লাস্ট স্টেশন পর্ব-৮+৯

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৮

গত দু’সপ্তাহে এই অ্যাপার্টমেন্টের সবার সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছে তূর্ণা। সাতদিনের কথা বলে দু’দিনের মাথাতে বউ নিয়ে আসাটা দারোয়ানের মুখ থেকে বুলেটের মতো ছড়িয়ে গেল। নাদিফের সাথে যার যার ভালো সম্পর্ক সবাই-ই একবার এসে উঁকি দিল বউ দেখার ছুঁতোয়। কেউ কেউ দু’জনকে দাওয়াত দিতেও ভুলল না। এরপর থেকে সকাল, বিকেল অথবা সন্ধ্যা… এই বাসার ভাবী এসে বলেন, এসো চা খেয়ে যাও। ওই বাসার ভাবী এসে বলেন, পিঠা বানিয়েছি, খেয়ে যাও। এমন করে করে পরিচিত সব ক’জনের বাসাতে চা-নাশতার দাওয়াত খাওয়া কমপ্লিট করে ফেলল।

নাদিফ মনে মনে বাসা খুঁজে চললেও তূর্ণার মধ্যে এই বাসা ছেড়ে দেয়ার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। বাসা খুঁজে পেয়েছে কি না এই প্রশ্নটাও করে না। মাত্র কয়েকটা সপ্তাহে এই অ্যাপার্টমেন্টের মানুষ ও নামহীন সম্পর্কের মধ্যে সে এমনভাবে ঢুকে পড়েছে, যেন এটাই তার সংসার, এটাই তার সব।

তূর্ণার এই বাড়াবাড়ি ও সবার সামনে স্বামী-স্ত্রী সেজে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলাটা ইতিমধ্যে শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। নাদিফ যদি কিছু বলেও তূর্ণা সেটা গায়ে মাখে না। ওইদিন দশ তলার এক ভাবীর ফ্লাটে নাশতা খেতে গিয়ে সবার সামনে বড়ো মুখ করে বলেছে, “জানেন ভাবী, আমার মা তো নাদিফের খুব প্রশংসা করেন। বার বার বলেন, এমন জামাই না কি তিনি ভাগ্য করে পেয়েছেন। মাঝেমধ্যে নিজের ভাগ্য নিয়ে আমার ভীষণ হিংসে হয়!”

লাগামছাড়া এসব কথা নাদিফের কানে ফুটন্ত লাভার মতো মনে হচ্ছিল। সে ঘরে এসে শক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিল, “এসব কী ধরনের কথা? কেন বার বার সবার সামনে আমাকে অপদস্ত করছেন?”

তূর্ণা হাসিমুখে উত্তর দিল, “অপদস্ত করব কেন? আপনার সম্মান বাঁচাচ্ছি। সবাই যদি জানে… আমাদের বিয়েটা কবুল হয়নি, তখন এইভাবে নামহীন সম্পর্কে থাকার অপরাধে জুতাপেটা করবে।”

“করলে করুক। সব দোষ আপনার।”

“আর আপনার না? আপনি কেন আমাকে জায়গা দিয়েছেন? কেন সাপোর্ট করেছেন?”

বিরক্তিকর মেজাজে নাদিফ উত্তর দিয়েছিল, “আমার কথা আমি আগেই বলেছি। আর বলতে পারব না। সম্পর্ক যা-ই হোক, আপনি বাড়াবাড়ি কিছু বলতে যাবেন না।”

এরপর থেকে অবশ্য মেপে মেপে কথা বলছে তূর্ণা। তবে একেবারে দমে যায়নি।

ছুটির দিন ছিল বলে আজও বাসা দেখতে বের হয়েছিল নাদিফ। ফিরে এসে বেল বাজাল অথচ দরজা খুলল না কেউ। ডুপ্লিকেট চাবি সাথে থাকায় নিজেই লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। একদম শান্ত পরিবেশ দেখে… ইতিউতি চোখ ঘুরিয়ে, তূর্ণার রুমের কাছে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল… বেশ আয়েশ করে মুভি দেখছে। ধুমধাম আওয়াজের সাথে ফাইট ও গুলাগুলি শোনা যাচ্ছে। কিছু ডায়লগ তার পরিচিত মনে হওয়াতে কান খাড়া করে রাখল।

কিছু সময় পর নাদিফ আলগোছে দরজায় শব্দ করে বলল, “আপনি না বলেছিলেন, কোনো ধরনের মুভি কিংবা ড্রামা দেখেন না?”

আচমকা নাদিফের কণ্ঠস্বর শোনে ধড়ফড়িয়ে উঠল তূর্ণা। পরনের ওড়না ঠিকঠাক করে, ফোনের সাউন্ড কমিয়ে বলল, “আপনি! কখন এলেন?”

