লাস্ট স্টেশন পর্ব-১৮+১৯

#লাস্ট_স্টেশন
…🖋️ তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৮

তূর্ণার পরিবারের সবাই ঠাঁই নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল তাদের নানাবাড়িতে। আপাতত পরিবেশ শান্ত করতে রাজিয়া বেগমের কাছে আর কোনো সমাধান ছিল না। এটা অবশ্য তূর্ণা মানতে চায়নি। অথচ না মেনে উপায়ও নেই। তবে সে দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। তার মতে, সে একা শাস্তি পাচ্ছে। দোষ তার একার নয়!

শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত তূর্ণা আজ এসেছে নাদিফকে উচিত শিক্ষা দিতে। ভেবেছে নাদিফ গ্রামে আছে। এখানে থেকে তার সম্মান নষ্ট করতে নেমেছে। কিন্তু না… এখানে এসে তাকে না পেয়ে তূর্ণার মেজাজ যেন আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল।

মনোয়ারা বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তূর্ণা তাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে বলল, “এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার ছেলেকে ডাকুন। আমার মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার তাকে কে দিয়েছে?”

“তোমার মান-সম্মান থাকলে তো ছিনিমিনি খেলবে?”

“কী বললেন আপনি? এত বড়ো কথা!”

মুহূর্তের মধ্যেই তূর্ণার আচরণ কেমন বদলে গেল। সে ওড়না কোমরে পেঁচিয়ে মনোয়ারা বেগমের চুলের মুঠো টেনে ধরে তাকে নিচে ফেলে দিয়ে, পেটের উপর উঠে মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “অসভ্য মহিলা। আমার সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। জীবনটাও শেষ। তা-ও তোর শান্তি হচ্ছে না?”

ওবায়দুর রহমান ঘরে ছিলেন না। নাদিরা ও নাজিফা ভেতরের ঘরে ছিল। এখানে যে এত চিৎকার-চেঁচামেচি ও চুল টানাটানি হয়ে যাচ্ছে, সেসব প্রথমে তারা দেখেনি। আচমকা তূর্ণার গলার স্বর শুনতে পেয়ে দুইবোন ভেতর থেকে ছুটে এসে তূর্ণাকে দু’দিক থেকে টেনে সরিয়ে নাজিফা বলল, “এই মেয়ে, তুমি কি পাগল? এভাবে একটা মুরব্বি মানুষের গায়ে হাত তুলতে তোমার বুক কাঁপল না?”

দু’জনে দু’দিকে টেনে ধরাতে তূর্ণা সুবিধা করতে পারল না। পা ছুঁড়ে ফ্লোরে লাথি মেরে বলল, “ছাড়, ছাড় আমাকে। আজ ওই লোভী মহিলাকে মেরে ফেলব। একটা শয়তান ছেলে জন্ম দিয়ে পরের মেয়ের পিছনে উসকে দিয়েছে উনি।”

নাদিরা বলল, “আমার ভাই সম্পর্কে আর একটা খারাপ কথা বললে তোমার মুখ সেলাই করে ফেলব দুঃশ্চরিত্রা মেয়ে। বের হও এই ঘর থেকে।”

মনোয়ারা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে, চুল ও শাড়ি ঠিক করে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন তূর্ণার গালে। এরপর আশেপাশের যত ঘর আছে, যত মুরব্বি আছে, সবাইকে ডাক দিলেন। মিনিট পেরোনোর আগেই দশ থেকে পনেরো নারী-পুরুষ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। সবাই-ই তূর্ণাকে দেখে নাকমুখ কুঁচকে বলে উঠলেন, “এই বেহায়া মেয়ে এখানে কী করছ?”

মনোয়ারা বেগম বললেন, “এই মেয়ে আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমি এখুনি এই মেয়ের উপযুক্ত বিচার চাই।”

তূর্ণা খেপাটে স্বরে বলল, “বেশ করেছি, হাত তুলেছি। তুই একটা ডাইনী। বলছি না, ছেলেকে ডাকতে? কথা কানে যাচ্ছে না?”

উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেলেন তূর্ণার এমন আক্রমণাত্মক আচরণ দেখে। একজন দ্রুত গিয়ে ওবায়দুর রহমানকে খবর দিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলেন। এরপর উপস্থিত নারীরা মিলে তূর্ণাকে একদম রাস্তায় ফেলে এলেন।

ওবায়দুর রহমান ফোন বের করে তূর্ণার মামার নম্বরে কল দিয়ে বললেন, “আধঘণ্টার মধ্যে আপনার ভাগনিকে আমার দরজার সামনে থেকে নিয়ে যান। নয়তো আমি গ্রামের মানুষকে উসকে দেব। এমনিতেও তার সম্মান নেই। এরপর একেবারে শেষ হয়ে যাবে! আমি ভদ্রলোক হতে পারি, কিন্তু আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা কোনো নির্লজ্জ মেয়েকে সহজে ছেড়ে দিতে পারি না।”

