#শেষ_চৈত্র [০৮]
সুমনার চোখেমুখে এবার ভয় স্পষ্ট। বিরবির করে বলে যাচ্ছে ‘ না না আমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছি, এটা অমিত হতে পারেনা,কোনোভাবেই না!’
তার গালে অমিতের আঙুলের ছাপ ভয়ংকরভাবে ফুটে ওঠেছে। কিন্তু সে সেই আঘাতের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলছে, আমি বিশ্বাস করিনা এটা সেই অমিত,প্লিজ আমাকে আমার আসল অমিতের কাছে নিয়ে চলো!
পাগলের মতো সুমনা বিলাপ করছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, তাকে ধরতে যাওয়ার সাহসও পাচ্ছিনা। আমার শাশুড়ীও এখানে নিরব দর্শক, সুমনার প্রতি কোনো প্রকার দয়াশীলতার লেশমাত্র দেখা যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে তিনি নিজেও সুমনার উপর ক্ষুব্ধ। হয়তো তার সম্পর্কে উনি কিছুটা হলেও জানেন।
তবে আমার কেন জানি মায়া লাগছে, কখনো স্বচক্ষে কারো দ্বারা কাউকে আঘাত পেতে দেখিনি বলে হয়তো। একটু সাহস সঞ্চয় করে নিজের স্থির পা টা একটু বাড়াতে যাবো তার আগেই অমিত তার হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে আমার বাহুতে ধাক্কা দিলো। ইশারা করলো ভেতরে যেতে। তারপর আম্মাকে এক হাতে আর আমাকে অন্য হাতে ধরে ভেতরে ঢুকালো আর
দরজার দুই কপাটে ধরে বললো,
‘ আবার দরজা খোলে যদি আপনার মুখ দেখতে পাই, তাহলে ভালো হবে না বলে দিলাম।
সুমনা চোখ তুলে বললো,
‘ এতক্ষণ কি আমার সাথে ভালো হয়েছে?
অমিত বিরক্তিকর গলায় বললো,
‘ ভালোই ভালোই চলে গেলো ভালোই হতো!
বলেই অমিত আওয়াজ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ভেতরে গিয়েই বললো,
‘ চৈতি খিদে পেয়েছে, খাবার দাও।
আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ আপনে খাইবেন এহন? দুপুরের লাইজ্ঞা কি রানছিলেন?
আম্মা মাথা ঝাকিয়ে বললো,
‘ সকালের রান্দা ভাত। আর পুঁডিমাছের ঝোল। এইসব অমিত খাইবোনি? আমি ভিতরে আইতা পারলে এতখনে রানতাম।
অমিত আম্মার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ যা আছে তাই দিক সমস্যা নাই। তুমিও আসো আম্মা।
আমার শাশুড়ী পেছনে একবার তাকিয়ে ভেতরে চললো। সুমনার কান্নার আওয়াজ ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু অমিতের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। চুপচাপ সুন্দরমতো খেয়ে রুমে চলে গেলো।
এদিকে এতক্ষণ সুমনার ব্যপারে জানার ইচ্ছে কম থাকলেও এখন কেন জানি অমিতের ব্যপারে জানার ইচ্ছে তীব্র হয়েছে। ওর খারাপ চরিত্রের সূচনাটাকে কেমন যেন গোলমাল মনে হচ্ছে। নিশ্চিত এটা জন্মগত নয়, কোনো কারণে সে এমন রূঢ় মানসিকতার হয়েছে, সেটার পেছনে যে সুমনার হাত আছে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম।
তাই খুব জানতে ইচ্ছে করছে পুরো ব্যপারটাকে!
