লাস্ট স্টেশন পর্ব-৬+৭

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৬

সারারাত ঘুমাতে পারেনি তূর্ণা। ভিন্ন জায়গা ও ভিন্ন পরিবেশ… তারমধ্যে রুমের বাতি বন্ধ করে শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, রাতের সব জ্বীন-ভূত তাকে অন্ধকারেও দেখছে। এ কারণে বাতি জ্বালিয়ে তো রেখেছেই, বারবার নাদিফের দরজায় ধাক্কাটাক্কা দিয়ে তাকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কখনও এসে বলেছে, রুমে কারও হাঁটার শব্দ পাচ্ছে আবার কখনও বলেছে, চোখ বন্ধ করলে কেউ তার উপর ঝাঁপ দিচ্ছে। এমনতর অসংখ্য ভয়ানক কথা ও চিন্তায় সে রুম ও ডাইনিং, ডাইনিং ও রুম এসবই করেছে।

একটা সময় বিরক্ত হয়ে নাদিফ বলেছে, “এটা শহর। অজপাড়াগাঁ নয় যে এখানে জ্বীন-ভূত উঁকিঝুঁকি মারবে৷ তাছাড়া, আমি এত বছর ধরে এখানে আছি, কখনও এই ধরনের কোনো সমস্যায় পড়িনি। সব আপনার মনের ভুল। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে এসেছেন বলে উল্টাপাল্টা চিন্তা করছেন। আপনি ঘুমান। সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তূর্ণা তা-ও জোর দিয়ে বলেছে, “আপনি বিশ্বাস করছেন না? এখানে ভূত আছে। ভূত নাহলে জ্বীন তো অবশ্যই আছে। নয়তো আমি কার পায়ের আওয়াজ শুনেছি?”

শেষমেশ সমাধান দিতে নাদিফ বলে দিয়েছে, “দেখুন, জ্বীন-ভূত আছে কি নেই তর্কে যাব না। তবে আগামীকাল আপনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। এখন যান… ঘুমান। আমাকেও ঘুমাতে দিন।”

ঘুমান বললেও তূর্ণা ঘুমায়নি। পুরো রাত ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কাটিয়ে দিয়েছে। সকালেও তাকে ওখানেই প্রথমে দেখল নাদিফ। ডাক না দিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নাশতা বানাতে গেল।

তূর্ণার ঘুম ভাঙল দশটার দিকে। ততক্ষণে সব ধরনের নাশতা ও দুপুরের রান্না শেষ করে, ঘর গুছিয়ে নিয়েছে নাদিফ। সে ঘুমঘুম চোখে টেবিলের কাছে এসে সবকিছু দেখে তড়িঘড়ি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসল। ঘরে কেউ আছে কি না, কেউ খাবে কি না, এসব খুঁজতেও গেল না।

নাদিফ নিজের রুম থেকে বেরিয়ে তূর্ণাকে নাশতা করতে দেখে বলল, “আমি দেখি, বাসা খুঁজে পাই কি না! আপনি চা অথবা কফি বানিয়ে নিয়েন। রান্নাঘরে সব রাখা আছে।”

তূর্ণা পরটা ও ঝুরঝুরে মাংস মুখে পুরে বলল, “আপনি বাসা দেখতে যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ…। এখানে তো আপনার অসুবিধা হবে।”

“আলাদা বাসা নেয়ার কী দরকার? খরচ বেশি। তারচেয়ে একটা চাকরি ম্যানেজ করে দিন।”

“চাকরি তো এখুনি মিলবে না। আপনার সব কাগজপত্র সাথে আছে? গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট তো, না?”

“জি, সব আছে।”

“কী ধরনের চাকরি হলে ভালো হবে?”

“যেকোনো একটা হলেই হবে। কোনোমতে এ শহরে চলার উপযুক্ত।”

মাথা নেড়ে নাদিফ বের হতে চাইল, অমনি তূর্ণা পিছন থেকে বলল, “বাসা দেখার দরকার নেই। আমি এখানেই ম্যানেজ করে নিতে পারব, যদি আপনার কোনো সমস্যা না হয়।”

দরজার কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নাদিফ বলল, “আমার তো সমস্যা হবে।”

“কেন?”