***

ধরেবেঁধে তূর্ণাকে একদম রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে এলেন আশেপাশের মহিলারা। মনোয়ারা বেগম প্রচণ্ড অসহায় হয়ে ঘরে এসে বসলেন। চুলের গোড়ায় এত জুড়ে টান দিয়েছে যে, বেশ কিছু চুল হাতের মধ্যে চলে এসেছে। মাথায় ব্যথা হচ্ছে। কণ্ঠে আফসোস নিয়ে তিনি বকে যাচ্ছেন, “আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিলাম! এমন অভদ্র মেয়ে আজও দুনিয়াতে আছে। ছিঃ ছিঃ। মান-সম্মানের ভয়ই নেই।”

নাদিরা ব্যথাতুর জায়গায় বরফ ঘষে দিয়ে বলল, “ছাড়ো তো। এতে ভাইয়ার জীবন নষ্ট হয়নি, বরং ভালোই হয়েছে। সত্যিটা সামনে আসায়, তার জীবন বেঁচে গেছে। নয়তো যদি ওই বাচ্চাটা থাকত আর দুর্ঘটনা না ঘটত, এই মেয়ে আমাদের সবাইকে চড়িয়ে খেত। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্য করেন। এত আফসোস করো না তো।”

মনোয়ারা বেগম শান্ত হতে পারলেন না। তূর্ণার এমন জঘন্য রূপ জেনে তিনি মা হয়ে যে কষ্ট আজ পাচ্ছেন, ভুল মানুষের সঙ্গে সংসার সাজানোর নাটক করতে গিয়ে নাদিফও হয়তো কষ্ট পেয়েছে। ছেলের কষ্টের কথা না জেনে, তাকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি নিজেই আরও খারাপ ব্যবহার করলেন! ক’দিন ধরে যোগাযোগ তো করছেই না, কী খাচ্ছে, কী করছে, কে জানে!

মায়ের মন… সন্তানের কষ্টের কথা ভেবে বুক কেঁপে উঠল। তিনি নাজিফাকে বললেন, “তোর ভাইকে একটা ফোন কর তো। জিজ্ঞেস কর, কেমন আছে।”

নাজিফা অবাক চোখে তাকাল। এই ক’দিন তিনি একবারও ছেলের কথা জিজ্ঞেস করেননি। দিন তিনবেলা করে বকে গেছেন। কেঁদেকেটে গাল ভাসিয়েছেন। সে ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে মোবাইল এনে ভাইয়ের নম্বরে কল দিয়ে বসল। রিং বাজতে বাজতে কল কেটে গেলেও রিসিভ্‌ হলো না। বলল, “ভাইয়া তো ফোন তুলছে না।”

মনোয়ারা বেগম দুঃখেভরা কণ্ঠে বললেন, “কী বলিস! কেন তুলবে না?”

“রেগে আছে হয়তো।”

“আমার সাথে আবার কীসের রাগ?”

নাদিরা মায়ের চুলগুলো পরিপাটি করে দিয়ে বলল, “রাগবে না? ওইদিন বকলে কেন?”

“অন্যায় করলে বকা দেব না?”

“না, দেবে না। কারও মান-সম্মান বাঁচানো কি অন্যায়?”

“তুই এসব বুঝবি না। সর। দেখি, ফোনটা দে তো।”

ফোন নিজের কাছে টেনে এনে মনোয়ারা বেগম নিজেই ছেলের নম্বরে ডায়াল করলেন। এবার একবার রিং বাজতেই কল রিসিভ্‌ হয়ে গেল। তিনি তৎক্ষনাৎ বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন, “বাড়িঘর নাই তোর? বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে না? এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে কী বুঝাতে চাস তুই? আমরা তোকে ত্যাজ্য করেছি?”

ওপাশ থেকে নাদিফ কোনো কথা বলল না। হয়তো ইচ্ছে করেই বলল না। এদিকে ছেলের কণ্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে মনোয়ারা বেগম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। নাজিফা মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, “ভাইয়া, তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি আসো। ওই নোংরা মেয়েটা আজ আমাদের বাড়িতে এসে মায়ের চুল ধরে টেনেছে!”

নাদিফের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার মাকে কেউ মেরেছে, এইভাবে! এত জঘন্য রূপ তূর্ণার? ঘৃণায় ও রাগে সে অধৈর্য্য হয়ে বলল, “কী বলছিস এসব?”

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। পাশের বাড়ির চাচা-চাচিরা এসে আটকেছেন। ওই মেয়ে তো মানুষ না ভাইয়া। একটা কালনাগিনী! তুমি যদি দেখতে, খুব কষ্ট পেতে। মায়ের কতগুলো চুল ছিঁড়ে ফেলেছে, জানো?”

