শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট :৪৭
দুপুরে সবাই একসাথে লাঞ্চ করছি । অগ্নিও কিছুক্ষণ পূর্বেই বাড়িতে ফিরেছে । অগ্নি নিজের পুরোটা সময় আমাকে দেয় ।আমি অগ্নির পাশের চেয়ারে বসে আছি ।খাবারের ঘ্রাণে মাথা ভনভন করে ঘুরছে । ভিতরে যা আছে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে । কিছু মুখে তুলতে পারছিনা । যা খাচ্ছি সব বেরিয়ে আসতে চাইছে । পেটটাও ঘুরঘুর করছে । আমি কোনো রকম নাক মুখ চেপে ধরে আছি । অগ্নি আমার প্রত্যেকটা কাজ খুব গভীর ভাবে খেয়াল করছে ।আমার এখন অবস্থা দেখে অগ্নি জিগ্যেস করে ,
– ” কি হয়েছে হুর ,খাচ্ছো না কেন ! খুব খারাপ লাগছে কি? ”
টেবিলে সবার দৃষ্টি আমার দিকে । আমি মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম,
– “না কিছুনা ,খাচ্ছি । ”
অগ্নিকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থেকে জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা টেনে এক লোকমা মুখে তুলি । অগ্নি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের খাবারে ধ্যান দেয় । দুতিন লোকমা মুখে তুলতেই আমার খারাপ লাগা শুরু করে দেয় ।ভিতরে সবকিছু ভল্কাতে শুরু করে ।যতটুকু খেয়েছি সব উপরের দিকে চলে আসছে । টেবিল ছেড়ে তাড়াতাড়ি উঠে বেসিনের দিকে যাই । যতটুকু খেয়েছি সববেরিয়ে আসে ।অনবরত বমি হচ্ছে । আমার নাজেহাল অবস্থা শরীর চলছে না । বড়বড় শ্বাস নিচ্ছি । ততক্ষণে অগ্নিও এসে গেছে । আমাকে পিছন থেকে এসে ধরে । আমি পুরো শরীরের ভর অগ্নির উপর ছেড়ে নেই । ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসছে । অগ্নি আমার মুখ পরিষ্কার করে কোলে তুলে রুমে নিয়ে যায় ।
রুমের বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে আমার পাশে আধ শোয়া হয়ে বসে । আমি তখনো অগ্নির শার্ট শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি । মুখটা অগ্নির বুকের মাঝে লুকানো ।
অগ্নি আমার গালে আলতো করে স্লাইড করছে । আমি নিভু নিভু চোখে অগ্নির মুখের দিকে তাকাই । অগ্নির চেয়ারায় স্পষ্ট চিন্তার ছাপ । কপাল কুঁচকানো । আমার গালে আগের মত স্লাইড করতে করতে চিন্তিতো স্বরে বলে,
– “খুব খারাপ লাগছে ! তুমি ঠিক আছো ? ”
আমি চোখে পাতা ঝাপটিয়ে উত্তর দেই আমি ঠিক আছি । কথা বলার মত শক্তি আমি পাচ্ছিনা ।শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগছে । আমি বুঝতে পারছি আমি ধীরেধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি । এমনটা তো হওয়ারই ছিলো !
ভবিষ্যৎ এর চিন্তা মাথায় আসতেই বুকটা অজানা ভয়ে নাড়া দিয়ে উঠে । দুশ্চিন্তা আর শারীরিক দুর্বলতায় গাঁ আর সায় দিচ্ছেনা । আমি আবার চোখ বুঝে অগ্নিকে আগের চেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করি ।এই বুকটাই আমার সবচেয়ে শান্তির স্থান । যদি এই মানুষটা আমার কাছে থাকে সব ধরনের লড়াই আমি করতে পারবো । হোক তা মানুষিক বা অন্যকোন । অগ্নি আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ।
আমি যখন অগ্নির বুকে প্রশান্তি আর ভয় নিবারণের ঔষধ খোঁজ করছিলাম অগ্নি তখন গভীর চিন্তায় লিন । সেই চিন্তার কারণটাও আমি । আমি জানি ঘুম ভাঙার পর আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে ।
ঘুম ভাঙে বিকেলের শেষ প্রহরের দিকে । অন্ধকার নেমে আসছে , মাগরিবের আজান এখনো দেয় নি । আমি ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে দেখি অগ্নি আমার খুব কাছে নিখুঁত চাহনি তে আমাকে দেখছে ।দুজনের গাঁয়ের উপর কম্বল ছড়ানো । রুমে এসি চলছে । অগ্নির খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আলতো হাতে স্পর্শ করি , মলিন হেসে নিচু স্বরে বলি,
– “এভাবে কি দেখছেন ? ”
অগ্নি আমার হাতের তালুতে চুমু দিয়ে আলতো করে নিজের মুঠোবদ্ধ করে ।অগ্নির গভীর চোখজোড়ায় ভয় ।যা সচ্ছভাবে ফুটে আছে । অগ্নির আমার দিকে তখনো আগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আমি আবার প্রশ্ন করলাম ,
– “কি বলবেন না ? ”
অগ্নি ভাঙা স্বরে জবাব দিলেন ,
– “হুর আমার ভয় হচ্ছে । প্রচন্ড ভয় । মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে দূরে চলে যাবে ,হারিয়ে যাবে । আমার অন্যকোন কিছুর প্রয়োজন নেই । আমার শুধু তোমাকে চাই । তোমার শরীরের দিন দিন এই অবউন্নতি আমার ভয় বাড়াচ্ছে । ”
– “অগ্নি ,আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন । আমি ঠিক আছি । ”
– “না হুর তুমি ঠিক নেই । কি ভেবেছো? তোমার শরীরের দুর্বলতা আমার চোখে পড়ছে না !
আমি স্পষ্ট দেখছে পারছি তুমি প্রচুর অসুস্থ । গলা ভেঙে যাওয়া ,এমন ঘনঘন বমি , ঘুমের সময় এভাবে ঘেমে যাওয়া এগুলো স্বাভাবিক ? ”
– ” অগ্নি প্রেগন্যান্সির সময় এসব স্বাভাবিক । প্রেগন্যান্সির সময় মেয়েদের ঘ্রাণ শক্তি প্রখর হয় যার ফলে কোনপ্রকার তৈলাক্ত খাবার বা অতিমাত্রা ঘ্রাণ যুক্ত কোন জিনিশের কারণে এমন বমি হয় । গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে প্রতিদিনে একবছরের তুলনায় বেশি ইস্ট্রোজেন হরমোর ক্ষরণ করেন যার ফলে গলার স্বর ভেঙে যায় । অতিরিক্ত ঘাম হয় । পায়ে পানি আসে । এসব কিছু অস্বাভাবিক কিছু না ।”
– “যতই স্বাভাবিক হোক না কেন আমার মন মানছে না । তাই তোমার চেনা ডক্টরের এপোয়েন্টমেন্ট নিয়েছি । সাতটার দিকে যাচ্ছি চেকআপের জন্য । রেডি থেকো । ”
অগ্নির কথায় আমি চিন্তিত হয়ে পরি । ভয় আরো বেড়ে যায় । ভিতু স্বরে বলি ,
– “অগ্নি আপনি শুধু শুধুই টেনশন করছেন । চেকআপ করতে হবে কেন ! আমি ঠিক আছি । ”
– “চেকআপ না করা পর্যন্ত আমি নিশ্চিত হতে পারছি না ”
– “অকে ,তাহলে ঠিক আছে । আমি আর হিয়া আপু যেয়ে চেকআপ করে আসবো । ”
– “উহু ,তোমার সাথে আমি যাবো । আমি তোমার সুস্থতার কথা ডক্টর এর মুখ থেকে শুনে নিশ্চিত হতে চাই । তা না হলে আমার মন অশান্ত থাকবে । ”
– “অগ্নি আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন । আমি আর আপু সব ম্যানেজ করতে পারবো তো ! ”
– “তুমি কেন আমার সাথে ডক্টরের কাছে যেতে চাইছো না ! ইজ এভরিথিং ওকে ? তুমি কি আমার থেকে কিছু লোকাচ্ছো ? বা লোকাতে চাইছো ? ”
আমি শুকনো ঢোক গিলে বলি ,
– “না ,একদম না ! কি লুকাবো ? কিচ্ছু লুকাচ্ছি না । ”
কথাটা বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে উঠে বসি । অগ্নি আমার দিকে সন্দেহ যুক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । যেন আমার কথা অগ্নির খুব একটা বিশ্বাস হয়নি !