“কারণ আমাদের সম্পর্কটা! আর এখানকার কেউ যদি জানে…।”

“অসুবিধা কী? লোকে তো আর সত্যমিথ্যা যাচাই করছে না!”

“না করলেও… নিজের বিবেককে আমি আর প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারছি না। আমার কাছে এটা একটা অদৃশ্য কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত নিজের কাছে পরিশুদ্ধ থাকার জন্য আলাদা বাসা দেখা জরুরী।”

তূর্ণা বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নেড়ে বলল, “নিজের উপর বিশ্বাস একদমই নেই তাহলে!”

“এমনটা নয়! নিজের উপর বিশ্বাস আমার আছে। কিন্তু আমি মানুষের সামনে হাসিঠাট্টার পাত্র সাজতে চাই না। নিজের অবস্থান সবসময় স্পষ্ট রাখতে চাই।”

তূর্ণা আর কথা বাড়াল না। নাদিফের কথাই যুক্তিযুক্ত। তার যত ভয় হোক, যতই অচেনা শহর হোক, এখানেই একাকী মানিয়ে নিতে হবে। নয়তো একটা সময়, এই সম্পর্ক নিয়ে সবাই হাসিঠাট্টা করবে।

নাদিফ চলে যাওয়ার পর তূর্ণা ভাবতে বসে গেল। ভাবতে ভাবতে চা বানিয়ে রুমের ব্যালকনিতে বসে মায়ের সাথে কথা বলল। এরপর শাশুড়ি ও দুই ননদদের সাথেও কথা চালিয়ে গেল।

***

প্রতিদিন নিজের বারান্দা থেকে নাদিফের চলে যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে সাফা। আবার তার ফেরার সময়টায়ও সে এখানেই বসে থাকে। এই বসে থাকা একদিন, দু’দিন ধরে নয়… গোটা কয়েকটা বছর ধরে। ইন্টার্নশিপ শেষ করে সে যখন বাসায় এসেছিল, তখন এই বাসায় উঠেছিল নাদিফ। সেদিন থেকে যখন তার মুখোমুখি হয়, তখন তার সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত অনুভূতির স্রোত বয়ে যায়। যতবার ওই চেহারা দেখে ততবার মনের এলোমেলো অনুভূতি… তাকে দিশেহারা করে দেয়। কিন্তু কখনও তা মুখফুটে বলার সাহস হয়নি।

ভেবেছিল সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ভাই-ভাবীর মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে… তা আর সম্ভব হলো না। এফসিফিএস ট্রেনিংয়ের চাপ এতবেশি ছিল যে, নাদিফের সাথে তার দেখাই হত না। সপ্তাহে একবার হুট করে দেখা হলে হাই-হ্যালো’র পর আর কিছু জিজ্ঞেস করা হত না। ওই সময়টায় চাইলেও কিছু বলতে পারত না সে। মনে হত, আরেকটু সময় যাক। মানুষটাকে আরেকটু চিনি। আরেকটু বুঝি। নিজের মনকে আরেকটু যাচাই-বাছাই করি। এসব প্রেম না কি সাময়িক মোহ… এইটুকু বুঝতে গিয়ে এতটাই দেরী হয়ে গেল যে, সব আজ হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল।

আগে যখন বারান্দায় এসে বসত, তখন রাস্তা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকত। নাদিফ বাইক নিয়ে বের হত। হেলমেট পরত। এরপর অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেত। পুরোটা সময় সে তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকত। আর আজ… তাকাতে গিয়ে মনে হলো… মানুষটা তো অন্য কারও। এই তাকানোটাও চরম নির্লজ্জতার শামিল। তা-ই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে রুমে এসে বসে রইল।

