শেষ প্রান্তের মায়া পর্ব -২২+২৩

#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

বিয়েটা যেনো আমার মাথার ওপর দিয়ে গেলো। হুট করে কি হয়ে গেলো ভাবতেই যেনো গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। শুকনো ঢোক গিলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রইলাম। সামনেই আরাফ আর বাকি সবাই মেতে উঠেছে বিয়ের আমেজে। মাহিদ আমার পাশে এসে বসে। আমি ওর দিকে তাকাতেই মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘অবশেষে আমার বুবু সুখের দেখা পাবে। আমার বুবুও সকল কষ্টের শেষে একফোঁটা সুখের বৃষ্টি পাবে।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মাহিদকে কিভাবে বলবো তার বুবু কখনোই সুখের দেখা পাবে না। মৃত্যু হয়তো খুব কাছে তার। চোখের কোণা ভিজে আসে। মাহিদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘বুবু তোমাকে ছাড়া থাকতে আমাদের অনেক কষ্ট হবে।’

আমি দ্রুত গতিতে ওকে ছেড়ে বললাম, ‘মানে? আমি কোথায় যাবো?’

‘ওমা তুমি তো এখন থেকে আরাফ ভাইয়ের এখানেই থাকবে।’

মাহিদের ঠোঁটের কোণের হাসি আর কথা শুনে প্রশান্তির শ্বাস নিলাম। ভেবেছিলাম আমার ভাইটাও বুঝি সত্যিটা জেনে গেছে। বড় বড় করে শ্বাস নিলাম। পরক্ষণেই মাথায় এলো মাহিদের পুরো কথা। আমি আরাফের সাথে থাকবো মানে! পাগল নাকি! চট করে মাহিদের হাত ধরে বললাম,

‘আমি থাকবো না এখানে।’

মাহিদ থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কেনো? কি হয়েছে? থাকবা কেনো? বিয়ে হয়ে গেলো তোমার তাহলে ভাইয়ার সাথে কেনো থাকবে না?’

‘বিয়ের খেতায় আগুন দে। আমি তোদের সাথে থাকবো। এখানে থেকে কি করবো আমি! বিয়ে হয়েছে হোক। কিন্তু তোরা ওখানে একা থাাকবি আর আমি এখানে থাকবো তা কখনো হয়?’

পাশ দিয়ে তিন্নি এসে মাথায় গাট্টা মে’রে বলে, ‘গা’ধী। আমরা আছি না! আর তুমি এমন পাগলামো করছো কেনো? বিয়ে হলে তো মানুষ শ্বশুরবাড়িতে নয়তো নিজের বরের সাথেই থাকে।’

আমি কিছু বলার আগেই মাহমুদা বলে, ‘আরেহ বুবুর কথা ধরছো কেনো? বাদ দাও। ‘ও’ যে কখন কি বলে না বলে ওর মাথার ঠিক নেই। ছাড়ো ছাড়ো!’

আমি তেড়ে গেলাম মাহমুদার দিকে। মাহমুদা ভোঁ করে দৌড় দেয়। সবাই হাসাহাসি শুরু করে। আরাফ কাছে এগিয়ে এসে মাইশা আর সিহাবের মধ্যে বসে পড়ে। হাসিমুখে বলে,

‘কি হয়েছে? সবাই এতো দৌড়াদৌড়ি কেনো করছে?’

তিন্নি হেঁসে বলে, ‘আপনার বউ নাকি আপনার সাথে না থেকে আমাদের সাথে থাকবে। নিয়ে যাবো নাকি আপনার বউকে?’

আরাফ ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমার দিকে। আমি উনার তাকানো দেখে চুপ করে মাহিদের কাছে সরে বসলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মাহিদ ঠোঁট চেপে হাসছে। আরাফ শান্ত গলায় বলে,

‘আপনাদের আর কষ্ট করতে হবে না আপু। বউ নিয়ে কালই তো যাবো আপনাদের বাড়ি। তখন না হয় রেখে দিয়েন।’

সবাই হাসে। আরাফ আর আমাকে নিয়ে ফাজলামি করতে থাকে। রাতে আরাফ সবাইকে খাইয়ে তারপরই ছেড়েছে। এখানে তো সে ছাড়া আর কেউ থাকে না তাই সম্ভবত বাহির থেকে খাবার এনেছে। আরাফ সবাইকে থাকতে বললেও কেউ থাকলো না। সবাই আমাদের নিজেদের একা ছেড়ে চলে গেলো। পুরো ফ্ল্যাটে আমি আর আরাফ শুধু একা। আরাফ নিচে গেছে কিছু আনতে। ওহ হ্যাঁ তিন্নি আর মাহমুদা মিলে বেডরুম সাজিয়েছে টুকটাক। আমি একবার সে ঘরে উঁকি দিয়ে পুরো ফ্ল্যাটে ঘুরলাম। একটা বেডরুম, একটা গেষ্ট রুম, কিচেন আর ছোট একটা ড্রয়িং রুম। একদম ছোট একটা ফ্ল্যাট তবে সুন্দর। দেয়ালটা সাদা রঙ করা। ড্রয়িং রুমে সোফা রাখা। আমি সোফাতেই পা তুলে গালে হাত দিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ বাদেই হাজির হলো আরাফ। আমাকে এমন সোফায় বসে থাকতে দেখে গম্ভীর মুখে কাছে এগিয়ে আসে। আমি তখনো তার দিকে গালে হাত দিয়েই তাকিয়ে আছি। উনি পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘নতুন বউ ঘোমটা দিয়ে বাসর ঘরে না বসে সোফায় পা তুলে বসার ঘরে কি করছেন?’

আমি উনার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই নিজে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি এমন একটা ভাব করছেন যেনো সব ঠিক আছে! বিয়েটা কেনো করলেন?’

