” ডিভোর্স! আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম শুভ্রতা আর আজ কি না তুমি আমার থেকে আলাদা হতে চাইছো? আমাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে? আমি ছাড়া অন্য পুরুষ যখন তোমায় ছোঁবে তখন তোমার গা ঘিনঘিন করবে না?”
ইমতিয়াজের কথার পরিপ্রেক্ষিতে শুভ্রতা নরমস্বরে বলে ওঠে,
” আমি বাঁচার মতো বাঁচতে চাই ইমতিয়াজ, তার জন্য ডিভোর্সই একমাত্র পথ।”
” তুমি যা বলবে আমি তাই করব শুভ্রতা। প্লিজ আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। তুমি তো জানো তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমিই একমাত্র আশ্রয়স্থল। ”
” হ্যাঁ আমি ছাড়া তোমাকে কেউ টাকা দিয়ে চলাবেও না, একটা ছেলের চাকরি বা কিছু করার জন্য তিনটা বছর অনেকটা সময় ইমতিয়াজ। আর তোমার ব্যবহার! সেটা আর এখন না বলি। আমার কোন শত্রুও যেন তোমার মতো ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে না করে, তোমার মতো কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করলে যে ভালোবাসা নিজে আত্মহ*ত্যা করে ম*র*বে।”
” আমি বলছি তো শুভ্রতা তুমি যা বলবে আমি তাই করব, এবার শুধু বলেই দেখ।”
” এই তিন বছরে তুমি এই কথা অনেকবার বলেছো ইমতিয়াজ। ”
” এবারই শেষ প্লিজ আমাকে এই একটাবার সুযোগ দাও।”
” তুমি আমার আমাকে কথা দিয়েছিলে আমি যেভাবে চাইবো তুমি সেভাবেই চলবে, সেটা আর কবে বলতে পারো?
আমি দেখতে এতটা খারাপ না, পড়াশোনায় এত খারাপ না যে আমি ভালো কাউকে পেতাম না। আমার ক্লাসমেটরা যদি বড় চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, বিসিএস ক্যাডার বিয়ে করতে পারে আমি তাদের সমান না হোক তবু কোন একটা অবস্থানের কাউকে বিয়ে করতে পারতাম।
তোমাকে কিছু করার কথা বললেই বলো আমি বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলাম অথচ তুমি ভুলে গেছো আমি কতবার ব্রেকাপ করতে চেয়েছিলাম, করেছিলামও আর তুমি সুইসাইড করতে গেছো বারবার।
তোমার সৎমা, অন্য কারো কাছে মানুষ হয়েছো আরো অনেক কিছু জেনেও তোমার সাথে ভালো থাকার জন্য বিয়ে করছিলাম তার দাম আমি তিন বছর হচ্ছে পাচ্ছি। খুব দাম দিয়েছো তুমি আমার ভালোবাসার। এই তিনটা বছর আমি নিজে ছোটখাটো একটা জব করে সংসার চালিয়েছি তোমাকে চালিয়েছি তোমাকে কাজের কথা বললেই সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়। আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। বিয়ের দেনমোহর তোমাকে দিতে হবে না, আমাকে যে দুই একটা গহনা দেওয়া হয়েছিল তা বিছানার ওপর বক্সে আছে দেখে নিও। আমি খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স ফাইল করব। আসছি, ভালো থেকো আর পরবর্তীতে কারো জীবনে জড়ানোর আগে তাকে ভালো রাখার দায়িত্বটা নিও।”
” যা চলে যা তুই, এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। আমি নিজেকে নিজে ঠিক চালিয়ে নেব।”
ইমতিয়াজের কথায় শুভ্রতা নিজে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে অন্তত এরকম অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটাতে হবে না তাই বিয়ের তিন বছরের মাথায় শুভ্রতা সিদ্ধান্ত নিল এবার বিবাহ বিচ্ছেদই পারে তাকে একটু বাঁচার সুযোগ করে দিতে। গাড়িতে ওঠা মাত্রই অতীত কেমন যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ইমতিয়াজ শুভ্রতার স্কুলের বান্ধবীর চাচাতো ভাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় বান্ধবীর কোন একটা পোস্টের কমেন্টে তাদের পরিচয় হয়েছিল। কমেন্ট থেকে রিপ্লাই, ফ্রেন্ডরিকুয়েষ্ট, মেসেজিং, বন্ধুত্ব, ভালো লাগা অতঃপর প্রেমে পড়া।
প্রথম যেদিন তারা দেখা করেছিল সেদিন শুভ্রতা নেভি ব্লু রঙের জামা পড়েছিল, চুল ছেড়ে দেওয়া চোখে চশমা কি যে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল সেদিন তাকে! এই প্রথমবার শুভ্রতাকে দেখেই ইমতিয়াজ প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইমতিয়াজকে মোটেও তার পছন্দ হয় না সেদিন। কেমন রোগা পাতলা চেহারা! বাড়ি এসে সরাসরি ইমতিয়াজের প্রোপোজালে ‘না’ করতে না পেরে শুভ্রতা তিন মাস সময় নেয় এটা বলে যে, ” আপনার প্রতি আমার যদি কোন অনুভূতি থাকে তাহলে এই তিন মাসের মধ্যে আমি আপনাকে নক দিব আর যদি আমি নক না দিই তাহলে ভেবে নিবেন আপনার প্রতি আমার কোন অনুভূতি নেই, তখন আপনি আমাকে আর মেসেজ দিবেন না।”
ইমতিয়াজ বুঝতে পারে শুভ্রতা হয়তো তাকে পছন্দ করে নি তাই সময় চাইছে। সেও কোন কথা বাড়ায় না শুভ্রতার কথায় রাজি হয়ে যায়।
শুভ্রতার কথানুযায়ী তিনমাস কেটে যায়। এই তিন মাস ইমতিয়াজের সাথে কথা না বলে খুব ভালো দিন কাটে তার। কিন্তু যেদিন তিনমাস পূরণ হবে তার কয়েকদিন আগে থেকেই শুভ্রতার চিন্তা বেড়ে যায় এটা ভেবে যে, ছেলেটা যদি আবার নক দেয়!
