#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#বোনাস_পার্ট
#আলিশা
স্মরণের রুমের দরজার এপাশে দাড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবার হৃদয়ে মেয়ের জন্য উপচে পড়া ভালোবাসা। চিন্তিত মুখের অভিপ্রায়। ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা পরম মমতা নিয়ে। ছোঁয়া আধবোজা চোখ নিয়ে বিছানার মধ্যে পরে আছে। নিমিষেই স্মরণ একটা কাচের বাটিতে পানি সহ রুমাল নিয়ে হাজির। দেখতে দেখতে সে রুমাল ভিজিয়ে কপালের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে থার্মোমিটার খুঁজে আনলো। টেবিলের ড্রয়ার হতে বের করলো বিস্কুট, চিপ্স, ব্রেড। ছোঁয়ার মুখের নিকট একেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে আর সেধে যাচ্ছে। কিন্তু ছোঁয়া এসবের কিছু খেতে বড্ড নারাজ। হঠাৎ যেন আমি তার চোখে পরলাম। সে অদূর হতেই ডেকে বলল
— আন্টি, আমি বিরিয়ানি খাবো।
মায়ার একটা আস্ত স্তুপ যেন ছোট মেয়েটার কথার দরূণ আমার বুকে চেপে বসলো। স্মরণ ঝট করে পেছন ফিরে আমাকে দেখতেই বলল
— আমি অর্ডার করছি।
আমি ধীর পায়ে হেটে গিয়ে ছোঁয়ার কপালে আলতো করে হাত রেখে বললাম
— আপনি এমন কেন? দেখছেন তো মেয়ে অসুস্থ। তারপরও এমন খিটখিট করেন কেন? আপনিও বুঝি এভাবেই বেস্ট বাবা হয়ে উঠতে চান? যে বাবা মেয়ের ভালো বোঝে না। যে বাবা মেয়ের মাতুল্য কোল চেনে না। এটা রুমাল ভেজানো হয়েছে? চুল ভিজে মাথায় পানি গিয়ে ঠান্ডা লাগবে আরো।
স্মরণ যেন বিস্মিত হলো আমার কথায়। এই বিষ্ময় ভাব কেটে উঠতে তার সময় লাগলো আনুমানিক তিনটে মিনিট। অতঃপর কড়া গলায় বলে উঠলো
— হোয়াট রাবিশ! আপনি আমাকে আমার মেয়ের ভালো মন্দ শেখাচ্ছেন?
— হয়তোবা। শিখে রাখুন। আপনি তো কথায় কথায় আমাকে হুমকি দেন এবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার। জোর করে তো কারো ঘাড়ে চেপে বসা যায় না।
স্মরণ প্রত্যুত্তর করলো না। আমি ছোঁয়াকে ছেড়ে স্মরণের দিকে একবার তাকিয়ে দেখতে চাইলাম তার অভিপ্রায়। সে যেন শূন্য, ঘোলাটে, পুরোটাই ধোঁয়াসায় মুড়িয়ে রেখেছে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে এক পা ফেলতেই হঠাৎ টান পরলো আমার হাতে। শুনতে পেলাম ছোঁয়ার কন্ঠ
— আন্টি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
বুকের মাঝে কষ্ট হলো এমন মিষ্টি ডাক শুনে।
— না তো মা। মেয়েকে ছেড়ে মা কি দূরে যেতে পারে কখনো?
— তুমি এখন এত্তগুলা ভালো হয়ে গেছো। আমি এখন তোমাকে মা বলেই ডাকবো। অথৈ মা আমাকে ফাঁকি দিয়েছে। তুমি আমাকে ফাঁকি দেবে না তো?
