শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট : ৪০
ইদানীং গা গুলানো টা খুব বেড়ে যাচ্ছে । মাথাটাও ভনভন করে ঘুরে । সেদিন নিশিতের কথায় তেমন গুরুত্ব না দিলেও । এখন আমার নিজের থেকেই সন্দেহ হচ্ছে । সত্যি প্রেগন্যান্ট কি ?
অগ্নি কে কিছু জানাই নি ।নিজের থেকে যতক্ষণ নিশ্চিত না হবো কাউকে জানাবো না । আজ অগ্নি সকাল সকাল বেরিয়েছে । রাতেই জানিয়েছে আজ তার মিটিং আছে । অগ্নি অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার পর পর ই সুযোগ বুঝে আমি হসপিটালে জন্য রওনা দেই
। ডক্টর আন্টি মামীর ক্লাসমেট । খুব ভালো সম্পর্ক মামীর সাথে ।আন্টি চেকআপ করে কিছু টেস্ট করতে বলেন ।দেড় ঘন্টার মাঝে ঘন্টার মাঝে সব টেস্ট বাড়ির জন্য রওনা হই । বাড়িতে পৌছিয়ে দুপুরের লাঞ্চ রেডি করতে হবে । তারপর বিকেলে আবার আপুর সাথে দেখা করতে মামা বাড়িতে যেতে হবে । আমি রিকশা তে বসে বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি । অলরেডি এগারো টা বাজে । কখন বাসায় যাবো আর কখন লাঞ্চ রেডি করবো ?
উফফ তার উপর এই ঢাকা শহরের জ্যাম ! আমি বিরক্তি নিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছি । হঠাৎ ই আমার চোখ আটকায় এক গাড়িতে । গাড়িটা আর কারো না অগ্নির । রিকশার হুডিটা উঠিয়ে মাথায় ভালো করে ঘুমটা টেনে নিলাম । অগ্নি দেখলে এখনি ঝামেলা শুরু করবে । এমনিতেই না বলে বেরিয়েছি । তার উপর আবার একা সাথে গাড়ি নেই । নিশ্চিত রেগে যাবে । যা মাথা গরম লোক । জ্যাম কিছুটা ছাড়তেই গাড়ি সামনের দিকে আসে । এরপর আমি যা দেখলাম তা দেখার জন্য মটেও প্রস্তুত ছিলাম না । আমার মাথায় যেন আসমান ভেঙে পরে ।চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে । অগ্নির পাশের সিটে সুপ্তি বসে । সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে । আমি রিকশা থেকে নেমে অগ্নির গাড়ির দিকে পা বাড়াই । এমন সময়ই জ্যাম ছেড়ে দেয় । গাড়ি চলে যায় । আমি রাস্তায় স্থব্দ হয়ে দাড়িয়ে থাকি । চোখ থেকে এখনো পানি পরছে ।আমি যেন এই দুনিয়াতে নেই । অন্যকোন দুনিয়ায় আছি । আশেপাশের কোনো কিছুই আমার কানে আসছে না । থম মেরে সেখানেই দাড়িয়ে আছি । হ্ঠাৎ কেউ আমাকে টান দিয়ে রাস্তার একপাশে নিয়ে যায় । এক মধ্যবয়সী মহিলা । তিনি ধমকের স্বরে বললেন ,
– “এই মেয়ে কি করছিলে! এখনি তো গাড়ির নিচে পড়তে । দেখে তো ভালো ঘরের মেয়ে মনে হচ্ছে । এভাবে রাস্তায় দাড়িয়ে ছিলে কেন ? ”
আমি তখনো ভাসা চোখে তাকিয়ে আছি মহিলাটির দিকে । কোনো কিছু আমার মাথায় ডুকছে না । আমি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছি । মহিলা আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন ,
– “এই মেয়ে শুনছো ? ”
ঝাঁকুনি তে আমার হুস ফিরে । চোখ মুখ মুছে বড়বড় শ্বাস নিচ্ছি । নিচের থেকে ব্যাগ হাতে তুলে তাড়াতাড়ি রিকশায় চড়ে বাড়িতে চলে আসি ।
বাড়িতে এসে এখনো আমার মাথা ঘুরছে । ওয়াশরুমে ডুকে বমি করি । ভিতর থেকে কেমন জানো অস্থির লাগছে । কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।। আমি শাওয়ার ছেড়ে এর নিচে বসে পড়ি । অস্থিরতা কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি ।কিন্তু কোনো ভাবেই তা কমছে না ।বার বার অগ্নির সাথে সুপ্তি সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠে । আর অস্থিরতা বাড়তে থাকে । কোন প্রকার চেষ্টা চালিয়ে নিজের মনে অস্থিরতা কমাতে পারছিনা বার বার চোখ ভরে আসছে । হৃদপিন্ডটা চাপ ধরে আছে । মনের আগুন কি বাহিরের এই ঠান্ডা পানিতে নেভে ?
দুপুরের লাঞ্চ তৈরি করছি । কোনো কাজে মন বসাতে পারছিনা । বার বার সেই দৃশ্য চোখে ভাসছে ।চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । আমি কোনো রকম ঠোঁট চেপে নিজের কান্না আটকাচ্ছি । অগ্নির সাথে সুপ্তিকে দেখে আমার মনে ভয় চেপে বসেছে । প্রচুর ভয় । বার বার মনে হচ্ছে সুপ্তি আমার কাছ থেকে আমার অগ্নিকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে । ভিতরে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে । যদি আমি অগ্নিকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলি ? কেন সুপ্তি ফিরে এসেছে ? কি চাই তার ? মনে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু কোনো উত্তর নেই । আমি অন্যমনস্ক হয়েই চুলার দিকে হাত বাড়াই । এমন সময়ই গরম কড়াই লেগে হাত পুড়ে যায় ।চম্পা আমার চিৎকারে কিচেনে আসে ।ঠান্ডা পানিতে হাত ভিজায় । কিন্তু তাতে তেমন কোনো কাজ হয় না । তার আগেই হাতে ফুষ্কা পড়ে গেছে । প্রচন্ড হাত জ্বালা পোড়া করছে । কিন্তু এরচেয়ে বেশি জ্বলছে মনে । রাগ জেদ আর অনেক বেশি অভিমান বুকে জমে আছে । বাকি রান্না চম্পা শেষ করে । চম্পা অগ্নিকে ফোন করে জানাতে চাইলো । আমি না করে দেই । বিকেল দিকে অগ্নি বাড়ি ফিরে । আমি তখন বারান্ধায় বসে আকাশের পানে তাকিয়ে বিকেলের শেষ প্রহরের বিদায় দেখছি । দুপুরের লাঞ্চ ও করিনি ।কেমন জানো গা গুলিয়ে আসছে । শরীরটাও কেমন জানো মচমচ করছে । গাঁয়ের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক । জ্বর- ট্বর আসবে কি ?
আসুক তাতে কি যেখানে মনের অসুস্থতায় তিল তিল শেষ হচ্ছি । সেখানে শরীরের অসুস্থতায় আর তেমন কি হবে !
