শুভ্র বর্ষণ পর্ব ১৪

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৪

রাতে মিহার শরীর গরম হওয়া ধরতেই সুমা বেগম বুঝে গেলো ওর জ্বর আসবে। তিনি এক গাল বকে একটা নাপা খাইয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে হুমকি দিয়ে গেলো জ্বর আসলে নিয়ম করে প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভেজাবে ওকে। মিহা চুপসানো মুখে সোফায় বসে রইলো। রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ জ্বর আসবে নির্ঘাত। ওর নিজের জ্বরের ওপর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। রাতে নিশান্ত ঘুমাতে পারবে না ওর জ্বালায়। সেই ভয়ে গুটিগুটি পায়ে শোভার রুমে উকি দিলো। শোভা তখন ফেইসবুকে মগ্ন। ধ্যান জ্ঞান সব মোবাইলে দিয়ে রেখেছে। মিহা ওর রুমে ঢুকতেই শোভার মনোযোগ মোবাইল থেকে সরে গেলো।

“কি ব্যাপার! এই রজনিতে প্রানপ্রিয় স্বামীকে ছেড়ে হঠাৎ আমার কক্ষে আগমন?”

মিহা ফোস করে নিশ্বাস ফেলে পা উঠিয়ে খাটে বসলো। বললো,
” আমার মনে হচ্ছে আজ রাতে জ্বর আসবে। জানিসই তো জ্বর হলে আমার হুস থাকে না। তোর ভাইয়ার কষ্ট হতে পারে। তাই..”

“তাই আজ রাতটুকু আপনি আমার কক্ষে অতিবাহিত করতে ইচ্ছুক। ঠিক বললাম!”

“রাখ তোর হেয়ালি। মা রেগে আছে বলে মায়ের কাছে শোয়ার কথা বলতেও পারছিনা। কি করবো বল না।”

“হুম, তবে তুমি অন্য যায়গায় ঘুমালে ভাইয়া রেগে যেতে পারে। ভাবতে পারে তুমি তাকে বিশ্বাস করতে পারছো না তোমার কেয়ার নিতে পারবে কিনা।”

“তেমনটা নয়। আসলে আমি ওনাকে জ্বালাতন করতে চাইছি না।”

মিহার আসতে দেরি হচ্ছে বলে নিশান্ত নিজেই বেরিয়ে এসেছিলো ওকে খুজতে। শোভার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা শুনে মৃদু শব্দ করে কেশে উঠলো। ওর আওয়াজ পেয়ে মিহা দাঁড়িয়ে গেলো। নিশান্ত সরাসরি না ডেকে, বাহানা দিয়ে ওকে বের করার জন্য বললো,
“আমার ব্যাগে কাদা লেগে শুকিয়ে গেছে। একটু হ্যাল্প করো।”

মিহা মাথা নাড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। শোভা মুচকি হাসলো। আজ মিহার অন্য কোথাও শোয়া হবে না সেটা শোভা বেশ বুঝতে পারলো। নিশান্ত মিহার পেছনে যাওয়ার আগে শোভা ডেকে বললো,

“ভাইয়া, আপুর শরীর গরম হচ্ছে। আজ বোধহয় জ্বর আসবে।”

“বুঝতে পারছি। আমি সামলে নেবো, চিন্তা করো না।”

“আপু রিয়েল লাইফে যেমন শান্তশিষ্ট, বাধ্য মেয়ে। জ্বর হলে ঠিক ততটাই অবাধ্য। সারারাত অবচেতনে বাজে বকবে। আপনার আজ ঘুমের খুব কষ্ট হবে ভাইয়া।”

নিশান্ত হেসে বললো,
“তাহলে আজ ওর অবাধ্য স্বভাবের সাথেও নাহয় পরিচিত হয়ে যাবো। তুমি চিন্তা করো না। আমি খেয়াল রাখবো।”

