লাস্ট স্টেশন পর্ব-১২+১৩

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১২

শাফিনের পরিবার থেকে এখনও কোনো পজেটিভ সিগন্যাল আসেনি দেখে স্বর্ণা কিছুটা চিন্তিত। এত আগ্রহ নিয়ে প্রস্তাব দিয়ে, কনে দেখতে এসে কনেকে পছন্দ করার পর হুট করে এভাবে থম মেরে বসে থাকা কেমন যেন সন্দেহজনক ঠেকল তার কাছে। এদিকে সাফাও বেশ ফুরফুরে মেজাজে নিয়মিত চেম্বার ও হসপিটালে ছোটাছুটি করছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুবই প্রাণোচ্ছল এক তরুণী। অথচ ভেতরটা ভাঙাচোরা। তারই চোখের সামনে… ভালোবাসার মানুষ অন্য একজন নারীকে নিয়ে সংসার সাজিয়েছে, সেই সংসার ও সম্পর্কের খুঁটিনাটি সুখ-সুখ ব্যাপার তার চোখের সামনে পড়ছে, বিশেষ করে তূর্ণার চঞ্চলতা একটুবেশিই সুখের আভাস দিচ্ছে। সবকিছুকে সামনা-সামনি দেখতে কোথায় তার কষ্ট হওয়ার কথা অথচ সে এগুলো দেখেও দেখছে না। যদিও অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করা অনধিকার চর্চা এবং তাদের নিয়ে মাথা ঘামানো বাড়াবাড়ি তবুও সাফার হাসিমুখটা দেখলে স্বর্ণার বুকের ভেতর চ্যাঁত করে উঠে।

সাফা না বললেও তার চোখের ভাষা, কথার ধরন ও মাঝেমধ্যে ব্যালকনি থেকে নাদিফকে লক্ষ্য করা এই সবকিছুই দেখত স্বর্ণা। ব্যক্তিগত ভেবে জিজ্ঞেস করতে চাইত না। ভাবত, সময় এলে সাফা নিজেই মুখ খুলবে। নিজেই জানাবে ভালোবাসার কথা। কিন্তু এই মেয়ে তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে ওস্তাদ।

মাঝখানে কিছুদিন মলিনমুখে চলাফেরা করলেও ক’দিন ধরে আগের রূপে ফিরে গেছে সাফা। হয়তো মনকে মানিয়ে নিয়েছে। হয়তো কষ্ট ভুলতে ভালো থাকার চেষ্টা করছে।

উপুড় হয়ে পা দুলিয়ে দু’হাতে গাল চেপে একটা ইংলিশ বই পড়ছিল সাফা। স্বর্ণা ভেতরে প্রবেশ করে বলল, “কী রে হসপিটালে যাবি না?”

সাফা পা দুলিয়ে উত্তর দিল, “যাব তো। কেন?”

স্বর্ণা বিছানায় বসে বলল, “তোর ভাইয়া জানতে চাইছিল, ওই প্রস্তাবটার কী হলো? এখনও তো শাফিনের ফ্যামিলি থেকে বিয়ের কোনো তোড়জোড় দেখছি না। আমি নিজেও যেচে জিজ্ঞেস করতে পারছি না। কেমন লজ্জা লাগছে।”

সাফা বলল, “হয়তো বয়স বেশি দেখে পিছিয়ে গেছে। এখনকার সব পুরুষই তো কমবয়সী মেয়ে চায়।”

“এমন হলে ওনারা প্রস্তাব দিতেন না। তোকে তো তাদের চেনার কথা। নিশ্চয়ই এখানে অন্য কোনো গল্প আছে।”

“ধুর… অন্য কী গল্প হবে আবার? তুমি একটু বেশি-ই ভাবছ। বিয়ে দেয়ার যদি এতই তাড়া থাকে, বলে দাও… বাসা ছেড়ে চলে যাই।”

“তুই খামোখা রাগ করছিস, সাফা। আমি শুধু চাইছি তুই সুখী একটা জীবন উপভোগ কর।”

“কেন? আমি কি দুঃখী জীবনে আছি?”