অগ্নি ড্রেস চেঞ্জ না করেই সরাসরি আমার কাছে আসে । আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে অস্থির চঞ্চল চোখে আমার হাত দেখছে । ঝলসানো ডান হাতটি দেখে অস্থির গলায় প্রশ্ন করে ,
– ” এতো খানি হাত পোড়লো কি করে ? আর আমাকে ফোন করে কিছু জানাও নি কেন ? ”
অগ্নির চেয়ারায় অস্থিরতা কষ্ট ভেসে আছে ।যেন ব্যথা আমি না অগ্নি পেয়েছে । আমি ঝাপসা চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে আছি । কেন এই কষ্ট ? আমার জন্য ? যদি তাই হয় তাহলে সুপ্তির সাথে কেন ছিলো । অগ্নি আবার ধমকের স্বরে বললেন ,
– “কি হলো ? বলো কি করে হয়েছে ? ”
– “অন্যমনস্ক হয়ে হাতে লেগে গেছে ”
– “আমাকে ফোন করে কেন জানাও নি ? ”
– “আজ কাল আপনি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত । তাই আর আপনাকে ডিস্টার্ব করিনি । ”
– “তোমার থেকে কোনো কিছু বেশি ইম্পরট্যান্ট না ”
তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে বলি ,
– “সত্যি কি তাই ? ”
– “অবশ্যই ! ”
– “যাক ,জেনে ভালো লাগলো । ”
– “হুর এমন ভাবে কথা বলছো কেন ? কিছু কি হয়েছে ? ”
– “কি হবে? কিছু কি হওয়ার আছে । ”
অগ্নি আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে ছোট এক নিশ্বাস নেয় । তার পর বললো ,
– “লাঞ্চ করেছো ? ”
– “না ”
– “কেন করোনি! চল আমার সাথে লাঞ্চ করবে । ”
আমার বাম হাত ধরতেই আমি অগ্নির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেই । অগ্নি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে । আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বলি ,
– “আমি খাবো না । আমার খিদে নেই । ”
অগ্নি আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কোলে তুলে নেয় । বাড়িতে চম্পা ছাড়া কেউ নেই । চম্পা নিজের রুমে । অগ্নি আমার করে নিয়েই ডাইনিং রুমে আসে । নিজের কোলে নিয়েই চেয়ারে বসে । আমি অগ্নি থেকে ছাড়া পাবার চেষ্টা চালাচ্ছি কিন্তু অগ্নি শক্ত করে আমার কমোড় জড়িয়ে ধরে আছে । অন্যহাতে খাবার সার্ভ করে । সামনে নেয় আমি অগ্নির সাথে না পেরে একসময় থেমে যাই । পুরুষ মানুষের শক্তির সামনে পারা যায় না । আমি প্রচন্ড বিরক্তি দিয়ে অগ্নির দিকে তাকিয়ে আছি । এসব আহ্লাদী আমার খুব বিরক্ত লাগছে । উনি এই আহ্লাদী করছে কেন ? আমার গাঁ জ্বলছে ।
তার উপর খাবারের গন্ধে শরীর শিরশির করছে । ভিতরে পাক বেঁধে সব গুলিয়ে আসছে ।
অগ্নি আমার মুখের সামনে খাবার ধরতেই আমি ঝারি দিয়ে খাবার প্লেট ফেলে দেই ।অগ্নি আমার দিকে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে । আমি সেই সুযোগে অগ্নির কোল থেকে উঠে পরি । রেগে বলি ,
– “কি সমস্যা আপনার ? আমি বলছি তো আমার খুদা নেই । তারপর ও বার বার এই আহ্লাদীপানা কেন করছেন ? ”
অগ্নি চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার পাশে এসে দাড়ায় । স্ফটলি বলে,
– “হুর কি হয়েছে এমন বিহেভ করছো কেন ? কিছু কি হয়েছে ? আমাকে বলো ! ”
– “কি হতে বলছেন? বলছিতো আমি ঠিক আছি । কেন আমাকে সবকিছু তে জোর করছেন ? কি চান ? দুনিয়া আপনার মন মত চলুক! সবাই আপনার হাতের পুতুল হয়ে থাকুক ? ”
বলেই বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি । অগ্নি শান্ত স্বরে বলে,
– “ওকে রিলেক্স ! গাঁ টা দেখলাম হাল্কা গরম । অসুস্থ? খুব খারাপ লাগছে কি ? ”
আমি উনার কোনো প্রশ্নের জবাব দিলাম না । দ্রুত পায়ে উপরে রুমে চলে আসলাম । রুমে এসেই বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ চেপে কিছুক্ষণ কান্না করলাম । জানি অগ্নি কষ্ট পেয়েছে । আমি অগ্নিকে কষ্ট দিতে চাইনি । কিন্তু ভিতরের রাগ ক্ষবে হুট করে এসব বলে দিয়েছি । পারছিলাম না নিজের কষ্ট চেপে রাখতে রাগের মাথায় বলে ফেলেছি ।
মিনিট পাঁচেজ পর অগ্নি আসে । আমার পাশে শুয়ে পরে আমি ইচ্ছে করে চোখ চেপে বন্ধ করে আছি । আমি চোখ বন্ধ রেখে ও বলতে পারছি অগ্নি আমার দিকে তাকিয়ে আছে । তাও খুব গভীর ভাবে !
শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট : ৪১
পাশ ফিরে শুয়ে আছি । চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে । ফুপিয়ে কান্না করছি । অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে আমি চাইনি অগ্নির সাথে ঐ রকম ব্যবহার করতে । কিন্তু কি করবো ? আমি যে হেল্পলেস ছিলাম ।নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না । আমি না পারছি সহ্য করতে ,না পারছি অগ্নিকে জিগ্যেস করতে !
কি জিগ্যেস করবো ? আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই । যদি অগ্নি চোখের ভুল বলে কাটিয়ে দেয় ?