এতকিছুর পর তূর্ণার মধ্যে অনুশোচনা না জন্মে এমন হিংসাত্মক আচরণের প্রকাশ টের পেয়ে নাদিফ কথা বলতে ভুলে গেল। একটা মানুষ এত কীভাবে খারাপ হতে পারে? সে বড়ো করে নিঃশ্বাস টেনে বলল, “বাবাকে বল মামলা করতে। এখনও চুপ করে আছেন কেন?”

“চুপ করে নেই তো। ওনাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ওনারা তো আজ চলে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময়ই মায়ের উপর আক্রমণ করে বসল।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“তুমি চলে আসো না ভাইয়া! এসব অশান্তি আর ভালো লাগে না।”

নাদিফ জানে, গ্রামে গেলে এখন অসংখ্য কথা ও আঘাতের উপর দিয়ে যেতে হবে। যেমনটা বাবা-মায়ের উপর দিয়ে তুফান যাচ্ছে। সে তড়িঘড়ি সমাধান দিতে বলল, “বাবা কোথায়?”

“ঘরেই আছেন।”

“ফোনটা দে তো।”

নাজিফা ফোনটা ওবায়দুর রহমানের হাতে দিলে তিনি হ্যালো বলার পর নাদিফ বলল, “এসব বিচ্ছিরি ঝামেলা এড়াতে চাইলে ঢাকায় চলে এসো।”

“কেন? আমরা দোষ করেছি কিছু?”

“কথাটা দোষের না বাবা। মানসিক শান্তির। ওখানে থাকলে ভালো থাকবে না। এরা মরুক, কী বাঁচুক, সেসব দেখে তো আমাদের কাজ নেই। আর এমনিতেও গ্রামে যত থাকবে এসব নাদিরা ও নাজিফার উপর প্রভাব ফেলবে। দু’দিন পর এগুলোর জন্য ওরা রাস্তাঘাটে বের হতে পারবে না।”

“এগুলো আগে ভাবতে পারিসনি?”

“এরকম জঘন্য পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে জানলে, আগেই ভাবতাম! আমাকে ক্ষমা করে দাও, বাবা। প্লিজ…। চলে এসো, এখানে। নাহলে বলো, আমি এসে নিয়ে যাই।”

***

পরদিন সবকিছু গুছিয়ে বিকেলের মধ্যেই গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন ওবায়দুর রহমান। বাড়িতে আপাতত তালা ঝুলছে। বিচারের ভার এখন গ্রামের মানুষের হাতে। তারা চাইলে তূর্ণা ক্ষমা পাবে, নয়তো না।

ঢাকায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মনোয়ারা বেগম। হঠাৎ করে প্রেশার বেড়ে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন। নাদিরা ও নাজিফা এখানে আগে এসেছে বলে সাফাকে তারা ভালোমতো চিনে।

নাদিরা ছুটে গিয়ে সামনের ফ্লাটে বেল বাজাল। সাফা দরজা খুলে বলল, “আরেহ, তুমি! কখন এসেছ?”

“এইতো আপু। কিছুক্ষণ আগে। একটু আসবে প্লিজ? মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”

“কী বলছ? তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি।”

সাফা স্টেথোস্কোপ হাতে নিয়ে নাদিরার সাথে নাদিফের ফ্লাটে এলো। সেইযে তূর্ণাকে দেখতে একদিন এসেছিল এখানে, এরপর আর আসেনি। এই ক’দিন ধরে নাদিফের সাথে তার সাক্ষাতই হয় না। নাদিফ শুধু তাকে নয়, এই অ্যাপার্টমেন্টের সবাইকে এড়িয়ে চলছে। ভুলবশত যদি সামনে পড়ে তো, মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।

সাফা ভেতরে এসে মনোয়ারা বেগমের প্রেশার মেপে দেখল, যথেষ্ট বেড়ে গেছে। তাকে খুব ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত লাগছে। সে ভদ্রমহিলাকে শান্ত করতে বলল, “রিল্যাক্স আন্টি, কিচ্ছু হয়নি। ঘাবড়াবেন না। নাক দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিন, আবার মুখ দিয়ে ছাড়ুন।

মনোয়ারা বেগম তা-ই করলেন। সাফার কথা অনুযায়ী শান্ত মস্তিষ্কে পাঁচ মিনিট শ্বাস নিলেন।

সাফা বলল, “নাদিরা, উনি প্রেশারের ঔষধ খান? ঔষধ আছে ঘরে?”

নাদিরা বলল, “না আপু। মা তো আগে কোনো ঔষধ খাননি।”

প্রায় একঘণ্টা সময় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঘরোয়া ট্রিটমেন্ট দেয়ার পর মনোয়ারা বেগম একটু সহজ হলেন। সাফা ভদ্রমহিলার ভেজা পা দুটো মুছে দিয়ে, মুখমণ্ডল পরিষ্কার করে দিয়ে জানতে চাইল, “এখন কেমন লাগছে?”