________________________
ডক্টর আন্টির সামনে বসে আছি । আমার হাত পা ঘেমে আসছে । টেনশনে কপালেও ঘাম জমেছে । আন্টি আমার রিপোর্ট গুলো চেক করছে । চেহারায় চিন্তার আভা ।কিছুক্ষণ পর আমার দিকে হতাশ চোখে তাকায় । অগ্নি আমার পাশেই বসে আছে ।
অগ্নি চিন্তিত স্বরে আন্টিকে জিগ্যেস করেন ,
– “আন্টি সব ঠিক আছে তো ? ”
আন্টি হতাশ স্বরে বললেন ,
– “অগ্নি কিছু ঠিক নেই ।অবস্থা খুব একটা ভালো না । ”
কথাটা শুনে অগ্নির চেহারার রঙ পাল্টিয়ে যায় । অগ্নি থতমত গলায় বললো ,
– “আন্টি প্লিজ বিস্তারিত বলুন । আমার খুব ভয় হচ্ছে । ”
– “অগ্নি হুরের প্রেগন্যান্সিতে কিছু কমপ্লিকেশন আছে ।অগ্নি আমি এখন যা বলবো খোলাখুলি ভাবে বলবো তোমার সবটা জানা দরকার ।
আমি প্রথম থেকেই হুরের ট্রিটমেন্ট করছি ।হুরের পাস্ট মেডিকেল রিপোর্ট সম্পর্কে সবকিছু আমার জানা ।হুরের কিছু প্রব্লেম ছিলো যার ফলে আমি হুরের ট্রিটমেন্ট করে। মেডিসিন কোর্স দিয়েছিলাম ।প্রব্লেম টা এমন ছিলো যে হুরের মা হওয়ার চান্স ফিভটি পার্সেন্ট ছিলো । আল্লাহ্ র অশেষ কৃপায় হুর প্রেগন্যান্ট হয়েছে কিন্তু এতে কিছু প্রব্লেম আছে । এটি প্রেগন্যান্সির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ । হুরের হিমোগ্লোবিনের পয়েন্ট এমনিতেই কম । শরীরের রক্তশূন্যতা রয়েছে তার উপর প্রেসার নিয়ন্ত্রণে আসেনা ,শরীর দূর্বল । এতে মায়ের জন্য লাইফ রিস্ক হতে পারে । তাই আমি হুর কে এভরোশন করতে বলি । কিন্তু হুর মানতে নারাজ । সে এ বাচ্চা চায় তাই কোনো উপায় না পেয়ে হুরকে প্রতিকারের জন্য ইনজেকশন নিতে বলি কিন্তু এর পর হুরের আর কোন খোঁজ নেই ।রিপোর্ট অনুযায়ী হুর টাইম টু টাইম ইনজেকশন নেয়নি ।
এখনকার রিপোর্ট অনুযায়ী বেবি সুস্থ আছে । কিন্তু ডেলিভারির সময় হুর ও বেবি দুজনের প্রব্লেম হতে পারে । মৃত্যু হতে পারে বাঁচার চান্সেস কম ! ”
অগ্নি আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকায় । আমি বেশ বুঝতে পারছি অগ্নির রাগের কারণটা কি । অগ্নির চোখ টলটল করছে । অগ্নি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ,
– “আমাকে এসব আগে জানাও নি কেন ? ”
আমি চুপ করে আছি । ভয় আমার হাত পা কাঁপছে । এতোটা দিন ঠিক এই ভয়েই ছিলাম । অগ্নির আমার ধমক দিয়ে বলে ,
– “আমি কিছু বলছি হুর ! আমাকে জানাও নি কেন ? হোয়াই ? ”
অগ্নির শেষ ধমকে আমি কেঁপে উঠি । অগ্নিকে এভাবে রেগে যেতে দেখে ডক্টর আন্টি অগ্নিকে বলে ,
– “বি কুল অগ্নি ! এখন মাথা গরম করার সময় না । হুর যা বোকামি করার তা করে ফেলেছে । কিন্তু এখন সলিউশন খোঁজা দরকার । ”
– “আন্টি আমাকে বলুন কি করতে হবে আমি সব করবো । আমার হুর যেন সুস্থ থাকে । এর জন্য যতটাকা লাগে যা যা করতে হবে আমি সব করবো ।”
অগ্নি করুণ স্বরে বললেন । অগ্নির চোখে মুখে ভয় । যেন সে দিশেহারা হয়ে গেছে । অগ্নির এমন মুখ দেখে আমার ভিতরের সব ভেঙে কান্নার ঢল নামতে চাইছে । আন্টি বললেন ,
– ” হুরের সাথে আমার সম্পর্ক এখনকার না অনেক আগের । আমি আর হুরের মামী ক্লাসমেট । হুর কে দেখে তার মা হুমায়রার কথা মনে পড়ছে। সে ও হুরের মতই ছিলো ,জেদি! হুমায়রার ও প্রেগন্যান্সিতে কম্পলিকেটেট ছিলো । কিন্তু সে হুরকে বেছে নিয়েছে । যার ফলে ডেলিভারির সময় তার মৃত্যু হয় ।হুর আমার কাছে আমার মেয়ের মত । আমি নিজের বেষ্ট ট্রাই করবো ।আর হ্যা এই সময়টায় সবচেয়ে বড় ঔষধি হলো সাহস । তোমাদের ভেঙে পড়লে হবে না । সাহস করে লড়তে হবে । আল্লাহ্ চাইলে অবশ্যই হুর আর বেবি সুস্থ থাকবে ।তুমি চিন্তা করোনা অগ্নি আল্লাহ কে ডাকো ”
আমি মাথা নত করে প্রত্যেকটা কথা শুনলাম । চেম্বার থেকে বের হতেই অগ্নি আমার হাত ধরে নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত আসে । অনেকটা জোরেই ধরেছিলো । একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায় নি । সারারাস্তা দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা ছিলো । অগ্নির ভিতরে রাগে ফুসছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি । না জানি অগ্নি কোন ঝড় তোলে ।
শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট :৪৮
বাড়িতে ফিরার পর থেকে অগ্নি আমার সাথে কোনপ্রকার কথা বলেনি । ভালো খারাপ কোনো কিছুই না । অগ্নির এই শান্ত স্বভাব আমার বড় কোন ঝড়ের পূর্বাভাস মনে হচ্ছে ।
আমি অগ্নির অপরাধী ,আমি মানি আমি যা করেছি তা ভুল অন্যায় আর বোকামি । অগ্নির কাছে কোনকিছু এক্সপ্লেইন করার মত আমার মুখ নেই । আমি আমার ভুলের কথা চিন্তা করে মাথা নত করে আছি । মন খুব কু ডাকছে না জানি কি হবে । খাবার টেবিলেও আসেনি । আসার পর থেকে মায়ের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে । ডাকার সাহস হয় নি । যদি রেগে যায় ?
কোন রকম ডিনার করে রুমে চলে আসি ।অগ্নি রুমে নেই কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না । চিন্তায় মাথা ভাড় হয়ে আছে । বিছানায় হেলান দিয়ে লাইট অফ করে বসে আছি । ঘড়ির কাটাতে রাত বারটা ছুঁই ছুঁই । এমন সময়ই দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসে । দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি অগ্নি রুমে এসেছে । লাইট অন না করেই কাবার্ড থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় । অগ্নির প্রত্যেকটা কাজ আমি খুব মন দিয়ে দেখছি । একবারের জন্যও বিছানায় তাকায়নি । এতো টা রাগ আমার উপর ?
