শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -৪৩+৪৪

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_43
#Writer_NOVA

বিয়ের দিন…..

গতকাল রাতে ঘুম হারাম আমার। সাড়ে তিনটার দিকে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সকালে উঠে চোখ ডলছি। রাতের পর থেকে এনাজ, তায়াং ভাইয়ার খবর জানি না। সামাদ ভাইয়াকে দেখে চেচিয়ে বললাম,

— রাতে কি খাইছিলা ভাইয়া? একেকজন যে টাল হয়ে পরে ছিলা। তা কোন জাদুর পানি পান করেছিলেন ভাইজান?

সামাদ ভাইয়া দ্রুত এগিয়ে এসে আমার মুখ আটকে ধরে বললো,
— চুপ কর। তুই তখন আমাদের রুমে গিয়েছিলি কেন?

ওর হাতে জোরে চিমটি দিতেই আহ্ বলে হাত সরিয়ে ফেললো। আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
— আমি সব ভিডিও করে রেখেছি। তোর বিয়ের প্যান্ডেলের মাঝখানে ল্যাপটপে ছেড়ে দিবো। আর যদি তাও না পারি তাহলে ভিডিওটা শুধু আব্বুকে দেখাবো। তারপর বাকিটা ইতিহাস 🥱।

— তুই এমন কিছু করবি না।

— আমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই ভাই। আমি দেখিয়েও দিতে পারি। তবে তুই যদি আমার মুখ বন্ধ করতে চাস তাহলে ১ হাজার টাকা দিতে পারিস। নয়তো ভিডিও ভাইরাল।

— এক টাকাও দিবো না। দেখি তুই কি করিস।

— ওকে আমি আব্বুর কাছে গেলাম।

আমি উঠোনের পশ্চিম দিকে যেতে নিলেই সামাদ ভাইয়া আমার হাত ধরে আটকে বললো,
— ৫০০ দিবো। কাউকে কিছু বলতে পারবি না।

— এক হাজারের মধ্যে এক টাকাও কম না। একে তো কালকে তোর স্টেজের জন্য খাবার ডিজাইন করতে গিয়ে আমার দেরী হইছে। একটু সাজতেও পারি নি।সবাই মিলে আমাকে বকছে। তার জন্য তুই টাকা দিসনি। আবার ৫০০ টাকা দিতে চাস। আরেকটা কথা বলবি দুই হাজার টাকা দিতে হবে।

— আচ্ছা যা মানিব্যাগ নিয়ে আয়। আমার রুমের টেবিলের ওপর দেখবি। কিন্তু ভিডিও কারো হাতে পরলে তোর খবর আছে।

আমি দৌড়ে ওর রুম থেকে মানিব্যাগ নিয়ে এলাম। সেটা ওর হাতে দিতেই ও বললো,
— একটা চেয়ার নিয়ে আয়।

রেগে ওর দিকে তাকাতেই শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— টাকা তো দিবোই। তাহলে একটু খাটিয়ে দেই।

চেয়ার আনতেই ও বসে মানিব্যাগ খুলে পাঁচশত টাকা সাধলো। কিন্তু আমি তো নিবো না। এক হাজার টাকা নিয়ে তবেই ওকে ছাড়ছি।সাথে আমার স্পেশাল ব্লাকমেইল তো আছেই। খুশিমনে টাকাটা ভাজ করে হাতে রেখে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

— বাকি দুই গাধাকে যে দেখছি না। উনারা কি উঠেছে? নাকি এখনো টাল হয়ে পরে আছে।

— আস্তে কথা বল।

— তোরা খেতে পারবি আর আমি বলতে পারবো না? খাওয়ার সময় মনে ছিলো না?

— চুপ করতে বলছি।

—ওকে আমি চুপ🤫।

— তুই কার কথা বলছিস?

