শূন্য থেকে আসে প্রেম পর্ব ৩১+৩২

#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ৩১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

আজ সৌরভ ভাইয়া বাসায় নেই। কোন এক পার্টিতে গেছেন। আমাকেও নিতে চাইছিলেন কিন্তু আমার এসব পার্টি টার্টি বেশি ভালো লাগে না। তাই আমি যায়নি। হটাৎ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। কিন্তু বাসা তো বাইরে দিয়ে লাগানো। এখন ?? আরেকবার বেল বাজলে আমি কোনো উপায় না পেয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। দরজার কাছে গিয়ে বুঝতে পারি যে আজ তালা মেরে যাননি। কি ব্যাপার। তালা দিয়ে যান নি কেনো উনি ?? উনার কি ভয় নেই যে আমি পালিয়ে যেতে পারি। আবার কলিং বেল বাজলে আমি ধ্যান থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দেই। এত ওই ডিভোর্স উকিল টার পিএ। কিন্তু এখানে কেনো ?? আমি হালকা হেসে জিজ্ঞেস করি,

” আপনি ?? ”

লোকটা তার হাতে থাকা ব্যাগ টা থেকে একটা ফাইল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,

” স্যার পাঠিয়েছেন। আপনাকে ফোন দিয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই। Kindly আজ বা কালকে সই করে জমা দিবেন পেপারটা। ”

আমি অনেক দ্বিধা নিয়ে লোকটার হাত থেকে ফাইল টা নিয়ে বলি,

” ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। ”

” My pleasure। ”

লোকটা চলে গেলে আমি দরজা টা লাগিয়ে ফাইল টা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। বিছানায় বসে ফাইল টা খুললে একটা কাগজ বের হয়ে আসে। আর সেই কাগজ দেখে আমি খানিকসময় থম মেরে বসে থাকি। সাথে সাথে অবাধ্য চোখের জল গুলো নিমিষেই গাল বেয়ে পড়ছে। কেনো যেনো দিল টা বড্ড পুড়ছে। কেনো জানিনা। কাগজ টায় স্পষ্ট লেখা ডিভোর্স পেপার। আমি কাপা কাপা হাত দিয়ে কাগজ টা নেই। অনেকক্ষন কাগজটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকি। নিজেকে কেমন যেনো অসহায় মনে হচ্ছে। আমি কাগজটা বিছানায় রেখে দু হাত দিয়ে চুল টা মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে জোড় টান দিতে থাকি। আমার এত ,এত কষ্ট হচ্ছে কেনো ?? আমরা এতটা তারাতারি আলাদা হয়ে যাব ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। কিন্তু না আমার এটা করতেই হবে। এটাই আমাদের দুজনের জন্যে ঠিক ডিসিশন হবে। কারণ পুরনো ঘা যে দিনে দিনে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। আমি বিস্তর ভাবলাম। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি সই করবো। কোনোমতে কাপা কাপা হাত দিয়ে কলম টা তুলে নিয়ে কাগজে সই দিতে গেলে আমার হাত এত জোরে কাপতে থাকে যে বারবার আমার হাত থেকে কলমটা পড়ে যাচ্ছে।

এই নিয়ে ১০ বার আমি কলম হাত নিয়েছি। কিন্তু বারবার সই করতে ব্যার্থ হয়েছি আমি। কান্নার পানি গুলো চোখ বেয়ে অনবরত পরেই যাচ্ছে। যার ফলে ডিভোর্সের কাগজটা খানিকটা ভিজে যাচ্ছে। আমি হাত দিয়ে আবার কাগজটা পরিষ্কার করে দিয়ে ক্ষণে ক্ষনে ঝাপসা চোখে কাগজটার দিকে তাকাচ্ছি।