না ,এভাবে রাগারাগি করলে কোন সমস্যার হাল বের হবে না । অগ্নিকে আমার সাইডটা বোঝাতে হবে । অগ্নিকে বুঝতে হবে আমি কেন এই রাস্তা বেছে নিয়েছি । বিছানায় হেলান ছেড়ে একটু উঠে বসি সবটা এক্সপ্লেইন করার জন্য নিজেকে প্রিপারেট করে নেই ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই অগ্নি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে । আমার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে বড়বড় পা ফেলে বারান্দায় চলে যায় । আমি শান্ত চোখে সবটা লক্ষ করলাম । তারপর অগ্নির পিছনে পিছনে বারান্দায় চলে যাই । অগ্নি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দুহাত বারান্দার রেলিং এর উপর রাখা ।আমিও অগ্নি পাশে যেয়ে দাড়াই । এইতো খানিক পূর্বেই বৃষ্টি থেমেছে । আকাশ একদম পরিষ্কার কোন মেঘ নেই । একদম সচ্ছ ।ঠান্ডা শীতল খাওয়ার গাঁ শিরশির করে উঠছে ।গাঁয়ের পশম দাড়িয়ে গেছে ।ঘাড় ঘুরিয়ে অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখি অগ্নি অন্যমনস্ক । চোখ এখনো আকাশের দিকে । কোন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন । আমার উপস্থিতি এখনো টের পায়নি ।আমি গলা ঝেড়ে নত স্বরে বলি ,
– “এখনো কি আমার উপর রেগে আছেন ? একবার জিগ্যেস করবেন না কেন করেছি ? জানতে চাইবেন না কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি ! ”
অগ্নির কোন সাড়া না পেয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি । অগ্নি অন্যমনস্ক ,যেন আমার কোন কথা উনার কানে যায়নি । আমি অগ্নির পাশে এতো টা সময় ধরে আছি উনার কোন খেয়াল নেই । অগ্নি এমন বিহেভ করছে যেন আমি এখানে নেই । অগ্নির এই নীরবতা স্থব্দতা সবকিছু আমাকে ভেঙেচুরে দিচ্ছে । পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শাস্তি গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে ইগ্নোর করা ।অগ্নি আমাকে সেই সবচেয়ে কঠিন শাস্তিটাই দিচ্ছে । আমাকে প্রচন্ড রকম ইগ্নোর করছে ।আমি পারছিনা অগ্নির এই শাস্তি ভোগ করতে । আমার চোখজোড়া ঘোলাটে হয়ে আসছে । তিলেতিলে হচ্ছি । মনে হচ্ছে কেউ বুকে মাঝে হাজার সুঁই এর ঘাই দিচ্ছে । আমি ছুটে গিয়েচ অগ্নিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি । চোখের জলের বাঁধ ছেড়ে দেই । শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলি ,
– ” কেন এমন করছেন ? কেন ? আমি পারছিনা তো আপনার ইগ্নোর সহ্য করতে । আপনি আমাকে মারেন ,বকুন ,ধমকান ! কিন্তু প্লিজ এই নিষ্ঠুর শাস্তি দিয়েন না । এই শাস্তি থেকে মরণ ও উত্তম । আমার সাথে কথা বলেন অগ্নি প্লিজ ,প্লিজজ ! ”
অগ্নি কোন কথা বললো না । ঠাই আগের ভঙ্গি তে দাড়িয়ে আছে । আমি আগের মতই চোখ মুখ বন্ধ করে কান্না করছি । অগ্নিকে অনবরত বলছি আমার সাথে কথা বলতে কিন্তু অগ্নির কোন সাড়া নেই । পাথরের হয়ে দাড়িয়ে আছে । আজ আমার চোখের পানি ও অগ্নির পাথর ন্যায় মন গলাতে পারছে না । এতোটা রুষ্ট আমার উপর ? আমি আর মানতে পারছি না ।এই নীরবতা স্থব্দতা নিতে পারছি না । আমি নিজের মাঝে থাকতে পারছি না । সব হুস জ্ঞান ভুলে অগ্নি সামনে চলে যাই । দুহাতের অগ্নির মুখ চেপে ধরে জোর করে অগ্নির মুখ আমার দিকে ঘুরাই ।
জোর করে অগ্নির ঠোঁটে আমার ঠোঁট জোড়া চেপে ধরি । জোর করে তাকে কিস করি । কিছুক্ষণ পর অনুভব করতে পারি অগ্নির তড়প থেকে কোন সাড়া নেই । আমি হতাশ চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখি । অগ্নি সবটা শান্তা চোখে দেখছে । আমি অগ্নির থেকে কিছুটা দূরে চলে যাই । চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলি ,
– “কেন এমন নির্দয় হচ্ছেন ! আপনি শুনতে পারছেন না আমার কথা ? আমার কান্না চোখের পানি আপনি দেখতে পাচ্ছেনা ? এতো নিষ্ঠুর শাস্তি কেন আমাকে দিচ্ছেন ? আপনার আমাকে এভাবে এড়িয়ে চলা ,আমাকে পাগল করে দিচ্ছে । এর চেয়ে ভালো আপনি আমাকে মেরে ফেলেন । নিজের দুহাতে আমার গলা চিপে প্রাণ নিয়ে নিন ! নিন ! নিচ্ছেন না কেন ? ”
আমি পাগলের মত বিহেব করছি ।জোর করে অগ্নির হাত আমার গলার কাছে টেনে আনছি। অগ্নি আমার প্রত্যেকটা কাজ শীতল চাহনি তে পর্যবেক্ষন করছে । উনার চোখে কোন প্রকার ভাব নেই । না আছে কোনো ভাষা !
অন্যদিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো ,
– ” অনেক রাত হয়েছে ,রুমে যেয়ে ঘুমাও । ”
অগ্নির কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে থাকলাম । উনার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে নিজেকে সামলিয়ে বললাম ,
– ” ঠিক আছে ,আমার সাথে কথা বলবেন না তো ? আমার দিকে তাকাবেন নাও পর্যন্ত !
তাহলে আমার এখানে ,এই বাড়িতে ,আপনার কাছে থেকে কি লাভ ? আমি কেন এখনে পড়ে আছি । আমার এখান থেকে চলে যাওয়াই উত্তম ! ”
কথা শেষ করেই হুরহুর করে অগ্নির সামনে থাকে চলে আছি । রাগ জেদ খারাপ লাগা আমার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে । আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই । পিছন থেকে তুফান বেগে অগ্নি এসে আমার বাহু ধরে আটকায় ।
আমাকে টানতে টানতে বিছানায় ফেলে ।অগ্নির চোখ জ্বলন্ত লাভা’র মত জ্বলছে ।
আমার হাতের ডানা শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বলে ,
– ” কি খুব সাহস বেড়েছে ? খুব ? একবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কলিজা বড় হয়ে গেছে । কথায় কথায় বাড়ি ছাড়া ? আমার থেকে মুক্তি চাস ? যাহ ,তুই মুক্তি !
বাবা ,মা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে । তুই ও যা । কাউকে লাগবে না আমার । কাউকে না ! যা তুই । যাহ্ । ”
এসব বলতে বলতে পানির জগটা মাটিতে ছুড়ে মারে । রুমের সব কিছু ভাঙচুর করতে লাগে ।পাগলের মত কাজ করছে । আমি ভয়ে কুঁকড়িয়ে গেছি । ডুকরে কান্না করছি । অঝোরে চোখ থেকে পানি পড়ছে । অগ্নির এই ভয়ংকর তান্তব আমি আগে দেখিনি । ভয়ে চুপসে গেছি । মুখ চেপে ধরে কান্নার করছি । সব ভাঙচুর করে কিছুক্ষণ পর হেলতে দুলতে আমার দিকে আসে । হাত থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু সেদিকে উনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।
অগ্নি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই । যে কোন সময় যে কোন কিছু করতে পারে ।
আমি ভয়ে পিছিয়ে যাই ।ভয়ে সাড়া শরীর কাঁপছে । অগ্নি আমার সামনে দপ করে বসে আমার দিকে হাত বাড়াতেই আমি সড়ে যাই । এতে যেন উনার রাগ আরো বেড়ে যায় । একটানে আমাকে টান দিয়ে তার বুকে সাথে জড়িয়ে নেয় ।
আমি ভয়ে তখনো ঠকঠক করে কাঁপছি । কি আশ্চর্য যেই বুকে নিজের শান্তির ঠিকানা খুঁজে নিতাম । আজ সেই বুকে মাথা রাখতে ভয় লাগছে । পরিস্থীতি কত কিছু পাল্টিয়ে দেয় ।
আমি আদো আদো স্বরে বলি ,
– “আমাকে ছেড়ে দিন আমার আপনাকে ভয় করছে খুব? ”
অগ্নি আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায় । আমার গালে উনার দুহাত চেপে ধরে । চোখ বন্ধ করে আমার নাকের সাথে উনার নাক ঘষতে ঘষতে বলে,
– “আর আমি যে তোমাকে হারানোর ভয়ে সেকেন্ড সেকেন্ডে মরছি ! তুমি এতো স্বার্থপর কেন? কেন আমাকে এমন ভয়ংকর শাস্তি দিতে চাও । আমার একটা ভুলের জন্য তুমি আমাকে এতো শাস্তি দিচ্ছো ! আমি না হয় তোমাকে চিনতে পারিনি যে তুমিই আমার ভালোবাসা ,আমার পরীজান তাই বলে এতো কঠিন শান্তি দিবে ?