— তায়াং ও এনাজ নামক দুই রামছাগলের।

— তায়াং, এনাজ, মুহিন ভোর সকালে শাহবাগ গিয়েছে বাসরঘরের ফুল আনার জন্য। এতক্ষণে তো চলে আসারও কথা।

— ওহ আচ্ছা।

ভাইয়ার অনেকগুলো বন্ধু আসতেই আমি কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। বাকিগুলো পরে পরে ঘুমাচ্ছে। অনন্যা উঠেছে আমার আগে। কিন্তু ওকে খুঁজে পাইনি। চোখ জ্বলছে। ঘুম না হওয়ার
ফল এটা।

ঘড়ির কাটা এখন দুপুর ১২ টার ঘরে। রুমে দরজা আটকিয়ে আমি, নূর আপি, তন্বী, অনন্যা, অর্থি বসে আছি। খুশিতে না ভাই। বাইরে রং দিয়ে একেকটাকে ভুত বানাচ্ছে। তার হাত থেকে রক্ষা পেতে। একটু আগে সবগুলো মিলে ভাইয়ার গোসলের জন্য কলসি করে পুকুর থেকে পানি এনে রাখতে না রাখতেই রং খেলা শুরু হয়ে গেলো। শুরুটা করেছে তায়াং ভাইয়া। তারপর একে একে সব। এখন বাইরে যাওয়া মানে যেচে বিপদ ডেকে আনা। আমি সুতি একটা থ্রি পিস নিয়ে গোসলে চলে গেলাম। আজ আমি গতকালের ভুল করছি না। গোসল থেকে বের হতেই দেখি সবগুলো রং দিয়ে ভূত হয়ে আছে।আমি হাসতে হাসতে খাটে গড়াগড়ি খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

— সবার এই অবস্থা কেন?

অনন্যা বললো,
— আমাকে ছোট মামা ডাক দিছে। আমি প্রথমে যেতে চাই না। তারপর জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম রং খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ভালো বলে গেলাম। মেজু নানাভাই মুখে অল্প একটু রং দিলো। তারপর সবাই একসাথে আমাকে ধরলো। আর বাকি সবাইকে বাইরে টেনে নিয়ে ভুত করছে।

আমি হাসি আটকিয়ে বললাম,
— একদম ঠিক হয়েছে। বলছিলাম কেউ ডাক দিলে যেতে না। গেলি কেন?

অর্থি শরীরের রংগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে আমাকে বললো,
— আমি তো ভালো মনেই গেলাম। তারপর এই অবস্থা।তুমি বাইরে যাইয়ো না নোভা খালামণি। তায়াং মামা আর এনাজ আঙ্কেল তোমাকে খুজতাছে।

নূর আপি বললো,
— তুই গোসলে গিয়ে বেঁচে গেছিস। নয়তো তোর অবস্থাও আমাদের হতো।

— হইছে আর কথা বলো না। সবাই একে একে গোসলে ঢুকে যাও। নয়তো সাজতে দেরী হবে।

বারান্দার দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম সবগুলো রং খেলে এখন পুকুরে গোসল করতে নেমেছে। শুধু শুধু চিল্লাচিল্লি করছে আর ডুবাচ্ছে। আমি দরজা আটকে সাজতে বসে পরলাম। আজ আর গতকালের মতো ভুল করছি না।

💖💖💖

পেস্ট কালারের লেহেঙ্গার সাথে গোল্ডেন রঙের হিজাব বেঁধে হাই হিল পরে নিলাম। বাইরে বের হয়ে দেখি আব্বু, চাচ্চু,ভাইয়ারা রাগারাগি করছে। এখনো অনেকের রেডি হওয়া বাকি আছে। আমি আজ সবার আগে তৈরি হয়ে গেছি। বাকি সবাই তাড়াহুড়ো করছে। ছেলেরা জুম্মার নামাজ পরে চলে এসেছে কিন্তু এখনো মেয়েদের সাজগোজ হয়নি। আমি বের হতেই তায়াং ভাইয়া ও এনজিও সংস্থাকে দেখতে পেলাম। তায়াং ভাইয়া কালো কোর্ট-প্যান্ট পরেছে। এনাজের পরনে সাদা কোর্ট-প্যান্ট ভেতরে পেস্ট কালারের শার্ট। অনেকটা আমার সাথে ম্যাচিং। আমি ওদের সাথে কথা না বলে সাইড কেটে যাওয়ার সময় এনাজ নিচু স্বরে কানের কাছে বললো,

—সবকিছু আছে তবুও মনে হচ্ছে কিছু নেই। বলতো কি নেই? ওহ হ্যাঁ পেয়ে গেছি। আমার আমিটাই নেই আমার কাছে। থাকবে কি করে বলো তো? সে যে বহু আগে তোমাতে হারিয়ে গেছে। মনে রেখো প্রিয়, তোমাতেই আমি এবং আমাতেই তুমি।

তার নিচুস্বরে বলা কথাগুলো মনের মধ্যে একটা ঝংকার তুলে দিলো। হুট করে একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো আমায়। মাথা নিচু করে সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে আবারো বললো,

— মা শা আল্লাহ টিডি পোকা। এত সাজছো কেন? আমিই তো আজ তোমায় দেখে হার্ট অ্যাটাক করবো। অন্য ছেলেদের কি হবে? আমার প্রতিযোগী বাড়ানোর জন্য এত সাজছো তুমি?