না আর পারলাম না। ডিভোর্স কথাটা মুখে বলা যতটা সহজ হাতে করা ঠিক ততটাই কঠিন। আজ আমি হারেহারে টের পাচ্ছি সেটা। আমি ডিভোর্সের কাগজটা টি টেবিলের উপর রেখে দিয়ে নিজ হাতে একটা চিঠি লিখে সেটাও টি টেবিলের উপর রেখে দিলাম। একটা বোরকা পড়ে নিয়ে সম্পর্ণ শরীর ঢেকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। যাওয়ার আগে বারবার সেই বাসার দিকে তাকাচ্ছিলাম আমি। কেনো যেনো পা টা চলছে না আমার। বারবার মনে হচ্ছে যাস নে। থেকে যা। নাহলে হয়তো বিশাল ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবি। কিন্তু না আমার তো যেতেই হবে। উনার কাছে থাকলে আমি কখনোই উনার দেওয়া আঘাত গুলো ভুলতে পারবোনা। তার ফলে সৃষ্টি হবে সংসারে অশান্তি। যার পরিণতি অনেক ভয়ংকর। অনেক। রাঙামটির বাসে উঠে আমি অনুভতুহিন ভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। মন টা আমার বারবার কু ডাকছে। কষ্টের ভার আরো,, আরো শক্তিশালী হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বাস নিজের গতিতে চলতে আরম্ভ করলো। আর আমি বিষাদ মনে চোখ টা বুজে নিলাম। সাথে সাথে চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়ল এক মুক্ত অশ্রু।

🖤🖤🖤🖤🖤

রাত প্রায় ১০:৩০ বাজে। সৌরভ পার্টি শেষে বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু বাসার দরজা সম্পূর্ণ খুলা দেখে তার হৃদয় অজানা কারণে ধক করে উঠে। মনে মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা এসে ভর করে। দৌড়ে ঘরের ভিতর ঢুকে চিৎকার করে ঈপ্সিতা কে ডাকতে থাকে সে। কিন্তু না। ঈপ্সিতার কোনো সাড়াশব্দ নেই। এতে আরও ঘাবড়ে যায় সে। কপাল বেয়ে ঘামের ফোটা জমা হয় । সব রুম গুলি চেক করেও ঈপ্সিতার খুঁজ পায়না। এরইমধ্যে তার মন কু ডাকা শুরু করে দিয়েছে। হটাত তার মনে হলো সিসি টিভি ফুটেজের কথা। সেটা চেক করলেই তার মাথা ভ ভ করে ঘুরতে থাকে। যা দেখে তাতে তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। ঈপ্সিতা পালিয়েছে। তা দেখেই সৌরভের রাগে মাথায় রগ ফুলে উঠে। চোখে জল চিকচিক করলেও রাগ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়েও ঈপ্সিতার কোনো খুঁজ পায় না সে। নিজেকে আর ঘরে আটকে রাখতে পারলো না। বাসা থেকে বেরিয়ে বাইক নিয়ে ছুটল ঈপ্সিতার খুঁজে। নিজের কেমন কেনো পাগল পাগল মনে হচ্ছে তার। রাত হোক আর দিন হোক তাতে তার কোনো পরোয়া নেই।

” ঈপ্সিতা দেখো যেখানে লুকিয়ে আছো ফিরে আসো বলছি। নাহলে আমি তোমার খুঁজ পেলে তোমার কি হাল করবো তা তুমি ভাবতেও পারবে না। প্লিজ ইপশিপাখি ফিরে আস না। আমি অপেক্ষা করছি তো। আমার না দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিশ্বাস আটকে আসছে আমার। প্লিজ এত বড় শাস্তি আমায় দিও না। আমি মরে যাবো। মরে যাবো আমি। আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ ইপশিপাখী ফিরে আসো না। প্লিজ। ”

সৌরভ বারবার মুখে বুলি আওয়ারাচ্ছে আর রাস্তায় বাইক নিয়ে পাগলের মত ঈপ্সিতা কে খুঁজে চলছে সে । মাঝেমধ্যে চেনা জানা মানুষদের অনবরত ফোন করেই যাচ্ছ। কিন্তু সে ব্যার্থ। কেউই ঈপ্সিতার কোনো খবর জানে না। হটাত একটা ট্রাক এসে সৌরভ এর বাইক কে ধাক্কা দেয়।আচমকা ব্যাপারটা ঘটায় সৌরভ টাল সামলাতে না পেরে বাইক থেকে ছিটকে পরে একটা গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার মনে হচ্ছে তার সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু এখনও তার মাথায় ঈপ্সিতার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই নির্জীব রক্তমাখা মুখ নিয়ে বারবার সেই একই বুলি আওড়ে চলেছে সে।

