#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০২
” আপু ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়েছে ইমতিয়াজ ভাইয়া।”
ছোটবোন স্নিগ্ধার কথায় ফিরে তাকায় শুভ্রতা। স্নিগ্ধার কথায় ছোট করে একটা শ্বাস নিল সে। শুভ্রতা নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, ” টেবিলের ওপর রেখে চলে যা।”
স্নিগ্ধা তাড়াহুড়ো গলায় বলল, ” আপু একটু তাড়াতাড়ি কোরো বাহিরে ঈমতিয়াজ ভাইয়া আর উকিল বসে আছে।”
ইমতিয়াজ এসেছে! তাকে নিতে নয় সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটাতে! শুভ্রতা বাবার বাড়ি এসেছে প্রায় মাস খানেক হয়েছে। বাড়ির ফোনটা সারাক্ষণ নিজের কাছে রেখেছে সে কিন্তু কোন লাভ হয় নি। ইমতিয়াজ একটাবারের জন্যও এ বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করে নি।
স্নিগ্ধা কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শুভ্রতা সেটা নিয়ে বাহিরের রুমের দিকে পা বাড়ালো। শুভ্রতাকে আসতে দেখেই মুখে বিরক্তভাব এনে অন্যদিকে তাকায়।
শুভ্রতা প্রথমে ভেবেছিল সে ইমতিয়াজের সাথে একা একটু কথা বলবে কিন্তু তার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে খুব বিরক্ত। কিন্তু তবুও তার কিছু কথা শোনা উচিৎ । শুভ্রতা এগিয়ে যায় তাদের দিকে। পাশের সোফাতেই শুভ্রতার বাবা-মা বসে আছে। দূরেই দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা।
শাহাদাত সাহেব মেয়েকে দেখে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। এই একমাসে মেয়েটার চেহারা কি হয়ে গেছে! নিজের প্রাণোবন্ত মেয়েটাকে এভাবে আর দেখতে পারছেন না উনি।
শুভ্রতা ইমতিয়াজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
” একটু আলাদা কথা বলা যাবে আপনার সাথে?”
ইমতিয়াজ কিছু বলে না, চুপচাপ বসেই রইল । তার কোন ইচ্ছে নেই শুভ্রতার সাথে আলাদা আর কোন কথা বলার। যে সম্পর্ক ভেঙেই গেছে সেই সম্পর্কের পিছনে ছোটা বোকামি।
ইমতিয়াজকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্রতা আবার বলে ওঠে, ” বেশি সময় নেব না চিন্তা নেই। আপনি চাইলে আমার রুমে আসতে পারেন পাঁচ মিনিটের জন্য। চার বছরের সম্পর্ক আর তিন বছরের সংসারে এই পাঁচ মিনিট তো আমি পেতেই পারি তাই না? আমি আমার রুমে অপেক্ষা করছি।”
শুভ্রতা নিজের রুমে চলে গেলে ইমতিয়াজও তার পিছু পিছু চলে আসে। তার মুখ থেকে বিরক্তির ছাপ এখনো যায় নি।
ইমতিয়াজ রুমে প্রবেশ করতেই শুভ্রতা চেয়ার এগিয়ে দেয় বসার জন্য। ইমতিয়াজ বসে না, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
” আমি বসব না হাতে বেশি সময় নেই, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আর যে মেয়ে তার স্বামীকে ছেড়ে রাতের বেলা বেরিয়ে যেতে পারে তার সাথে কোন কথাই থাকতে পারে না।”
” একটা মেয়ে কি তার স্বামীকে অসম্ভব ভালোবাসার পর কম কষ্টে ছেড়ে আসে?”
” আমি তোমার কষ্ট দেখতে আসি নি মোটেও।”
” দেখাচ্ছি না তো। যার প্রতি ভালোবাসা থাকে তার সবকিছুতেই আগ্রহ থাকে। যার প্রতি ভালোবাসা থাকে না তার সব কথা এমনকি তার উপস্থিতিও বিরক্তকর লাগে।”
” ঠিকই ধরেছো, খুব বিরক্ত লাগছে আমার। আর তুমি বলেছিলে না আমি তোমার মতো কাউকে পাব না? এই মাসের মধ্যেই আমি বিয়ে করছি দেখে নিও।”
” বউকে চালানোর মতো কিছু অর্জন করে বিয়ে কোরো। শুধু শুধু জিদ করে আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট কোরো না। কি যেন বলেছিলে আমাকে অন্য পুরুষ স্পর্শ করলে গা ঘিনঘিন করবে কি না? আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করার আগে তুমিই তো অন্য নারীর হয়ে যাবে।”
” হ্যাঁ হয়ে যাব, তোমার মতো মেয়ের সাথে এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছে আমার নেই। আর তুমি নাকি আমাকে উপার্জন করে খাইয়েছো? বাড়িটা না থাকলে থাকতে কোথায়? আমি কি তোমার জন্য কিছুই করি নি?”