আমি কোন কথা না বলে মুখ ভেংচি দিয়ে সরে গেলাম। একটার সাথেও কথা বলবো না। কালকে ড্রিংক করছে কেন? তার জন্য এটাই ওদের শাস্তি। অবশেষে পৌনে তিনটায় সবাই রেডি হয়ে আসতেই আমাদের HICE ছাড়লো। তায়াং ভাইয়া এনাজের সাথে যেতে বলেছিলো। কিন্তু আমি ওদের কথা না শুনে এক প্রকার ত্যাড়মি করেই হাইসে চলে আসি।

মেয়ের বাড়ি আমাদের পাশের উপজেলায়। আসতে প্রায় আধা ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। বিয়ে বাড়িতে আসার পর ভাইয়াকে তার শালীরা গেইট আটকায়। এখন দশ হাজার টাকা না দিলে ছাড়বে না। তায়াং ভাইয়া, মুহিন, এনাজ, দুলাভাই মিলে বুদ্ধি করে ওদের হাতে চার হাজার ধরিয়ে দেয়। বেচারীরা তো মানবে না। কিন্তু মিচকা শয়তানগুলোর সাথে কি এরা পারবে। অবশেষে ফিতা কেটে ভাইয়ার সাথে সাথে আমরা ভেতরে ঢুকি। ভাইয়াকে স্টেজে বসিয়ে সাগরআনা দিয়েছে। কিন্তু আমি,নূর আপি,ইভা ও তন্বী টেবিলে খেতে বসেছি। ভাইয়ার সাথে অনন্যা, অর্থি, ঐশী, আশা ভাইয়ারা বসেছে। তন্বী, তায়াং ভাইয়াকে বললো,

— ভাইয়া কম করে খাস। নয়তো পেট খারাপ করবে।

ভাইয়া রেগে তাকাতেই তন্বী চুপ হয়ে গেলো। আমি এখন অব্দি তায়াং ভাইয়া ও এনাজের সাথে একটা কথাও বলিনি। নূর আপিও না। এনাজ অনেকবার কথা বলতে এসেছিলো আমি এড়িয়ে গেছি। খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে অন্য দিক দিয়ে আসতে নিলেই একটা হাত এসে আমার হাত টেনে ধরে একটা ঘরের আড়ালে নিয়ে গেলো। আমি চিৎকার করতে গেলেই সে মুখ আটকে বললো,

— আস্তে আস্তে টিডি পোকা করো কি? আমাকে গণধোলাই খাওয়াবে নাকি?

আমি তার হাত আমার হাত ও মুখের থেকে সরিয়ে চলে যেতে নিলে উনি হাত আটকে বললো,
— হয়েছি কি তোমার? সকাল থেকে দেখছি আমাকে ইগনোর করছো। কি করেছি আমি?

আমি কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
— এখন সাধু সাজা হচ্ছে? আপনি জানেন না কি হয়েছে?

— জানলে কি জিজ্ঞেস করতাম?

— জানেন না যখন তাহলে আর জানতে হবেও না।

— প্লিজ, প্লিজ বলো না আমি কি করছি? আমার ভুল হলে আমি অবশ্যই মাফ চাইবো। তোমার ইগনোর আমার সহ্য হচ্ছে না।

— রাতে কি খাইছেন?

— বিরিয়ানি।

— আর কি খাইছেন সাথে?

আমি রেগে কথাটা বলতেই উনি মাথা চুলকে অপরাধী ভঙ্গিতে বললো,
— আসলে সবার সাথে সাথে আমিও একটু খাইছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারি নাই তুমি দেখলে নারাজ হইবা।

— না, আমি খুশি হবো।এত খুশি হইছি যা বলার বাইরে। এগুলা খাওয়া যে হারাম তা কি আপনি জানেন না?

