#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৪
তূর্ণার বাবা হায়দার আলী মফস্বলের একটা শপিং সেন্টারের মালিক। ওখানে মোটামুটি দশ থেকে পনেরোটা দোকানের ভাড়া দিয়ে সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মিটে যায়। যা কিছু বেঁচে থাকে তিনি সেটা ব্যাংকে একটু একটু করে সঞ্চয় করছেন, যেন ভবিষ্যতে কোনো বিপদ-আপদে কারও কাছ থেকে ধার নিতে না হয়। তিনি মিতব্যয়ী বলে সন্তানদের সবসময় হিসেব করে টাকা দিতেন। যেখানে যত লাগবে, ততই বুঝিয়ে দিতেন। বাড়তি যা দিতেন, সেটা শুধু টিফিনের টাকা হিসেবে। আর ছেলেমেয়েদের যা কিছু লাগত, সেটা তাদের মা কিনে আনতেন।
হায়দার আলীর চার সন্তানের সবচেয়ে ব্যতিক্রম ও বেহিসেবী খরচে অভ্যস্ত তূর্ণা। তার প্রতিদিনই কসমেটিকসের কিছু না কিছু কেনা চাই। মাসে একের অধিক জোড়া জুতো চাই। প্রতিমাসে নতুন জামা চাই। ব্যাগভরা টাকা চাই। বন্ধুদের নিয়ে ফূর্তি করা চাই, এখানে-ওখানে ঘুরতে যাওয়া চাই। কিন্তু বাবা যেখানে হিসেবী, সেখানে মেয়ে কীভাবে দু’হাত ভরে টাকা পাবে? সে-ও পেত না। এই না পাওয়া থেকে রোজ মায়ের সাথে তার একটা নয় একটা ঝগড়া হত আর এসব ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে বাবা হিসেবে হায়দার আলী মেয়েকে কিছু টাকা বাড়িয়েও দিতেন। যাতে মেয়ে নিজের শখগুলো ষোলোআনাই মুঠোয় পুরতে পারে।
কিন্তু তূর্ণার তো এসবেও চলছে না। তার শখ জাগে দামী গাড়ি থেকে দামী বাড়িরও। বাবার এই নিত্য শ’খানেক টাকায় তার কিছুই হয় না। এ কারণে সে বিভিন্ন নামে ফেইক আইডি খুলে বড়োলোক বাবার ছেলেদের ফাঁসানোর ধান্ধায় নামত। প্রতি একমাস অন্তর অন্তর দেখা যেত তার নতুন বয়ফ্রেন্ড তৈরী হচ্ছে। সেটাও করত, নিজেকে খুব পর্দার মধ্যে রেখে। এমন ভাব দেখাত, যেন সে জীবনে প্রেমের পথে হাঁটেনি। এমন করতে করতে এই প্রতিমাসের প্রেমটা তার কাছে একটা নেশার মতো হয়ে যায়। যে নেশায় পা দেয় কায়েসও।
কায়েস প্রতিদিন বাইক নিয়ে ভার্সিটি আসত। তার চলাফেরা, স্মার্টনেস ও চেহারার সৌন্দর্য দেখে তূর্ণা প্রায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। কীভাবে পাখিকে খাঁচায় আটকাবে বুঝতে পারছিল না। এদিকে আগেরটার থেকে মোটামুটি একটা ভালো মানের অ্যামাউন্ট নিয়ে ব্রেকাপ করে ফেলেছে। সে মূলত, প্রথম কিছুদিন দূরে দূরে থাকত, লোকলজ্জার কথা বলে, এরপর হাত ধরা থেকে শুরু করে… বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত! এরূপ করতে করতে একটা সময় পর্দাকে ব্যবহার করে, নিজের চেহারা আড়ালে রেখে নামমাত্র প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক যত গভীর করলে নিজের ফায়দা, তত গভীরেই যেত! এরপর কয়েকটা ভিডিয়ো রেখে দিয়ে তাদের সেটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করত।
দুর্ভাগ্য এখন পর্যন্ত তূর্ণা যার যার সাথে এমন করেছে, কেউ-ই তার আসল চেহারা দেখেনি। সব কাজ করত মুখ লুকিয়ে। বলত, লজ্জা লাগে!
