সঞ্চারিণী
আফনান লারা
২.
গিয়াস রহিমের অফিসে আলাদা করে একটা রুম আছে।যেখানে সবসময় মিটিং বসে।রুমটাতে শুরু থেকে শেষ অবধি টেবিল।তবে এটা গোল টেবিল।লম্বা না।কোনো কেস নিয়ে পূর্বপরিকল্পিনা করার হলেই এই রুমটার প্রয়োজন পড়ে।সচরাচর এর দরজা বন্ধই থাকে।পরিচ্ছন্নতা কর্মী কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে এই রুমটা ধোয়া মোছা করে।কে জানে কবে মিটিংয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে বসে।
চেয়ার একটা ব্যাঁকা হয়ে থাকলে গিয়াস রহিম অনেক রেগে যান।তিনি এসব ব্যাপারে স্ট্রিক্ট। তার ভয়ে কর্মীরা কাজ ঠিকঠাক চালু রাখে সকাল বিকাল।
তো মিস্টার রেদোয়ানের এবং তার স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর রহস্যর উদগাটন করতে আজ এই রুমে মিটিং বসবে পরিচ্ছনতা কর্মী রফিক কথাটা শুনে গিয়াস রহিমের ভয়ে চুপিচুপি গিয়ে আরও একবার দেখে এসেছে, রুমের সব ঠিক আছে কিনা
সে বেরিয়ে আসার দশ মিনিট পর ঐ রুমে ঢুকে সবাই যার যার চেয়ার টেনে বসে পড়লো।
শুধু শাওন চেয়ারে বসলো না।সে কখনই বসেনা।গিয়াস রহিম এই অফিসে তার পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন একমাত্র শাওনকে।শাওন এই অফিসে জয়েন হয়েছে পাঁচবছর হলো।এই কটা বছরে সে গিয়াস রহিমের মন জয় করতে সক্ষম। গিয়াস রহিমকে নিজের বাবার চোখে দেখে সে।তিনিও শাওনকে তার ছেলে ভেবে মাঝে মাঝে বকেন আবার বুকে টেনে নেন।বলতে গেলে আপন মানুষ হয়ে গেছে সে এখন।
সবাই শাওনের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেও মেধা তার পাশে বসে থাকা নিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।ইচ্ছে করেই।শাওনের দিকে তাকাবে না সেটা ঠিক করে রেখেছে।
শাওনের রাগ হলো।টেবিলে হাত রেখে নিচু হয়ে সে বললো,’নিউজে নিশ্চয় দেখাচ্ছে মিস্টার রেদোয়ানের এবং তার স্ত্রীর খুনের কথা। বাট!আমরা নিউজ দেখবোনা।আমরা দেখবো সেখানে গিয়ে।স্বচক্ষে। নিউজের আগে নিজের চোখকে বিশ্বাস করা জরুরি।আজকে মিঃ রেদোয়ানের বাসায় আমার সঙ্গে নুহাশ,নিতু এবং রায়হান যাবে।মিস মেধা আগামীকাল যাবে।আজ তাকে আমি নিতে পারছিনা সরি’
কথা শেষ করে শাওন টেবিল থেকে হাত সরিয়ে উল্টো পথে চলে গেলো।আর এক মূহুর্তও দাঁড়ালো না সেখানে।না কারোর মতামত নিলো।
মেধার প্রচুর রাগ হচ্ছে।সবাই এক এক করে শাওনের পিছু পিছু চলে গেলো মিনিট পরেই।
-“বস কি গিয়াস স্যার নাকি এই শ্যাওলা স্যার?আমাকে দেখে উইক মনে হয়?আমি এক শুটে দুটোকে কুপোকাত করতে পারি।চেনে আমাকে?হুদাই কি অফিসার পদটা নিতে পেয়েছি?নিজের ক্ষমতা দেখাতে পারছিনা কারণ পার্সোনাল দূর্বলতা আছে।সিক্রেট ওটা।তাই বলে এভাবে রাগ ওঠাবে?মন চাচ্ছে তারে এক শুটে মাথার খুলি উড়িয়ে দেই।’