— হু জানি তো। বললাম তো সবার তালে তালে খেয়ে ফেলছি।

— তাহলে এখন সবার সাথে তালে তাল মিলিয়ে থাকেন। আমার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করবেন না।

— এই না না প্লিজ এমন করো না। তুমি এখন যা শাস্তি দিবে তাই মেনে নিবো। তবু তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করো না।

— দশবার কান ধরে উঠবস করেন।

— কি?

— নয়তো আমি আপনার সাথে কথা বলবো না।

এনাজ ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
— না করলে হয় না।

— না হয় না।

— আচ্ছা করতেছি। মান-সম্মান আর কিছু রাখলা না। তুমি একটু পাহারা দিও কেউ যাতে না আসে।

এনাজ কান ধরে উঠবস করা শুরু করলো। আমার পেট ফেটে হাসি আসছে। কোনরকম সেটাকে আটকে রাখছি। পাচবার শেষ হতেই বেচারা আমার দিকে করুণ মুখে তাকালো। যার অর্থ বাকি পাঁচটা মাফ করে দাও। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সেটা দেখেও দেখলাম না। তার সাথে আমি অবশ্য এখন আর রেগে নেই। কেন জানি তার উপর রাগ করে থাকতেই পারি না। তবুও তাকে শাস্তি পেতে হবে। যদিও শাস্তিটা কম হয়ে গেছে। তবে পরেরবার একি কাজ করলে খবর আছে। দশবার উঠবস করতেই কারো গলার স্বর পেয়ে বেচারা আমার সামনে থেকে দ্রুত কেটে পরলো।দুজন লোক কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। সে যেতেই আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। অনেকখন ধরে হাসি আটকে রাখছিলাম।এখন আর সম্ভব নয়। বেচারার মুখটা দেখার মতো ছিলো।

সেখান থেকে প্যান্ডেলের কাছে আসতেই দেখি ভাইয়ার জুতা লুকানো নিয়ে দুইপক্ষের কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আমি আস্তে করে বাসার ভেতরে ঢুকে গেলাম। এই ভেজালে আমি নেই। মারিয়া মানে ছোট ভাবীর সাথে কতগুলো ছবি তুলে বাইরে চলে এলাম। অনেকখন ধরে তায়াং ভাইয়া ও নূর আপিকে খুঁজে পাচ্ছি না। তন্বীকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এই তায়াং ভাইয়া আর নূর আপি কোথায়রে? তাদের কি দেখেছিস?

— আমিতো একটু আগে এদিকেই দেখছিলাম। এখন বলতে পারছি না৷

আমি বাইরে চলে এলাম। এনাজকে সামনে দেখে ডাকলাম।

— এই যে মিস্টার এনজিও সংস্থা এদিকে আসেন।

— জ্বি মিস টিডি পোকা বলুন। আপনার কি সেবা করতে পারি?

— নূর আপি আর তায়াং ভাইয়া কোথায়?

— আমিও অনেকখন ধরে তায়াংকে খুঁজতেছি। কিন্তু পাচ্ছি না। ওরা গেলো কোথায়? চলো দুজন মিলে খুঁজি।

আমি ও এনাজ এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুজতে বাড়ির পাশের এক বালুর মাঠে চলে এলাম। লেহেঙ্গা উঁচু করে হাঁটতে গিয়েও আমি পিছিয়ে পরছি। হাই হিল পরে বালুর মধ্যে কি হাঁটা যায়? এনাজ পেছনে এসে আমার এক হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। আমার এক দূর সম্পর্কের চাচ্চুকে দেখে আমি দ্রুত হাত সরিয়ে ফেললাম। উনারা গাড়ির দিকে যাচ্ছে। আমাদের এভাবে দেখে ফেললে ঝামেলা হবে। এনাজ প্রশ্নবোধক চাহনিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি ইশারা করে নিচুস্বরে বললাম,

— আমার এক চাচ্চু এদিকে আসছে।

এনাজ সেদিকে তাকিয়ে আর কোন কথা বললো না। বালুর মাঠেই তায়াং ভাইয়া ও নূর আপিকে দেখা যাচ্ছে। তাদের কিছুটা সামনে গিয়ে দেখলাম……
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_44
#Writer_NOVA

এনাজ সেদিকে তাকিয়ে আর কোন কথা বললো না। বালুর মাঠেই তায়াং ভাইয়া ও নূর আপিকে দেখা যাচ্ছে। তাদের কিছুটা সামনে গিয়ে দেখলাম তায়াং ভাইয়া কানে ধরে দাঁড়িয়ে আপির রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। আমি তা দেখে জোরে হেসে উঠলাম। ভাইয়া আমাদের দেখে দ্রুত কান ছেড়ে এগিয়ে এসে বললো,

— সব দোষ তোর শাঁকচুন্নি। তুই ভিডিও কেন করছিস? করছিস ভালো কথা তা নূরকে দেখানোর কি দরকার ছিলো?