‘ভালোবাসি তাই।’

উনার শান্ত গলার ‘ভালোবাসি তাই’ শুনে নড়েচড়ে বসলাম। দৃষ্টি সরিয়ে এদিক ওদিক করলাম। উনি নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। হাই তুলে এগিয়ে গেলেন বেডরুমের দিকে। আমিও যাবো কি না দোনামোনা করতে করতে বসে রইলাম। আমার বিয়ে এর আগেও হলেও অনুভূতি এমন যেনো এটাই প্রথম বিয়ে। এটা সত্য আমি লজ্জা, ভয়, অস্বস্তি নিয়েই আরাফের সাথে স্বাভাবিক হতে পারছি না। বার বার মনে হচ্ছে বিয়েটা করে বোধহয় ভুল করে ফেললাম। আরাফের জীবনটাও ন’ষ্ট হবে না তো! দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছিলাম আর চিন্তার সাগরে ডুবে ছিলাম। হুট করেই আরাফের ডাক শুনে চমকে উঠলাম। এতোটাই চমকেছি যে সোফা থেকে একটুর জন্য পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। বুকে থু থু করতে করতে ছুট লাগালাম রুমের দিকে। আরাফ একটা প্যাকেট হাতে ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘রুমে আসার ইচ্ছে আছে নাকি সারা রাত ওই ড্রয়িং রুমেই পার করার শখ?’

আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘আমার তো বাড়ি যাওয়ার শখ।’

আরাফ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কাবাড থেকে কাপড় বের করতে করতে বলে, ‘বিয়ে যখন করেছি তখন বউকে আর একা ছাড়ছি না কোথাও। ওই ব্যাগে শাড়ি আছে। চুপচাপ পড়ে নেন।’

আমি ব্যাগের দিকে তাকাতেই উনি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। পুরো রুমের পরিবেশ দেখে বুঝলাম আমার শ্বশুর আব্বা বিরাট বড়লোক না হলেও ভালোই ছিলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলাম তার ভেতরে একটা লাল শাড়ি। রীতিমতো টাস্কি খেলাম যেনো। বিয়ের পর শাড়ি দেয় কে ভাই! আমি বোকার মতো ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চিল্লিয়ে বললাম,

‘বিয়ে শেষ হওয়ার পর শাড়ি পড়ে কে? বিয়ে শুরু হওয়ার আগে যে শাড়ি দিতে হয় তা জানেন না!’

ভেতর থেকে সাড়া শব্দ পেলাম না। ব্যাগ এক সাইডে রেখে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলাম। এটা কি ধরনের বোকামি! মাথাটাই খারাপ হওয়ার জোগাড়।

কতক্ষণ বাদে আরাফ সাহেব বের হলেন তার হিসেব নেই। উনি বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শাড়ি পড়েননি কেনো?’

‘বিয়ে শেষ হওয়ার পর শাড়ি দিচ্ছেন কেনো? আগে দেন নাই কেনো?’

‘তাতে কি হয়ছে?’

আমি কপাল চাপড়ে বসে রইলাম। এই লোকের সাথে তর্ক করতে চাওয়াটাই ভুল। চুপচাপ ব্যাগটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। ব্যাগের মধ্যে আমার প্রয়োজনীয় সবটাই ছিলো। দাঁতে দাঁত চেপে শাড়ি পড়ে নিলাম। এরপর বেরিয়ে আসলাম। আরাফ তখন বিছানায় বসে পা দলাচ্ছে। আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আয়নার সামনে বসলাম। আরাফের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি সে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি নিজের দিকে ভালো করে দেখলাম। সবই তো ঠিক আছে। নিজের মতো চুলটা আঁচড়ে বেঁধে নিলাম। পেছনে তাকিয়ে তার সামনে এগিয়ে এসে বললাম,

‘আমার মধ্যে এমন কোনো বিশাল পরিবর্তন হয়নি যে হা করে তাকিয়ে থাকবেন! রাতের বেলা হুদাই তো শাড়ি পড়ালেন এবার কি রাতের বেলা শাড়ি পড়ে নেচেও দেখাবো?’

আরাফ আমার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেঁসে দেয়। ইশশ কতদিন পর তার হাসি দেখলাম। আজ কাল আমার মনে হয় আমি তার এই হাসিতেই ম’রে যাবো। তার হাসিতে আমার নিজের ঠোঁটও প্রসারিত হয়ে গেলো। আরাফ আমাকে টেনে বসিয়ে দিয়ে টুপ করে কপালে চুমু খেয়ে একটা বেলীফুলের মালা খোঁপায় গুজে দিয়ে বলে,

‘আপনি আমার কাছে সব পরিস্থিতিতেই সুন্দর মায়া। আর এই যে লাল শাড়ি! এটাতে আপনাকে একদম বউ বউ লাগছে। একদম আমার নতুন বউ। আর আমার বিয়ে করা বউকে আমি হা করে দেখবো নাকি সামনে বসিয়ে মন ভরে দেখবো তা আমার একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এই ব্যাপারে আমি আপনার কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নিবো না। বুঝেছেন!’

আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। চোখ দুটো একদম চোখের দিকে। আমি শুকনো ঢোক গিললাম। চোখ দুটো মুহুর্তেই জ্বালা করে ওঠে। নিজেকে সামলাতে গিয়েও পারলাম না। জাপ্টে ধরলাম আরাফকে। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আরাফ নিজেও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলো। কপালের এক কোণায় চুমু দিয়ে বললো,

‘আমি আপনাকে আজীবন এভাবেই ভালোবাসবো মায়া। কোথাও হারাতে দেবো না আপনাকে।’

ভাঙা গলায় বললাম, ‘আমাকে তো হারাতে হবে আরাফ। আপনি তো জানেন আমার ব্লাড ক্যান্সার। হয়তো আমি আর কিছুদিন..’