পাকা পাকা কথাগুলো আমার চোখে জল আনতে বাধ্য করলো। আমি জড়িয়ে যাওয়া গলা নিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। ওর যে মা নেই। ওর থেকে বহু দূরে চলে গেছে তা এতো ছোট মস্তিষ্কে না ঢুকলেও পারতো। ছোট কলিজা নিশ্চয়ই ছটফট করে।
— বাবা আম্মুর কথা মনে পরছে৷
হঠাৎই ছোঁয়া একথা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। স্মরণ দিশেহারা হয়ে কোলে তুলে নিলো। সেও যেন অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। মেয়েকে দু’টো কথায় বুঝ দিতে গিয়ে হঠাৎই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। খেয়াল করে দেখলাম তার চোখ বন্ধ। কান্নারত ছোঁয়াকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। চোখের কর্ণিশ বেয়ে উঁকি দিচ্ছে একটু আধটু জল। মুহূর্তেই ঘর ছেড়ে গেলো বিষাদে। স্মরণ হঠাৎ ছোঁয়া কে ছাড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি আগলে নিলাম ছোট মেয়েটাকে। স্মরণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ। মনে পরে গেলো অনেক আগের কথাগুলো। এই মানুষটাই ছিলো আমার প্রথম ভালোবাসা! অবাক হবার বিষয় না? আমি বড্ড অবাক হয়েছি দু’দিন আগে। যেদিন সে ব্যাবসার উদ্দেশ্যে বিদেশে ছুটলো। সেদিন রাতে। ঐ তো ছোঁয়ার সাথে আমার ভারি ভাব হলো। তাকে নিয়ে এই রুমের বেলকনিতে বসে ছিলাম। একটু আধটু কৌতুহল ছিলো এই মানুষটাকে নিয়ে। সেই থেকে সকলের অগোচরে সেদিন খুঁজে ছিলাম কিছু। যদি কিছু নোটবুক মেলে? মনে দুই আনার আশা নিয়ে খামোখা এই ঘরটা দেখতে গিয়ে হাতে পেয়েছিলাম একটা অ্যালবাম। যে এলবামে দেখেছি তেরো বছর বয়সে দেখে আসা মুখটা। এলোমেলো এক গুচ্ছ সিল্ক চুলের অধিকারী ছেলেটাকে। যার কিনা একটা অবাধ্য, জোর করে বসে যাওয়া সৌন্দর্য আছে। একটা গেজ দাঁত। এই দাঁতের হাসিটা দেখার জন্য আমি প্রত্যহ বাসা থেকে বেরিয়ে সামনের খেলার মাঠে গিয়ে বসে থাকতাম। ছোট থেকেই ভীষণ শান্ত প্রকৃতির আমি একদিন এলাহি কান্ড বাধিয়ে ঝগড়াও করেছিলাম একটা মেয়ের সাথে। কেন সে আমার ভালো লাগার মানুষটার দিকে তাকাবে এই নিয়ে। হাজারো স্বপ্ন বুনে বুনে মনের মাঝে রেখে দিতাম। এই মানুষটার নামে খোলা আকাশে চিঠি পাঠাতাম। কিন্তু সে আমাকে কখনো চেনেনি। কখনো জানেনি তার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো আমার কিশোরী মন। তবে আমার সব অনুভূতি মরমর হলো একদিন। যেদিন দেখেছিলাম আমার স্বপ্নে, শয়নে, জল্পনা-কল্পনায় অবিরাম বসবাস করা মানুষটা অন্য মেয়ের রাজা। রাজা রাণীর গভীর ভালোবাসা। একে অপরের প্রতি পুকুর ঘাট আর দুবলা ঘাসের মতো আসক্ত। দিনের শুরু হয় ঝগড়ায় আর দিনশেষে শেষ বিকেলে তাদের দেখা যায় হাতে হাত রেখে নদীর তীরে বালুচরে হাঁটতে। আমার কিশোরী মন ভেঙে গুড়িয়ে যেতো তাদের এই মিষ্টি দৃশ্য দেখে। প্রথমে সৌভাগ্য ভেবে বসেছিলাম। অতঃপর দেখি আমার দূর্ভাগ্য যে আমি তাদের সাথে একই কলেজে পড়ি। প্রতিষ্ঠানটা ছিলো স্কুল এন্ড কলেজ। তারা দু’জনে কলেজে আর আমি স্কুল হলগুলোর একটাতে। একদিন আমার সাথে খুব হৃদয়বিদারক এক ঘটনা ঘটলো। স্মরণ রাজার রাণী আমাকে হুট করে একদিন রাস্তার মাঝে ডেকে বলল
” তুমি ভারি মিষ্টি। তোমার নাম কি মেয়ে? ”
আমি গোমড়া মুখে বলেছিলাম
” খেয়া জান্নাত। ”
” ওয়াও! নাইস নেম।”
” তুমি কিসে পড়?”