কায়েসের সাথে সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর যখন তার কাছ থেকে কোনোভাবেই টাকা আদায়ের সুযোগ পেল না, তখন বাধ্য হয়ে বিয়ের মতো রাস্তাকে বেছে নিল। লুকিয়ে বিয়ে করে যেখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি এবং বিভিন্ন হোটেলে রাত কাটানো। কারণ তার ধারণা ছিল, কায়েস বড়োলোক বাবার ছেলে এবং তার পকেটভরা টাকা মানে ভবিষ্যত নিরাপদ।
সবকিছুর পরও কায়েসের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ঝামেলায় যাওয়ার কোনো সুযোগ তূর্ণা পেল না। বিয়ের আগে কায়েস তার সাথে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করেনি, বরং বিশ্বস্ত মানুষ ও সঙ্গীর মতো চলাফেরা করেছে। তার খেয়াল রেখেছে। বিয়ের পর বাঁধল আসল গণ্ডগোল। যখন বিয়ের সত্যি প্রকাশ্যে এনে মোটা অংকের টাকা আদায় করতে চাইল, তখনই জানা গেল, কায়েসের নিজেরই কোনো ইনকাম নেই। সহায়-সম্পদ কিছুই নেই। তূর্ণার মাথায় বাজ তো সেদিনই পড়েছিল।
মানুষকে ফাঁসাতে ফাঁসাতে তূর্ণা এতটাই বেখেয়ালি ছিল যে, কায়েসের সম্পর্কে তেমন একটা খোঁজখবর না নিয়েই তার সাথে নাটুকে প্রেমে জড়িয়েছে আবার অতি লোভের বশবর্তী হয়ে বিয়ে করে নিয়ে তার বাচ্চার মা-ও হতে যাচ্ছে। এই খবর যেদিন তূর্ণা পেল, কায়েসকে জানানোর পর সে বলল, “তোমাকে এখন বাচ্চা নিতে বলেছে কে? খাওয়াব কী? আমার আছে কিছু?”
তূর্ণা অবাক হয়ে বলেছিল, “কিছুই যদি না-ই, এমন রাজা-বাদশার মতো ঘোরাঘুরি করতে কেন?”
“এগুলো স্টাইল। এ যুগে স্টাইল না থাকলে চলে? পকেটে টাকা থাকুক আর না থাকুক, স্টাইল ঠিকই থাকা লাগে!”
“আমাদের বিয়ে?”
“কীসের বিয়ে? ওটা তো তোমার মতো মেয়েকে ভোগ করার একটা পথ ছিল মাত্র।”
“কী বলতে চাইছ তুমি?”
“কিছুই না। একটু মজা নিতে ইচ্ছে হলো!”
“তুমি আমার সাথে এটা করতে পারো না। আমি তোমার নামে মামলা করব!”
“কোনো লাভ নেই। উলটে তোমার মান-ইজ্জত যেটুকু ছিল, সেটাও যাবে।”
এরপর কায়েস যেসব ভিডিয়ো দেখাল, তা দেখে ঘৃণায় তূর্ণার নিজের শরীরই জ্বলে উঠল। নিজের পাতা ফাঁদে সে নিজেই কীভাবে জড়িয়ে গেল, টেরও পেল না। কোনোমতে বলল, “আমি প্রেগন্যান্ট কায়েস। প্লিজ, এমন কিছু করো না। আমার এই বাচ্চার কী হবে, বলো তো?”
“কী হবে মানে? মেরে ফেলো!”
“অসম্ভব!”