“বেশ কিছুক্ষণ আগে। ভাগ্যিস ডোর খুলে ভেতরে এলাম… নাহলে তো আপনার মিথ্যে মুখোশ সম্পর্কে জানা হত না। আমাকে মিথ্যে বলার কারণ কী?”

হাসিমুখে সামনে এলো তূর্ণা। মাহিরা খানের ছবি দেখিয়ে বলল, “মিথ্যে না বললে আপনার মিথ্যেটা ধরতাম কী করে?”

নাদিফ বিব্রতবোধ করল। অস্থিরচিত্তে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “আমি কী মিথ্যে বলেছি?”

“আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। আর না কোনো ডিভোর্সি মেয়েকে আপনি বিয়ে করতে চান!”

বেকায়দায় পড়ে নাদিফ আর কথা বাড়াতে চাইল না, এড়িয়ে চলে গেল। তূর্ণা মিটিমিটি হাসিতে ঠোঁট ভরিয়ে তুলে বলল, “স্বর্ণা ভাবী আজ দুপুরের দাওয়াত দিয়েছিলেন। যাবেন না?”

“আপনি যান!”

“একা যাব কী করে? উনি তো আপনাকেও যেতে বলেছেন।”

“ভালো লাগছে না।”

“তা বললে কী হয়? উনি তো অপেক্ষা করবেন।”

এইটুকু বলে টেবিলের উপর নজর দিল তূর্ণা। কিছু স্ন্যাকস ও ফলমূল দেখে নিশ্চিত হলো, নাদিফ যাবে। ধরা পড়াতে লুকোচুরি খেলছে। সে ঘড়িতে সময় দেখে গোসল শেষ করে সুন্দর একটা থ্রিপিস পরল। অল্প একটু সাজগোজ করল।

নাদিফ টিভি দেখছে। তার কপালে একগাদা চিন্তার ভাঁজ। পনেরো দিন হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত বিপরীত দিক থেকে কোনো ধরনের প্রশ্ন কেন আসছে না? সেদিনের সেই চুক্তিপত্র কি এখনও তূর্ণার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছায়নি?

তূর্ণা এসে বলল, “এখন টিভি দেখতে বসে গেলেন? ভাবী অপেক্ষা করছে!”

সন্দিহান চোখে তূর্ণার সহজ-সরল মুখটা দেখে, টিভি বন্ধ করে নাদিফ বলল, “আপনার বাবা-মা ফোন করেন তো নিয়মিত?”

“হ্যাঁ…। না করার কী আছে?”

“কোনোকিছু জানতে চান না?”

“কী জানতে চাইবেন?”

তূর্ণা হয়তো এসব ঝামেলা সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখে না। তা-ই কথা না পেঁচিয়ে নাদিফ সোজাসাপটা জানতে চাইল, “এতদিনে তো ডিভোর্স পেপারটা আপনার বাবা-মায়ের হাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আর যদি সেটা একবার পৌঁছে যায়… বুঝতেই পারছেন কী ঝামেলা হবে!”

“হম… চিন্তার বিষয়। আচ্ছা, ওসব পরে দেখব। এখন আসুন তো।”

তূর্ণার এই গা-ছাড়া ভাবটা কেমন ভাবিয়ে তুলল নাদিফকে। অতি সুক্ষ্মভাবে খুঁচিয়ে যেতে লাগল। মেয়েটা তার কথায় পাত্তা দিচ্ছে না, উলটে কী স্বাভাবিকভাবে দিনরাত কাটিয়ে দিচ্ছে, যেন জীবনে তার কোনো প্যারা নেই। অথচ… প্রতিটা রাত তার চিন্তায় চিন্তায় কেটে যায়, কখন যে ঘুর্ণিঝড় আসে, এই ভয়ে!

***

সারারাত রোগী দেখে সকালে ফিরে এসে টানা দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে সাফা। ঘুম ভাঙার পর ডাইনিংয়ে পা রেখে স্বর্ণার তাড়াহুড়ো এবং মাছ-মাংস ও সবজি এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল, “এ কী, তুমি এতকিছু নিয়ে বসেছ কেন? এগুলো একসাথে কে খাবে?”

স্বর্ণা মাংস তুলে সিংকের ট্যাপ ছেড়ে উত্তর দিল, “মেহমান আসবে তো। তা-ই…।”

“মেহমান?”

“হ্যাঁ, নাদিফ আর ওর বউ। দাওয়াত দিয়েছি তো। নতুন বউ নিয়ে ফিরল, অথচ এখনও ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতে পারিনি।”

সাফা ঠোঁট উলটে একটা আপেল ধুয়ে সেটা মুখে পুরে বলল, “খুব ভালো। হেল্প লাগবে?”