“একটু ভালো।”

বাড়াবাড়ি রকমের ক্ষতি হওয়ার আগে সাফা তৎক্ষনাৎ যে চিকিৎসা দিয়েছে, তাতে কিছুটা হলেও বিপদ ঠেকানো গেছে। এরপর সে ফোন হাতে নিয়ে নাদিফকে কল দিল। এখনও বাসায় ফিরেনি। খরচ আনতে গিয়ে না-ই হয়ে গেছে।

কল রিসিভ্‌ হওয়ার পর ঝটপট বলল, “আন্টির তো প্রেশার বেড়ে গিয়েছে। যদিও এখন একটু শান্ত আছেন। কয়েকটা ঔষধ নিয়ে আসবেন মনে করে।”

এরপর আরও কী কী লাগবে, সবটা বলে সে পুনরায় প্রেশার মাপল। কিছুটা আয়ত্তে এলেও ভয় দূর হলো না। কেমন যেন বিপদের আভাস পাচ্ছে সে।

সাফা খানিকটা দূরে সরে নাজিফাকে বলল, “এর আগে এমন হয়েছিল?”

নাজিফা বলল, “না। ওই দুর্ঘটনার পর থেকে একটু শরীর খারাপ হত। আজ দীর্ঘপথের জার্নিতে মনে হয় বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”

“প্রেশার কন্ট্রোলে আসছে ঠিকই তবে ভয় থেকে যাচ্ছে। ওনার কি বুকে ব্যথা হয়?”

“না। মায়ের হাই প্রেশারও না। এমনিতে হঠাৎ হঠাৎ অসুস্থ হলেও কখনও এইভাবে অস্থির হতে দেখিনি।”

“বুঝতে পারছি।”

নাদিফ খুব দ্রুত খরচের সাথে ঔষধ নিয়ে ফিরল। সাফা দেখে দেখে প্রয়োজনীয় ঔষধ খাইয়ে বলল, “আপনি এখন ঘুমান। আর একদম টেনশন করবেন না। এসব কিচ্ছু না।”

পাশে বসে নাদিফ অস্থির হয়ে বলল, “আর কোনো সমস্যা হবে না তো? হসপিটালে নিয়ে যাব?”

প্রেশার বেড়ে গেলেও ভদ্রমহিলার হুঁশ, জ্ঞান এমনকি কণ্ঠস্বরও যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল। তিনি যে ছেলের জীবনের চিন্তায়ই এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, সেটা এতক্ষণে স্পষ্ট। তবে দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলতে থাকলে সমস্যা বাড়বে। এ কারণে সাফা আপাতত অভয় দিয়ে বলল, “এক্ষুণি প্রয়োজন নেই। তবে এরপর যদি আবারও প্রেশার বাড়ে, সাথে বুকব্যথা বা অন্য কোনো লক্ষ্মণ দেখেন, দেরী না করে হসপিটালে নিয়ে যাবেন।”

ঔষধের প্রভাবে মনোয়ারা বেগম কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন। নাদিরা মাকে ভালোমতো শুইয়ে বলল, “আপু, তুমি বসো। তোমাকে চা দিই। এতক্ষণ ধরে খালিমুখে বসে আছো।”

সাফা মুচকি হেসে বলল, “এখন চা লাগবে না, নাদিরা। তোমরা রেস্ট করো। দরকার হলে ডেকো, কেমন?”

এরপর সাফা বিদায় নিয়ে রুম ছেড়ে ড্রয়িংরুমে এলো। নাদিফ পিছন পিছন এসে বলল, “থ্যাংক ইউ।”

“এটা আমার ডিউটি। আন্টির খেয়াল রাখবেন। আর এভাবে দেবদাসের মতো ঘুরছেন কেন? মুখের তো অবস্থা নেই। ভালোই দাড়িগোঁফ জন্মেছে। একদম জংলী লাগছে।”

নাদিফ চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বলল, “কী? জংলী? দাড়ি তো পুরুষের চেহারার সৌন্দর্য বাড়ায়!”

“কী জানি! আমিই হয়তো দিনকানা।”

সাফা কৌতুক করল না কি মজা নিল বুঝল না নাদিফ। লম্বা হওয়া দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “সত্যিই জংলী লাগছে? আমি আসলে খেয়াল করিনি।”

মুখ টিপে হেসে সাফা বলল, “আয়নায় নিজেকে দেখেন না?”

“দেখে লাভ?”

“কেন? নিজের সন্তুষ্টি, ভালোমন্দ, সুস্থতা এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হয় না? একটা ছোট্ট ঘটনা নিয়ে এভাবে নিজের উপর অত্যাচার করছেন কেন?”

