লাস্ট স্টেশন পর্ব-১০+১১

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১০

তূর্ণার ভয় কাটাতে, তাকে মানসিকভাবে শক্ত করতে, অফিস শেষ করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছিল নাদিফ। ডাক্তারের কাছ থেকে সব ধরনের সাজেশন নিয়ে, ঔষধ কেনার সময় তূর্ণা বলে উঠল, “কোনো ঔষধ নিতে হবে না।”

নাদিফ অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“প্রেগন্যান্সির মধ্যে এইসব ঔষধ খাব? যদি ক্ষতি হয়?”

“আপনি ডাক্তারকে এটা বলেননি?”

“না।” স্পষ্ট উত্তর তূর্ণার।

আটশো টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসে যদি নিজের শারিরীক ও মানসিক অবস্থা রোগী শেয়ারই না করে, তাহলে আসার দরকার কী?

তূর্ণার এমন খামখেয়ালি আচরণে মন ও মেজাজ… দুটোরই বারোটা বেজে গেল। এই মেয়েকে ডাক্তারের চেম্বারে একা ঢুকিয়েই ভুল হয়েছে। রেগে গেলে হুট করে চেঁচিয়ে ওঠা নাদিফের অভ্যাস কিন্তু তাও জনসম্মুখে মান-সম্মানের কথা ভেবে রাগ দমিয়ে রেখে বলল, “আপনি কি পাগল? এখানে এসেছি কেন? পরামর্শ নেয়ার জন্যই তো! প্রবলেম বলতে এসে কেউ এসব ব্যাপার লুকোয়?”

গালে হাত দিয়ে তূর্ণা বলল, “কী করব? আমার লজ্জা লাগছিল!”

“লজ্জা? আপনার মধ্যে?” তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল নাদিফ।

“কেন? থাকতে নেই?”

“নিজের অবস্থানটা দেখুন আগে। এরপর নিজেই বুঝুন… লজ্জা কাকে বলে!”

“আপনি আমাকে নির্লজ্জ বলতে চান?”

বাবা-মাকে লুকিয়ে বিয়ে করে, লুকানো স্বামীর বাচ্চাকে গর্ভে নিয়ে, নিজেকে কেউ কীভাবে লজ্জাবতী দাবী করতে পারে? যার মধ্যে লাজলজ্জা আছে, সে এমন লুকোচুরি করবে কভু? সামান্যতম লজ্জা থাকলে তূর্ণা এমন কাজ করতে পারত? বাবা-মাকে লুকিয়ে বিয়ে, সন্তান, আবার ডিভোর্স…।

এইমুহূর্তে এই মেয়েটাকে ঠিক কী বলবে, ভেবে পেল না নাদিফ। ঝামেলা এড়াতে বলল, “ঔষধ নিবেন না?”

“না।”

“আবার কি ডাক্তারের কাছে যাব?”

“না।”

“অকে। আজ রাতে যদি উল্টাপাল্টা আচরণ করতে দেখি, সোজা আপনার বাবা-মাকে ফোন করব। এরপর ওনাদের এখানে আসতে বলব। ওনারা এলে আপনার নিশ্চয়ই আর ভয় থাকবে না?”

ঝটপট কিছু একটা ভেবে নিল তূর্ণা। এরপর বলল, “ওনাদের এসব বলার কী দরকার?”

“দরকার না? আপনি রোজ-রোজ বলবেন, ঘরে জ্বীন-ভূত আছে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে মানুষের সামনে আমাকে বিব্রত করবেন। অথচ আপনি জানেন… আমরা একে-অন্যের জন্য কতটা অস্বস্তির।”

“আমি কী করব? আমার ভয় তো যায় না।”

“ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যেত।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। নিন।”

“শিয়োর?”

“হম…।”

“আবার নাহয় জিজ্ঞেস করে আসি?”