রাতে মিহার আর অন্য কোথাও শোয়া হলো না। নিশান্তের তোপের মুখে পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই যেন শরীর অবস হয়ে যেতে লাগলো। ঘন্টা পেরোতেই গা কাপিয়ে জ্বর এলো। জ্বরের ঘোরেই হাত পা ছুড়ে আবলতাবল বকতে শুরু করলো, যার বেশিরভাগ কথাই বাবাকে নিয়ে। নিশান্ত নিজের রুমাল ভিজিয়ে ওর কপালে দিলো। গায়ে মোটা কাথা চাপিয়ে দিলো। মিহার মুখ তখন অনবরত বকেই যাচ্ছে। কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট। জ্বরের হেরফের না হওয়ায় বাথরুম থেকে বালতিতে পানি এনে মাথায় পানিও ঢাললো। একসময় মিহার কথা বলা কমে গেলো। গায়ের তাপমাত্রা কমেছে। কিন্তু মিহা হুসে আসেনি।
রাত তখন আড়াইটা বাজে। নিশান্তের ক্লান্ত চোখেও ঘুম নেমে আসছে। ভালো করে মিহার মাথা মুছিয়ে দেওয়ার সময় মিহা আধো আধো চোখ মেলে তাকালো। লাল হয়ে থাকা চোখ। তা দেখে নিশান্ত বললো,
“এখন কেমন লাগছে তোমার? খুব কষ্ট হচ্ছে?”

মিহা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কিছুক্ষন সময় নিয়ে জড়ানো গলায় বললো,
“আপনি খুব নিষ্ঠুর।”

মিহার এহেন কথায় নিশান্ত অবাক কন্ঠে বললো,
“আমি কি করলাম?”

“আপনি খারাপ লোক। শুধু আমায় কষ্ট দেন। খালি ব্যস্ততা দেখান। এতো ব্যস্ত হলে বিয়ে কেনো করেছেন, হ্যা! আপনার বিয়ে করা উচিৎ হয়নি। একদম উচিৎ হয়নি। আপনার চিরকুমার থাকা উচিৎ।”

নিশান্ত হেসে ফেললো। বউ তাহলে হুশে নেই। বললো,
“তাহলে আমি তো খুব বড় ভূল করে ফেললাম বিয়ে করে। এখন কি হবে?”

মিহা খুব ধীর কন্ঠে বললো,” শাস্তি পেতে হবে। কঠিন শাস্তি। আমাকে রোজ রোজ অপেক্ষা করানোর শাস্তি।”

“আমি সেই শাস্তি মাথা পেতে নিতে চাই মহারানী।”

নিশান্ত ওর মাথা মুছে রাখা ভেজা তোয়ালে রাখতে গেলে মিহা হাত টেনে ধরে বললো,
“আবার পাল্লাচ্ছেন! আবার! বেধে রাখবো। আচলে বেধে রাখবো। লুকিয়ে রাখবো। কোত্থাও যেতে দেবো না। আপনি কেনো চলে যান বলুনতো!”

“যাবো না পাগলি। ভেজা কাপড়টা রেখে আসি একটু।”

“না কোত্থাও যেতে দেবো না। আবার চলে যাবেন। আপনি ভালোবাসেন না আমায়। মিস করেন না আমায়। আমার প্রেম আপনার চোখে পড়ে না। প্রণয় বোঝেন না আপনি।”

নিশান্ত ঝুকে এসে মিহার গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে বললো,
“ঊনত্রিশ বছর বয়সী পুরুষকে তুমি প্রণয় শেখাচ্ছো মেয়ে। প্রণয়ের বিষ এই শরীরে প্রবেশ করেছে আরো বছরখানেক আগে। সেই রঙিন ব্যথায় জর্জরিত হয়ে কতবার প্রণয় স্ট্রোক করেছি তার খেয়াল কি রেখেছো? কতবার তোমার প্রণয় বানে আহত হয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে খবর রেখেছো? এবার যে তোমার পালা। প্রণয়ের বিষ ধারণ করতে হবে তোমায়। তবেই না আমার শুদ্ধতম প্রেম সার্থকতা লাভ করবে।”

_________

মিহার জ্বর সকালে কমে গেলো। কিন্তু, মাথা ঘোরানো, দুর্বলতা রয়ে গেছে। তাই সবার বকাঝকা খেয়ে বিছানায়ই শুয়ে থাকতে হলো। কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে টফি একাই দেখতে এসেছে মিহাকে। কিন্তু এসে সে নিজেই রোগীর থেকে আদর খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মিহা টফির পিঠ চুলকে দিচ্ছে এবং টফি চোখ বন্ধ করে গড়িয়ে গড়িয়ে হাত পা ছড়িয়ে তা উপভোগ করছে। শোভা যখন দুধ আর কেক নিয়ে মিহার রুমে এলো ওর মেজাজ গরম হয়ে গেলো।

“এই শিয়ালটা এখানে কি করে?”