অগ্নি আমার কাছে ঘেষে শুয়ে পরে । আমার চুল গুলো বিলি কেটে দিচ্ছে । আমি কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করছি না আগের মতই চোখ বুঝে শুয়ে আছি । কোনো সাড়াশব্দ করছি না । অগ্নির ঘনঘন নিশ্বাস আমার মুখের উপর পড়ছে । আমি তখনো চোখ বুঝে । কিছুক্ষণ পর অগ্নি পিছন থেকে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে । আমার খোলা চুলে মুখ ডুবায় । অগ্নির গরম নিশ্বাস গুলো এবার আমার ডান ঘাঁড়ে পড়ছে । অগ্নি নাক টানছে ,তবে অগ্নি কাঁদছে ? আমি চোখ খুলে পেছনে ফিরার চেষ্টা করি । কিন্তু তা পারি না । কারণ অগ্নি খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে । অগ্নি পিছন থেকে ভাঙা গলায় বলে ,
– “জানি না তোমার কি হয়েছে ! তুমি যদি না বলতে চাও ঠিক আছে ,আমিও জিগ্যেস করে তোমাকে কষ্ট দিবো না । কিন্তু প্লিজ আমার সাথে একটু কথা বলো । তোমার রাগ জেদ অভিমান সবকিছু আমি সহ্য করতে পারবো । আমাকে যে শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে মেনে নিবো ।
শুধু আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করো না ! অনেক ভালোবাসি । অনেক বেশি ভালোবাসি ।আমার দুনিয়াটা শুধুই তোমাকে ঘিরে । তুমিই যদি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেও আমি কি করে থাকবো ? বলো ? ”
অগ্নি থামলেন । আমিও চুপ । অগ্নি আবার বলতে শুরু করলেন ,
– “হুর ! প্লিজ এভাবে আমাকে এড়িয়ে চলো না । আমার কষ্ট হয় তো । তোমার ইগ্নোর আমাকে ক্ষণে ক্ষণে আমাকে দগ্ধ করে । আমি নিজের মধ্যে থাকি না । আমার পুরো দুনিয়া অগোছালো হয়ে যায় । ”
ভালোবাসার মানুষ যত বড় অপরাধই করুক না কেন । সেই মানুষটার কান্না ভেজা কন্ঠ শুনলে যে কেউ দুর্বল হয়ে পড়বে । শক্ত হিম শীতল হৃদয়টাও মোমের মত গলতে শুরু করে । অগ্নির কথা গুলো আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো । আমার সাথেও তাই হচ্ছিলো কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথা ব্লাংক হয়ে যায় । আমি অন্যকোন কিছু ভাবতে পারছিলাম না ।ততক্ষনে অগ্নির হাতের বাঁধন হাল্কা হয়ে গিয়েছে । হুট করে পিছনে ফিরে অগ্নির বুকে মাথা রেখে জোরে শব্দ করে কান্না করতে লাগি । ভিতরের সব কষ্ট গুলো চোখে পানির সাথে বেরিয়ে আসছিলো । অগ্নি আমার কান্না দেখে কিছুক্ষন থম মেরে ছিলো । নিজেকে সামলিয়ে আমার মাথায় হাত রাখে । আমাকে শান্ত করা চেষ্টা করে ।
রাতে অগ্নি নিজ হাতে আমাকে খায়িয়ে দিলেন । আমি যতক্ষণ অগ্নির সাথে ছিলাম এক ঘোরে ছিলাম । অগ্নি খুব যত্ন করে আমার হাতে ঔষধ লাগিয়ে দিলেন ।আমি পুরোটা সময় অগ্নির দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর ভেবে যাচ্ছিলাম , এই মানুষটা কি আমাকে ধোকা দিতে পারে ? এই নিষ্পাপ চোখ জোড়া কি আমার সাথে বেঈমানি করে অন্য কারো দিকে তাকাতে পারে ?
আদৌ কি তা সম্ভব ?
পরের দিন সকালে অগ্নি কোনো এক কাজের জন্য ঢাকার বাহিরে চিটাগাং যাচ্ছে । কিন্তু আমি যতটুকু জানি চিটাগাং এ এখন কোনো অফিসিয়াল কাজ নেই !
তাহলে অগ্নি কেন যাচ্ছে ? বরাবর ই আমার মাথায় নানা রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে । অগ্নি কেন আমার সাথে এমন লুকোচুরি খেলছে ? কি করছে ? আর কি করতে চাইছে ?
সকালের আলো ফুটেছে অনেকক্ষন । অগ্নি একটু পরই বাড়ি থেকে বের হবে । আমি নাস্তা রেডি করতে কিচেনের দিকে পা বাড়ালে অগ্নি কড়া নির্দেশে মানা করে দেয় । কড়া করে নিষেধাজ্ঞা দেয় । সারাদিন বিছানায় রেস্ট নিতে বলে । আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে অগ্নির দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছি । অগ্নির প্রত্যেকটা কাজ খুব মন দিয়ে দেখছি । অগ্নি হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে আমার সামনে এসে বসে । আমি কিছুটা নড়েচড়ে বসি । আমার চোখে একরাশ অভিযোগ । অগ্নি আমার গালে আদুরে হাত ছুঁয়িয়ে বললেন ,
– “আমার যাওয়াটা খুব ইম্পরট্যান্ট । যদি জরুরী কাজ না হতো আমি কখনোই যেতাম না ।রাগ করোনা লক্ষিটি । আমি কাল রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো ।ফিরে এসে তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে ।অনেক কিছু তোমার অজানা তা জানানোর আছে । দোয়া করো আমি যেই কাজের উদ্দেশ্য যাচ্ছি তা যেন সঠিক ভাবে হয় । ”
অগ্নির কথা গুলো আমার মাথায় ডুকছে না । অগ্নি ঠিক কি ব্যাপারে বলছে ? কি জানানোর আছে তার ! আমি শুধু অগ্নির দিকে ড্যাবড্যাব চোখ করে তাকিয়ে আছি । অগ্নি আমার কাছে এসে আমার কপালে খুব দাবিয়ে চুমু খেয়ে কিছুক্ষণ নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে । আমি তখনো ভাবলেশহীন ভাবে আছি । অগ্নি আমার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন ,
– “একদম হেলামি করবে না । কেমন ? নিজের খেয়াল রাখবে । টাইমমত খাবার খাবে আর মেডিসিন নিবে । আমি চম্পা কে বলে যাচ্ছি ।আর কোনো প্রব্লেম হলে অবশ্যই আমাকে জানাবে ।
আমি এখন আসি ! ”
আমি আগের ভঙ্গি তে বসে ধীর আওয়াজে বলি,
– “আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন ।পৌছিয়ে জানাবেন । ”
– “ঠিক আছে । ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাচ্ছে ,আমি এখন আসি । ”
অগ্নি আমার কপালে নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করে ।বিছানা ছাড়ে উঠে । আমি অগ্নির চলে যাচ্ছে । আমি অগ্নির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি । কেমন জানো বুকটা চিনচিনিয়ে ব্যথা করে উঠছে । মনে হচ্ছে এই দেখাই শেষ দেখা । অগ্নি দরজার সামনে যেয়ে আমার দিকে একবার ফিরে তাকায় । আমি ঝাপসা চোখে অগ্নিকে বিদায় দিচ্ছি । অগ্নি মলিন হেসে চলে যায় । আমি ঠায় অগ্নির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি !
দুপুরের পর ডক্টর দেখিয়ে বনানীর ফ্লাটে যাচ্ছি । হাতে প্রেগন্যান্সির পজিটিভ রিপোর্ট । বনানীতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো সুপ্তির সাথে দেখা করা । অগ্নি সুপ্তিকে সেই ফ্লাটে রেখেছে।কেয়ার টেকার থেকে ফোন করে সব জানতে পেরেছি ।
রাগে জিদে আমার শরীর কাঁপছে । শেফা সাথে আছে । শেফা আমাকে বার বার শান্ত করার চেষ্টা করছে । আমি কোনো ভাবেই নিজের রাগ ঠান্ডা করতে পারছি না । অগ্নি আমার সাথে কি করে এমন করতে পারে ? অগ্নি সুপ্তি কে নিজের ফ্লাটে উঠিয়েছে ? কেন সুপ্তির সাথে অগ্নির কিসের সম্পর্ক ? কিসের এতো সহঅনুভূতি ?
সুপ্তি তো অগ্নির প্রাক্তন । অগ্নিকে বিয়ের সাপ্তাখানিক আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছে । তার প্রতি এতো দয়া কেন ? যদি সুপ্তির প্রতি এতোই ভালোবাসা তাহলে আমাকে কেন নিজের জীবনের সাথে জড়িয়েছে ?