” ক্লাস নাইন।”
” আমি ইন্টার ফ্রাস্ট ইয়ার। তোমার বড় আপু।”
আমি মনে মনে ভেংচি কেটে বলেছিলাম
” বড় আপু না। আমার সতিন তুমি। আমার মনের মানুষ তুমি নিয়ে নিয়েছো।”
” ঐ যে দেখছো, কালো শার্ট পরা সুন্দর ছেলেটা ওকে একটু ডেকে দেবে?”
আমি আপত্তি করতে চেয়েও পারিনি। সেদিন ডেকে দেই স্মরণকে। আর বারবার মেয়েটাকে মনে মনে বলেই যাই,
” তুমি আমার সতিন। তোমাকে এত্তগুলো ঘৃণা।!”
বুঝিনি ওটুকু বয়সে দিয়ে আসা গালিটা এভাবে সত্যি হবে। এভাবে আদোতেই তার সতিন হয়ে যাবো। আমার কিশোরী বয়সের ভালোবাসার মানুষটা এভাবে আমার খুব কাছের হয়ে যাবে। কিন্তু আফসোস, দুঃখ, আমার ভাগ্য তাকে পেয়েও হারানোর পথে। সে তো চায় না আমায়। সে তো বারেবারে বোঝাতে চায় সে আমার কখনো ছিলো না, আর কখনো হবে না। তবে আমি তাকে বলে দিতে চাই
” না বাসলেন ভালো। নাই বা আপনার কাধে আমার মাথা রাখার সাহসটা দিলেন। আমি আপনার রাজ্যের রাণী না হয় নাই হলাম। পরম ভালোবাসা দিয়ে আমার খোঁপায় রোজ একটা বেলি ফুলের মালাও পরিয়ে দিতে হবে না৷ শুধু আমি যেটুকু ভালোবাসা দেই এটুকু একটু গ্রহণ করুন। আমি সব হারিয়ে অবশেষে আপনার দ্বারে। দূরে ঠেলে না দিলে কি হয় না? শুধুমাত্র জীবনের শেষ বিকেলে আমি আর আপনি কি একসাথে ঘোর কুয়াশার মাঝে হেঁটে হেঁটে বহুদূর যেতে পারি না?