” হ্যাঁ করেছো তো, আমার জীবন নষ্ট করেছো। তোমার ওপর দয়া করেছিলাম আমি ভেবেছিলাম তোমাকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব, দিন চলার মতো কিছু করলেই যথেষ্ট ছিল কিন্তু তুমি সেটাও করো নি।”
” এই শোনো তোমার এসব কথা শুনতে আমি এখানে আসি নি। এসব যেন সারাদিন কানের কাছে না বলতে পারো সেই ব্যবস্থা করতে এসেছি। বড়লোক বাবার মেয়ে তাই একটু কষ্ট সহ্য করে থাকতে পারো নি এটা তোমার ব্যর্থতা। এ বাজারে চাকরি পাওয়া কত কঠিন তুমি জানো?”
” তিন বছর কি যথেষ্ট ছিল না? ”
” না ছিল না।”
” আমি সহজে তোমাকে ছাড়ি নি, তুমি ছাড়তে বাধ্য করেছো। এবার আমি মায়া ত্যাগ করলে আমাকে আর আগের মতো পাবে না। আমি অন্য মেয়েদের মতো নই যে বিরহের সাথে দিন অতীত করব। আমি জীবন উপভোগ করতে পারি, তোমাকে ভালোবাসি বিধায় অনেককিছু সহ্য করে নিয়েছি। আমার জীবনে কেউ আসতে চায় নি এমন কিন্তু না তোমার চেয়েও ভালো কেউ আসতে চেয়েছিল আমিই তোমায় ছাড়া কাউকে গ্রহণ করি নি। অপরিপক্ক বয়সে মানুষ ভুল করে, আমার ভুলটাও এমন।”
” তোমার বস্তাপঁচা কথা শুনতে আমি আগ্রহী নই। বদলে যাও, একইরকম থাকো, এমনকি ম*রে যাও আমি দেখতে আসব না। সাইন করে দাও চলে যাব, সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে একদম নেই।”
” এত পরিবর্তন! ভুল করলে ইমতিয়াজ, একদিন ঠিক পস্তাতে হবে। অন্তত আমি ভালো থাকব আর তুমি সেটা দেখে হায়হায় করবে মনে রেখো।”
” যা ইচ্ছে করো। আপাতত আমার জীবন থেকে বিদায় নাও।”
” তুমি আমাকে পেয়েও হারালে, এমন একটা সময় আসবে যখন আমাকে পাওয়ার জন্য ভিখারির মতো ঘুরলেও পাবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি কি জানো? ফিরে আসা, যেটা আমি চাই না আর তুমিও কোনদিন পাবে না।”
” ইচ্ছেও নেই।”
ইমতিয়াজের এই কথাটা যেন শুভ্রতার গায়ে জ্বা*লা ধরিয়ে দেয়। তাকে ছাড়া থাকার জিদ পেয়ে বসে। শক্ত গলায় বলে ওঠে,
” ‘আপনি’ চরিত্রটা আসলেই মাদক,
আপনাকে ছাড়লে ভালো থাকব জেনেও কেমন সদিচ্ছায় আপনাকে গ্রহণ করে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছি দেখুন! কিন্তু আর নয় এবার আমি বাঁচব, আপনাকে ছাড়া খুব ভালোভাবে বাঁচব।”
শুভ্রতা কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দুজনের দারুণ সম্মতিতে যেমন একদিন দুজন এক হয়েছিল ঠিক তেমনই দুজনের সম্মতিতে আজ দুজন আয়োজন করে আলাদা হয়ে গেল। আজ থেকে দুজনের পথ ভিন্ন, গন্তব্য ভিন্ন, দুজনের কাছে দুজনের ফিরে আসার পথ ভিন্ন।
একজন বলেছিল, ” শুভ্রা প্লিজ বিয়েটা করিস না ছেলেটা ভালো না। তুই ভালো থাকতে পারবি না ওর সাথে।”
তার কথাটা মিথ্যা প্রমাণ করতেই শুভ্রতা এতদিন ইমতিয়াজের সবকিছু সহ্য করে গিয়েছে। অন্যকে ভুল প্রমাণ করতে ভুল মানুষের সাথে সারাজীবন তো কাটিয়ে দেওয়া যায় না। যে কথাটি বলেছিল সেই নাহয় সঠিক হলো!