কিছুক্ষণের ভিতর বনানীতে চলে আসি । শেফা ভাড়া মিটাচ্ছে । আমি সোজা ফ্লাটের সামনে চলে যাই । কয়েকবার ডোর বেল চাপি কোনো সাড়াশব্দ নেই । আমার হাত পা রাগে কিটকিটা হয়ে আছে । শেষের বার বেল বাজাতেই সুপ্তি এসে দরজা খুলে । সুপ্তি দরজা খুলতেই আমি সজোরে কয়েকটা থাপ্পড় মারি । সুপ্তি ছিটকে যেয়ে সোফার উপর পরে । আমি আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেছি ।এই মুহূর্তে কোনো কিছুই আমার চোখে পড়ছে না । আমি সুপ্তির কাছে যেয়ে ওর গাল চেপে ধরে কান্না করতে করতে বলি ,
– “কেন ফিরে এসেছিস ? আমার সংসার ভাঙতে ? কেন আমার সাজানো সংসারে আগুন লাগাতে এসেছি ? কি চাই তোর টাকা ? সম্পদ ? বাড়ি? গাড়ি? তোর যা চাই তুই নিয়ে নে । কিন্তু আল্লাহ্ র দোহাই লাগে আমার স্বামী কে ছেড়ে দে । আমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ডুকিস না । ”
আমি রাগে জিদে কান্না করছি আর বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছি । এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে হেল্পলেস মানুষ আমি ।নিজের সংসার বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি । ভিতরে প্রতি মুহূর্তে পুড়ছি । মাথায় হাজারো টেনশন । দুদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুলছি । প্রতিটা সেকেন্ড নিজের স্বামী সংসার হারানোর ভয় আমাকে খেয়ে যাচ্ছে । সুপ্তি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কিন্তু এই মুহূর্তে যেই সুপ্তি আমার সামনে আছে সে আমার স্বামীর প্রাক্তন ।
পৃথিবীর কোনো স্ত্রী তার স্বামী প্রাক্তন কে মেনে নিতে পারবে না । সে প্রাক্তন যেই হোক না কেন ?
ছোট থেকে আপনজন বলতে কেউ ছিলো না । না মা ,না বাবা । না ছিলো কোন পরিবার । মামা মামীর আশ্রিতা ছিলাম । অনেক আদরে বড় হলেও মা বাবার আদর ভালোবাসা থেকে সর্বদাই বঞ্চিত ছিলাম । বিয়ের পর প্রথমে স্বামীর থেকে অবহেলা পেয়েছি । আপন বলতে শাশুড়ি রুপে মা পেয়েছি । তারপর আস্তে আস্তে আমার জীবন গোছাতে লাগলো । স্বামীর আদর সোহাগ ভালোবাসা অর্জন করলাম । আমারও একটা পরিবার হলো ।আচানকই মাকে হারালাম । মাকে হারিয়ে ভেঙে পড়লেও আমার সাহস জুটিয়ে উঠে দাড়ালাম । কিন্তু এর মাঝেই স্বামী অতীত ফিরে এসে যদি সামনে দাড়ায় । নিজের গোছানো সাজানো সংসারটা ধমকা হাওয়ার ভেঙে যে দেই কি করে ? জীবনে সবকিছু কি শুধু হারিয়েই যাবো ? আমার জীবনে সুখ নেই !
এতো হারানোর পর যদি নিজের সংসারটা জলে ভেসে যেতে দেখি তাতে কি আমার রাগ জেদ কষ্ট হবে না ?
আমি সুপ্তির দিকে আবার তেড়ে গেলে শেফা আমাকে আটকায় । শেফা আমাকে সোফায় বসিয়ে দেয় । আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,
– “কি করছিস তুই । পাগল হয়ে গেছিস ? শান্ত হ ! ”
– “শান্ত হবো ? কি করে ? নিজের স্বামীর প্রাক্তনকে তারই ফ্লাটে দেখে কি করে শান্ত হবো আমি ? ”
– “হুর সুপ্তি প্রেগন্যান্ট । ”
আমি এতোক্ষন লক্ষ করিনি । ভালো করে খেয়াল করে দেখি সুপ্তি সত্যি প্রেগন্যান্ট । দেখে মনে হচ্ছে আট মাসের অন্তসত্তা । আমি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করি । সুপ্তির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলি,
– “কি চাই তোর ? কেন অগ্নির জীবনে ফিরেছিস ? ”
সুপ্তি আমার দিকে বাঁকা রাগী চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয় ,
– “অগ্নি আমার ।আমি আমার অগ্নির জীবনে ফিরেছি ।
তোর অগ্নির উপর যতটা অধিকার আমারো ঠিক ততটাই অধিকার । বরং তোর চেয়ে বেশি আমার অধিকার ! ”
– “তোর অধিকার মানে! তোর কিসের অধিকার ? আমি অগ্নির বিবাহিত স্ত্রী । ”
– “আর আমি অগ্নির বাচ্চার মা হবো । ”
সুপ্তির কথা শুনে আমি থম মেরে আছি । কি বলছে ও এই সব ? অগ্নির বাচ্চার মা মানে ?
আমি সুপ্তির উপর হাত উঠিয়েও নামিয়ে দেই । রেগে গর্জন করে বলি,
– ” ফালতু কথা বন্ধ কর সুপ্তি । কার বাচ্চা অগ্নির ঘাঁড়ে চাপাচ্ছিস ? ”
– “আমার গর্ভের সন্তান অগ্নির ”
– “আমি মানিনা । অগ্নি আর যাই করুক কখনো এ কাজ করবে না । নিশ্চিত তুই অগ্নিকে কোনো ট্যাপে ফেলেছিস । আমি এখনি অগ্নি কে ফোন করবো । অগ্নি এখনি সবটা ক্লিয়ার করবে । তার পর তোর ঘাঁড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে । ”
ব্যাগ থেকে ফোনটা হাতে নিতেই সুপ্তি আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় । আমি ফোন নিতে গেলেই সুপ্তি চেঁচিয়ে বলে,
– “কি শুনতে চাস অগ্নি থেকে এই বাচ্চা কি করে হলো ? এই বাচ্চা আমার আর অগ্নির ভালোবাসার চিহ্ন । তোর বিয়ের আগে আমি আর অগ্নি কাছাকাছি ছিলাম । আর এই বাচ্চা আমাদের সেই বিশেষ মুহূর্তের চিহ্ন । তুই আমাদের মাঝে এসেছিস । আমার আর অগ্নির মাঝে ।”
– “এতোই যখন তোদের ভালোবাসা তাহলে বিয়ে আগে পালিয়েছিস কেন ? ”
সুপ্তি আমতা আমতা করে উত্তর দেয় ,
– “আমি আদ্রিতা আন্টির ভয়ে পালিয়েছি । বিয়ের সাপ্তাহ আগে জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট । খুব ভয়ে ছিলাম এমনিতেই আদ্রিতা আন্টি আমাকে পছন্দ করে না । এই বাচ্চা যদি মেনে না নেয় । আর অগ্নিও যদি তার মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয় । এই ভয়ে পালিয়েছি । ”
আমার সুপ্তির কথায় কেমন যেন সন্দেহ হলো । আমি সুপ্তির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলি ,
– “অগ্নির সন্তান হলে অগ্নি কেন মেনে নিবে না ? তোর মনে হচ্ছেনা তুই মিথ্যা ভিত্তিহীন কথা বলছিস ?তুই যা বলছিস তা কি আদৌ যুক্তিপূর্ণ ? ”
– “হুর ,তুই মেনে নে আর না নে এটাই সত্যি । এটা অগ্নির বাচ্চা । সত্যি বলতে তুই মানতে চাইছিস না । বুঝতে পেরেছি অগ্নির টাকা লোভে পড়েছি । তাই না ?