একজীবনে মানুষ যা চায়, তা পায় না বলেই ব্যর্থতা, আহাজারি ও বুকভরা না পাওয়ার ঢেউ গুনে দিন কাটিয়ে দিতে হয়। সাফা নিশ্চিত হয়ে গেল… তার জীবনের বাকি দিন সে ব্যর্থতার হিসেব গুনে কাটিয়ে দিবে।

ভাই-ভাবী অনেকদিন ধরে তার কাছে জানতে চাইছে, আর কত দেরী। এবার বিয়ের মত দে। অথচ সে… একটা মানুষকে ও নিজের মনকে বুঝতে গিয়ে এতবেশি দেরী করে ফেলল… এখন আর এসবের কোনো সমাধানই নেই। মন জানে ঠিক কতটা অনুভূতি জমে আছে ওই মানুষটার জন্য… তবুও তা প্রকাশ করার অনুমতি নেই। হবেও না আর। সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

গত দু’দিন আগে যখন নাদিফ গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছিল। তখন দারোয়ান তাকে ব্যাগপত্র নিয়ে বের হতে দেখে বলেছিল, “কী ব্যাপার ভাইজান! কয়দিনের জন্য যাচ্ছেন?”

রোগীর অপারেশন শেষ করে মাত্রই হসপিটাল থেকে ফিরেছিল সাফা। গাড়ি গেট দিয়ে খুব ধীরগতিতে প্রবেশ করছিল। তখন নাদিফের কথাটা কানে এলো, “যাচ্ছি তো এক সপ্তাহের জন্য।”

দারোয়ান চমকে গিয়ে বলেছিল, “এক সপ্তাহ? আপনি তো এত লম্বা ছুটি নেন না! বিশেষ কোনো কাজ ভাইজান?”

নাদিফ হালকা হেসে উত্তর দিয়েছিল, “বাবা-মা নিজেদের পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন।”

“তা-ই না কি ভাইজান! তাহলে কি ভাবীকে নিয়ে ফিরবেন?”

“হ্যাঁ… ইচ্ছে তো আছে!”

ব্যস… এইটুকু কথা ও গতকালকে নাদিফের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি… তাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। এরপর অবশ্য ভাবীর মুখ থেকে শুনেছিল, কত তারিখে বিয়ে ছিল।

সাফার সাথে নাদিফের দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও তার ভাইয়ের বউ স্বর্ণার সাথে খুব ভাব। মাঝেমধ্যে দু’জনকে ছাদে বসে গল্পগুজব করতে দেখা যায়। দরকারী জিনিস আনানো যায়। কখনও কখনও বাজারের ব্যাগটাও উপরে টেনে তুলে দেয়। স্বর্ণার স্বামী দেশে নেই বলে… বিপদে-আপদে যথেষ্ট সাহায্য করে সে।

সাফা অবশ্য চেয়েছিল দেশের বাইরে গিয়ে সেটেল্ড হবে। তার ভাই ফারাবীর এমনটাই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু নিজের মনের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে, তার প্রতি যত্নশীল হতে গিয়ে… সব সিদ্ধান্ত বদলে সে দেশেই থেকে গেল। এখানকার সরকারি হসপিটালের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রোগীদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে নামল।

শেষবার সাফা হাউমাউ করে কেঁদেছিল মায়ের মৃত্যুতে। তা-ও দশম শ্রেণীতে থাকতে। বাবা তো ছোটোবেলা থেকেই নেই। বাবার আদর-শাসনের সাথে তার পরিচয় নেই।

আজ আবারও, বহুদিন পর… বুকের ভেতর কেমন কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গেল। স্বর্ণার মুখোমুখি হলে রক্ষা নেই… এই ভয়ে ছাদে চলে এলো সে। এখানে এসেই দেখা হয়ে গেল নাদিফের বউয়ের সাথে।

ভেবেছিল নিজের সাথে একচোট দ্বন্দ করবে, কতক্ষণ বসে থেকে কাঁদবে, তা আর হলো না। তূর্ণাকে দেখে দুঃখ বুকে পুষে নিয়ে সাফা ফিরে যেতে পা বাড়াল।

পিছন থেকে তূর্ণা বলল, “আপনি ডাক্তার?”

