সঞ্চারিণী পর্ব -০১

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

১.

-‘এখানে কি বাচ্চাদের বার্থডে সেলিব্রেশন হচ্ছে?বলেছিলাম সব গ্রে কালারের বেলুন ঝুলাতে। কার আইডিয়াতে এসব পিংক,ব্লু কালারের বেলুন টাঙাচ্ছো তোমরা?স্টুপিডের দল!’

-‘সাহেব!নুহাশ ভাইয়া বলেছে যিনি নতুন ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার আসবেন উনি মেয়ে।আর মেয়েদের তো সবসময় গোলাপি,নীলই পছন্দ হয়।এটা আমি বলিনি।নুহাশ ভাইয়া বলেছেন।’

-‘শোনো!সে মেয়ে সেটা বুঝলাম।কিন্তু সে একজন অফিসার।একজন অফিসারের এমন রঙিন রঙ পছন্দ?জলদি এসব রঙ পাল্টে আমি যে রঙ বলছি সে রঙ ঝুলাও’

স্টাফদের বকাবকি করে গিয়াস রহিম তাদের অফিসের দালানটা একবার দেখে নিলেন।এখানে তার চাকরির বয়স বিশ বছর।তিনি একমাত্র সিনিয়র অফিসার।বাকিরা জুনিয়র।আজকে আরেকজন জুনিয়র আসছে।নাম মেধা আঞ্জুমান।ইন্টার্ভিউতে মেধার কথা বলার ধরণ এবং বুদ্ধিমত্তা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে ছিলেন।তার বিশ্বাস মেধা তার মেধা দিয়ে এই অফিসের নাম উজ্জ্বল করবে।
মুখে হাসি ফুটিয়ে তিনি সোজা গেলেন অফিসের ভেতরে।দূরের একটা কেবিনে নুহাশকে দেখা যায়।সে কন্ট্রোল রুমে বসে সিসি টিভি ফুটেজ দেখা বাদ দিয়ে সেই একই কম্পিউটারে গেমস খেলছে।তা দেখে গিয়াস রহিমের মেজাজ চড়ক গাছ।রেগে তিনি তেড়ে
গেলেন সেদিকে।রুমে প্রবেশ করে এক ধমক দিলেন নুহাশকে।
নুহাশ!!!!

-“এ্যাহ!!ইয়ে মানে হ্যাঁ!স্যার।গুড মর্নিং!’

-“তুমি কি করছো এখানে?’

-“বাহিরের কর্মচারীরা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সেসব দেখছি।আফটার অল আমার ডিউটি তো এটাও স্যার’

-“তুমি কি করছিলে তা বেশ ভালোমতন দেখছিলাম আমি।কাজে এত ফাঁকি কিভাবে দাও?আমি বুঝি না তুমি অফিসার পদটা কিভাবে পেলে!”

-“স্যার ভাইবা টিকে গেছিলাম অনায়াসেই’

-“সেটা আমার জীবনের তৃতীয় ভুল।তোমাকে একটা সহজ প্রশ্ন করেছিলাম।বাচ্চার ফিডারের ছিপি লক হয়ে গেলে বাচ্চা কিভাবে দুধ খাবে’

-“আর আমি বলেছিলাম তার মা থাকতে ফিডারের কি দরকার।হেহে’

-“নট সো ফানি।ডেকোরশেনের লোকদের ভুলভাল কাজ করতে দিছো কেন?মিস মেধা আসবেন আজকে।তাকে দেখে তোমার কি মনে হয়?সে গোলাপি,নীল বেলুন দেখে খুশি হবে?ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসারদের এগুলো দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়?স্টুপিড কোথাকার!!”

-“আমি তো উনাকে দেখিনি।তাই জানি না।আচ্ছা বলছি কালো বেলুন ঝুলাতে’

-“শাট আপ!শোক দিবস পালন হচ্ছে?আশ্চর্য!
আচ্ছা শাওন কোথায়?ওর তো দেরি হবার কথা না।তাহলে আজ এত দেরি কেন?’

-‘আজকে নতুন একটা কেস এসেছে।কাল রাতে রেদোয়ান চৌধুরীর রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছিল কিনা!’

-‘দেখেছিলাম নিউজে।বেচারা।তার বউকে যে তিনি মেরেছেন তার কথাও বলতে পারলাম না।কারণ বউকে সমেত সে নিজেই খুন হয়েছে।
তো সেই কেসটা আমাদের ঘাঁড়ে এসে পড়েছে নাকি?’

