সঞ্চারিণী পর্ব -০৫

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

৫.
রশ্নি হাত বাড়িয়ে অশ্রুসিক্ত শাওনের চোখজোড়া মুছে দিয়েছে।তারপর নিচের ফুলটার দিকে তাকিয়েই তাচ্ছিল্য করে হেসে ফেললো সে।শাওনের রাগ হলো।খুব রাগ হলো।
তার কপালের রেখায় রেখায় বাঁকাভাব ফুটে উঠেছে।নাক লাল হয়ে গেছে।
কেন রশ্নি হাসছে?আমি কাঁদছি তাহলে সে কেন হাসছে?সে কি আমার প্রশ্নের জবাবে সবসময় এভাবে হেসেই উড়িয়ে দেবে?সে কি বোঝে না আমি তাকে নিয়ে সিরিয়াস?
এই ভেবে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো সে।রশ্নির তারপরেও হাসি পাচ্ছে।শাওনের রাগ ভাঙ্গানো উচিত বলে মনে করে
হাসি থামিয়ে শাওনের সামনে এসে বললো’ফুলটাকে মেরে দিবো?তাহলে ভালো লাগবে?’

শাওন মুখ ঘুরিয়ে বারান্দা থেকে চলে আসলো।
রশ্নির জানা আছে।শাওন এখন চাদর মুড়িয়ে কড়া ঘুম দিবে।একেবারে পরেরদিন সকালে চোখ খুলে তাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আবার।শাওনের রাগ নাকের আগায় থাকে।আর সেই রাগ চোখের পলকে কিংবা এক রাত পার হলেই দমে যায়।এটার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই।শাওনের রাগ করা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি ভালোবাসাটাকে আরও ঘাড়ো করতে রাগ করে বসে থাকে।
আসলে সহজ কথা হলো,একটা সম্পর্কে রাগ ভাঙ্গন সৃষ্টি করেনা সবসময়।মাঝে মধ্যমে এটা সেই সম্পর্কটাকে আরও মজবুত করে তোলে।আপনি পাগল হয়ে যাবেন সম্পর্কটার নেশায় আবদ্ধ হতে।শাওন এখন তাই করছে।সে আমায় তার প্রতি আরও আসক্ত করে তুলছে।
________

-‘ঐদিন হাত ভেঙ্গেছিলি আর আজ মাথাও ফাটিয়েছিস?তোকে কে বলেছে অফিসার হতে?’

-‘তোমরাই বলেছিলে।বাবার আদর্শ পালন করছি।ভুলে যাবা না আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার।এখনও রিটায়ার্ড হয়নি।আর আমি কিন্তু অফিসার হওয়ার আগেই হাত ভেঙ্গেছিলাম এটা আর ওটা এক না।’

-“একই।অফিস অফিস করে করেই তো হাত ভেঙ্গেছিলি।এখন আবার কপালে কি হলো তোর?’

-‘ও কিছুনা।জলদি খাবার রেডি করো।খুব খিধে পেয়েছে আমার।’

মা চলে যেতেই মেধার ছোট বোন মৌমিতা এসে হাজির ওর কাছে।ক্লাস টু তে পড়ে সে।মেধা ওর চুলগুলোকে গুছিয়ে দিয়ে বললো,’কই ছিলি এতক্ষণ? ‘

-‘মটু পাতলু দেখছি।তুমি দেখবেনা?’

-‘দেখবো তো।আপু ফ্রেশ হয়ে আসি?তুই যা টিভি দেখ’

মৌমিতা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।মেয়েটা বড্ড সহজ সরল।অবশ্য বাচ্চারা হয়ই সহজ সরল।তাদের মুখে যেমন মায়া, মনেও তেমন মায়া।আগে বাসায় ফিরলেই তাকিয়ে থাকতো যতক্ষণ না ব্যাগ থেকে ক্যাটবেরি বের করে তার হাতে দিতাম।
আর এখন কদিন হলো সে আর চকলেটই চায় না।দূর থেকে উঁকি মেরে দেখে আবার চলে যায়।কারণটা মা বলেছিলো আমায়।আমি হেসেছিলাম তার ভাবনার কথা শুনে।এক হাত ভাঙ্গা বলে আমি নাকি চকলেট কিনে ব্যাগে পুরতে পারবোনা তাই সে আর চকলেট চায়না।আজ ভুলে গিয়েছিলাম কাজের চাপে।নাহলে আমি তার জন্য চকলেট আনতে ভুলিনা।’

