#লাস্ট_স্টেশন
… 🖋️ তামান্না বিনতে সোবহান
শেষপর্ব
আলিশা মুনতাহা নামের আইডির মালিক যে সাফা এই সত্য যেদিন জেনেছে, সেদিন থেকে ওই আইডি থেকে আসা প্রত্যেকটা কমেন্ট খুব করে ভাবাত নাদিফকে। প্রথম কয়েকদিন তো খেয়াল করেনি। তূর্ণার ঝামেলায় মনেও ছিল না। পরে যখন স্মরণে এলো এই আইডির মালিক তার পরিচিত এবং তার সম্পর্কে যথেষ্ট জানে, তখন থেকে ব্যাপারগুলো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল। কোনো দুঃখ, মন খারাপ কিংবা নিঃসঙ্গ মুহূর্তের ক্যাপশনে সাফা এমনভাবে মন্তব্য করত, সেই মন্তব্যের পর একটা প্রশান্তি কাজ করত মনে। সে উপলব্ধি করত, অচেনা হয়েও মানুষের মনের কষ্ট কেউ কীভাবে বুঝে নিচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী ব্যথা উপশমের উপায়ও বাতলে দিচ্ছে। বুঝার পর থেকে সে আরও ইচ্ছাকৃতভাবে এমনসব পোস্ট করত, যার পরিপ্রেক্ষিতে সাফার একটা না একটা মন্তব্য থাকতই। কখনও কখনও সাফা লিখত, জীবন মানুষকে ভুল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেয়। বুদ্ধিমান মানুষ সেই সুযোগ কাজে লাগায়, বোকারা অবহেলা করে। আবার কখনও কখনও মন্তব্য করত, সব ভুল যদি ফুলই হয়ে ফুটত তাহলে ভুলের জন্য মনে কাঁটা ফুটত না। কিছু কিছু জায়গায় মন্তব্য করত, মানুষের জীবন সুখ-দুঃখের সমষ্টি। কোনো মানুষই পরিপূর্ণ সুখী নয়। বরং দুঃখকে মনে বাঁচিয়ে, টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে সুখী হওয়ার উপায় খুঁজে নেওয়াই হচ্ছে, জীবন।
একটা সময় নাদিফ এসব কমেন্টের দ্বারা নিশ্চিত হলো, সাফা দূরে থেকেও তার পাশে ছিল। এখনও আছে। কিন্তু কেন? কোনো ধরনের লিখিত চুক্তি ছাড়া এই পাশে থাকার কারণটা ঠিক কী? এই একটা ভাবনার উত্তর খুঁজে বের করা সহজ ছিল না নাদিফের জন্য। কারণ সে, সাফাকে নিয়ে এত গভীর ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেয়নি। আজ যখন নতুন গন্তব্যে এসে সবকিছু গুছিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসল তখনই মেয়েটির মনমরা মুখ, ফোলা ফোলা গাল ও অহেতুক রেগে যাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়তেই পিছনের সব কমেন্টে চোখ বুলাতে বুলাতে সাফার প্রোফাইলে ঢুকল।
রাত দশটার দিকে সাফা একটা পোস্ট দিয়েছে। সেখানে একটা মেয়ের অস্পষ্ট চেহারা, এলোমেলো চুলে ঢেকে যাওয়া গাল এবং ক্যাপশনে লেখা ‘অপেক্ষা’ শব্দটা কিঞ্চিৎ ভাবিয়ে তুলল নাদিফকে। মেয়েটি কার জন্য অপেক্ষা করছে? বিশেষ কারও জন্যই কি তার অপেক্ষা? হতে পারে। নাদিফ কী বুঝে যেন কমেন্টে লিখল, “অপেক্ষা সুন্দর। ব্যক্তিটি যদি বিশেষ হয়, তার জন্য অপেক্ষার প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ্য। আই উইশ, আপনার অপেক্ষা দ্রুত ফুরিয়ে যাক।”
কমেন্টে একটা ‘ওয়াও’ রিয়েক্ট। কারণ সাফা যতই কমেন্ট করুক, নাদিফ কখনও তার কমেন্টে ‘আপনার কথাগুলো সুন্দর। গভীর উপলব্ধির সংমিশ্রণ লুকিয়ে আছে।’ এসব বলা ছাড়া যেচে আলিশা মুনতাহা আইডির পোস্টে কোনো কমেন্ট করেনি। মাঝেমধ্যে রিয়্যাক্ট দিত। তবে কমেন্ট ভুলেও করত না!