স্বর্ণা এবার শক্তচোখে তাকাল ননদিনীর দিকে। এরপর সামনের বই টেনে নিয়ে বলল, “আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল।”

সাফা হতবাক কণ্ঠে বলল, “কী আশ্চর্য! বই টেনে নিলে কেন? খুবই ইন্টারেস্টিং একটা পার্টে আছি। দাও তো।”

“পরে দেব। আগে আমার কথার উত্তর দে।”

হাঁটু ভাঁজ করে বসে সাফা বলল, “কী?”

“তুই নাদিফকে ভালোবাসিস না?”

কিছু সময়ের জন্য থেমে গেল সাফার হৃৎস্পন্দন। দৃষ্টি ও চেহারায় জড়ো হলো মেঘ। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “ফালতু টপিক নিয়ে আলোচনা করতে ভালো লাগছে না।”

“ফালতু টপিক? তাহলে এসব কী?”

সেন্টার টেবিলে থাকা সাফার ফোন হাতে তুলে গ্যালারি ওপেন করল স্বর্ণা। প্রথমে গ্যালারিতে প্রবেশ করে নাদিফের একগাদা ছবি দেখাল এরপর আলিশা মুনতাহা অ্যাকাউন্ট দেখে নাদিফের ফেসবুক আইডির বিভিন্ন পোস্টে লাইক দেখিয়ে বলল, “এগুলো এমনিই রেখেছিস? কোনো কারণ ছাড়া? তুই ওর আইডি ফলো করিস। অথচ ও জানেও না আলিশা মুনতাহা তোর আসল নাম। জীবনেও তো জানবে না, যদি না তুই কোনোদিন পরিচয় দিস।”

সাফা হাতের টানে ফোন কেড়ে এনে ধুম করে সেটা ফ্লোরে ভেঙে দিয়ে বলল, “হয়েছে শান্তি? ফোনও নাই, ফলোও নাই। এখন শান্তিতে থাকো। আর শোনো, ওই মানুষকে নিয়ে আর একটা প্রশ্নও আমাকে করবে না। আমি তাকে ভুলে যেতে চাই।”

কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে প্রবেশ করল সাফা। ফ্রেশ হয়ে পরনের কাপড় পালটে, অ্যাপ্রোন ও স্টেথোস্কোপ সাথে নিয়ে রুম ছাড়ল।

স্বর্ণা বলল, “সাফা শোন… রাগ করিস না। আমি তো তোর একপাক্ষিক কষ্ট নিতে পারছি না। তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না আমার। প্লিজ… একটু শান্ত হ।”

সাফা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি তাকে ভুলতে চাই ঠিকই… কিন্তু এর মানে এই না নতুনভাবে ঘর-সংসার শুরু করলে ভুলে যাওয়ার পথ সহজ হয়ে যাবে। উলটে যার জীবনে জড়াব, তার কষ্ট বাড়বে। কারণ যাকে আমি ভালোবাসি তাকে কোনোদিন ভুলা সম্ভব না। আর অন্য কাউকে বিয়ে করে তাকে নিয়ে মিথ্যে সংসার সাজানো সম্ভব না। এরচেয়ে যদি আমি একা থাকি, নিঃসঙ্গ থাকি, তাতেও সুখ। অন্তত আমার মন জানবে সে আমার না হয়েও আমারই আছে। আমি তারজন্য কাঁদব, তার স্মৃতি বুকে নিয়ে বাঁচব, এটাই তো স্বস্তির। অন্যকে মিছে আশা দিয়ে, কবুল বলে কেন শুধু শুধু পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয়জনের আগমন ঘটিয়ে সম্পর্কের বৈধতার দিকে প্রশ্ন তুলব? শাফিন যদি কিছু জানতে চায় আর, বলে দিয়ো… এ বিয়েতে মত দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কাউকে ঠকাতে চাই না।”