” প্লিজ ইপশিপাখি ফিরে আসো। আমি অপেক্ষা করছি তো।প্লিজ ফিরে আসো। ”

বলেই চোখ বুজে নেয় সৌরভ। সাথে সাথে হাত টা নির্জীব ভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তার।

🖤🖤🖤🖤

৩ বছর পর…

” শুরুতেই কিছু বলে সম্বোধন করলাম না। আপনি আমার প্রিয় কিনা তা নিয়ে বেশ কদিন ধরে আমি অনেক দ্বিধা ভুগছি। .তাই কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করলাম।

জানেন সত্যি বলছি আমি বারবার চেষ্টা করেছি আপনাকে ক্ষমা করার। কিন্তু ওই। আমার মন তাতে সায় দেয়নি। মনে যে আপনি অনেক ,,অনেক তিক্ততা ভরিয়ে দিয়েছেন তাই হয়তো। জানেন আজ ডিভোর্স পেপার বাসায় এসেছিল। কিন্তু কেনো যেনো আমি ওই ডিভোর্স পেপারে সই করতে পারিনি। এই দেখেন বারবার আপনাকে বলি যে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিবো। কিন্তু যখন আমরা সই করার সময় আসে তখন অজানা কারণে আমার হাত কাপছিল। জানেন অনেকবার চেষ্টা করেছি আপনাকে মুক্ত করার। কিন্তু পারেনি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছি।
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেহেতু মুক্ত করতে পারিনি তাই আমি আপনার থেকে অনেক দূর চলে যাবো। এই ঘৃণার শহরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই কখনোই আমাকে এই শহরে খুঁজতে যাবেন না।

ভালো থাকবেন। আর যদি মন চায় আরেকটা টুকটুকে বউ নিয়ে আসতে পারেন আপনার ঘরে। চিন্তা নেই আমি কখনোই আমার অধিকার নিয়ে আপনার সামনে দাড়াবো না। জানেন আজ খুব করলে বলতে মন চাইছে “”ভালোবাসি আপনাকে ।””
কিন্তু আদৌ কি ভালোবাসি ?? না মোহ এটা ??আমি আমার এই নাম না জানা অনুভতির নিয়ে বড্ড বিরক্ত জানেন। এই নামহীন অনুভতির বয়ে বেড়াতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। কিন্তু কিছু করার নেই। এই কষ্ট আমাকে আজীবন বয়েই বেড়াতে হবে। আজীবন। “”

চিঠিটা পরেই ভাইয়ের কষ্টে মন ধক করে উঠে সুরভীর । চিঠিটা পড়ে সে যেখানে নিজেও এতটা কষ্ট পাচ্ছে সেখান তার ভাই কিভাবে নিজেকে ঠিক রাখবে ?? নিজের ভাইয়ের কষ্ট একটি হলেও অনুভব করতে পারছে সুরভী। আজ সামান্য ভুল বুঝাবুঝির কারণে দুটো মানুষ এতটা,, এতোটা কষ্ট পাচ্ছে। আলাদা হয়ে আছে এত বছর যাবত। সেটা তো জাহান্নামের যন্ত্রণার মতোই কষ্টকর। এসব ভেবেই সুরভীর চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।
#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ৩২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

চৌধুরী বাড়ির সবাই পঙ্গু হাসপাতালে একটা কেবিনের সামনে দাড়িয়ে আছে। আজ তিন বছর পর সৌরভ রিলিজ পাবে এই হসপিটাল থেকে। সেদিনের অ্যাকসিডেন্ট এর পর সৌরভ এর ডান পা সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ততটা গভীর না হওয়ায় সেই পা এখন সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে গেছে। সৌরভের কেবিন থেকে ডক্টর বের হয়ে আসলে সবাই রীতিমত উনার উপর হামলে পরে সৌরভের অবস্থা জানার জন্যে। সৌরভের মা তো পুরো কেদে কেটে অস্থির হয়ে আছেন। সবার এরকম উদগ্রীব অবস্থা দেখে ডক্টর মুচকি হয়েছে বলেন,

“Now He is alright। আপনারা উনাকে আজ বাসায় নিয়ে যেতে পারেন নিশ্চিন্তে। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ রাখবেন অতিরিক্ত হাঁটা চলা যেনো না হয়। নাহলে পায়ে আবার সমস্যা দেখা দিতে পারে। ”