— একদম ঠিক করেছি। খাওয়ার সময় এসব কথা মনে ছিলো না।

— ভিডিও জলদী ডিলিট কর।

— একটুও করবো না। এগুলো প্রমাণ। তোরা যে কত ভালো মানুষ তার প্রমাণ রেখে দিয়েছি।

এনাজ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,
— ভাই, ভাবীর রাগ ভাঙছে?

— না, নূর কিছুতেই মানতাছে না।

— আমাকে দশবার কান ধরে উঠবস করাইছে। না করলে আমার সাথে কথাই বলতো না।

— এই ছেমরি যত নষ্টের মূল।

আমি রেগে দুই হাত কোমড়ে রেখে বললাম,
— একদম আমার সাথে রাগ দেখাবি না। নয়তো আগুনে আরো ঘি ঢালবো। নূর আপি ও নূর আপি। দেখো তায়াং ভাইয়া আমাকে বকছে। তোমাকে ভিডিও দেখাইছি বলে।

তায়াং ভাইয়া খাইয়া ফালামু লুক দিলো।তাতে আমি একটুও ভয় পেলাম না। নূর আপি গতকাল রাতে আমাদের সাথে ছিলো না। পরে আমি তাকে ভিডিওটা দেখিয়েছিলাম। তাতে আপি ভাইয়ার ওপর হেব্বি রেগে আছে। আমার মন বলে নূর আপিও ভাইয়াকে পছন্দ করে। কিন্তু প্রকাশ করে না। নূর আপি সামনে এসে বললো,

— কি হয়েছে নোভা?

— দেখো না নিজেরা খেয়েছে তাতে দোষ হয়নি। আমি ভিডিও করে তোমাকে দেখিয়েছি তাতে দোষ হয়ে গেছে।

— ছাইপাঁশ গেলার সময় মনে থাকে না। এখন ভিজে বেড়াল সাজা হচ্ছে।

তায়াং ভাইয়া আমার হাত ধরে অন্য দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে নরম সুরে বললো,
— বোইন ভিডিওটা ডিলিট করে দে না।

— গলার স্বর এতো মিষ্টি কেন ভাইয়া? তুই ঠিক আছিস তো? তিতা করলা আজ মধুর মতো মিষ্টি লাগছে। কুছ তো গড়বড় হে 🤔।

— যা বলছি তা শুন।

— একটুও ডিলিট করবো না। খালুর ইমো তে পাঠিয়ে দিবো। তাকে দেখাতে হবে তো তার গুণধর ছেলে কিভাবে তার মুখ উজ্জ্বল করছে।

— এখন কি তোর পায়ে ধরতে হবে?

— কিছুই করতে হবে না।

— কত টাকা লাগবে তোর?

আমি রেগে বললাম,
— ঐ পাইছিস কি? সবসময় টাকার গরম দেখাস কেন?

— তুই ঘুষ নিস তাই আরকি।

— তুই কিন্তু আমায় ইনসাল্ট করছিস পাঠা।

—আচ্ছা চল এখুনি তোকে আর নূরকে নিয়া মাওয়া ঘুরতে যাবো। এখান থেকে তো সামনেই।তাও তুই ভিডিও ডিলিট করে দিস।

— তোর বাইক আনছিস?

— হ্যাঁ, সকালে ঢাকায় ফুল আনতে গিয়েছিলাম।তখন নিয়ে আসছি।

— ঠিক আছে মাওয়া ঘুরতে নিয়ে গেলে ভেবে দেখবো ভিডিও রাখবো নাকি রাখবো না। তবে নূর আপিকে রাজী করার দায়িত্ব তোর।