কিন্তু এই ব্যপারে অমিতকে প্রশ্ন করা যাবেনা। একে তো সুমনার নাম শুনলেই তেলে বেগুনে হয়ে উঠে, অন্যদিকে উনার আবার সকাল থেকে মেজাজ গরম হয়ে আছে।
আমি এদিক ওদিক ঘুরতে থাকলাম। গ্রামের বাড়িগুলোতে দিনেরবেলা সামনের দরজা বন্ধ থাকলে দম বন্ধ লাগে। মনে হচ্ছে কবরে আছি। একে তো চৈত্র মাস, তপ্ত রোদ্দুর। সেখানে আবার বিদ্যুৎতিক আলোয় ঘরবন্দী। এই আলোটা দিনের বেলা চোখের জন্য ঠিক পোষায় না।
সুমনার ব্যপারে আম্মা কিছু জানতো কিনা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উনার বেরসিক গম্ভীর মুখ দেখে সেটা করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা, কিনা কি জবাব দিয়ে বসেন!
আমি খেয়াল করছিলাম অমিতের চেয়ে উনিই বেশি গাম্ভীর্যভাব করে আছেন।
আমি কয়েকবার সুমনার গুনগুনিয়ে কান্না শুনলাম। তারপর কোনো উপায়ন্তর না দেখে ভাবলাম অমিতের কাছেই যাই।
আমি আমার শাশুড়ীর রুম পেরিয়ে যেতে চাইবো তখনি উনি আমাকে ডেকে বললেন,
‘বউ ভিতরে আইয়ো।
আমি যেতেই উনি বললেন,
‘ চৈতি জানো সুমনা কেডা?
আমি উৎসুক দৃষ্টিতে বললাম,
‘ না কেডা?
তিনি বললেন,
‘ সুমনারে অমিত কেরে আপনি আপনি কইরা ম্যাডাম ডাকতাছিলো সেইডা জানো?
আমি একটু ভেবে বললাম,
‘ মালিক আছিলো না কিতা?
উনি হেসে বললেন,
‘ নাহ মালিকের মাইয়া আছিলো।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ উনি তো বাঙালি।
আমার শাশুড়ী আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এরাও প্রথম প্রবাসীই আছিলো। তবে মেলা আগেই ওখানকার নাগরিকত্ব পাইয়া গেছে। মেলা বড়লোক, মেলা মানুষ ওদের ওইহানে কাম করে।
এই কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। কি বলে এসব? এমন একটা মেয়ে এমন জায়গায় এসে কান্না করতেছে? আর অমিত? এতো মারাত্মক! কতটা নির্দয় ব্যবহার দেখাচ্ছে!
আমি আরো কিছু জানতে চাইলাম। কিন্তু আমার শাশুড়ী বললো,
‘ আমারে তেমন কিছু জানায় নাই। অল্প অল্প হুনছি মাইনষের কাছে। কেরে জানি মনে কয় ওর সাথে খুব খারাপ করছে। দেশে আওনের পরেই আমি আমার ছেলেরে চিনতা পারছিলাম না। শুধু একবার জিগাইছিলাম তুই নাকি বিয়া করছিলি, অমিতে ডাইনিং টেবিলডা উল্টাইয়া নিচে ফেলে কইছিলো, আরেকদিন বিয়া করছিলি শব্দটা কইলে হের বানানো এই ভিটা নিজ হাতে কোপাইয়া ভাইঙা নাকি বাড়িত্তে যাইবোগা। আগের বিয়ার কথাডা কইলেই অমিত নিজের হুশ হারাইয়া ফেলে।
এটা শুনে আমি যেন কি একটা ভাবলাম। তারপরই বললাম,
‘ আম্মা আপনের মোবাইলডা একটু দেইন না। বাড়িত ফোন দিমু।
উনি হাত বাড়িয়ে উনার বাটন ফোনটা আমাকে এগিয়ে দিলো। আমি আব্বার নাম্বারে ফোন লাগালাম। জানি আব্বা ক্ষেত থেকে না ফিরে থাকলে মোবাইল আম্মার কাছেই আছে।
রিং বাজার কিছুক্ষণ যেতে আম্মা রিসিভ করে বললো,
‘ হ্যালো।
আমি আস্তে আস্তে বললাম,
‘ আম্মা আমি চৈতি। নাফিজ কি ঘরে আইছে?