রেগে মেধা টেবিলে একটা বাড়ি দিতেই উল্টে প্লাস্টারের সঙ্গে জোরে বাড়ি খেয়ে ব্যাথা পেয়ে মাথা মুড়িয়ে নিয়েছে।
গিয়াস স্যার বললেন বাসায় ফিরে যেতে।
মেধা মুখটা গম্ভীর করে অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ক্যাব বুক করলো।রিকশা খোঁজার মন মানসিকতা নাই।
বাসায় পৌঁছাতে আধঘন্টা লাগবে।বেশিদূর না।জ্যাম ধরেই যত সময় বরবাদ করে।নিউমার্কেটের সামনে যে জ্যাম।এ জ্যাম চাইলে সারাদিন একটা মানুষকে ঐ জায়গাতেই বসিয়ে রাখতে পারবে।হেঁটে যাওয়ার আলসেমি থেকে বাঁচতে বসে থাকার প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে হয়।বাসায় মেধা,তার বাবা মা আর একটা ছোটবোন থাকে।ছোট একটা পরিবার তাদের।বাসায় ফেরার কথা মনে আসলেই শত শত রাগ অভিমান,ক্লান্তি ধুয়ে মুছে বিলিন হয়ে যায় তার।
——–
-‘ঢাকা শহরের শুরুতেই বিশাল আয়তনের একটা বাড়ি মিঃ রেদোয়ানের।বিশালকেও হার মানাবে।মিঃ রেদোয়ান তার সব কিছু মনে হয় এই বাড়ির পেছনেই ইনভেস্ট করেছেন।আহারে!শেষে বেচারা মরেই গেলো।দুঃখজনক!
সাথে তার ওয়াইফ ও মরলো,দুঃখজনক হোল স্কয়ার।কে খাবে এত সম্পত্তি?
আচ্ছা সম্পত্তির জন্য মারলোনা তো শাওন?’
নুহাশের কথা শুনে শাওন বাড়িটা দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকে গেছে।ভেতরে ঢোকার আগে নজরে পড়েছিল গ্লাস ভাঙ্গা।সেটা পরে দেখা যাবে আগে ভেতরে দেখতে হবে।বাসার ভেতর দুজন গার্ড দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।আর পাহারে দিয়ে কি হবে?
-‘শাওন শুনতে পাচ্ছো?সম্পত্তি টপিক হতে পারে।ভেবে দেখো।এটা তো কমন আজকাল’
শাওন নুহাশের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,’মিঃরেদোয়ান বিয়ে করেছে কটা বছর হলো।তার বেবি নাই।সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে চাইবেটা কে?আমাকে বোঝাও’
নুহাশ মুখে আঙ্গুল দিয়ে ঐ জায়গা থেকে কেটে পড়েছে।একেবারে রায়হানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে।
ড্রয়িং রুম জুড়ে বিশাল বিশাল সোফা।এক বিন্দু জায়গা খালি রাখেনি সব জায়গায় সোফা বসানো।তার মাঝের সেন্টার টেবিলটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে আছে।শুধু কালো কালো পাতের পিলার দাঁড়িয়ে আছে সেটার।কাঁচ একেবারে শেষ।একটা বড় টুকরো ও পাওয়া যাবেনা।তার পাশেই টাইলসে লাল মার্কার দিকে মার্ক করা,লেখা মিসেস রেদোয়ান।মানে ওখানে মিসেস রেদোয়ানের ডেথ হয়েছে।
রায়হান হাত ভাঁজ করে বললো,’খুনি তাকে সেন্টার টেবিলে ছুঁড়ে মেরেছে?আচ্ছা তা নাহয় বুঝলাম
বাট মিঃ রেদোয়ান মরলো কি করে?গলায় ফাঁস দিয়ে?’