আরাফের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকলো যেনো আমাকে কেউ কখনো তার থেকে আলাদা করে নিয়ে যেতে পারবে না। কান্না পেয়ে গেলো ভীষণ রকম। নিজেকে উজাড় করে কাঁদতে না পারলেও চোখ থেকে তখনো জলের স্রোত বয়ছে। কতক্ষণ সেভাবে কেটেছে আমার জানা নেই। একটা সময় আমি যখন আরাফকে ছাড়াতে নিলাম তখনও আমাকে আরাফ ছাড়লো না। বিড়বিড় করে বললো,

‘আমি আপনাকে আজীবন এভাবেই শক্ত করে বুকের মাঝে আটকে রেখে দেবো। কোথাও যেতো দেবো না আপনাকে। আপনি আজীবন আমার কাছে এভাবেই থেকে যাবেন।’
_____

আরাফের নিজেকে স্বাভাবিক করতে সময় লাগে বেশ অনেকক্ষণ। এরপরও তার চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে ছিলো যেমনটা কেউ কান্না আটকানোর সময় করে। উনার মন ভালো করার জন্য নিজে থেকেই বললাম,

‘নামাজ পড়বেন না? কত কথা বলে সময় নষ্ট করতেছেন অথচ বিয়ের রাতে যে নামাজ পড়ে পথচলা শুরু করতে হয় জানেন না!’

আরাফ হাসার চেষ্টা করে। এরপর দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করে জায়নামাজেই বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে দুজনে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। বাইরে সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। একদম গোল। চাঁদ দেখেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলাম। আরাফ আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এক চাঁদ আকাশে একা আরেক চাঁদ আমার পাশে। আমার বউ।’

আমি লজ্জা পেলাম। চোখ মুখ খিচে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। আরাফ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনী রেখে বলে,

‘আমি আমার চাঁদ কে হারাতে দেবো না। ভাালোবেসে আগলে রাখবো আজীবন।’

আমি উনার খুশিটা ন’ষ্ট করলাম না। যে কয়দিন বাঁচবো ততদিন না হয় এই মানুষটার সাথে, তার বুকে মাথা রেখেই কাটালাম। আমার একটা আক্ষেপ তো মিটে গেলো। হোক ক’দিনের জন্য তবুও ভালোবাসার মানুষকে তো আপন করে পেলাম। যতদিন বাঁচবো না হয় তাকে ভালোবেসেই বাঁচলাম। হ্যাঁ হয়তো আমি হয়েছি স্বার্থপর তবে এবার না হয় একটু স্বার্থপর হয়েই বাঁচলাম। আর দূরত্ব না-ই বা আসলো আমাদের মাঝে। নয় হয় এবার দূরত্ব টুকু মিটিয়ে একে অপরের মাঝে মিশেই থাকলাম। হলাম না হয় একে অপরের পূরক।

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
______________

আরাফকে নিজের বাড়িতে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে আমি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। আরাফ এখানে আসবে কিভাবে? এটা তো অসম্ভব। চোখ পিটপিট করে একবার আরাফের দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকালাম মাহিদের দিকে। মাহিদ কাছে এসে দুহাতে গাল আগলে নেয়। হেঁসে বলে,

‘তোমাকে আমি বুঝি বুবু। তোমার চোখ দেখলে বুঝতে পারি তোমার মন কি চায়! সেখানে আরাফ ভাইয়ের বিষয়টা বোঝাটা আমার কাছে কঠিন কিছু ছিলো না। আর আমি তো চেয়েছিলাম তুমি জীবনকে একটা সুযোগ দাও। যখন তুমি নিজেকে সুযোগ দিয়েছো তখন প্রশ্নই আসে না আমার বাঁধা দেওয়ার। তোমার জন্মদিন উপলক্ষে আমাদের পক্ষ থেকে তোমাকে দেওয়া সবথেকে বেষ্ট গিফ্ট। তুমি খুশি তো বুবু?’

মাহিদের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আচমকা ভাইকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠলাম। কল্পনাও করিনি ভাই আমাকে এতোটা বুঝে! আমার খুশির জন্য ওরা আরাফকে গিফ্ট দিলো। মাহমুদা আর তিন্নি আমার কাছে এসে পিন্চ মে’রে বলে,

‘এবার তাইলে আমরাও খালামনি হবো!’

লজ্জায় চোখ গরম করে তাকালাম। আরাফ এগিয়ে আসে কাছে। মাহমুদা ফিসফিস করে বলে, ‘বুবু ভাইয়াকে কেক খাওয়াও।’

ছোট ভাই বোনদের মধ্যে লজ্জায়, জড়তায় কিছুই পারলাম না। আরাফ আমাকে সহজ করে নিজেই একটুকরো কেক তুলে আমাকে খাইয়ে দিলো। আস্তে করে বললো, ‘শুভ জন্মদিন ম্যাম।’

আমি মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হাসলাম। সকালের কথা মনে পড়তেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। আরাফের দিকে তাকালাম মলিন চোখে। আরাফ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো। মাহিদ, মাহমুদা, মাইশা, সিহাব, তিন্নি, সোহান ভাই সবাই অন্যদিকে কেক খেতে আর গল্প করতে ব্যস্ত। তারা আমাদের থেকে খানিকটা দুরে। আরাফ একবার তাদের দিকে তাকিয়ে আমার কানের কাছে মুখ এগিয়ে আনে। ফিসফিস করে বলে,

‘মানুষ নাকি প্রেমে পড়লে বোকা হয়ে যায়! এতোদিন শুধু শুনতাম আজ তা দেখেও নিলাম।’

ঠোঁট কামড়ে হাসে আরাফ। আমি কথার মানে বুঝলাম না। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আরাফ কোনোমতে হাসি আটকিয়ে বলে,

‘বিয়ের কথা বললাম ঠিক আছে কিন্তু কার সাথে তা বলেছি কি? জিজ্ঞেস করেছেন? কবে থেকে এতো বোকা হয়ে গেলেন?’