মৌমিতার কথা ভাবতে ভাবতে গায়ের কালো কোটটা অনেক কষ্টে খুলছে সে।হাতের ব্যাথাটা তাজা এখনও।এই তো ঐদিনই হাতে চোট পেয়েছিলো।
প্রচুর ব্যাথা হয়েছিলো তখন।প্রচুররররর
চুলগুলোকে ক্লিপ দিয়ে বন্দি করে অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়েছে মেধা।হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুয়ে থেকেই পায়ের উপর পা তুলো বললো,’আমার নাকি হাত কাঁপে শুট করতে।আমি কোনো কাজের না।আহারে!আফসোস হয় তাদের উপর যারা আমার বাহ্যিক রুপ দেখে সিওর হয় আসলে আমি নামক মানুষটার ক্ষমতা কতদূর।সে জানেও না মেধা কি জিনিস।অবশ্য কখনও জানবেও না।সারাজীবন ভীতূর ডিম মেধাকেই চিনবে তারা।এর পেছনে লুকিয়ে আছে যে সঞ্চারিণী তাকে সঞ্চার করা ওদের কারোর কাম্য নয়।স্পেশালি মিঃ শাওনের।ঐ লোকটার এমনিতেও মাথার তার ছিঁড়া।আমার ক্ষমতা জানতে তাকে নজর রাখতে হবে আপকামিং ক্রাইম স্পটে।সে বুঝবে এটা এক সঞ্চারিণীর কাজ,তবে সে জানবেনা এটা কোন সঞ্চারিণীর কাজ।সঞ্চারিণীরা নাম দিয়ে বেড়ায়না।তাদের পদবি তারা সঞ্চারিণী’

-‘মেধা দেখ তো কে এসেছে।তোর বাবা কিনা গিয়ে দেখ।মৌমিতা দরজার নাগাল পাবেনা।আমার হাতে ডিম লেগেছে’

মেধা উঠে গেলো দরজা খুলতে।চেক না করেই খুলে ফেললো আজ।দরজার ওপারে কেউ নেই।ভ্রু কুঁচকে মেধা বাহিরে বেরিয়ে করিডোরের দুপাশে তাকালো তাও সব ফাঁকা দেখে পুনরায় বাসায় ঢুকে দরজা লাগাতে যেতেই খুব জোরে একটা ধাক্কায় ছিটকে ফ্লোরে গিয়ে পড়লো সে।হাতের ব্যাথাটা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেছে।মনে হয় হাত আলগা হয়ে গেলো বুঝি।
অন্য হাত দিয়ে হাতটা চেপে মাথা তুলে দেখলো তিনজন এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে।সবার মুখে মাস্ক লাগানো।দুটো চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না।
গান তাক করে রেখেছে মেধার দিকে।মৌমিতা অপরিচিত মানুষ দেখে চিৎকার করে বসলো।একটা লোক এগিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরে অন্য রুমে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে বাহিরে দিয়ে লক করে আবার মেধার সামনে এসে দাঁড়ালো।মৌমিতার আওয়াজে মা ছুটে এসে এসব দেখে তিনিও চিৎকার করতে গিয়েও পারলেন না।মেধা ঠিক হয়ে বসে বললো,’আমার মায়ের কপাল থেকে গান সরাও’

লোকটা গান সরিয়ে ইশারা করলো একজনকে।সে মৌমিতা যে রুমে আছে ঐরুমে মাকেও রেখে এসে বাহিরে দিয়ে আবার দরজা লাগিয়ে ফেললো।

-‘কে তোমরা?আদৌ জানো আমি কে?’

-‘তুমি কে সেটা আমাদের জানার বিষয় না।
আমাদের জানার বিষয় হলো যে ক্লিপটা তোমার কাছে আছে সেটা ফেরত দাও।নাহলে আজ তোমার পুরো পরিবার শহীদ হবে।’

লোকটা থুঁতনিতে হাত রেখে দাঁত কেলিয়ে আবারও বললো,’আর তোমাকে আমরা এমনি এমনি মারবো না।এত সুন্দর জিনিসকে কি আর সোজাসুজিভাবে মারা যায়??’

মেধা পকেটে চাপ দিয়ে টের পেলো ওটাতে গান নেই।তখন কোট খুলেছিল অফিস থেকে ফিরে।কোটের ভেতর গানটা ছিল।উপায় না পেয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে এখন।
লোকটা গান মেধার কপালে ঠেকিয়ে ধরে বললো,’কাজ শুরু করবো নাকি ক্লিপ দিয়ে দিবা?’

মেধা তার পায়ে হাত দিয়েছে।পায়ের টাকনুর কাছাকাছিতে তার গান আরেকটা থাকে প্যান্টের নিচের ভাগে যার কারণে দেখা যায়না।ভাগ্যক্রমে তখন সেটা খুলে রাখেনি সে।লোকটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।এরপর পায়ের থেকে গান নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কপালে তাক করে বললো,’ওদের সবাইকে বলো গান নিচে নামাতে।নাহলে তোমায় আমি শুট করবো।আর এটাও খুব ভালো করে জানি যে তোমরা আমায় মারবেনা।আমায় মারলে ক্লিপ পাবে কি করে?
বুঝলে,ট্রেনিং করার সময় ভুলে কজনের গায়ে সত্যি সত্যি গুলি মেরে দিয়েছিলাম।আশেপাশে হসপিটাল ছিল বলে তারা বেঁচে গিয়েছিলো।কিন্তু আমার বাসার আশেপাশে তো দূরে থাক,দূর দূরান্তেও এমন হসপিটাল নেই যেখানের ডাক্তার গুলি উঠিয়ে সারিয়ে তুলতে পারবে তোমায়।
আর এখন তো ট্রেনিং শেষে একেবারে পাকাপোক্ত অফিসার হয়েছি।কিন্তু এবারও যদি ভুল হয় তাও মরবা।আর ভুল নাহলেও মরবা।’