নুহাশ সিঁড়ি দেখে এসে বললো,’নাহ।সিঁড়ি থেকে পড়ে।মার্ক করা সিঁড়ির নিচে’
শাওন নুহাশের দিকে তাকিয়ে ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বললো,’তো মিস অতিরিক্ত যে বললেন আত্নহত্যার কেস এটা?’
-“মিস অতিরিক্ত কে আবার?’
-“ঐ যে আজ আসলো না।মিস মেধা।আমাদের অফিসের অতিরিক্ত অফিসার’
-“সে তো আন্দাজে বলেছে।তুমি তোমার কাজ করো।আমি দেখি ফ্রিজে কি আছে’
রায়হান ব্র কুঁচকে তাকালো ওর দিকে।
নুহাশ দাঁত কেলিয়ে বললো,’ফুড থেকেও তো বিষক্রিয়া হতে পারে তাই না?একজন অফিসার হিসেবে আমার উচিত সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা।’
রায়হান নুহাশের ঘাড়ে হাত রেখে বললো,’ঐ খাবার আবার তুমি টেস্ট করতে যেওনা।যদি তোমার মাঝেও বিষক্রিয়া হয়।তখন তো এই বাড়িতে খুন নাম্বার ৩ ঘটে যাবে’
নুহাশ ভেংচি কেটে দোতলার দিকে চলে গেলো।
শাওন সেন্টার টেবিলটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সেন্টার টেবিলটার কোণার দিকে একেবারে এক শটে ভেঙ্গেছে।মানে কোণাতে কাঁচের ছিঁটেফোটাও নেই।একটা মানুষকে সেন্টার টেবিলের দিকে জোরে ধাক্কা দিলে মানুষের ভারে পুরো সেন্টার টেবিলটা ভেঙ্গে যাওয়া উচিত বাট হালকা ঝাপসা কাঁচ অবশিষ্ট রেখে।নতুবা কোণা দিয়েনকিছু কাঁচ অবশিষ্ট থাকার কতা।একেবারে কোণাতে কাঁচের ছিঁটেফোটা উধাও হওয়া তো ভাবাচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে শাওন সোফায় গিয়ে বসলো।এই হলো এক দোষ। যখন ঘটনাটা ঘটে তখন আমাদের ডাকেনা।ডাকে একদিন পর।একদিন পর লাশ ছাড়া এসব দেখে কিছু বোঝা যায় নাকি।মাথা খাটাতে হবে।আমি সিওর মিসেস রেদোয়ানকে টেবিলে ছুঁড়ে মারা হয়নি।এত সহজে কেউ মারবেনা।তাহলে তাকে হত্যা করা হলো কিভাবে?
আমাদের জন্য সহজ হবে তাদের দুজনের শত্রু কে আগে তা খুঁজে বের করা।কারণ অপরিচিত মানুষ এসে খুন করবেনা।যতদূর জানি তারা বাসায় সোনা, রুপা, টাকা কিছুই রাখতেন না।যা রাখতেন তার সব ব্যাংকে।এমনকি তারা না গেলে ঐ ব্যাংকের টাকা অন্য পরিচয়ে কিংবা চেক নিলেও দেওয়া হতোনা।যে খুন করেছে সে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে গেছে। সেলিব্রেটিদের খুন করা মানে হাতেনাতে ধরা খাওয়া।ঐ খুনিকে ধরতে আমার এক মাস ও লাগবেনা।
এসব ভেবে শাওন উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে অন্য রুমের দিকে চললো।সোফার রুম থেকে লম্বা করিডোর একটা গিয়ে শেষ হয় গেস্ট রুমে।সেখান অবধি পাঁচটা বড় আকারের ফুলদানি লাইন বাই লাইন সাজিয়ে রাখা।দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে। একেবারে গেস্ট রুমের দরজা পর্যন্ত।একটাতে ল্যাভেন্ডার, অন্যগুলোতে অর্কিড,জার্বেরা,গ্লাডিওলাস,আইরিশ।