চলবে…..#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_৭
দিনটা মন খারাপেই কাটছে । সাধ্য মতে ছোঁয়াকে মায়ের আদর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। জানি না কতটুকু পেরেছি। স্মরণের আসছে না বহুক্ষণ হলো। তার দেখা নেই। ছোঁয়াকে কখনো কাঁধে কখনো বেলকনির চেয়ারে বসে কোলের ওপর বুকের মাঝে রেখে দিলাম। কখনো গল্প শুনিয়ে এটা সেটা খাইয়ে দিয়ে ওষুধ মুখে তুলে দিলাম। সে এখন আমার কোলে বসে আছে। উত্তপ্ত শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার কোনো খোজ নেই। বন্ধ চোখে আমার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিতে আছে যেন। আমি পলকহীন তাকিয়ে দেখছি বাড়ির নিচের বাগানটা। যেখানে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আছে স্মরণ। মাথা ঝুঁকে আছে মাটির দিকে। সব কেমন ঘোলাটে। সব হচ্ছে উচ্ছাসহীন। এক ঝাঁক এলোমেলো ক্ষেত্র ঘিরে আছে যেন সকলকে। বসন্তের শেষ ভাগের একমুঠো অনুভূতি যেমন হৃদয় ছটফটিয়ে তুলে বিদায় নেয়। ঠিক তেমনই অনুভূতি বুকে বাসা বেধেছে।
দেখতে দেখতে, পলকহীন তাকিয়ে থাকার মাঝে চোখের এক ফোটা জল ঝড়ে গেলো। আমার হুঁশ ফিরলো ততক্ষণে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোঁয়াকে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলাম। আমার বিছানায় শুয়ে দিয়ে আমিও শুয়ে পরলাম ওর পাশে। স্মরণ চলে গেলে ছোঁয়াকে নিয়ে সোজা আমার ঘরেই চলে এসেছি। ওঘরে অস্বস্তি হলো। আজ দম এঁটে এলো আমার। কোথাও যেন আমার জন্য কেউ নেই। কেউ যেন আমাকে এতটুকু ভালোবাসা দিতে রাজি নয়। ক্রমান্বয়ে শুধু অপমানের উক্তিগুলোই ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে আমার দিকে। ভাবনার মাঝে বিছানা হাতড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলাম। ওয়ারেসিয়াকে কি একবার ফোন করবো? দ্বিধায় সাগরে অবিলম্বে পরে হাবুডুবু খেতে আরম্ভ করলাম। ঠিক এমন সময়ই ভাষাহীন আওয়াজ। দরজাতে কড়াঘাতের শব্দ।
— ছোঁয়া?
স্মরণের কন্ঠ। দরজা শুধু আলগোছে চাপিয়ে রেখেছিলাম। এপাশ হতে বলে দিলাম
— ঘুমোচ্ছে।
সে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে শীতল দৃষ্টিতে ছোঁয়ার পানে তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড পাচেক। অতঃপর ধীর পায়ে হেঁটে এসে মেয়ের কপালে এক হাত রেখে উষ্ণতা মেপে নিলো অন্তরালে। আমি ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে গেছি।
— কিছু খেয়েছে?
— হুম।
— ওষুধ?
— খেয়েছে।
এরপর তিন মিনিটের মতো নীরবতা। আমি তাদের থেকে প্রায় পাঁচ কদম দূরে দাড়িয়ে।
— থ্যাঙ্কস।
ছোট একটা শব্দ হঠাৎ এই কৃপণ মানুষটার গলা থেকে উঠে এলো। আমি খানিকটা অবাক হয়ে হজম করলাম পরিস্থিতি। প্রতিবারের মতো শুধু ছোট করে প্রত্যুত্তর করলাম
— ওয়েলকাম।
— আপনি কিছু খেয়েছেন?
আমার চোখ চরক গাছ হয়ে গেলো। আজ হঠাৎ খোঁজ খবর? এতো ভালো কেন হলো?
— না।
— খেয়ে আসুন।
দৃষ্টি ছোঁয়ার পানে রেখেই সে একথা গম্ভীর সুরে শুনিয়ে দিলো। আমি নড়তে পারলাম না। সেচ্ছায় দাড়িয়ে রইলাম আগেরই মতো।
— কি হলো? যাচ্ছেন না কেন?
দু’মিনিটের মাথায় আমাকে একবার পরখ করে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মাথায় সে বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল।
— আপনি খেয়ে আসুন। আপনি খাননি সকালে।
— আমি খাবো না। আমার খিদে নেই।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। অতিবাহিত হলো আরো দু’টো মিনিট। পা ফেলে রুম ছাড়ার প্রস্তুতি নিতেই সে বলল
— সরি, আপনার ঘরটা আটকে রাখলাম। ওর যদি ঘুম ভেঙে যায় তাই তুলে নিয়ে যাচ্ছি না।
— হুম।
— কি?