লোকগুলোর মধ্যে প্রধান যে আছে তার আদেশের অপেক্ষা করছে বাকিরা।মেধা গানটা আরও জোরে চেপে ধরে বললো,’সুন্দর করে মারার কথা ছিল না?আমিও তোমায় খুব সুন্দর করে মারবো।শুধু ছেলেরা মেয়েদের টর্চার করে মারবে কেন।মেয়েরাও টর্চার করুক।থ্যাংক গড বাবা কাল অনেকগুলো মোমবাতি কিনে এনেছিলো।টর্চারের সূচনা পর্ব ওটা দিয়েই শুরু হোক?’
——
-‘রশ্নি শুনতে পাও??রশ্নি?’

শাওন শোয়া উঠে বসে দেখলো রশ্নি নেই কোথাও।
-‘কই গেলো মেয়েটা।আমি অভিমান করেছি বলে সে উল্টে অভিমান করেনি তো?’

বিছানা ছেড়ে নেমে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বারান্দার পর্দা টেনে ফেললো শাওন।সকাল সকাল তার রুমের পর্দা সরানো মোটেও পছন্দ না তার।কেউ তার অপছন্দের এই কাজটা ভুলেও করেনা।
তাহলে আজ কে করলো এমনটা।চোখ টনটন করছে।সবেমাত্র ঘুম থেকে ওঠা চোখ আমার।শুরুতেই এত আলো সহ্য হয় নাকি।রশ্নি কই তুমি?
পর্দা তুমি সরালে?
শাওনের মুখের বুলি আটকে গেলো।রশ্নি কিভাবে সরাবে।রশ্নি কি তাহলে ফিরে এসেছে?
মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে শাওন রুম থেকে বের হতেই বাবার মুখোমুখি হলো।বাবা ওর ঘাড়ে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললেন,’কি হলো শাওন?ভয় টয় পেলো নাকি?ওহ হ্যাঁ আজ তো আমি তোমার রুমের পর্দার সরালাম।বাবা তোমার অপছন্দের কাজ করে ফেলেছি।এখন কি বকবে?’

শাওন হাসার চেষ্টা করে বললো,’নাহ।আচ্ছা!আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।একসাথে নাস্তা করবো’

বাবার চোখের সামনে থেকে সরে শাওন রুমে আসতেই ফোন বেজে উঠলো তার।রায়হানের কল।
সে জানালো একটা গ্যাংয়ের তিন সদস্য হাতে পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েছে কাল রাতে।তাদের সবাইকে কে গুলি করেছে বলতে পারছেনা কেউই।শুধু মমমম করছে।’

-‘মমম?ট্রমা ছাড়ুক।নাম বলে দেবে।বাট আমাকে জানাচ্ছো কেন এসব?’

-‘ঐ গ্যাংটাকে ধরতে মাস খানেক আগে আমরা অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলাম স্যার।মনে আছে?একেবারে নেত্রকোনা’

শাওন কপাল টিপে ধরে বললো,’হ্যাঁ মনে পড়েছে।লিয়াকতের গ্যাং না ওটা?ব্রাভো!!ঐ তিনটাকে গার্ড দিয়ে পাহারা দাও।কান টানলে মাথা ঠিক চলে আসবে’

মুচকি হেসে ফোন রেখে শাওন ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে দেখতে পেলো রশ্নিকে।শাওনের শখের গাঁদা ফুলগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচে বসে আছে সে।শাওন কাছে এসে বললো,’এতবার ডাকলাম।শুনলেনা?’

রশ্নি মাথা তুলে বললো,’তোমাদের বাসায় আজ একটা পরিবার আসবে’

-“জানি।তৃনা আপুর হবু শ্বশুর বাড়ির লোক’

-‘হুম।কিন্তু তুমি কি জানো?তৃনা আপার হবু বরের ছোট বোন তোমায় পছন্দ করে।তোমার বাবা চায় তার সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা আলাপ জমাতে।এবং সেটা আজকেই।আর….’

শাওন রশ্নির হাত ধরে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,’তোমাকে না বললাম আমার রুম ছেড়ে কোথাও যাবেনা?কথা শোনো না কেন?যেটা দেখলে মন খারাপ হয় সেটা জেনেবুঝে দেখতে যাও কেন?’

রশ্নি শাওনের দুহাত মুঠোবন্দি করে ধরে বললো,’প্লিজ শাওন।এবার বিয়েটা করে ফেলো।তোমায় সুখে দেখলে আমারও শান্তি লাগবে’

-‘না লাগবেনা।কাল মেধার হাত ধরায় তোমার চাহনি আমি দেখেছিলাম।আমি জেনেশুনে তোমায় কষ্ট দিতে পারিনা।সরি!’
চলবে♥
Afnan Lara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here