— আচ্ছা৷ তবে ভিডিও ডিলিট তোকে করতে হবে।

— আগে তো ঘুরতে নে তারপর।

ভাইয়া ও এনাজ অনেক কষ্ট করে নূর আপিকে রাজী করালো। আমরা বাড়ির দিকে গেলাম। বিদায়ের পালা ঘনিয়ে আসছে। মামী ওরফে ভাইয়ার শাশুড়ী কান্না জুড়ে দিতেই একে একে সব কান্না শুরু করলো। আমি সেদিক থেকে সরে এলাম। আমি এখানে থাকলে ইমোশন হয়ে যাবো। সব একে একে বেরিয়ে পরলো। রাস্তার আসার ভাবীকে ধরে তার দুই ভাই সেকি কান্না। আমার চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। আমিও তো একদিন সবাইকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবো। তায়াং ভাইয়া এক দৃষ্টিতে ভাই-বোনের কান্নার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর সামনে গিয়ে বললাম,

— ভাইয়া, একদিন আমি ও তন্বীও তোকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবো। সেদিন তুইও এভাবে কাঁদবি। এক হিসেবে তোর ভালো হবে। তোকে কেউ ডিস্টার্ব করবে না, জ্বালাবে না। তোর শান্তির দিন চলে আসবে। আদোও কি শান্তিটা তোর ভালো লাগবে?

ভাইয়া উত্তর দিলো না। গোমড়া মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি চোখের কোণে থাকা পানিটা ওর আড়ালে মুছে এনাজের বাইকে উঠে বসলাম। হাইস, বাইক একসাথে চলতে লাগলো। শ্রীনগর মেইন রাস্তায় এসে হাইস পূর্বে বাড়ির দিকে ছুটলো। আর আমরা দক্ষিণে মাওয়ার দিকে। একটানে বাইক এসে থামলো মাওয়া ফেরি খাটে। বাইক পাশে রেখে আমরা চারজন নেমে দাঁড়ালাম।

মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সেই তালে পদ্মা নদীর ঢেউগুলো নাচছে। দুই হাত বাড়িয়ে ওড়নাটাকে মেলে দিয়ে টাইটানিক পোজে দাঁড়ালাম। পেছনে এনাজ দাঁড়িয়ে। সাথে নূর আপি। তায়াং ভাইয়া আমাদের জন্য কোল্ড ড্রিংকস আনতে গিয়েছে। একটু আগের মন খারাপ লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। নদীর বড় বড় ঢেউগুলো পাশে এসে আছড়ে পরছে।এনাজ সেদিকে তাকিয়ে বললো,

— ওয়েদারটা কি জোস তাই না? সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহুর্ত। পাখিরা তার নীড়ে ফিরছে। আবছা হালকা কুয়াশার চাদরে চারিপাশ ঢেকে আছে। আমার তো এমন ওয়েদার দেখে প্রেম প্রেম পাচ্ছে।

আমি ও নূর আপি মিটমিট করে হাসলাম। চোখ বন্ধ করে আবারো হাত দুটো মেলে দিয়ে বড় করে শ্বাস নিলাম। মনে হচ্ছে টাইটানিক জাহাজেই আছি। নদীর ঢেউগুলো উপভোগ করছি। তায়াং ভাইয়া চারটা সেভেনআপের ক্যান নিয়ে এসে বললো,
— আজকের ওয়েদারটা কিন্তু সেই লাগছে।

এনাজ তার সাথে গলা মিলিয়ে বললো,
— আমিও তাই মাত্র বললাম। এর আগেও কয়েকদিন তোর সাথে যে মাওয়া ঘাটে ঘুরতে এলাম তখন এতটা ভালো লাগেনি। আজ খুব ভালো লাগছে।

— ভালো লাগলেও বেশি সময় থাকতে পারবো না।

আমি ও নূর আপি একসাথে বলে উঠলাম
— কেন?

💖💖💖

তায়াং ভাইয়া আমাদের হাতে ক্যান দিয়ে নিজেরটা ভেঙে মুখে দিয়ে বললো,
—সামাদ ভাইয়া কল করেছিলো। আমরা কোথায় তাই জিজ্ঞেস করছে। বাসরঘর সাজার দায়িত্ব আমাদের। এখন না গেলে সারারাত লাগবে বাসরঘর সাজাতে। তাহলে বেচারা ভাইয়ের বাসরই মাটি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— বাসরঘর কে কে সাজাবে?