“না, না… আর জিজ্ঞেস করতে হবে না। এখন তো ওনাকে পাবেন না। চলে গেছেন বোধহয়। যদি অসুবিধা হয়… সাফা আপুর থেকে পরামর্শ নেব।”

নাদিফ ঠোঁট উলটে বলল, “আপনার তো ওনাকেও সন্দেহ হয়।”

“ডাক্তার যেহেতু দেখিয়েছি, আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে।”

প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ফার্মেসি থেকে ঔষধ নিয়ে বাইকের সামনে এলো নাদিফ। ঔষধের প্যাকেট তূর্ণার হাতে দিয়ে বাইক স্টার্ট করল।

তূর্ণাও বাইকের পিছনের ক্যারিয়ার শক্ত করে ধরে বসে, পরনের ওড়না কোলের কাছে রেখে দিল। বাইক স্টার্ট দেয়ার পর বলল, “একটু আস্তে চালাবেন, প্লিজ।”

নাদিফ কোনো কথা না বলে সাবধানে বাইক স্টার্ট করে বাসার পথ ধরল। অন্ধকার রাত… অচেনা পরিবেশ… দুটো অচেনা হৃদয়… তবুও যেন তূর্ণার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির ঢেউ খেলে গেল। আজকের সম্পূর্ণ ঘটনা মনে করে নাদিফের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ যেমন জন্মাল, তেমনই সামনে থাকা পুরুষটিকে ঘিরে ভালো লাগার আবেশে মন তৃপ্তি খুঁজে নিল।

চলতে চলতে নাদিফ ভদ্রতা রক্ষার্থে বলল, “কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?”

অনেকক্ষণ ধরে ক্ষিধে পেটে নিয়ে ঘুরছে তূর্ণা। লজ্জায় মুখ খুলতেও ইচ্ছে করছে না। ভেবেছে বাসায় ফিরেই তো খেয়ে নিবে, এখন আর বলার দরকার কী?

নাদিফের প্রশ্ন শোনে না-ও করতে মন সায় দিল না। আজ মনটা একটুবেশি বেহায়া হতে চাইছে। একটুবেশি লাগামছাড়া আচরণ করতে ইচ্ছে করছে। এ কারণে চুপ না থেকে তূর্ণা বলল, “কী খাওয়া যায়?”

“আপনার যা ইচ্ছে।”

“ভাজা পরোটা, বেশি বেশি ঝাল দিয়ে ঝুরঝুরে মাংস। অবশ্যই গোরুর। আর শুকনো মরিচের চাটনি।”

তূর্ণার ইচ্ছে শোনে রেস্টুরেন্টের পাশে বাইক থামিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল দু’জনে। কয়েক পদের চাটনির সাথে ঝুরঝুরে মাংস ছাড়াও… দুটো জুস অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

ঢাকায় আসার পর এই প্রথমই নাদিফের সঙ্গে বাসার বাইরে এসেছে তূর্ণা। আর প্রথম দিনই সামনে থাকা পুরুষের কাজকর্ম তাকে মুগ্ধতার পাশাপাশি একটুকরো শান্তি শান্তি অনুভূতি দিয়েছে। দূরে দূরে থেকেও নাদিফ কীভাবে যে তার দিকে তাকে টেনে নিচ্ছে, সেটা সে খুব করে ভেবেও বুঝে উঠতে পারছে না। আসলেই কি টানছে? না কি সব তার অবচেতন মনের ভুল ধারণা? এত সহজে কেউ কাউকে মনে ঠাঁই দিতে পারে? তা-ও তারমতো ভাঙাচোরা হৃদয়ের মানুষ!

তৃপ্তিভরে খেয়ে তূর্ণা বলল, “খাবারটা তো দারুণ।”

নাদিফও সায় জানাল, “আসলেই দারুণ। বাসায় নেব?”

“নষ্ট হয়ে যাবে না?”

