাচ্ছে ভেতরে ঢুকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে আসে শুভ্রাকে।
এনে চোখের সামনে বসিয়ে রেখে সব কথা খুলে বলে, যা বলতে চাচ্ছে গত কয়েক মাস ধরেই, কিন্তু সুযোগটাই হয়ে উঠছে না।
সেই ভয়াবহ দিনেই বেছে বেছে ফরেন ডেলিগেটদের সাথে মিটিং পড়তে হয়েছিল পারভেজদের অফিসে। মিটিং এর মধ্যে ফোন সাইলেন্ট করে রাখা ছিল।
সেই মিটিং শেষ করে বাইরের গেস্টরা চলে যাওয়ার পর আধা ঘন্টা ব্রেক দিয়েই আবার শুরু হয়ে গিয়েছিল কোম্পানির নিজস্ব ইয়ার এণ্ডিং প্ল্যান। সেই ব্রেকের মধ্যে চলে যাওয়ার কথাটা বলতেই পারল না পারভেজ।
অফিস ছুটি হয় প্রতি দিন পাঁচটায়। সেদিন বের হতে হতে বেজে গেল ছয়টা।
জ্যাম ঠেলে আপার বলে দেওয়া ঠিকানার নার্সিং হোমে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়ির কাঁটা গিয়ে ঠেকেছিল সাতের ঘরে। ছুটতে ছুটতে এসে পারভেজ দেখে শুভ্রাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ততক্ষণে, আর ওটির বাইরে তুমুল বাগযুদ্ধে লিপ্ত পপি আপা আর শায়লা।
ঝগড়াঝাটির মাঝপথে এসে অনেক কষ্ট করে যেটুকু বুঝতে পারে পারভেজ তা হলো শায়লা সন্দেহ প্রকাশ করছে এই ক্লিনিকের সেবার মান নিয়ে। এই অপরিষ্কার মেঝে আর পানের পিকের রঙ লাগা দেয়াল তার সূক্ষ্ম রুচিবোধকে আহত করছে।
তার বক্তব্য হচ্ছে পারভেজের টাকা নাই থাকতে পারে! তারা তো আর মরে যায়নি যে তার বোনের চিকিৎসার জন্য এই নোংরা নার্সিং হোমে আসতে হলো?
কথা বার্তা মাঝখান থেকে শুনে যা বোঝা গেল, প্রথম কিছু ক্ষণ পপি আপাও শায়লাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে আসলে মূল ব্যাপারটা টাকার নয়। এই ক্লিনিকটা বাসার একদম কাছেই ছিল বলে, শুভ্রাকে চট করেই নিয়ে আসা গেছে।
অন্য কিছু তখন মাথায় আসেনি। বিশেষত পপি আপা ঢাকার বাসিন্দা নয়, পারভেজ ছিল অফিসে, মিটিং এ ব্যস্ত, ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে।
সেই ক্রাইসিস মুহূর্তে শুভ্রারা যে এপার্টমেন্টে সাবলেট থাকে সেই মহিলার সহায়তা নিয়ে পপি আপা নিজের বুদ্ধিতে যা পেরেছে করেছে। এখন যদি শায়লা কিংবা পারভেজ এই হাসপাতাল থেকে শিফট করে শুভ্রাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চায়, তাহলে পপি আপার তাতে কোনো আপত্তি নেই।
আপন মনে গজ গজ করতে করতে বলছিল শায়লা, “তাই করব! এই ফকিন্নির ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে দেখে কি এই ডাস্টবিনে ফেলে রাখব নাকি আমার বোনকে?”
পারভেজ কথাটা না শোনার ভান করে ইগনোর করে গেলেও কথাটা ধরল পপি আপা।
“কী বললেন? আমার আম্মা আব্বা ফকিন্নি? আপনি কোথাকার কোন শাহজাদী?’
“কার অনুমতি নিয়ে আপনি আমার বোনের অপারেশনের কনসেন্টে সই করে ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন? আপনি ওর গার্জিয়ান? আমরা কি মরে গিয়েছিলাম? ওর হাজব্যান্ড ছিল না?”
“পারভেজ ফোন ধরছিলি না, এদিকে গাইনী ডাক্তার চলে যাবে অন্য কোথায় নাকি চেম্বার আছে, তাই আমি সই দিয়ে দিলাম! তাতে কী হয়েছে? আমি পারভেজের বড় বোন না? আমি কি বানের জলে ভেসে আসছি নাকি? আমার যদি এইটুকু দাবি না থাকে তাহলে আপনারই বা এত লাফালাফি কীসের? আপনিও বড় বোন আমিও বড় বোন। আমি যা ভালো মনে করছি করছি!”
“আমার লাফালাফি কীসের? আমার লাফালাফি কীসের মানে? বোনটা আমার! এই সস্তা জায়গায় ডি এণ্ড সি করে ওর যদি ইনফেকশন হয়ে যায়? ওর যদি কিছু হয়ে যায়, আপনাদের একজনকেও আমি ছাড়ব না! আপনাদের চৌদ্দ গুষ্টিকে আমি জেলের ভাত খাওয়াব!”
“আরে যা যা মাগী যা করবি কর! থানা পুলিশ, জজ ব্যারিস্টার সব তো উনার নাং লাগে! এত সস্তা! বললেই হলো জেলের ভাত খাওয়াব!”