এনাজ বললো,
— তুমি, আমি, নূর আপি, তায়াং, অনন্যা, মুহিন।

— তাহলে তো অনেক মানুষ। বেশি সময় লাগবে না। আরেকটু থেকে যাই।

তায়াং ভাইয়া ক্যানের সবটুকু সেভেন আপ এক চুমুকে খেয়ে ক্যানটাকে লাথি মেরে দূরে ফেলে বললো,
— ওকে। তবে বেশি সময় নয়।

নূর আপি অপরাধী সুরে বললো,
— তন্বী যদি জানতে পারে ওকে ছাড়া আমরা মাওয়া ঘুরতে এসেছি তাহলে নির্ঘাত আমাদের সাথে রাগ করবে। ওকে কেউ ভুলেও বলেন না যে ঘুরতে এসেছি এখানে।

তায়াং ভাইয়া এনাজের হাত থেকে ক্যানটা ছোঁ মেরে নিয়ে দুই ঢোক খেয়ে বললো,
— জানলে জানবে। বলবা তোর বয়ফ্রেন্ড থাকলে তোকে নিয়ে যেতাম। কিন্তু তোর তো বয়ফ্রেন্ড নেই তাই তোকে নেইনি।

নূর আপি তায়াং ভাইয়ার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই ভাইয়া বেক্কল মার্কা হাসি দিলো।আমি মিটমিট করে হেসে বললাম,
— তুই কি বড় ভাই নাকি অন্য কিছু?

— অবশ্যই বড় ভাই।

এনাজ পশ্চিম দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,
— তায়াং চল ঐদিকটায় যাই।

আমরা পশ্চিম দিকে চলে গেলাম। নদীর পাড়ে নেমে লেহেঙ্গা উচু করে ধরে পানিতে পা ভেজাতে লাগলাম। ইস, কত দিন পর এতো মজা করতে পারছি।ভাবতেই মন খুশি হয়ে গেলো।খুশিতে বালুর ওপর কয়েকটা লাফও দিলাম।এনাজ তায়াং ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— তোর বোনকে টিডি পোকা কি আমি সাধে বলি? দেখ কেমন টিডি পোকার মতো লাফাচ্ছে। লেহেঙ্গা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেদিকেও খেয়াল নেই।

আমি জিহ্বা বের করে এনাজকে ভেংচি কেটে নদীর পাড়ে হাঁটতে লাগলাম। এনাজ আমাদের ছবি তুলছে। তায়াং ভাইয়া ও নূর আপির অনেকগুলো ছবি তুলে দিলো। তারপর তায়াং ভাইয়ার হাতে মোবাইল দিয়ে বললো,

— এবার আমাদের দুজনের ছবি তুলে দে।

আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি কিছুটা দূরে সরে যেতে চাইলে বাহুতে ধরে তার পাশে দাঁড় করে রাখলো। চারজন মিলে অনেক ছবি তুললাম। পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পরেছে সেই কবে। আজানও দিয়ে দিছে বহু আগে। বেশি দেরী না করে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। বেশি রাত হয়ে গেলে সমস্যা। এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও মাওয়াকে বিদায় জানিয়ে ফিরতেই হবে। মাওয়ার রাস্তাটা দিনের থেকে রাতে বেশি সুন্দর লাগে। দুইপাশের আলোক বাতি গুলো সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।আসার সময় সারা রাস্তায় মন খারাপ ছিলো। এনাজ আমার মন খারাপ দেখে বাইক চালাতে চালাতে বললো,

— মন খারাপ করো না। আমরা আবার আসবো।

তার আশ্বাসেও মন ভালো হলো না। বাসায় আসতেই সামাদ ভাইয়া বকা শুরু করলো। এশারের আজান দিয়েছে কিছু সময় আগে। কোনরকম ফ্রেশ হয়ে তার বাসরঘর সাজাতে ঢুকলাম। তায়াং ভাইয়া, এনাজ শুধু কোর্টটা খুলে কাজে লেগে পরেছে। আমি ও নূর আপি ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকতেই অনন্যা চেচিয়ে বললো,
— এই তোমাদের আসার সময় হলো? অন্য দিকে আমার ছোট মামা পাগল হইয়া যাইতাছিলো। ওরা আসে না কেন? কবে আসবো? আমার বাসরঘর কি সাজাইবো না ওরা।

আমি ফুলের মালায় গিট দিতে দিতে বললাম,
— বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে যা হয় আরকি?