***

আগামীকালই ঈদ। নাদিফ ও তূর্ণা গ্রামের যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বাসা ছেড়ে বের হয়েছে। এখান থেকে স্টেশন পর্যন্ত রিকশাতে যাবে। এরপর বাসে উঠে দীর্ঘ যাত্রার পর গ্রামে পৌঁছে যাবে। সকালেও একগাদা শপিং করেছে নাদিফ। যেহেতু বাবা-মা ফুপা-ফুপুকে দাওয়াত দিয়েছেন, তাদের জন্যও জামাকাপড় কিনেছে। সেগুলো প্যাক করে বের হতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। মধ্যরাতের আগে বাড়ি পৌঁছাতে পারলে আগামীকালের ঈদ ও জামায়াত ধরতে পারবে।

রিকশার সামনে দু’জনের দুটো লাগেজ রাখতে অসুবিধা হলেও একটার উপর অন্যটা রেখে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলল তারা। কিছুদূর এগোনোর পর তূর্ণা হঠাৎই বলল, “পানি নিইনি তো। যদি বমি চলে আসে? এক বোতল পানি নিতে পারবেন?”

নিরাপদ একটা জায়গা দেখে রিকশা থামিয়ে দোকান থেকে পানির বোতল কিনতে গেল নাদিফ। এরমধ্যেই ধুম করে একটা শব্দ হলো। হাতে থাকা বোতল নিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল সে। চোখের সামনে রিকশাটা উলটে যেতে দেখে দৌড়ে এলো সড়কে। ইতিমধ্যে একটা নিয়ন্ত্রণহীন লড়ি সর্বোচ্চ গতিতে রিকশার পিছনে ধাক্কা মেরে নির্ভার মনে বসে থাকা তূর্ণাকে ফেলে দিয়েছে নিচে। শুধু যে ফেলেছে তা নয়। তার শরীরে থাকা রিকশার উপর দিয়ে লড়ি চলে গেছে।

ব্যথায় একবার শুধু আর্তনাদ করেছে তূর্ণা। এরপর অজ্ঞান হয়ে গেছে। নাদিফ যতক্ষণে ছুটে এসেছে, ততক্ষণে রিকশাচালকের নিঃশ্বাস থেমে গেছে। কারণ লড়ির সবগুলো চাকা তার পেটের উপর দিয়ে চলে গেছে।

মুহূর্তের মধ্যে মানুষের ভীড় জমে গেল রাস্তায়। কেউ কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনার তাড়া দিল। কেউ কেউ হা-হুতাশ করল। আর নাদিফ… হাতে থাকা পানির বোতল ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে এসে তূর্ণার রক্তাক্ত শরীর ধরতে গিয়ে কেঁপে উঠল।

পুরোটা সকালজুড়ে মেয়েটির মুখে হাসি ছিল। গ্রামে ফেরার আনন্দে সবার সাথে কত হাসিখুশিভাবে কথা বলেছিল। বাসার সবাইকে বলেছে, ঈদ করতে গ্রামে যাচ্ছি। ফিরে এসে গল্প হবে। শেষমুহূর্তে এটা কী হয়ে গেল? এখন তূর্ণার বাবা-মাকে কী জবাব দিবে সে? নিজের বাবা-মাকেই বা কী বলবে?