নাদিফ অসহায়ের মতো দেয়ালে কাঁধ ঠেকিয়ে বলল, “আমি আসলে কোনো সমাধান দেখছি না। সবকিছু হঠাৎ করে কেমন যেন বদলে গেল। আমার চেনা পৃথিবীর সব রং মুছে গেল। এতকিছুর পর নিজের জন্য আমি আর কী ভাবব, বলুন?”

নাদিফ এতদিনে তূর্ণাকে ভালোবেসেছে কি বাসেনি, এরকম কোনো প্রশ্নে যেতে চাইল না সাফা। সে সামনে থাকা পুরুষের মনের ভার হালকা করার একটা ছোট্ট সমাধান দেখিয়ে দিল, “রব নিশ্চয়ই উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি যদি এই একটা ঘটনা দিয়ে আপনার সততা ও ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন, তাহলে আপনি এত ভেঙে পড়ছেন কেন? অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি, এটা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি! যদি মনে করেন, সত্য আপনাকে মুক্তি দিচ্ছে, তাহলে সব পিছনে রেখে দিন। মানুষ কী বলল, এসব ভেবে লাভ নেই। আপনি তো জানেন, সত্যিটা কী?”

নাদিফ উপরনিচ মাথা নেড়ে হাসল সামান্য। সাফা বলল, “সবার সব কথা, চিন্তাভাবনা, যুক্তি… এগুলো স্রেফ একপাশে রেখে দিয়ে নিজের জন্য বাঁচুন। আন্টি-আংকেল এবং দুই বোনের জন্য বাঁচুন। আজ যা হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, ধৈর্য্যই একদিন তার হিসেব বুঝিয়ে দিবে আপনাকে।”

“আপনি কি মানুষ হারানোর কথা বলছেন?”

সাফা উত্তর দিতে পারল না। যেহেতু নিশ্চিত নয়, তা-ই চুপ করে গেল। নাদিফ বলল, “আমি মানুষ হারাইনি, সাফা। প্রশ্নই আসে না। আমি তো সম্মান হারানোর যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। কত মানুষের চোখে খারাপ হয়েছি, জানেন? জানি না এই ক্ষত কতদিনে সারবে। আদৌ সারবে কি না।”

এর উত্তর সাফার নিজের কাছেও নেই। তবুও মনে জোর এনে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”

***

চলবে…

#লাস্ট_স্টেশন
…🖋️ তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৯

সময়ের সাথে সাথে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া একেকটা ঘটনা এবং তার খেসারত হিসেবে সবার কাছে খারাপ হয়ে যাওয়া… এসব এখন খুব একটা প্রভাব না ফেললেও যখন মনে হয়, জীবন আরও সুন্দর হতে পারত; তখনই সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায় নাদিফের। সেদিনের পর জীবন থেকে কেটে গেছে তিনটে মাস। সবকিছুতে পরিবর্তন এসেছে। বাবা-মা ও দুইবোন এখন তার সাথেই থাকে। আর সে… ব্যস্ত সময় কাটায় নিজের কর্মক্ষেত্রে বসে। প্রথম ক’দিন অফিসের সবাই তার দিকে তাকিয়ে হাসিঠাট্টা কর‍ত। খোঁচাখুঁচি করত। সে পাত্তা দিত না। একবার ভেবেছিল, চাকরি ছেড়ে দিবে। অন্যকিছু করে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই চিন্তা বাদ দিয়েছে। কারণ মানুষের চিন্তাভাবনা ও মানসিকতার পরিবর্তন সে ঘটাতে পারবে না। আলোচনা কিংবা সমালোচনা থামাতে পারবে না। আজ যারা কটুক্তি করছে, কালই তারা আবার মাথায় তুলে নাচবে। তা-ই মন খারাপ না করে নিজেকে ভালো রাখতে চেষ্টা করছে।

এরপর থেকে সবার সব কথা একদিকে ফেলে রেখে নাদিফ নিজের মতো কাজ করত। তার সততা ও পরিশ্রমে মুগ্ধ হয়ে সিনিয়র অফিসার বলেছিলেন, “সব মানুষের জীবনেই কমবেশি দুর্ঘটনা ঘটে। সবাই-ই কোনো না কোনো সময় ভুল করে। বুদ্ধিমানরা কী করে জানেন? সঠিক সময়ে ভুলকে শোধরে নেয় এবং সত্যকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি আপনাকে। এবং এটাও নিশ্চিত যে, এই খারাপ সময়টা একদিন ঠিকই কাটিয়ে উঠবেন।”

নাদিফ সেদিন ভরসা পেয়েছিল। বুঝে নিয়েছিল মানুষে-মানুষে পার্থক্য এবং ভালো ও মন্দের পার্থক্য। তবে অফিসের প্রয়োজনে কাজের জায়গার পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাকে। নিজের মানসিক শান্তির জন্য এরকম একটা নোটিশ তারজন্য খুব প্রয়োজন ছিল।