বাবা কে খুব কমবয়সে হারিয়েছি । তার পর মা ই সব ছিলো । কিন্তু মাও ছেড়ে চলে গেছে । তোমাকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন বুনেছি । আমার মন জান প্রাণ ধ্যান সবকিছু তোমাকে উৎস্বর্গ করেছি । তোমাকে ঘিরে আমার দুনিয়া বানিয়েছি এখন তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছো । আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারো ? ”
অগ্নির চোখে পানি আমার গাল বেয়ে পড়ছে । আমি চোখ খুলে দেখি অগ্নির চোখ বন্ধ ।
উনার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝোড়ছে । ছেলেরা সহজে কাঁদে না ।বুকে প্রচন্ড রকম বড় কষ্ট না পেলে তাদের চোখের পানি ঝড়েনা । আমার কাজ্ব অগ্নি এতোটা কষ্ট পেয়েছে । এতোটা ?
এতো গভীর আঘাত দিয়ে ফেলেছি নিজের ভালোবাসার মানুষটা কে !
অগ্নির চোখের জল মুছে দিয়ে বলি,
– “আপনি আমাকে একবার বুঝার চেষ্টা করলেন না ! আমি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা জানতে চাইলেন না ? আমি আপনাকে কোন শাস্তি দিতে চাইনা । এমন করার চিন্তাতো আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না ।
শতবছর আপনার সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছি । কিন্তু তখন পরিস্থীতি এমন ছিলো আমি ভেঙে পড়েছিলাম । রাগের বসে আপনাকে ছেড়ে তো গিয়েছিলাম কিন্তু বাঁচার জন্য আমার কাছে কোন কারণ ছিলোনা । আমি পারতাম এবরশন করতে কিন্তু তারপর কি নিয়ে বেঁচে থাকতাম !
মায়ের আদর ভালোবাসা শাসন আমি কখনো পাইনি । তা কেমন জানি না । তাই আমি চেয়েছি আমার সন্তানের শৈশবে নিজের শৈশব খুঁজে পাওয়া । তাকে দুনিয়ার সবরকম সুখ এনে দিতে । আমি যা যা থেকে বঞ্চিত হয়েছি সে সব আমার সন্তানকে দিতে চেয়েছি । এতে যদি আমার জীবনে কোন প্রকার ঝুঁকি আসে তো আসুক আমি লড়াই করে নিবো । সিলেট থেকে ফেরার পর অনেক বার আপনাকে বলতে চেয়েছি কিন্তু সাহস জোটাতে পারিনি ।আমি জানি আমার কাজে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু আমি মা হয়ে কি করে আমার গর্ভের সন্তান কে হত্যা করতাম ? এতোটা সাহস যে আমার মাঝে নেই !
যেখানে আমার মা হওয়ার সম্ভাবনা ফিপটি পার্সেন্ট ছিলো সেখানে মহান আল্লাহ্ র দোয়ায় আমি সেই সৌভাগ্য লাভ করেছি । আমি কি করে আল্লাহ্ র এই দানকে অস্বীকার করতাম ? আমার যে এই বাচ্চাটা চাই অগ্নি ! ”
– “আমার তোমাকে চাই ।পৃথিবীর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই আমার শুধু আমার পরীজান কে চাই । বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেকটা নিশ্বাস এর জন্য শুধু তোমাকে চাই ।এবার আমার থেকে দূরে গেলে সত্যি সত্যি আমি মরে যাবো ।
আমার কোন বাচ্চা চাইনা আমার শুধু আমার হুরকে চাই । ব্যসসস ! ”
অগ্নি আমার কোলে মাথা রেখে এসব পাগলের মত প্রলাপ করছে । অগ্নির প্রত্যেকটা কথায় আকুল আবেদন । অগ্নির ভালোবাসার গভীরতা কতোটা তা আমার জানা । আল্লাহ্ না করুক যদি কোনদিন আমার কোন কিছু হয়েও যায় অগ্নি আমাদের সন্তানের মুখ দেখে কখনো তাকে দূরে ঠেলে দিবেনা । বুকের মাঝে নিয়ে ঠিক আগলে রাখবে । আমি অগ্নির চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলি ,
– “এমন বলতে নেই ,এই সন্তান আমাদের দুজনের অংশ । যদি আমার কখনো কিছু হয়েও যায় । আমাদের সন্তানের মাঝে আমার ছায়া পাবেন । ”
অগ্নি ধমকের স্বরে বলে,
– ” শার্ট আপ ,হুর ! আর কখনো এমন বাজে কথা বলবেনা । তোমার কিছু হবেনা । তোমার আমার জন্য বাঁচতে হবে । আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না । অগ্নির হুর শুধু অগ্নির কাছেই থাকবে । ”
অগ্নির ধমকে মুচকি হাসি । আমি জানি এই ধমকের পিছনে অফুরন্ত ভালোবাসা আছে । আমি পাশ থেকে মেডিসিন বক্সটা নিয়ে অগ্নির হাতে কাটা জায়গায় মেডিসিন লাগিয়ে দেই । অগ্নির মাথায় ঠোঁট ছুঁয়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলি ,
– “হুম , আপনার পরীজান শুধুই তার রাক্ষসরাজের ”
শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট :৪৯ (অন্তিম পর্ব )
সময় চলমান স্রোতের ন্যায় । নিজ গতিতে চলে । আস্তে আস্তে ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে আসছে । ডাক্টার আন্টি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সিজার করতে হবে । সিজার ছাড়া সম্ভব না ।মা আর বাচ্চা দুজনেরই প্রানের ঝুঁকি রয়েছে । যতদিন যাচ্ছে টেনশন আর ভয় বাড়ছে ।
আজ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বাস্তবতার মুখোমুখি হবো ।মনে একরাশ ভয় জমেছে । সুন্দর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে ভয় কেন ?
কারণ মা হওয়া চারটে খানি কথা না । একজন মহিলার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হলো মা হওয়া । সেই সাথে সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্তটাও সন্তান জন্ম দেওয়া । যদি তা সিজারিয়ান হয় তাহলে তো ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই ।সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যও অনেক সাহসের প্রয়োজন । এতো বড় একটা অপরেশন ভয় বুকটা চাপ ধরে আছে । তাই মায়ের রুমে মায়ের ছবির সামনে দাড়িয়ে আছি ।এই মানুষের ছবিই যথেষ্ট আমার মনে সাহসের জন্য । উনার প্রতিচ্ছবিই আমার মনোবল বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত !
ঠোঁটে কি সুন্দর হাসি ঝুলে আছে । চোখে মুখে তেজ । প্রত্যেকটা মেয়ের জন্য উনি আইকন । উনার জীবনী থেকে নতুন ভাবে বাঁচার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় । জানিনা জীবন কি মোর নিবে কিন্তু যদি বেঁচে ফিরতে পারি তাহলে মায়ের পথেই চলবো । বেস্ট মা হবো নিজের পরিচয় গড়ে তুলবো ।হঠাৎ অনুভব করি কেউ আমার কাঁধে হাত রেখেছে । আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি অগ্নি । চোখে মুখে ভয় আর টেনশনের ছাপ ।অগ্নি হাল্কা আওয়াজে বলে ,
– “আমাদের বের হওয়ার সময় হয়েছে ”
আমি মাথা হ্যা বোধক নাড়াই । অগ্নি আমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ,
– “কিছু হবে না । আল্লাহ্ র কৃপায় দেখবে সব ঠিক হবে ।”
আমি ভিতু ভিতু গলায় বলি,
– ” আমার খুব ভয় করছে ।”
-” ভয় পেওনা ,সব ভালো হবে । তুমি একটু সাহস রেখো । ”
আমি হ্যা বোধক মাথা নাড়ালাম । অগ্নি আমার কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয় । সব ফাইল সবকিছু রেডি করে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হই । পুরোটা সময় অগ্নির বুকে মাথা রেখে এসেছি । অগ্নির আমাকে সান্ত্বনা দিলেও সে নিজেই আমাকে নিয়ে আরো বেশি ভয় আর চিন্তায় রয়েছে ।
হসপিটালে পৌছানোর পর আমাকে অপারেশন বেডে নেয়া হয়। আমার শরীর ভয়ে কাঁপছে । অগ্নির দিকে অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে আছি অগ্নির চোখে ও জল চিকচিক করছে । কিছুক্ষণ পর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় ।
আমাকে আইভি ফ্লুইড দেয়া হয় ক্যানুলার মাধ্যমে। তারপর আমাকে অ্যানাসথেসিয়া করা হয়।ডাক্টার আমার সাথে কথা বলছে । আমাকে সাহস দিচ্ছে । কিছুক্ষণ পর আমার পেট পরিষ্কার করা হয় । এরপর কি হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারিনা ।বেশ খানিক সময় পর একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসে । এই কান্নার শব্দটা মধুর শব্দের মত আমার কানে বাজে । হৃদয়ের গহীন থেকে এক তীব্র সুখের অনুভূতি হয় । আমার চোখে থেকে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে । অদ্ভুত এক অনুভূতি । আমার ঠোঁটে হাসি চোখে জল ।নার্স বাচ্চা কোলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন ,”অভিনন্দন কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন ”
আস্তে আস্তে আমার চোখ বুজে আসে । কিন্তু তখনো ঠোঁটে হাসি বিদ্যমান !
জ্ঞান ফেরার পর দেখি ,অগ্নি আমার পাশে বসে আমার একহাত জড়িয়ে ধরে আছে । অগ্নির চোখ থেকে অনবরত পানি ঝোরছে। আমি পিটপিট চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেওয়ার চেষ্টা করি । অগ্নি আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলে ,
– ” এখন কেমন লাগছে ? ”
আমি চোখের ঝাপটা ফেলে উত্তর দেই যার অর্থ ভালো । অগ্নির চোখ থেকে একফোঁটা পানি আমার হাতে পড়ে ।অগ্নিরকে উদ্দেশ্য করে অভিমানী স্বরে বলি ,
– ” আপনাকে এতো বড় উপহার দিলাম । আর আপনি কান্না করছেন ? কেন আপনি কি খুশি হননি ? ”
অগ্নি হাতে চুমু খেয়ে । চোখের পানি নিয়েই মুচকি হেসে বলে ,
– ” পাগলি ,এই জল খুশির ।
তুমি আমাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছো । বাবা হওয়াটার অনুভূতি হওয়াটা যে এতো সুন্দর ,এতো সুখের অনুভূতি হয় তা আমার জানা ছিলোনা । তুমি আমাকে সেই সুখের সাথে পরিচয় করিয়েছো ।
বলো তোমার কি চাই ? আমি দুনিয়ার সব সুখ তোমার সামনে বিছিয়ে দিবো । ”
আমি একহাতে অগ্নির হাতের উপর আলতো স্পর্শ করে বলি ,
– “আমি সারাজীবন আপনার আর আমাদের মেয়ের সাথে বাঁচতে চাই । ”
অগ্নি আমার উত্তরে মুচকি হেসে আমার কাছে এসে আমার মুখে অনবরত চুমু দেয় । কিছুক্ষণ পর আপু আমাদের বাবু কে কোলে করে কেবিনে ডুকে । আপুর পিছনে বাকি সবাই ।সবাইকে দেখে আমি উঠে বসার চেষ্টা করলে অগ্নি আমাকে ধরে উঠে বসায় ।
আপু আমার কোলে বাবুকে দিয়েই আমার চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরে ।বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ছোট ছোট হাত ছোট ছোট আঙুল । চকচক চাহনি । একদম মায়ের মত সেই চাহনি ।
আমি চোখ বুজে আলতো করে বাবুর কপালে চুমু দিয়ে বলি ,
– ” তুই আমার আদ্রিতা ! মা ছেড়ে যাবার পর আমার জীবনে মায়ের অপূর্ণতা ছিলো । আজ সেই অভাবটাও তুই পূর্ন করে দিলি । আজ সঠিক অর্থে আমার জীবনের সকল চাওয়া পূর্নতা পেলো ।তোকে বুকে নিয়ে আমার সেই স্পর্শের অনুভব হচ্ছে । ”
অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখি ,অগ্নি গাঢ় চোখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে ।এই চাহনি তে সুখ , প্রাপ্তি ,খুশি স্পষ্ট !
এক এক করে সবার সাথে কথা বলি । কিছুক্ষণ পর আমাদের দুজনকে রুমে একা রেখে বাকি সবাই বেরিয়ে যায় । বাবু তখনো আমার কোলে । এতো দেখার পর ও কোন ভাবেই চোখের তৃপ্তি মিটছেনা । অগ্নি আমাদের দুজনের দিকে আগের দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে ।ঠোঁটে ঝুলন্ত হাসি !
আদ্রিতার উপস্থিতি আমাদের জীবনে খুশির বাহার নিয়ে এসেছে । আমাদের দুনিয়া আদ্রিতাকে ঘিরে । যে অগ্নি বাচ্চা কন্সিভ করায় আমার উপর রুষ্ট ছিলো ,সে এখন সারাদিন মেয়েকে নিজের বুকে জড়িয়ে রাখে । এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দেয় না । আমি বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে নিজের চোখ জুড়াই । সঠিক অর্থে জীবন বোধহয় এটাকেই বলে । যতবার অগ্নি আর আদ্রিতার দিকে তাকাই ততবার আমার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে । আমার মনে হলো এই বুঝি আমার জীবনের সব কষ্টের অবসান হয়েছে । কিন্তু বাস্তবতা ছিলো অন্যকিছু । আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার জীবন অভিশাপ্ত । এই জীবনে সুখ নামক সোনার হরিণ নেই ।আদ্রিতা জন্মের পনের দিনের মাথায় গভীর রাতে আমার খুব জ্বর হয় । চোখ খুলে রাখতে পারছিনা । অগ্নি জ্বর মেপে দেখে একশত পাঁচ ডিগ্রি জ্ব্রর । তার উপর সিজারের সেলাইয়ের সেই জায়গায় প্রচন্ড রকম ব্যথা হচ্ছে ।যদিও আগের থেকেই ব্যথা ছিলো কিন্তু এখন ব্যথা ক্রোমশ বাড়ছে ।
বিছানায় মরার মত অচেতন হয়ে পড়ে আছি । অগ্নি আমার এই অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে । দ্রুত হসপিটালে এডমিড করে । আমার পুরোপুরি ভাবে জ্ঞান ফিরে দুদিন পর । এই দুদিন কোনো কিছুরই আমার খেয়াল নেই । অচেতন ছিলাম । জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করি । শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই । পেটে অসহনীয় ব্যথা । পেটের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার পেটের সেলাই ছোটানো । নার্সরা ড্রেসিং করছে । অগ্নি অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । অগ্নিকে কিছু জিগ্যেস করলে অগ্নি চোখে জল নিয়ে কেবিন থেকে চলে যায় । আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি । আমাকে উত্তেজিত হতে দেখে নার্সরা কোনো রকম শান্ত করে । আমি শান্ত হয়ে উনাদের জিগ্যেস করতেই জানতে পারি ।
আমার সিজারিয়ানের সময় পর্দা সেলাইয়ের মাঝে একটা ভুলবশত করা হয়নি । আর আদ্রিতা গর্ভে থাকা কালিন সময় হ্ঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়ায় ডায়বেটিস হয় ,যার কারণে ভিতরের গাঁ শুকায়নি ইনফেকশন হয়ে পচন ধরে গেছে । অবস্থা খুব বেশি ক্রিটিকাল । কিছু বলা যাচ্ছেনা ।
সবশুনে আমি থম মেরে আছি । ডক্টরদের সামান্য ভুলের জন্য আমার জীবনে মৃত্যুর পথে । আমি অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছি । এমটাই কি আমার সাথে হওয়ার ছিলো !