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আরাফ এবার শব্দ করে হাসতে থাকে। তার হাসির শব্দে সবাই আমাদের দিকে তাকায়। আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলাম। সোহান ভাই জিজ্ঞেস করে,

‘কি ভাই! এতো হাসি কিসের?’

‘ভাই আপনার শালিকা তো অনেক বোকা। উনাকে একটু বুঝান আমার বিয়ে কার সাথে!’

আরাফের সাথে সাথে বাকি সবাইও হেঁসে উঠে। এবার আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। তিন্নি কাছে এসে মাথায়য় গাট্টা মে’রে বলে,

‘আপনার আর আরাফ ভাইয়ের বিয়ে ফিক্সড করা হয়ে গেছে ম্যাম।’

ড্যাবড্যাব করে তাকালাম সবার দিকে। পুরো ব্যাপারটা ভাবতেই বুঝে গেলাম আসল ঘটনা কি! নিজের বোকামির জন্য নিজেই নিজেকে বকা দিলাম। আরাফ ঠিক বলেছে মানুষ বোধহয় প্রেমে পড়লে সত্যিই বোকা হয়ে যায়। লজ্জায় মাটির মধ্যে ঢুকে যেতে মন চাচ্ছে। এরপর সবাই টুকটাক গল্প করলো। আরাফ সবার সাথে দারুণ ভাবে মিশে গেলো। সবার একে অপরের সাথে মিল দেখে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এরপর খাওয়া দাওয়া শেষ করে আরাফ বাড়ি চলে যেতে চাইলো। প্রথমে মাহিদ আর সোহান ভাই এগিয়ে দিতে চাইলেও পরে সবাই আমাকেই বললো এগিয়ে দিতে। আমি প্রথমে না না করলেও তিন্নি আর মাহমুদার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। আরাফ আর আমি পাশাপাশি হেঁটে বস্তির বাহিরে আসলাম। দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আরাফ নীরবতা ভেঙে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘এটা নিন।’

আমি প্যাকেটটার দিকে তাকালাম। গিফ্ট পেপারে মোড়ানো। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আরাফ হেঁসে বলে, ‘আমার পছন্দের একটা শাড়ি।’

‘আপনি? কিন্তু টাকা!’

‘আসলে আমার তো ফ্যামিলির কেউ নেই তাই পড়াশোনার সাথে সাথে একটা পার্ট টাইম জব করতাম। আমার পুরো টাকাটা কাজে লাগতো না। তাই যা বাচতো তা তুলে রাখতাম। সব টাকা দিয়ে আপনার জন্য নিজের পছন্দের একটা শাড়ি কিনেছি। পড়বেন তো?’

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মানছি তার পছন্দের শাড়ি কিন্তু শাড়িটা নেওয়া ঠিক হবে কি না ভেবেই দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম। হাত কচলাতে কচলাতে নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়লাম। আরাফ বোধহয় বুঝলো আমার অস্বস্তির বিষয়টা তাই সে শাড়িটা নিজের দিকে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘ইটস ওকে। আপনার অস্বস্তি হবে জানলে আমি দিতাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি তাই কখনোই চাইবো না আপনি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করুন। এটা না হয় থাক!’

আরাফের চোখ মুখে মলিনতা স্পষ্ট দেখলাম। আরাফ মন খারাপ করে প্যাকেটটা নিয়ে চলে যেতে নিলে আমি প্যাকেটটা টেনে নিজের কাছে নিলাম। হেঁসে বললাম,

‘বাহ রে! হবু জামাই গিফ্ট করছে আর আমি নিবো না বুঝি! কখনোই না। আমার জন্য এনে আবার ফিরে নিয়ে চলে যাচ্ছে হুহ!’

আরাফ প্রথমে থতমত খেলেও পরে আমার কাজে হেঁসে দিলো। তার গিফ্ট টা নিয়েছি বলে সে ঠিক কতটা খুশি হলো বলে বুঝাতে পারবো না। চোখে মুখে খুশির রেশ থেকে গেলো। এতোটুকুতেই ছেলেটা এতো খুশি! আরাফ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে,

‘ওহ হ্যাঁ! একটা কথা।’

বলেই পকেট থেকে একটা খাম এগিয়ে দিলো। আমি খামটা হাতে নিয়ে তার দিকে তাকালাম। সে বললো, ‘গেস করুন কি হতে পারে!’

‘আপনি বলে দিন।’

আরাফ পকেটে হাত গুজে বলে, ‘আমি চাকরী পেয়ে গেছি ম্যাম। সকালে এই সুখবরটার কথায় বলেছিলাম।’

উনার চাকরীর কথা শুনে খুশি হলাম। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। ছেলেটা অনেকদিন থেকেই জবের জন্য ছুটছিলো। অবশেষে পেয়ে গেলো। আমি হাসলাম। আরাফ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘সকালে কিন্তু আমি আপনি যাওয়ার আগে চলে যাইনি। একটু দুরে লুকিয়ে ছিলাম। আর বিকেলেও এসেছিলাম। কিন্তু যত যায় বলেন আপনার মুখটা কিন্তু দেখার মতো ছিলো! আহারে বিয়ের কথা শুনে একদম মুখটা চুপসে গেছিলো।’

বলেই হাসতে থাকে। আমি গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। একে তো কষ্ট দিয়েছে তারওপর এখন হাসছে! আরাফ আমার গাল ফুলানো দেখে বলে,

‘সরি ম্যাম। আসলে ভাবলাম একটু সারপ্রাইজ দেওয়া যাক কিন্তু এতোটা কষ্ট পাবেন একদমই ভাবিনি।’