তূর্ণার বাচ্চাটা? ওর কথা ভাবতে গিয়ে নাদিফ কেঁপে উঠল। চিৎকার দিয়ে বলল, “কেউ একটু হেল্প করুন প্লিজ। হসপিটালে যেতে হবে।”

উপস্থিত লোকজনের সাহায্যে তূর্ণাকে নিয়ে হসপিটালে এলো নাদিফ। তার সমস্ত শরীর বেয়ে রক্ত পড়ছে। হাত-পা, পেট-পিঠ সব জায়গায় জখম হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ইমার্জেন্সি ডাক্তার জানালেন ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা জরুরী। পেটের কোথাও কোনো আঘাত লেগেছে কি না সেটুকু নিশ্চিত হবেন। এরপর বাকি চিকিৎসা দিবেন। এরমধ্যে একবারও চোখ খুলেনি তূর্ণা। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।

আরও ঘণ্টা দেড় ঘণ্টার ধৈর্যের পর রিপোর্ট আনার ডাক পড়ল। ঈদের ছুটি। তাই হসপিটালেও ডাক্তার কম। ইমার্জেন্সিতে যে ক’জন ছিলেন, সবাই-ই বিদায় নিয়েছে।

রিপোর্ট কাকে দেখাবে বুঝে উঠতে পারল না নাদিফ। কিছুক্ষণ আগে যে ডাক্তার তূর্ণার হাতে-পায়ের চিকিৎসা দিলেন, তিনি চলে গেছেন। রাত বাড়ছে দেখে কেউ-ই আর থাকেনি। কাউকে না পেয়ে আউটডোরে বসে নিজেই রিপোর্টে চোখ বুলাচ্ছিল নাদিফ। এরমধ্যেই একজন নার্স ও ডাক্তার বের হলেন ও.টি থেকে।

ইমার্জেন্সিতে থাকা রোগীর অবস্থা খুব খারাপ দেখে আরেকজন নার্স ছুটে এসে বলল, “ম্যাম… তূর্ণা নামের একজন পেশেন্ট আছেন। অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি যদি তাকে একটু দেখতেন। এতক্ষণ যে ডাক্তার ছিলেন, ওনার আজকের ডিউটি শেষ হওয়াতে উনি চলে গেছেন।”

হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক পরিহিত ডাক্তার আলিশা মুনতাহা নার্সকে বলল, “কোথায় পেশেন্ট?”

নার্স তাকে নিয়ে কেবিনে গেল। সেখানে তূর্ণার শরীরে রক্তের সেলাইন প্রবেশ করছে। এমন অসময়ে তূর্ণাকে এখানে দেখে সাফা খুবই অবাক হলো। এবং তার অবস্থা থেকে ভয়াবহ রকমের ভয় গেঁথে বসল মনে। বলল, “পেশেন্ট কি একা?”

নার্স বলল, “না ম্যাম। ওনার হাসব্যান্ড আছেন। উনি রিপোর্ট আনতে গেছেন।”

এমতাবস্থায় নাদিফও কেবিনে প্রবেশ করল। ডাক্তার আলিশা হাত বাড়িয়ে রিপোর্ট নিয়ে তাতে চোখ বুলাতে গিয়ে চরম অবিশ্বাস্য কিছু আবিষ্কার করে একবার নাদিফকে দেখল একবার তূর্ণাকে। এরপর নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করল, “উনি কি প্রেগন্যান্ট ছিলেন?”

মুখে মাস্ক থাকার কারণে নাদিফ পাশে থাকা রমণীকে চিনতে পারল না। বলল, “জি।”

“কতদিনের?”

“আই থিংক তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। এমনটাই বলেছিলেন উনি আমাকে।”

ডাক্তার আলিশা স্থির চোখে প্রশ্ন করল, “তিন মাসের বেশি? ওনার মিসক্যারেজ হয়েছে। এখুনি ডি এ্যান্ড সি করাতে হবে। ভ্রুণের কিছু অংশ ওনার পেটে রয়ে গেছে।”

নাদিফ অসহায় কণ্ঠে বলল, “আপনি ওনাকে যেভাবে হোক সুস্থ করে দিন, প্লিজ। নাহলে আমি ওনার বাবা-মায়ের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। একটা সুস্থ মানুষকে এতদূরে টেনে এনে… তাকে একেবারে মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। এত বড়ো ভুল কী করে হয়ে গেল!”