সৌরভের মা তারাতারি করে বলে উঠেন,

“অবশ্যই খেয়াল রাখবো। আমার ছেলের আর কোনো অ্যাকসিডেন্ট আমি কিছুতেই হতে দিবো না। মরতে মরতে বেচেছে ও। আমি আবার ওকে হারাতে পারবনা। কিছুতেই না। ”

বলেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল টা মুছে নিলেন সৌরভের মা। সৌরভের বাবা তার স্ত্রীর কাধ ধরে আশ্বাস দিলেন যে এবার ওদের ছেলের আর কিছুই হবে না।

কেবিনের বেডের উপর নির্জীব ভাবে শুয়ে আছে সৌরভ। চোখে মুখে রাগী ভাব যেনো সামনে কাউকে পেলেই ভষ্ম করে দিবে। এই তিন তিনটা বছর ওর জীবন থেকে চলে গেছে। এই তিন বছর ও শুধু এই রাস্কেল বেডের উপর শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছে তা ভাবতেই তার রাগে মাথার রগ ফুলে উঠেছে। কিন্তু এই অসুস্থ অবস্থায় ইপশিতার খবর নিতে ভুলে নি সে। কিন্তু কেউই বলতে পারেনি ঈপ্সিতা কোথায় আছে। এবার ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুস্থ হওয়ার পর ও নিজে খুঁজবে ঈপ্সিতা কে। পালিয়ে আর কতদূরই বা যাবে। ধরা তো ওকে দিতেই হবে। কারণ ঈপ্সিতা সৌরভের চয়েজ। আর সৌরভ কখনোই তার পছন্দের জিনিস হারায় না। কখনোই না।

কেবিনে এক এক করে চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা প্রবেশ করছে। সৌরভ এর মা কেবিনে ঢুকেই সৌরভের কাছে বসে ডুকরে কান্না করতে থাকেন। নাক টা টেনে টেনে বলতে লাগেন,

” জানিস আমি খুব ভয় পে গেছিলাম। কেনো এতো রাতে বের হয়েছিলি তুই বল ?? বের হয়েছিস তো বাইক তো আস্তে করেই চালানো যায়। তাইনা ?? ”

” সাবিনা , এখন তো সব ঠিক আছে। এসব কান্নাকাটি বন্ধ কর। নাহলে ছেলের সাথে তুমিও অসুস্থ হয়ে পড়বে। ”

সৌরভের বাবার কথা শুনে সৌরভের মা উনার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলেন,

” এখন আমি শান্তি মত কাদতেও পারবোনা তোমার জন্যে। কেনো ?? ”

“আরে। রাগছো কেনো ? আমি সেটা বলি নি। আচ্ছা বাদ দেও। ছেলেকে ঘরে নিয়ে যাবে না ? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ”

সুরভী নাক ফুলিয়ে বলে,

” দেখছো ভাইয়া আজ তুমি অসুস্থ বলে তোমার এত কদর। আর আমি যেনো নদীর জলে ভেসে এসেছি। ”

সৌরভ হলকা হেসে বলে,

” নদী এটাতো ভালো জায়গা। কিন্তু তুই ত এর থেকেও খারাপ জায়গা মানে ড্রেন থেকে এসেছিস। চাল হাট। ”

আর সুরভী সৌরভের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। সৌরভের ভালোই লাগছে এসব। সবাই কতোটা টেনশন করে ওর জন্যে। নিজেকে এমন পরিবারের ছেলে ভেবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে নি সে। সৌরভ বলে,

” মা। আমি ঠিক আছি। কেনো এতো চিন্তা করছো মম I’m alright। এই দেখো। ”

বলেই পায়ের দিকে ইশারা করলো সৌরভ। সৌরভের মা ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলেন,

” হুমম। জানি। আল্লাহ আমার বুকের ধন আমার বুকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। সে জন্যে আলহাদুলিল্লাহ।

সবাই মিলে সৌরভ কে বাসায় নিয়ে আসে। আজ অনেকদিন পর নিজের বাড়ি দেখতে পেয়ে আর নিজ পেয়ে হাঁটতে পারে অসম্ভব ভালো লাগছে সৌরভের। কিন্তু এখন ওর অন্য কাজ আছে। যেই কাজ পূরণ করতেই ও এত তারাতারি ডক্টর কে বলে হসপিটাল থেকে রিলিজ নিয়েছে।