আমি কিছু বললাম না। নিকুচি করেছি তার সারপ্রাইজের! ওদিকে যে আমার সবে গড়ে ওঠা মনটা ভেঙে যাচ্ছিলো তার বেলায় কিছু না! সে থাকুক তার সারপ্রাইজ নিয়ে। হুহ! হুট করেই আরাফ হাত টেনে আমার অনামিকা আঙুলে কিছু একটা পড়িয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখি সুন্দর একটা রিং। অবাক হলাম। আরাফ হাটু মুড়িয়ে বসে হাত ধরে বলে,

‘আপনাকে আমি ভালোবাসি মায়া। আপনার সাথে আমার বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কাটাতে চাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি শুধু আর শুধু আপনাকে ভালোবাসতে চাই। আপনাকে প্রতিটা ভোরের শুরু এবং প্রতিটা রাতের শুরুতে পেতে চাই। আপনার এই মায়ায় ভরা মুখ দেখে আমি আমার ক্লান্তির অবসান ঘটাতে চাই। তীব্র জ্বরে আমি আপনাকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটাাতে চাই। আপনি কি হবেন আমার জীবনসঙ্গীনি? হবেন আমার প্রতিটা মিষ্টি সকালের শুরু? হবেন আমার তীব্র তৃষ্ণার প্রশান্তি? থাকবেন আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সঙ্গী হতে? ভালোবাসবেন আমায়?’

ভাষা হারিয়ে ফেললাম কিছু বলার। কেউ কখনো আমাকে এতোটা ভালোবাসেনি। কেউ কখনো এতটা আকুলতা দেখায় নি। প্রশান্তিতে চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আরাফ দ্রুত বসা থেকে উঠে আমাকে আগলে নেয়। দুহাতে গাল আগলে বলে,

‘কি হয়েছে মায়া? কাঁদছেন কেন? আমার কোনো কথায় খারাপ লেগেছে?’

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়াতে থাকে। উনি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমাকে। ডুকরে উঠলাম। ভরসার, নিরাপত্তার জায়গা পেয়ে আঁকড়ে ধরে থাকলাম। আরাফ কিছু বললো না। শুধু চুপটি করে জড়িয়ে ধরে থাকলো। আমার কান্না কিছুটা কমে আসতেই উনি আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দুচোখের পাতায় চুমু খেলেন। কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে থাকলাম। মুহুর্তেই অনুভব করলাম কপালে আরাফের গভীর চুম্বন। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। আবেশে শক্ত করে ধরলাম আরাফের শার্ট। আরাফ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘আপনি এখন আমার বাগদত্তা। ক’দিন বাদেই একদম নিজের করে নিবো। আপনার অতীতে যেই থাকুক বর্তমান আর ভবিষ্যৎ হবো শুধু আমি। কেউ এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।’

________

সারা রাত ঘুম হলো না। আজ জুম্মার দিন। আমার গার্মেন্টস অফ। আজ আর আরাফের সাথে দেখা হবে না। সকাল সকাল উঠে নিজেই সব কাজ সেড়ে নিলাম। স্নেহাকে নিয়ে মাহমুদা বসে আছে। মাহিদ আর সোহান ভাইয়েরও আজ ছুটি৷ সবাই মিলে বাড়িতে থাকার মজা অন্যরকম। হৈ চৈ লেগেই থাকে দুই বাড়ি মিলে। মাহমুদা আর তিন্নি আমার আঙুলের রিং টা খেয়াল করেনি। সকাল যখন স্নেহাকে নিতে গেলাম তখনই দুজনে খেয়াল করেছে। সাথেই সাথেই দুজনে চেপে ধরে বলে,

‘রিং কে দিয়েছে? আরাফ ভাই? বাব্বাহ আমাদের না জানিয়ে এনগেজমেন্টও হয়ে গেলো!’

মাহমুদা হায় হুতাশ করে বলে, ‘বুবু এটা কোনো কাজ করছো? লুকিয়ে লুকিয়ে সরাসরি এনগেজমেন্ট! আচ্ছা আরাফ ভাই রোমান্টিক প্রপোজ করছিলো তো নাকি?’

আমি কান টেনে ধরলাম মাহমুদার। চোখ রাঙিয়ে বললাম, ‘খুব পাকনামি করা হচ্ছে! একদম কান ছি’ড়ে দেবো। হুহ!’

মাহমুদা ‘বুবু ছাড়ো’ বলে চেচাচ্ছে। আমি ওকে ছাড়তেই তিন্নি বলে, ‘তলে তলে ট্যাম্পু চালাও তোমরা আর আমরা বললেই বুঝি দোষ!’

আমি তিন্নিকে চোখ গরম দিয়ে স্নেহাকে কোলে নিয়ে চলে আসলাম। এই দুটো মেয়ে আমাকে ক্ষেপাতে পারলে আর কিছু লাগে না। আমি নিজের কপাল চাপড়ে স্নেহাকে কোলে নিয়ে বসলাম। সিহাব আর মাইশা আমার কাছে ছুটে আসে। দুটো মিলে সারাদিন ঝ’গড়া করে। আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘কি হয়ছে? আজ কি নিয়ে লেগেছে?’

দুজনে একসাথে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি যেনো বললো। ওদের চেঁচানোতে স্নেহা কান্না করে ওঠে। দুজনকে ধমকে থামিয়ে স্নেহাকে থামালাম। তারপর দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘এক এক করে বলো। আর কোনো চেঁচামেচি নয়। বুঝছো?’

দুজনে মাথা নাড়ালো। সিহাব মাইশার দিকে আঙুল তাক করে বলে, ‘বুবু মাইশু বুবু আমাকে মে’রেছে।’

আমি মাইশার দিকে তাকালাম। মাইশা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘সিহাবও আমাকে মে’রেছে৷ সত্যি বলছি!’