আফসোস, দুঃখ ও অপরাধবোধ নিয়ে নাদিফ ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। ডাক্তার আলিশা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে তূর্ণার ডি এ্যান্ড সি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভালোমতো রিপোর্ট আবার দেখে সন্দিহান চোখে নাদিফের দিকে তাকাল। বিয়ের মাত্র এক মাস। আর ভ্রুণ সাড়ে তিন মাসের? হিসেবে কী ভুল আছে ভেবে পেল না সে। তবে তার মনে হলো, প্রশ্ন ও সন্দেহের চেয়ে এইমুহূর্তে তূর্ণার চিকিৎসা জরুরী। তাই তৎক্ষনাৎ ব্যবস্থা নিয়ে তাকে নিয়ে ও.টিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

নাদিফ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তূর্ণাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর সে বাবা-মায়ের কাছে ফোন করল। অপরাধীর মতো জানাল, “গ্রামে ফেরা অসম্ভব মা। তোমার বৌমা অসুস্থ। তাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছি।”

***

চলবে…

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৩

কয়েকঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তূর্ণার সব বিপদ কেটে যাওয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে তাকে কেবিনে পাঠিয়ে দিল ডাক্তার আলিশা হরফে সাফা। ভোর হতে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। ফজরের পরই নতুন দিন, নতুন খুশি নিয়ে সূর্য উঠবে। অথচ কারও কারও মুখে থেকে যাবে ঘুটঘুটে আঁধার।

বারান্দার একটা বেঞ্চে বসে মাথায় হাত ঠেকিয়ে রেখেছে নাদিফ। বাড়ি থেকে ক্রমাগত ফোনকল আসছে। সবাই অশান্ত হয়ে উঠেছেন। তূর্ণার বাবা-মা ও নাদিফের বাবা ঢাকার পথে রওনা দিয়েছেন। এত বড়ো একটা উৎসবের সময় এমন দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। বার বার তাকে বকা দিচ্ছেন, চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন, তার দায়িত্বহীনতাকে খুব ভালোভাবেই মাথায় গেঁথে নিয়েছেন সবাই। আর সে-ও মনের মধ্যে ভয়, উৎকণ্ঠা ও তূর্ণার জীবনের শঙ্কা নিয়ে রবকে ডেকে যাচ্ছে।

অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে সাফার সাহস ও ইচ্ছে কোনোটাই হলো না নাদিফের মুখোমুখি হতে। সে মনের মধ্যে অগণিত প্রশ্ন ও দুটো মানুষের বিয়ে নিয়ে নানান চিন্তার জাল বিছিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। এবং এটা স্বাভাবিক। যে মানুষকে চোখের সামনে দেখল নতুন বউ নিয়ে সুখে সংসার করতে, আজ জানল; তার সেই বউটা সাড়ে তিন মাসের গর্ভবতী! কিছু অভিমান, কিছু বোবাকান্না ও কিছু ধোঁকার সংমিশ্রণ তার মনের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ল। যদিও এটা তার বেশি আবেগ অথবা ছেলেমানুষী চিন্তা মনে হলো, তবুও ভালোবাসার মানুষকে সবাই-ই শুদ্ধ দেখতে পছন্দ করে। দোষে-গুণে মানুষ, এটা সে জানলেও হুট করে সেটা মানতে পারছে না। তবে সে জানে তার মানা ও মানাতে কিছু যায় আসে না, তা-ও মনের দুর্বলতা ঠেকানোর উপায় নেই। অনুভূতিকে মিথ্যে ভাবার সুযোগ নেই।

এড়িয়ে চলে যেতে চেয়েও পায়ে থাকা হিলের গটগট শব্দে হুঁশে ফিরে এলো নাদিফ। মাস্ক পরিহিত ডাক্তারকে অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে অন্যদিকে যেতে দেখে বলল, “ডক্টর, পেশেন্টের কী অবস্থা?”