“ফ্রিজে রেখে দেব।”

“ঠিক আছে।”

ওয়েটারকে বলে দু’জনের জন্য পরিমাণমতো খাবার প্যাক করে নিয়ে আবারও বাইকে চেপে বসল দু’জন। বাইক স্টার্ট দেয়ার সময় হুটহাট বেকায়দায় পড়ে নাদিফের কাঁধ চেপে ধরল তূর্ণা। এরপর লজ্জিত হেসে বলল, “স্যরি… পড়ে যাব তো।”

***

নীল রঙের থ্রিপিস পরে, গায়ে অ্যাপ্রোন জড়িয়ে মাত্রই নিজের রুম থেকে বের হলো সাফা। এরমধ্যেই স্বর্ণা এসে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “একটু দাঁড়া। একটা জিনিস দেখে যা।”

এইটুকু বলে ঝটপট নিজের ফোনের গ্যালারি থেকে হ্যান্ডসাম পুরুষের ছবি ও বায়োডাটা দেখিয়ে বলল, “সুন্দর না ছেলেটা?”

সাফা একবার ছবির দিকে তাকাল। এরপর বায়োডাটা দেখে বলল, “হম… সুন্দর। কে উনি?”

“ইঞ্জিনিয়ার রে সাফা, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।”

“আরেহ বাবা, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সেটা তো আমি দেখলামই। কী কারণে দেখালে সেটা তো বলো।”

স্বর্ণা সন্তুষ্টির সাথে বলল, “ও তোর ভাইয়ের বন্ধুর ছোটো ভাই।”

“ওহ…।”

ভাইয়ের বন্ধুকে দেখলেও তার ছোটো ভাইকে কখনও দেখেনি সাফা। তা-ই স্বর্ণার কথা শোনে অতি উৎসাহও দেখাতে পারল না।

স্বর্ণা বলল, “তোর ভাইয়ের কাছে ওরা প্রস্তাব রেখেছে, তোর জন্য। এবার আর না করিস না, সাফা। রাজি হয়ে যা।”

কোনো প্রতুত্তর না দিয়ে ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি পান করল সাফা। এরপর বলল, “এসব বন্ধ করো, ভাবী। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই।”

স্বর্ণার মুখের হাসিটা ধুপ করে নিভে গেল। সে কপালে হাত দিয়ে বলল, “আর কবে প্রস্তুত হবি তুই?”

“কেন? বয়স কি বেশি হয়ে গেছে?”

“হচ্ছে না? এই বয়সে তোর দু’চারটে বাচ্চার মা হওয়ার কথা, সাফা।”

“দু’চারটে?”

“তা নয়তো কী?”

“বাদ দাও, ভাবী। আমাকে এসব নিয়ে আর প্যারা দিয়ো না।”

স্বর্ণা কোমরে হাত চেপে রগরগে মেজাজে বলল, “প্যারা দিয়ো না মানে? বিয়েটা তোর কাছে প্যারা?”

“হম…।”

“কেন? তোর সমস্যা কী? এরপর লোকে নিন্দেমন্দ রটাতে শুরু করবে। একবার যদি নামের সাথে খারাপ ট্যাগ লাগে, জীবনেও সেটা মুছতে পারবি না।”

“লোকের আর কী? করুক যা খুশি।”

স্বর্ণা সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, “তুই কেন বিয়ে করতে চাইছিস না? কী কারণ তার? বিয়েতে বিশ্বাস করিস না? না কি কাউকে ভালোবাসিস? এসব ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা আছে?”

এত প্রশ্ন শোনে স্বর্ণার কপালে একটা ঠ্যালা দিল সাফা। মুচকি হেসে বলল, “তুমিও না, কিছু একটা পেলেই হয়ে গেল। দেরী হচ্ছে, আমি যা-ই।”

“উত্তর দিয়ে যা, সাফা। এভাবে আর কত তুই বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কটাকে এড়িয়ে যাবি? তোর কি মনে হয় না, এবার অন্তত বিয়ে করে কারও ঘরণী হওয়া উচিত?”

ভ্রু কুঁচকে নিয়ে সাফা বলল, “তোমাকে খুব বেশি জ্বালা দিচ্ছি? দূরে সরানোর তাড়া একটু বেশি-ই মনে হচ্ছে না?”