এবার সিহাবের দিকে তাকালাম। দুজন শুরু করলো একে অন্যকে দোষ দেওয়া। বাড়িতে দুই বিচ্চু থাকলে আর কি-ই বা আশা করা যায়! আমি দুজনকে থামিয়ে বললাম,

‘কি নিয়ে মা’রা’মা’রি আগে শুনি!’

মাইশা ঢোক গিলে বলে, ‘আসলে বুবু তোমার ফোন বাজতেছিলো তখন দুজনেই দৌড়ে গেছি। পরে ওটা নিয়ে দুজনে টানাটানি করতে করতে ভুলবশত ফোনটা মাটিতে পড়ে যায়। তাই আমি ওকে থা’প্প’ড় মে’রেছি। পরে ‘ও’ আমাকে মে’রেছে।’

আমি দুজনের ঝ’গড়ার কারণ শুনে কপাল চাপড়ালাম। দুটোর সারাদিন আর কোনো কাজ নেই। আমি মাইশাকে কড়া গলায় বললাম,

‘এগুলো কি ধরনের কথা মাইশা? সিহাব নাা তোমার ছোট ভাই! তুমি ওকে মা’রলে কেনো? সরি বলো! আর দুজনে মিল করে নাও।’

সিহাবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আর সিহাব! মাইশু তোমার বড় বুবু না? তুমি ওকে উল্টো মা’রলে কেনো? তুমি কি আমাকে মা’রো? সরি বলো!’

মাইশা আর সিহাব দুজনেই কান ধরে সরি বলে। আবার ছুটে চলে যায় খেলতে। আমি হেঁসে দিলাম। ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি ফোনটা টেবিলের ওপর রাখা কিন্তু এলোমেলো অবস্থায়। স্নেহাকে কোলে নিয়েই ফোনের ব্যাটারী লাগিয়ে ফোন অন করলাম। আরাফের মিসড কল দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো। মিনিট খানেক না যেতেই ফোন স্বশব্দে বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই ব্যস্ত কন্ঠে আরাফ বলে,

‘কখন থেকে কল দিচ্ছি রিসিভ করছিলেন না কেনো? আর হঠাৎ ফোন অফ কেমনে হলো? ঠিক আছেন তো? শরীর ঠিক আছে তো?’

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে বললাম, ‘ঠিক আছি আমি। বাইরে ছিলাম। কল দিয়েছেন যে?’

আরাফ দম নেয়। ধীর স্বরে বলে, ‘আজ আপনি বিকেলে ফ্রি আছেন?’

‘হুম। কেনো?’

‘একটু বেরোতে পারবেন?’

‘কোথাও যাবেন?’

‘হু। হবু বউরে নিয়া ঘুরতে যাবো।’

আমি ভ্রু কুঁচকালাম। বললাম, ‘কোথায় যাবেন?’

‘ওটা সারপ্রাইজ। আসবেন কি না বলেন?’

‘কয়টায় আসতে হবে?’

‘আপনি বিকেলে তৈরী হয়ে থাকবেন আমি কল দেবো। মোড়ে থাকবো আমি।’

আমি কিছু বললাম না। শ্বাস আটকে রাখলাম। আরাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘বরাবরের মতো খোঁপা ফাঁকা রেখে আসবেন। আর আমার দেওয়া শাড়িটা পড়ে আসবেন।’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

বিকেলে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে রেডি হলাম। আরাফের দেওয়া শাড়ি। শুভ্র রঙের শাড়িটার কারুকাজ চোখ ধাঁধানো। তিন্নি আর মাহমুদা বেশ প্রশংসা করেছে শাড়িটার। তিন্নি নিজেই সুন্দর করে চুল বেঁধে দিয়েছে। তিন্নি আর মাহমুদা যখন আমাকে ক্ষেপাতে ব্যস্ত তখন কল আসে আরাফের। আরাফ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কল পেতেই হার্টবিট লাফানো শুরু করে। লজ্জায় গাল লাল বর্ণ ধারণ করে। তিন্নি আর মাহমুদার থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। অনামিকা আঙুলের সেই রিং টা আঙুলেই ঘোরাতে শুরু করলাম। মোড়ের কাছে এসে দেখি আরাফ দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক শুভ্র রঙের একটা পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো। চোখ পড়তে মুগ্ধতা ঘিরে ধরে। আরাফ আমার কাছে এগিয়ে আসে। হাতে রাখা বেলীফুলের মালা খোঁপায় জড়িয়ে দেয়। হাত গুঁজে দেয় একটা গোলাপ। তারপর মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘মাশাল্লাহ। কি সুন্দর লাগছে! আপনাকে নিয়ে তো আর আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না৷ যদি কেউ চু’রি করে নিয়ে যায়!’

আমি হাা করে তাকালাম। তারপর মাথা নিচু করে নিয়ে বললাম, ‘তাহলে কি আমি বাড়ি চলে যাবো?’