এনাজ স্টেন্ডে ফুলের মালা লাগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— কথাটা ঠিক নয়। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করতে পেরেছে বলে তার এমন এক্সপেরিমেন্ট কাজ করেছে। বয়সের জন্য না।

এনাজের কথার মাঝেই তার পকেটে থাকা মোবাইল চিৎকার করে উঠলো। এনাজ মোবাইল বের করে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— ইমরান কল দিয়েছে।

তায়াং ভাইয়া ফুলে টেপ পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,
— রিসিভ করে কথা বল। লাউড বাড়িয়ে দিস।

এনাজ কল রিসিভ করে লাউড স্পিকার বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— হ্যাঁ ভাই বল। কি অবস্থা তোর?

— তুই এখন কোথায়?

— গুলিস্তানে ওভার ব্রীজের নিচে ফুটপাতে বইসা জামা-কাপড়ের বেচতাছি। বাইছা নেন ১০০, বাইছা নেন ১০০ যেটা নিবেন সেটাই ১০০। তুইও আয়। একসাথে বিক্রি করি ভালো লাভ হবে।

— কবের থেকে শুরু করলি এই ব্যবসা?

— এই তো তিনদিন ধইরা।

— ভালো ভালো ব্যবসা কর তাহলে।

— কানের নিচে দুইটা দিয়া বয়রা বানাবো শালা। তুই জানিস না আমি কোথায় আছি?

আমি আর ওদের কথায় মনোযোগ দিলাম না। ইতিমধ্যে আমি, অনন্যা, নূর আপি হাসির প্রতিযোগিতা লাগিয়েছি। এনাজ ইমরান হাশমি ভাইয়াকে বেশ কিছু সময় ঝেরে কল কেটে দিলো। সাড়ে সাতটার সময় ঢুকেছি। এখন দশটার বেশি বাজে। তবুও মনে হচ্ছে শেষ হচ্ছে না কাজ। এরা একটা বোকামি করেছে। ফুলের মালা কিনে না এনে বস্তা ভরে ফুল কিনে এনেছে। সেগুলো মালা করতে গিয়ে সবার দফারফা। আমি ও নূর আপি তো মুহিন, এনাজ, তায়াং ভাইয়াকে মালা বানাচ্ছি আর বকছি। মুহিন বললো,

— আমাকে বকবি না। আমার কোন দোষ নাই। আমি তাদের বলছিলাম মালা কিনে আনতে। কিন্তু এরা আমার কথা শুনেনি।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— সবাই ভালোর ছালা। আমাদের হাত দুটো আর রইলো না। কতগুলো সুচের খোচা খাইছি। হাত এখন জ্বলতাছে।

এখন রাগ লাগছে। আমরা মেয়ে তিনজন মালা বানাচ্ছি আর ছেলে তিনটা সেগুলো দিয়ে সাজাচ্ছে। তন্বী,অর্থি, ইভার খবর জানি না। সেই যে সাতটায় ঢুকছি তারপর বাইরের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সবাই এখন বউ নিয়ে ব্যস্ত।তাই এদিকে তেমন কেউ আসেও না। সাড়ে এগারোটার নাগাদ রুম পুরো কমপ্লিট করে বের হলাম। বসে থাকতে থাকতে কোমড় ধরে গেছে। মুহিন, তায়াং ভাইয়া, এনাজ তিনটা ঘেমে গোসল করে ফেলছে। ওরা ফ্রেশ হতে চলে গেল। গরমে একেকটা সিদ্ধ হইছি। ফ্যানের সাথে গোল করে ফুলগুলো সাজানোর দরুন ফ্যান অফ ছিলো। এতে একেকটা গরমে শেষ। ১২ টা বাজে ভাবীকে বাসরঘরে বসিয়ে দিয়ে ভাইয়ার থেকে রুম সাজানোর পারিশ্রমিক নিয়ে তবেই তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলাম।

ওরা তিনজন ফ্রেশ হয়ে আসতেই আমরা সবগুলোতে উঠোনে চেয়ার পেতে বসে গল্পের আসর জমালাম। এক পাশে মহিলারা আগামীকালের রান্নার জন্য পাটায় মসলা বাটছে, আরেক দিকে পেয়াজ, মরিচ কাটছে। উত্তরপাশে মুরগী জবাই করছে। সেখানে বসে আব্বু, চাচ্চুরা পুরনো দিনের গল্পের আসর বসিয়েছে। অপরপাশে আমরা।আজ দেরী করে ঘুমাবো। রাত দুটো অব্দি গল্প করে তারপর ঘুম। এর আগে নয়।

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here