-‘জ্বি স্যার’

-‘শাওন কেসটাকে হাতে নিয়েছে নাকি আমাকে দেখতে হবে?দেখতে গেলেও কি।আমি তোমাদের উপরই দায়িত্বটা গছিয়ে দেবো।’
———
-‘কি মামণি??কেউ পাখা কেটে দিলো নাকি??
আহারে মামণিটার হাত ভাঙ্গা রে।ডানাকাটা পরী রে!!’

মেধা রিকশা পাচ্ছিল না বলে এই রোদের ভেতর হেঁটে যাচ্ছিল অফিসে।কিছু বখাটের কথা শুনে পেছনে তাকালো সে।
ছেলেগুলো দাঁত কেলিয়ে ওকে দেখছে।হাবভাব দেখে মনে হয় না শুধু ডিস্টার্ব করবে।হাতে স্টিলের ব্রেসলেট।নাকে বালি,ব্রুতে বালি,জিহ্বাতে বালি।উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর।তাছাড়া দেখে মনে হয় কোনো গ্যাংয়ের আওতাভুক্ত এই দল।

একজন তো বলেই দিলো আজ একে উঠানো যাক।হাত ভাঙ্গা! এক মোড়োই কাত হয়ে যাবে।
তার মানে আমার আগে আরও কজনকে উঠিয়েছে।হুমমম।অপহরণ কেস!
মেধা চুপ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।রাস্তার ওপাশে শাওন গাড়ী থামিয়ে নেমেছে সবে।ছেলেগুলো টিজিং করছে দেখে এগিয়ে আসছে সে।গাড়ীর ভেতরে থেকে দেখছিল সব।
আচ্ছামত ধোলায় দেবে।সে অর্ধেক পথ আসতে না আসতেই দেখলো মেয়েটা তার হাতে গান তাক করে ধরেছে ছেলেগুলোর দিকে।চেঁচিয়ে বললো,’আর একটু কাছে আসলে শুট করে দিব।চেনো আমাকে??’

মেয়েটার হাত কাঁপছে ভয়ানক ভাবে।শাওনের হাসি পেয়ে গেলো।মেয়েটার হাত এত কাঁপছে যে সে বখাটেগুলোকে গুলি না করে আরেকজনকে গুলি করে দেবে পাক্কা।শাওন এগিয়ে এসে ছেলেগুলোর দিকে একবার তাকাতেই ওরা ভৌ-দৌড় দিলো।শাওনকে চেনা আছে ওদের।মেধা দম ফেলে গানটা অনেক কষ্টে পকেটে পুরছে এবার।শাওন যেতে যেতে বললো,’ভীতুদের হাতে আবার কে যেন গান ছেড়ে দিয়েছে’

মেধা মাথা তুলে শাওনের গাড়ীটার সিল দেখে নিয়েছে।
মনে হচ্ছে তার অফিসেরই লোক।গানটাকে সুন্দর করে পকেটে রেখে বাঁকা হাসলো মেধা।মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বোকা হতে হয়।দূর্বল হতে হয়।আপনি বুঝবেন না অফিসার সাহেব!!!সময় হলে বুঝবেন।বুঝতে বুঝতে মরবেন।তলিয়ে যাবেন অতলে।
——
-“স্যার সেটা তো শাওন আসলেই বুঝতে পারবো।ঐ তো আসছে সে মনে হয়”

অফিসের বাকি কর্মচারী এগিয়ে এসে বললো,’-“গুড মর্নিং শাওন স্যার!”

-‘সুমন আই উইল কল ইউ ল্যাটার।একি!! আজ অফিস এমন সাজানো হচ্ছে কেন নুহাশ?গুড মর্নিং গিয়াস স্যার!”

-“গুড মর্নিং শাওন।কাল যে এত লেকচার দিলাম।তোমার মন কোথায় ছিল?’

-“স্যার কাল আপনি লেকচার দিয়েছিলেন?মনে আসছেনা তো’

-“কিভাবে মনে আসবে।ব্লু টুথ খুললে তো তো টের পাবা আমি প্যান প্যান করছি নাকি ঘ্যান ঘ্যান করছি”

-“সরি স্যার।”

-‘এই মনে হয় মেয়েটা এসে গেছে।’

-‘কোন মেয়েটা?’

