#শেষ_বিকেলের_মায়া (২০)
একদল মানুষ যখন রিহানের দিকে তেড়ে যাচ্ছিল। পুলিশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল। ডিম, টমেটো ছুড়ছিল। তখন ফারিহার মনে হলো এর থেকে ভয়াবহ দূশ্য সে হয়ত আর দেখে নি। ওর হৃদপিন্ড বের হয়ে আসছে। ও কি করবে বুঝল না। আদীব বার বার সরাতে চাইলেও মেয়েটি নড়ল না। এক পর্যায়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি। ছুটে এল রিহানের নিকট। রিহান যেন কোনো যন্ত্র মানব। তার ভেতরে কোনো অনুভূতি নেই। সে সিগারেটে ঠোঁট জ্বালাচ্ছে।
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনি সরছেন না কেন?”
ফারিহার কণ্ঠ চিনল কী না কে জানে। তবে রিহান নড়ল না। একই ভাবে চারপাশে নজর বুলাতে লাগল।
“রিহান স্যার। শুনছেন আমার কথা?”
এবার ও শুনল না রিহান। ফারিহার রাগ হচ্ছে। এই মানুষটা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চায়? সে নিজের ছোট্ট হাতটা রিহানেয দিকে এগিয়ে দিল। রিহান ধরল না। তাকাল ও না। ফারিহার এবার কান্না পাচ্ছে। লোকজন গালাগাল করছে। সবার মতে রিহান নিজের হাতে বিজনেস শেষ করেছে। তার জন্য সবার চাকরি গেছে। ফারিহার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে আর থাকতে পারল না। রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরল। কোনো এক অদৃশ্য বলে টেনে বের করে নিল। ছুটতে ছুটতে কোথায় এসে দাঁড়াল জানা নেই। আঁধারে চারপাশ স্তব্ধ। ফারিহা পুনরায় নিজের ধ্যান ফিরে পেল। ছিটকে সরে গেল রিহানের থেকে। এদিকে রিহান পুনরায় সিগারেট ধরাল। ফারিহা চেয়ে রইল। দেখতে লাগল বদলে যাওয়া মানুষটাকে। ওর খুব জানতে ইচ্ছে হলো এই কয়েক মাসে কি এমন ঘটে গিয়েছে?
“রিহান স্যার।”
রিহান না তাকিয়েই বলল,”বলো।”
“আপনি এমন কেন হলেন?”
এবার রিহান চুপ। বড়ো যত্নে সিগার টানতে লাগল।
“উত্তর দিন প্লিজ।”
“কোন উত্তর চাও?”
“এভাবে কেন শেষ হচ্ছেন?”
“শেষ তো অনেক আগেই হয়েছি।”
“এভাবে বলবেন না প্লিজ। আমি আপনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। আন্টি আঙ্কেল সবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি।”
রিহান এবার হেসে ওঠল। ফারিহা তাকিয়ে রইল। ছেলেটা কেমন যেন করছে। দেখলেই ভয় হয়।
“রিহান স্যার,রিহান স্যার। কথা বলুন।”
“বাড়ি যাও।”
এ কথায় কিছু বলল না ফারিহা। রিহান তার এক হাতের সাহায্যে নিজের লম্বা চুল গুলোয় হাত বুলাতে লাগল। তার চুল গুলো এখন কপালের শেষ ভাগে এসে ঠেকেছে।
“আন্টি আঙ্কেল কোথায়?”
“নেই।”
“নেই মানে?”
“মা রা গিয়েছেন। চারদিন হলো।”
ফারিহার মাথায় আকাশ ভে ঙে পড়ার মতো অবস্থা। রিহান তার হাতে থাকা সিগারটা সময় নিয়ে শেষ করল। দু হাত দুলিয়ে বলল,”লাইফ ইজ ফুল অফ ট্রাজেডিস, ইয়ার। ফুল অফ ট্রাজেডিস।”
এ বাক্য শেষে আঁধারে মিলিয়ে যেতে লাগল রিহান। আর ফারিহা,পাথরের মতো তাকিয়ে রইল। ওর দুটি চোখে অবিশ্বাস। জীবন এভাবে বদলে যেতে পারে?
