লাস্ট স্টেশন পর্ব-১৬+১৭

#লাস্ট_স্টেশন
…🖋️ তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৬

হায়দার আলীকে নিজের বাড়িতে ডাকেননি ওবায়দুর রহমান। বাজারে এসে দেখা করতে বলেছেন। এরপর একটা চায়ের দোকানে বসে ঠাণ্ডা মাথায় সব ঘটনা খুলে বলেছেন। তিনি বুঝতে চেয়েছেন, মেয়ের প্রেগন্যান্সির এই সত্যি ভদ্রলোক জানেন কি না। তার সন্দেহটাই ঠিক হলো। হায়দার আলী না মেয়ের প্রেম সম্পর্কে জানতেন আর না জানতেন এতসব নোংরামি! হুট করে নিজের মেয়ের সম্পর্কে এত খারাপ খারাপ কথা শোনে তিনি রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলেন। ক্ষমা চেয়ে নিজেকে লজ্জিত করতে ইচ্ছে হলো না। স্থির চোখে কতক্ষণ রাস্তাঘাটের যানবাহনের দিকে চেয়ে রইলেন।

ওবায়দুর রহমান বললেন, “আমার উচিত ছিল আপনার মেয়ের সম্পর্কে আরও ভালোমতো খোঁজখবর নেয়া। সেটা না করে আমি আপনাদের কথার উপর ভরসা করে আমার ছেলের জীবনে বিপদ টেনে নিয়েছি। এখন এই অন্যায় ও পাপ থেকে বের হওয়ার পথ একটাই, আপনার মেয়েকে ঘরে তুলে নেয়া।”

হায়দার আলী থম মেরে বসে থেকে বললেন, “আপনি চাইলে মামলা করতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

দোকানে উপস্থিত ছিলেন তূর্ণার মামা মাসুক তরফদার। তিনি বিষয়টা মিটমাট করে নিতে বললেন, “আমি বলি কী, ওদের আবার বিয়ে দিয়ে দিলে সব সমস্যা মিটে যেত। মানুষজন জানত না, নিন্দেমন্দ রটত না। সবদিক দিয়ে একটা মেয়ের সম্মান ও পরিবার রক্ষা পেত। আপনি আমার কথাটা একটু বিবেচনা করুন।”

ওবায়দুর রহমান কাষ্ঠ হেসে বললেন, “একবার যে মানুষ ভুল করেছে, অন্যায়ে পা ডুবিয়েছে, সে যে আবারও ভুল করবে না, তার কী গ্যারান্টি? তাছাড়া আমার ছেলে, যে এত বড়ো একটা ধোঁকার শিকার হলো! ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ হলো! কষ্ট পেল! সেসবের কী হবে? বিয়ে দিলেই সব মিটমাট হবে না। বরং সমস্যা আরও বাড়বে। যে সম্পর্কে বিশ্বাস, ভরসা ও শ্রদ্ধা-সম্মান নেই, শুধু মিথ্যে গল্প লুকানো, সে-ই সম্পর্ক কখনোই সুখের মুখ দেখে না। আমি দ্বিতীয়বার আমার ছেলের মন ভাঙতে পারব না।”

“আপনি ভেবে দেখুন ভাই সাহেব, এভাবে একটা মেয়ে একেবারে অসহায় অবস্থায় কোথায় যাবে?”

“সেটা ভাবার দায়িত্ব আপনাদের। আমার নয়, ভাই।”

“এখন আপনি ঠিক কী চাইছেন?”

“আমি তো অবশ্যই এই অন্যায়ের সঠিক বিচার চাইব। প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেব। তবুও আমার ছেলের জীবন নষ্ট হতে দেব না।”

“আর আমরা যদি বলি, আপনার ছেলে আমাদের মেয়েকে জোরপূর্বক আটকে রেখে নির্যাতন করছে তখন?”

ওবায়দুর রহমানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি তো এইদিক ভাবেননি! এখন তো নাদিফ নিজে ফেঁসে যাবে। তবুও মাথা উঁচু করে নির্ভয়ে জানালেন, “করতে পারেন যা খুশি। আমার ছেলের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আইন যখন পর্যাপ্ত প্রমাণ চাইবে, তখন না আবার আপনাদের মেয়ের কুকর্ম বাইরে চলে আসে। শত হলেও সে অসংখ্য পুরুষের মন ভেঙে খেয়েছে। তার দোষ তো একেবারে ছেড়ে দেয়ার মতো নয়, তাই না?”