আরাফ শব্দ করে হাসে। আমার আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল গলিয়ে বলে, ‘নাহ থাক। আজ ঘুরে আসি! এমনেই হবু বউ আমার বেশ ব্যস্ততায় সময় পার করে।’

আমি শুধু হাতের দিকে তাকালাম। লজ্জায় তার মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। আরাফ হাতে হাত রেখেই টেনে নিয়ে আসে রিক্সার কাছে। দুজনে রিক্সায় উঠে বসলে আরাফ নিজেই আমার শাড়ির আঁচল ভালো করে তুলে কোলের ওপর রাখে। তারপর আমার পাশে বসে। উনার এই কেয়ারিং গুলো বেশ প্রশান্তি দেয় আমাকে। কই এতো যত্ন, এতো খেয়াল তো মাহিদ ব্যাতীত আর কেউ আগে রাখেনি! ছেলেটার প্রতি আমার আলাদা এক ভালো লাগা, আলাদা এক টান কাজ করে৷ সে তার কর্মকাণ্ডে বুঝিয়ে দেয় পৃথিবীতে তার কেউ না থাকলেও আমিই সব তার। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্য করেন তাই তো তন্ময়ের থেকে এতো কষ্ট দেওয়ার পর এখন মিলিয়েছে সুখের দেখা। আনমনে হাসলাম। একটা লেকের পাড় এসে দুজনে ঘুরলাম। ফুসকা, হাওয়াই মিঠাই সব মিলিয়ে দারুণ কাটলো বিকেল।
__________

সকাল বেলা গার্মেন্টসের কাছে এসে দেখি প্রতিদিনের মতোই আরাফ দাঁড়িয়ে আছে। আজ সে নতুন চাকরীতে জয়েন করবে। ফরমাল ড্রেস আপে আছে। অথচ এই সাধারণ ভাবেই তাকে আমার কাছে অসাধারণ মনে হলো। আসলেই বোধহয় ভালোবাসার মানুষ একটু বেশিই সুন্দর হয়। আমি আরাফের কাছে আসলাম। সে আমাকে দেখে হাসলো। তার বাতাসে উড়তে থাকা এলেমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে গুছিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো৷ কিন্তু নিজের ইচ্ছে মনেই রাখলাম। আরাফ গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘ম্যাম আপনার নজর হঠাৎ আমার চুলে কেনো? ধরতে ইচ্ছে করছে? নাকি কে’টে ফেলতে ইচ্ছে করছে?’

আমি জবাব দিলাম না। কথা ঘুরিয়ে বললাম, ‘আজ আপনি জয়েন করবেন?’

আরাফের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। মলিন মুখে মাথা নাড়ায়। আমি ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে প্রশ্ন করলাম, ‘মুখটা এমন হয়ে গেলো কেনো? চাকরী নিয়ে খুশি না?’

‘নাহ একদমই নাহ।’

‘ওমা! তা কেনো?’

আরাফ ঠোঁট উল্টে বলে, ‘চাকরীটার জন্যই তো আর আপনাকে রোজ দেখা হবে না। আপনাকে না দেখলে তো আমার ভালো লাগে না। একদম এখানে ব্যাথা করে।’

আরাফের ঠোঁট উল্টে বুকের বাম পাশ দেখানো দেখে আমার হাসি পেলো। হাসি আটকে বললাম, ‘বুঝলাম এইজন্য জনাবের মন খারাপ! তা এখন রোজ দেখতে পাবেন না বলে এতো কষ্ট হচ্ছে! যদি ম’রে যাই? তখন কি করবেন?’

সাথে সাথেই আরাফের চোখে মুখে আকাশের মেঘের মতো অন্ধকার ঢেকে দিলো। শুধু কেমন চোখে তাকিয়ে কিছু না বলেই অন্যদিকে হাঁটা ধরে। আমি অবাক হয়ে গেলাম তার এমন ব্যবহারে। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকার পরও যখন সাড়া দিলো না তখন হতাশ দৃষ্টিতে তাকালাম। ছেলেটা রেগে গেলো কেনো? আমার ম’রার কথা শুনে! ওটা তো শুধু কথার কথা বললাম। তাই বলে এভাবে রেগে যাবে! ইশশ। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। চুপচাপ কিছুক্ষণ তার যাওয়ার দিকে চেয়ে যখন ঘুরে তাকালাম তখন চোখে পড়লো তন্ময়ের তীক্ষ্ণ চোখ। প্রথমে চমকে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলাম। তন্ময় আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলে,

‘ওহ আচ্ছা! এই জন্যই তাহলে আমারে ওইদিন এতো বড় বড় কথা বললি!’

আমি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘কি বলতে চান?’

‘এই না’গ’রে’র জন্যই তাইলে আমার কাছে ফিরতেছিস না! তা তোর এই প্রেমিক কি আমার থেকে বেশি বড়লোক!’

আরো কিছু অকথ্য কথা বলে গা’লি দেয় আমাকে, চরিত্র নিয়ে যত খারাপ কথা বলা যায় সব বলে। কান ঝা ঝা করে ওঠে মুহুর্তেই। চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে থা’প্প’ড় বসালাম তার গালে। পর পর দুইটা থা’প্প’ড় দিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালাম। তন্ময় আগুন চোখে তাকায় আমার দিকে। আমি আঙুল তুলে বললাম,

‘নিজের চরিত্রের সাথে কোনোদিন গুলাবেন না আমাকে। আপনার মতো চরিত্র’হীন নই যে যার তার কাছে চলে যাবো! আপনার মতো না যে আজ এক আবাসিক হোটেলে তো কাল নি’ষি’দ্ধ পল্লীতে চলে যাবো! ঘরে বউ রেখে প্রাক্তন বউকে ফিরিয়ে নিতে আসেন আবার আমার চরিত্রে আঙুল তুলছেন! এসব নোং’রামি আপনার দ্বারা হয় আমার দ্বারা নয়। দ্বিতীয়বার চোখের সামনে পড়লে থা’প্প’ড় নয় একদম জু’তা বসিয়ে দিবো গালে।’

তন্ময় তেড়ে আসে আমার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তোর এতো বড় সাহস আমাকে থা’প্প’ড় দিছিস! তোরে আজ..!’

আমি দুপা পিছিয়ে হুংকার ছুড়লাম, ‘একদম গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। খুব খারাপ হয়ে যাবে!’

আমাদের চেচামেচিতে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া কয়েকজন লোক এগিয়ে আসে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপু কোনো সমস্যা?’