মাঝখানে একদিন তূর্ণার বান্ধবী সাজি একটা দুর্ঘটনার খবর দিতে ফোন করেছিল। যেহেতু নাদিফ ওই বাড়ির কারও সাথে যোগাযোগ রাখছে না, তা-ই কারও খবরাখবরও তার কাছে ছিল না। সে তূর্ণার বাবার মৃত্যুর খবর জানিয়ে বান্ধবীর ভুলত্রুটি এবং ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তা নিয়ে আফসোস করেছে। নাদিফ অবশ্য এত কথা কানে নিতে যায়নি। সে দু’একটা কথা শুনার পরপরই কাজের অজুহাত দেখিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে চিরদিনের জন্য সাজির নম্বর ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিয়েছে। কারণ সে চায় না, তূর্ণার সাথে জড়িয়ে থাকা কোনোকিছু তার পিছু নিক!

খারাপ সময় কাটিয়ে নাদিফ এখন পুরোদমে নিজেকে এবং নিজের বাবা-মা, বোনদের নিয়ে ব্যস্ত। এখন তার জীবনে পরিবারের আগে আর কিচ্ছু না। আগামী সপ্তাহে তার নারায়ণগঞ্জের অফিসে জয়েন করার কথা। তাই আজই বাসা ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে সে। যদিও বাবা-মা, দুইবোনকে এখানে রেখে যাবে। এবং ছুটিতে আসবে এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নাদিফ অবশ্য বেশিকিছু নিচ্ছে না। গত সপ্তাহে একটা বাসা দেখে এসেছে। খুবই ছোটো এবং একা মানুষের থাকার জন্য যতটুকু স্পেস দরকার, সবটাই সেখানে আছে। তাই সে নিজের প্রয়োজনীয় যা কিছু নেয়া জরুরী, সেসব একটা ট্রাকে তুলে দিচ্ছে।

সাফা নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নাদিফের কাজকর্ম দেখছে। নাদিফের আচরণ আগের মতোই। সবাইকে এড়িয়ে চললেই যেন বাঁচে। হয়তো লজ্জার জন্যই এমন করে… অথবা খারাপ কথা থেকে বাঁচতে… তবে এখানকার সবাই তাকে যথেষ্ট সম্মানের সাথে গ্রহণ করে নিয়েছে। কেউ-ই এখন আর খোঁচাখুঁচি করে না।

সাফার এই লুকিয়ে-চুরিয়ে তাকানো এবং অনুভূতি চেপে রাখার ব্যাপারটায় ইদানীং খুব বেশি বিরক্ত হচ্ছে স্বর্ণা। কতবার বলেছে, যা গিয়ে বলে দে… এখুনি সুযোগ। কিন্তু সাফার এক কথা, ওর মনের অবস্থা ভালো না। এখন এসব কথা বললে উলটে নেগেটিভ কিছু ভেবে বসবে। এ কারণে একটা সুযোগ খুঁজছে সে, যেন মনের কথা বলার পর… কোনো ধরনের না’বোধক শব্দ নাদিফের মুখ দিয়ে বের না হয়। যেন সে একেবারে আটকে যায়। বুঝতে পারে, কেউ তাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছে। কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন সুযোগ আসেনি আর আসবেও না।

স্বর্ণা রুমের দরজায় ঠেস দিয়ে, দু’হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে, দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “ভীতু কোথাকার। তুই এভাবেই দ্যাখ…। বলার কী দরকার? শেষে দেখবি, ও সত্যি সত্যিই বিয়ে করে নিয়েছে। এরপর তুই ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে পড়ে থাকবি। আর তোর ভাই, আমাকে কথা শুনাবে।”

সাফা বিরক্ত হয়ে বলল, “উফফ, ভাবী… যাও তো।”

“নাদিফ চলে যাচ্ছে, সাফা।”

“যাক না যেখানে খুশি।”

“বলবি না?”

“এক্ষুণি সম্ভব না।”

“আর কবে?”

“সুযোগ আসুক।”

“জীবনেও আসবে না। শাফিনের বাড়ি থেকে বিয়ের কার্ড এসেছে। ও মেয়ে পেয়ে গেল আর তুই আজও ভালোবাসি কথাটা বলতে পারলি না। যে ছ’বছরে একটুখানি সাহস সঞ্চয় করতে পারে না, সে ছয় যুগেও পারবে না। অথচ ওই একটা শব্দ উচ্চারণ করা ছয় সেকেন্ডের ব্যাপার।”

সাফা এসব কথা কানেই তুলল না। স্বর্ণা বলল, “সাফা, ধর… নাদিফ ওখানে গিয়ে বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পেল। এমন কাউকে পেল, যে ওর মন থেকে তূর্ণার মতো ধোঁকাবাজ মেয়ের সব স্মৃতি মুছে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলল। তখন তুই এখানে বসে কী করবি?”

স্বর্ণার দিকে ঘুরে সাফা বলল, “এত দ্রুত সম্ভব ভাবী?”