“ডেজার্টটা করে দিবি? আমি মাছ-মাংস রান্না করে নেব।”

“অকে…।”

এরপর শুধু ডেজার্টের আইটেম নয়, বিরিয়ানি ও চিকেন রোস্ট সাফা নিজ হাতেই রান্না করল। বাকিটা স্বর্ণাই সামলে নিয়েছে। সব রান্নাবান্না শেষে, গোসল সেরে রুম ছেড়ে বের হতেই ড্রয়িংরুমে সুখী দম্পতিকে দেখে হাই-হ্যালো করে, টেবিল সাজাতে গেল। আর স্বর্ণা একাধারে দু’জনের সাথে বকবক চালিয়ে গেল।

সবকিছু সাজানো হলে স্বর্ণা বলল, “চলো, আগে খেয়ে নেবে। এরপর জমিয়ে গল্প হবে।”

তূর্ণা বলল, “আপনি এত ঝামেলা করতে গেলেন কেন, ভাবী?”

“বারে? নতুন বউ তুমি। একটু তো যত্ন করতেই হত।”

“কী যে বলেন!”

নাদিফের মনে হচ্ছে সে এখানে দর্শক সেজে এসেছে। কারণ আসার পর থেকে দুই রমণীর এত বকবকানি শুরু হয়েছে যে, এসবে তার কান ঝালাপালা। এদিকে স্বর্ণা সুযোগ পেলেই খোঁচা মারছে। একবার তো বলেই ফেলেছে, “শোনো নাদিফ… এখন বিয়ে করেছ। একদম কিপটামি করবে না। বউয়ের পিছনে বেশি বেশি খরচ করবে। মন খুলে খরচ করবে।”

নাদিফ পালটা উত্তর দিয়েছিল, “না ভাবী, মন খুলে খরচ করতে পারব না। আমি মন বেঁধে রেখে খরচ করব।”

এ কথায় দু’জনের সে কী হাসি! দেখলে শুধু শরীর জ্বলবে। সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে এমন একটা প্যাঁচে নাদিফ জড়িয়েছে, যেখান থেকে তার এত সহজে মুক্তি নেই। আসলে, এর থেকে মুক্তির উপায়ই তার জানা নেই। প্রতিদিন ভাবে, উপায় খুঁজে, নানান কথার প্যাঁচ সাজায়, আর দিনশেষে চাপা শ্বাস ছেড়ে আওড়ায়, “এসবের সমাধান কী?”

সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে সম্পূর্ণ ঘর ভরে গেছে। স্বর্ণার হাত ধরে তূর্ণা ডাইনিংয়ে এলো। ঘ্রাণ শুঁকে প্রশংসা করে বলল, “ঘ্রাণেই তো পেট ভরে যাচ্ছে, ভাবী। খাব কী?”

স্বর্ণা হেসে বলল, “সব খেতে হবে আজকে। না খেলে ছাড়াছাড়ি নাই।”

“এত খাবার খেয়ে শেষ করা যাবে না কি?”

“শুরু করলেই শেষ হয়ে যাবে। নাও শুরু করো। নাদিফ, বসে আছো কেন? এসো…।”

অস্বস্তি নিয়ে নাদিফ এগিয়ে এলো ঠিকই কিন্তু পুরো আয়োজন ও স্বর্ণা ভাবীর কষ্টের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। মানুষটা কত আশা নিয়ে দাওয়াত দিয়েছে। যেদিন জানবে এই সম্পর্কটাই মিথ্যে… সেদিন কী রিয়্যাক্ট করবে! রাগ করে সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করে দিবে না তো? এই মানুষটাকে নাদিফের বড়ো বোনের মতোই মনে হয়। মাঝেমধ্যে অফিসের ঝামেলা ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে টুকটাক কথা শেয়ার করত। তখন স্বর্ণাই তাকে সমাধানের পথ বাতলে দিত।

সাফা সালাদের বাটি মাঝখানে রেখে পানির জগ থেকে প্রতিটা গ্লাসে পানি ঢেলে প্লেটের কাছাকাছি রেখে দিল। এরপর তূর্ণাকে বলল, “বসুন ভাবী। আপনার পছন্দের খাবার কী, তা তো জানি না। তবে নিজেদের পছন্দমতো যা কিছু রান্না করেছি, তার সব একটু একটু করে মুখে তুলতে হবে আজকে।”

হাত ধুয়ে চেয়ারে বসে তূর্ণা বলল, “সে দেখা যাবে। এখন আপনারাও আসুন। আমরা একা খাব না কি!”