মরজিনা খাবারের থালা সাজিয়ে বললেন,”মেয়েটা দুদিন ধরে খাওয়া নাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কি হলো বল তো।”
আদীব মৌন রইল। বিষয়টা আড়াল করতে বলল,”খালা
মা রা গিয়েছেন প্রায় দু মাসের মতো। তবু স্বাভাবিক হতে পারে নি। তাই এমন করছে।”
“কিন্তু বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হত না?”
“সেটা তো হতই মা। তবে ওর পরিস্থিতিটাও বুঝতে হবে।”
মরজিনা মৌন রইলেন। তিনি ছেলের কষ্টটা বুঝতে পারেন। কোথাও একটা ঝামেলা সেটা খুব ভালোই বোঝা যাচ্ছে। তবে ছেলে তার, এড়িয়ে যাচ্ছে।
“আসব?”
ফারিহা না তাকিয়েই বলল,”হুম।”
“দুদিন ধরে খাবার খাচ্ছ না ঠিক মতো।”
“খাই তো।”
“ঘরেই তো বসে থাকো।”
“সে থাকি।”
“কি হয়েছে,একটু বলবে?”
“কিছু না। এমনি,এমনি।”
“এমনি,এমনি কিছু হয়?”
“আসলে আমার ভালো লাগছে না। কিছুতেই শান্তি নেই।”
আদীব ইচ্ছে করেই রিহানের কথা তুলল না। ও চাচ্ছে না রিহান কোনো ভাবে ওদের বিষয়ে জড়িয়ে যাক। স্মৃতিতে জড়িয়ে যাক। তবে ফারিহার মনে চলছে অন্য কথা। সে খুব করে অনুভব করছে রিহানের য ন্ত্র ণা। সে নিজেই তো মা হারিয়ে পাগল প্রায়। ওদিকে রিহান তো বাবা মা উভয় কে এক সঙ্গে হারিয়েছে। আদীব জোর করেই ফারিহাকে খাওয়াল। মেয়েটির কাছে খাবার যেন বি ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কোনো মতে খেলেও খুব বেশি সময় পেটে রাখতে পারল না। বিকেলে গড়গড় করে বমি করল। এক পর্যায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল। সোজা রিহানের বাসায়। সেখানে নতুন গার্ড রাখা হয়েছে। তাদেরকে ঠেলেই ভেতরে প্রবেশ করল সে। রিহান নিজের ঘরে বসে। মেঝে জুড়ে সিগারেটের আধ খাওয়া ফ্লিটার। চারপাশ কেমন গুমোট। ফারিহা আঁতকে ওঠল। ওমন অবস্থায় ছেলেটাকে কল্পণা ও করতে পারে না সে।
“রিহান স্যার, রিহান স্যার।”
রিহান উত্তর দিচ্ছে না। ও কাছে এসে বাহুতে স্পর্শ করল।
“কি অবস্থা করেছেন নিজের!”
রিহান কিছুটা মাতাল। সে তাকাল ঘোলাটে চোখে।
“ফারিহা?”
“আপনার কি হলো। কেন এমন ভে ঙে গেলেন।”
“আমার কিছু হয়েছে?”