“অসম্ভব কেন? জীবন কি থেমে থাকে?”

“উনি তো কাজের জন্য যাচ্ছেন তাই না? মেয়ে খুঁজতে না! কোনো একসময় নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।”

“যদি না ফিরে? যদি সারাজীবনের জন্য ওখানে থেকে যায়?”

সাফা কোনো উত্তর দিতে পারল না। বড্ড বেশি অশান্তি লাগছে। এই একটা ছেলেকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে গিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দেয়া যাচ্ছে না। কত ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে গেল, অথচ ভালোবাসা কমল না। উলটে আরও বেড়ে গেল। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে এই পুরুষের জন্য সীমাহীন মায়া পুষে রাখতে গিয়ে এখন তার দমবন্ধ লাগে। অথচ মুখফুটে বলাও যায় না। তূর্ণার ওই ঘটনার পর কোথায় ঘৃণা হবে, রাগ হবে, তা না… উলটে মনের বেইমানী সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দিনকেদিন সে উপলব্ধি করছে এই পুরুষকে না পেলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

উত্তর না পেয়ে স্বর্ণা বলল, “তুই চাইলে আমি আন্টিকে বলে রাখতে পারি।”

“কী বলবে?”

স্বর্ণা সাফার কাঁধে হাত রেখে বলল, “বলব যে এই অ্যাপার্টমেন্টে একটা চোর আছে, যে অনেক বছর ধরে একটা পুরুষকে চুরি করার ধান্ধায় আছে, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না দেখে হাত গুটিয়ে বসে আছে। যখন সুযোগ পাবে, ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। বলব?”

“ভাবী প্লিজ…।”

***

দরকারী সব জিনিসপত্র পাঠানো হয়ে গেলে নাদিফ নিজের ব্যাকপ্যাকে ছোটোখাটো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ঢুকিয়ে নিয়ে খাবার টেবিলে এলো। সবাই তার অপেক্ষায় ছিল। খাওয়াদাওয়া শেষে সে বেরিয়ে যাবে, তাই তার মা মনোয়ারা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? খাওয়া শুরু কর দ্রুত। আবার কবে আসবি…।”

নাজিফা ও নাদিরা ইতিমধ্যে চেয়ারে বসে পড়েছে। ওবায়দুর রহমানও ছেলের পাশের চেয়ারে বসে বললেন, “তোর মায়ের তো শরীর আজকাল ভালো থাকে না জানিস। ক’দিন ধরে ভাবছিলাম, একটা ভালো মেয়ের খোঁজ পেলে..।”

খেতে বসার আগেই এমন কথা শোনে নাদিফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। একবার ভালো মেয়ে খুঁজে পেয়ে যা কেলেঙ্কারি হয়েছে, সেসব মনে পড়লে জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয়, এভাবেই চলে যাক…। মন্দ তো না।

বাবার কথার উত্তরে নাদিফ বলল, “এসব কথা বাদ দাও তো।”

“মানুষের জীবনে কত দুর্ঘটনাই তো ঘটে। ভালো এবং মন্দ যা কিছুই হোক, জীবন কী থেমে থাকে? তাছাড়া তোর কোনো অন্যায় নেই। হ্যাঁ, একটা ভুল করেছিস, এখন তো সেই ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিস। তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধা কী?”

“মানুষ যে হাসিঠাট্টা করবে না, তার কি গ্যারান্টি?”

“কী আশ্চর্য! মানুষের কথা ভেবে নিজে কষ্ট পেয়ে লাভ আছে? কিছু মানুষের জন্মই হয়েছে অন্যকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার জন্য। অথচ পরিস্থিতি সবসময় ভালো থাকে না। খারাপ সময় সবার জীবনেই আসে, বাপ। আর এই সুযোগে কিছু মানুষ মন্দ কথা বলবে। এগুলোকে থামাতে পারবি না। এর মানে এই না যে, নিজেকে ভালো রাখতে পারবি না। দেখ, যা হয়েছে, হয়ে গেছে। এখন তোর মুভঅন করা উচিত। কই, এসব ঘটনা ওই মেয়েটার উপর প্রভাব ফেলছে? ও তো দিব্যিই ভালো আছে। তাহলে তুই কেন একটা ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিস না?”

এই হিসেব নাদিফ নিজেও মেলাতে পারছে না। কারও ভালো চাইতে গিয়ে যে অসম্মানের মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতে হয়েছে, যে কঠিন সময় কাটিয়ে আজকের এই দিনে এসে উপস্থিত হতে হয়েছে, সেসব সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। এ কারণেই হয়তো মনকে কাজের প্রতি ঘুরাতে পারলেও জীবন সাজানোর কথা চিন্তা করতে পারছে না। দুর্ঘটনার প্রভাবে মনে যে ক্ষত তৈরী হয়েছে, তা সারছে না।

ভাবতে ভাবতে নাদিফ উত্তর দিল, “আমার আরও সময় লাগবে বাবা।”

“সেটা লাগুক। অসুবিধা নেই। তুই সময় নিতে পারিস। তবে দিনশেষে প্রতিটা মানুষকে কিন্তু ঘরে ফিরতে হয়!”