সাফা দাঁড়াল। নরম স্বরে বলল, “বিপদ কেটে গেছে। ওনাকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। সকালের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে।”

“আর কোনো সমস্যা নেই তো?”

“আপাতত নেই। তবে কয়েকটা মাস একটু সাবধানে থাকতে হবে। মিসক্যারেজ রোগীর মেন্টালিটির উপর চাপ ফেলে। তখন কাউকে না কাউকে তার ভরসা হতে হয়। আমি আশা করব একজন স্বামী হিসেবে আপনি তার এই দুঃসময়ের সঙ্গী হবেন।”

তূর্ণাকে ও.টিতে নেয়ার আগে ডাক্তারের সাথে খুব একটা আলাপ হয়নি তার। এখন অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে, চোখের দৃষ্টি ও পরনের পোশাক দেখে কিঞ্চিৎ চিন্তা হলো।

এইটুকু বলে সাফা চলে যাচ্ছিল। নাদিফ বলল, “কতদিন থাকতে হবে?”

“তিন থেকে চারদিন। এরপর বাসায় ফিরে গেলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও যত্নে রাখবেন।”

ঘণ্টাখানেকের জন্য বিশ্রাম নিতে সাফা নিজের চেম্বারে প্রবেশ করল। অমনি তার চোখ বেয়ে হুড়মুড়িয়ে অশ্রুর ফোয়ারা ছুটল। ক্ষণে ক্ষণে শরীর কেঁপে উঠার সাথে সাথে ভেতরের জ্বালা বাড়তে লাগল। আযানের পর চোখমুখ মুছে নামাজ পড়ে বাড়িতে ফোন করল। সে যখন কথা বলতে ব্যস্ত ছিল, এরমধ্যে দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো।

নার্স ভেবে অনুমতি দেয়ার পর ভেতরে প্রবেশ করল নাদিফ। মুখে মাস্ক দেয়ার আগেই চোখে চোখ পড়ল আর চরম লজ্জায় মাথা নুয়ে এলো তার। চমকে গিয়ে বলল, “আপনি?”

সাফা ফোন রেখে ইলেকট্রিক ক্যাটলিতে পানি ফুটাতে দিয়ে হাসিমুখে বলল, “জি, আমি-ই আলিশা।”

“ওহ…।”

“কিছু বলতে এসেছেন?”

ডাক্তার আলিশা মুনতাহার জায়গায় সাফাকে দেখে হতবাক হওয়ার পাশাপাশি চরম সত্যির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাকহারা হয়ে গেল নাদিফ। একজন ডাক্তার, যে তূর্ণার শরীর ও অসময়ে ঝরে যাওয়া ভ্রুণের অপসারণ করেছে, তাকে আর কী বলে বুঝাবে, কীভাবে কথা শুরু করবে, সেটাই ভেবে পেল না সে। কিছু সময় থম মেরে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আসলে… তূর্ণা… মানে এই বিয়ে…।”

নাদিফের এলোমেলো শব্দ উচ্চারণ দেখে চুপ থেকে তার ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখ দেখে দু’কাপ কফি বানিয়ে নিল সাফা। এক কাপ গরম কফি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধীরে…। এত টেনশনের কিছু নেই। কী বলতে চাইছেন, বলে ফেলুন। একমাসের বিয়ে ও সাড়ে তিন মাসের প্রেগন্যান্সি… এসব কথা আমি কাউকে বলব না।”

নাদিফ এবার সাহস নিয়ে বলল, “আমাদের বিয়েটা হয়নি। বিয়ের দিন, অর্থাৎ বাসররাতে তূর্ণা জানালেন, উনি প্রেগন্যান্ট…।”