নাদিফ এবার তূর্ণার কথায় সায় জানিয়ে বলল, “ঠিক তো। ভাবী, আপনিও বসুন প্লিজ।”

এরপর সাফাকে বলল, “দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।”

সাফা অসম্মতি জানিয়ে বলল, “না না, আপনারা খান। আমি পরে খেয়ে নেব।”

পাশাপাশি চেয়ারে দু’জনকে দেখতে যতবেশি কষ্ট হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি জ্বালাযন্ত্রণা হচ্ছে… এই ভেবে যে, পছন্দের মানুষ এই প্রথমই তাদের ঘরে এলো, অথচ তাকে মন ভরে দেখার অধিকার নেই। তার একটু সেবা করার অধিকার নেই। দূরে দাঁড়িয়ে দেখা এবং একজন মেহমান ভেবে… সীমানা বুঝে খেয়াল রাখা ছাড়া, বাড়াবাড়ি কিছু করার সাহসও নেই। না থাকাই স্বাভাবিক। যে অনুভূতি অপ্রকাশ্য, যে অনুভূতির নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই, সে-ই অনুভূতিকে নিয়ে আকাশ-পাতাল অধিকার সাজানো নেহাৎই বোকামি ও বেহায়াপনা।

এক আকাশসম ব্যথা বুকে আগলে নিয়ে সাফা মনে মনে প্রার্থনা করল, “আজকের পর এই মানুষটা আমার সামনে আর না আসুক, মাবুদ। না আসুক।”

বিরিয়ানি এগিয়ে দিয়ে স্বর্ণা বলল, “এটা সাফা রান্না করেছে। ও খুব ভালো বিরিয়ানি রাঁধতে পারে।”

তূর্ণা বলল, “ঘ্রাণ তো এটা থেকেই আসছে। মনে হচ্ছে, খেতে আরও সুস্বাদু হবে। আমার আবার বিরিয়ানি খুব পছন্দ।”

সাফা পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে বেশি করে খান আর বেশি বেশি প্রশংসা করুন। রান্নার প্রশংসা শুনলে, কী যে তৃপ্তি লাগে।”

“সত্যিই তা-ই।”

খুব আগ্রহ নিয়ে চামচে একটু বিরিয়ানি তুলে মুখে পুরতে গিয়ে বার বার নাক টানল তূর্ণা। ঠোঁটমুখে একটা অস্বস্তি ভাব ফুটে উঠল। এতক্ষণ যে ঘ্রাণটা তার নাকে সুস্বাদু খাবারের প্রমাণ দিল, এখন সেটাই তার পেটের সবটুকু নাড়িভুঁড়িকে সুনামির মতো ওলট-পালট করে দিতে লাগল।

স্বর্ণা বলল, “কী হলো? খাও।”

“খাচ্ছি।”

কোনোমতে এক চামচ, দুই চামচ, এরপর তিন চামচ বিরিয়ানি মুখে তোলার পর তূর্ণার অস্বস্তি ও অশান্তি বেড়ে গেল। ভেতরের সব এবার বেরিয়ে আসবে। সে খাবার ফেলে রেখে একছুটে বেসিনের কাছে গেল। চোখেমুখে পানি ঝাপটা দিয়ে কোমরে হাত দিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

তূর্ণার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে তার কাছে ছুটে গেল স্বর্ণা। বলল, “কী হয়েছে তোমার? কষ্ট হচ্ছে? অসুস্থ না কি?”

এটা যে কীসের সমস্যা বুঝতে পেরে তূর্ণা আগত ঝড়তুফানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বলল, “আর বলবেন না। সকাল থেকে প্রেশার নেমে গিয়ে অবস্থা একেবারে শেষ। ভেবেছিলাম, একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না… ঠিক হচ্ছেই না। মাথায় ও ঘাড়েও ব্যথা হচ্ছে। ইশ্‌, আপনাকে কী কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়ে… এখন আবার অসুস্থ হয়ে গেলাম! স্যরি ভাবী।”

আদুরে স্বরে এইটুকু বলে, মাথার দুলুনি থামাতে অনেকক্ষণ দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তূর্ণা।

সাফা কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনার কি লো প্রেশার?”

“জি।” উত্তর দিল তূর্ণা।

“আমি দুটো ডিম সিদ্ধ করে দেব, ঠিক হয়ে যাবে। আপনি একটু বিশ্রাম নিন। তার আগে আমি আপনার প্রেশার চেক করে নিই, কেমন?”

“প্রেশার চেক করতে হবে কেন?”

“চেক না করলে বুঝব কী করে, কতটা নামল?”

“ওহ… আচ্ছা।”

সাফা গেস্টরুমের বিছানায় তূর্ণাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, “একটু বসুন। আমি স্টেথোস্কোপ নিয়ে আসছি।”

তূর্ণার এই অবস্থা দেখে নাদিফকে একগাদা বকে দিল স্বর্ণা। বলল, “কেমন স্বামী তুমি, বউয়ের খেয়াল রাখতে পারো না? ইশ্‌… ওর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে। এত বেখেয়ালি কেন তুমি?”