পরদিন বিকেলে এক কাপ চা হাতে নিয়ে জানালার পাশে চেয়ারে বসে আছে শুভ্রতা। চোখ দিয়ে তার অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। আনমনে কি সব ভেবে চলেছে সে। ইমতিয়াজ সত্যিই সম্পর্কটা শেষ করে দিল! দুজনের যে কম ভালোবাসে সেই নাকি সম্পর্কের সবটা নিয়ন্ত্রণ করে! তবে ইমতিয়াজ চাইলেই তো সম্পর্কটা আগের মতো করে নিতে পারত। এত ভালোবাসার পরও পুরুষ এরকম করতে পারে!
দরজায় নক করার শব্দ পেতেই ওরনা দিয়ে চোখটা মুছে নেয় শুভ্রতা। দরজার দিকে তাকাতেই চোখ চড়কগাছ। তার সব চাচাতো ভাই বোনেরা দরজায় দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। তাদের সাথে স্নিগ্ধাও রয়েছে, ওদের সবার লিডার এই মেয়ে। নিশ্চিত মা শুভ্রতার মন ভালো করার জন্য কিছু করতে বলায় সে গিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসেছে।
স্নিগ্ধা, নেহা, শাকিরা, রায়হান, ইরা সবাই একসাথে হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাঝখান দিয়ে আবিরা আপু রুমে প্রবেশ করল। আবিরা আপুর পিছু নিয়ে সবাই একে একে বিছানায় এসে বসলো।
” কি ব্যাপার শুভ্রতা! একা একা এখানে বসে কি করা হচ্ছে শুনি?”
” কিছু না আপু, এই তো বসে চা খাচ্ছিলাম। তোমরা সবাই এখানে যে?”
” রাতে যে গ্রুপ খুলেছি মেসেঞ্জারে, তোকেও তো এড দেওয়া হয়েছে তাহলে তুই গ্রুপে যাস নি কেন?”
” গ্রুপ? কিসের গ্রুপ? আর আমি তো অনলাইনে যাই নি। ”
” কেন? ফোন নেই তোমার আপু?”
মাঝখান দিয়ে নেহা প্রশ্নটা করে ওঠে। সবাই রাত থেকে কত মজা করছে গ্রুপে! আর শুভ্রতা কি না সেখানে নেই!
” এসব ছাড়ো, ইরা তুই কবে এলি এখানে?”
শুভ্রতা ইরাকে দেখে অবাক হয় কারণ গতকাল পর্যন্ত ও তো কেউ ছিল না এখানে। ওরা সবাই ঢাকায় থাকে, ওর বাবা কয়েক ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তারা প্রায় দশ বছর ধরে গ্রামে থাকে না তারা।
” গতকাল তো গ্রুপ খোলার পর সবার একসাথে হওয়ার কথা ছিল। আমরা যদিও বা আজ সকালেই এসেছি আগামীকাল চলেও যাব। নিহা…..”
ইরাকে আর কথা শেষ করতে দেয় না আবিরা। শুভ্রতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে গিয়েছিল সে, তাকে থামিয়ে দেওয়া হলো।
” কি বলতে চাইছিলি রে ইরা?”
ইরা এবার আবিরার দিকে তাকায়। সে যে মুখ ফসকে লুকোনো বিষয়টাই বলে দিতে গিয়েছিল। ইরা এবার আমতা আমতা করে বলে,
” তেমন কিছু না আপু, বলতে চাইছিলাম যে কিছুদিন পর আবার আসব।”
” না অন্যকিছু বলতে চাইছিলি হয়তো।”
” ও আবার অন্যকিছু কি বলতে চাইবে? বাদ দাও আপু ওসব।”
স্নিগ্ধা কথা ঘুরিয়ে নিতে ইরাকে সরিয়ে সামনের দিকে এসে বসে সে। পাশে থেকে শাকিরাও অন্য কথা তুলে যেন নিহান নামক কারো কথা এখন আর সামনে না আসে।
চলবে…..