সব দেখি বিদেশী ফুল।বেটা তার সব টাকা মনে হয় প্রতিদিন এই ফুলদানি সাজাতে ব্যয় করত।
আইরিশ তো ইউরোপ,এশিয়ার ফুল।বড়লোক হলে মানুষের কত কি না মন চায় হায়রে!!এক মিনিট!ফুলদানির সারি ওলটপালট মনে হচ্ছে।’
শাওন বিষয়টা লক্ষ করে থামলো।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো পাঁচটা ফুলদানি কেন?থাকলে ছয়টা থাকার কথা।পাঁচটা তো কোনো সিকুয়েন্স নাহ।
রায়হান আমার জন্য মিজারিং টুলস নিয়ে আসো।
রায়হান এগিয়ে এসে পকেট থেকে মিজারিং টুলস বের করে শাওনের হাতে দিলো।শাওন পাঁচটা ফুলদানির একেকটা থেকে একেকটার দূরত্ব মাপলো নিচে বসে বসে।
এরপর মিজারিং টুলটা রায়হানের হাতে দিয়ে বললো,’ প্রতি পাঁচমিটারে একটা করে ফুলদানি বসানো তাহলে দুইটা ফুলদানির মাঝের দূরত্ব কেন চার করে বাড়লো? তার মানে এখান থেকে একটা ফুলদানি সরানো হয়েছে।সেম দেখতে ফুলদানি!!
তাহলে ঐ ফুলদানিটা কোথায় এখন?খুঁজে বের করো।আই গেস ওটা দিয়েই মিসেস রেদোয়ানকে মারা হয়েছে।ওটা যদি একবার পাই।ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়ে যাবো সহজেই।টিপস হলো ঐ ফুলদানিটাতে বিদেশি ফুল থাকবে, আমি একশো পার্সেন্ট সিওর।পুরো বাসা খুঁজে দেখো কোনো বিদেশী ফুল পাও কিনা।একটা পাতা পেলেও সেটা নজরের বাহিরে নিবা না।আমার কাছে নিয়ে আসবে।পাতা থেকে ও ফুলের নাম,বংশ পরিচয় বের করা যায়।আমি সিওর হতে হবে এখানে ছয়টা ফুলদানি ছিল।এত বড় ফুলদানি দিয়ে আঘাত করলে যে কেউ মরবে।এই বাসার থেকে একটু কম দূরত্বে একটা কার রিপেয়ারিং শপ আছে।ওখানে লোহার ওজন মাপার মেশিন দেখেছিলাম।ঐ দুটো গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে ঐ মেশিন নিয়ে আসো’
-‘কেন স্যার?’
-‘এই ফুলদানি মাপবো’
-‘স্যার আমরা এক কাজ করি এই ফুলদানি নিয়ে যাই?সেটা তাহলে ইজি হবে’
শাওন মুচকি হেসে পিছিয়ে সিঁড়ির রেলিংয়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে বললো,’নিতে পারলে নাও।দেখি আমি’
রায়হান তার কালো কোটটা খুলে শার্টের হাতা উঠিয়ে নিচু হয়ে ফুলদানিটা ধরে শুয়ে পড়লো একেবারে তাও এক বিন্দু নাড়াতে পারলো না।মাথা চুলকে গার্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,’তোমরা হাসতেছো কেন?আসো আমায় হেল্প করো’
গার্ডগুলো ছুটে এসে রায়হানের সঙ্গে ফুলদানি টানতে লাগলো।তারা তিনজনে হয়রান হয়ে শাওনের দিলে তাকালো।শাওন হাতের ঘড়ি চেক করে বললো,’জলদি যে টাস্ক দিছি তা কমপ্লিট করো।আমার হাতে সময় কম।এখনও উপরের তলা দেখা বাকি।’
রায়হান ঘাম মুছতে মুছতে চলে গেলো।
এই ফুলদানি উঠিয়ে মেশিনে রাখতে আমাদের টিমের সবগুলো লোককে লাগবে।
চলবে♥
Afnan Lara