“সাফা, আমি ঢংয়ের মুডে নেই। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য বিয়েটা আবশ্যক। কেন বুঝতে পারছিস না?”

“এই আবশ্যক ব্যাপারটায় আমি বাঁধা পড়তে চাইছি না।”

“কারণটা তো বলবি?”

“কোনো কারণ নেই!”

“এ-ও বিশ্বাস করতে হবে আমায়? কোনো কারণ নেই, অথচ বিয়ে করবি না!”

সাফা অধৈর্য্য হয়ে বলল, “ভাবী প্লিজ… এসব কথা ছাড়ো।”

স্বর্ণা ফোঁসফোঁস করে বলল, “কেন ছাড়ব? কেন? তুই কী ভাবিস, খুব ভালো লুকোচুরি খেলা শিখে গিয়েছিস? তোকে আমি চিনি না? বুঝি না? দশ বছর সাফা। দশটা বছর ধরে তোকে চোখের সামনে দেখছি। তোকে হাসতে দেখেছি, কাঁদতে দেখেছি, নিজেকে গড়ে নিতে দেখেছি। তা-ও বুঝব না, তুই কী চাস?”

“আমি যাচ্ছি। ডোর আটকে দাও।”

নিজেকে লুকাতে একরকম পালিয়ে গেল সাফা। নিচে এসে গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে গেটের সামনে এসে কিছু সময়ের জন্য থামল। সেই সময় বাইক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল নাদিফ। পিছনে বসে থাকা তূর্ণা পরম ভরসায় আপন পুরুষটির কাঁধে হাত রেখেছে। দেখতে কী সুন্দর লাগছে! তবে এই সুন্দর সম্পর্কের ভরসায় মোড়া দৃশ্যটা তার বুকের জ্বলুনি বাড়িয়ে দিল। না চাইতেও বেলেহাজ মন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওদিকেই ছুটল। তবে তাকে ঝটপট সীমানা চিনিয়ে দিল সে। নিজেকে বকাঝকা দিল, “ছিঃ সাফা। তুই কবে এত নির্লজ্জ হলি? শোন, এত বেহায়া হলে চলে না। কখনও কখনও ভালোবাসা হারিয়েও তৃপ্তি খুঁজে নিতে হয়। দেখছিস তো, তুই তাকে হারিয়েছিস বলেই… অন্যজন পেয়ে সুখী। অন্যের সুখে নজর দিস না। ভালো হবে না।”

এ যেন অবুঝ মনকে শাসানো, বুঝানো, তাকে তার সীমা-পরিসীমা বুঝিয়ে দেয়া। নয়তো মন তার কোনোদিন সে-ই পুরুষকে ভুলতে পারবে না, যে পুরুষ তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে থেকেও শতসহস্র মাইল দূরে। আর এই দূরত্ব… কখনও শেষ হবে না।

***

চলবে…

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১১

আজ ছুটির দিন। ঈদের আর বেশি দেরী নেই দেখে বাড়ির সবার জন্য কাপড়চোপড় কিনতে শপিংমলে গিয়েছিল নাদিফ ও তূর্ণা। প্রত্যেকের জন্য দুটো করে জামা, শাড়ি, পাঞ্জাবি-পায়জামা ও জুতো কিনে ফিরেছে। কসমেটিকস তো আছেই। পুরোদিন জামাকাপড় পছন্দ করতে করতেই গেল।

বাসায় ফিরে তূর্ণা কিছু সময় বিশ্রাম নিল এরপর খাবার রান্না করতে গেল। ফেরার পথে আজও লাঞ্চ করতে হয়েছে বাইরে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। নাদিফকে একটুবেশি সময় পাশে পাওয়া যাচ্ছে।

তূর্ণা জানে না, এই নামহীন অনুভূতি তার জন্য কতটা ঠিক, কতটা ভুল। তবুও সে এখন নিয়ম করে ঘর-সংসার সামলায়, নাদিফের অপেক্ষায় থাকে, সকালের নাশতা ও রাতের খাবারটা খুব করে উপভোগ করে। দিনগুলো তার কাছে এখন ঘুমঘোরে দেখা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