— না কিছু না। আমি যাচ্ছি। আপনারা থাকুন।
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সোজা হেঁটে চলে গেলাম বাবার রুমে। একবার উঁকি দিয়ে এসে আবার চলে গেলাম গেস্ট রুমে। ওঘরে রাখা ইজি চেয়ারে বসতেই হঠাৎ দেখি ভুলো মন ভুল কান্ড করে বসেছে। ফোনটা ফেলে এসেছি আমার ঘরে। আবারও ছুটলাম। দরজা নক না করেই ঘরে প্রবেশ করতেই স্মরণ ফিরে চাইলো আমার দিকে। ছোঁয়ার নিকট সে থার্মোমিটার হাতে বসে ছিল। তারসাথে আমার কোনো বাক্য বিনিময় হলো না। সে শুধু দেখে গেলো আমাকে। আমি ফোনটা নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে চলতি পায়ে ওয়ারেসিয়ার কাছে ফোন করলাম। এক বারের বেলাতেই ফোন তুলে কেউ বলল
— হ্যালো, কে বলছেন?
চাচি আম্মার কন্ঠ। আমি সালাম জানিয়ে বললাম
— কেমন আছেন চাচি আম্মা? আমি খেয়া। ছোটাব্বুর শরীর কেমন? অন্তু ভালো আছে?
— ভালো, সবাই ভালোই আছে। তুই ফোন করেছিস যে?
— ভয় পবেন না। আমি ওবাড়িতে যাওয়ার জন্য ফোন করিনি। আপনাদের থেকে যৌতুকের জিনিসপত্র নেবো বলেও ফোন করিনি। ওয়ারেসিয়ার কথা মনে পরছিলো খুব। জানেনই তো, এই পৃথিবীতে আপনার মেয়েটা ছাড়া আমার আর আপন কেউ নেই। ওই মেয়েটাই শুধু ভুল করে আমাকে ভালোবাসে। ওকে একটু বলবেন, ও যেন আমার সাথে দেখা করে। অনেক মিস করছি ওকে।
হঠাৎ হয়তো ভীষণ ছন্নছাড়া ভাব করে বসলাম আমি। ফোনের ওপাশ হতে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া শুনতে পেলাম না। আমিও সেসব ভাবনায় না রেখে ফোন কেটে দিলাম।
.
বিকেল চারটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরলাম। ওয়ারেসিয়ার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে। একটা রিকশা নিয়ে দশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে পৌছে গেলাম পার্কে। অপেক্ষার প্রহর গুণতে হলো না। ওয়ারেসিয়া আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। আমাকে দেখতে পেয়েই সে দ্রুত এসে জাপ্টে ধরলো।
— কেমন আছিস?
— অনেক ভালো। তোকে দেখে আরো ভালো।
— চল ওদিকটায় বসি।
ওয়ারেসিয়া আপত্তি না করে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলো। ছোনের তৈরি একটা ছাউনির নিচে বসে পরলাম দু বোন। কিছু সময় নীরবতায় পার হলো।
— আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার যে একটা বাচ্চা আছে একথা তুই জানতি?
প্রশ্ন শুনে ওয়ারেসিয়ার মুখ শুকিয়ে গেলো যেন৷ আমি বিরতি হীন তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
— হ্যা। তোমাকে বলা হয়নি একথা। মা-বাবা বলতে চায়নি৷
— আচ্ছা।
এরপর বিষন্নতা। মন খারাপ গুলো বুকের খাঁচায় ছটফট করছে। আমি ভেজা চোখ নিয়ে ওয়ারেসিয়াকে বললাম
— একটা কাজ করে দিতে পারবি?
ওয়ারেসিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার পানে চাইলো৷ আমি ভেঙে আসা কন্ঠ পুনরায় শক্ত করে নিয়ে বললাম
— কিন্ডারগার্টেনে এক জব খুঁজে দে। আমার ভীষণ দরকার।
— কিন্তু কেন আপু? তোর শশুর বাড়িতে তো অর্থের অভাব নেই।
— তোর এমন কোনো জবের বিষয়ে খোঁজ আছে?