টফি শোভার কন্ঠস্বর পেয়েই শোয়া থেকে উঠে লেজ নাড়তে শুরু করলো। মিহা বললো,
“ছাড়া পেয়ে চলে এসেছে বোধহয়। থাক কিছুক্ষন।”

“এহহ! আবার জিভ বের করে লেজ নাড়ানো হচ্ছে। একটু খাবারও দেবো না বলে দিলাম। যেভাবে এসেছিস সেভাবেই যাবি।”
শোভা খাবার রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলে টফিও তার পেছনে ছুটলো। মিহার ডাকেও থামলো না।

“কি ব্যাপার! আমার পেছনে আসছিস কেনো?”

টফি চিকন কন্ঠে দুইবার ডাকলো। শোভার ওড়না কামড়ে ধরে রান্না ঘরের দিকে টানলো। শোভা ভ্রু কুচকে বললো,
“ওরে ব্যাটা, তুই তোর শত্রুর কাছেই খাবার চাইছিস! ইংলিশ আন্টি যে তোকে এতো এতো খাবার দেয় তাতে পেট ভরে না?”

টফির মুখ থেকে আচল সরিয়ে শোভা রুমে ঢুকে গেলো। টফি বাইরে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে বসে রইলো। রুমে ঢুকে শোভার মনে হলো কাজ টা ঠিক হলো না। বেচারার বোধহয় সত্যি সত্যিই খিদে পেয়েছে। যাবে না যাবে না করেও শেষমেষ রুম ছেড়ে বের হলো। টফি সেখানেই বসে আছে। শোভাকে বের হতে দেখেই উঠে দাড়ালো। শোভা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,
“আদর করতে আসিনি। আমি দয়ার সাগর, তাই তোকে একটু দয়া দেখাতে এসেছি। আয় আমার সাথে।”

শোভা রান্নাঘরে গেলো। কিছু মুহূর্ত খোজাখুজি করলো কি দেওয়া যায় খাবার জন্য। হুট করে ওর রুম থেকে একটা আওয়াজ আসতেই আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো টফি নেই। দৌড়ে রুমে গিয়ে দেখলো মোবাইল ফ্লোরে পড়ে আছে। শোভা সেটা হাতে নিয়ে দেখলো গ্লাস ফেটে গেছে। পেছনের গ্লাস কভারও ভেঙে গেছে। কাদো কাদো মুখ করে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো টফি নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথেই শোভা চিৎকার করে উঠলো,

“শিয়ালের বাচ্চা টফি। তোর এতো বড় সাহস! আমার রুমে ঢুকে আমারই মোবাইল ভেঙে দিলি! আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন।”

টফি ততক্ষনে দৌড় লাগিয়েছে। পেছনে ছুটেছে শোভা।
রিয়াদ সোফায় বসে খেলা দেখছিলো। বাড়িতে ঢুকেই টফি সোফার পেছনে চলে গেলো। শোভা হন্তদন্ত হয়ে এসে এদিক ওদিক খুজলো ওকে। রিয়াদ চোখ ছোট ছোট করে ফেললো।
“বাড়ির ভেতর দৌড়াদৌড়ি করছো কেনো? বাহিরে যায়গার অভাব নাকি?”

“আপনার কুত্তা না সরি শিয়াল..”
শোভা রাগে এবং দৌড়ানোর ফলে হাপনোর জন্য কথা শেষ করতে পারলো না।

“কি বলছো এসব? কিসের শিয়াল! কিসের কুত্তা!”

“আপনার টফির কথা বলছি। কোথায় লুকিয়ে আছে ও?”

রিয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো,
“আজেবাজে বকছো কেনো? ও কেনো লুকাবে?”

“কারণ সে আমার মোবাইল ভেঙেছে। আপনি ভাবতে পারছেন! মাত্র কয়েকদিন হলো মোবাইলে নিউ ডিজাইনের গ্লাস কভার লাগিয়েছি আমি। টফি সেটা ভেঙে দিলো। আমার সাথে ভালোমানুষি করে আমার ক্ষতি করে চলে এলো।”

শোভা নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দেখালো রিয়াদকে। রিয়াদ তাচ্ছিল্য করে বললো,
“সামান্য গ্লাস এবং কভারইতো ভেঙেছে। মোবাইলের তো কিছু হয়নি। অথচ ভাব করছো মোবাইল খেয়ে ফেলেছে। এমন ছোটখাটো ভুল হতেই পারে। তোমার দ্বারাও হতে পারতো।”

শোভা তেতে উঠলো। তবুও লোকটা টফির দোষ দেখলো না! নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শোভা বললো,
“হতে পারতো। হয়নি তো। বুঝতে পেরেছি। সব বুঝতে পেরেছি। আসলে এই ফোন ভাঙার জন্য ইন্ডাইরেক্টলি আপনিই দায়ী।”

“আমি!”