আম্মা বললো,
‘ হ একটু আগেই আইছে। এইহানেই আছে।
আমি আমার শাশুড়ীর দিকে একবার তাকিয়ে বললাম,
‘ আম্মা হের কাছে একটু দিবা?
আম্মা নাফিজের কাছে দিতে চাইলে সে বারণ করলো। কিন্তু আম্মা জোর করে ওর হাতে দিলো।
আমি বেশ ইতস্তততা জমিয়ে বললাম,
‘ নাফিজ বিয়ারদিন তোর দুলাভাই যে তোর দিকে থালা ছুড়ছিলো, তহন তুই কি কিছু কইছিলি?
নাফিজ রাগের সাথে বললো,
‘ না কিছু কই নাই।
আমি আবার বললাম,
‘ মনে কইরা দেখ।
নাফিজ ১০ সেকেন্ড পরে বললো,
‘ হ কইছিলাম নিজের বিয়াতে যেমনে খাইতাছেন, জামাই বেশটারে তো নতুন লাগতাছেনা। আর এইডা বলার লগে লগেই স্প্রে মারছিলাম।
আমি বিরাট একটা দম নিয়ে বললাম,
‘ বুঝলাম! কেরে এই কাম করছিলো তহন।
নাফিজ আর কিছু বলার আগেই আমি কেটে দিলাম! অমিত যেকোনো ক্রমে সুমনার কথা মনে হলেই রেগে যায় ? তাহলে নাফিজের সাথে খারাপ আচরণ করার কারণ এটাই ছিল ?
আমার শাশুড়ী আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। দুজনের কথায় বিষয়টা হয়তো বুঝে নিয়েছেন৷ তাই আর প্রশ্ন করেন নি।
আমিও এরপর অমিতের রুমে গেলাম। অমিত ঘুমাচ্ছে! এখন তাকে তুলনামূলক শান্ত লাগছে। নাহ সুমনার নাম শুনেই রেগে উঠা মানুষটা বাইরে সুমনার রেখেও যে এতটা আরাম করছে সেটা জটিল বিষয়। আবার এমনও হতে পারে সুমনাকে এই অবস্থায় দেখে উনার মধ্যে একটা অন্য রকম প্রশান্তি কাজ করছে। একটা প্রতিশোধপরায়ণ অনূভুতি যাকে বলে!
আমি কিছু না বলে পায়ের দিকে চুপচাপ গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলাম।
‘
রাত ৯ টা। এখনো দরজা খোলা হয়নি। সুমনাও দরজা থেকে যায়নি। আর ওকে সাহায্য করতেও আশেপাশের কেউ এগিয়েও আসেনি। কেউ যে আসবেনা সেটা আমরা সবাই জানি!
আমরা তিনজন খেতে এসেছি। দরজার ওপাশ থেকে এদিকে আমাদের অস্তিত্ব বুঝতেই সুমনা জোরে জোরে কাঁদতে থাকলো। খাওয়ার মধ্য সময় সুমনা বলতে লাগলো,
‘ সারাদিন ধরে উপোস আমি। একটু খাইতে দাও অমিত। আমার মতো তুমিও আমার উপর এতটা নির্দয় হয়োনা। এমন করলে আমি বাঁচবোনা।
অমিত কানেই নিচ্ছেনা এসব। খাওয়াদাওয়া শেষ, আমি টেবিল গুছাচ্ছি। আর অমিত রুমে চলে যাবে এমন সময় সুমনা জোরে জোরে বললো,
‘ অমিত জানো ওহোম মারা গেছে। আমার ছেলেও আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে, আর আমার স্বামীও!
অমিত এটা শুনতেই চকিত চোখে দরজার দিকে তাকালো। আমিও আৎকে উঠলাম। ছেলে মানে?
অমিত আমার দিকে তাকিয়ে দেখলো মূহুর্তে আমার চোখ জলে চিকচিক করছে। কি বুঝে যেন সে আমার মাথায় হাত রাখলো, আর আস্তে আস্তে বললো,
‘ ওহোম সুমনার অবৈধ সন্তান ছিল। যার দায়ভার চাপানো হয়েছিল আমার উপর!
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার