শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব -১৬

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৬

রায়হানকে গতকাল কল দিয়ে বলার পরও রায়হান কোন খোঁজ খবর নেয়নি শুনে শুভ্রতার বেশ রাগ হলো। রায়হান যে শাকিরাকে পছন্দ করে সেটা শুভ্রতার কাছে একশো শতাংশ পরিস্কার। তাহলে পছন্দের মানুষের বিয়ে হতে দিচ্ছে কি করে! তারা তো প্রেম করে নি যার কারণে বিয়ের পর অশান্তি হতে পারে এরকম কোন ব্যাপারও নেই। তার ফুপা ফুপিও যথেষ্ট ভালো মানুষ শাকিরাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। ছেলের বউ বানাতে নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। রায়হানও যেহেতু ভালো একটা ছেলে বাবার সাথে ব্যাবসা সামলাচ্ছে তার মানে কিছু একটা করছে, বসে তো নেই সে হিসেবে এখান থেকেও না করবে না। তার মানে দাঁড়ালো সবদিক দিয়ে সবকিছু ইতিবাচক।

রায়হান কাল থেকে আর কল দেয় নি জন্য শাকিরা রাগ করে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। তার মতে যে দূরে থাকতে চায় তাকে দূরে রাখাই শ্রেয়। শাকিরাদের বাড়ি আসলে শুভ্রতার ফোনেরও নেটওয়ার্কের সমস্যা করে৷ গ্রামে আবার এই একটা ঝামেলা, সবকিছু উন্নত হচ্ছে কিন্তু নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাটা তার একদম পছন্দ না। একেক জায়গায় একেক সিমের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।

বাহিরের আওয়াজে বোঝা গেল ছেলেপক্ষ চলে এসেছে। তাদের হয়তো এখন নাস্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। শাকিরাকেও সাজানো প্রায় শেষ কিন্তু সে কান্না করছে জন্য কাজলটা ঘেটে ঘ হয়ে যাচ্ছে বারবার। সেটা ঠিক করতে করতে শুভ্রতা বেশ চটে যায়।

” তুই কান্না করবি সেটা আমাকে আগে বলতে পারলি না? সাজানোর আগে কান্না করে নিলেই হতো, এখন কান্না করে সাজটা নষ্ট কেন করছিস শাকিরা? বারবার এটা ঠিক করতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।”

শাকিরা কোন কথা না বলে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। শুভ্রতা আবার তার চোখের নিচের জায়গাটা ঠিক করে দিল। একজন এসে ছোট করে একটা কালো টিপ দিয়ে দিতে বলল কিন্তু শুভ্রতা টিপ দিতে নারাজ কারণ মুসলিম মেয়েদের টিপ ইগনোর করে চলা উচিৎ বলে সে মনে করে। যারা সুন্দর তাদের টিপ ছাড়াই সুন্দর লাগে।

শাকিরা এখন চুপচাপ বসে আছে। কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে আছে। হঠাৎ স্নিগ্ধা রুমে এসে বলল,

” আপু, রায়হান ভাইয়া তোমাকে বাহিরে ডাকছে।”

শাকিরা চোখ বড় বড় করে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” রায়হান ভাই এসেছে! আমি জানতাম উনি আসবে, আমি যে বুঝেছিলাম উনিও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমাকে না ডেকে তোকে কেন ডাকছে শুভ্রতা?”

” আমি কি জানি? তুইও এখানে আর আমিও এখানে। আর তাছাড়া তোকে আজ দেখতে এসেছে তোর সাথে রায়হান ভাইয়া আলাদা করে কথা বললে সবাই কিছু মনে করতে পারে৷ শোন শাকিরা আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুই কিন্তু ওদের সামনে যাবি না ঠিক আছে?”

শাকিরা মাথা নাড়ায়, সে যাবে না। শুভ্রতা আর স্নিগ্ধা বাহিরে দাঁড়িয়ে চলে আসে। বাড়ির বাহিরে এসে দেখে রায়হান, নিহান, নেহা, আবিরা সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা আর শুভ্রতা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।

” এটা কোন কাজ করেছ ভাইয়া?

শুভ্রতা কথাটা বলতেই রায়হান অসহায়ের মতো মুখ করে বলে, ” বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলাম, সারাদিন জার্নি করে এসেছি। কোনরকমে এসে পৌঁছেছি, ট্যুরে গিয়েও শান্তি নেই। বাবা ওখানেও কাজ ধরিয়ে দিয়েছেন দোকানে গিয়ে গিয়ে কাস্টমারের সাথে রাতে দেখা করে কথা বলতে হয়েছে। একটু পানিও পড়েনি পেটে আজ। ”

” ফোন করে বলে দিলে হতো না?”

” নিজে আসা আর ফোনে বলা তো এক না। ”

” আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে এবার বল কি করা যায়?”

আবিরা কথাটা বলার পরই নিহান বলে, ” শাকিরা কি ওদের সামনে গিয়েছে?”

” না।”

শুভ্রতা ছোট করে জবাব দিয়ে দেয়। নিহান শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” তুমি তাহলে ওকে গিয়ে বলো সে যেন মাথাঘুরে পড়ে যায় জ্ঞান হারায় যেন তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। ”

” শাকিরা জ্ঞান হারাবে মানে?”

” ওকে দেখানো তো কোনমতে থামাতে হবে তাই না!”(আবিরা)

” তুমি যাও তাড়াতাড়ি। ”

শুভ্রতার সাথে তুমি করে বলায় খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার। নিহানের কথাটাও সবার পছন্দ হয়। আরও কিছুক্ষণ সবার মাঝে আলাপ আলোচনা চলে।

শুভ্রতা আর নেহা চলে যায় শাকিরার কাছে। রুমে আপাতত তেমন কেউ নেই। রুমে ঢুকেই শুভ্রতা নেহাকে বলে, ” তুই শাকিরার কাছে বসে সবকিছু বুঝিয়ে বল আমি বাহিরের দিকটা দেখছি। ”

শুভ্রতার কথামতো নেহা শাকিরার কাছে চলে যায়। নেহা শাকিরাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। শুভ্রতা বাহিরে পাহাড়া দিচ্ছে কেউ যেন এখনই না আসে। শুভ্রতা বাহিরে গিয়ে দাঁড়াতেই নিহান এসে পাশে দাঁড়ায়।

” রেডি হয়ে যাও জান, বিয়েটা ভেঙেই তো বিয়ের জন্য বসতে হবে।”

” মানে?”

” একটু পরেই বুঝতে পারবে।”

” আপনি এমন কেন করছেন বলুন তো? আপনার ব্যবহার আমার কাছে ঠিক লাগছে না একদম। আমার আশেপাশে আসবেন না প্লিজ।”

” কাছাকাছি থাকারই ব্যবস্থা করছি অপেক্ষা কর শুধু আরেকটু।”

” আমি ডিভোর্সি, নিহান ভাই।”

” আমি তোকে ভালোবাসি। ”

কথাটা যেন সরাসরি শুভ্রতার হৃদয়ে আঘা*ত করে। সে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই শাকিরার রুম থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আসে। সবাই শাকিরার রুমের দিকে ছুটে যায়। শাকিরার মা আঞ্জুয়ারা মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। মুখে পানি ছিটানো হয় তবুও শাকিরা চোখ খোলে না। অতঃপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ছেলেপক্ষের কয়েকজন নিজেদের মাঝে বলাবলি শুরু করে মেয়ে হয়তো অসুস্থ তাই তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইছে। অনেক মেয়ের তো অনেকরকম অসুখ থাকে। কেউ কেউ তো বলতে শুরু করে হয়তো মেয়ে অন্যকাউকে পছন্দ করে সেই চিন্তায় জ্ঞান হারিয়েছে আসল ব্যাপার কোনটা কে জানে!

শাকিরার বাবা ছেলেপক্ষের কাছে এসে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে ক্ষমা চায় কারণ তার মেয়েকে এখন ডাক্তার দেখাতেই হবে জ্ঞান ফিরছে না। ছেলেপক্ষের একজন বলে ওঠে,

” মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যান ভাই, আমরাও নাহয় আজ উঠি। যোগাযোগ করে আবার অন্যদিন চলে আসব।”

আশেপাশের সবাইও তাই কথা মেনে নেয়। শাকিরার বাবাও আর আপত্তি করে না। তিনি তাদের থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েকে নিয়ে বের হন সাথে রায়হান আর নিহান যায়।

শাকিরাকে নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। বাড়ির বাহিরের বড় উঠোনে জোৎস্নার আলোতে সবাই বসে আছে। আবিরা পুকুর পাড়ের সিড়িতে বসে ফোনে কথা বলছে। সম্ভবত সে অভিকের সাথে কথা বলছে। একটু দূরেই বাড়ির বড়রা বসে কথা বলছে। শাকিরার মা শেষ দেড় ঘণ্টা চিন্তিত থাকলেও এখন বেশ খানিকটা চিন্তামুক্ত আছেন কারণ তার মেয়ে সুস্থ আছে। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত গরমে শাকিরার এমন হয়েছে তার ওপর আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ঠিকমতো না খাওয়া। এই বয়সে মেয়েরা অনেকেই খাওয়া কমিয়ে দেয় এটা ভেবে যে শরীর ঠিক রাখতে হবে মোটা হওয়া যাবে না। এটাই তাদের অসুস্থতার মুখ্য কারণ হিসেবে ধরা হয়। ভালো থাকতে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবারে প্রয়োজন আছে।

শুভ্রতা একাই শুধু পায়চারি করছে। অপেক্ষা করছে কখন তারা সবাই বাড়ি এসে পৌঁছবে।

মিনিট দশেকের মাথায় সবাই বাড়ি এসে পৌঁছল। কাজিনরা সবাই একসাথে শাকিরার রুমে বসে আছে শুধু নিহান ছাড়া। শাকিরার খাটে আর আশেপাশে চেয়ার নিয়ে সবাই বসে আছে। আঞ্জুয়ারা বেগম মেয়ের জন্য ডিম সিদ্ধ আর গরম দুধ আনতে গিয়েছেন।

” আপনি আমাকে পছন্দ করেন রায়হান ভাই?”

শাকিরার এমন উদ্ভট প্রশ্নে এতগুলো মানুষের মধ্যে লজ্জা পেয়ে যায় রায়হান। কখন কোথায় কি বলতে হয় এই মেয়ে এখনো শিখে উঠতে পারল না!
নেহা আর স্নিগ্ধা মুখ টিপে হাসছে। আবিরা তো বলেই ওঠে,

” হ্যাঁ রায়হান ভাইয়া বল, তুই শাকিরাকে বলে দে তো আমিও রেকর্ড করে রাখি যেন পরে তুই অস্বীকার করতে না পারিস।”

আবিরার কথায় স্নিগ্ধা শব্দ করে হেসে ফেলে। আবিরা আবার বলে, তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা কর ভাই দুই বিয়ে একসাথে খাব।”

” দুই বিয়ে! কে কে বিয়ে করছে?”

রায়হান ঠিক বুঝতে পারল না দুইটা বিয়ের কথা আবিরা কেন বলল!

” তোর আর নিহান ভাইয়ের।”

” নিহান ভাই বিয়ে করছে নাকি?”

” তো বিয়ে করবে না? তিনমাস ছুটি পেয়েছে এরপর কি আর কখনো এত ছুটি পাবে! ছুটিটা কাজে লাগাতে হবে তো!”

” মেয়ে দেখা হচ্ছে?”

” হ্যাঁ দেখা হচ্ছে তো।” মাঝখান থেকে নেহা রায়হানের কথাটার জবাব দিয়ে ওঠে।

শুভ্রতার এবার অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিকই দেখে বেড়াচ্ছে অথচ তার ওপর শুধু অধিকার ফলাচ্ছে। তার মতে শুধুমাত্র বাবা ছাড়া কোন পুরুষই যথাযথ নয়।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here