এখন রাত দুটো। এত রাতে এই কমেন্টের রিপ্লাই আসার কথা নয়। কিন্তু দুই থেকে তিন মিনিট পরই রিপ্লাই এলো, “থ্যাংক ইউ। কিন্তু একটা কথা, অপেক্ষা সুন্দর এটা আপনি জানলেন কী করে? কখনও কারও জন্য অপেক্ষা করেছেন?”
নাদিফ রিপ্লাই দিল, “হম… করছি। একটা কাঙ্খিত জীবনের… সুখের… শান্তির এবং একটা চমৎকার মনের জন্য।”
সাফা এখানে কেয়ার রিয়্যাক্ট দিলেও রিপ্লাই দিল না কিছু। নাদিফের অপেক্ষা করার কথা নয়, তবুও একটা রিপ্লাইয়ের অপেক্ষায় রইল সে। অথচ এক মিনিট, দুই মিনিট ছাড়িয়ে দশ মিনিট কেটে গেলেও কোনো রিপ্লাই এলো না।
নাদিফ ফোন রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করল। অথচ তার চোখে ঘুম এলো না। রুমের জানালা খুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর রাতের আকাশ দেখতে দেখতে জীবনের হিসেব কষে যেতে লাগল! একটা ভুল… তাকে কতকিছু থেকে বঞ্চিত করে দিল। সব হলো তার শুধু একটা গন্তব্য হলো না। যে গন্তব্যের শেষে কেউ না কেউ তার জন্য দু’হাত ভরা শান্তি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে!
***
নাদিরা ও নাজিফা এখনও কমেন্টকারীর পরিচয় পায়নি। তবে হাল ছাড়েনি। খুব ধৈর্য্য নিয়ে দুই বোন ওই একজনকে খুঁজে মরছে। আজ সাফা স্বেচ্ছায়ই এসেছে মনোয়ারা বেগমকে দেখতে। ছেলের চিন্তায় তিনি অস্থির থাকেন সবসময়। মাঝেমধ্যে তাদের বাসায় গিয়ে বসেন, আফসোস করেন, কেঁদে গাল ভাসিয়ে দেন। স্বর্ণা সুযোগ বুঝে অনেকবার বলতে চেয়েছে, কিন্তু সাফা আটকে দিয়েছে। এইভাবে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ সে নিতে চায় না। সে চায়, নাদিফ তাকে বুঝুক। এরপর সিদ্ধান্ত নিক। অথচ নাদিফের দিক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত আসেনি। আসার কথা নয়। কারণ সে সাফাকে নিয়ে ভাবছে না। এতজলদি ভাবা সম্ভব নয়। ও তো ঢিলে মাথার প্রাণী! এসব আকার-ইঙ্গিত কী আর বুঝবে?
দুই বোনের সাথে গল্প করতে করতে তাদের পড়াশোনার খবর জানতে চাইল সাফা। উত্তর দিয়ে দু’জনে আবার ফোনের কমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
মনোয়ারা বেগম চা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ওরা পড়বে কী? সারাদিন কী কানাকানি করে আর ফোন ঘাটাঘাটি করে। পড়তে বসলে তো। নাদিফ থাকলে দুটোর কান মলে দিত।”
সাফা হেসে বলল, “তা-ই না-কি। ফাঁকিবাজি করছে ওরা?”