যেই ভাবা সেই কাজ তিনমাস পূরণ হওয়ার দিনই সকালবেলা তার ফোনে মেসেজ আসে। শুভ্রতাও চাপ না নিয়ে সাহস করে বলে দেয় সে সম্পর্কে জড়াবে না। ছেলেটা মেনেও নেয় কিন্তু কয়েকটা দিন একটু কথা বলতে বলে। শুভ্রতাও টুকটাক কথা বলে। এই সুযোগটাই ব্যবহার করে ইমতিয়াজ। সে যে অনাথ, তার মা নেই ইত্যাদি অনেক কথাই বলে সে শুভ্রতাকে। শুভ্রতার মনেও ইমতিয়াজের জন্য খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তাদের সম্পর্ক ও হয়ে যায়। কিন্তু সম্পর্ক হওয়ার পরই ইমতিয়াজের রাগ বাড়তে থাকে। কিছু হলেই রাগ করা, বকাবকি করা যেন নিত্যদিনের রুটিন হয়ে যায়। শুভ্রতা ব্রেকাপ করতে চাইলেই সে সুইসা*ইড করতে চলে যেত। এদিকে শুভ্রতাও তাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছিল, তার এমন ব্যবহারের জন্য না পারছিল তাকে ছাড়তে আর না পারছিল ভালোভাবে থাকতে। এদিকে শুভ্রতার বাসা থেকেও বিয়ের সম্বন্ধ দেখা হচ্ছিল। বিষয়টা ইমতিয়াজকে জানাতেই ইমতিয়াজ তার বাড়ির মানুষকে রাজি করিয়ে ফেলে বিয়ের জন্য। শুভ্রতার বাবা মাও মেয়ের কথা ভেবে একটাবারও দ্বিমত করে না। শুভ্রতাও ভাবে ইমতিয়াজ হয়তো বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে তাই সে ভালো ভালো সম্বন্ধকে পাশ কাটিয়ে ইমতিয়াজকে বিয়ে করে নেয়। বিয়ের পর থেকে শুরু হয় বড় সমস্যা কারণ ইমতিয়াজের সৎমা জানায় একসাথে এক বাড়িতে সে থাকবে না তাই তারা দুজন আলাদা বাড়িতে থাকতে শুরু করে। দুজনের মাঝে ভালোবাসা যেমন ছিল তেমন ছিল ইমতিয়াজের খারাপ স্বভাব। কিছু হলেই প্রচন্ড রেগে যেত, কোন চাকরি সে করবে না, ব্যবসার জন্য বাবার থেকে টাকা নিয়ে সেটাও কীভাবে কীভাবে খরচ করে ফেলে। এই সময়টাতেই শুভ্রতা জানতে পারে ইমতিয়াজ নে*শা করে। তবুও সে সবটা ঠিক করে নিতে চায় কিন্তু দিনকে দিন তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে থাকে। শুভ্রতা অনেকবার ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে ঠিক তখনই ইমতিয়াজ কান্নাকাটি করে তাকে আটকে রাখতো কিন্তু শেষমেশ ইমতিয়াজ এতটাই উশৃঙখল হয়ে যায় সে শুভ্রতা আর তা সহ্য করতে পারে না। তাই সে এবার সত্যি সত্যি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে সম্মান নেই, শ্রদ্ধ নেই, বলতে গেলে ভালোবাসাটাও একদম তলানিতে ঠেকেছে সেখানে আর যাই হোক ঘর করা যায় না। যেখানে প্রিয় মানুষটি ভালো থাকা কেড়ে নেয় সেখানে নিজেকেই নিজের জীবনীশক্তি হতে হয়।
শুভ্রতা একা একা পথে হাটছে। ফোনটাও নিয়ে আসে নি সে। রাস্তার পাশে একলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায়। লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি বুঝালে লোকটা পিছনে ফিরে তাকায়।
” কিছু বলবে মা?”