সাফা দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করল, “কেন?”

“জ্বীন-ভূতে বিশ্বাস করেন?”

সাফা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তূর্ণা বলল, “আমি এ বাসায় এরকম কিছু একটা টের পেয়েছি। ঘুম হয়নি তো রাতে। নাদিফকে কতবার বললাম… এখানে জ্বীন-ভূত আছে, ও তো আমার কথা বিশ্বাসই করছে না।”

উত্তর না দিয়ে সাফা চলে যেতে চাইল। তূর্ণা বলল, “সাবধানে থাকবেন। কখন, কী হয়, বলা তো যায় না।”

সাফা ঠাট্টার স্বরে বলল, “আমি ওসবে ভয় পাই না। আপনি সাবধানে থাকবেন। নতুন বউ তো। জ্বীন-ভূত আবার নতুন বউদের উপর আছর করে বেশি।”

তূর্ণা ভয় ও বিস্ময় নিয়ে বলল, “কী বলছেন? তারমানে এখানে সত্যিই জ্বীন-ভূত আছে? এজন্যই আমি রাতে আওয়াজ পেয়েছি। ওমা গো… আমার কী হবে!”

নাদিফ তো তারছেঁড়া নয়, তবে তার বউ এমন হলো কেন? তূর্ণা আরও কিছু বলতে চাইলে, সাফা তড়িঘড়ি বলল, “আপনি থাকুন। আমি যাই। এখন আমার বিশ্রামের সময়। আপনার স্বামীকে বলবেন, ভালো একজন কবিরাজের কাছ থেকে তাবিজ এনে দিতে। ঠিক হয়ে যাবে।”

***

চলবে…

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৭

লিফটের দরজা খোলার সাথে সাথে মুখোমুখি পড়ে গেল নাদিফ ও সাফা। হুট করে বাইরে পা ফেলতে গিয়ে সামনে থাকা পুরুষটিকে দেখে চোখদুটোতে আঁধার নেমে এলো। প্রতিবারের মতো ভদ্রতাস্বরূপ যে ক’টা বাক্য বিনিময় করে, আজ তার সেটুকু টেনে আনতেও কষ্ট হলো। শব্দেরা টর্নেডোর মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে কণ্ঠনালীর ব্যথা বাড়িয়ে তুলল।

মাত্রই বাসা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে নাদিফ। পায়নি। এ শহরে এত সহজে বাসা পাওয়া যায় না। এত ছোটাছুটি করে এই সন্ধ্যায় আটতলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

সাতটা থেকে সাফার চেম্বার শুরু হয়। তবে প্রতিদিন একটা সময় সরকারি হসপিটালেও উপস্থিত থাকতে হয়। আর কোনো কোনোদিন সারাদিনেও বাসায় ফিরতে পারে না সে। এ কারণে দু’জনের খুব একটা দেখা হয় না। কথাও হয় না।

সাফাকে দেখে ভদ্রতাসূচক শব্দে নাদিফ বলল, “হাই…।”

এড়িয়ে গেলে ব্যাপারটা কোনোভাবেই সামনে থাকা ব্যক্তির জন্য সম্মান ও শ্রদ্ধার হবে না। এজন্য না চাইতেও উত্তর দিল সাফা, “হ্যালো, কী অবস্থা আপনার?”

“ভালো। আপনার?”

“চলে যাচ্ছে। আসি?”

ব্যস… এতটুকুই। আলাপ শেষে সাফা চলে যেতে গিয়ে পিছনে ফিরে বলল, “একটা কথা ছিল।”

লিফটে পা রাখতে যাচ্ছিল নাদিফ। সাফার ডাক শোনে থামল। জানতে চাইল, “বলুন।”

“আপনার ওয়াইফ বোধহয় জ্বীন-ভূতে খুব ভয় পান। গতরাতে উনি না কি কিছু একটা টের পেয়েছেন। আমাকে সাবধানে থাকতে বললেন। পারলে একটা তাবিজ এনে দিবেন।”

“তাবিজ? জ্বীন-ভূত? তা-ও এখানে?” চমকে গিয়ে প্রশ্ন করল নাদিফ।

সাফা খানিকটা হেসে বলল, “মা-চাচীদের মুখে শুনেছি, নতুন বউদের উপর জ্বীন-ভূতে ভর করে। হতেও তো পারে না?”