মাসুক তরফদার দাঁতে দাঁত চেপে তাকালেন। ওবায়দুর রহমান পাত্তা না দিয়ে বললেন, “শুনুন ভাই, সন্তানদের মানুষ বানাতে না পারলেও অমানুষ হতে সাহায্য করবেন না। এমনকি তার সব অন্যায়কে ক্ষমার চোখে দেখবেন না। সব অন্যায় ক্ষমা করে দেয়া গেলেও নোংরামিকে কখনও ক্ষমা করা যায় না। আমার এসব কথা বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আপনাদের মেয়ের চরিত্রই তাকে আজ এই অবধি টেনে এনেছে। যদি সে ভালো মানুষ হত, এত খারাপ ঘটনা তার সাথে ঘটত না। আর সে-ও আজ পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরত না।”

“আপনি দয়াকরে এইসব বিষয় আর পাঁচকান হতে দেবেন না।”

“কেন? এত বড়ো একটা অন্যায় করলেন আপনারা। জানার পরও ছেড়ে দেব আমি?”

“বাচ্চা মানুষ ভুল করে ফেলেছে।”

“ও বাচ্চা। আপনারা তো বাচ্চা নন। আপনি কীভাবে জেনে-বুঝে বিষয়টা গোপন রাখলেন? দোষ তো আপনাদেরও আছে।”

মাসুক তরফদার দিশেহারাবোধ করলেন। এভাবে যে তূর্ণার সামনে পাহাড় ধ্বসে পড়বে তিনি ভাবেননি। মেয়েটার আর সংসার হলো না। তিনি মাথাভরা চিন্তা নিয়ে বললেন, “ভাই ছাড়েন না। ব্যাপারটা আমরা-আমরা মিটিয়ে নিলেই তো হয়ে যাবে। আপনি যেহেতু তূর্ণাকে ছেলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবেন না, সেক্ষেত্রে একটা উপকার করুন। এইসব কথা না বলে সবাইকে এটাই বুঝাই যে, ওদের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে!”

ওবায়দুর রহমান বিস্মিত চোখে চেয়ে বললেন, “আপনিও দেখছি আপনার ভাগনির মতো বাচ্চা হয়ে গেলেন। এত বড়ো একটা ঘটনাকে এইভাবে চেপে যেতে চাইছেন? আমি আজই আট-দশজন মুরব্বি জমা করব বাড়িতে। আপনাদের দাওয়াত রইল। এসে ঝামেলা মিটিয়ে যাবেন।”

***

বিকেলের শেষমুহূর্তে তূর্ণার কাছে তার মামার ফোন এলো। রিসিভ্‌ করে ভালোমন্দ কিছু না বলে তিনি শুধু বললেন, “তাড়াতাড়ি গ্রামে ফিরে আয়। তোর বাবা হার্ট-অ্যাটাক করেছে।”

এইটুকু শোনে তূর্ণার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। জানতে চাইল, “কীভাবে হলো?”

“আর বলিস না। নাদিফের বাবা গ্রামের মুরব্বি ডেকে বিচার বসানোর জন্য তারিখ চেয়েছেন। এসব শোনে সবাই যখন তোর বাবার কাছে আসল ঘটনা যাচাই করতে এলো, তখনই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমি দুলাভাইকে নিয়ে এখন হসপিটালে আছি। তুই আপাকে নিয়ে চলে আয়।”

“আচ্ছা, আমি দেখছি।”

ফোন রেখে ডিসচার্জের প্রস্তুতি নিল তূর্ণা। নাদিফের উপর তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ক্ষমা করবে না ঠিক আছে, তাইবলে এইভাবে মানহানীর মধ্যে ফেলবে? এই ছেলেকে এবার উচিত শিক্ষা দিতে হচ্ছে। সে মনে মনে একটা পরিকল্পনা এঁটে অসুস্থ শরীর নিয়ে বেড ছেড়ে রাজিয়া বেগমকে বলল, “গ্রামে ফিরতে হবে, মা। সব গুছাও।”

রাজিয়া বেগম বললেন, “তোর তো চিকিৎসা বাকি। এক্ষুণি এতদূরে জার্নি কি ঠিক হবে?”