নাদিফ ম্লান হেসে একগ্লাস পানি খেয়ে বলল, “আমার ঘরে ফেরার জন্য তোমরা তো আছো, বাবা।”

ওবায়দুর রহমান ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “সময় অনেককিছু সহজ করে দেয়। একদিন সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

খাওয়া শেষ করে নাদিফ আর দেরী করল না, বিদায়ের প্রস্তুতি নিল। দুই বোনে তখন ফোনে কিছু একটা নিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে। আমি আগে দেখব, আমি আগে দেখব, এসব বলে। কিন্তু কী দেখবে, সেটা আর বলছে না।

ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে নাদিফ দুই বোনকে বলল, “ঝগড়া করছিস কেন?”

নাদিরা বলল, “দেখো না, তোমার লাস্ট পোস্টে আলিশা মুনতাহা নামের আইডি থেকে একটা কমেন্ট এসেছে।”

“তো? এটা নিয়ে ঝগড়া করার কী আছে?” ভ্রু টেনে প্রশ্ন করল নাদিফ।

“কী সুন্দর কাব্যিক কথা! এ্যাই নাজিফা ওই আইডিটা ফলো কর তো।”

“কী একটা আইডি নিয়ে পড়লি তোরা! আমি যে চলে যাচ্ছি, এটা দেখতে পাচ্ছিস না?”

নাজিফা বলল, “যাও না। তোমাকে আটকাল কে?”

“ধুর… পাজির দল। ভালো থাকিস।”

নাজিফা ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল আর নাদিরা ভাইকে জাপটে ধরে বলল, “এসব কী চাকরি করো, খালি দূরে যেতে হয়!”

নাদিফ বলল, “এখন আবার চাকরির কী দোষ?”

“দোষ না? কখনও তোমাকে কাছে পাই না। কারও জন্মদিনে না, বিয়েতে না। তুমি এত দূরে চলে গেলে আমাদের ভালো লাগে না।”

“কিছু করার নাই। যেতে হবে। বিদায়ের সময় ভাব কম।”

এরমধ্যে নাজিফা চেঁচিয়ে উঠে বলল, “এ্যাই নাদিরা দেখে যা…।”

দুই বোনের এই অহেতুক কাজে নাদিফ যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেল।

নাদিরা বোনের পাশে বসে বলল, “কিছু পেলি?”

“হ্যাঁ, এই আইডি থেকে ভাইয়াকে ফলো করছে অনেকদিন ধরে। ভাইয়ার অনেক বছর আগের পোস্টেও কমেন্ট আছে।”

“তাতে কী?”

“কমেন্টগুলো দেখ! প্রত্যেকটা কমেন্ট থেকে এই আইডির কমেন্ট আলাদা।”

“হতে পারে মেয়েটি কবিতা-টবিতা লেখে।”

“হম… হতে পারে। রিকুয়েস্ট এ্যাকসেপ্ট করেছে। দাঁড়া, আইডি ঘুরে আসি।”

দুই বোনে মিলে আলিশা মুনতাহা নামের আইডির কোণায় কোণায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও কোনোকিছু খুঁজে পেল না। কারণ এই আইডির মালিক প্রোফাইলে নিজের ছবি দেয় না। শুধু হঠাৎ হঠাৎ দু’লাইনের মনোভাব শেয়ার করে। এসব দেখার পর খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও কমেন্ট থেকে বের হতে পারল না দু’জনের কেউ-ই। এই নামে তো তাদের পরিচিত কেউ নেই। তাহলে, মালিক কে?

দু’জনের এই গোয়েন্দাগিরি ভাব দেখে নাদিফ ওদের চুল টেনে দৌড়ের উপর বেরিয়ে গেল। নিচে এসে বাইকে বসে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দেয়ার পরপরই মিররে চোখ পড়ল। কপালের এলোমেলো চুল সরিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাফা। চোখমুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ বুঝল না সে। মাথা তুলে ব্যালকনিতে দৃষ্টি রাখতেই সাফা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। সাথে সাথে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। কপালে ভাঁজ পড়ল। এই মেয়ে তো কখনও এমন করে না!

এতকিছু না ভেবে গাড়ি ঘুরিয়ে গেট দিয়ে বের হতে গিয়ে আবারও উপরে চোখ তুলল নাদিফ। ওই রমণীর কঠিন দৃষ্টির কারণ আয়ত্তে আনতে না পেরে নিজের মতো করে চলে গেল। সবসময় হাই-হ্যালো করা সাফাকে হাত নাড়িয়ে বিদায়ও জানাল না আজ।

সাফা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড়াল, “গাধা কোথাকার।”

***

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here