🖤🖤🖤

রাঙামাটি একটা আশ্রমে ঈপ্সিতা বাচ্চাদের ক্লাস নিচ্ছে। এই বাচ্চাগুলোর সাথে যতক্ষণ ও থাকে যেনো জান্নাতের সুখ পায় ও। পুরনো দুঃখ ভুলতে এই বাচ্চাগুলো যে সহায় ওর। আজও বাচ্চাদের বায়না অনুযায়ী সিন্ড্রেলার গল্প শুনাতে হয়েছে ওর। ভালোই লাগে এই ছোট ছোট বাচ্চাদের ছোট্ট ছোট্ট বায়না রাখতে। এরাই তো সব ওর। বেচে থাকার আশ্বাস।

ক্লাস শেষে ঈপ্সিতা সবাইকে সালাম দিয়ে বের হয়ে আসে। আশ্রমের মাঠ দিয়ে একলা হাতে হাঁটতে থাকে। যখনই ও একা থাকে পুরনো স্মৃতি ওর মাথায় চড়ে বসে। বহুত চেষ্টা করেছে ও সৌরভ কে ভুলতে। কিন্তু এখানে আসার পর ওর মনে হচ্ছে এই সৌরভ নামটা ওর মাথায় আরো ঝেকে বসেছে। রাত দিন সবসময় এই নামটা ওকে জালিয়ে মারছে। হ্যা এখন ও মানতে শুরু করেছে যে ও দূর্বল হয়ে পড়েছে সৌরভের প্রতি। কিন্তু ও ফিরে যেতে পারছে না নিজের স্বামীর কাছে। হয়তো ইগোতে বাঁধছে ওর। আবার একটু একটু অভিমান হয়েছে তার। এই তিন বছর সৌরভ ওকে একবারও কি খুজার চেষ্টা করেনি। দূর সৌরভ কিভাবে ওকে খুজে পাবে ও তো জানেইনা ইপ্সিতা কোথায় আছে। কিন্তু ভালো করে খুঁজলে কি সত্যিই ঈপ্সিতার খোঁজ ও পেত না। হয়তো পেত। হতে পারে সৌরভ আবার বিয়ে করেছে। তাই হয়তো ওর কোনো খুঁজ নেয়নি। কেনই বা বিয়ে করবে না। ও কি কখনোই ভালোবেসে সৌরভ কে। সৌরভ এর একটা ভুলের জন্যে এত বড় শাস্তি না দিলেও পারতো ও। কিন্তু তখনো ওর কাছে এটাই ঠিক মনে হয়েছে। সৌরভ মনে হয় তার নতুন বউয়ের সাথে খুব খুব সুখে আছে। থাকুক না ওরা ওদের মত। কি দরকার ওদের মধ্যে তৃতীয় জন হওয়ার।

” কিরে নিজের জামাইয়ের ধ্যানে আছিস নাকি ?? ”

মৌমিতার কণ্ঠ শুনে ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসি আমি। ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,

” কেনো ?? যখনই কোনো ধ্যানে থাকবো তখনই কি আমার জামাইয়ের সেখানে ঠায় নেওয়া জরুরি ?? উহু আমি এসব ভাবি না। বুঝলি। ”

মৌমিতা আর আমি পাশপাশি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছি। মৌমিতা বলে উঠে,

” আচ্ছা তো কি সত্যিই তোর হাসবেন্ডের করে মনে পড়েনা ?? তুই এত পাষাণ কেনো রে ?? ”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,

” হুমম। আমি পাষাণ। নিজের স্বামীকে যে ফেলে আসতে পারে সেতো পাষাণই। ”

” ফিরে যাস না কেনো তার কাছে ?? ”

” সে কি একবারও আমার খুজ নিয়েছে ?? ”

” তুই কি করে জানলি সে খুঁজ নেইনি ? ”

” জানিনা। মনে হলো তাই বললাম। হয়তো সে তার নতুন অর্ধাঙ্গিনী নিয়ে হ্যাপী। ”

” এতটা খারাপ ভাবিস নিজের স্বামীকে ?? ”