“কিছু হবে না, মা। ঝটপট করো তো। ভালো লাগছে না।”

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হসপিটালের সব ঝামেলা মিটিয়ে নাদিফের ফ্লাটে এসে উপস্থিত হলো তূর্ণা। দরজা বন্ধ। ফোন বন্ধ। বেল বাজালেও খুলে দিচ্ছে না। এদিকে ঘরের ভেতরে তার অনেককিছু আছে। এসব না নিয়ে কীভাবে যাবে?

দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে ব্যথা ধরে এলো। সাফা বের হতে গিয়ে মা ও মেয়েকে দরজার সামনে দেখে বলল, “একী, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনারা?”

এই মেয়েটার আদিখ্যেতাটা অসহ্য লাগল তূর্ণার। এমনিতেই মেজাজ ঠিক নেই, তারমধ্যে এসব গা জ্বালানো কথা। রেগে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “গ্রামে যাব তো আপু। কিছু দরকারী জিনিস আছে ঘরে।”

“ওহ…। শরীর ঠিক আছে আপনার?”

“জি, একদম।”

সাফা অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। এইটুকু শুধু ভদ্রতা রক্ষার্থে বলেছে, একজন ডাক্তার হিসেবে। নয়তো এমন জঘন্য মন-মানসিকতার মানুষের সাথে কথা বলার রুচিও হত না তার।

সাফা চলে গেলে তূর্ণা যেন আচমকা একটা বুদ্ধি পেয়ে গেল। নাদিফ তো তার ফোন ধরছে না। নম্বরও ব্লক করা। স্বর্ণার নম্বর থেকে নিশ্চয়ই নাগাল পাওয়া যাবে? বিজয়ীর ন্যায় হেসে স্বর্ণার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজাল সে।

স্বর্ণা দরজা খুলে তূর্ণাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “ওমা তুমি! গ্রাম থেকে এরমধ্যেই চলে এসেছ? এক সপ্তাহ থাকার কথা ছিল না?”

তূর্ণা নিশ্চিত হলো, সাফা তার দুর্ঘটনার কথা শেয়ার করেনি। রোগীর চিকিৎসা করেও ডাক্তার এত নীরব কেন? এই কয়েকঘণ্টায় সে তো চাইলেই পারত, এখানকার সবাইকেস সব সত্যি বলে দিতে! এসব ভাব-ভালোবাসা না কি করুণা?

স্বর্ণার কথার উত্তরে তূর্ণা বলল, “সাফা আপু মনে হয় আপনাকে কিছু বলেনি! যাকগে, ব্যাপার না। আমার ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি ভাবী। নাদিফের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। পাঁচ মিনিটের জন্য আপনার ফোনটা একটু দিবেন?”

“কেন নয়? ভেতরে এসো।”

“না না, ভেতরে যাব না। আপনি ফোনটা দিন। আমি জরুরী কিছু কথা বলব।”

স্বর্ণা ভেতরে গিয়ে নিজের মোবাইল নিয়ে এসে তূর্ণার দিকে বাড়িয়ে দিল। তূর্ণা ঝটপট সেটায় নাদিফের নম্বর তুলে ডায়াল করল। রিসিভ্‌ হতেই ওপাশ থেকে সালাম ভেসে এলো। আর তৎক্ষনাৎ রাগ চড়ে গেল মাথায়। কিড়মিড় করে বলল, “ফোন তো দেখছি হাতের কাছেই থাকে। তাহলে আমি ফোন দিলে রিসিভ্‌ করেন না কেন?”

ওপাশ থেকে নাদিফ বলল, “স্যরি… আপনি কে? আপনার ফোন আমি ধরব কেন?”

“আমি এত কথা বলার মুডে নেই, নাদিফ। আমার বাবা অসুস্থ। এখন যদি ওনার কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটে আমি আপনার পরিবারের সবাইকে জেলের ভাত খাওয়াব।”

“তা-ই না কি? আচ্ছা… আমি অপেক্ষায় থাকব।”

“কাজটা আপনি ঠিক করেননি। আমি আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম।”

“একই ধারণা তো আমার মনেও ছিল। আমি কার কাছে বিচার চাইব?”