এই আরাম আয়েশের জীবন ছাড়তে চাইছিস না । তাই তো ? ”
– ” মুখ সামলে কথা বল সুপ্তি ! গোল্ডডিগার আমি না তুই । যদি অগ্নি এতোই তোকে ভালোবাসে তাহলে আমাকে এসব কেন জানায়নি ? তোকে বাড়িতে তুলেনি কেন ?আমার এখন যা জানার আমি সব অগ্নির থেকেই জানবো । অগ্নিই সব বলবে । ”
আমি ছোঁ মেয়ে সুপ্তির হাত থেকে ফোনটা নেই । অগ্নি কে ফোন দিবো এমন সময়ই সুপ্তি বলে ,
– “কি জানবি অগ্নি থেকে ? অগ্নি তো তোকে এখনো এটাই বলে নি যে অগ্নি ই অরন্য ! ”
সুপ্তির কথায় আমার হাত থেকে ফোন পরে যায় । আমি থম মেরে বসে আছি । সুপ্তির কথা আমার কানে বাজছে । মাথাটা ঝিমঝিম করছে ।আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে নেয় । জোর করে খুলি । সুপ্তি আবার বললো ,
– “হ্যা । অগ্নিই অরন্য । সেদিন পহেলা বৈশাখের ফাংশনে অগ্নি এসেছিলো । দূর থেকে যখন তোকে দেখে অগ্নি তখন ফিরে যায় । অগ্নির তোকে পছন্দ হয়নি । সত্যি বলতে তুই অনাথ তাই তোকে পছন্দ করেনি ।অগ্নির তোর মত মিডেল ক্লাস মেয়ে চাইনা । তাই তোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় । তারপর আমার সাথে পরিচয় হয় অগ্নির। আস্তে আস্তে আমরা একে অপরের প্রেমে পরি ।আমাদের সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে । আমি নিজের বোকামির বসে অগ্নিকে ছেড়ে চলে যাই । আর তোর অগ্নির সাথে বিয়ে হয় । কিন্তু প্রথমে অগ্নি তোকে মেনে নিতে পারেনি । পরে আস্তে আস্তে তোর মোহতে পড়েছে । শত হোক পুরুষ মানুষ তো এক ছাদের নিচে থাকতে দুর্বল হয়ে গেছে । কিন্তু তোকে কখনো ভালোবাসেনি । তোর মায়ায় পড়েছে । তোকে দয়া করেছে ।
অগ্নি আজও আমাকে ভালোবাসে । তাই তো আমাকে নিজের ফ্লাটে উঠিয়েছে । হসপিটালে সব জায়গায় নিজের স্ত্রীর পরিচয় দিয়েছে । বিশ্বাস হয় না তো ? ওয়েট ! ”
সুপ্তি ভিতরের রুম থেকে ওর মেডিকেল ফাইল এনে আমার সামনে রাখে । যেখানে লিখা সুপ্তির নামের শেষে অগ্নির নাম । ফাইলে অগ্নির সাইন আছে । সব দেখে আমি থম মেরে বসে আছি ।আমি কার এতোদিন সংসার সাজালাম ? কাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসলাম ? একটা প্রতারক কে ! যে একবার না বার বার আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমার সাথে ঠকিয়েছে । আমি তাকেই আবার অন্ধের মত বিশ্বাস করলাম ।কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমার প্রচেষ্টা ছিলো আমি এই সংসার বাঁচাবো । যে কোনো মূল্যেই হোক অগ্নিকে নিজের থেকে দূরে যেতে দিবো না । কিন্তু এখন আমার অগ্নির চেহারা দেখার ইচ্ছা নেই । পৃথিবী তে সবচেয়ে ভয়ংকর অস্র হলো বিশ্বাসঘাতকতা । এই অস্র যে কোনো মানুষকে তিলে তিলে খুন করার জন্য যথেষ্ট । আমি সেই ভয়ংকর অস্রে ঘায়েল হয়েছি । এই প্রতারক কে ঘৃণা করি । সে অগ্নি বা অরন্য যাই হোক না কেন আমি তাকে ঘৃণা করি । শুধুই ঘৃনা ।
আমি আর টু শব্দ পর্যন্ত করিনা । চুপচাপ ফ্লাট থেকে বেরিয়ে আসি । শেফা সারারাস্তা আমাকে বোঝায় কিন্তু শেফার কোনো কথা আমার কান পর্যন্ত আসেনা । কষ্ট পাথর হয়ে গিয়েছিলাম । আর হবো নাই বা কেন ? আঘাত তো আর কম পাইনি ।
শেফা আমার রাতে বাড়ি পৌছিয়ে দেয় । রাতে আমার সাথে থাকতে চাইলে আমি না করি । সাথে কড়া করে নিষেধ করি আজ যা হয়েছে তা যেন কাউকে না জানায় ।
সারারাত নিদ্রাহীন ভাবে কাটাই । বাড়ির প্রত্যেকটি দেয়াল ছুঁয়ে দেই । এই ছয়টা মাসে এই বাড়ির মায়ায় পড়ে গেছি । বাড়ির প্রত্যেকটা দেয়াল যেন আমার আপন হয়ে উঠেছে ।মায়ের রুমে গিয়ে মায়ে ছবিটায় একবার হাত বুলিয়ে আসি । এই ছয়টা মাসের প্রত্যেক জিনিস মিথ্যা হলেও মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা ছিলো সত্যি । মনের সম্পর্ক । সেখানে কোনো মিথ্যার ছায়া ছিলো না । আমি নিজের রুমে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নেই । রাতে চম্পা এসে জানায় অগ্নি আমার ফোন বন্ধ পেয়ে চম্পার কাছে কয়েকবার ফোন করেছে । আমার খবর নিয়েছে । কাল বিকেলে অগ্নি ঢাকায় ফিরবে । আমি চম্পার কথায় শুধু দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ি ।
“”এই শহরের প্রত্যেকটা অলিগলি যেন তার প্রতারণার সাক্ষী । এই শহর আমার জন্মভূমি হলেও আজ এই চেনা শহর প্রতারকের । এখানে প্রান ভরে নিশ্বাস নেওয়া দুষ্কর ।প্রত্যেক টা নিশ্বাস যেন বিষাক্ত । যে শহরে বেঈমানির ছায়া রয়েছে সেই শহর পরিত্যাগ করাই উত্তম । “”
এতটুকু লিখেই “শত ডানার প্রজাপতি ” বন্ধ করে ব্যাগে রাখি । সকাল আটটা আমি ট্রেনে জানালার পাশে বসে আছি । কিছুক্ষণের মাঝেই ট্রেন ছাড়বে । ভাঙাচুরা ফোনটা হাতে নিয়ে অন করি । ফোন খুলতেই শতশত মেসেজ অগ্নির নাম্বার থেকে । আমি কোনো টেক্সট পড়ি না । ছোট্ট একটা টেক্সট পাঠাই ,
– ” আমি আমার কথা রাখছি ,আপনার জীবন থেকে সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি । আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না । দিন শেষে প্রতারক গুলো ভালো থাকে । আপনাদের নতুন জীবন সুখের হোক । ”