এরপর দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আন্টি কী বলছেন এসব? তোমরা না কি পড়াশোনা করতে চাও না?”
নাদিরা উত্তর দিল, “করি তো!”
“কেমন করছ দেখতে পাচ্ছি। ফোনে কী?”
নাজিফা বলল, “দেখো না আপু, প্রতিদিন একটা মেয়ের আইডি থেকে ভাইয়ার পোস্টে বিজ্ঞের মতো কমেন্ট আসে। ওই মেয়েটা কে সেটাই খুঁজছি।”
“তাই? কই দেখি!” আগ্রহী চোখমুখ নিয়ে বলল সাফা।
নাদিরা ফোনের স্ক্রিনে থাকা আইডি দেখাল। সাফা সেটা দেখে ঠোঁটমুড়ে হেসে বলল, “ওহ, এটা…। সুন্দর তো। তোমাদের ভাই তো সেলিব্রেটি হয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা তাকে এত সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করছে।”
“আরেহ ধুর… সব মেয়েরা না। ওই একটা মেয়েই।”
“বাদ দাও এসব। অযথা ঘাটাঘাটি করে লাভ নেই।”
“অসম্ভব। এখানে কিছু একটা রহস্য আছে।”
“ওমা! গোয়েন্দা হয়ে গেলে দেখছি! তা রহস্য ধরতে পেরেছ?”
নাজিফা ভাবুক চেহারায় বলল, “আমার মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা ভাইয়াকে পছন্দ করে।”
সাফা ভীষণ চমকাল। এইটুকু মেয়ে, এত গভীরভাবে ভাবছে এই কমেন্ট নিয়ে। বুঝেও ফেলেছে। অথচ যার বুঝার কথা, সে-ই বুঝছে না। হতাশায় ভরা কণ্ঠে সে বলল, “হায় কপাল! এই তাহলে ঘটনা। কিন্তু তুমি এতটা নিশ্চিত কী করে?”
নাদিরা এই কথার উত্তরে বলল, “মেয়েটি অনেক বছর ধরে ভাইয়াকে ফলো করছে। সুন্দর সুন্দর কমেন্টস করছে। শুধু তাই নয়… ভাইয়ার সব দুঃখ, হতাশা কিংবা একাকীত্বের পোস্টে সে এত চমৎকার কমেন্ট করে যেন সে দূর থেকেও ভাইয়াকে পড়তে পারে। বুঝতে পারছে। আচ্ছা, এমন যদি হত… ওই মেয়েটা ভাইয়াকে খুব ভালোবাসে। খুব ভালো হত তাই না?”
সাফা বিস্ময় ধরে রেখে বলল, “তাতে কী হত?”
“আমার ভাইয়াকে বুঝার মতো একটা মানুষ বাড়ত।”
“তুমি কি চাও, কেউ তোমার ভাইয়াকে বুঝুক? তার পাশে থাকুক?”
“আমরা সবাই চাই।”
“তোমার ভাইয়াও কি তাই চায়?”
“সেটা তো জানি না!”