নাদিফ বোকাবোকা দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “আমি কী করে বুঝব, উনি অসুস্থ! একবারও তো বলেননি। এখানে আসার আগেও তো দেখলাম সব ঠিক আছে।”

“স্ত্রীরা তাদের কষ্টের কথা সবসময় মুখফুটে বলে না, নাদিফ। স্বামীদের সেটা বুঝে নিতে হয়। তোমরা পুরুষেরা না, টিউবলাইট। বুঝো ঠিকই… কিন্তু দেরীতে। আর এত বেখেয়ালি হওয়া যাবে না। যদি দেখেছি ও অসুস্থ আর তুমি খেয়াল রাখছ না, তখন কিন্তু আমি আন্টিকে ফোন করে বিচার দেব। বিয়ে করে বউয়ের দায়িত্ব না নিয়ে, ফাঁকিবাজি করে দিন কাটিয়ে দিবে ভেবেছ। তা হবে না।”

নাদিফ চিন্তিতমনে বসে রইল, খাওয়াদাওয়া সব চাঙ্গে তুলে। স্বর্ণা হুমকির স্বরূপ বলল, “বসে আছো কেন? বউয়ের কাছে যাও। তার কষ্ট হচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করো।”

“আমি?” ভ্যাবাচেকা খেয়ে প্রশ্ন করল নাদিফ।

“না… তুমি যাবে কেন? তোমার বউয়ের কাছে আরেক ব্যাটা যাবে। যাও…। পরে খাবে। বউ রেখে একা একা খাওয়া-দাওয়া আমি মানব না।”

ভদ্র ছেলের মতো নাদিফ এগিয়ে গেল… তবে তার মনের মধ্যে জড়ো হওয়া চিন্তাগুলো এবার আরও গাঢ় হলো। এভাবে ঠিক কতদিন চলবে? কেন তূর্ণা যাচ্ছে না? কেন নতুন বাসা মিলছে না? না… আবার খুঁজতে হবে। খুব ভালো করে খুঁজতে হবে। নয়তো এই অসহ্যকর সম্পর্ক তাকে ধীরেধীরে নিঃশেষ করে দিবে।

***

চলবে…

#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৯

নাদিফ ভেতরে এগোতে এগোতে ভাবছিল, এইমুহূর্তে তূর্ণার পাশে বসবে কী করে আবার দূরেই বা থাকবে কী করে? যেভাবে সম্পর্কটা সবার সামনে খোলাসা না হয়ে উল্টে আরও প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে, এতে করে দিনদিন তাকেও নানাবিধ ঝামেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এখন এই জটিল ও কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে কী করে?

চিন্তিত নাদিফকে বাঁচিয়ে দিল সাফা। সে দ্রুত পায়ে স্টেথোস্কোপ হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল আর নাদিফ… একটু দূরে থাকা ছোট্ট টোল টেনে বিছানা থেকে খানিকটা দূরে বসল।

তূর্ণা আধশোয়া হয়ে বসেছিল। সাফা তার মুখোমুখি বসে হাতের মধ্যে আর্ম কাফ বেঁধে, পাম্পারটা হাতে তুলে নিল। এরপর ছোট্ট গোল অংশ হাতে চেপে প্রথমে প্রেশার মাপতে গেল। একবার… দুইবার… তিনবার দেখার পর তার ভ্রু কুঁচকে গেল। অস্ফুটস্বরে আওড়াল, “প্রেশার তো ঠিকই আছে। নরমাল দেখাচ্ছে। মাথা কখন থেকে ঘুরছে?”

“সকালে একবার মনে হয়েছিল মাথা দুলছে। এখন আবার!”

“আর বমি?”

এবার তূর্ণার চিন্তা বাড়ল। এখন যদি সে এক লাইন বেশি বলে… নিজের বিপদ নিজেই বাড়িয়ে ফেলবে। কিছু সময় চুপ থেকে বলল, “আমার মনে হয় গ্যাস্ট্রিক বেড়েছে। এজন্য এমন হচ্ছে।”

সাফাও সায় জানিয়ে, স্টেথোস্কোপ দিয়ে হার্টবিট চেক করে, চোখ ও জিহ্বা দেখে বলল, “শরীর দুর্বল। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেন না?”