আমি জবাব দেওয়ার আগেই তন্ময় রাগী কন্ঠে বলে, ‘কোনো সমস্যা নাই। এটা আমাদের নিজেদের ব্যাপার। আপনারা যান!’

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঠকাঠ বললাম, ‘লোকটা মিথ্যা কথা বলছে ভাই। আমি উনাকে চিনি না। আমাকে এসে যা তা বলছে, বিরক্ত করছে।’

একজন লোক বললেন, ‘আপনি যান আপু। একে তো আমরা দেখছি!’

আমি সরে আসলাম জায়গা থেকে। পেছন থেকে কয়েকবার তন্ময় ডাকলেও সাড়া দিলাম না। আজ গন’ধো’লাই খাক শ’য়’তা’নটা। পেছনে না তাকিয়ে ঢুকে গেলাম গার্মেন্টসের ভেতরে। রাগে এখনো গা জ্বা’লা করছে। আমাকে দেখে হেনা আপা আর মিতা এগিয়ে আসে। আজ সোমা আসেনি। হেনা আপা আমাকে বললো,

‘কিরে মুখ এমন কেনো? আরাফ সাহেবের সাথে দেখা হয়নি? আজ তোর খোঁপায় বেলিফুল নেই যে!’

আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলাম। জা’নো’য়া’রটার কত বড় সাহস আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলে! ওর মতো নিচু মানসিকতার কারো থেকে আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট নিতে হবে নাকি! হেনা আপা আমার অন্যমনষ্কতা খেয়াল করে বলে,

‘কি হয়ছে মায়া? তোর মুখ এমন লাগছে কেনো?’

মিতা বলে, ‘মনে হচ্ছে রেগে আছিস! কি হয়ছে তোর? বল!’

দাঁতে দাঁত চেপে রাগী স্বরে বললাম, ‘ওই জা’নো’য়া’রটা এসেছিলো। আমার জীবন তো শেষ করে দিয়েছে এখন আসছে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে!’

‘শান্ত হো প্রথমে। কি হয়ছে এটা বল!’

‘তন্ময় আসছিলো। আমাকে আর আরাফকে একসাথে দেখে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে। কত্ত বড় কলিজা! আমাকে বলে আমি নাকি আরাফের সাথে বেডে! ছিঃ।’

মিতা শক্ত কন্ঠে বলে, ‘তুই কিছু বলিসনি?’

‘দিয়েছি গালে বসিয়ে। পরেরবার দেখলে জু’তা দিয়ে দিবো।’

মিতা আর হেনা আপা আমাকে শান্ত করে। এতোকিছুর মধ্যে মাথা থেকে আরাফের কথাটা বের হয়ে গেছিলো। মাথা ঠান্ডা হতেই প্রথমে তার কথা মনে পড়লো। দ্রুত ফোন বের করে কল লাগালাম তাকে। পর পর দুবার কল দেওয়ার পরও সে কল তুললো না। এতো রেগে আছে! অভিমান হয়েছে নাকি আমার ওপর! মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেলো। নিজের মতো কাজে মন দিলাম। হেনা আপা কাজ করতে করতে ফাজলামি করে বলে,

‘তা আজ তোর আরাফ সাহেব তোকে বেলীফুল দেয়নি?’

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘নাহ। সাহেবের আজ রাগ হয়েছে। রাগ করে চলে গেছে তারওপর কল দিলাম রিসিভই করলো না।’

মিতা বলে, ‘হঠাৎ রাগ কেনো?’

আমি সবটা বলতেই হেনা আপা আর মিতা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো অবাক চোখে। এরপর হাসতে শুরু করলো। আমি দুজনের হাসিতে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে তাকিয়ে রইলাম। হেনা আপা হাসি থামিয়ে বলে,

‘বাব্বাহ! এটা তো দেখি আরাফ ভাইয়ের পিউর ভালোবাসা রে! তোকে দেখছি ভীষণ ভালোবাসে! শোন ছেলের অভিমান হয়েছে প্রেমিকার মুখে ম’রার কথা শুনে। তুই একটু সরি বলে দিস দেখবি ঠিক হয়ে গেছে।’

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘অভিমান তো তখন ভাঙাবো যখন সে আমার কল রিসিভ করবে কিন্তু সে তো কলই রিসিভ করতেছে না।’

‘আরেহ! কতক্ষণ রেগে থাকবে! তোকে না দেখে বেচারা কখনো থাকতে পেরেছে? দেখবি কালই চলে আসবে। শুধু মুখটা একটু ভার করে রাখবে এই আরকি!’

বলেই হেনা আপা আর মিতা হাসতে থাকে। আমি জবাব দিলাম না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকলাম। কাজ করতে করতেই হঠাৎ করে মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলাম। সামনে ভালো করে তাকাতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ ডলতে শুরু করলাাম। হেনা আপা আমার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বললেন,

‘কিরে কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’

আমি জবাব দিলাম না। মুহুর্তেই মনে হলো পেট গুলিয়ে উঠলো। ঝাপসাা চোখ নিয়েই কোনোমতে দৌড় দিলাম ওয়াশরুমের দিকে। সাথো সাথেই পেট থেকে যেনো সব বের হয়ে গেলো। দেয়াল ধরে কোনোমতে চোখ মুখে পানি দিতেই ঝাপসা চোখে দেখলামম বেসিন ভর্তি রক্তের ফোয়ারা। সামনে থাকা আয়নায় নজর পড়তেই দেখলাম মুখে রক্তের ফোঁটা। মাথা ঘুরিয়ে আসলো। নিজেকে সামলে কোনোরকমে বের হয়ে আসতেই সব ঝাপসা হয়ে আসে। মুহুর্তেই ভারসাম্য হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে।

চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন
কেউ বকা দিয়েন না পিলিস🥹)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here