“তাহলে পেটে রাখো৷ আমার কী? আমি এর দায়িত্ব নিতে পারব না। যদি বেশি সাহস দেখাতে যাও, সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেব। দেখে নেব, তোমার তেজ কতটুকু! তোমার ওই শরীর গোটা দেশ দেখবে, ভালোই হবে তখন, কী বলো? মানুষ মজা নিবে।”
“তাহলে তুমিও শোনে রাখো, এই নামমাত্র সম্পর্ক থেকে মুক্তি নেব আমি।”
কায়েস হেসে বলল, “নিয়ে নাও। তাতে আমার কী? আমার যা পাওয়ার, সেটা তো আমি পেয়ে গেছি।”
এই ঘটনার পরের সপ্তাহে দশ লাখ টাকার যৌতুক নিয়ে বাবা-মায়ের পছন্দের একটা মেয়েকে বিয়ে করে কায়েস। সেই টাকা দিয়ে একটা দোকান তুলেছে। যেটা তাকে আর্থিক সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। আর তূর্ণা অনাগত সন্তান নিয়ে অথৈ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে।
তূর্ণা যখন আবারও কায়েসকে বুঝাতে গেল, কায়েস তাকে ফিরিয়ে দিল। আরও বলল, “যদি যৌতুক হিসেবে তোমার বাবার ওই শপিং সেন্টার দিয়ে দাও, ভেবে দেখতে পারি।”
“আমাদের বাচ্চার কথা ভাববে না?”
“ভেবে লাভ? আমি চেয়েছিলাম বাচ্চা?”
নিজের সম্মান বাঁচানো, বাবার দোকান বাঁচানো, আবার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ, সবমিলিয়ে তূর্ণার তখন দিক হারানোর দশা।
এমন সময় সমস্ত সমস্যার সমাধান দিতে হুট করে নাদিফের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব যাওয়া। তূর্ণার মামা একজন চেয়ারম্যান এবং মেম্বার নাদিফের মামার বন্ধু। তাদের মাধ্যমেই কনের খোঁজখবর আসে এবং নাদিফের মামার পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব যায়।
তূর্ণার এইসব দুই নম্বরি কাজ সব তার মা রাজিয়া বেগম জানতেন। মেয়েকে পুরোটাই বিপদে দেখে তিনি এ্যাবরশনের সিদ্ধান্ত নিলেও তূর্ণা সেটা করেনি। জেদ দেখিয়ে নিজের বাচ্চাকে বাঁচাতে চেয়েছে। এদিকে নাদিফের বাড়ি থেকে একরকম তাড়াহুড়ো শুরু হয়। মেয়ে অনেক সুন্দর। নম্র-ভদ্র, শান্ত। চরিত্রও সুন্দর। দেরী করার কোনো প্রশ্নই আসে না। তা-ই দ্রুত বিয়ে ঠিক করে, গোপনে মেয়েকে তিনি শিখিয়ে দিলেন, কীভাবে ওই সংসারে থেকে নিজেকে এবং নিজের সন্তানকে বাঁচানোর পাশাপাশি নাদিফকেও জালে আটকে রাখতে হবে।
এরপর থেকে বিয়ের রাতে তূর্ণা যত সত্যমিথ্যা এক করে নানান কাহিনীর প্যাঁচ সাজিয়েছে, সবই তার মায়ের শেখানো। এমনকি জ্বিন-ভূত এসবের কথা বলে নিজেকে দুর্বল বুঝিয়ে বার বার নাদিফের কাছেপাশে থাকতে চেয়েছে। তার খেয়াল রেখে বুঝাতে চেয়েছে, সে একজন ভরসাযোগ্য মানুষ। তার বাবা-মায়ের প্রতি ভাব-ভালোবাসা দেখিয়ে নিজেকে ভালো বৌমা সাজাতে চেয়েছে।
তাছাড়া সেদিনের সেই চুক্তিপত্রের খবরটাও তূর্ণার মামা আগে জেনেছেন। জানার পর বোনকে জানালে, তিনি ভাইকে বলে সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দেন। এবং অপ্রকাশ্য রেখে দেন। কারণ এই সত্য প্রকাশ পেলে তূর্ণার সাথে নাদিফের যে মিছে সংসার, সন্তান এবং নাদিফের বাড়ির গোটা সম্পত্তি, সবটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর যাইহোক, এত বড়ো বাড়ি ও বাড়ির মালিকানা মেয়ের হাতের বাইরে যেন না যায়, সেজন্য তিনি খুব গোপনে মেয়েকে নানানভাবে নাদিফের কাছ ঘেঁষে থাকার বুদ্ধি শিখিয়ে যাচ্ছিলেন।
পিছনের সব ঘটনা ও গতকালের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় মেয়ের গর্ভের সন্তান হারানোয় রাজিয়া বেগম খানিকটা খুশিই হয়েছেন। এবার নাদিফকে আরেকটু বুঝিয়ে নিতে পারলেই মেয়ে ওখানে সারাজীবনের জন্য জায়গা করে নিতে পারবে। যদিও সবার সামনে কান্নার নাটক করতে হয়েছে, তবে তিনি মন থেকে চাইছিলেন এই বাচ্চার জন্ম না হোক।
মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “তোকে যে বললাম, নাদিফকে জালে আটকাতে? তার কী হলো?”