“হ্যা আপনি। টফিকে বেধে কেনো রাখেননি? কেনো ছেড়ে দিয়েছেন ওকে। আর ছেড়ে দিলেও খেয়াল কেনো রাখেননি? আসলে সব দোষ আপনারই। যদি না আপনি ওকে ছেড়ে দিতেন তাহলে এমন হতো না।”

রিয়াদ আশেপাশে টফিকে খুজলো। সোফার পেছনে ওর লেজ দেখতে পেয়ে টেনে বের করলো। টফি মুখটা এমন করে আছে যেন কিছুই বোঝে না। শোভা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জ্বলে উঠলো। ইশ মুখ দেখে মনে হচ্ছে এর থেকে সরল প্রাণী বুঝি আর হয়ই না। আসলে হাড়ে বজ্জাত। শোভার ওপর প্রতিশোধ নিলো।

রিয়াদ টফিকে ঝাকিয়ে বললো,
“তুই শোভার ফোন ভেঙেছিস?”

“আরে ও কি বলবে! আমি বলছিতো ভেঙেছে।”

রিয়াদ টফিকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে ওকে ছেড়ে দিলো। শোভার কাছে এসে বললো,
“তো ভেঙে যখন ফেলেছেই কি করা। বলো এখন কি চাও?”

“আপনার টফি যেহেতু ভেঙেছে তাই আপনি আমার ফোন ঠিক করে দেবেন। সেইম ডিজাইনের গ্লাস লাগাবেন। আর সেটাও আজকের মধ্যে। নাহলে আমি..”

“নাহলে তুমি কি?”

শোভা এগিয়ে গিয়ে সোফা থেকে রিয়াদের ফোন তুলে নিয়ে বললো,
“আপনার ফোনও পাবেন না। আমি নিয়ে গেলাম।”

“আরে সামান্য কভারইতো। তারজন্য এমন লেইম কাজ? আমার ইম্পর্ট্যান্ট ফোনকল আসতে পারে।”

“টাকা কি গাছে ধরে? আপনার হয়তো ধরে, আমার না। এটা দাম দিয়ে এনেছি। নিজে ঠিক করতে গেলেই বুঝবেন কত টাকা। যত জলদি আমার টা ঠিক করে দেবেন তত জলদি নিজের টা ফেরত পাবেন।”

“তো তোমার মোবাইল যে আমায় দিয়ে যাচ্ছো! তোমার বয়ফ্রেন্ড বা আদার ফ্রেন্ডস যদি কল করে?”

শোভা বয়ফ্রেন্ড কথাটা শুনে প্রথমে থমকালো। তারপর আবারো ঝাঝালো গলায় বললো,
“কেউ ফোন করবে না। আমি ফোন বন্ধ করে দিয়েছি।”

“কিন্তু আমার বিশেষ কেউ কল দিয়ে আমায় না পেলে!”

শোভা ভ্রু কুচকে ফেললো। বললো,
“বিশেষ কেউ মানে?”

“বিশেষ অনেকেই হতে পারে। কেনো তোমার বিশেষ কেউ নেই? বোঝো না?”

কথাটা শোভার ভালো লাগলো না। বিশেষ কেউ! ওর রাগ হুট করে আরো বেড়ে গেলো।
” ওহহ, আপনার গার্লফ্রেন্ড তো! আপনার গার্লফ্রেন্ড যেন কল না দিতে পারে তাই আপনার ফোনও সুইচ অফ করে রাখবো। আমার ফোন ঠিক না হওয়া অবধি আপনার প্রেমালাপ বন্ধ। গেলাম।”

“রাগছো কেনো?”
শোভা আর কোনো কথাই পাত্তা দিলো না। যেভাবে ঝড়ের বেগে এসেছিলো, সেভাবেই বেরিয়ে গেলো রিয়াদের বাড়ি ছেড়ে।

রিয়াদ বিড়বিড় করে বললো, “জল্লাদ মেয়ে একটা।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here