“আমি এতকিছু জানি না। আপনার ঘরে আমার সোনাগয়না আছে। ওগুলো ফেরত চাই। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”

এইটুকু বলার সাথে সাথে কল কেটে গেল। ঠিক তার একমিনিটের মাথায় নাদিফের ফ্লাটের দরজা খুলে গেল। সে ভেতর থেকে গয়নার বাক্স এবং আলমারিতে থাকা বাড়তি কাপড়সহ যা কিছু এখানে নিয়ে এসেছিল সব বের করে দিয়ে বলল, “অমানুষ কোথাকার। আর জীবনে আমার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে গণপিটুনি খাওয়াব।”

এ কথা বলে সে আবার দরজা বন্ধ করে দিল। তূর্ণা মেজাজ দেখাতে চেয়েও পারল না। তার পাশেই হতবাক দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্ণা। এসব কী দেখছে সে? নাদিফের মতো এত ভদ্র একটা ছেলে, বউকে এইভাবে বের করে দিচ্ছে? ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেল সে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলার কথাও মাথায় এলো না।

সবকিছু চেক করে নিয়ে তূর্ণা হাতের ফোন স্বর্ণার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আসছি।”

স্বর্ণাকে কিছু বলার সুযোগই দিল না আর। সবকিছু নিয়ে লিফটে উঠে নিচে নেমে গেল।

***

চলবে…

#লাস্ট_স্টেশন
…🖋️ তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৭

গ্রামে এসে আরেক বিপদে পড়ল তূর্ণা। এমন কোনো মানুষ বাদ যাচ্ছে না, যে তাকে কথা শুনাতে ছাড় দিচ্ছে। যে, যখন আসছে নোংরা কথাবার্তা বলে তার মন-মানসিকতার দিকে আঙুল তুলছে। এরমধ্যে কোথা থেকে যেন তূর্ণার অতীতের সব নোংরামির ভিডিয়ো কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে।

তূর্ণার মামার কাছে বেশ কিছুদিন আগে বিচার চেয়েছিল কায়েস। নানান কথা সাজিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবী করেছিল। কিন্তু তিনি তার কথাকে আমলে নেননি। উলটে নিজের ভাগনিকে বাঁচাতে তাকে হুমকিধামকি দিয়ে থামিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এবার… একটা ঘটনার জের ধরে সব সত্য সামনে এসে গেছে। সে-ও সাহস পেয়ে গেছে সত্য প্রকাশের। যে নোংরা খেলায় একদিন তূর্ণা নেমেছিল, ব্ল্যাকমেইল করে দু’হাত ভরা টাকা আদায় করেছিল, সে পথেই তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে কায়েস।

একদিন, দুইদিন, তিনদিন… পরপর কয়েকটা দিনের মধ্যে নিজের সত্যিকার রূপ যখন প্রত্যেকের সামনে এসে গেল তখন আর ঘরের বাইরে পা দেয়ার সুযোগ হলো না তূর্ণার। দিনরাত একঘরে থেকে সে হাঁপিয়ে উঠল।

হায়দার আলীর অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন। ঘটনার কোনোকিছু তিনি জানতে না পারলেও অসুস্থ শরীরের জোর ফিরে পাচ্ছেন না। বরং সময়ের সাথে সাথে শরীর ও মন হার মেনে নিতে চাচ্ছে। আইসিইউতে থেকে মনে মনে জীবনের প্রতিটা ভালোমন্দের হিসেব খুলে বসেছেন তিনি। কোথায় খামতি, কোথায় ত্রুটি সেসব আবিষ্কার করতে গিয়ে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি তার অসহায়ত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে। তিনি কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না। কেবল ফ্যালফ্যালিয়ে ডানে-বামে তাকিয়ে থাকছেন।

এতসব ঘটনায় ওবায়দুর রহমান বিচার জড়ো না করলেও গ্রামের মানুষজন তূর্ণার পরিবারকে গ্রামছাড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেউ-ই চাইছে না, এই মেয়ে কিংবা তার পরিবারের কেউ গ্রামে থেকে বাকিদের জীবন নষ্ট করে দিক। তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি হবে এটাই।

এসব শোনে তূর্ণা প্রতিবাদ করতে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “আমি কেন গ্রাম ছাড়ব? ছাড়বে তো ওই নাদিফ। ও এতদিন ধরে আমাকে ব্যবহার করে এসেছে। এসব কেন আপনাদের চোখে পড়ছে না? শাস্তি আমি একা কেন পাব? ওরও শাস্তি পাওয়া উচিত।”

উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে শালিসে বসা নাদিফের মামা খোরশেদ পাটোয়ারী বললেন, “ও যে তোমাকে ব্যবহার করেছে, এমন কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে? দেখো, তুমি যদি প্রমাণ দিতে পারো, আমি নিজে আমার ভাগনেকে উপযুক্ত শাস্তি দেব।”

তূর্ণা এবার উশখুশ শুরু করল। নাদিফকে শাস্তি দেয়ার মতো এমন কোনো উপায় তার জানা নেই, যার মাধ্যমে সবাইকে বিশ্বাস করাবে যে, দোষ তার একার নয়। ভেবেছিল, কোনোভাবে তার চরিত্রের উপর বদনাম টানবে, কিন্তু সেখানেও কেস খেয়ে গেছে হুট করে আপলোড হওয়া ভিডিয়োর মাধ্যমে। কায়েস যে কেন এসব করল!

আরেকজন মুরব্বি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নাদিফকে আমরা অনেক বছর যাবৎ চিনি। এমন কোনো কাজ ও করবে না, যার জন্য মান-সম্মানের উপর আঙুল আসবে। যেখানে তুমি নিজেই সৎ নও এবং এখন পর্যন্ত তোমার চরিত্র নিয়ে মানুষের মধ্যে নানান কথাবার্তা চলছে, সেখানে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করে, অন্যের উপর আঙুল তুলছ কেন?”

তূর্ণা বড়ো গলায় বলল, “এগুলো এখন হরদম হয়। দুনিয়াতে সবাই কি সৎ না কি!”

খোরশেদ পাটোয়ারী বললেন, “তার মানে তুমি স্বীকার করছ, দোষটা তোমারই! তুমিই আমার ভাগনেকে ফাঁসাতে চাইছ? তার ক্ষতি করতে চাইছ?”

“আমি ক্ষতি করব কেন? সে কি দুধে ধোয়া তুলসীপাতা? বিয়ে ছাড়া একটা মেয়েকে তার ঘরে জায়গা কেন দিয়েছে, এটা আপনাদের চোখে পড়ছে না? সন্দেহ জাগছে না?”

“সেটা তো অবশ্যই জাগছে। সে যে নিরুপায় হয়ে এমনটা করেছিল, এটা তো স্পষ্ট। ইতিমধ্যে তোমার চরিত্রটা গ্রামবাসীর সামনে উঠে এসেছে। এখন তুমি নিজের সপক্ষে কী যুক্তি দিবে?”

তূর্ণা বুঝে গেছে তাকে জালে আটকানোর জন্য কায়েস ইচ্ছে করে সব ভিডিয়ো প্রকাশ করে দিয়েছে। এসব যে নাদিফের ইশারাতে হচ্ছে, সেটাও নিশ্চিত। দূরে থেকে নাদিফই তার বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে কায়েসকে। এই ভিডিয়ো যদি ভাইরাল না হত, আজ সে নাদিফকে উচিত শিক্ষা দিতে পারত। কিন্তু সে তো কিছু করার সুযোগই আর পাচ্ছে না। কারণ এগুলো মিথ্যে না। সবই সত্যি। আর এসব সম্পর্কে তার মামাও এখন নিশ্চিত। এ কারণে তিনিও চুপ মেরে আছেন।

সবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, তূর্ণার পরিবার আর এ গ্রামে থাকতে পারবে না। সবাই-ই তার দিকে তাকিয়ে থুতু ছুঁড়ে বিদায় নিল। কিন্তু এসব তো তার অসুস্থ বাবার কানে দেয়া যাবে না। কী করবে ভেবে না পেয়ে উঠোনে বসে রইল সে।

তূর্ণার মামা মাসুক তরফদার বললেন, “এত কাঁচা কাজ করিস কেন? যা তোর বিপদ ডেকে আনে?”

তূর্ণা উত্তর দিল, “তখন কি আর জানতাম, এইভাবে ফেঁসে যাব? আর ওই হারামি এইভাবে দুই নম্বরি কীভাবে করতে পারল?”