মনোয়ারা বেগম মেয়েদের এই পাকনামি কথা শোনে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী নাটক শুরু করলি তোরা? মেয়েটা এসে বসেছে, এরমধ্যে তোদের কাহিনী শুরু হয়ে গেল! আর কোনো কাজ নাই? যা ভাগ…।”
নাদিরা ও নাজিফা গাল ফুলিয়ে চলে গেল। মনোয়ারা বেগম সাফাকে বললেন, “তুমি ওদের কথায় কিছু মনে করো না, মা। বাচ্চা মানুষ। সবকিছু বুঝে না। ক’দিন ধরে কীসব আইডির চক্করে পড়েছে এরা! এখন তোমাকে জ্বালাতে শুরু করেছে।”
সাফা হাসিমুখে বলল, “না না, আন্টি। অসুবিধা নেই। ওরা তো আর এতকিছু বুঝে না। আমি আসছি। আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন। আর কোনো অসুবিধা দেখলে আমাকে জানাবেন।”
রুমে এসে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সাফা একটা পোস্ট লিখল। ট্যাগ করল নাদিফকে। তবে পোস্টটা পাবলিক করল না। শুধু দু’জনের মধ্যেই রাখল। এরপরও যদি গাধাটার হুঁশ না হয়… তাহলে আর কিছু করার নেই।
***
নতুন অফিসের কলিগদের নিয়ে চট্টগ্রামে তিন দিনের ট্যুরে গিয়েছিল নাদিফ। সেখান থেকে আজই ফিরছে। তবে বাইক নিয়ে নয়… ট্রেনে। সেদিন সাফার পোস্ট সে দেখলেও কোনো রেসপন্স করেনি। ইচ্ছে করেই কিছু বলেনি। নিজেকে সময় দেয়ার পাশাপাশি অনুভূতির স্বচ্ছতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছিল সে। এ কারণে টানা দুই মাস আইডি ডিএকটিভ করে রেখে দিয়েছিল। এতে ওপাশের ব্যক্তির মনের মধ্যে কী চলছে তার জানার উপায় তার না হলেও নিজ দায়িত্বে উপলব্ধি করতে চাইছিল, সে কোনোভাবে সাফার প্রতি দুর্বল কি না।
ওইদিন সাফা পোস্ট লিখেছিল, “আমি বিশেষ ব্যক্তিটির অপেক্ষায় আছি৷ আজ থেকে নয়… অনেক, অনেক বছর ধরে। যদি তার মনে হয়, এবার গন্তব্য চিনে নেয়া উচিত, তাহলে আমার সব অপেক্ষাদের মুক্তি দিক। জীবন তো একটাই তাই না? একজীবনে আমি আর কত অপেক্ষা করব! নাদিরা ও নাজিফা বুঝে নিল… আলিশা মুনতাহা আইডির মেয়েটা তাদের ভাইকে পছন্দ করে। অথচ আপনি গাধা কিছুই বুঝলেন না।”
এরপর সাফা কেমন আছে এইটুকু খোঁজ না নিলেও প্রতিদিন একবার স্বর্ণার কাছে ফোন করত নাদিফ। ভালোমন্দ আলাপ করে রেখে দিত।
আজ অনেকদিন পর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লগইন করে নাদিফ সে-ই পোস্টে রিয়্যাক্ট দিয়ে লিখল, “এত বছর ধরে অপেক্ষা করে লাভ কী হলো? আজও তো একাই রইলেন। আপনার কাছে যে বিশেষ, তার মন তো ভাঙাচোরা! এই ভাঙাচোরা মন নিয়ে কেউ আপনার সামনে দাঁড়াবে কী করে? তার তো সেই সাহস নেই! তবুও যদি সে সামনে দাঁড়ায়, যদি তাকে সামলাতে না পারেন, যদি মনে হয় সে খারাপ, তখন কী করবেন?”
এইটুকু লিখে নাদিফ বাড়িতে ফোন করে জানাল সে ফিরছে। ছুটি আরও তিনদিন আছে। এই তিনদিন সে সবার সাথে কাটাতে চায়।
আইডিতে আজ আবারও একটা পোস্ট লিখে পোস্ট করল নাদিফ। কিন্তু সেখানে সাফার কোনো কমেন্ট এলো না। একটানা জার্নি শেষ করে স্টেশনে কাউকে দেখার আশায় মুখিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত চেনা মুখের একজনের দেখাও পেল না।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে অল্প একটু খেয়ে দ্বিধা সরিয়ে সিদ্ধান্ত নিল সাফার মুখোমুখি হবে। খুব যত্ন নিয়ে একগুচ্ছ ফুলও কিনে এনেছে। এমন সময় নাদিরা ও নাজিফাকে উৎফুল্ল মেজাজে পাশের ফ্লাটে যেতে দেখে বলল, “এত ছুটছিস কেন তোরা?”