“খাব না কেন? খাচ্ছি তো। মনে হয়, সবাইকে ছেড়ে এসেছি যে, এজন্য মনের সাথে সাথে শরীরও খারাপ হয়ে যেতে চাইছে।”

হেসে ফেলল সাফা। বলল, “জগতের নিয়ম তো এটাই। যত ছাড়াছাড়ি শুধু মেয়েদের জন্যই… ছেলেদের জন্য নয়।”

এরপর নাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব একটা সমস্যা তো দেখা যাচ্ছে না। তবুও যদি শরীর ঠিক নাহয়, কয়েকটা টেস্ট করিয়ে নিবেন। আর একটু খেয়াল রাখবেন।”

নাদিফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বাঁচা গেছে। ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, যদি ধরা পড়ে যায়? সেরকম কিছু হয়নি দেখে রিল্যাক্স মুডে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। এখন থেকে এত বেশি, এত বেশি খেয়াল রাখব যে, মাটিতে পা ফেলতেই দেব না। প্রয়োজনে সারাদিন মাথায় তুলে রাখব।”

মজাচ্ছলে কথাগুলো বললেও ওই সামান্য কথা সাফার মনের আকাশে ঘনকালো মেঘের আগমন ঘটিয়ে দিল। তবে এই হঠাৎ আসা মেঘকে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিল না সে। হাসিমুখে তূর্ণাকে বলল, “ঠিক লাগছে এখন না কি দুর্বল লাগছে?”

তূর্ণা উত্তর দিল, “আগের চেয়ে একটু ভালো।”

“টেবিলে আসতে পারবেন?”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দিলে সাফা রুম ছেড়ে বের হয়ে গেল। নাদিফ বসে রইল অস্বস্তি নিয়ে। অসুস্থ তূর্ণার দিকে একপলক তাকাল। মেয়েটাকে আসলেই দুর্বল লাগছে। ব্যস্ততায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। অথচ আরও আগেই তাকে ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল। এখন তো সে একা নয়… দু’জন। একসাথে দু’দুটো প্রাণের যত্ন নেয়া সম্ভব না কি!

একটুখানি ভাবতে গিয়ে নাদিফ উপলব্ধি করল, সে তূর্ণাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলছে। এটুকু উচিত না কি অনুচিত, সে-ই হিসেবে যেতে মন চাইল না। শুধু বলল, “উঠা যাক?”

তূর্ণা আস্তেধীরে বিছানা ছেড়ে নামল। নতমুখে বলল, “আপনাকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি। জানি এটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু কিছু তো করার নেই। এই অবস্থায় আমি আসলে কী করব, কোথায় যাব, বুঝে উঠতে পারছি না।”

নাদিফ বলল, “এখন এসব কথা থাক।”

ডাইনিং থেকে স্বর্ণার গলা ভেসে এলে কেউ-ই আর বসে থেকে সময় নষ্ট করল না। ধীরপায়ে বেরিয়ে এলো।

দু’জনকে একসাথে দেখে স্বর্ণা বলল, “কী রে ভাই… বউয়ের হাত ধরতেও লজ্জা পাও? অসুস্থ মানুষটার হাত ধরলে কী ক্ষতি? না কি এখানে আমরা আছি বলে লজ্জা পাচ্ছ?”

“সেরকম কিছু না ভাবী।”

“তাহলে? হাত ধরে নিয়ে আসো। আবার মাথা ঘুরে যাবে।”

নাদিফ অসহায় মুখ নিয়ে পাশের জনের দিকে তাকালে, তূর্ণা ঝট করে বলল, “আরেহ ধুর… আমরা কি নিব্বা-নিব্বি না কি? ঘেঁষাঘেঁষি না করলে হাঁটতে পারব না!”

স্বর্ণা কৌতুকের সুরে বলল, “নিব্বা-নিব্বি না হও, স্বামী-স্ত্রী তো। আর স্বামী-স্ত্রী হাত ধরে হাঁটলে ক্ষতি নেই। উলটে লাভ আছে। এই একটা সম্পর্কের এত বেশি সম্মান যে, যখন একে-অন্যের পাশাপাশি, কাছাকাছি থাকবে তখন রবের সন্তুষ্টির সাথে সংসারে রহমত নেমে আসবে।”

এত কথার বান সহ্য করতে না পেরে নাদিফ খুকখুক শব্দে কেশে উঠল। স্বর্ণা ভাবী তাকে আজ ইচ্ছেমতো পঁচানোর চিন্তা মাথায় নিয়েই দাওয়াত দিয়েছেন। এজন্যই সুযোগ বুঝে… একেকবার একেক কথা বলে তাকে লজ্জায় ফেলছেন। অথচ তিনি জানেনও না, তারা ঠিক কতটা অন্যায় করছে! আর এর ফল কী হতে পারে! উফফ…

রিস্ক এড়াতে অল্প একটু খেয়ে দাওয়াত রক্ষা করে সন্ধ্যের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে নাদিফকে নিয়ে চলে এসেছে তূর্ণা। যদিও এখানে একটু কাজের অজুহাত দেখাতে হয়েছে… নয়তো স্বর্ণা ভাবী আবার রাগ করত।

***

রাতে চেম্বারে যাওয়াত আগে একবার ভদ্রতা রক্ষার্থে তূর্ণাকে দেখে যাওয়াটা দায়িত্ব মনে করল সাফা। তা-ই মনের সব অস্থিরতা ও না পাওয়া অনুভূতিদের সামলে নিয়ে নিজেদের ফ্লাট থেকে নাদিফের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দু’বার বেল বাজানোর পর ডোর খুলে দিল নাদিফ।

সাফা অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে দ্রুত বলল, “ভাবীর শরীর এখন কেমন?”