তূর্ণা বলল, “কিছুই হচ্ছে না। ও মেয়েদের কাছ ঘেঁষা পুরুষ না। খুবই সতর্ক এবং রক্ষণশীল। নিজের শরীরে অন্য মেয়ের একটা স্পর্শও সহ্য করতে পারে না। তারমধ্যে সে জানে আমি তার বউ না। বিয়েটা হয়নি। এ কারণে ও দূরত্ব মেইনটেইন করে চলে।”
“কী বলিস? এমন করলে প্রেম হবে কী করে? আর প্রেম না হলে, ওই সংসারে তুই ঠিকবি কী করে? সংসারে না ঠিকলে, এতসব সম্পত্তি তোর হবে কী করে?”
“সেটাই তো ভাবছি।”
“শোন, এইবার আরেকটু নাটক সাজাতে হবে। এখন বাচ্চাটা নেই। এই সুযোগে অতিরিক্ত কান্নাকাটি ও অসহায় অবস্থা দেখিয়ে বুঝাতে চাইবি যে, ও ছাড়া তোর কেউ নেই। প্রয়োজনে এটাও বলবি যে, মিছে সংসার করতে করতে তাকে ভালোবেসে ফেলেছিস। ভালোবাসার কথা জানলে যেকোনো পুরুষকে দুর্বল করে ফেলা সম্ভব।”
“ঠিক আছে। দেখব।”
ঠিক সে-ই সময়ই নাদিফ ভেতরে প্রবেশ করে নিজের মনের ক্ষোভ ঝেড়ে মা ও মেয়ের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল।
রাজিয়া বেগম কিছু না বুঝার মতো করে জানতে চাইলেন, “এসব কী বলছ? কীসের পরিচালক? কীসের সত্য?”
নাদিফ গর্জে উঠে বলল, “চুপ থাকুন আপনি। আর একটা কথা বলবেন তো, আমি ভুলে যাব আপনি আমার গুরুজন।”
তূর্ণা ভীষণ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, “উনি আপনার মায়ের বয়সী, নাদিফ!”
“সো হোয়াট? ওনার অন্যায়টা আমি দেখেও দেখব না?”
“আসলে হয়েছে কী!”
“চুপ… একদম চুপ। আপনি আর একটা কথা বলবেন, আমি আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই কেবিনের বাইরে নিয়ে ফেলব। যতটা সম্মান, যত্ন ও ভদ্রতার কারণে এতদিন আপনার মতো একটা লোভী, বিবেকহীন মানুষকে দুর্বল ও সহজসরল ভেবে দয়া দেখিয়ে থাকতে দিয়েছি, ততটাই অপমান ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হব। কারণ আপনি এসবের যোগ্য নন।”
“নাদিফ আপনি ভুল বুঝছেন!”
নাদিফ আঙুল তুলে শাসাল, “একটা শব্দও না। একটাও না।”
এরপর রাজিয়া বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি তো মা। আপনার উচিত ছিল না, মেয়েকে ভুলের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে সঠিক রাস্তা চেনানো? তা না করে আপনি তার ভুলকে প্রশ্রয় দিয়ে আরও হাজারটা ভুল করিয়েছেন! সেইসাথে আমার গোটা পরিবার ও আমাকে ঠকিয়েছেন। আমার পরিবারের মানুষ আপনার কী ক্ষতি করেছিল, যার কারণে এরকম একটা জঘন্য কাজ করে আমার জীবন নষ্ট করে দিলেন? আপনাদের সাথে তো আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। এই নাটুকে বিয়ের আগপর্যন্তও আমি আপনাদের কাউকে চিনতাম না। তাহলে এসব কেন? কী প্রয়োজনে?”