চুলায় তরকারি বসিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসল তূর্ণা। নাদিরা কল করেছিল, রিসিভ্‌ করতে পারেনি। এখন কলব্যাক করে ননদিনীর সাথে সময় কাটানোর তাড়া অনুভব করল।

রিসিভ্‌ হওয়ার পর নাদিরা বলল, “তোমরা কবে আসবে? ঈদ তো চলে এলো।”

তূর্ণা নিজের শরীরের দিকে তাকাল। এখনও পেটটা বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু খাবারে ভীষণ অনিয়ম হচ্ছে। বমি বমি ভাব ও খাবারে অতিরিক্ত গন্ধ সহ্য হচ্ছে না। এদিকে আবার নাদিফের শরীরের গন্ধ তার ভীষণ ভালো লাগে। যতক্ষণ পিছনে বসে কাঁধে হাত রাখে… ততক্ষণ বুকভরে শ্বাস নেয় সে। কোন পারফিউম ব্যবহার করে জিজ্ঞেস করা হয়নি। রুমে প্রবেশ করে চেকও করা হয়নি। কিন্তু ওই গন্ধটা নেশার মতো মনে হয় তার কাছে। বার বার অক্সিজেনের মতো গ্রহণ করতে মন চায়।

উত্তর না পেয়ে নাদিরা আবারও বলল, “ভাবী, আমার কথা শুনছ?”

“হ্যাঁ, বলো।” ঝটপট উত্তর দিল তূর্ণা।

“ঈদ চলে এলো তো!”

“তোমাদের ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখব।”

“জিজ্ঞেস করবে মানে? আসবে না?”

“আমি তো ঠিক জানি না।”

“ভাইয়া কোথায়?”

“ঘরেই আছে।”

“ফোনটা দাও তো তার কাছে। মা কথা বলবে।”

নাদিফ টেলিভিশন দেখছিল। তূর্ণা ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মা কথা বলতে চাইছেন।”

টেলিভিশনের সাউন্ড কমিয়ে ফোন কানে ঠেকিয়ে সালাম দিল নাদিফ। উত্তরের পর ভালোমন্দ গল্প চালিয়ে গেল।

মনোয়ারা বেগম বললেন, “তোরা কবে আসবি?”

নাদিফ কিঞ্চিৎ বিচলিত হলো। এরপর বলল, “যাওয়াটা কি বাধ্যতামূলক?”

“বাড়ির একমাত্র বউ। ঈদের সময় বাড়িতে থাকবে না? লোকে জানলে কী বলবে?”

“আমি তো ভেবেছিলাম, এই ছুটিতে অন্য কোথাও ঘুরতে যাব। মানে…।”

ছেলের মনোভাব হয়তো বুঝলেন মনোয়ারা বেগম। কিছু সময় চুপ থেকে বলবেন, “পরে যাবি। দু’দিনের জন্য গ্রামে আয়। ঈদ করে তারপর অন্য কোথাও ঘুরতে যাবি।”

“ঠিক আছে। দেখছি…।”

“দেখছি না, আসতে হবে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে দাওয়াত দিয়েছি। ঈদের পরদিন সবাইকে খাওয়াব। তোর ফুপা-ফুপুও আসবেন।”

“আচ্ছা… আসব।”

ফোন রাখার পর নাদিফ বলল, “দু’দিনের জন্য গ্রামে গেলে সমস্যা হবে?”