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে । চলতি ট্রেন থেকে ফোনটা জানালার বাহিরে ছুঁড়ে মারি । সিটে গাঁ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে পেটে হাত রেখে বলি ,
– “আমার দুনিয়া শুধু তোকে নিয়ে । তোর উপর কোনো প্রতারকের ছায়া পড়তে দিবো না ।আমিই তোর মা আর আমিই তোর বাবা হবো ! ”
শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
🦋বোনাস পার্ট🦋
( আরে ভাই থামেন 😂 আমি কি একবার ও বলেছি আমি স্টার জলসার মত পাঁচ-দশ বছর টেনে দিবো ? আপনারা তো এক ঘন্টায় কত কাহিনী বানাইয়া ফেললেন বাপরে 🙄কোনো কিছু বলার আগে আগের কাহিনী গুলোতে একটু মাথা খাটাইতেন ।আর আমার গল্পে প্রতি জায়গা জায়গায় টুইস্ট আর টার্ন থাকে ।যে কোনো সময় কাহিনী ঘুরে যায় । এখানে এখনো অনেক কিছু বাকি আছে ।বায় দ্যা ওয়ে যারা এক্সট্রা পার্ট চেয়েছিলেন তাদের জন্য এই পার্টটা ❤️)
“আজ দুমাস পাঁচ দিন ।সেই চেনা শহর ছেড়ে এসেছি । খুব অল্প সময় হলেও আমার জীবনের বিরাট পরিবর্তন এসেছে । ঋতু পরিবর্তন হয়েছে ।জীবন নতুন করে শুরু করেছি । কিন্তু পুরানো স্মৃতি আজো পিছু ছাড়েননি । সারাদিন হাসি খেলে পাড় করলেও রাতটা কাটে নিদ্রাহীন । শরীর আস্তে আস্তে বাড়ছে । শরীরটাও দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ।আমার গর্ভে নতুন প্রাণ বেড়ে উঠছে । ”
এতোটুকু লিখেই ডাইরি টা বন্ধ করলাম । হ্ঠাৎ ই তানিন আমার পাশে এসে বসে জড়িয়ে ধরে । মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকাতেই তানিন বলে ,
– “ফুপিমনি !!!! ”
– “হুম বাবাই ”
– “তোমার পেট টা এতো বড় কেন ? ”
– “এখানে একটা ছোট্ট বাবু আছে তাই ”
তানিন ভীতু গলায় বলে,
– “ও মাই গড । তুমি বাবু খেয়ে ফেলেছো ? ”
আমি তানিনের কথায় গাঁ কাঁপিয়ে হেসে দেই ।
– “না বাবাই ”
– “তাহলে বাবু পেটে কি করে গেল ? ”
– “এটা তো অনেক কঠিকপ্রশ্ন ! উমমমম,আল্লাহ্ দিয়েছে । ”
তানিন কিছুক্ষণ ভেবে বলে ,
– “তাই! বাবু হলে কি যখন আসবে তখন কি তুমি আর আমাকে আদর করবে না ? ”
– “অবশ্যই! আমার বাবাইকে তখনো এতো গুলো আদর করবো । ”
বলেই তানিনের গালে চুমু খাই । কিন্তু তানিন তখনো ভাবনায় বিলিন । কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করলো,
– “তখনো আমার সাথে কি এভাবে খেলবে ? ”
– “হুম । তখন আরো বেশি খেলবো । আমি তুমি আর বাবু একসাথে খেলবো । কেমন ? ”
তানিন বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বলে,
– “তাহলে তো অনেক মজা হবে । আমরা একসাথে অনেক গেম খেলবো ।ঠিক আছে ফুপিমনি ? ”
-“ঠিক আছে বাবাই । কিন্তু এখন তো আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে । লেট হলে মাম্মাম খুব রেগে যাবে ! ”
তানিন বেঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাড়ায় । আমার দিকে তার ছোট হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে ,
– “মাম্মাম বলেছে তোমার খেয়াল রাখতে । আমার হাতটা ধরো আমি তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবো । ”
আমি মুচকি হেসে তানিনের হাত ধরি দাড়াই । মিষ্টি করে বলি,
– “ইস ,আমার বাবাইটা না থাকলে আমার কি যে হতো !
কে খেয়াল রাখতো আমার !”
তানিন আমার কথায় আরো খুশি হয়ে যায় । আমার হাত আরো শক্ত করে ধরে বুক ফুলিয়ে সামনের দিকে বড় বড় পা ফেলে । খুব দায়িত্ব সহকারে মায়ের আদেশ পালন করছেন । তার ভাবভঙ্গি এমন যেন বড় মানুষটা ! কে বলবে এই ছেলের বয়স পাঁচ বছর !
দুজন কথা বলতে বলতে বাড়ি চলে আসি । বাড়িতে ডুকতেই দেখি ড্রইং রুমে কয়েকজন লোক । ভাইয়ার সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে ।সিলেটে নাম করা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমার চাচা ছিলেন একজন । উনার মৃত্যুর পর ভাইয়াই সবটা সামলিয়েছে । চাচা অনেক চেয়েছে আমাকে নিজের কাছে রাখতে কিন্তু মামা দেয় নি । মামার একটাই কথা ছিলো “নিজের বোনের শেষ চিহ্ন নিজের থেকে দূর করবেনা ” ।
ভাইয়া আমাকে আর তানিনকে দেখে হেসে বলেন,
– “আরে তোমরা এসে গেছো ! তো কেমন কাটলো তোমাদের দিন ? ”
আমি মুচকি হেসে বলি,
– “জি ভাইয়া ভালো । আমি আর তানিন আজ খুব খেলেছি । তাই না তানিন? ”
– “ইয়া ফুপিমনি । জানো পাপ্পা আমি ফুপিমনির খুব খেয়াল রেখেছি । ”
ভাইয়া খুশি হয়ে বলে,
– “বাহ ! আমার বাবাটা তো অনেক বড় হয়ে গেছে ।”
তানিন ভাইয়ার কথায় বড়দের মত ভঙ্গি করে দাড়ায় । আমি ভাইয়া কে জিগ্যেস করি,
– “ভাইয়া ,ভাবী কোথায় ? ”
– “আশা কিচেনে আছে । তোমাদেরই অপেক্ষা করছে । ”
আমি আর তানিন কিচেনের দিকে যাই । হ্ঠাই আমি লক্ষ করি ভাইয়ার সাথে বসে থাকা একটা লোক আমার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে । আমি ভ্রু কুঁচকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেই । এই লোকটা কে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।কোথায় যেন দেখেছি ঠিক মনে পড়ছে না !