নাজিফা পরনের সাজগোজ ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিয়ে বলল, “তুমি জানো না? আজ তো সাফা আপুর আকদ!”
“কী? কার সাথে?” আঁতকে উঠে প্রশ্ন করল নাদিফ।
সাফার ভাই ফারাবী দেশে এসেছে গত সপ্তাহে। এরপর বোনের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেছে। সাফা সব বলতে গিয়ে এবারও থেমে গেছে। ওভাবে স্পষ্টভাবে সব প্রকাশের পর থেকে যখন নাদিফের আইডির পাত্তা মিলল না, এত অপেক্ষার পরও যখন কেউ তার অনুভূতির মূল্যায়ন করল না, তখন তার থেকে আর কিছু আশা করতে পারছে না সে। মেনেও নিয়েছে নিয়তি! হয়তো সে নাদিফের যোগ্য নয়। হয়তো সে ছ্যাঁচড়া! নির্বোধ! নয়তো জেনে-বুঝে কেউ বিষ পান করে?
এতকিছু তো নাজিফা জানে না। তবে সাফার ভাইয়ের তোড়জোড়ের কথা জানিয়ে বলল, “তুমি যাবে? আকদ শুরু হবে সন্ধ্যায়!”
সাফার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত সবাই… এ কারণেই ঘরে কেউ নেই! নাদিফ কোনো শব্দ ছাড়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সামনের ফ্লাটে এলো। দরজাটা খোলাই ছিল।
নাদিফকে দেখে স্বর্ণা বলল, “কখন এলে?”
“অনেকক্ষণ। কেমন আছেন?”
“ভালো। বসো। আজ বাসায় অনেক মেহমান আসবে। আমি এত ব্যস্ত…। তুমি কি বসবে? আসলে আমি বাইরে যাব। কিছু কেনাকাটা বাকি।”
“না, ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি।”
“তা কী করে হয়? মাত্রই এলে। খালিমুখে চলে যাবে? তুমি বসো, আমি সাফাকে বলছি, চা করে দিবে।”
“এসবের দরকার নেই, ভাবী। ওনাকে বিরক্ত করবেন না।”
“বসো তো। এ আর কঠিন কী!”
এরপর সাফাকে ডাক দিয়ে বলল, “এ্যাই, সাফা…। নাদিফ এসেছে। তোর সাজগোজ হলো? ওকে এক কাপ চা দিতে পারবি? তোর ভাইকে কী কী আনতে বলেছিলাম, এ বেচারা ভুলে বসে আছে। এখন উরাধুরা ফোন করছে। আমি যাচ্ছি। তুই একটু দেখ…।”
কোনোদিকে না তাকিয়ে স্বর্ণা বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সাফা নিজের সাজগোজ ফেলে রেখে বাইরে এসে বলল, “আরেহ, আপনি!”
এই প্রথম সাফাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল নাদিফ। আকাশি রঙের শাড়ি ও খোঁপায় গুঁজে রাখা বেলিফুলের গাঁজরায় তাকে কী সুন্দরই না লাগছে! এই মেয়েটা এত কাছে ছিল… অথচ সে মুগ্ধতা খুঁজে পায়নি এতদিন। ভালোমতো দেখেওনি! জানতও না, মেয়েটির মনে তাকে নিয়ে এত ভালোবাসা জমানো! এখন যখন জানল, সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। উত্তর না দিয়ে মুগ্ধ হয়ে সে দেখে গেল সামনে থাকা রমণীকে।
সাফা এক কাপ গরম চা টে-টেবিলে রেখে সোফায় হেলান দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। নাদিফ বলল, “পাত্র কী করে?”
“জানি না।” নতমুখে উত্তর দিল সাফা।
“কেন?”
“প্রয়োজন নেই।”
“কী বলছেন?”
“সব ভাইয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছি!”