তূর্ণা বলল, “মায়ের কোনো দোষ নেই, নাদিফ। আমি অপরাধী। আমার অতি লোভ আমাকে এই কঠিন শাস্তি দিয়েছে। প্লিজ, আপনি মাকে কিছু বলবেন না।”
নাদিফ তীব্র রাগে ফেটে পড়ে বলল, “আপনার তো সাহস কম না। চুপ থাকতে বলেছি না? এত কথা কীসের? কে আপনি? এ্যাই মেয়ে, হু আর ইউ? আমি আপনার সাথে কথা বলছি? আগ বাড়িয়ে আর একটা মিথ্যে কথা যদি বলেছেন, গাল ফাটিয়ে দেব।”
ভয়ে কেঁপে উঠল তূর্ণা। নাদিফকে এত রাগতে দেখেনি কোনোদিন। আজ এইভাবে… উফফ। নিজের উপর রাগ হলো তার। সব সত্যি এভাবে জেনে গেল! ধাৎ… এখন কী করবে?
রাজিয়া বেগম কিছু বলার আগেই পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে বেডের উপর রেখে নাদিফ বলল, “আগামী তিনদিনের খরচ। পাপ যেহেতু আমি টেনে এনেছি, এর দায়ভারও আমার। তিনদিন পর মেয়েকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবেন। আর কোনোদিন আমার বাড়ির ত্রিসীমানায়ও যেন আপনাদের ছায়া না দেখি। যদি দেখেছি তো… শহরের প্রতিটা কোণায় আপনি ও আপনার মেয়ের এসব নোংরামির খবর ছড়িয়ে দেব। সো বি কেয়ারফুল!”
এরপর চোখ গরম করে তূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনাকে খুব সাদাসিধে একটা মানুষ ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম, গ্রামের অন্যসব সাধারণ ও সহজসরল মেয়ের মতোই একজন। আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে যে গেইম আপনি খেললেন… এসবের পর আমার রব যদি আপনাকে ক্ষমা করে দেন, আমি দেব না। আমার গোটা পরিবারের সুখ, শান্তি, হাসি-আনন্দ কেড়ে নেয়ার জন্য যে দায়ী, তাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। কোনোদিনও না।”
নিজের কথার স্পষ্টতা দেখিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে এলো নাদিফ। এরপর একটা টিকেট কেটে গ্রামের পথে রওনা হলো!
***
চলবে…
#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৫
শেষরাতে বাড়ির উঠোনে এসে উপস্থিত হলো নাদিফ। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে নাজিফাকে কল করল। রিসিভ্ হওয়ার পর বলল, কাউকে না ডেকে চুপচাপ গেট খুলতে।
নাজিফাও সেটাই করল। গভীর ঘুম ছেড়ে উঠে বাড়ির উঠোনে ভাইকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। গেটে লাগানো তালা খুলতে খুলতে বলল, “তুমি একা কেন? ভাবী কোথায়?”
নাদিফ কোনো উত্তর দিল না। হাতের লাগেজ টেনে টেনে ঘরে এসে বলল, “বাবা-মাকে এখুনি ডাকবি না। আমি সকালে কথা বলব।”
নাজিফা ঘাড় নেড়ে পুনরায় তালা আটকে নিজের রুমে চলে গেল।
নাদিফ রুমে এসে লাগেজ থেকে নিজের শার্ট-প্যান্ট আলমারিতে তুলতে গিয়ে ওখানে তূর্ণার প্রয়োজনীয় যা কিছু পেল, সব আলাদা একটা লাগেজে ঢুকিয়ে চেইন আটকে রেখে দিল। এরপর ফ্রেশ হয়ে চিৎ হয়ে পড়ল বিছানায়। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। মন ও শরীর দুটোই এখন বিশ্রাম চাইছে। অথচ… চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। মনে একচিমটি শান্তি ও স্থিরতা নেই। জীবনে এমন ধোঁকাবাজ নারী সে কম দেখেছে। নাটক-সিনামায় হরদম এসব দেখে থাকলেও বাস্তবে এমনকিছু হতে পারে বলে তার ধারণা ছিল না। যদি না তূর্ণার এই ধোঁকাবাজি নিজের সাথে ঘটত, হয়তো বিশ্বাসও হত না, কেউ কাউকে এইভাবে ভুল বুঝাতে পারে, এইভাবে ঠকাতে পারে। নিজের বোকামি ও নির্বুদ্ধিতার পাশাপাশি চট করে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলার মতো অতি বাড়াবাড়ি রকমের ভালো মানুষি আচরণে সে নিজেই এখন বিরক্ত। কী দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে এত সাহায্য করার? কী দরকার ছিল, তূর্ণার মিথ্যেটাকে প্রশ্রয় দেয়ার? প্রথমদিনই যদি সবাইকে বলে দিত, আজ মনটাও এতটা কষ্টের পাহাড়ের বোঝা বয়ে বেড়াত না।
ওভাবে শূন্যে দৃষ্টি রেখে কখন যে ক্লান্তিভরা দুটো চোখে ঘুম চলে এসেছে, টেরও পেল না। সকাল নয়টায় তার বাবার ডাকে ঘুম ভাঙল।
হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে এলো নাদিফ। বাবা যে প্রচুর রেগে আছেন, সেটুকু স্পষ্ট। নতমুখে জানতে চাইল, “ডেকেছ?”