উল্টো পাল্টা লাগছে সব। রিহানের হাত থেকে সিগারেট সরিয়ে দিল সে।
“উঠে আসুন।”
রিহানকে দু হাতে উঠানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখতে পেল ছেলেটার অন্য হাত থেকে র ক্ত ঝরছে। ফারিহার বুকের ভেতরটা অসম্ভব গতিতে কেঁপে উঠল। তার শরীরে ভীষণ আর্তনাদ।
“হায় আল্লাহ। কি করেছেন এটা।”
মেয়েটির আর্তনাদে নিজের যন্ত্রণা খুঁজে পেল রিহান। এত সময়ে সে কোনো যন্ত্রণাই বুঝতে পারে না। হাতের দিকে তাকিয়ে সে নিজেও ভরকে গেল। অনেকটা কে টে ছে। ফারিহার দু চোখে ভয়। ভীত হয়ে যাওয়া নয়নে সে উঠে দাঁড়াল। বাইরে থেকে গার্ডরা ডাকাডাকি করছে। ও দরজা খুলে দিতেই ভেতরে প্রবেশ করল। রিহানের অবস্থা দেখে ফারিহার উপর হা ম লা করতে গেল তারা। রিহান হাত দিয়ে বাঁধা দিল।
“যাও তোমরা।”
গার্ডরা চলে যেতে নিলে ফারিহা বলল,”প্লিজ একজন ডাক্তারকে কল করে দিবেন। ওনার হাত বেশ অনেকটা
কে টে ছে।”
গার্ডরা চলে গেল। ফারিহা সাধারণ উপায়ে র ক্ত থামাচ্ছে। তবে ক্ষ ত বেশি। কিছুতেই থামছে না।
“ঝরতে দাও।”
ফারিহা তোয়াক্কা করল না। সে নিজের মতো চেষ্টা চালাতে লাগল। মেয়েটির খুব খারাপ লাগা অনুভব হলো। রিহান তার জীবনে অনেক সাহায্য করেছে। যদিও বিনিময় জিনিসটা ছিল তবু রিহান ওর নিকট অনেক বেশি সম্মানের। ডাক্তার এসে চেকাপ করতে লাগলেন। ফারিহা ঠায় দাঁড়িয়ে। সিরিয়াস হয়ে সবটা শুনে চলেছে। বুঝার উপায় নেই মেয়েটি নিজেও মাতা বিয়োগের শোকে রয়েছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। ফারিহা খাবার এনে রাখল। রিহান কে জোর করেই কিছুটা খাওয়াল। ইষৎ শান্ত হয়েছে ছেলেটা। হয়ত কোনো মানুষের যত্নের আশাতেই ছিল। ফারিহা পুরো ঘর পরিষ্কার করতে লাগল। তার ফোন বেজে চললেও ধ্যান নেই। রিহান এক নজরে দেখতে দেখতে বলল,”তোমার মা হয়ত কল করেছেন।”
ধ্যান ফিরতেই ফারিহা বলল,”কি বললেন?”
“তোমার কল এসেছে। সন্ধ্যা হয়েছে, হয়ত তোমার মা কল করেছেন।”
ফারিহার ভীষণ কান্না পেল। সে কোনো মতে সেটা ঠেকিয়ে বলল,”মা তো নেই রিহান স্যার।”
এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল রিহান। সে যত দূর জেনেছে ফারিহার মায়ের চিকিৎসা পুরোপুরি হয়েছে। তা ছাড়া প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি টাকা ট্রান্সফার করেছে সে।
“মা নেই দুই মাস হলো। সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। তবে সৃষ্টিকর্তা বেশি দিন অবস্থান করতে দিলেন না। হুট করেই চলে গেলেন।”
রিহান একটু থমকে গেল। ফারিহা চোখের জল মুছে নিচ্ছে।
“সরি,তোমায় কষ্ট দিলাম। আমি আসলে জানতাম না।”
পুরো কথাটা এড়িয়ে নিয়ে ফারিহা বলল,”আপনার এ অবস্থা ভালো লাগছে না। নিজেকে সংযত করুন প্লিজ।”
“রাত হচ্ছে। ফিরে যাও। আমি কাউকে সাথে দিচ্ছি।”
ফারিহা কোনো জবাব ই দিল না। নিজের মতো কাজ করে চলেছে। রিহান দু চোখ বুজে নিল। মেয়েটির সাথে কত কিছু ঘটে গেল। তাদের দুজনের জীবনই কেমন ট্রাজেডিতে ভরা।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
পর্ব (২১)
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=330137336213834&id=100076527090739&mibextid=2JQ9oc