ভাবী কিচেনে নাস্তা রেডি করছে । আমি আর তানিন যেতেই ভাবী আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে ,
– “কি খবর আপনাদের ফিরতে এতো লেট হলো যে ? ”
– “এইতো ভাবী খেলতে খেলতে লেট হয়ে গেছে । ”
– “সত্যি হুর ,তুমি এখনো বাচ্চা রয়ে গেছো । তবে যাই বলো এই দু মাসে তোমার আর তানিনের ভালো বন্ডিং হয়েছে । তানিন তো কারো সাথে মিশতেই চায়না । কিন্তু ফুপিমনি বলতেই অজ্ঞান ! ”
আমি ভাবীর কথায় মুচকি হাসি । ভাবী বিকালের নাস্তা রেডি করছে । আমি ভাবী কে বলি,
– “ভাবী তুমি সরে দাড়াও । আমি চা করছি । ”
– “হ্যা ,তুমিই করো ।এই দুমাসে খুব বাজে অভ্যাস করে দিয়েছো তোমার চা না খেলে বিকেল কাটে না । অন্যরকম এক স্বাদ আছে । ”
– “মামাও আমার হাতের চা খুব পছন্দ করতো । প্রতিদিন বিকেলে বাড়ি ফিরেই আমার হাতের চা চাই মামার । কিন্তু এখন মামা থেকে কতটা দূরে আছি । ”
হ্ঠাৎ ই মনটা খারাপ হয়ে যায় । ভাবী আমার কাঁধে হাত রেখে বলে,
– “একবার মামার সাথে কথা বলে নিলেই পারো ”
– “না ভাবী তা হয়না । মামার সাথে যোগাযোগ করলে ঠিক ঐ লোকটার কানে পৌছাবে । আমি নতুন করে কোনো ঝামেলা চাইনা । ঐ লোক তার নতুন জীবন নিয়ে ভালো থাকুক । ”
আমার মন খারাপ দেখে ভাবী বললেন,
– “আচ্ছা এসব ছাড়ো । কাল তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছো তো ? ”
– “কোথায় ভাবী ? ”
– “ওমা ভুলে গেছো ? কাল না পহেলা বৈশাখ । এখানে এক ভার্সিটিতে বড় করে আয়োজন করা হবে । তুমি কিন্তু আমাদের সাথে যাচ্ছো ! ”
– “এই পাঁচ মাসের পেট নিয়ে ? ”
– “তাতে কি ? আমি তো তানিনের সময় কতো ঘুরাঘুরি করেছি । কিছু হবে না । তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছো মানে যাচ্ছো । অনেক মজা হবে । তানিন ও খুব খুশি হবে । ”
আমি আর ভাবী কে না করতে পারিনা । পহেলা বৈশাখ নাম শুনেই বুকে ভয় চেপে বসে । এক পহেলা বৈশাখের ঝড় আমার জীবন তছনছ করে দিয়েছে । না জানি কাল কি হয় । যাই হোক কিন্তু দু মাস আগে ফেলে আসা সেই অতীতের সম্মখীন যেন কোনো ভাবে না হই ! শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট :৪২
আজ পহেলা বৈশাখ ।সকাল থেকে ভাইয়া ভাবী বিকেলের অনুষ্ঠানের জন্য তোড়জোড় করছে । চেহারায় কিছুটা চিন্তার ছাপ । কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তিত । দুপুরে বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হলো । প্রত্যেকটা খাবার আইটেম ভাবী নিজ হাতে তৈরি করেছেন ।সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করি । দুপুরের খাওয়ার পর ভাবী আমার রুমে আসে ।ভাবী কে দেখে আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসি ।ভাবী আমার সামনে এসে বসে বললেন ,
– “এখনো তৈরি হও নি! এইতো কিছুক্ষণ পরই বিকেল নামবে । ”
– “আমি আর কি তৈরি হবো ভাবী । শুধু ড্রেসটা চেঞ্জ করবো । ”
– “আজ পহেলা বৈশাখ নতুন বছরের সূচনা আজ অনন্ত একটু সাজগোজ করো । চাঁদের মত মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ”
– “ভাবী যার জীবনটাই রংহীন ,তার জন্য কিসের বৈশাখ কিসের বসন্ত ? আমার জীবনের প্রতিটা রং তো সেদিনই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে যেদিন জেনেছি যাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করেছি সে আমার সাথে বেঈমানি করেছে । ”
– “হুর ,অগ্নিকে একটা সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো । একবার তার মুখ থেকে সবটা শুনে নিতে ! ”
আমি তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে বলি,
– “সুযোগ ? কিসের সুযোগ দিতাম ভাবী ? যেখানে সত্যিটা আমার চোখের সামনে সচ্ছ পানির মত । ভাবী তুমি যদি ভেবে থাকো আমি সুপ্তির কথায় বিশ্বাস করে উনাকে ছেড়েছি । তাহলে তা ভুল !
আমি সেই প্রথম থেকেই অগ্নির আর অরন্য নিয়ে সন্দেহ ছিলো । আমি যতবার অগ্নির কাছে যেতাম অরন্যকে অনুভব করতাম । কিন্তু বার বার নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে ,আমি ভুল । ভাবী আমি নিশ্চয় অগ্নিকে সুযোগ দিতাম । নিজের দিক উপস্থাপনের করার একটা সুযোগ দিতাম ।যদি না জানতাম অগ্নিই অরন্য !
ভাবী তুমি জানো না আমি অরন্য নামটাকে কতটা ঘৃণা করি । আমি কতটা পুড়েছি, কি ভাবে নিজের দিন পার করেছি , তা কেবল আমি জানি ।একটা সময় ছিলো আমি এই নামটাতে পাগল ছিলাম । এতোটা যে মুহূর্তেই নিজের দুনিয়াদারি সব কিছু উজাড় করে দিতে পারতাম । কাউকে জেনে শুনে ভালোবাসায় এতোটা পাগলামো থাকে না ,যতটা কাউকে না দেখে ,না জেনে ভালোবাসায় থাকে । আমি তার জন্য উম্মাদ ছিলাম । কিন্তু সে আমার সাথে কি করেছে ধোকা দিয়েছে । আমার এতো স্বপ্ন ভালোবাসা ঘর মুহূর্তেই চুরমার করে দিয়েছে । তারপর ও আমাকে তাকে সুযোগ দিতে বলো ? কি করে দিবো বলো ? তুমি আমার জায়গায় থাকলে পারতে !
ভাবী সুপ্তি অগ্নির প্রথম ভালোবাসা যা অগ্নি বিয়ের দিনই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো । সেখানে আমি কি করে তাকে সুযোগ দিতাম । যা আমি জানি অগ্নি নিজে আমাকে বলেছে সেখানে তাকে মুখ থেকে দ্বিতীয় বার শুনার কোনো মানে হয় ? আর আমার সাথে যা ছিলো তা খানিকে মোহ । আমি তার কাছে পুতুল আমার মন নিয়ে সে খেলতে পছন্দ করে । তাই আবারো তাই করলো । যদি সে জানতো তার সন্তান আমার গর্ভে আছে নিশ্চিত আমাকে নিজের কাছে আটকাতো । কি তা শুধু নিজের সন্তানের জন্য না হয় আমার উপর দয়া করে । যা আমি চাই না ।আবারো উনার প্রতারণার শিকার হতে চাই না । ভুল একবার করলে তা ভুল মানা যায় । কিন্তু বার বার একই ভুল করা মূর্খতা !