ওবায়দুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে বজ্রকণ্ঠে বললেন, “তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি আমি? ঘরের বউকে একা রেখে চলে এসেছিস! এসব কী, নাদিফ?”
নাদিফ একটু সময় নিল। এরপর আস্তেধীরে বিয়ের রাত থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত যা যা ঘটে গেল, এবং কীভাবে নিজেই নিজের বোকা বোকা কাজে ফেঁসে গেল, সবটুকু বলে একটু দম নিল।
ওবায়দুর রহমান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললেন, “ইন্না-লিল্লাহ! এসব কী জঘন্য কথা বলছিস!”
“এটাই সত্যি, বাবা। আমি জানি কাজটা ঠিক করিনি। এরজন্য তুমি আমাকে যে শাস্তি দিবে মাথা পেতে নেব। তা-ও এমনকিছু বলো না, যেটুকু গ্রহণ করতে কষ্ট হবে।”
“আমি এক্ষুণি দশ গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বার, এমনকি যত মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গ আছেন, সবাইকে এই ঘটনা জানাব। জেনে-বুঝে তারা কীভাবে আমাদের ঠকাল এবং এতবড়ো অন্যায় কাজকে সমর্থন করতে বাধ্য করাল, তারজন্য কঠিন জবাবদিহি করতে হবে তাদের। আমি এত সহজে এই অন্যায়কে মেনে নেব না।”
“লোক জানাজানির দরকার নেই, বাবা। শুধু গার্ডিয়ানদের জানিয়ে বলো যে, আমাদের এই বাড়িতে আর তাদের মেয়ের জন্য কোনো জায়গা নেই।”
“এই কাজটা তোর আগেই করা উচিত ছিল। ওদের তো আমার এখন পুলিশে দিতে মন চাইছে। এত খারাপ এরা মা-মেয়ে! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।”
মনোয়ারা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন এসব শোনে। নাদিরা ও নাজিফা হা হয়ে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। তূর্ণাকে দুইবোন কত আপন ভেবেছিল। নিজেদের একজন ভেবে কতশত খুঁনসুটি করেছিল। আজ জানল, সে-ই মানুষটা এই ঘরের বউ-ই হয়নি। উলটে তার নিরপরাধ ভাইয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছিল! মানুষ এত জঘন্য!