আমার মেয়ের ভাগ্যে কি আমার মত হবে । মাতৃহীন সারাজীবন কাটাতে হবে ?
এই মুহূর্তে আমার মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে । কত স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম আদৌ কি তা পূর্ন হবে !
নার্সরা যাওয়ার সময় বলে দেই আমার বাড়ির লোকেদের ভিতরে পাঠাতে । কিছুক্ষণ পর আপু আদ্রিতা কে কোলে করে ভিতরে আসে । আমার একদম পাশ ঘেষে বসে ।আপুর চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে । নিশ্চিত কান্না করেছে । আমি নিজেকে খুব শক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছি । আমি শক্ত গলাই বলি,
– “আপু আদ্রি কে একটু আমার কাছে আনো ”
আপু আদ্রিকে আমার কাছে আনতেই আমি অনবরত আদ্রির সারামুখে চুমু দিতে লাগি ।চুমু দিতে দিতে একসময় কান্না করে দেই । আপুও আর নিজেকে আটকাতে পারেনা । আমার সাথে সাথে কান্না করে দেয় ।আপু আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে ,
– “বোন তুই কান্না করিস না । ডক্টর বলেছে তুই খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবি । ”
আমি আদ্রির দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলি ,
– “আপু কেন মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছো! আমি জানি আমি বাঁচবো না । আমার সময় ঘনিয়ে আসছে । কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে আমার মেয়েটার জন্য আমার মেয়েটার ভাগ্যে আমার মত হবে । মা ছাড়া জীবন কতোটা যন্ত্রনাদায়ক হয় আমি তা জানি ।কতো স্বপ্ন ছিলো অগ্নির সাথে আদ্রির সাথে বাঁচবো কিন্তু দেখ হলো কি ! কেন এমনটা শুধু আমার সাথেই হয় ? আমার ভাগ্যেটা এমন কেন বলতে পারো ? জীবনে সব পেয়ের পর হারিয়ে যায় । ”
আমি অনবরত কান্না করছি । কোনো ভাবেই শান্ত থাকতে পারছিনা । আদ্রিতা খাবারের জন্য কান্না করছে । আমি নিজের মেয়েকে খাওয়াতে পর্যন্ত পারছিনা। বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছিনা। কতো টা অভাগী মা আমি !
আপু আমাকে শান্ত করে আদ্রিকে খাওয়াতে বাহিরে নিয়ে যায় । আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি । আলো ছায়ার অদ্ভুত খেলা দেখছি ।এমন কেন আমার জীবন ? যদি কোনো কিছুর সুখ আমার জীবনে নাই থাকে তাহলে খানিকের জন্য দিয়ে পরে ছিনিয়ে কেন নেয় !
এমন সময়ই রুমে অগ্নির উপস্থিতি টের পাই । তাকিয়ে দেখি অগ্নি একপা একপা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে । এই দুদিনে নিজের কি অবস্থা করেছে । চোখের নিচে মোটা করে কালো দাগ পড়েছে । দেখে মনে হচ্ছে চোখে কালি লেপ্টিয়ে রেখেছে । চেহারা মলিন । উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল ।দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক পরাজীত সৈনিক !
উনি আমার অগ্নিই না এই যে এক অন্য অগ্নি !
অগ্নি আমার খুব কাছে এসে আমার গালে ঠোঁট ছোঁয়ায় ।টুলে বসে নিচু হয়ে আমার বালিশে মাথা রাখে । অগ্নির ভারী নিশ্বাস আমার গালে পড়ছে । আমি চোখ বন্ধ করে নেই । চোখের কোন গড়িয়ে পানি পরে । অগ্নি তখনো চুপচাপ । আমি চোখে বন্ধ করে ভারী স্বরে বলি ,
– “অগ্নি আপনি আমার জীবনে অমূল্য রত্ন । আপনাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি তা হয়তো কোন শব্দ বা বাক্যে প্রকাশ করা সম্ভব না ।ভালোবাসা কি আপনার থেকেই শিখেছি !
আপনি মানুন আর না মানুন আমি জানি আমার হাতে সময় খুব কম । আমার শরীরের কন্ডিশন খুব খারাপ । যে কোন সময় অঘটন ঘটতে পারে । এটাই এখন সবচেয়ে তিক্ত সত্য । আমি আমার মৃত্যুর পূর্বে কিছু ইচ্ছে আপনার কাছে বলতে চাই পূর্ন করবেন কি ? ”
অগ্নি চুপ উনার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ,আমি অগ্নির দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাই । অগ্নি আমার দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে । এই চোখে অজস্র যন্ত্রণা । আমার কথা গুলো অগ্নির বুকে সুঁই এর মত বিঁধচ্ছে তা আমি জানি । অগ্নির এই দৃষ্টি আমাকে আঙুল দেখিয়ে বলছে “হুর তুমি বড়ই নিষ্ঠুর ”
আমি নিজেকে একটু শক্ত করে বলি ,
– “কি রাখবেন না আমার শেষ ইচ্ছে ? ”
এবার অগ্নি অশ্রুতে টলটল করা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হ্যা বোধক মাথা নাড়ায় । আমি ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম ,
– “আমি চাই আমার মৃত্যুর পর আপনি ভেঙে পড়বেন না ,নিজেকে শক্ত রাখবেন। আমাদের আদ্রিকে সামলাবেন । তাকে বাবা মা উভয়ের আদর দিবেন । কখনো যেন তাকে আমার ভাগ্যের মত কষ্ট বইতে না হয় !
দুই , “শত ডানার প্রজাপতি ” এই ডাইরিটায় আমার সব অপূর্ন ইচ্ছে স্বপ্ন বন্ধি আছে । যা পূর্ন হয়নি ।আমার সেই প্রত্যেকটা ইচ্ছে স্বপ্ন আপনি আদ্রিকে নিয়ে পূর্ন করবেন । এতেই আমার আত্মা শান্তি পাবে ।
এই ডাইরি তে আমাদের সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ সবটা লিপিবদ্ধ আছে ,আমি চাই আদ্রি যখন বড় হবে তার বাবা মায়ের সম্পর্কের গভীরতা জানুক । এটা আদ্রির মায়ের তরফ থেকে তার জন্য শেষ উপহার !
আর আমার সর্বশেষ ইচ্ছে ,আমি শেষ বারের মত মামা মামী নিশিত উৎস ভাইয়া ,টিয়া আপু সবাইকে দেখতে চাই ”
অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝোরছে । আমি অগ্নির এই কান্না দেখে হাউমাউ করে কান্না করে দেই । অগ্নিও আমার সাথে কান্না করছে । আর বুকে জড়িয়ে নিতেও পারছে না পেট কাটা । আমার হাত জড়িয়ে ধরে অগ্নিও হাউমাউ করে কাঁদছে । আমি কান্নার মাঝেই অফুটন্ত স্বরে বলি ,
– “অগ্নি আমি বাঁচতে চাই ,আপনার সাথে আদ্রির সাথে বাঁচতে চাই । ”
মৃত্যু ভয় কতোটা কঠিন জিনিস আমি সেই সময় বুঝেছি । পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী সেই ব্যক্তি যে ব্যক্তি সুস্থ এবং যার পরিবার তার সাথে আছে । টাকা অর্থ সম্পদ খানিকে মোহ !
জিবন কতোটা মূল্যবান তা অসুস্থ হলে বোঝা যায় ।সেদিন হারে হারে টের পেয়েছিলাম !
ভালোবাসার মানুষ গুলোকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে করেই আমি হাজার দফা মরছিলাম । প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছি !
_____________
অগ্নি আর পড়তে পাড়লো না । বুকের বাঁ পাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে । ওহ কি অসহ্য যন্ত্রণা । চোখটাও ভরে এসেছে । এই চারবছরে কতো বার এই ডাইরিটা পড়েছে প্রত্যেকবারই একই রকম ভাবে বুকটা চিনচিন করে উঠে । চোখের কোনে জমানো অশ্রুটা মুছে অগ্নি দীর্ঘতর নিশ্বাস ছাড়ে । এমন সময়ই রুম থেকে আদ্রিতার কান্নার আওয়াজ অগ্নির কানে ভেসে আসে । অগ্নি ছুটে রুমে যেয়ে দেখে আদ্রিতার ঘুম ভেঙেছে । বিছানায় বসে বাবাই বাবাই বলে কান্নার করছে । অগ্নি মেয়ের কাছে যেয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে ,
– ” এই তো বাবাই ,মাম্মাম তুমি কান্না করছো কেন ? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো কি ? ”
আদ্রিতা টলটল চোখে তাকিয়ে হ্যা বোধক মাথা নাড়ায় । অগ্নি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে ,
– “কিছু হবে না ,এই তো বাবাই তোমার কাছেই আছি । ”
আদ্রিতা বাবার বুকে মাথা রেখে আহ্লাদী গলায় বলে ,
– “বাবাই ,মাম্মামের গল্প বলোনা । মাম্মামের গল্প শুনলে সব ভয় ভেনিশ হয়ে যায় ।
বাবাই মাম্মাম দেখতে কেমন ? ”
অগ্নি মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে মুচকি হেসে বলে,
– “তোমার মাম্মাম একদম পরীদের মত । যখন প্রথমবার তোমার মাম্মাকে দেখি মনে হচ্ছিলো পরীদের দুনিয়া থেকে এসেছে । এতোটা সুন্দর তোমার মাম্মাম । একদম আমার এই প্রিন্সেসের মত ! ”
আদ্রিতা বাবার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠে । কিছু একটা ভেবে আমার বলে ,
– “বাবাই ,কাল আমার বার্থডে আমরা মাম্মামের কাছে যাবো তো ? ”
অগ্নি আদ্রিতার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে ,
– “অবশ্যই ,প্রিন্সেস ! ”
আদ্রিতা বাবার বুকে মাথা রেখে মায়ের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায় । আদ্রিতা ঘুমাতেই অগ্নি বিছানায় শুয়িয়ে দেয় । মেয়ের মুখের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে অগ্নি । একদম মায়ের অবিকল ।হুরের মত চোখ মুখ ঠোঁট হাসি । পুরো মায়ের কপি । মায়ের মতই দুষ্টু !
সকাল সকাল আদ্রিতাকে নিয়ে অগ্নি বেরিয়েছে । কিছুক্ষণ পর কবর স্থানের সামনে গাড়ি থামে । অগ্নি মেয়ের হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে যায় । আদ্রিতা বাবার সাথে যাচ্ছে ঠিক কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা তার জানা নেই । ছোট্ট মস্তিষ্কে কিছু ডুকছে না । তাই আদ্রিতা বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করেই বসে ,
– “বাবাই আমরা এখানে এসেছি কেন ? এটা কোথায় ”
– “প্রিন্সেস এখানে দাদুনের কবর জিয়ারত করতে এসেছি । আজ তোমার জন্য অনেক বড় দিন তাই দাদুনের ব্লেসিং নিতে এসেছি । ”
আদ্রিতা এদিকে ওদিকে খোঁজাখুঁজি করে বলে ,
– “বাবা দাদুন কোথায় ? আমাদের সাথে থাকে না কেন ?
অগ্নি মেয়েকে একটা কবর দেখিয়ে বলে ,
– “ওই সেখানে দাদুন ঘুমিয়ে আছে । তুমি বড় আম্মুর সাথে থাকো আমি ভিতর যাই । কেমন ? ”
আদ্রিতা তার বাবার কথা মত হিয়ার সাথে বাহিরে দাড়ায় । অগ্নি ,আদিল আর আবির ভিতরে যেয়ে কবর জিয়ারত করে ।
____________
এয়ারপোর্ট এর সামনে অধীর কৌতূহল নিয়ে দাড়িয়ে আছে অগ্নি ,আদ্রিতা । আদ্রিতা বার বার ঘড়ি দেখছে । ইসস ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে কখন এখনো তার মাম্মাম বের হচ্ছেনা কেন ? উফফ কখন তার মাম্মাম বের হবে । কখন তাকে দেখবে ?
অগ্নির ও মেয়ের মত একই অবস্থা বার বার ঘড়ি দেখে চলছে আর সামনের দিকে তাকাচ্ছে । হ্ঠাৎ ই সামনের দিকে তাকিয়ে আদ্রিতার চোখ আটকে যায় । রয়েল ব্লু কালারের গ্রাউন পড়া একটা পরী আসছে । কি সুন্দর দেখতে একদম তার মতো । আদ্রিতা ছবিতে মাম্মামকে দেখেছিলো ।তবে এটাই কি তার মাম্মাম ? হুম এটাই তার মাম্মার । তার বাবা বলেছে তার মাম্মাম একদম পরীদের মত । আদ্রিতা ছুটে যায় সামনের দিকে । অগ্নি আদ্রিতার যাওয়ার দিক লক্ষ করে তাকিয়ে থমকে যায় । সময় যেন এখানেই থেমে গেছে । এই তো সামনে তার পরীজান দাড়িয়ে আছে । পুরো একবছর এক সাপ্তাহ পর দেখছে । অগ্নির বুক থেকে শান্তির এক শ্বাস বেরিয়ে আসে । অগ্নি থম মেরে দাড়িয়ে আছে । সামনের দৃশ্য দেখে চোখ ঝুড়াচ্ছে । অগ্নির পুরো পৃথিবী তার সামনে । আহ! কি মধুর দৃশ্য !
হুর মেয়েকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে । চোখ থেকে পানি ঝোড়ছে । আজ একবছর এক সাপ্তাহ পর মেয়েকে দেখছে । কত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা । আদ্রিতার হয়তো তার মায়ের মুখ মনে ও নেই । হুর আদ্রিতার ছোট ছোট হাতে চুমু খেয়ে বলেন ,
– “মিস ইউ মাম্মাম ,মিস ইউ আ লট ”
আদ্রিতা নিজের ছোট ছোট হাতে মায়ের মুখে হাত বুলিয়ে আধো আধো গলায় বলে ,
– “মাম্মাম তুমি সত্যি সত্যি বাবাই এর বলা পরীদের মত সুন্দর ! কি সুন্দ্রর ।
হুর মেয়েকে আবার জড়িয়ে ধরে অগ্নির দিকে তাকায় । অগ্নি লাগামহীন চাহনি তে হুরকে দেখছে । দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই হুর লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে ।
আদ্রিতা আমার বলে ,
– মাম্মাম জানো আমিও তোমাকে এতোগুলো মিস করেছি ।আমাকে আর রেখে যাবেননা ,হুম! ”
– “হুম ,প্রিন্সেস আর কখনো তোমাকে রেখে যাবো না। এখন থেকে আমরা সবাই একসাথে থাকবো । ”
আদ্রিতা মায়ের কথায় খুশিতে লাফালাফি করতে থাকে ।খুশিতে সবাইকে এই সংবাদ জানায় । হুর অগ্নির দিকে দিকে এগিয়ে যাই । এই মানুষটাই হুরের জীননের সবচেয়ে বড় সম্বল । আজ সে বেঁচে আছে এই মানুষটার ভালোবাসার জোড়ে । চার বছর আগে মৃত্যু দুয়ার থেকে হুর ফিরে এসেছে । মেডিকেল সাইন্স এ তার এমন অবস্থায় বেঁচে ফিরা অনেকটা অলৌকিক ঘটনার মত ।
যেখানে সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিলো হুরে বাঁচার সেখানে অগ্নি হার মানে নি । বাহিরে বিভিন্ন দেশে ডক্টর দের কাছে হুরের মেডিকাল রিপোর্ট মেইল করেছে । সবরকম পন্থা অবলম্বন করেছে । দিন রাত হুরের সেবা করে তাকে সুস্থ করেছে । তিনমাস হসপিটালে থাকার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে । স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আরো তিন মাস লেগেছে । আর পুরোটা সময় অগ্নি তার ঢাল ছিলো । আল্লাহ্ অশেষ কৃপায় আর অগ্নির দোয়া ,সেবা তেই হুর আজ বেঁচে আছে ।এই যে আজ হুর ইন্টার্নশিপ শেষ করে দেশে ফি্রেছে এর পিছনেও অগ্নির অবদান । হুর ইন্টার্নশিপের জন্য বাহিরে যাওয়ার জন্য একদম রাজি ছিলো না । হুরের খুব শক্ত জবাব ছিলো সে অগ্নি আর আদ্রিতাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা । কিন্তু অগ্নির জোরাজোরি সাথে পেরে উঠে না । অগ্নির হুরকে নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায় । হুরকে শুধু সংসার জীবনে বেঁধে রাখতে চায়না । স্বাধীন সফল দেখতে চায় । হুর যাওয়ার পর আদ্রিতাকেও নিজেই সামলায় । কষ্ট হয়েছে হুর কে ছাড়া থাকতে কিন্তু হুরের সফলতার জন্য সব কিছু সহ্য করতে পারবে !