আমি জানিনা আমার ভবিষ্যৎ কি হবে । এমনো হতে পারে ডেলিভারির সময় আমার মৃত্যু হতে পারে । কিন্তু যাই হোক না কেন আমি আমার সন্তানের উপর ঐ লোকের ছায়া পড়তে দিবো না ।”
ভাবী আমার হাতের উপর হাত রেখে বলে ,
– “হুর ,এমন করে বলছো কেন ! ডেলিভারির সময় মৃত্যু হবে কেন ? ”
– “ভাবী বলা তো যায় না । কি থেকে কি হয়ে যায় ! ”
– “এসব ভেবো না । সব ভালো হবে দেখো । ”
– “তোমার কথাই যেন ঠিক হয় ”
– “আচ্ছা এসব কথা ছাড়ো । তুমি আজ শাড়ী পড়বে । আমি আজ নিজ হাতে তোমাকে সাজাবো । ”
– “ভাবী তার কি দরকার আছে ! এখন আর সাজগোজ ভালো লাগে না । ”
– “উফফ! চুপ করো তো । দিনদিন একদম বুড়িদের মত হয়ে যাচ্ছো । আমি বলেছি আমি সাজিয়ে দিবো মানে আমি সাজিয়ে দিবো । ”
– ” ওহহ ! ভাবী ,তোমার জিদের সাথে কি আজ পর্যন্ত পেরেছি ? যে এখন পারবো ! ”
ভাবী খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে । পড়নে লাল সাদা জামদানি শাড়ী । চুলগুলো কার্ল করে ছাড়া । হাল্কা মেকআপ । কানে ভারী দুল । আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে আছি । এই দুমাসে নিজেকে একদম হারিয়েই গিয়ে ছিলাম । আমার মধ্যে এই আমিটাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম । ভাবী কানের পিছনে কালো টিকা লাগিয়ে দিয়ে বললেন,
– ” মাশাল্লা ! কারো নজর যেন না লাগে । ”
আমি উত্তরে মুচকি হাসি ।কিছুক্ষণের মাঝেই বাড়ি থেকে রওনা হই ।ভাইয়া ড্রাইভ করছে । ভাবী ভাইয়ার পাশে । আর আমি আর তানিন পিছনের সিটে বসে আছি । তানিন আমার গাঁয়ে মাথা ঠেকিয়ে ফোনে গেম খেলছে । আমি বাহিরের তাকিয়ে আছি ।সিলেটে দুমাস ধরে এসেছি এখনো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি । মূলত বলতে গেলে ইচ্ছে করেই বের হইনি । মনে অশান্তি থাকলে কোনো কিছুই ভালো লাগেনা । এসব ভাবতে ভাবতেই অনুষ্ঠানে পৌছাই । গাড়ি থেকে নামতেই দেখি শতশত মানুষের ভিড়। সবাই খুব সুন্দর সাজগোজ করা ।আশেপাশে অনেক কাপোল রয়েছে । হাতে হাত ধরে হাঁটছে । কি সুন্দর লাগছে । আমি মুচকি হেসে তানিন কে নিয়ে আশেপাশে স্টল গুলো ঘুরেঘুরে দেখছি । ভাইয়া আর ভাবী কে একান্ত কিছু সময় কাটানোর জন্য স্পেস দিয়েছি । তানিন এটা ঐটা নিয়ে উদ্ভট প্রশ্ন করে যাচ্ছে । আমি তানিনের কথায় কোনো ভাবেই নিজের হাসি আটকাতে পারছিনা । শব্দ করে হাসছি । তানিন বায়না ধরে রেশমি জিলাপি খাবে । আমি তানিন কে নিয়ে জিলাপির স্টলে যাই । কিন্তু হ্ঠাৎ মনে হলো কে জানো আমার পিছু নিচ্ছে ।ভ্রু কুঁচকে এদিকে ওদিকে তাকাই কিন্তু কেউ নেই । মনে ভুল ভেবে তানিনের দিকে তাকাই । কিন্তু বার বার একই অনুভূতি হচ্ছে যেন কেউ আমাকে ফলো করছে ।কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে ভাইয়া ভাবী কে আসতে ফোন দেই । কেমন জানো অস্বস্তি লাগছে । আকাশটাও মেঘে কালো হয়ে আছে । ভাইয়া ভাবী আসতেই ভাইয়া বলি আমি গাড়ি বসতে চাই । এখানে এতো ভিড়ের মাঝে ভালো লাগছে না । ভাইয়া গাড়ির চাবি আমার কাছে দেয় । আমি পার্কিং এরিয়ার দিকে পা বাড়াই । ঝড়ো হাওয়া ছেড়েছে । মনে হচ্ছে কাল বৈশাখী ঝড় হবে !
আমি গাড়ির সামনে আসতেই কেউ পিছন থেকে আমার চোখ বেঁধে দেয় । আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার হাত বেঁধে ফেলে আমাকে গাড়ি তে উঠায় । আমি চিৎকার চেঁচামেচি করছি কিন্তু আমার কথা লোকটার কানে ডুকছে না । কোনো সাড়াশব্দ করছেনা । আমি বারবার জিগ্যেস কেন আমার সাথে এমন করছে ? কি চাই তার ? কিন্তু কোনো উত্তর নেই । আমি কোনো প্রকার জবাব না পেয়ে হেল্প ! হেল্প।! বলে চিৎকার করতে লাগি । অবশেষে লোকটা আমার বাঁচার শেষ রাস্তা বন্ধ করে দেয় । আমার মুখ আটকে দেয় । আমি আঁচ করতে পারছিলাম লোকটা আমার পাশেই বসে আছে ।
আমাকে কোথাও বসিয়ে রেখেছে । মনে হচ্ছে কোনো বিছানা । আমার চোখ ,হাত ,মুখ এখনো বাঁধা । কানে শব্দ আসছে । লোকটা আমার দিকে বোধহয় এগিয়ে আসছে ।কিছুক্ষণ পর আমার গালে কারো স্পর্শ পেলাম । আমার গালে আঙুল দিয়ে স্লাইড করছে । এই স্পর্শটা আমার অপরিচীত না । খুবই পরিচীত । আমার চোখ মুখ খুলে দেয় । সামনের লোকটাকে দেখে আমি স্থব্দ হয়ে গেলাম । মাথা চক্কর মারে ।মুখ থেকে অফুটন্ত স্বরে বেরিয়ে আসে “অগ্নি ” !
আমার শরীরে কাঁপুনি উঠে গেছে । আমি কোনো ভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছিনা । আমি রাগ ভয় সব মিলিয়ে থতমত গলায় বলি,
– “কেন এসেছেন আপনি ! কি চান আপনি । আমাকে ছেড়ে দেন । আমি এখনি বাসায় যেতে চাই । আ….আমি আপনার চেহারাও দেখতে চাইনা ।বাসায় যাবো ….
আমি এসব কিছু বলতে বলতে কাঁপা পায়ে বিছানা থেকে পা নামাই । কিন্তু উঠে দাড়ানোর আগেই অগ্নি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসিয়ে দেয় ।আমার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে । থমথম আওয়াজে বলে ,
– “হুসসসস, একটা কথাও না !”
আমি চুপ করে হাত পা গুটিয়ে বসি । আমার চোখ অগ্নির চোখে । আমার আজ এই চোখ দেখে ঘৃণার চেয়ে বেশি ভয় করছে । প্রচন্ড ভয় । এই অগ্নিকে আমি কোনো দিন দেখি নি । এই এক অন্য অগ্নি,যে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না । আমার চোখ থেকে ভয়ে পানি ঝোড়ছে ।আমি আস্তে আস্তে পিছনে বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছি ।
চলবে….❤️