উত্তর দেয়ার আগে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো তূর্ণা। নাদিফ অফিসের কাজ করছিল, এই ফাঁকে সে রাতের রান্নাটা শেষ করে নিচ্ছিল। সাফাকে দেখে বলল, “দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।”

সাফা এগোলো ঠিকই… কিন্তু ভেতরে এক ধরনের দমবন্ধ করা অনুভূতি তাকে সম্পূর্ণ গিলে খেতে লাগল।

তূর্ণা বলল, “বসুন না আপু।”

“না, অসুবিধা নেই। আপনি ঠিক আছেন কি না এটুকু জানতে এসেছিলাম।”

“আমি ঠিক আছি।”

“তাহলে আমি যাই। রোগী আছে।”

“যা-ই বলতে তো হবে না, একটু বসুন। এক কাপ চা দিই।”

“না না, আমি কিছু খাব না।”

“খায় না, পান করে। আসুন তো।”

সাফার অসম্মতিকে কানে জায়গা দিল না তূর্ণা। হাত ধরে থাকে সোফায় বসিয়ে বলল, “এক কাপ চা-ই তো… বেশি সময় লাগবে না।”

সাফা ড্রয়িংরুমে বসলে, নাদিফও অপজিটের সোফায় বসে নিজের কাজে মনোযোগ দিল। এরমধ্যে কোনো কথা হলো না কারও। কেউ-ই আগ্রহ দেখাল না।

তূর্ণা ফিরে এলো খুব দ্রুত। হাতে গরম গরম চা ও বিস্কুট। ট্রে’টা সাফার সামনে রেখে চা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “সারাদিন একা বাসায় এত বিরক্ত হই। আপনি কিন্তু সময় পেলে আসবেন। আমরা ছুটিয়ে গল্প করব।”

সাফা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি তো ফ্রি’ই হতে পারি না। সারাদিনই দৌড়ের উপর থাকি।”

“ফ্রি বসে থাকি শুধু আমিই। কোনো কাজকাম নাই।”

“বসে থাকতে ভালো না লাগলে কিছু একটা করতে পারেন।”

“সেটাই ভাবছি, কিন্তু এত সহজে হবে বলে মনে হয় না। এ শহরে নতুন তো…।”

“তাতে কী? আপনার হাজব্যান্ড তো আছেন। উনার কত জানাশোনা। ঠিকই একটা চাকরি আপনাকে ম্যানেজ করে দিতে পারবেন।”

এই শব্দটা বোধহয় এত সহজে নাদিফের পিছু ছাড়বে না। সে চোখ তুলে একবার সাফার দিকে তাকাল এরপর আবার কাজে মনোযোগ দিল।

তূর্ণা বলল, “উনিও চেষ্টা করছেন।”

হঠাৎই মশলা পুড়ে যাওয়ার গন্ধ নাকে এলো। তূর্ণা লাফ দিয়ে বলল, “এইরে… পুড়ে যাচ্ছে। আপনি বসুন, আমি এখুনি আসছি।”

তড়িঘড়ি রান্নাঘরে ছুটে গেল তূর্ণা। তরকারি ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে-ই সময়ই হলো লোডশেডিং আর ভয়ানক একটা চিৎকার দিয়ে, ‘ভূত’ বলে কাঁপতে কাঁপতে পুনরায় ড্রয়িংরুমে ছুটে এলো সে।

নাদিফ ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে বলল, “ভূত আসবে কোথা থেকে?”

এইটুকু বলতে দেরী… অথচ নাদিফের বুকে ঝাঁপ দিতে দেরী হলো না তূর্ণার। সে সবকিছু ভুলে গিয়ে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে বলল, “ওখানে কিছু একটা আছে। আমি কারও কান্নার আওয়াজ পেয়েছি।”

ততক্ষণে আইপিএস এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টে আলো জ্বলে উঠেছে। তবে তা তূর্ণার খেয়ালে এলো না। সে কাঁপা-কাঁপি চালিয়েই গেল।

নাদিফ পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল, “কিছু হয়নি। দেখি সরুন… আমাকে দেখতে দিন।”

তূর্ণা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “আমি সত্যি বলছি, ওখানে কিছু তো আছেই। নয়তো আমি কেন এখনও আওয়াজ শুনছি?”