এরপর আর কী বলবে ভেবে পেল না নাদিফ। সামনে রাখা চা’টুকুও গিলতে পারল না। অস্থির মনে জানতে চাইল, “আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিভ না?”
“আছি তো। কেন?”
“এমনি!”
নাদিফ উঠে গেল। বলতে চেয়েও সাহস হলো না। কেমন ভোতা যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। চোখদুটো জ্বলছে! কাউকে পেয়েও হারানোর মতো যন্ত্রণা কেমন আগে তা উপলব্ধি হয়নি। আজ হলো… ভীষণ বাজেভাবে!
সাফা বলল, “চলে যাচ্ছেন?”
“হম… ভালো থাকবেন। নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা রইল।”
দু’পা এগিয়ে পিছনে ফিরল নাদিফ। খুব করে মনে সাহস সঞ্চয় করে সাফার মুখোমুখি দাঁড়াল। কোনো শব্দ না করে দু’হাতের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, “আপনি না বিশেষ একজনের অপেক্ষায় ছিলেন? তাহলে এত দ্রুত কীভাবে অন্যকারও হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন? কষ্ট হয়নি?”
“না…। কার জন্য কষ্ট হবে? যার মনে আমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই, তারজন্য কষ্ট পেয়ে লাভ?”
“এত বছর অপেক্ষা করে এই অল্প কিছুদিনে হার মেনে নিলেন?”
“আমার কিছু করার নেই আসলে!”
“ওহ…। সব অনুভূতি নিঃশেষ হয়ে গেল?”
সাফা অশ্রুভেজা চোখে উত্তর দিল, “অনুভূতি নিঃশেষ হয় না কি?”
“তাহলে? কেন সবাইকে সত্যিটা বলেননি?”
“কেন বলব? কীসের জন্য বলব? আপনি আমাকে কোনোকিছুর নিশ্চয়তা দিয়েছেন? এই দুটো মাস… আমার দিন কীভাবে গেছে, সে-ই খবর রেখেছেন? রাখেননি!”
নাদিফ দিশেহারাবোধ করল। দু’হাতে সাফার কান্নাভেজা মুখ ছুঁয়ে বলল, “বিশ্বাস করুন… আমি অনেক আগে টের পেয়েছিলাম, কিন্তু নিজেকে কীভাবে আপনার সামনে দাঁড় করাব সেটা বুঝতে পারছিলাম না। একবার ধাক্কা খেয়ে আবারও জীবন সাজানোর সুযোগ পাব কি না, সবকিছু ভালো হবে কি না, মনের ক্ষত সারবে কি না, এসব নিয়ে আমি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিভ ছিলাম না ঠিকই… কিন্তু প্রতিদিন ভাবীর কাছে ফোন করেছি। মায়ের কাছে ফোন করে আপনার খোঁজখবর নিয়েছি। এমনকি বাবা ও মাকে বলেছি, ছুটিতে এখানে এলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। আর একটু অপেক্ষা করতে পারলেন না? হাল ছেড়ে দিলেন?”
সাফা অভিমানে দূরে সরে যেতে চেয়ে বলল, “দেখি… সরুন, সবাই এসে পড়বে।”
নাদিফ দূরে গেল না উলটে সাফার ভেজা গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “আগে বলুন কবুল… তারপর দূরে যাব।”
“অসম্ভব। আপনি একটা স্টুপিড! এতগুলো বছর ধরে আমি পুড়ে মরেছি শুধু আপনার জন্য… অথচ আপনি কাছে থেকেও দেখেননি।”
“আমি স্টুপিড মানছি। আপনি তো ক্লেভার। নিজের ভালোবাসাকে কাছে টানার সাহস করতে পারেননি কেন?”
সাফা উত্তর খুঁজে না পেয়ে ডুকরে কাঁদল। তার সেই কান্নায় নাদিফ আরও অশান্ত হয়ে উঠল। দিকদিশা হারিয়ে ক্রমাগত গালে, কপালে, ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, “এখনও তো সময় আছে, তাই না? আপনি শুধু সম্মতি দিন, আমি সবাইকে ম্যানেজ করে নেব। ভাইয়াকে সব খুলে বলব। প্লিজ…।”
“কী বলবেন?”