“করবে না? ও এখন একটা সুযোগ পেয়েছে তাই সব উসকে দিয়েছে। খুব ভালোমতোই বুঝেছে, তোকে শায়েস্তা করার উপযুক্ত সময় এটাই।”

জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আজ তূর্ণার উপলব্ধি হলো, সে ঠিক কতটা ভুল ও অন্যায়ের উপর বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। মনে জমা হওয়া অপরাধবোধ ক্রমশ বাড়তে থাকল। আর সে সম্মানের একটা জীবন ছুঁয়ে দেখার আফসোস নিয়ে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে গেল।

***

তিন-চার দিনের এসব নোংরা ঘটনা ও গ্রামের মানুষের আচার-আচরণ সবটাই নাদিফের কানে এলো। বিশেষ করে তূর্ণার প্রাক্তন স্বামী ও তাদের সাথে কাটানো একেকটা স্পেশাল মুহূর্তের দৃশ্যও। যদিও একটা ভিডিয়োও সে দেখেনি, শুধু নিউজ দেখে নিশ্চিত হয়েছে। তবে এসব জানার পর আরও বেশি খারাপ লাগা শুরু হলো তার। এতগুলো দিন একসাথে থাকায় যেটুকু মায়া জন্মেছিল সেটায়ও যেন ধুলোর আস্তরণ পড়ে গেল। মন তাকে ইঙ্গিত দিল, এমন জঘন্য শ্রেণীর মানুষকে কখনও ক্ষমা করতে নেই।

ক’দিন ধরে বাড়িতে ফোন-টোন না করলেও মামার মাধ্যমে বাড়ির সবার খোঁজখবর নিচ্ছে নাদিফ। গ্রামে কী হচ্ছে না হচ্ছে সবটাই জানতে পারছে। নিজের বোকা বোকা আচরণে সবার সামনে সে যথেষ্ট লজ্জিত এবং অপরাধীও। মুখ দেখানোটাও এখন লজ্জার। আর ক্ষমা, ওটুকুও বোধহয় মিলবে না। মা যেভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন, তাতে মনে হয় না, ছেলেকে তিনি কোনোদিন ক্ষমা করবেন আর! অথচ সে তূর্ণার সাথে কোনো অন্যায় করেনি। একই ছাদের নিচে থাকলেও খারাপ নজরে তাকায়নি। কখনও মনে হয়নি, একটা মেয়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়ায় মোক্ষম সময় এটাই। উলটে শ্রদ্ধা, সম্মান ও পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিয়ে পাশে থেকেছে, যেন তার গর্ভের সন্তানটা নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হয়। একটা ছোট্ট প্রাণকে বাঁচানোর ইচ্ছা পোষণ করা, একটা মেয়ের সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করা, এসব নিশ্চয়ই অন্যায় নয়! তবুও কেন এমন অসম্মানজনক মুহূর্ত জীবনে এলো?

নিউজ দেখে অ্যাপার্টমেন্টের সবাই মোটামুটি নাদিফকে ঝেঁকে ধরল ঘটনার সত্যতা জানার জন্য। নাদিফ ভেবেছিল, ক’টাদিন ঘরের মধ্যে থাকলে সবার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবে, কেউ তার কাছে কিচ্ছু জানতে চাইবে না। অথচ সেটাও আর সম্ভব হলো না। কেউ না কেউ দিন একবার দরজায় নক দিত, জানতে চাইত সত্যিটা কী! বিরক্ত নাদিফ বাধ্য হয়ে শেষে সবাইকে সব বলেছে। এরপর অবশ্য ভালো ও মন্দ দুই ধরনের মন্তব্যের মুখে সে পড়েছিল। তবে সেসব দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। মন্দের ভালো এই যে, এই কয়েকটা দিন সাফা কিংবা স্বর্ণা কেউ-ই তার দরজায় নক দেয়নি।

এই ক’দিন ঘর থেকে বের হয়নি নাদিফ। আজ বাজার শেষ হয়ে গেছে দেখে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াতেই সাফা উপরে এলো। দু’জনে এই প্রথম অচেনা সাজার ভান করল। সাফা নিজ থেকে হাই-হ্যালো যেমন করল না, নাদিফও ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল না। একে-অন্যকে এড়িয়ে যে যার মতো দু’দিকে চলে গেল।