” আঙ্কেল আপনার ফোনটা একটু দেয়া যাবে? আমার বাড়িতে একটু কল দিব।”
” দেয়া যাবে না কেন? এই নাও।”
শুভ্রতা ফোনটা নিয়ে বাবার নম্বরে কল দেয়। কয়েকবার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হয়।
” হ্যালো বাবা…!”
” কে শুভ্রা মা?”
” হ্যাঁ বাবা, আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে বাবা? আমি আর এখানে এক মুহূর্তও থাকতে পারছিলাম না দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। আমি বাসা থেকে একেবারে বেরিয়ে এসেছি আর ফিরবো না কখনো। তুমি এই বাসার গোলির সামনের রাস্তার প্রথম দোকানটায় পাবে, আমি এখানেই আছি।”
” কি হয়েছে মা?”
” বাবা তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো আমি ফোন বা টাকা কিছুই নিয়ে বের হই নি।”
” ঠিক আছে মা তুই আধাঘণ্টা অপেক্ষা কর আমি চলে আসছি।”
শুভ্রতা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ফোন ফেরত দিয়ে সামনের দোকানটার পাশে দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। ইমতিয়াজের কথা খুব মনে পড়ছে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে, নিজেই নিজেকে বলে ওঠে, ” আর নয় শুভ্রতা, আর কত ওই মানুষটাকে সহ্য করবি? স্বামীর দায়িত্ব তার স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া, কোন স্ত্রীর দায়িত্ব নয়। আর সে তো তোর সাথে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে ওখানে আর এক ফোঁটা ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে সংসার হয় না। ইমতিয়াজ ঠিক তোকে ছাড়া বাঁচবে তোকেও বাঁচতে হবে।”
কিছুসময় পরই শুভ্রতার বাবা শাহাদাত হোসেন বাইক নিয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। শুভ্রতা এগিয়ে এসে কোন কথা না বলে বাবার বাইকে চড়ে বসে। শাহাদাত সাহেব হালকা ঘাড় বাঁকা করে মেয়ের দিকে তাকান।
” তোর বাসায় চল মা, কি হয়েছে গিয়ে দেখি।”
” না বাবা ওটা আমার বাড়ি না। তুমি প্লিজ আমাকে আর ওখানে যেতে বোলো না। ওই বাড়িটাও আমার না মানুষটাও না।”
” তোদের মধ্যে ঝগড়া তো অনেকবার হয়েছে, এভাবে তো বাড়ি ছেড়ে আসিস নি! আজ হঠাৎ কি হলো?”
” আমি আর সহ্য করতে পারছি না বাবা। তোমার মেয়েটা খুব ক্লান্ত,অনেকরাত ঠিকমতো ঘুমায় না তোমার মেয়ে।”
” আমি একবার ইমতিয়াজের সাথে কথা বলি?”
“কোন লাভ নেই বাবা। বড়জোর সে দুইদিন ভালো থাকবে, ভালো ব্যবহার করবে এরপর যেমন তেমনই হয়ে যাবে। বাবা ওর ব্যবহার এত বাজে যে আমি এখন ওর সাথে কথা বলতে ভয় পাই, ও কথার আঘা*তে ক্ষ*তবিক্ষ*ত করে ফেলে আমাকে। লাস্ট দুই বছর আমি অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। ওকে ছাড়াই আমি ভালো থাকব।”
” হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে নেই রে মা।”
” হুট করে না বাবা, আমি অনেকদিন ধরেই ভেবেছি। তুমি প্লিজ এখন এখান থেকে চলো। আমার আর ভালো লাগছে না।”
শুভ্রতার কথামতো শাহাদাত সাহেব আর সেখানে দেরি করেন না। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন কারণ তিনি জানেন ইমতিয়াজ আর শুভ্রতার সম্পর্ক অনেকদিন ধরে খারাপ যাচ্ছে। তিনি এই আশায় থাকেন যে শুভ্রতা বাসায় যাওয়ার পর ইমতিয়াজ নিয়ে আসতে গেলে তাকে বুঝিয়ে ভালো একটা জবে ঢুকিয়ে দেবে। তার মেয়ের ভালো থাকাটাই মুখ্য কারণ।
#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#সূচনা_পর্ব(০১)
দেখা যায় প্রথম পর্ব পড়ে অনেকেই পরে আর গল্প খুঁজে পান না, তাই সবাই গল্পের নাম আর কোথায় পড়ছেন সেটা একটু মনে রাখবেন, সময়টাও মনে রাখার চেষ্টা করবেন যেন পরবর্তীতে হারিয়ে না ফেলেন।
কেমন লাগলো জানাবেন সবাই।