সাফার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির চোখের মাঝে দৃষ্টি মিলিয়ে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাদিফ বলল, “আমি এই পাগলিটাকে ভালোবাসি।”
সাফা অনেকক্ষণ পর চোখেমুখে স্বস্তির সাথে হাসি ফুটিয়ে বলল, “কবুল…।”
এরমধ্যেই হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভেতরে সবাই ঢুকে পড়ল। একসাথে হৈহৈ করে উঠল। বিশেষ করে নাদিরা ও নাজিফা। নাদিফ দূরে সরে অবাক হয়ে বলল, “কী আশ্চর্য! সবাই এখানে…। ভাবী, আপনি যাননি?”
স্বর্ণা ভেতরে এসে বলল, “ড্রামা শেষ হয়েছে? বিয়ে কি আজ করবে না কি কাল?”
“বিয়ে? আমি?”
“হ্যাঁ, তুমিই। এরপর পালালে কিন্তু দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবে না।”
নাদিফ অবাক হয়ে বাবা-মা, দুইবোন ও সাফার দিকে তাকিয়ে রইল। সাফা বলল, “আমি ওই পোস্টে আপনার কমেন্টটা দেখেছি আজকে। এরপর এই দুষ্টুমিটা করেছি। কষ্ট পেয়েছেন? স্যরি…।”
নাদিফ কথার জবাব না দিয়ে সাফার হাতটা মুঠোয় পুরে রাখল। ফারাবী এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ক’দিনের জন্য এসেছ?”
“তিনদিনের।”
“তুমি সিদ্ধান্ত নাও কবে বিয়ে করবে। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
সাফার দুটো হাত এবার দু’হাতে আটকে নিয়ে নাদিফ বলল, “আজই… এক্ষুণি।”
***
আকদের পর সাফাকে নিজেদের ফ্লাটে নিয়ে এসে দুইবোনে আবার স্বর্ণাকে সাহায্য করতে ছুট দিল। বলে গেল, কাজ শেষে আসবে। সব মেহমানদের ভীড়ে সাফা রীতিমত লজ্জা পাচ্ছিল আবার কারও সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। অ্যাপার্টমেন্টে যত পরিবার ছিল, কেউ বাদ যায়নি আজকের দাওয়াত থেকে। তা-ই ভীড় থেকে বাঁচাতেই স্বর্ণা ওদের বলেছে, সাফাকে এখানে রেখে যেতে।
কতক্ষণে সব আয়োজন শেষ হবে কে জানে! সবার খাবার-দাবারের ঝামেলা শেষ করে তবেই বাকিরা ঘরে ফিরবে। এতক্ষণ একা একা কী করবে সে? ভেবে না পেয়ে পুরো ঘর হেঁটে বেড়াল সাফা। মাথার আঁচল ফেলে গুটি গুটি পায়ে নাদিফের রুমে যাবে, অমনি কারেন্ট চলে গেল! ভয়ে কেঁপে উঠল সে। ভুলে গেল এই ফ্লাটের সামনের দরজা বন্ধ করেছিল কি না। এখন যদি চোর আসে? হাতে তো ফোনও নেই। কীভাবে কী করবে?
পা ফেলতে গিয়ে সামান্য ঠলে উঠল সাফা। এই ঘরের কোথায় কী, কিছুই তো জানে না। এখন বের হওয়ার রাস্তা খুঁজবে কী করে? ভাবনারত সাফাকে চমকে দিয়ে খুব সামান্য একটা আলোর রেখা দরজার দিকে দেখা দিল। সাফা দূরে থেকে বলল, “কে?”
ভরাট গলায় ভেসে এলো, “আমি জ্বিন-ভূতের রাজ্য থেকে এসেছি। নতুন বউ দেখতে!”