সব কথা বলা শেষ হলে মনোয়ারা বেগম স্থির চোখে ছেলেকে দেখে বললেন, “তুই নিজেও তো একই অন্যায়ে পা দিয়েছিস। বিয়ে ছাড়া দিনের পর দিন একটা মেয়েকে নিয়ে একই ফ্লাটে! ছিঃ… তুই আমার সন্তান এইটুকু ভেবে আমার এত রাগ হচ্ছে। এক্ষুণি আমার চোখের সামনে থেকে যা। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি। তোর কোনো ক্ষমা নেই। তুই একটা পাপী। অপরাধী।”
এতটুকু বলে তিনি হাপুসনয়নে কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেলেও নিজেকে থামাতে পারলেন না।
নাদিফ বলল, “একই ফ্লাটে ছিলাম, তাইবলে নিজের চরিত্রের বিসর্জন দিইনি। আমাকে আর যা-ই ভাবো, অন্তত চরিত্রহীন ভেবো না। তবুও যদি তুমি চাও, আমি এখান থেকে চলে যাই; তা-ও মেনে নেব।”
মায়ের দিক থেকে আর কোনো বাক্য না এলেও নাদিফ বাড়িতে থাকল না। যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে তূর্ণার লাগেজটা নাজিফার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিস।”
নাজিফা বলল, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
“যেখানেই যা-ই, মা না চাইলে আর ফিরব না। তোরা ভালো থাকিস।”
একটা সুখের সংসারে মুহূর্তেই যেন আগুন ধরে গেল। মনোয়ারা বেগম আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে গেলেন। আর ওবায়দুর রহমান একদম পাথর হয়ে বসে থাকলেন। একসময় ফোন করলেন, হায়দার আলীর নম্বরে।
***
শুয়ে-বসে থেকে একদম বিরক্ত হয়ে গেছে তূর্ণা। তারমধ্যে নিজের করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। যে সন্তানের জন্য সে এই মিথ্যে খেলায় নামল, সে-ই সন্তানই তার রইল না। এদিকে তার সমস্ত অন্যায় ও মিথ্যে গল্পকে পিছনে রেখে মন পুরোটাই নাদিফের প্রতি দুর্বল হয়ে বসে আছে। এরকম একটা সময়ে এসে এখন কীভাবে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে জানে, ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় হয়ে গেছে… এখন আর কিছু বলে এই সত্যকে মিথ্যে প্রমাণ করতে পারবে না। পারবে না মাথা উঁচু করে নাদিফের সামনে দাঁড়াতে। এ কারণে কাল থেকে যতবার ফোন করার চেষ্টা করেছে, ততবারই কল কেটে দিয়েছে নাদিফ। একসময় নম্বর ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিয়েছে। মায়ের ফোন থেকে ট্রাই করেছিল, সেটাও ব্লক করে ফোন বন্ধ করে রেখেছে৷ এ পর্যন্ত যতবার ভিন্ন ভিন্ন নম্বর থেকে কল দিয়েছে, ততবারই ফোন সুইচড অফ শুনিয়েছে। আর কীভাবে যোগাযোগ করবে ভেবে পাচ্ছে না।
দুর্বল শরীর নিয়ে সকালের নাশতা খেতে গিয়ে সেটাও গিলতে পারল না। অপরাধবোধ তার সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক গিলে খেতে চাইছে। নাদিফের মতো মানুষকে এইভাবে ঠকানোর চিন্তা মাথায় না আনলেও বোধহয় ভালো ছিল। একটুখানি চেষ্টা চালিয়ে যদি মায়ায় ফেলতে পারত, তাতেও কাজ হয়ে যেত! কিন্তু সে যা করল!
সাফা কেবিনে প্রবেশ করে দেখল তূর্ণা শান্ত দৃষ্টিতে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো কিছু ভাবছে, হয়তো না। সে গতদিনের ব্যাপার জানে না, এমন একটা ভাব দেখিয়ে বলল, “এখন কেমন আছেন?”
তূর্ণা জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “এইতো, ভালো।”
“সকালের ঔষধ খেয়েছেন?”
“জি…।”
সাফা তার শারীরিক অবস্থা দেখে-বুঝে বলল, “এখন থেকে নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হবেন। আর একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।”
তূর্ণা এখনও জানে না, সাফা সত্যিটা জানে কি না। তবে তার কণ্ঠস্বর শোনে খুব একটা সন্দেহ জাগল না মনে। শুধু বলল, “কাল নাদিফ কিছু বলেছে আপনাকে, আমার ব্যাপারে?”
সাফা জানতে চাইল, “কেন বলুন তো!”
“এমনিই। না মানে, আপনি তো একজন ডাক্তার। রোগীর সবকিছুই আপনার জানা। আচ্ছা, পরশু রাতে আমার ট্রিটমেন্ট করেছিল কোন ডাক্তার?”