তূর্ণা কী যেন ভাবল। এরপর বলল, “ম্যানেজ করে নেব।”

“আপনি ম্যানেজ করতে পারলে তবেই যাব, নয়তো বিপদ সামনে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই।”

“না গেলে তো সবাই ভুল ভাববে। তাছাড়া মা-ও কষ্ট পাবেন। উনি হয়তো ধরে নিবেন, বউ পেয়ে ছেলে বাবা-মাকে ভুলে গেছে।”

এইদিকটা নাদিফ নিজেও ভেবেছে কিন্তু তূর্ণার শারিরীক অবস্থার কথা চিন্তা করে কিছু বলেনি, কোনো বাড়াবাড়ি সিদ্ধান্তও নিতে চায়নি। ভেবেছিল, সবার জন্য কেনা জামা-কাপড় কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিবে। এখন মনে হচ্ছে, একটু রিস্ক নিয়ে যদি চায়, তার নিজেও একটা কাজ হয়ে যাবে। যে কাজের হদিস এইমুহূর্তে সামনে থাকা রমণীকে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

সবদিক ভেবেচিন্তে নাদিফ বলল, “তাহলে আগামী সপ্তাহেই চলে যাই কেমন? আগের দিন যাব, পরেরদিন চলে আসব।”

“এটাই ঠিক হবে।”

তূর্ণা আবারও রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর নাদিফ… চোখটা টেলিভিশনের পর্দায় রেখেও অন্তহীন ভাবনায় ডুবে রইল। এই মিথ্যে সম্পর্ক… মিথ্যে সংসার… এসবকে কতদিন এভাবে চালিয়ে নিতে পারবে, বুঝতে পারল না। তার অস্থির মনে বাবা-মায়ের হাসি-হাসি মুখের জায়গায় ঠকে যাওয়া মলিন মুখটা উঁকি দিল! কত বড়ো অন্যায়ে পা ডুবিয়ে ফেলল সে! এর থেকে মুক্তির উপায় কী?

***

সাদামাটা পোশাকে পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়ানোর পর সাফার শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। কতবার স্বর্ণাকে বলেছে, সে বিয়ে করবে না। অথচ সে না শুনেনি। তাকে না জানিয়ে, একরকম নিজে গার্ডিয়ানের আসনে বসে, পাত্রপক্ষকে আসতে বলেছে। সাফা ভেবেছিল অন্য কোনো মেহমান কিন্তু রুম থেকে বেরিয়ে এসে তার শরীরে কম্পনের সাথে সাথে চোখদুটো জ্বলে উঠল। আড়চোখে স্বর্ণার দিকে তাকাল একবার। দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিল, “এই প্রতারণার মানে কী?”

গুনেগুনে মাত্র দুই মিনিট বসল সাফা। এরপর বলল, “স্যরি… আমাকে এখন হসপিটালে যেতে হবে।”

এইটুকু বলে কোনোমতে ড্রয়িংরুম থেকে রুমে এসে সবকিছু গুছিয়ে বের হয়ে গেল। নিজের ভাবীর দিকেও ঠিকমতো তাকাল না।

ও.টি শেষ করে এক অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গোটা রাত কাটিয়ে দিল সাফা। একের পর কফি গিলে… চোখের ঘুমের সাথে সাথে মনের জ্বালা নিবারণের চেষ্টা চালিয়ে গেল। যে জ্বালায় অন্তর জ্বলে, তাকে কি সহজে নেভানো যায়? না কি এই জ্বালা কাউকে দেখানো যায়?

শেষরাতে দ্বিতীয় ও.টি সামাল দিয়ে সকালের নাশতা করতে ক্যানটিনে এসে বসল সাফা। গরম গরম রুটির সাথে সবজি, দুটো সিদ্ধ ডিম ও এক কাপ চা নিয়ে বসল। সেই সময় তার ফোনে অচেনা একটা নম্বর থেকে কল এলো। ফোন সাইলেন্ট থাকে বলে রাতে কেউ কল করেছে কি না দেখা হয়নি। এখন সেটা হাতের পাশে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠতে দেখে রিসিভ্‌ করে সালাম দিল।

ওপাশ থেকে কেউ একজন সালামের জবাব দিয়ে ভদ্রতাস্বরূপ বলল, “আপনি কি আলিশা মুনতাহা বলছেন?”

“জি…। আপনি কে?”

“আমি শাফিন।”

সাফা ফুঁস করে শ্বাস নিয়ে বলল, “হঠাৎ?”