— তোর কি কোন সমস্যা হচ্ছে ওখানে?
— আমিই তো সবার সমস্যা ওয়ারেসিয়া।
— আপু….
— আমি আসি। মেয়েটা অসুস্থ।
কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে আমি হাঁটা দিলাম সম্মুখ পথে। ওয়ারেশিয়া ডেকে গেলো। শুনলাম না তার কথা। এবার সত্যিই সময় এসেছে নিজের পথ দেখার। একা বাস করতে পারবো না? হ্যা, পারবো। সময় সুযোগ বুঝে ছোঁয়ার সাথে দেখা করবো। বাবার সাথে ফোনে কথা হবে। তার সাথে হয়তো সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখা হতে পারে ভুল করে। তার কারটা আমার পাশ ঘেঁসে চলে যাবে। আমি দৃষ্টির আড়াল না হওয়া অব্দি তাকিয়ে থাকবো। আর সে? হয়তো খেয়ালই করবে না। ভুল করেও খুঁজবে না আমাকে।
— হেই, হ্যালো।
ভাবনার মাঝে শুনলাম হঠাৎ যেন কেউ আমার উদ্দেশ্যে পিছু ডাক দিলো। পেছন ঘুরে চাইতেই ভাবনার সত্যতা প্রমাণিত হলো। ধবধবে সাদা অ্যাপ্রোন অযত্নে হাতে ধরে প্রায় দৌড়ে আসছে যেন অঙ্কন।
— হোয়াটস আপ? এখানে কি করছেন?
এসেই তার প্রথম প্রশ্ন।
— বোনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
— মাইন্ড না করলে আমি কি আপনার সাথে এই পথে হাঁটতে পারি আপনার পাশে?
ভীষণ সুন্দর করে সে প্রস্তাবটা তুলে ধরলো। মুখে একটু হাসি। আমি মাথা নাড়িয়ে সাই জানিয়ে বললাম
— হুম।
— হসপিটাল থেকে ফিরছিলাম। আপনার সাথে দেখা হয়ে গেলো। ভালো লাগছে। আচ্ছা আপনি কি খুব বেশিই কম কথা বলেন?
আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। এই প্রশ্নটা প্রায় প্রত্যেকটা মানুষই আমাকে করে বসে।
— না তো এমন কিছু না।
— হুম। দেখতে পাচ্ছি। আমি কিন্তু শুনেছি যারা কম কথা বলে তারা মানুষ কে মনে মনে অসংখ্য গালি দেয়। আপনিও কি দিচ্ছেন আমাকে?
— না না। গালি দেবো কেন।
— ডোন্ট কল মি নানা। আমার বয়স মাত্র সাতাশ। বুড়া হইনি। স্মরণ অনার্সে ভার্তি হয়েই বিয়ে করেছে। এজন্য ওর বাচ্চা কাচ্চা আছে৷ কিন্তু আমার তা না।
আমি হেসে ফেললাম। আরো টুকটাক কথা হলো। সে তার পরিবার সম্পর্কে অনেক বিষয় জানালো। আমি চুপটি করে হাঁটতে হাঁটতে শুনে গেলাম। মাঝে টুকটাক কথা বললাম। ভালোই কাটলো সারাবেলা মন খারাপ থাকার পর এই শেষ বেলা টুকু। কখন যে বাড়ির সামনে গেটের কাছে পায়ে হেটে পৌছে গেলাম তা যেন বুঝে উঠতেই পারলাম না। কথায় কথায় অঙ্কন কে বলে ফেললাম ছোঁয়ার কথা। সে তাই নিজের বাসার দিকে আর অগ্রসর না হয়ে ছোঁয়ার কাছে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো।
চলবে…..