নাদিফ গলা খাঁকারি দিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল, “জি…। কিন্তু একটা প্রশ্ন!”

“কী?”

“ডাক্তাররাও কি জ্বীন-ভূত বিশ্বাস করে? না মানে… আপনার মুখে তাবিজ!”

এইবলে মুখের উপর হাত চেপে হাসি আড়াল করে ফট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল নাদিফ।

সাফা নিজেও হেসে বলল, “কোনোদিন যদি এমন অভিজ্ঞতা হয়, তখন বলব।”

“অকে…।”

আর কথা না বাড়িয়ে হাসিমুখে সাফা প্রস্থান করল আর নাদিফ মেজাজে আগুন নিয়ে নিজের ফ্লাটে এলো।

কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথে ডোর খুলে দিল তূর্ণা। তার দিকে তাকিয়ে ফুরফুরে প্রশ্ন করল, “বাহ… এসে গেছেন! বাসা খুঁজে পেয়েছেন?”

নাদিফ থমথমে মুখে উত্তর দিল, “না, পাইনি। এত তাড়াতাড়ি পাব না।”

এরপর ভেতরে এসে স্যু রেখে বলল, “আপনি তো জানেন, আমাদের সম্পর্কটা কী! বাইরের মানুষের সামনে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা কি ঠিক হলো আপনার?”

তূর্ণা না বুঝে বলল, “কী বাড়াবাড়ি করলাম?”

“সামনের ফ্লাটের ডাক্তার ম্যাডামকে কী বলেছেন?”

“আমি তো কিছু বলিনি।”

“আপনি আমার ওয়াইফ এটা বলেননি?”

তূর্ণা ঠোঁট কামড়ে বলল, “না বলিনি।”

“তাহলে? উনি কি জ্বীন-ভূত আসার খবর আসমান থেকে পেলেন?”

“তা হবে কেন? এ কথা আমি বলেছি ঠিকই তবে আমি আপনার স্ত্রী, এটা বলিনি!”

এরপর নিজেদের মধ্যে হওয়া কথাটুকু স্পষ্ট তুলে ধরল তূর্ণা। তারপর বলল, “আপনি যে বিয়ে করবেন, এটা কি এখানকার সবাই জানত?”

নাদিফ পিছনের কথা মনে করে বলল, “হ্যাঁ… জানার তো কথা। দারোয়ান ও স্বর্ণা ভাবী জানতেন। ওনাদের মুখ থেকে বাকিদের জানা খুব একটা কঠিন না।”

“স্বর্ণা ভাবী কে?”

“সাফার ভাবী।”

“তাহলে উনি বলেছেন হয়তো! আর গতরাতে তো আপনার ডাক্তার ম্যাডাম আমাকে এবং আপনাকে একসাথে দেখেছেন। এভাবে দেখলে যে কেউ ধারণা করবে, আমি আপনার স্ত্রী! আপনি তো আর বাইরের কোনো মেয়েকে ঘরে জায়গা দেয়ার পুরুষ নন।”

শেষের কথায় যে কী পরিমাণ অবজ্ঞা ও ঠাট্টা মিশেছিল, সেটুকু খুব সহজেই বুঝে নিয়ে নাদিফও বলে উঠল, “আপনি কে তাহলে! আপনাকে ঘরে জায়গা দেয়ায় কারণ কী?”