এরপর ধীরেধীরে সব ঘটনা খুলে বলার পর সাফার স্থির চোখের সামনে থাকতে অস্বস্তি ও লজ্জা অনুভব করে নাদিফ বলল, “ও-ই ছোট্ট বাচ্চার সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছি। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো একটা পজেটিভ চিন্তা কোনো এক ভাঙাচোরা মনের মধ্যে শক্তির সঞ্চার করতে পারে। বদনাম তো সবাই দিতে পারে। সত্যি এটাই যে, মানুষ দোষ খুঁজে বের করে অপর মানুষকে হেনস্তা করতে বেশি সচেষ্ট। সেখানে আমি চেয়েছিলাম, অন্তত একটা মিথ্যে দিয়ে হলেও কারও জীবন সুন্দর করতে।”

সাফা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “মিথ্যে যে সবসময় কল্যাণকর হয় না, দেখলেন তো?”

“হ্যাঁ… কিন্তু আমি এই সত্যি কীভাবে এখন সবার সামনে তুলে ধরব ভেবে পাচ্ছি না।”

“সত্য জানাতে হবে না কেন? এমনই থাক না। এখন তো সম্পর্কটা জোড়া লাগতে কোনো বাঁধা নেই। মানে… আপনি চাইলে তাকে বিয়ে করে নিতে পারেন। সবার সামনে সবকিছু আগের মতোই থাকল। তূর্ণাও ভালো থাকল আর আপনিও।”

নাদিফ চিন্তিতমনে বলল, “এটা কী করে সম্ভব হয়?”

“অসম্ভব কেন?”

“আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বেবির জন্মের পর দু’জনে আলাদা হয়ে যাব।”

“নিয়তি হয়তো আপনাদের এক করতে চাইছে, তাই অসময়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।”

আসলেই কি এটা সম্ভব হবে? নাদিফ কোনো যুক্তি খুঁজে পেল না। তূর্ণাকে তার ভালো লেগেছে, তবে সে মিথ্যে মায়ার সম্পর্কে থাকতে চায় না। এমতাবস্থায় এই দুর্ঘটনা!

***

সকাল আটটার মধ্যে মুরব্বিরা উপস্থিত হলেন হসপিটালে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে তূর্ণার বাবা-মা হা-হুতাশ শুরু করলেন। নাদিফ অবশ্য মিসক্যারেজের সত্যিটা জানাল না। যেহেতু ওনারা জানেন না, ওটা চেপে গেল।

ওবায়দুর রহমান ছেলেকে বললেন, “কবে বাসায় নিয়ে যেতে পারবি জানিয়েছেন কিছু?”

নাদিফ ঘাড় নেড়ে জানাল, “হ্যাঁ, তিন-চারদিন পর।”

“তাহলে তো গ্রামে যেতে পারবি না। ঈদের দিনে…।”

“বাদ দাও। সব ঈদ তো সুন্দর হয় না।”

তূর্ণার জ্ঞান ফেরার পর রাজিয়া বেগম একটু বেশি-ই অস্থির হয়ে উঠলেন। মেয়ে কী খাবে, কীভাবে সুস্থ হবে, এসব বলে বলে ডাক্তার ও নার্সকে বিরক্ত করে ফেললেন। সাথে মেয়ের জামাইকে বকেঝকে পুরো হসপিটাল গরম করে ফেললেন। বললেন, “তুমি মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছ কেন? যদি তার খেয়াল রাখতে না পারো? তোমাদের মতো পুরুষেরা ঘরের বউয়ের প্রতি যত্নশীল হতে পারে না, পারে শুধু গা বাঁচিয়ে চলার অজুহাত দেখাতে।”

সাফা এখুনি বাসায় চলে যাবে। তূর্ণার মায়ের এত পাকনামি ও রোগীর সামনে মাতব্বরি দেখে শরীর জ্বলে উঠল তার। ধৈর্য্য হারিয়ে বলল, “এত যখন সমস্যা, মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন। আমরা রোগীর সামনে এত কান্নাকাটি, চিৎকার-চেঁচামেচি অ্যালাও করি না। যা করার রোগীকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে করুন। এখানে, হসপিটালে নয়।”

রাজিয়া বেগম চোখ পাকিয়ে বললেন, “বড়ো বড়ো কথা কম বলো মেয়ে। আমি মা, আমাকে বুঝতে দাও। আমার মেয়ের কোথায় কষ্ট হচ্ছে সেটা আমি ছাড়া ভালো কে বুঝবে?”

