লাস্ট স্টেশন পর্ব-০১

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১

“আমাদের বিয়েটা ‘কবুল’ হয়নি।”

ঝড়তুফানের পূর্বলক্ষণ না জানিয়ে ধুম করে একটা বাজ পড়ল নাদিফের মাথায়। নিজের সম্পূর্ণ নামের সিগনেচার দিয়ে, ‘কবুল’ বলে যাকে বিয়ে করল আজই, তার মুখে এই কথা! চরম আশ্চর্যান্বিত চেহারায় বলল, “কী বললেন আপনি?”

“জি, ঠিক শুনেছেন।” মিনমিনে স্বরে ভেসে এলো কথাটি।

নাদিফ সর্বোচ্চ জোর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাইল, কিন্তু বাড়িভরা আত্মীয়স্বজনের কথা মনে পড়তেই, কণ্ঠ নামিয়ে ফেলল। ভারী অথচ রাগী স্বরে বলল, “আপনি কি জানেন, আপনি ঠিক কী বলছেন?”

“জানি!”

“কবুল না হওয়ার কারণ? আপনাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে? না কি আপনি মন থেকে সম্পর্কটা গ্রহণ করতে চাননি?”

“আমি প্রেগন্যান্ট!”

“হোয়াট!” থমকানো দৃষ্টি নাদিফের।

“জি, এটাই সত্য।”

‘ও আল্লাহ’ অস্ফুটে এইটুকু আওড়ে নাদিফ বলল, “তাহলে এখানে কী করছেন? আপনার বাচ্চার বাবার কাছে যান। আমাদের এই বিয়ে তো কবুলই হয়নি! জেনে-বুঝে আপনি কত বড়ো গুনাহের মধ্যে আমাকে ঠেলে দিয়েছেন, ভেবে দেখেছেন?”

“আমার আসলে কিছু করার ছিল না!”

নাদিফের মনে হলো এবার নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলা উচিত। কেন বাবা-মায়ের কথা শোনে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে গেল! এখন কী করবে? ‘কবুল’ বলার পরও যে বিয়ে অসম্পূর্ণ, যে সম্পর্ক অবৈধ, সেই সম্পর্ক নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব? তার তো এখুনি ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে উঠছে। পরিবারের সবাইকে কী বলবে? কীভাবেই বা জেনে-বুঝে একটা পাপকে সমর্থন করে যাবে? জোছনা ভরা রাত তো তারজন্য কালবৈশাখী তুফান নিয়ে এলো! কিছুক্ষণ আগেই ভেবেছিল, এই রাত… এই নতুন জীবন… এই মুহূর্ত… সবটাই সুন্দর! অথচ একনিমিষেই সবকিছু অদৃশ্য তাণ্ডবের সামনে পড়ে খড়কুটোর অনিশ্চিত বাসার মতো ভেঙে গুড়িয়ে গেল। যার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যই নেই।

ডিভানে বসে মাথার চুল টেনে ধরল নাদিফ। তার বিছানায় বসে থাকা রমণী… যাকে কি না কিছুক্ষণ আগেও নিজের জীবনসঙ্গিনী মনে হচ্ছিল, এখন তাকে পরনারী মনে হচ্ছে। চোখ তুলে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না! এই ঘৃণিত, নোংরা ও পাপিষ্ঠ নারীকে দেখাটাও পাপ। এই পাপ বয়ে বেড়ানো আরও বড়ো পাপ। উফফ…

নিজের রাগকে কন্ট্রোল করা দায় হয়ে পড়ল। এই রুমে বসে থাকাও অসহ্যকর ঠেকল। ধৈর্য্য হারিয়ে নাদিফ বলল, “রাত বেশি হয়নি, আপনি আপনার বাবার বাসায় চলে যান, প্লিজ। এই বিয়েটা যেহেতু কবুল হয়নি, এভাবে একসাথে বসে থাকাটাও অন্যায়। আমি বাবা-মাকে বলে আসছি…।”

দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে পড়ল তূর্ণা। নাদিফের সামনে দু’হাত মেলে বাধাপ্রদান করে বলল, “প্লিজ, কাউকে কিছু বলবেন না। এটা আমার প্রেস্টিজ ইস্যু!”