রাগে কথার ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল পপি আপা। পরিস্থিতি এরপর চলে গেল একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এক পর্যায়ে পপি আপা শায়লাকে মারতে উঠলে রীতিমত বাধ্য হয়েই তাকে টানতে টানতে বাইরে বের করে নিয়ে এসেছিল পারভেজ। বাইরে বের হয়েই বাসায় ফোন করতে শুরু করে দিয়েছিল পপি আপা।
শুধু আম্মা আব্বাকে ফোন করেই ক্ষান্ত হয়নি, শুভ্রা যে কত বেয়াদব আর শুভ্রার পরিবারের সবাই যে কত খারাপ, আত্মীয় স্বজন সবাইকে অনতিবিলম্বে সেটা জানানো যেন অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়েছিল তার। বাধ্য হয়ে ফোন কেড়ে নিয়েছিল পারভেজ, “আপা! মেয়েটা এখনো ওটিতে!”
“আরে রাখ রাখ! কী আমার অপারেশন! ওয়াশ করতে আবার অজ্ঞান করা লাগে নাকি? সবাই তো অবশ করা ছাড়াই করে!”
“মানে?”
মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল পারভেজের মুখ।
“তুমি করেছটা কী, আপা? এনেস্থিসিয়া ছাড়া ডি এণ্ড সি করতে বলে দাওনি তো আবার? ও যে ব্যথা সহ্য করতে পারে না! একটা মাছের কাঁটা ফুটলেও…”
“থাক থাক আর ঢং করতে হবে না! অজ্ঞান করেই করবে! তোমার বউ যে কি ননীর পুতুল তা কি আর আমি জানি না?”
আপাকে শান্ত করবার জন্য টানতে টানতে গিয়ে বাসায় রেখে এসেছিল পারভেজ। অফিসের ব্যাগ রেখে আবার ছুটে এসেছিল নার্সিং হোমে।
আশে পাশে তাকিয়ে কোথাও চোখে পড়েনি শায়লাকে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছিল সে। যাক বাবা, শায়লার সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো শক্তি কিংবা ইচ্ছে, কোনোটাই বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট ছিল না পারভেজের, সারা দিন অফিস করে, আর বিশেষত শুভ্রার এই অবস্থায়!
ঠিক তখন শুভ্রাকে বের করে আনছে ট্রলিতে শুইয়ে, এনিস্থিসিয়ার প্রভাবে তখনো অর্ধ অচেতন মেয়েটা। ঠোঁট জোড়া ফ্যাকাসে রক্তশূন্য।
আহারে সারা বছর লিপজেল লাগাত শুভ্রা, ওর ঠোঁটগুলো এমন শুকনো বিবর্ণ দেখাচ্ছিল সেদিন!
ছুটে গিয়েছিল পারভেজ, শুভ্রার শক্তিহীন কবজি চেপে ধরে নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে অস্ফুটে ডেকেছিল, “শু, শু!”
যেন ঘুমের ঘোরেই উত্তর দিয়েছিল শুভ্রা, “হু!”
“আই লাভ ইউ!”
“ওকে এখন ডাকবেন না”, সতর্ক করে দিয়েছিল ডাক্তার।
“ডাকব না?” ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল পারভেজ।
“জি না, উনি মেন্টালি খুব আপসেট ছিলেন। খুব কান্নাকাটি করছিলেন, একদম কোওপারেট করছিলেন না। এই জন্য কেটামিনের একশন শেষ হওয়ার আগেই উনাকে আরো সিডেটিভ দিতে হয়েছে। ছয় ঘন্টা ঘুমালে একটু স্টেবল হয়ে আসবে।“
ধীর পায়ে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এসেছিল পারভেজ। সে তো এটাই চেয়েছিল, চাচ্ছিল।
কেমন বিনা আয়াসেই ঝামেলাটা থেকে মুক্ত হয়ে গেল শুভ্রা, কোনো কাউন্সিলিং লাগল না! তবুও এত কষ্ট হচ্ছিল কেন?
শুভ্রার রক্তশূন্য ফ্যাকাসে বিবর্ণ মুখটা জুড়ে ছিল দুচোখের সামনে। রাত নামছিল, আঁধার কালো রাত!
ঘরে ফিরে যাওয়ার পর সান্ত্বনা দিয়ে ভাতের থালা সামনে ধরে দিয়েছিল আপা।
“অত ভাবিস না, একটা গেলে আরেকটা আসবে!”
আপার নিশ্চিন্ততায় আচমকা চমকে উঠেছিল পারভেজ, “তুমি কিছু করনি তো?”
এ কথায় আবার খেপে উঠেছিল আপা, “যদি করেই থাকি? হ্যাঁ, যদি করেই থাকি? ঢং দেখে তো গা জ্বলে যাচ্ছে একেবারে! কালকে বলিস নাই তুই, আপা, এত খরচ, কী দিয়ে কী সামলাব ভেবে কুল পাই না! আর ওই অলক্ষ্মী মেয়ে, প্রত্যেকটা তরকারিতে গাদা গাদা তেল মশলা দিলেই যেন রান্না ভালো হয়! ভাত বেশি হয়, তরকারি বেশি হয়, কুকুর বিড়ালকে খাওয়ানো হয়! সংসারের এই তো অবস্থা! খারাপটা হলো কীসে?”
“আপা!”
(প্রিয় পাঠক, গল্পটি পড়তে ভালো লাগলে পাশে থাকতে পারেন আমার নতুন বই সংগ্রহ করে। প্রি অর্ডার লিংক কমেন্ট সেকশনে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here