“তা-ই? তাহলে ডিসচার্জ লিখে দিই? মেয়েকে নিয়ে চলে যান।”

এরপর নার্সকে বলল, “রিসেপশনে গিয়ে বলো, এই রোগীর চিকিৎসা শেষ। এনাকে আর রাখা যাবে না।”

পরিস্থিতি জটিল ও ডাক্তারের রেগে যাওয়া দেখে হায়দার আলী স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বললেন, “সবসময় এত বাড়াবাড়ি করো কেন? ডাক্তার তুমি না কি উনি?”

রাজিয়া বেগম চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, “আমার সুস্থ বাচ্চাটা একেবারে ঝরে যাচ্ছে আর আমি কিছু বলব না? তোমার জামাই, সব দোষ ওর। ও আমার মেয়ের খেয়াল রাখেনি। এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ও।”

নাদিফ নিশ্চুপে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এত কথা ও অপবাদের সামনে নিজেকে নিয়ে কোনোপ্রকার তর্কে নামতে ইচ্ছে করছে না।

সাফা আড়চোখে একবার তাকে দেখে, তূর্ণার শরীর চেক করে বলল, “আপনার বিপদ কেটে গেছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

সাফাকে এখানে দেখে নিজের গর্ভের সন্তানের কথা জানতেও ভয় হলো তূর্ণার। তবে শরীরে কঠিন অবস্থা ও ভয়াবহ যন্ত্রণা অনুভব করে দুর্ঘটনা কিঞ্চিৎ আঁচ করতে পারল। নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে শুধু ঘাড় নাড়ল।

যেহেতু ঈদের দিন… বাড়িতে কুরবানিও হবে… এই সময় সবার এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। তারমধ্যে রোগীর সাথে এতজন থাকাও ঠিক না। সবদিক বিবেচনা করে, ডাক্তারের সাথে কথা বলে দুই বেয়াই পুনরায় গ্রামের পথ ধরলেও মেয়ের সেবাযত্নে হসপিটালে থেকে গেলেন রাজিয়া বেগম।

ডাক্তারের লিখে দেয়া ঔষধ খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতে হলো তূর্ণাকে। এরমধ্যে একবারও নাদিফের সাথে তার কথা হয়নি। জানা হয়নি, গোপন সত্য।

মা ও মেয়ের মাঝখানে অযথা বসে থাকার ধৈর্য্য পেল না নাদিফ। রাতের খাবার আনতে হসপিটালের নিচের রেস্টুরেন্টে এলো সে। খুঁজে খুঁজে নরম ও হজমযুক্ত খাবার কিনে নিল।

কেবিনে প্রবেশ করতে গিয়ে আচমকা পা থেমে গেল নাদিফের। ভেতরের কথাগুলো স্পষ্ট কানে এসে শুকনো মরিচের গুঁড়োর ন্যায় জ্বালা ধরিয়ে দিল শরীরে। রাগে শরীর কেঁপে উঠল। সবকিছু নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে রাজিয়া বেগমকে বলল, “আমি তো এতদিন জানতাম, একটা মেয়ের সম্মান বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছি। অথচ আজ জানলাম, এই গোটা কাহিনীর পরিচালক আপনি। পাপ না কি বাপকেও ছাড়ে না আর সত্যও যে চিরদিন চাপা থাকে না, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আপনি ও আপনার মেয়ে!”

***

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here