তূর্ণা স্তম্ভিত ও ব্যথিত চোখে তাকিয়ে বলল, “আমি কে এতটুকু আমরা দু’জনে জানলেই হবে। বাকিদের সামনে যদি সত্যিটা তুলে ধরি, ব্যাপারটা মোটেও আমাদের জন্য সম্মানের হবে না।”

সময় যত গড়াচ্ছে, এই সামনে থাকা নারীটিও তার জন্য ভয়ংকর একটা ফাঁদ হয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে, এটা বেশ বুঝতে পারল নাদিফ। জেনে-বুঝে নিজের বিবেক, জবান ও অন্তর কলুষিত করা সম্ভব নয়… তা-ই যত দ্রুত সম্ভব এই কঠিন ফাঁদ থেকে নিজেকে মুক্ত করা জরুরী। ভালোবাসার মতো পবিত্র অনুভূতি তার সর্বনাশের কারণ না হোক! এজন্য কথা না বাড়িয়ে আলগোছে সরে পড়ল সে।

***

ডাইনিং টেবিলে তূর্ণাকে ব্যস্ত হাতে খাবার সাজাতে দেখে খানিকটা অবাক হলো নাদিফ। ভ্রু আপনা-আপনি কুঁচকে গেল। মনে জড়ো হলো প্রশ্ন। হাতে থাকা মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মা কথা বলতে চাইছেন।”

খাবার সাজিয়ে ভেজা হাত ওড়নায় মুছে চট করে ফোন হাতে তুলে নিয়ে সালাম দিয়ে তূর্ণা একদম ভদ্র বউমার মতো বলে উঠল, “আপনি এত চিন্তা করছেন কেন, মা? আপনার ছেলে আছে না? আমি তো একা নই। ঠিক আমার খেয়াল রাখবেন উনি।”

ফোনটা লাউড স্পিকারে ছিল। ওপাশ থেকে উত্তর এলো, “চিন্তা হবে না? কত্ত দূরে! হুট করে ঘর-সংসারের কী বুঝবে তোমরা?”

“ধীরেধীরে শিখে নেব, মা। আপনি এত চিন্তা করবেন না। শেষে অসুস্থ হয়ে যাবেন।”

আচমকাই দুই ননদিনীর চিৎকার-চেঁচামেচি কানে এলো তূর্ণার। ওরা ভিডিয়োকল দিয়ে বসল। সুইচ অন করার পর নাদিরা বলল, “ভাবী তোমাকে খুব মিস করছি। এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে কেন? এক সপ্তাহ পর যেতে। ধুর… ভাইয়াটাও যে কী! শুধু কাজ আর কাজ। নতুন ভাবীর সাথে আমাদের মজার কোনো স্মৃতিই তৈরী করতে দিল না।”

নাদিফ গলা উঁচিয়ে বলল, “এত স্মৃতি দিয়ে কী হবে?”

নাজিফার গলায় উত্তর এলো, “স্মৃতি জমাব না? যখন তোমরা বাচ্চাকাচ্চার বাবা-মা হবে, তখন তাদেরকেও দেখাব আমরা কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি।”

“বেশি কথা বললে একটা চড় দেব। রাখ ফোন। পড়াশোনা নাই তোদের? এক্ষুণি পড়তে বোস দুটো। নাহলে ঈদে নতুন জামা দেব না।”

“ব্ল্যাকমেইল করছ?” ফোলা ফোলা চোখে প্রশ্ন করল নাদিরা।

“হুঁ করছি।”

“তুমি এমন করতেই পারো না।”

“একশোবার পারি। এখন থেকে উল্টাপাল্টা কথা শুনলে এমনই করব। খুব বেশি ফালতু কথা বললে, ঈদে বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেব।”

নাদিরা বলল, “বারেহ… আমাদের কি শখ থাকতে পারে না? ফুপি-টুপি হওয়ার ইচ্ছে জন্মাতে পারে না?”

নাদিফ কড়া শাসনের স্বরে বলল, “লিমিট ক্রস করিস না তোরা। যখন-তখন যা-তা আবদার করা সাজে না। সময় ও পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতে হয়। কাকে, কী বলতে হবে, কখন বলা জরুরী, এইটুকু বোঝ রাখতে হবে। বড়ো হয়ে লাভ কী, যদি বোধবুদ্ধি না জন্মায়?”