ঘরে এসে ব্যাগ রেখে ক্লান্ত শরীর নিয়ে চেয়ারে বসে একগ্লাস পানি পান করল সাফা। এরপর টেবিলে হাত রেখে ওখানেই চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। গত কয়েকদিনের খবরাখবর তার মনে শুধু খারাপ লাগার জন্ম দেয়নি। তূর্ণার মতো মেয়েদের করা ভুল কাজ ভালো মানুষের জীবনে কীভাবে অভিশাপ হয়ে আসে সেসব ভেবেই কষ্ট বাড়ছে। একজন নির্দোষ মানুষ যে কতটা শাস্তি ও অসম্মানের মুখে দাঁড়িয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ নাদিফের নিষ্প্রাণ চেহারা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়… সে ভালো নেই। না থাকাই স্বাভাবিক! জেনে-বুঝে বোকার মতো কাজ করে এমন বিপদ ঘাড়ে নেয় কেউ? একজন শিক্ষিত, সতর্ক ও জ্ঞানী মানুষের কাছ থেকে এমন আচরণ ও নির্বুদ্ধিতা আশা করেনি সাফা।

সকালের নাশতা দিতে এসে সাফাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে স্বর্ণা বলল, “বসে রইলি কেন? যা, ফ্রেশ হ।”

সাফা ক্লান্ত স্বরে বলল, “যাচ্ছি।”

যাচ্ছি বলেও বসে থাকল সাফা। স্বর্ণা পাশের চেহারে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “মন খারাপ?”

“না, ভাবী।”

“তাহলে? এভাবে বসে আছিস কেন?”

“ভাবছি!”

“কী?”

“মানুষের জীবন কত বিচিত্র!

ক’দিনের ঘটনার একটা বাজে প্রভাব যে সাফার উপর পড়েছে সেটুকু নিয়ে আর সন্দেহ নেই। যে মানুষকে তীব্রভাবে চাওয়ার পর থাকে অন্য কারও হতে দেখার কষ্টে বুকে পাথর চেপে সুখী সাজার নাটক করে যাচ্ছিল, এখন তার জীবনের ভয়াবহ সত্য এবং এভাবে একটা ভুলকে প্রশ্রয় দেয়ার সত্যিটা সামনে আসায় হয়তো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এরপর আর ভালোবাসাটাও আগের মতোই থাকবে কি না, সেটাও যথেষ্ট চিন্তার।

স্বর্ণা ধীর গলায় বলল, “সেটাই স্বাভাবিক সাফা। সবার জীবনের সব রংরূপ তো আর আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যখন যা সামনে আসে, সেটাই জানতে হয়।”

“ভাবী, আমি না এটা মেনে নিতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, এই মানুষটা এমন একটা কাজ করতে পারে না। এতগুলো বছর দেখার পরও তাকে কেন ভালোভাবে চিনতে পারলাম না?”

“তুই মানুষকে ততটাই চিনবি, যতটা মানুষটা তোর সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করবে।”

“সেটাই।”

“তবে এখানে নাদিফকে দোষ দেয়া যেমন যায় না, তেমনই একেবারে ছেড়ে দেয়াও যায় না।”

“আমি কারও দোষ-গুণ বিচার করতে চাইছি না, ভাবী।”

“তাহলে মন খারাপ করছিস কেন? যতটুকু ভালোবাসা এতদিন ধরে মনে বাঁচিয়ে রেখে পথ চলছিস, সেটুকুও মুছে ফেল।”

“সম্ভব?” চোখ তুলে তাকাল সাফা।

“অসম্ভব কেন?”

“এর উত্তরটাই তো পাচ্ছি না।”

“ছাড় এসব। এত ভেবে লাভ নেই। তুই বরং এখন আর পিছুটান না রেখে জীবন এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা কর। একজন ভুল মানুষের জন্য নিজেকে এত কষ্ট দেয়ার মানেই হয় না।”

“ভুল মানুষ?”

“তা নয়তো কী!”

সাফা উত্তর খুঁজে পেল না। মন পুড়ে ছাঁই হয়ে যেতে লাগল, অথচ কোনো যুতসই সমাধান খুঁজে পেল না। উলটে মনের ভেতর ক্রমাগত বেশ কয়েকটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে, “নাদিফ এখন কী করবে? জীবন এগিয়ে নিবে না কি এই অপমান সইতে না পেরে ভুল সিদ্ধান্ত নিবে? না কি এতসব অপমানকে তোয়াক্কা না করে… জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিবে?”

***

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here