“প্রেস্টিজ ইস্যু?” স্পষ্ট কৌতুক নাদিফের কণ্ঠে।

“জি…। ছ’মাস আগে ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছিলাম, লুকিয়ে। বিয়ের সাক্ষী ওর দুই বন্ধু আর আমার এক বান্ধবী। বাবা-মা এখনও জানেন না।”

“লুকিয়ে বিয়ে করার দরকার কী ছিল?” বিরক্তিকর গলায় প্রশ্ন করল নাদিফ।

তূর্ণা বলল, “উপায় ছিল না। ও ওইমুহূর্তে দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মানে, ওর কোনো চাকরি ছিল না। আর প্রিয় মানুষ হারিয়ে ফেলার ভয়ও ছিল, তা-ই!”

“তাহলে আমাকে আপনাদের মাঝে টেনেছেন কেন? এটা তো বিয়ের আগেই বলা যেত!”

তাজমেরী হক তূর্ণা। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান হলেও ভীষণ উড়নচণ্ডী স্বভাবের। যা কিছুর প্রতি তার টান ও আকর্ষণ, মায়া ও ভালোবাসা, তা একফোঁটাও ছাড়তে নারাজ। ঠিক এই কারণেই… ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে, বাবা-মাকে লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিল। ভেবেছিল, এতে অন্তত কারও দিক থেকে বিট্রে করার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু কে জানত… তার বোকামি ও অতি আবেগ এবং মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাসের ফল এখন তাকেই ভোগ করতে হবে?

নিজের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি সিদ্ধান্ত আজ তাকে কতটা লাঞ্ছনার জীবনে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সেটা যদি বাবা-মা জানেন, নির্ঘাত দু’জনে গলায় দঁড়ি দিবেন! লজ্জায় ও অপমানে ফুঁপিয়ে উঠল তূর্ণা।

নাদিফ বিরক্ত হয়ে বলল, “ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবেন না তো! বিরক্ত লাগছে। আপনার লুকানো বরকে বলুন, এসে নিয়ে যাক। এসব ঝামেলা আমার অসহ্য লাগছে।”

তূর্ণা ভেজা গলায় বলল, “ও আর আসবে না।”

“আসবে না মানে?”

“ও ওর বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছে পনেরোদিন আগে।”

“বাহ, তালিয়া! তা, আপনি কী করছিলেন? আটকাতে পারেননি? ও বিয়ে করে নিল আর আপনি তামাশা দেখছিলেন?”

তূর্ণা অসহায় মুখে বলল, “আমি জানতামই না। বিয়ের দু’দিন পর ওর বন্ধুদের মধ্য থেকে একজন ম্যাসেজ করে ছবি পাঠিয়েছে। এরপর যখন দেখা করতে চাইলাম, ও বলল ডিভোর্স দিয়ে দিবে। কিন্তু আমি মানতে পারিনি। কী করে মানব বলুন? যাকে ভালোবাসি, লুকিয়ে কবুলও বলে ফেললাম, সে এখন হাত ছেড়ে দিতে চাইছে! তা-ই আমি তার নামে মামলা করতে চাইলাম, অথচ আমাদের সব লুকানো মোমেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখাল, আমাকে কলঙ্কিত করার হুমকি দিল। ভয়ে… আমি গুটিয়ে গেলাম। কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। তা-ই ওর দুই বন্ধু ও আমার বান্ধবীর সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব। কিন্তু এখানেও সমস্যা দেখা দিল। যেদিন ডিভোর্সের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে যাব, সেদিনই জানতে পারি, আমি প্রেগন্যান্ট। দেড় মাসের ছোট্ট ভ্রুণ এখন আমার সঙ্গী। তখন আমার নামমাত্র স্বামী আমাকে ওয়ার্নিং দিল, বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার! এতেও আমি অপারগ। জানি না কেন, কোন টানে… বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আর সবাইকে সব কথা বলতেও পারলাম না। তা-ই সিদ্ধান্ত নিলাম, বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনব আর ওর দায়িত্ব আমি একাই নেব। এদিকে আপনার পরিবার থেকে তাড়াহুড়ো করে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে ফেলল, এইকারণে ডিভোর্সের ব্যাপার নিয়েও এগোতে পারিনি। তবে শীঘ্রই যাব। কারণ, ওই মিথ্যুকটাকে আমি আমার জীবনে আর চাইছি না।”