শাওন পেছনে তাকিয়ে দেখলো কালো পোশাকে একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে।কালো শার্ট তার উপর দিয়ে কালো কোট।নাম তার মেধা আঞ্জুমান।আসছে এদিকেই।কে উনি আর কেন আসছেন তা জানেনা শাওন।তবে মনে হয় কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে হালকা ঝাপসা পরিচয় হয়েছিল।
তাকে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করলোনা সে।সোজা চলে গেলো তার কেবিনে।
মেধাকে সবাই চিনতে পেরেছে।কারণ তার পরনে অফিসেরই পোশাক।চুলে একটা জুটি করা।হাতে ছোট পার্স।আর ডান হাতে প্লাস্টার লাগানো।
এদিকেই আসছে সে।শাওন চোখ উল্টে কানে ব্লু টুথ লাগিয়ে অফিসের ভেতরে চলে গেছে ততক্ষণে।

-‘ওয়েলকাম মিস মেধা।কেমন আছেন?’

-“অল গুড।আপনি মিঃ গিয়াস রহিম রাইট?’

-“ইয়েস।প্লিজ কাম’

মেধা অফিসের ভেতরে ঢুকতেই শাওনকে দেখতে পেলো।শাওন তার কেবিনে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে গাল ফুলিয়ে।কেবিনের চারিদিকটাতে গ্লাস লাগানো তারপরেও ওকে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
মেধা চোখ নামিয়ে এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।মিঃ গিয়াস শাওনকে ডেকে পাঠালেন। ওর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য।
গিয়াস রহিম দেখলেন মেধার ডান হাত ভেঙ্গে গলায় জুলিয়ে রেখেছে। তার সেদিকে কোনো ভ্ররুক্ষেপ ও নেই। গিয়াস রহিম জিজ্ঞাসুচোখে মেধার দিকে তাকিয়ে বললেন,’তোমার হাত ভাঙ্গলো কি করে?আহারে!!অফিসের প্রথম দিনেই হাতটা ভেঙ্গে রেখেছো?’

শাওন এসে মেধার হাত ভাঙ্গা দেখে বললো,’-‘স্যার আমাকে বলবেন না যে হাত ভাঙ্গা এই মেয়েটা আজ থেকে আমার সহকারী অফিসার?’

-‘কেন?তোমার তাতে কোনো সমস্যা? ‘

-“একজন অফিসার হয়ে হাত ভেঙ্গে বসে আছে তাও প্রথমদিনে??আজকে যে রেদোয়ানের কেস এসেছে সেটা সামলাতে কত চড়াই উতরায়ে যেতে হবে তা কি উনি জানেন?তাছাড়া হামলাকারী যদি হামলা করে বসে তখন সে নিজের সেফটি দেবে কি করে?’

মেধা নিচের ঠোঁট উল্টে একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো,’হামলাকারী তো নিজেই মরে গেছে।আর কিসের টেনসনে শাওন স্যার!?’

-‘আপনার মতে রেদোয়ান হামলাকারী??’

-‘অবশ্যই।তিনি প্রথমে তার স্ত্রীকে মেরেছেন এবং তারপর আত্নহত্যা করেছেন।সিম্পল! একজন অফিসার হয়ে এটুকু বুঝে যাওয়া তো পানিভাত’

-‘ওটা আত্নহত্যা নাকি অন্যকিছু তা তো সেখানে গেলেই বুঝতে পারবো।সবাই রেডি হও।আর হ্যাঁ আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন।হাত ভাঙ্গা অফিসারকে নিয়ে গিয়ে আমরা বিপদে পড়তে চাইনা।আর উনার গান ধরার স্টাইল অনেক উইক।আরও ট্রেনিং নিতে হবে’

-‘আমার সেফটি আপনাকে দিতে হবেনা।।নিজের কাজে মন দেন।সহকারী কি বললেন?
আমিও আপনার মতনই অফিসার।আপনার পি.এ নই।’

-‘আহা মেধা মা।বোঝার চেষ্টা করো।সুস্থ হও।তারপর নাহয় আমাদের সঙ্গে কাজে হাত মেলাবে’

-‘সরি স্যার।এটা আমার ডিউটি।আমি তো যাবোই’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here