ওপাশ থেকে শাফিন বলল, “আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। সময় হবে আপনার?”

“গতকাল রাতেই তো দেখা হলো। আবার কেন?”

“আধঘণ্টা সময় নেব, প্লিজ। দেখা করাটা জরুরী।”

“কোথায় দেখা করতে চান?”

“আপনি যেখানে বলবেন।”

“আমি হসপিটালে আছি। এখন কোনোভাবেই সম্ভব না।”

“আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আপনি শুধু লোকেশন বলুন, আমি চলে আসব।”

“হসপিটালের ডানদিকে একটা ক্যাফে আছে, চাইলে ওখানে আসতে পারেন।”

“কতক্ষণ থাকবেন?”

“দশটা পর্যন্ত।”

“আমি এখুনি বের হচ্ছি।”

ঠিক পনেরো মিনিট পর ক্যাফেতে মুখোমুখি শাফিন ও সাফা। প্রথম কয়েক মিনিট কেউ-ই কোনো কথা বলল না। সাফা অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের অস্বস্তি দূর করতে চাইল আর শাফিন একদৃষ্টিতে সামনে থাকা রমণীকে দেখে গেল।

কফি আসার পর সাফাকে সহজ করতে তার দিকে গরম কফির কাপ বাড়িয়ে দিয়ে শাফিন বলল, “আপনি কোনো কারণে আপসেট?”

সাফা উত্তর দিতে পারল না। ঠোঁট কামড়ে বসে রইল।

শাফিন বলল, “আমাকে পছন্দ না হওয়ার কারণ?”

নতমুখী সাফা বলে উঠল, “আমি তো কিছুই বলিনি।”

“আপনার আচরণই অনেককিছু বলে দিচ্ছে। আমি মনোবিজ্ঞানী নই, কিন্তু মানুষের চোখের ভাষা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।”

বিপরীতে কোনো কথা এলো না সাফার মুখে। শাফিন সরাসরি বলল, “আমার পরিবারের সবাই আপনাকে পছন্দ করেছে। আমার ভাই ও ভাবী, বাবা-মা এমনকি আমিও অপছন্দের কোনোকিছু দেখতে পাইনি, খুঁজেও পাইনি। তা-ই প্রস্তাবে সায় জানিয়েছি।”

অনেকক্ষণ পরও কোনো বক্তব্য না পেয়ে শাফিন বলল, “দেখুন, আমার পছন্দ হলেই যে আমি আপনাকে জোর করে বিয়ে করব এমনটা ভাবার কারণ নেই। আমি আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে চাই। আপনি সময় নিন। প্রয়োজনে আমাকে চিনুন, জানুন, আমার ফ্যামিলিকে দেখুন। এরপর যদি মনে হয়, আমি আপনার যোগ্য নই, আপনি ‘না’ বলে দিতে পারেন।”

এবার আর চুপ থাকার কোনো কারণ দেখল না সাফা। স্পষ্ট করে বলল, “আপনাদের পরিবার সম্পর্কে আমি যথেষ্ট জানি। কিন্তু আমি নিজে…।”

একটু থেমে শ্বাস ছেড়ে আবারও শ্বাস টানল সাফা। কিছুটা হালকা হওয়ার পর ধরা গলায় বলল, “আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি। এ কারণে…।”

শাফিন চমৎকার করে হেসে বলল, “আপনার চেহারা দেখে, এটাই ভেবেছিলাম। ভাগ্যবান ব্যক্তিটি কে?”

“আছে, কেউ একজন।”

“তাহলে তাকে বিয়ে করছেন না কেন?”

“সে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। আসলে আমিই বোকা, বলছি, বলব, একটু সময় নিই… এই করে করে অনেকগুলো বছর তাকে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে দেখতে মনের কথা জানাতে পারিনি। এরমধ্যে হঠাৎই একদিন সে তার বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে।”

শাফিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিঞ্চিৎ দুঃখবোধ চেহারায় ফুটিয়ে তুলে বলল, “এখন তো আর কিছুই করার নেই, তাই না?”