একটু দম নিল তূর্ণা। এরপর বলল, “আমি কালকের দিন পর্যন্ত আপনার সাথে দেখা করার, কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার বাবা-মায়ের এক কথা, বিয়ের আগে কোনো আলাপ-আলোচনা নয়। আমি জানি, এটা খুব অন্যায় ও নিকৃষ্ট একটা কাজ। এর কোনো ক্ষমা নেই।”

নাদিফ কপালে বিরক্তির ভাঁজ নিয়ে ডিভানে বসে বলল, “এখন কী করবেন? আমাদের এই বিয়েটা তো কবুল হয়নি। আমাদের একসাথে থাকা অন্যায়।”

“জানি…। তবে এই বিপদ থেকে আপনিই আমাকে বাঁচাতে পারেন।”

“আমি! কীভাবে?” চমকাল নাদিফ।

“আমি শুনেছি আপনি শহরে জব করেন এবং গ্রামের বাড়িতে আসেন কম।”

“তো?”

“বিয়ের এক সপ্তাহ পর তো আপনার শহরে যাওয়ার কথা!”

“এটাও জানেন?”

“জি, জানতে হয়েছে।”

“এরপর?”

“আপনি আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? এমন কোনো কাজ, যে কাজের বাহানায় আমি এই গ্রাম ছেড়ে বছর কিংবা দুই বছরের জন্য শহরে থেকে যেতে পারব! বাড়িতেও আসতে হবে না, এখানেও না।”

“তাতে কী হবে?”

“এই গ্রামে থাকলে ওই অমানুষটার কথা মনে পড়বে আমার। আর ধীরেধীরে সময় যত এগোবে সবাই জেনে যাবে। তখন কলঙ্কের বোঝা মাথায় নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আর শহরে গিয়ে কাজে ডুবে গেলে নিজেও বাঁচব, বাচ্চাকেও বাঁচাতে পারব। আমি কথা দিচ্ছি, এরজন্য আপনাকে কোনোপ্রকার কষ্ট কিংবা অসম্মানের মুখে দাঁড় করাব না। বাচ্চাটা ভালোয় ভালোয় আমার কোলে ফিরে এলে আমি ওই হারামজাদাকে ডিভোর্স দিয়ে সব দায় ও ঘৃণার কবল থেকে মুক্তি নেব।”

“আর লোকের সামনে থাকা আপনার ও আমার সম্পর্ক?”

“বিয়েই তো হয়নি, সম্পর্ক তৈরী হলো কই! তবে এর সমাধানও আমি দেব। বছর ঘুরে গেলে, সবাইকে বলব যে, আপনি আমাকে চাকরি করতে দিচ্ছেন না। দাসীর মতো খাটাচ্ছেন। রোজ রোজ মারধর করছেন, ব্যস…। তখন আমাদের বাবা-মায়ের কেউ-ই চাইবে না, সংসারটা হোক।”

“আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে চান?”

“আপনি চাইলে আমাকেও ফাঁসাতে পারেন। আপাতত এই এক দেড়বছর আমাকে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিন, যেন বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়াতে না হয়!”

“এতে আমার লাভ?”

তূর্ণা এইদিকটা মাথাতেই আনেনি। সে নিজের জন্য ভাবতে গিয়ে অন্যের জন্য কোনো চিন্তাই মাথাতে ঠাঁই দেয়নি। আসলেই তো! কেউ যদি তার উপকার করে… তাকে বিনিময়ে কী দেয়া উচিত?

আচমকা তূর্ণা বলল, “আপনি কাউকে ভালোবাসেন?”

নাদিফ বলল, “হম… কিন্তু সে ডিভোর্সি আর বাবা-মা তাকে মেনে নিবেন না।”

তূর্ণা এবার ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ব্যাপার না। আমাকে নকল ডিভোর্স দিয়ে আপনি তাকে বিয়ে করে নিবেন।”

“এত সহজ? বাবা-মা মানবেন না।”

“উফফ, আমি আছি না? আপনি আমার জন্য কিছু করতে পারলে, আমিও আপনার জন্য এইটুকু করতে পারব!”

“ঠিক তো?”

“ইয়েস! এখন বলুন, আমাকে সাহায্য করবেন?”

ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার শেষ সুযোগ হারাতে চাইল না নাদিফ। কাঁধ নাচিয়ে বলল, “ইয়াপ… ডান।”

***

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here