“এখনও শুনছেন?”

কান খাড়া করে রাখল তূর্ণা। পরক্ষণেই টি’শার্ট খামচে ধরে আরেকটু জোর দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ, শুনছি তো।”

দু’জনের মাঝখানে সাফা খুব বিব্রতবোধ করল। ভ্যানিটিব্যাগ হাতে তুলে বলল, “ভাবী আমি যাচ্ছি। ডোর আটকে দিন।”

সাফা চলে গেলে নাদিফ হাতের ধাক্কায় তূর্ণাকে দূরে সরিয়ে বলল, “আর ইউ ক্রেইজি? কী করছিলেন এটা?”

তূর্ণা পরনের জামা খামচে ধরে বলল, “আমি কী করব? ভয় পেয়ে গেছি তো।”

“ভয়? এখানে? সব আপনার মনের ভুল তূর্ণা।”

“আপনি কোনো আওয়াজ শুনতে পাননি?”

নাদিফ বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনাকে আগেও বলেছি, আমি এখানে দীর্ঘবছর ধরে আছি। কখনও এরকম পরিস্থিতিতে পড়িনি। এখানে এমনকিছু নেই।”

“তাহলে আমি পাচ্ছি কেন?”

ভাবনারত তূর্ণাকে রেখে দরজা আটকে ফিরে এলো নাদিফ। চারিদিকে তাকিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে, জানালার পাল্লা মেলে দিয়ে ভালোমতো খুঁজে কোনোকিছু না পেয়ে বলল, “কোথায় আওয়াজ?”

এইটুকু সময়ের মধ্যে আবার কারেন্টও চলে এলো। তূর্ণা মাথায় হাত চেপে সোফায় বসে চিন্তিতমনে বলল, “কিছু যদি না-ই থাকে, আমি কেন শুনছি?”

নাদিফ বলল, “আমার মনে হচ্ছে আপনার একজন সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নেয়া উচিত। রেগুলার কাউন্সিলিংয়ে থাকলে সুস্থ হয়ে যাবেন।”

মুহূর্তের মধ্যে রেগে গেল তূর্ণা। বলল, “আপনি আমাকে পাগল বললেন?”

“এখানে পাগলের দেখলেন কী? মানুষ কি মেন্টালি ডিপ্রেসড হতে পারে না? যা হয়েছে আপনার সাথে, তাতে আপনার স্ট্রং থাকা তো এতটাও ইজি নয়!”

“তাইবলে আমি পাগল হয়ে যাইনি। এই বাসায় সমস্যা আছে। আলবাত আছে।”

এতটুকু বলে রান্নাঘরে গেল তূর্ণা। তরকারি চেক করে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “আপনি বলছেন, আপনি এসব শুনেননি?”

নাদিফ স্পষ্ট উত্তর দিল, “না…।”

“শুধু আমি শুনছি। তা-ও…!”

কিছু সময়ের জন্য থেমে গিয়ে তূর্ণা বলল, “আমার মনে হচ্ছে… এই সাফার মাঝে কিছু একটা সমস্যা আছে। যতবার ওকে দেখি, ততবারই আমি ওইসব আওয়াজ শুনতে পাই। কোথাও ওর সাথে খারাপ জ্বীন জড়িয়ে নেই তো!”

নাদিফ মাথার চুল টেনে সোফায় বসে বলল, “প্লিজ… স্টপ। নিজের অসুস্থতার দায় অন্যের উপর চাপাবেন না।”

“আমি দায় চাপালাম কোথায়? যা সত্য তা-ই বললাম। এবং আমার এটাই মনে হচ্ছে।”

নাদিফ শক্ত চোখে বলল, “অন্যের দোষ না ধরে নিজের দোষ দেখুন। জ্বীন-ভূত যদি আসেই… সেটা আপনার দোষে এসেছে। আর শুনুন, কাল ডাক্তারের কাছে যাব।”

“বিশ্বাস করলেন না আপনি?”

“আর একটা ফালতু লজিক দেখালে খুব খারাপ হবে। একটা মানুষ যদি আপনার এসব কথা শোনে, কতটা কষ্ট পাবে, ভাবতে পারছেন?”

তূর্ণা চুপ করে রইল। নাদিফ বলল, “ভাববেন কী করে? আপনি তো নিজেরটা ছাড়া অন্যের ভালো দেখতে পারেন না।”

ঠোঁটমুখ ফুলিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল তূর্ণা। নাদিফ পড়ল চিন্তায়। আসলেই কি এমনকিছু হচ্ছে? না কি সবটাই তূর্ণার অবচেতন মনের ভুল?

***

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here