ভয়ের কারণে সাফা কণ্ঠস্বর চিনতে না পেরে কেঁপে কেঁপে বলল, “খবরদার একপাও এদিকে আসবেন না। দূরে যান। আমি এক্ষুণি চিৎকার দেব।”
এরমধ্যে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আলোও নিভে গেল। ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেল পায়ের শব্দ শোনে। সাফা ওখান থেকে চিৎকার দিয়ে বলল, “কে আপনি!”
মুহূর্তের মধ্যে তাকে অবাক করে দিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলল নাদিফ। বলল, “এত ভয়?”
এরপর ফোনের টর্চ জ্বেলে সাফার মুখোমুখি হয়ে একহাতে তাকে কাছে টেনে বলল, “আহা… নতুন বউয়ের অবস্থা তো খুব খারাপ। এইটুকুতে কেঁপেটেপে শ্যাষ!”
সাফা ঠোঁটমুখ ফুলিয়ে বলল, “এসব কী ধরনের ফান? আর একটু হলে দম আটকে যেত!”
সাফা যে সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে যাবে বুঝেনি নাদিফ। বুঝলে এমনটা করত না। সে দু’হাতে সাফাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “স্যরি…। আপনি একদিন বলেছিলেন, নতুন বউকে জ্বিন-ভূত কীভাবে ধরে সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। তা-ই একটু মজা করছিলাম।”
উত্তর না দিয়ে নিজের কাঙ্খিত আশ্রয়ে মুখ লুকিয়ে… অনেক বছর ধরে অপেক্ষায়, অস্পর্শ্যে বাঁচিয়ে রাখা অনুভূতিটাকে হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে অনুভব করতে চাইল সাফা! এই একটা নিরাপদ জায়গাকে নিজের নামে দেখতে পাওয়ার কত আফসোস ছিল তার…। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই মানুষ, এই ঘর এবং এই হৃদয়ের মালিক আজ সে।
নবপরিণীতার শরীরের কাঁপুনি ও ক্রমাগত অশ্রু বর্ষণ টের পেয়ে দু’হাতের সাহায্যে তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে নিজের রুমে এলো। বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে আদুরে সুরে বলল, “এভাবে কাঁদলে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়, সাফা।”
সাফা ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল, “সব কান্নায় কষ্ট থাকে কে বলল? এতগুলো বছর আমি যে পানি লুকিয়ে রেখে দিন কাটিয়েছি, আজ তা উন্মুক্ত করেছি আপনাকে পাওয়ার সুখে। এটা আমার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে ফিরে পাওয়ার কান্না।”
নাদিফ সন্তুষ্টি ভরা মন নিয়ে সাফার মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “আরও আগে যদি এমন বিশুদ্ধ ভালোবাসার খোঁজ পেতাম… হয়তো জীবনের এতগুলো দিন নিজেকে এতটা কষ্ট পেতে দিতাম না।”
“তাই? এখন পেয়ে কি মনে হচ্ছে?” আদুরে কণ্ঠে প্রশ্ন করল সাফা।
নাদিফ স্পষ্ট কণ্ঠে উত্তর দিল, “মনে হচ্ছে, অবশেষে আমি আমার লাস্ট স্টেশনে এসে পৌঁছাতে পেরেছি। যেখানে আমার একজন নিজের মানুষ আছে। যে আমার জন্য এতগুলো দিন অপেক্ষা করেছে। এবং যার জন্য এখন থেকে আমি সব ব্যস্ততা শেষে ঘরে ফেরার তাড়না অনুভব করব। থ্যাংক ইউ বলব না। শুধু বলব… দিনশেষে আমরা একে-অপরের লাস্ট স্টেশন হয়ে থেকে যাব ইনশা’আল্লাহ, যেখানে আপনার জন্য আমি এবং আমার জন্য আপনি!”
***
সমাপ্ত…