কে বলেছে শুধু মাত্র পুরুষেরই সাফলতার পিছনে নারীর অবদান থাকে ? নারীর সাফলতার পিছনেও পুরুষের সমান অবদান থাকে । আর আজ যে হুর বেঁচে আছে এর পিছনে তার স্বামীর অবদান । হুরের জীবনটাই অগ্নির দান !
বাড়ি ফিরার পর সবাই হুরকে ঘিরে আছে । অগ্নি হুরের কাছে ভিরার চান্স পাচ্ছে না । হুর কে দূর থেকে দেখছে । আদ্রিতা হুরের গলা জুলে বসে আছে । হুর সবার সাথে গল্প করছে । মাঝে মাঝে অগ্নির সাথে চোখাচোখি হচ্ছে ।আদ্রিতার বার্থডে তে তার ফ্রেন্ডসরা এসেছে । সবার সাথে হুরের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে । আর বুক ফুলিয়ে বলছে “দেখেছো আমার মা কত সুন্দর ! একদম ডিজনি প্রিন্সেসদের মত । ”
হুর মেয়ে কান্ড দেখে হেসে যাচ্ছে ।আদিল ও ছোট বোনের সাথে তাল মিলাচ্ছে ।
হুরের মামা মামী শেফা তানবীর নিশিত উৎস সবাই আজ এখানেই থাকবে ।নিশিত প্রেগন্যান্ট খুব শিঘ্রই মা হবে । শেফা আর তানবীরের তিন বছরের একটা মেয়ে আছে ।
গভীর রাত আদ্রিতা কিছুক্ষণ পূর্বেই ঘুমিয়েছে । মায়ের সাথে হাজারো গল্প করেছে । জমানো সব কথা আজ মায়ের সাথে বলেছে । এখন বুকে মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে আছে । অগ্নিও পাশেই ছিলো খানিক আগেই বারান্ধার দিকে গেছে । হুর আদ্রিতাকে বিছানায় শুয়িয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়।এই বারান্দায় হুর অগ্নির হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে । হুর চোখ বন্ধ করে শান্তির নিশ্বাস নেয় । নিজের বাড়ির মত পৃথিবীর কোথাও শান্তি নেই ।
বারান্দার দরজায় দাড়িয়ে দেখে অগ্নি গভীর দৃষ্টি তে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ।হুর আলতো পায়ে অগ্নির কাছে যায় । পিছন থেকে অগ্নিকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । অগ্নি হুরের হাত টেনে , সামনে আনে । হুরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে ,
– ” এখন সময় হলো আমার কাছে আসার ? ”
হুর অগ্নির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে ,
– “কি করবো বলুন ? আপনার মেয়েই তো ছাড়ছিলো না । ”
– “তুমি পালাচ্ছিলে ,আর এখন আমার মেয়ের দোষ দেওয়া হচ্ছে ? ”
অগ্নি কথা বলতে বলতেই হুরকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে । ঘাড়ের কাছে মুখ ডুবিয়ে । বড় বড় নিশ্বাস টেনে নিতে নিতে বলে ,
– “বুঝলে সুন্দরী ? এতোটা বছরে কিছু পাল্টায়নি তুমি না আমাদের ভালোবাসা । আজও তোমার গাঁয়ের মিষ্টি ঘ্রাণ আমাকে পাগল দিশেহারা করে দেয় ।আজও আমি তোমার প্রেমেতে অন্ধ । দিন দিন তোমার সৌন্দর্য বাড়ছে আর আমাকে আরো বেশি পাগল করছে ! ”
হুর লজ্জায় মিলিয়ে যাচ্ছে । এখনো অগ্নির কাছে আসলে সেই প্রথম বারের মত অনুভূতি হয় । গাঁ ঠকঠক করে কাঁপে । অগ্নি হুরের থুতনি ধরে উঁচু করে বলে,
– “উফফ এই লজ্জা ! আমার মাথা ধরিয়ে দিলে সুন্দরী ।আর যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না । ”
বলেই আর এক সেকেন্ড দেরি না করে হুরকে কোলে তুলে নেয় । রুমের দিকে পা বাড়ায় ।ভালোবাসার রং এ আবার দুজনে মিলিয়ে একাকার হয়ে যায় ।
________________
অনেকটা বছর পেরিয়ে গেছে । এই তো প্রকৃতি প্রখর শীতের প্রভাব ছাড়িয়ে বসন্তের দিকে পা বাড়িয়েছে।গাছে গাছে নতুন পাতা জন্মাচ্ছে । প্রকৃতি নতুন রুপে সাজচ্ছে । এদিকে আদ্রিতা ঘুমে মগ্ন । একদম মায়ের রুপ রং পেয়েছে । অসম্ভব সৌন্দর্যের অধিকারী । সূর্যের আলো চোখের উপর পড়তে ঘুম ভাঙে । নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে দেখে তার বালিশের কাছে রেপিং কাগজে মোড়ানো একটা বইয়ের মত কিছু । আদ্রিতা চমৎকার এক হাসি দিয়ে চট করে উঠে বসে । কেলেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখে ডেটটা মার্ক করা । আজ তো তার আঠারো তম জন্ম দিন । সে ভুলেই গিয়েছিলো । তাড়াতাড়ি করে রেপিং কাগজ ছাড়িয়ে দেখে । উপরে লিখা “শত ডানার প্রজাপতি “এটাতো তার মায়ের ডাইরি । যার প্রতি তার কৌতূহল সেই ছোট থেকে । সাথেই একটা ছোট চিরকুট ।
” শুভ জন্মদিন মাই প্রিন্সেস । আমি জানি তোমার খুব কৌতূহল এই ডাইরিটা নিয়ে । আমি বলেছিলাম এটা তোমার আঠারো তম জন্মদিনের গিফট ।আজ তুমি আঠারো তে পা দিয়েছো । এখন থেকে এটা তোমার আমানত । ”
আদ্রিতা পাশের টেবিলে বাবার দেওয়া গিফট ,দামী ঘড়িটা পেলো । খুশিতে পুরো বাড়িতে নেচে বেড়াচ্ছে । সবাইকে দেখাচ্ছে । কিন্তু তার বাবাই আর মাম্মাম কোথায় ? সে জানে এই সময় তারা কোথায় থাকতে পারে !
বাগানের কাছে যেতেই দেখে অগ্নি আর হুর বাগানের বেঞ্চে বসে আছে । অগ্নি খুব আদুরে হাতে হুরের বিনুনি তে ফুল গেঁথে দিচ্ছে । হুর লজ্জায় জর্জরীত হয়ে যাচ্ছে । আদ্রিতা তার বাবাই মাম্মামকে দূর থেকে দেখে চোখ জুড়াচ্ছে । আজ এতোটা বছর পরও তাদের মাঝে এতো প্রেম !
এই যুগে এমন প্রেমিক যুগল পাওয়া সত্যি খুব দুর্লভ !
আদ্রিতার কাছে ভালোবাসার ব্যাখ্যা মানেই তার বাবাই আর মাম্মাম ।
সমাপ্ত ❤️