“আমি-ই ছিলাম।”
বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল তূর্ণা। তারমানে এটাই দাঁড়ায়, সাফা সবকিছু জানে। যেহেতু সে একজন ডাক্তার, তার কাছে তো সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেছে। সর্বনাশ! এখন এই লজ্জা সে কোথায় রাখবে?
তূর্ণার চিন্তিত মুখ দেখে সাফা বলল, “যাই হয়ে যাক, নিজের খেয়াল রাখতে ভুলবেন না। আমি এখন যাচ্ছি। রাতে দেখা হবে।”
এরপর আর না দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কেবিন থেকে বের হয়ে এলো সাফা। হসপিটাল থেকে নিচে এসে দাঁড়াতেই শাফিন এসে দাঁড়াল সামনে। আঙুল নাচিয়ে বলল, “হাই… কী খবর?”
সাফা মুচকি হেসে বলল, “ভালো। আপনার?”
“খুব ভালো। আপনি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন? অযথা সময় নষ্ট কেন করছেন? একবার হ্যাঁ বলে দেখুন, আমি আপনাকে পৃথিবীর সেরা সুখীদের একজন করে দেব।”
“তা-ই? সুখকে পাওয়া এতটাই সহজ?”
“সহজ নয়?”
“একদমই না। ঢং বাদ দিয়ে নিজের কাজ করুন।”
“পাত্তা দিচ্ছেন না তো? পরে কিন্তু পস্তাবেন।”
“আচ্ছা। যখন পস্তাব, তখন আপনাকে ডাকব। কেমন?”
শাফিন কাঁধ নাচিয়ে বলল, “ঠিক আছে।”
শাফিন জানে, সাফাকে রাজি করানো সহজ কাজ নয়। তা-ই সে চেষ্টায়ও করছে না। এই রাস্তা ধরে কাজে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে সাফা সামনে পড়ায় তার সাথে একটু কৌতুক করতে ইচ্ছে করল। আসলে এমন কঠিন মনের মানুষ যারা, তারা সহজে নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে পারে না। আবার অন্যকে গ্রহণও করে নিতে পারে না। যদি সুখ জীবনে না-ও আসে, তবুও এরা খুব যত্নে একপাক্ষিক ভালোবাসা মনে পুষে রেখে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।
শাফিন নিজেও চায় না, যে তার জীবনে আসবে সে অন্য কাউকে মনে নিয়ে সুখী সাজার ভান করে জীবন কাটিয়ে দিক। তার জীবনে যে আসবে, সে যেন পুরোটা তার হয়েই আসে। এজন্য সাফা সম্পর্কে বাড়িতে হ্যাঁ বা না কিচ্ছু বলেনি। শুধু বলেছে, বিয়ে নিয়ে পরে ভাবব। আমার আরও কিছুদিন সময় লাগবে।
সাফাকে রেখে শাফিন চলে গেল। ভাবনারত মন নিয়ে সাফা গাড়িতে উঠে নিজের ফোন থেকে ফেসবুকের নিউজফিডে চোখ রাখল। তখনই দেখল, “ওয়ালিদ-উর-রহমান” নামক আইডি থেকে একটা পোস্ট আপলোড হয়েছে। একটা উদাসীন ছবি ও ক্যাপশনে লেখা – “সব গল্পের শেষে সুন্দর গন্তব্য কিংবা সুন্দর সমাপ্তি থাকে না। কিছু কিছু গল্পের শেষটা হয় সময়ের নিষ্ঠুর ছোবলের মতো। যে ছোবল ব্যক্তির হৃদয়ে বিষের ন্যায় যন্ত্রণা দেয়। ব্যক্তিকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। তাকে ফাঁকা পথে হোঁচট খাওয়ায় আবার একাকী পথ চলার অনুপ্রেরণা জোগায়।”
ক্যাপশন দেখে সাফা একটা কমেন্ট করল, “একাকীত্ব কিন্তু সুন্দর! একা বেঁচে থাকাতে শান্তি। একা পথ চলাতে মানসিক সুখ নিহিত। যদি সব বাধাকে অতিক্রম করে; তা উপভোগ করতে পারেন।”
***
চলবে…