নাজিফা ও নাদিরা একসাথে বলল, “স্যরি… আর বলব না।”

“মনে থাকে যেন।”

এইবলে চট করে ফোন রেখে দিল নাদিফ। তূর্ণা প্লেটে খাবার তুলে বলল, “ওদের উপর রাগ দেখিয়ে লাভ আছে? ছোটো মানুষ।”

“ছোটো মানুষ বলে যে সবকিছুতে বাড়াবাড়ি রকমের কথাবার্তা বলতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। আর আমরা বড়োরা সবকিছুকে ভুল ভেবে উড়িয়ে দেব, এমনটা ভাবলেই বা চলবে কেন?”

“ওরা কি এতকিছু ভেবে বলেছে? ভুল তো হতেই পারে।”

“ভুল হতেই পারে, কিন্তু সে-ই ভুলকে প্রশ্রয় দেয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অন্তত ছোটোদের ভুলকে চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়াই বড়োদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশ বলে মনে করি।”

তূর্ণা দমে গেল। কেন যেন নাদিফের সব কথা তার উপর উড়ে এসে পড়ে গেল। খুব গায়ে লাগল আবার চিন্তাও বাড়ল। আসলেই সবাই পারে, সবসময় ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করতে? না কি মাঝেমধ্যে কেউ কেউ ভুলকেও প্রশ্রয় দিয়ে দেয়?

নাদিফ তখনও বলে চলল, “ছোটোরা ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সব বিষয়ে কথা বলা ও মাতব্বরি করা উচিত না। তাছাড়া এমন কোনো বিষয়ে আগ বাড়িয়ে অতি আদিখ্যেতাও দেখানো উচিত না, যা আপাতদৃষ্টিতে ঠিক মনে হলেও আসলে তা ভুল! এ কারণে… ছোটোরা কখন কী করে, কোথায় কী বলে, কার সাথে মিশে, কতটা পথ একাকী চলার সাহস দেখায়, কখন বড়োদের সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে ছুটে আসে, এইটুকু পরিবারের মানুষদেরই বুঝতে হবে, জানতে হবে এবং ছোটোদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দ্বারা বিচার করে ভুল ও সঠিকের পথটা বাতলে দিতে হবে। নতুবা ছোটোরা ভুলপথে যাবে… আর দিনশেষে সেই নামমাত্র গার্ডিয়ানদের হা-হুতাশ করতে হবে!”

কথাগুলো তীরের তীক্ষ্ণ ফলার মতো বিঁধে গেল তূর্ণার মনে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ঠোঁট কামড়ে বিক্ষিপ্ত ও জ্বলন্ত চোখজোড়া নিক্ষেপ করল নাদিফের পানে। বরফ শীতল কণ্ঠে বলল, “আপনি নিজেকে খুব বেশি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ভাবছেন না কি?”

নাদিফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “তা হতে যাবে কেন?”

“তাহলে এত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলছেন কেন? আমি কি আপনার কাছে এত কথার ব্যাখ্যা চেয়েছি?”

সন্দিহান চোখে তূর্ণার মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করল নাদিফ। কোথাও, মেয়েটা তার কথাগুলো নিজের দিকে টেনে নিল না তো? সে নিশ্চিত হতে বলল, “আমি এসব কথা আপনাকে বলতে যাব কেন? আমি তো আমার বোনেদের কথার উপর একটা যুক্তি দিলাম মাত্র। আপনি ব্যাপারটা আপনার দিকে টেনে নিচ্ছেন কেন?”

তূর্ণা ঠাণ্ডা মারা গলায় বলল, “নেব না? আপনার সব কথার মানে তো এটাই দাঁড়ায়, আমার বাবা-মা আমাকে মানুষ করতে পারেননি। আমার ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেননি। ভুল ও সঠিকের পার্থক্য শেখাননি। যার কারণে আজকের এই পরিস্থিতি!”

নাদিফ হালকা হেসে, কিছুটা রহস্যময় গলায় বলল, “পড়ল কথা হাটের মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে! ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল না?”

***

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here