“না। ভাবিনা। কিন্তু এটাই কি স্বাভাবিক নয় ?? ”

” আমার মনে হয়না সে এটা করতে পারে। তোর কথা মত আমার মনে হয় বড্ড ভালোবাসে তোকে। ”

” হয়তো। ”

হটাৎ মৌমিতা উত্তেজক সুরে বললো,

” আচ্ছা শুন। কাল আমাদের এখানে রিউনিয়ন হবে। জানিসই তো তুই। তো কাল গেস্ট হিসেবে আমার কলেজ ক্রাশ আসবে। জানিস আমি বলে বুঝাতে পারবো না আমি কতোটা হ্যাপী। দেখ কতদিন পর ওকে সামনাসামনি দেখবো। ভাবতে পারছিস আমার কি অবস্থা হবে তখন। I’m super duper excited। ”

আমি ওর কথার উত্তরে হালকা হাসলাম। কিছুসময় ওর ক্রাশের কথা শুনে ওকে বিদায় জানিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলাম। আবার সেই একই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওর। বিছানায় বসে নিজের মাথাটা চেপে ধরে সৌরভের চিন্তা মাথা থেকে দূর করার বৃথা চেষ্টা করে চলেছি আমি। কিন্তু যার স্থান হৃদয়ে সে কি কখনো মস্তিষ্ক থেকে তাড়িয়ে যেতে পারে। একদমই না। তাই নিজেকে সামলে সাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে ঢুকলাম আমি। এখন মাথাটা ঠান্ডা করা ভীষণ দরকার আমার।

🖤🖤🖤

আজ ২৯ / ০৭ / ২০২০ তারিখ। আজ আশ্রমে রিউনিয়ন হবে। ভোর সকালে মৌমিতা ফোন দিয়ে রেডী হতে বলেছে আর আমি এখন মাত্র সাওয়ার নিয়ে আসলাম। একটা কাতানের শাড়ি পড়ে চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা নুড কালার লিপস্টিক দিয়ে দিলাম আমি। কানে ঝুমকা দিয়ে ব্যাস আমি পুরো রেডী। আমি ফোন দিয়ে মৌমিতা কে আশ্রমে আসার কথা বলে বের হয়ে গেলাম ঘর থেকে।

🖤🖤🖤

আজ সকালে সৌরভ রেডী হচ্ছিল ইপশিতার খুঁজে যাওয়ার জন্যে। এখনও অনেক জায়গায় ওর খবর নেওয়া বাকি। ঠিক তখনই সৌরভের বাবা ওর রুমে এসে বলেন,

” সৌরভ , কোথায় যাচ্ছ তুমি ?? ”

সৌরভ শার্ট টা পড়ে নিয়ে বলে,

” একটু বাইরে যাবো বাবা। কেনো কোনো দরকার ?? ”

” হুমম। তুমি যে আশ্রমে টা ওপেন করেছিলে আজ সেখানে রিউনিয়ন হবে। ওরা তোমাকে ফোন দিচ্ছিল রিসিভ নি কেনো তুমি ?? ”

” বাবা আমার এখন অনেক কাজ আছে। ওই রিউনিয়ন এটেন্ড করা আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়। প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো। ”

” দেখ তুমি না গেলে ওরা অনুষ্ঠান কি করে শুরু করবে ?? কাজ টা আপাদত বন্ধ রেখে তুমি আশ্রমে যাও। ”

” বাব.. ”

” আমি বলছি তুমি যাবে তো যাবে। অন্য কোনো কথা না। আর বেশি হাঁটাচলা করবে না। জানইতো তোমার পায়ের কি অবস্থা। ”

” ওকে। ঠিক আছে আমি যাবো। ”

সৌরভের বাবা চলে গেলে সৌরভ বিরক্ত মাখা মুখ নিয়ে বাবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরেকটা দিন ওর হাত থেকে চলে গেলো। কি আর করার । বাবার কথাটা মানতেই হবে ওকে। কোনো ভুল আর ও করতে চাইনা। একটা ভুলে জন্যে ও আজ এত বড় শাস্তি পাচ্ছে সেখান দ্বিতীয় ভুল ও কখনোই করবে না।

চলবে…

[ গল্প শেষের পথে ….. ]
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here