“জানি…। এজন্যই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোনোদিন বিয়ে করব না। আমি খুব দুঃখিত।”

কফি শেষ হওয়ার পর আরও কিছু সময় চুপ করে বসে রইল দু’জন। শাফিন বলল, “একটা কথা বলি?”

“হম…।” ঘাড় নাড়ল সাফা।

“যে আপনার জীবনে আর ফিরবে না, ফেরার কোনো চান্স নেই, তার জন্য আপনি কেন কষ্ট পাচ্ছেন? কেন নিজের জীবনকে থামিয়ে দিচ্ছেন? কেন সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন?”

“ওইযে… বোকামন, ধরেই নিয়েছিল তার মাঝে সুখ। এ কারণে, চাইলেও তাকে ভুলে যেতে পারছি না।”

“সে খুব ভাগ্যবান। একসাথে দুটো নারীর ভালোবাসা পাচ্ছে।”

কৌতুক না কি খোঁচা সেটা বুঝতে পারল না সাফা। তবুও ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “হয়তো।”

আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে, সময় নিয়ে মনের সাথে যুক্তিতর্কে গিয়ে শাফিন একটা সিদ্ধান্তে এসে স্থির হলো। এরপর বলল, “আপনার জন্য একটা প্রস্তাব রাখছি, যদি মনোঃপুত হয়, ভেবে দেখবেন।”

সাফা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কী?”

শাফিন জানাল, “আপনার পছন্দের মানুষকে নিয়ে আমি কোনো রাগ-ক্ষোভ মনে জমা করব না। আপনাকে কাঁদার সুযোগ দেব। তার জন্য মন খারাপ করার সুযোগ দেব। কখনও বলব না, তাকে ভুলে যান। এমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পর যদি মন থেকে সায় পান, একটা মিসডকল দিবেন। আমি চলে আসব।”

সাফা বলল, “একটুবেশিই সিনেমাটিক হয়ে যাচ্ছে না? কোনো পুরুষ, নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষকে নিয়ে ভাববার অধিকার দিবে?”

“গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। কেউ-ই দিবে না। কিন্তু ওইযে… মানুষ কখনও কখনও বর্তমানের সুন্দর জীবনের ফাঁকে অতীত খুঁজে। পিছনে হারিয়ে যাওয়া মানুষ অথবা সময়কে ভেবে মন খারাপ করে, কাঁদে। সবাই তো আর মনের খবর জানে না, তা-ই কার চোখের পানি, কার জন্য… এটা বুঝে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে।”

“আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন। আমি এ সম্পর্কে জড়াতে পারব না। আর না কোনোদিন তাকে ভুলে আপনাকে মনে জায়গা দিতে পারব।”

“ঠিক আছে, দেখা যাবে।”

সাফার বিস্মিত চোখদুটোকে পিছনে রেখে কফির দাম দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাফিন। যাওয়ার আগে পিছন ফিরে বলল, “জীবন খুব ছোট্ট আলিশা। এই ছোট্ট জীবনটা একটা মানুষের না পাওয়া ভালোবাসার হিসেব কষে কাটিয়ে দিবেন না। আপনি যার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন, সে হয়তো দিব্যি ভালো আছে। আপনার কষ্ট, আপনার চোখের পানি, এসবের কোনো মূল্য নেই তার কাছে। সে জানেও না, আপনি তার জন্য ভেবে মরছেন। কষ্ট পাচ্ছেন। নিজের জীবনের সব শান্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। পরিবারের সবার আশাকে ভেঙে দিচ্ছেন। এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে, লাভ কী হচ্ছে? দিনশেষে আপনি একাই থেকে যাচ্ছেন। অথচ এই একাকীত্ব থেকে মুক্তিটা আপনার ভীষণ দরকার।”

শাফিন যেন চোখে আঙুল দিয়ে সাফাকে বুঝিয়ে দিল, “আপনি ডাক্তার হয়েও নিজেকে বুঝতে পারেন না, সাফা।”

***

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here